মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-২৬+২৭

0
548

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৬

🍁
নিশুতি রাত, শান্ত শীতল পৃথিবী। হৈ হুল্লোড় নেই কোথাও। হঠাৎ দুই একটা গাড়ির হর্ণ বাজছে, আবার কখনও বা শোনা যাচ্ছে ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া পাখির কিচিরমিচির ডাক।
পাঁচ তলায় অবস্থিত এক ব’দ্ধ রুমের নিকষ কালো আঁধারে দুটো চোখ তাকিয়ে আছে সম্মুখে। বিশাল আকাশে জ্ব/লজ্ব/ল করে জ্ব/লতে থাকা থালার মতো মস্ত বড় চাঁদের কিঞ্চিৎ আলো খোলা জানালা ভেদ করে পর্দার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঢুকে মীরার কপাল থেকে থুতনিতে তীর্যক ভাবে লেপ্টে আছে৷ সদ্য নববধূ তার গালের নিচে মেহেদী রাঙা হাত রেখে বিভর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মাথায় পেঁচানো শাড়ির আঁচল টা সরে গিয়ে বালিশের উপর পরে আছে। খোঁপা করে রাখা চুল বাঁধন ছেড়ে চোখ স্পর্শ করে গালের উপর লেপ্টে আছে। মাথার উপর ভনভন করে চলা ফ্যানের বাতাসে মৃদু উড়ছে সেগুলো। গায়ের উপর পাতলা কাঁথা জড়িয়ে আরাম করেই ঘুম দিয়েছে মীরা। এই শহরের সবাই হয়তো মীরার মতোই গভীর নিদ্রায় কিন্তু নিদ্রাবিহীন শুধু তার পাশে শুয়ে থাকা পুরুষটি। চোখ সয়ে যাওয়া অন্ধকার রুমে কাত হয়ে এক হাতের উপর ভর দিয়ে মুগ্ধ নয়নে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইফ। পলক ফেলছে অনেক ক্ষণ পর পর। মীরার শরীর থেকে আসা বেলীফুলের মেয়েলি সুবাস নিঃশ্বাসের সাথে সুগভীর ভাবে গ্রহণ করছে সে।

রাইফের সাথে ঘুমানোর আগে মীরার মাঝে ভীষণ সংকোচ কাজ করছিলো। মীরার আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া অবস্থা দেখে রাইফ আর তাকে খুব একটা ঘাটে নি তখন। নাজুক মীরাকে তার ব্যাক্তিগত বিছানা ছেড়ে দিয়ে ঘুমাতে বলে কাজের বাহানা দিয়ে চলে গিয়েছিল বাহিরে। মীরা দুরুদুরু মনে খাটের এক কোণায় শুয়ে পড়েছিলো রাইফের কথা মতো। সারাদিনের ধকল শেষে ক্লান্ত মীরা গা এলিয়ে দিয়েছিলো রাইফের নরম বিছানায়। শোয়ার সাথে সাথেই সেই পরিচিত ঘ্রাণ হালকা হালকা অনুভব করছিলো মীরা। পাবেই বা না কেনো? যেখানে সেই ঘ্রাণের ব্যাক্তিটির ই বসবাস, সেখানে ঘ্রাণের ছোঁয়া থাকাটাই তো স্বাভাবিক। অতিরিক্ত কান্নার ফলে ফোলা ফোলা চোখ দুটো জ্ব/লছিলো মীরার। ক্লান্তিকর চোখ বুজে জেগে থাকা মীরা ঘুমের দেশে যে কখন পাড়ি জমিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। রাইফ পাঁচ-সাত মিনিট পরেই যখন উঁকি দিয়েছিলো রুমে, মীরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে অবাক হয়েছিলো বেশ। এতো অল্প সময়েই কেউ গভীর নিদ্রায় কিভাবে যেতে পারে? তাও আবার বাসর রাতে?
বিছানার কাছাকাছি এসে একটা বালিশ দূরত্ব রেখে মীরার পাশে রাখা দেখে মুচকি হেসেছিলো রাইফ। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করেছিলো তখন। মীরা যে রাইফের জন্য বিছানায় জায়গা রেখে ঘুমিয়েছে তা বুঝতে বাকি রইলো না তার। ফুটফুটে মেয়েটার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখাবয়ব অনেক ক্ষণ দেখার ইচ্ছা থাকলেও লাইট টা অফ করে দিয়েছিলো যেনো মীরার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

টিকটিক করে চলা দেয়াল ঘড়িটা শব্দ করে জানান দিলো এখন রাত্রী তিনটা। মৃদু শব্দ কানে যেতেই মীরা নড়েচড়ে উঠলো কিছুটা। রাইফের ধ্যান ভা/ঙলো। অন্ধকারেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলো অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমানো উচিত তার। মীরা এখন তার অর্ধাঙ্গিনী, জীবনসঙ্গী। রাইফের জীবনের সাথে ওৎপৎ ভাবে জড়িয়ে গেছে সে। সারাটা জীবন এভাবেই পাশাপাশি থাকবে তারা। কাল দিনের আলোয় দেখা যাবে ভেবে দুচোখের পাতা এক করলো ঘুমানোর উদ্দেশ্য। নাহ, কিছুতেই ঘুম আসছে না রাইফের। বালিশ টা মীরার দিকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে সে নিজেও সামনে আগালো, মীরার কাছাকাছি এলো কিছুটা। রাইফের শ/ক্তপো/ক্ত হাতটা চুপিসারে মীরার মেহেদী রাঙা কোমল হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। ছোট্ট হাত টা রাইফের হাতের তালুতে আব/দ্ধ করে বুকের কাছে টেনে নিলো। নির্ঘুম দু চোখ কে রেহাই দিয়ে চোখ বুজলো রাইফ। মীরার দেখা পাওয়ার পর থেকেই শান্তির ঘুম উড়ে গিয়েছিলো তার চোখ হতে। চোখ বুজলেই মীরার প্রথম দিনের হতভম্ব চেহারা অকপটে ভেসে উঠতো তার। আজ আর তেমন হচ্ছে না রাইফের। এই তো পাশেই সে। মীরার নরম হাতটা রাইফের মুঠোব’ন্দী। মুঠোব’ন্দী তার লাজুকলতা।

তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। নিত্যদিনের অভ্যাসরত মীরা আজানের ধ্বনিতে নড়েচড়ে উঠলো। হালকা হলো তার গভীর নিদ্রা। অন্য দিকে পাশ ফেরার জন্য কাত ঘুরতেই টান লাগলো হাতে। ভ্রু কুঞ্চিত করে অন্ধকারেই চোখ মেলল, শ’ক্ত করে ধরে রাখা হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। অন্য হাতে বালিশের নিচে রাখা ফোনটা বের করে ফ্ল্যাশলাইট অন করল। কাছাকাছি পাশে শুয়ে থাকা রাইফ কে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো সে। বলিষ্ঠ হাত দুটো বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে মীরার হাত। মীরা কি যেনো ভেবে ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসলো। বেখেয়ালি ভাবে ফোনের আলো রাইফের মুখে পরতেই রাইফ চোখ কুঁচকালো। মীরা দ্রুত ফোন সরিয়ে অন্য দিক করে রাখল। হালকা উঁচু করে রাখা মাথাটা আবারও বালিশে রাখল সে। মুখের পাশ দিয়ে বির/ক্ত করা এলোমেলো চুল গুলো কানে গুঁজে রাইফের দিকে দৃষ্টি দিলো। বাহিরে এখনও অন্ধকার ভাব কাটেনি। ফ্লাশ লাইট এর আলোয় রাইফের অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মীরা। এই সেই পুরুষ, যার উপস্থিতি মীরার তনুমন উচাটন করে তোলে, যার স্পর্শে মীরার হৃদ স্পন্দন বেগতিক হারে বাড়ে। যার ঠোঁট কা/টা স্বভাব মীরাকে লজ্জায় ফেলে, যার তীক্ষ্ণ নজর মীরাকে আড়ষ্ট করে তোলে।
এই প্রথম মীরা সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো রাইফের মুখে। চৌকস চেহারার অধিকারী লোকটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সরু নাক, ব’দ্ধ চোখ এ নজর বুলালো। আগে অনেক বার সাক্ষাৎ হলেও এতো কাছাকাছি থেকে গভীর দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কখনও দেখেনি মীরা। সুগভীর ভাবে পরখ করে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের রাইফকে সুপুরুষ থেকে কম মনে হলো না মীরার। সময়ে কে/টে গেলো বেশ। ফর্সা হতে শুরু করেছে ধরণী। মীরা রাইফের মুঠোয় পরে থাকা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। উহু, পেশিবহুল হাতটা দিয়ে এমন ভাবে ধরে রেখেছে, ছাড়ানো যাচ্ছে না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা একটু জোর প্রয়োগ করে হাত টা আরেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আরো শ/ক্ত করে ধরে ফেলল রাইফ। ভ্রু কুঁচকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে আদেশ সূচকে বলল,

-‘আহ! নড়াচড়া করো না তো মীরা। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও। ঘুমাতে পারি নি আমি।’

হুট করে রাইফের কন্ঠস্বর শুনে মীরা চমকে উঠল, কপালে ভাঁজ পরলো দু একটা। নড়াচড়াই বা সে করলো কখন? হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে মাত্র। এটা কে কি নড়াচড়া বলে? মীরা নোয়ানো গলায় বলল,

-‘হাত টা ছাড়ুন, দেড়ি হয়ে যাচ্ছে আমার। নামাজ পড়বো।’

মীরা অপেক্ষা করলো, কিন্তু রাইফ ছাড়লো না। এভাবে আর কতোক্ষণ থাকবে সে। হতাশ হয়ে আবারও মীরাই বলে উঠলো,

-‘ছাড়ুন না। সত্যি দেড়ি হয়ে গেছে। আর আপনি ঘুমাতে পারেননি কেনো?’

মীরার করা প্রশ্ন কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি ফুটে তুলল রাইফ। মীরার দৃষ্টিগোচর হলো সেই হাসি। রাইফের এই হাসি তার চেনা, ভীষণ চেনা। এই হাসির অর্থ সে বুঝে গেছে এ ক’দিনে। এখনি কিছু বলে ফেলবে এই লোক তা সে হাড়ে হাড়ে জানে। মীরা এই সাত সকালে আর লজ্জায় পরতে চায় না। তাই তো দ্রুত এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে উঠে বসল। পা দুটো ফ্লোরে রেখে উঠে দাঁড়াতেই শাড়ির আঁচলে টান লাগলো। অগ্রসর হওয়া পা থেমে গেল, চোখ বুজে ফেলল মীরা। শেষ রক্ষা তার হলো না আজকেও। রাইফ হাতে শাড়ির আঁচল কিছুটা পেঁচিয়ে মীরাকে কাছে টানল। ঘুমুঘুমু চোখ মেলে মীরাকে বলল,

-‘সদ্য প্রস্ফুটিত একটা ফুল যদি পাশে থাকে, কি করে ঘুমাই বলো? তোমার মতো নি’ষ্ঠুর তো আমি নই যে বাসর রাতে ঘুমিয়ে যাবো।’

কথাটা বলে ইউঠে বসে রাইফ মীরাকে ঘুরিয়ে নিলো তার দিকে। হাতটা টেনে নিয়ে পুরুষালী কন্ঠটা আরো খাঁদে নামিয়ে আনলো রাইফ। মীরার হাত টা নেড়েচেড়ে স্মিত স্বরে বলল,

-‘তুমি আমার হৃদয়হ’রণ করেছো মীরা। অ|প|রা|ধ করে ফেলেছো, কঠিন অ|পরা|ধ। তোমাকে যাবত জীবন কা/রাদ/ন্ডে দ/ন্ডিত করা হলো আজ থেকে।’

রাইফ প্রেয়সীর হাতটা উপরে তুলে ধরলো। মীরার এদিক সেদিক তাকানো দৃষ্টি থেমে গেলো হাতে জ্ব/লজ্ব/ল করা হীরার ছোট্ট আংটিটাতে এসে। ভুল দেখছে না সে। রাইফ মাত্র পরিয়ে দিয়েছে তাকে। মীরার তনুমন আবারও কেঁপে উঠল। পিটপিট করে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল কাঁথা মুড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে শুয়ে পরেছে রাইফ।

চলবে….

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৭

ঘড়ির কাটা নয়টা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। রৌদ্রজ্বল সকাল। মীরা মায়ের কোলে মাথা রেখে জাপটে ধরে আছে খাদিজা বেগমকে। কিছুক্ষণ আগে এসেছে নিজ নীড়ে।
বিয়ের পর গুনে গুনে তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। বৌভাতের দিন নিজ পরিবারের সাথে দেখা হলেও আত্নতুষ্টি মিলেনি মীরার। এ ক’দিন রাইফের দুষ্ট মিষ্ট সঙ্গ পেয়ে সময় কাটলেও পরিবাবের কথা ভেবে ঠিকই বুক টা হা হা করে উঠেছিলো তার। আজ সকালে হুট করে ড্রয়িং রুমে যখন শওকত রহমানের উপস্থিতি দেখছিলো রাইফের সাথে, শশুড় বাড়ির কথা সাত পাঁচ না ভেবেই দৌড়ে এসে আব্বাজান কে জাপটে ধরেছিলো মীরা। বাঁধাভাঙ্গা চাপাকান্না হু হু করে নিরবে অশ্রুপাত করেছিলো বাবার বুকের মাঝে মাথা রেখে। শওকত রহমান বাবার স্নেহে সামলে নিয়েছিলেন মেয়েকে। রাজিয়া বেগম বুঝেছিলেন এই কান্নার মানে। মীরার কান্নারত মুখটা দেখে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। নতুন পরিবেশে যতই আদর যত্নে রাখা হোক না কেনো, মনটা যে আপন নীড়েই পরে থাকে তা তিনি জানেন। উপলব্ধি করেছিলেন, মনের কোণে ভেসে উঠেছিলো আরো বছর ত্রিশেক আগের স্মৃতি। সপ্তদশী কন্যা রাজিয়া যখন নতুন বউ হয়ে শশুড় বাড়িতে পা রেখেছিলেন, আদর যত্নের কোনো কমতি রাখেন নি রাইফের দাদা দাদী। তার উপর তো রাইফের বাবার সঙ্গতো ছিলোই। তারপরেও সপ্তদশী কন্যার পরিবারের সখ্যতা লাভের জন্য তনুমন প্রতিনিয়ত হাহাকার করে উঠত।
মীরাকে আর বাঁধা দেন নি তিনি। নিজ থেকেই মীরাকে বাসায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন শওকত রহমান প্রস্তাব দেওয়ার আগেই।

শওকত রহমান এর হাত ধরেই সকাল সকাল চলে এসেছে মীরা। চুপটি করে কোল থেকে মাথা তুলে খাদিজা বেগমের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে আছে মিনিট পাঁচেক হল। মায়ের বুকের শান্তি টুকু কুড়িয়ে নিচ্ছে আপনমনে। খাদিজা বেগম মাথাটা তুললেন মেয়ের। বাবার সাথে কান্না করে ক্ষান্ত হয়নি, মাকে দেখেও হেঁচকি তুলে নাক টেনে টেনে কান্না করেছিলো অনেক ক্ষণ। যার ফলে মীরার ফর্সা আদল খানি লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। খাদিজা বেগম মেয়ের মুখটা আলতো হাতে ছুঁইয়ে দিলেন। থুতনিতে হাত রেখে আদর মাখা কন্ঠে বললেন,

-‘এতো যখন মনে পড়েছিলো আমাদের কথা, রাইফ কে বললেই তো দেখা করাতে নিয়ে আসতো। পাঁচ তলা থেকে তিন তলায় আসতে কি এমন ব্যাপার?’

মীরা ভেজা নয়নে মায়ের পানে তাকালো। থমথমে মুখটা আরো থমথমে করে বলল,

-‘তুমি তো জানোই আম্মা, আমি কেমন। অনেক চেষ্টা করেছি বলার কিন্তু আমি বলতে পারিনি। যদি উনারা ভুল বুঝে মানা করে দেয়?’

খাদিজা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের এতো কান্না দেখে মনের মাঝে ঠিকই অনেক ক্ষণ থেকে ঘুরঘুর করছে এক প্রশ্ন। মায়ের দ্বায়িত্ব বোধ থেকে প্রশ্নটা করেই বসলেন,

-‘কেমন মনে হলো তোর শাশুড়ী কে? যতো দূর মনে হয় উনি অনেক ভালো। তার পরেও আমাকে বল, কোনো অসুবিধা হয়েছে কি?’

-‘না না, উনি অনেক ভালো আম্মা। কোনো অসুবিধা হয় নি। চিন্তা করো না।’

‘আর রাইফ ভাই? সে কেমন হ্যাঁ? আদর যত্ন ঠিক মতো করেছে তো আমাদের মীরারানীর?’
মীরা এবং খাদিজা বেগম চকিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। উর্মি দরজায় দাঁড়িয়ে। মুখে তার ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। প্রশ্নটা করে খাদিজা বেগমের সামনেই মীরাকে জ্বব্দে ফেলেছে সে। বাঁকা হেসে ভ্রু নাচিয়ে মীরাকে ইশারায় জব্দ করেই যাচ্ছে।
শওকত রহমান রাতেই উর্মিদের জানিয়েছিলেন আজ সকালে মীরাকে আনতে যাবেন। মীরাদের বাসায় চলে আসার জন্য উর্মি এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো সকাল সাতটা থেকে আটাটার।
দশ মিনিট পর পর তুমুল বেগে চলা এলার্মের শব্দও ঘুমকাতুরে উর্মিকে তুলতে সক্ষম হয়নি। শেষ মেশ সানজিদা বেগমের হাঁক ডাকে উঠতে উঠতে নয়টা বেজে গিয়েছিলো তার। কোনো রকমে ফ্রেশ হয়েই দৌড় লাগিয়েছিলো এখানে আসার উদ্দেশ্যে। বাসার মেইন দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপতে গিয়েও নব মোচড় দিতেই যখন খুলে গেলো তখন চুপি সারে এসে দাঁড়িয়েছে মীরার রুমের সামনে। মা মেয়ের কথোপকথনে শেষ কথা টুকু কানে আসতেই খাদিজা বেগমকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সময় না দিয়ে বু/লেটের গতিতে গলা উঁচিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলেছে সে।
মীরা চোখ পাকিয়ে আছে উর্মির দিকে। খাদিজা বেগম গোপনে মুচকি হাসলেন। এখানে আর থাকা উচিত হবে না তার। দুজনের জন্য খাবার রেডি করার বাহানা দিয়ে কেটে পরলেন রুম থেকে।
উর্মি দ্রুত পায়ে মীরার কাছে এসে জাপটে ধরল। হঠাৎ আসায় তাল সামলাতে পারল না মীরা, পিছিয়ে গেলো কিছুটা৷ উর্মি ছাড়ল,উৎসুক কন্ঠে বলল,

-‘কি হলো বললি না যে, উত্তর দে?’

-‘কি?’

-‘কি মানে? আমি এক কথা দুবার বলতে পছন্দ করি না। বল কেমন আদর যত্ন করলো?’

মীরা হঁচকালো না। উর্মির সাথেই তাল মেলাল। গদগদ কন্ঠে উর্মির সুর অনুকরণ করে বলল,

-‘স্বামী-স্ত্রীর ব্যাক্তিগত আদর যত্নের কথাও আমি তৃতীয় জনকে বলতে পছন্দ করি না গলার মালা।’

উর্মি মুখ গোমরা করল, সরু ঠোঁটদুটো ফুলিয়ে অভিমানের স্বরে বলল,

-‘আমাকেও বলবি না? বিয়ে হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে এভাবে পর করে দিলি মীরু। জানতাম তুই এমন করবি, তাই বলে এতো দ্রুত।’

মীরা হেসে দিলো শব্দ করে। উর্মির নাদুস নুদুস গালটা দু আঙ্গুলের সাহায্যে টেনে দিয়ে বলল,

-‘তোর রাইফ ভাই ভীষণ দুষ্ট, কথার জালে ফাঁ/সাতে সে ভীষণ পটু।’

উর্মি মীরার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মুখ খুলে বলবে
” আর আদর যত্নে কেমন পটু?”
তা আর বলতে দিলো না মীরা। হাত ধরে টেনে তুলল উর্মিকে। তাগদা দিলো সাথে আসার জন্য, আজ মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার খাবে পেট ভরে।

____________

সন্ধ্যা নেমেছে পৃথিবীতে। পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ছে মীরা। উর্মি অলস ভাবে বিছানায় শুয়ে ফোন ঘাটছে। এমন সময় কলিং বেল বাজলো পর পর দুবার। তৃতীয় বার কলিং বেল বাজতেই মীরা বিরক্তি ভরা চোখে উর্মির দিকে তাকালো। শুয়ে আছে, তবুও উঠছে না উর্মি। মীরা তাগদা দিলো দরজা খোলার জন্য। উর্মি হেলে দুলে উঠে বসেছে তখনই বাহিরে খাদিজা বেগমের কন্ঠস্বর শুনে মনের বিপরীতে ওঠে বসা উর্মি আবারও ধপ করে শুয়ে পরলো। মামি উঠে গেছে মানে উনি দরজা খুলবে, তার আর যাওয়ার প্রয়োজন নেয়। মীরা আবারও ধ্যান দিলো পড়ায়।

বই পড়ুয়া মীরার পড়া থেমে গেলো রাইফের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই। বাহির থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে রাইফের কন্ঠস্বর। রাইফ যে হেসে হেসে কথা বলছে তা মীরা না দেখেই বুঝতে পারছে। মীরা দ্রুত পিছু ফিরে তাকাল। ওমা, যে উর্মি এতোক্ষণ বিছানা থেকে উঠতে নারাজ সেই উর্মি উঠে গিয়ে উঁকি দিচ্ছে দরজার বাহিরে। এক পলক বাহিরে উঁকি দিয়েই মীরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো উর্মি,

-‘তাকিয়ে দেখলে হবে নাকি আসতে হবে। আয় আয়, দ্রুত আয়। তোর আশিক এসেছে।’

বলেই ফিক করে হেসে দিলো সে। মীরা আহম্মক বনে গেলো। একদিকে রাইফ তো আরেক দিকে উর্মি, যে যখন পাচ্ছে তখনি মীরাকে কোনো না কোনো ভাবে খোঁচা দিয়েই যাচ্ছে তাকে। মাঝে মাঝে উর্মি তাও ছাড় দেয়, কিন্তু রাইফ সুযোগ পেলেই হলো। কথার পিঠে কথা বলে লজ্জা নামক মিঠে অস্বস্তিতে ফেলতে দুবারও ভাবে না।

___________

এতোক্ষণ শাশুড়ী এবং শালিকার সাথে হেসে হেসে কথা বলা রাইফের জবান থেমে গেলো মীরার মিহি কন্ঠে রাইফের উদ্দেশ্যে দেওয়ার সালাম শুনে। তড়িৎগতিতে রাইফ তাকালো মীরার দিকে। এই প্রথম মীরা তাকে সালাম দিয়েছে। স্বামীর সম্মান যেন স্পষ্ট উপলব্ধি করছে রাইফ। রাইফের সারাদিনের ক্লান্তি মীরার মিহি স্বরের সালাম পেয়েই দূরীভূত হলো, প্রশান্তিতে ভরে উঠল মন। আওয়াজ করেই লম্বা সুরে সালাম ফিরালো রাইফ,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ’
গুটি গুটি পায়ে মীরা মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। রাইফের সালামের ধরণ দেখে মিটিমিটি হাসছে উর্মি। খাদিজা বেগম মেয়েকে তাড়া দিলেন রাইফকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সারাদিন অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে আছে। রাইফকে ফ্রেশ হতে বলে উর্মিকে নিয়ে খাদিজা বেগম চলে গেলেন কিচেনে। নতুন জামাই এসেছে বাড়িতে, আপ্যায়ন এ কোনো কমতি রাখবেন না তিনি।

▫️

মীরার পিছু পিছু রাইফ ঢুকেছে মীরার রুমে। ঘাড় ঘুরিয়ে মীরার পুরো রুমে চোখ বুলাল। আজকেই প্রথম মীরার রুমে এসেছে রাইফ। বেশ পরিপাটি গুছানো রুম। শৌখিন জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছে পুরো রুম জুড়েই। শার্টের উপরে দুই বোতাম খুলে নেভি ব্লু শার্টের স্লিভ গুটিয়ে বিছানায় বসল সে। মীরা সুইচ টিপে ফ্যান অন করে বেরিয়ে যাবে তখনি রাইফ ডেকে উঠল মীরার নাম ধরে৷ মীরা থামল, ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নত্নক দৃষ্টিতে চাইলো। রাইফ ইশারায় কাছে ডাকল। মীরা ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে এলো রাইফের দিকে, মিনমিন করে ছোট্ট আওয়াজে বলল,

-‘চা আনি আপনার জন্য?’

-‘পরে, এদিকে আসো। কাছে আসো, দূরে দাঁড়িয়ে কেনো। আসো, বসো।’

মীরা খানিক দূরত্ব রেখেই বসল রাইফের পাশে। রাইফ এর তর সইলো না। সারাদিন অফিসের ধকল শেষে বিয়ে করা বউ যদি দূরে গিয়ে বসে, সারাদিনের ক্লান্তি দূর হবে কি ভাবে? দূরত্ব ঘুচালো, মীরার বাহুর সহিত রাইফের বাহু ছুঁই ছুঁই অবস্থা এমন ভাবে বসলো। কোলের উপর রাখা মীরার মুঠো করে রাখে হাতটা টেনে নিজের কাছে নিলো। খানিক নেড়েচেড়ে প্যান্টের পকেট থেকে বেলি ফুলের মালা বের করে পরিয়ে দিলো মীরার হাতে। সাদা বেলির মাঝে লাল গোলাপ ভীষণ সুন্দর লাগছে দেখতে। মীরার ভালোলাগা কাজ করলো, মুচকি হাসি স্থান করে নিলো ঠোঁটের কোণে। রাইফের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে সুবাস নিলো গভীর শ্বাস গ্রহন করে। গোলাপ-বেলির মিঠে সুবাসে মন প্রাণ তাজা হলো মীরার। রাইফ অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মীরাকে। পিটপিট চোখে মীরা রাইফের দিকে তাকালো,

-‘ঘ্রাণ টা অনেক সুন্দর।’

তৃপ্তির হাসি ফুটলো রাইফের মুখে। সহজ হতে শুরু করেছে মীরা। মীরার বলা কথায় রাইফের ভরাট কন্ঠের ঝটপট জবাব,

-‘আমার ফুলটাও অনেক সুন্দর, তার ঘ্রাণ এর থেকেও হাজার গুন বেশি প্রখর। রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে নে/শা সৃষ্টি করে, মা/দ/কতায় ছড়িয়ে যায় আমার ভেতর বাহির। ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছে গুলো হামলে পরে, শক্ত করে বক্ষ পিঞ্জরে আব’দ্ধ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।’

মীরা দৃষ্টি নুইয়ে ফেলল। রাইফের ইশারা যে তার দিকেই স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। শব্দ বিহীন উঠে দাঁড়ালো। গুটি গুটি পায়ে রাইফ কে অতিক্রম করে দরজার কাছে এলো। মাথায় দেওয়া ওড়না টা সরিয়ে হাতের বেলি ফুলের মালাটা খোঁপায় পেঁচিয়ে মাথায় ওড়না টেনে ছুটলো কিচেনে। এখানে যতোক্ষণ থাকবে ততক্ষণই রাইফ যে তাকে ছাড়বে না তা মীরার ঢের জানা। কিন্তু আসলেই কি লুকাতে পারবে? পবিত্র সম্পর্ক যেখানে বন্ধন সৃষ্টি করেছে সেখানে পূর্ণতা না পেলে যে বেমানান। চোখে লাগার মতোই বেমানান।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে