#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৪
🍁
পরপর কে/টে গেছে এক সপ্তাহ। রাইফ এই ক দিন মীরার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। মীরার মুখ থেকে হু হা ব্যাতীত কিছুই বের করতে পারে নি সে। দেখা করতে চাইলেও মীরা নাকচ করেছে ইনিয়ে বিনিয়ে।
অবশেষে ধৈর্য হারা হলো রাইফ, এভাবে মীরাকে না দেখে থাকতে পারছে না মোটেও। মেয়েটা যে কেনো বোঝে না ওর অবস্থাটা? একটু দেখতেই তো চায় শুধু, কাছে তো এখনি টেনে নিচ্ছে না। এতো সংকোচের কি আছে? আজব!
রাইফ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রাজিয়া বেগম কে জানিয়েছে আজ অফিস যাবে না। মীরাদের বাসায় যাবে বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে। কালকের মাঝেই মীরাকে তাদের বাসায় চায় তার।
রাজিয়া বেগম রাইফের কথাতে মুখের উপর কাঠকাঠ ভাবে অসম্মতি জানালেন। সামনে মীরার ফাইনাল পরীক্ষা। বিয়েটা তিনি পরীক্ষার পর ই করতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা, রাইফ এর এক কথা, এখনি বিয়ে করবে সে। পরীক্ষা তো আর আঁটকে রাখছে না সে। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিবে৷ না করেছে কে? রাজিয়া বেগম রেগে গেলেন কিঞ্চিৎ, শক্ত কন্ঠে বললেন,
-‘সমস্যা কি তোর রাইফ? এখনি বিয়ে করতে হবে কেনো? মেয়েটার সামনে পরীক্ষা। এখন বিয়েটা হলে ওর পরীক্ষা খারাপ হতে পারে। আর একটা প্রস্তুতি আছে না? হুট করে বিয়ে করানো যায়? মীরাকে রাজ রানী করে ঘরে তুলবো আমি।’
রাইফ ছটফট করে পায়চারি করছে। একবার বসছে তো একবার হাঁটছে। অস্থিরতা স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে তার ভাব ভঙ্গিমায়। কি করে বলবে তার সমস্যা কি। মাকে কি এখন বলা যায় যে মীরাকে না দেখলে তার ভালোলাগে না, ঘুম হয় না রাতে। অফিস করেও শান্তি পায় না। এসব মুখ ফুটেই বলতে হবে কেনো? বুঝে নিতে কি অসুবিধা? ছোট্ট শ্বাস ফেলে রাজিয়া বেগমের কাছে এসে বসলো রাইফ।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘যে আগে থেকেই রানী, সে সাজলেও রানী, না সাজলেও রানী। নতুন করে বানাতে হবে না আম্মা।’
রাজিয়া বেগম দমলেন না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সে নাহয় কোনো রকমে আনলো কিন্তু মীরাদের পরিবার এর কথাও তো ভাবতে হবে। নিজেকে শান্ত করে রাইফ কে মানাতে কোমল স্বরে বললেন,
-‘উনারা কি ভাববে আব্বা? উনাদেরও তো একটা প্রিপারেশন আছে তাই না?’
মায়ের কথা রাইফের মনঃপুত হলো না। এটা কোনো কারণ হলো? অদ্ভুত কারণ দিয়ে যাচ্ছে কখন থেকে।
ভ্রুকুঞ্চন করে অশান্ত ভঙ্গিতে বলল রাইফ,
-‘কিসের প্রিপারেশন আম্মা? তিন তলায় থেকে পাঁচ তলায় মেয়েকে পাঠাতে কিসের প্রিপারেশন? আনতে ঘোড়াও লাগবে না, হাতিও লাগবে না। কোলে করেই আনতে পারবো।’
-‘মুখে লাগাম দে বে/য়া/দব কোথাকার।’
রাইফ মায়ের ধমকে হাসি দিলো। দুহাতে জাপটে ধরে আবদারের স্বরে বলল,
-‘আম্মা, তুমি যাও প্লিজ। কথাতো বলে দেখো।’
-‘বুঝিস না কেনো?’
-‘কি বুঝবো আম্মা? তোমার কি একটু মায়া দয়া হয় না। উপযুক্ত ছেলেটা মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলছে। বাবা থাকলে এরকম কখন ও হতো না। আমি বলার আগেই ব্যাবস্থা করে দিতো।’
জায়গা মতো কো/প দিয়ে রাইফ মন খারাপের ভাব ধরে চুপ করে রইলো। রাজিয়া বেগম স্বামীর কথা মনে হতেই আবেগাপ্লুত হলেন। স্মৃতি চারণ এ ব্যাস্ত হলেন। ছেলের বিয়ে নিয়ে কতোই না শখ ছিলো উনার। মন গলল রাজিয়া বেগমের। রাইফ আঁড়চোখে একবার দেখলো মাকে। চেহারা পাল্টে গেছে, ইতিবাচক সিদ্ধান্ত মনে করে বিস্তর হাসি ফুটল তার মুখে।
_____________
ড্রয়িং রুমে রাজিয়া বেগম এর সাথে খাদিজা বেগম খোশ মেজাজে গল্প করছেন। শওকত রহমান ও ছিলেন এই আড্ডায়। আসরের সালাত আদায় করতে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে।
মীরার পরিবার রাজিয়া বেগমের আকস্মিক আগমকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছিলেন। একটা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে তারা, আসবেন তো অবশ্যই। কিন্তু রাজিয়া বেগম ভণিতা ছাড়াই শওকত রহমান এবং খাদিজা বেগমকে জানিয়েছেন কালকের মাঝেই মীরাকে তার পুত্রবধূ করতে ইচ্ছুক। রাইফের কথা চিন্তা করে শওকত রহমান কে মিনতিও করেছেন রাজি হওয়ার জন্য।
শওকত রহমান দোটানায় ভুগছিলেন অনেক ক্ষণ। একটা মাত্র মেয়ে তার। বিয়েটা তিনি ধুমধাম করেই দিতে চান। কিন্তু এতো দ্রুত কিভাবে সব কিছুর আয়োজন করবেন তিনি? রাজিয়া বেগম ও ছাড়ছেন না কিছুতেই। কিছু বুঝে ওঠতে না পেরে ফোন করলেন বোন সানজিদা বেগম এবং মীরার বড় মামাকে। শলা পরামর্শ করে শওকত রহমান এক দিনের সময় চেয়ে নিলেন রাজিয়া বেগমের থেকে। বিবাহের দিন ধার্য করলেন এক দিন পর। রাজিয়া বেগমও খুশি হলেন, উনারও তো সময় দরকার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। সম্মতি জানালেন শওকত রহমান কে। বিয়ের তারিখ ধার্য হলো অবশেষে।
শওকত রহমান মসজিদ থেকে ফেরার সময় রাইফের সাথে দেখা হলো রাস্তার মোড়ে। কুশলাদি বিনিময় করে তিনি জোর করে বাসায় এনেছেন হবু জামাতা কে। রাইফের ও অবশ্য ইচ্ছে ছিলো, অনেক দিন হলো মীরাকে দেখে না। এই সুযোগে এক নজর দেখা হলে মন্দ হয় না।
দুপুরের খাওয়া শেষে সেই যে ঘুম দিয়েছিলো মীরা, একেবারে বিকেল পাঁচটায় সজাগ পেয়েছে। হাই তুলে চোখ মুখ ডলে উঠে বসল। বেড সাইডে সুইচ টিপে অন্ধকার রুমটা কৃত্রিম আলোয় আলোকিত।
বালিশের পাশে রাখা সুতি ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। আসরের সালাত আদায় করবে ভেবে অজু করতে যেতে চেয়েও ও দিকে আর পা বাঁড়ালো না মীরা। অনেক ক্ষণ ঘুমানোর ফলে মাথাটা ভার ভার হয়েছে। ঘুম ঘুম ভাব কাটানো দরকার। কড়া লিকারের এক কাপ রঙ চা ই পারে মাথাটা সতেজ করে তুলতে। সিদ্ধান্ত নিলো চা বানানোর জন্য চুলায় পানি দিয়েই বরং সে নামাজ পড়বে। নামাজ ও হলো, চা ও হলো। সময়টাও বেঁচে গেলো।
রুমের দরজা খুলে লম্বা একটা হাই তুলল মীরা। কোমড় ছাপানো খোলা চুল গুলো দু হাতের সহিত খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে আনমনে হাঁটা ধরলো কিচেনে।
দু হাতের কার সাজিতে চুল গুলো পেঁচিয়ে গুজে দিলেই খোঁপা বাধা শেষ হবে এমন মুহূর্তে হাত আঁটকে গেলো, ছোট্ট ছোট্ট পায়ের কদম থেমে গেলো সোফায় বসে থাকা রাইফ কে দেখে। মীরা আ/তং/কিত হলো, বিস্ময় ভরা চেহারায় তাকিয়ে রইলো। অসম্ভব, উনি এখানে কেনো থাকবেন? দেখার ভুল ভেবে বিরক্তিতে অন্য দিকে তাকাতেই গলা খাঁকারির শব্দ শুনে চমকে উঠলো, কেঁপে উঠলো জোরেসোরেই। হাতে ধরে রাখা খোঁপার বাঁধন আগলা হলো কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ কে দেখে। ধীরে ধীরে কোমড় ছাপানো দীঘল কালো চুল গুলো জায়গা করে নিলো পুরো পিঠ সমেত। দু গালের পাশ দিয়েও জায়গা করে নিলো ঘাড় সমান ছোট চুলগুলো।
সেই সুপরিচিত ঘ্রাণ পাচ্ছে মীরা। তড়িৎগতিতে মস্তিস্ক জানান দিলো এটা তার দেখার ভুল নয়, এটা সত্যি। হুলুস্থুল করে ওড়না টেনে মাথায় জড়ালো।
রাইফ তাকিয়েই আছে এক দৃষ্টিতে। মীরার কাঁধ বেয়ে কোমড় ছুঁয়ে দেওয়া চুল দেখে বিমোহিত হয়েছে সে। মীরার এমন রূপ যে তার অজানা। এই ঘুম কাতুরে ফোলা ফোলা স্নিগ্ধ মুখটাও তার অদেখা।
মীরা খুব করে চেষ্টা করছে কিছু বলতে কিন্তু রাইফের হঠাৎ সাক্ষাতে সব কিছুই গুলিয়ে যাচ্ছে। রাইফ ই প্রথম কথা বলল। ওড়না ভেদ করে কোমড়ের দিকে বেরিয়ে আসা চুল গুলো আরেকবার দেখে মীরার নজরে নজর আব/দ্ধ করলো। গম্ভীর গলায় নিবিড় কন্ঠে বলল,
-‘তোমার এই মোহনীয় রূপ টা আমার ভেতরটায় কাল বৈশাখী ঝ/ড় তুলেছে মীরা। বিশ্বাস করো, অবাধ্য ইচ্ছে গুলো হামলে পরেছে। গগণ বিদারী চি/ৎকার করে বলছে চুল গুলো ছুঁয়ে দিতে। ফোলা ফোলা চোখ দুটোয় ওষ্ঠ ছোঁয়ার প্রচন্ড লো’ভ হচ্ছে আজ।
রাইফের চাপা স্বরে বলা কথা গুলো মীরার হৃদয় নাড়িয়ে দিলো। ভয়ে আড়ষ্ঠ হলো। লোকটা কি বলছে এসব? ভয় ভয় চেহারা লুকিয়ে চেহারায় স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে মাথা নাড়ালো, যার অর্থ এমন কাজ করবেন না, ভুলেও না।
রাইফ জ্বল জ্বলে হাসি দিলো মীরার এমন চেহারায়। দীর্ঘদেহী পুরুষটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকলো মীরার দিকে। চাপা স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
-‘আর দুটো দিন, রেডি থেকো মীরা। আমি ছাড়বো না তোমাকে, সত্যি ছাড়বো না।’
চলবে…..
#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৫
🍁
বাসা ভর্তি মেহমান গিজ গিজ করছে। হৈ হুল্লোড় এ মেতে উঠেছে সবাই। খুশির ঝিলিক চোখে মুখে উপচে পরছে বর পক্ষ এবং কনে পক্ষের সকলের মুখেই। কেউ খোশ গল্পে মেতে ওঠেছে তো কেউ কেউ ব্যাস্ত তার নিজ কর্মে।
কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে নিজের রুমে খুবই সাধারণ ভাবে বধু সেজে বসে আছে মীরা। লাল রঙের জমিনের উপর সোনালী রংয়ের কারুকার্য করা বেনারসি টা মীরার অঙ্গ জুড়ে জড়িয়ে আছে, অপরূপ সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলেছে। চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো রূপ ঠিকরে পরছে মাথায় দেওয়া ছোট্ট ঘোমটার মাঝে ফর্সা আদল টুকুতে। টানা টানা চোখ দুটোই হালকা করে দেওয়া কাজল লেপ্টে আছে। গোলাপি সরু অধরে হালকা কৃত্রিম গোলাপি আভা লাগিয়ে মীরার সৌন্দর্য আরো দ্বীগুণ করে তুলেছে।
টকটকে লাল মেহেদী দেওয়া হাত টা কোলের উপর রেখে কঁচলে যাচ্ছে অনেক ক্ষণ। সকাল থেকেই কয়েক চোট কান্না করে লাল করে ফেলেছে দু চোখ। ফোলা ফোলা চোখ দুটোই কাজল দেওয়াতে মীরার চেহারায় অন্য রকম মায়া সৃষ্টি হয়েছে আজ।
উর্মি আজ ভীষণ খুশি। সুন্দর একটা ড্রেস পরে মীরার আশে পাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজিয়া বেগম মীরার এমন রূপ দেখে অনেক ক্ষন ধ্যান মে/রে তাকিয়ে ছিলেন। ছেলে যে তার এমনি এমনি পাগল হয় নি তার আজ খুব করেই টের পাচ্ছেন। মেয়েটা গুণেও যেমন গুণবতী, রূপেও তেমন রূপবতী। কোনো অংশই যেনো কমতী নেই মীরার মাঝে।
শওকত রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে প্রবেশ করলেন মীরার রুমে। বিয়ে পড়ানোর আগে তিনি একান্ত সময় কাটাতে চান মীরার সাথে। প্রাণের আম্মাজান কে কাছে টেনে শেষ মুহুর্তে আরেকটু আপন করে নিতে চান তিনি। মীরা বাদে রুমের সবাই চলে গেলো বাহিরে।
মীরার বউ সাজার মুখটা দেখে শওকত রহমান যেমন খুশি হলেন তেমনি ভাবে বুকটাও হু হু করে উঠলো। একমাত্র কন্যাকে আজ অন্য ঠিকানায় পাঠাবেন তিনি। এতো দিনের আগলে রাখা মেয়েটাকে অন্য কোথাও পাঠাতে হবে ভেবে ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল তার। মেয়েকে বুঝতে দিলেন না, প্রকাশ করলেন না কিঞ্চিৎ পরিমাণও। মীরা তার আব্বাজানের আগমনেও আজ নীচু করেই রেখেছে মুখটা। আব্বাজানের সাথে চোখে চোখ মেলাতে পারবে না কিছুতেই। কঠোর ভাবে অশ্রু গুলোকে ব/ন্দী করে রেখেছে আঁখি কোঠরে। আব্বাজানের পানে তাকালেই যেনো অশ্রু গুলো মুক্তি পাবে, চোখের কোণ দিয়ে ঝর ঝর করে বর্ষণ ধারা ঝরে যাবে কপোল ছুঁয়ে।
শওকত রহমান ভ’ঙ্গুর হৃদয়ে মীরার পাশে বসে ফাঁকা জায়গাটুকু দখল করে নিলেন। মীরার মাথায় হাত রাখতেই কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে গেলো শওকত রহমানের। নীজের ভেতরের ব্যাথাতুর অনুভূতি গুলোকে সন্তর্পণে লুকিয়ে ফেললেন ছোট এক শ্বাস ছেড়ে। মীরা পিতার কাঁধে মাথাটা হেলান দিলো। আব্বাজানের খসখসে হাতটা টেনে নিলো, নিজের দু হাতের মুঠোয় পুরে তাকিয়ে রইল সম্মুখে। নীরব দুজনেই। টিক টিক করে সময় কে/টে গেলো মিনিটের পর মিনিট। শওকত রহমান ছোট্ট করে চুমু খেলেন মীরার মাথায়। নিরবতা ভেঙ্গে মোলায়েম স্বরে বললেন,
-‘ইমাম সাহেব আসছেন আম্মাজান। ওদিকের কাজ শেষ। অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। ডাকবো উনাকে?’
মীরা বাবার প্রশ্নে উত্তর দিলো না। মৃদু ভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো শুধু।
শওকত রহমান গলা উঁচু করে ডেকে ইমাম সাহেব কে রুমে আসতে বললেন। ইমাম সাহেবই প্রথম প্রবেশ করলেন। তার পেছন পেছন এক এক করে মীরার মা, ফুপু-ফুপা, রাজিয়া বেগম, উর্মি এবং রাইফের বড় চাচা-চাচি সহ বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানিত ব্যাক্তিগণও প্রবেশ করলেন। পিতার কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো মীরা। বুকের বা পাশে ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে হাজার গুন। কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার৷ শরীর টাও কেমন ঝিমিয়ে গেছে যেনো। এই বোধ হয়ে নেতিয়ে পরবে শরীর টা। বয়োবৃদ্ধ ইমাম ইসলামি ধর্ম মোতাবেক বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। শেষ সময়ে এসে যখন মীরাকে বলতে বললেন কবুল, মীরা দুচোখ বন্ধ করে কেঁপে উঠল। শওকত রহমান ঠাহর করলেন পাশে বসে থাকা আদুরে কন্যার অবস্থা। বরাবরের ন্যায় শওকত রহমানের ভরসার হাত টা মীরাকে পেছন থেকে জাপটে নিলো তৎক্ষনাৎ। কোমল কন্ঠে নিচু আওয়াজে মীরাকে বললেন,
-‘আমার সাহসী আম্মাজান, ভয় নেই। আপনার আব্বাজান সব সময় আপনার পাশে ছিলো, আছে এবং থাকবে।’
মীরা ছলছল নয়নে মুখ তুলে শওকত রহমানের পানে তাকাল। যতই চেষ্টা করুক অশ্রু লুকানোর, কিন্তু ভেজা নয়ন স্পষ্ট বলছে মীরা কেঁদেছে যার ছোঁয়া এখনও আঁখি পল্লবে লেগে আছে। শওকত রহমান মেয়ের মুখের পানে তাকালো। মুখে মুচকি হাসি লেপ্টে ঘাড় নাড়িয়ে চোখের পাতা এক বার বন্ধ করে আবারও খুলল। পিতার নিকট থেকে সাহস পেলো মীরা। কিন্তু ধুকপুকানি কমছে না কিছুতেই। খাদিজা বেগম মেয়ের একটা হাত মুঠোয় নিলেন। মায়ের সংস্পর্শে মীরা এবার আর নিজের সংযত করতে পারল না। গুঙিয়ে কেঁদে উঠলো, হুরমুর করে ধেয়ে আসা অশ্রু গুলো চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরল। কান্নারত মীরা কাঁপা কাঁপা স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে মৃদ্যু আওয়াজে বলল ‘কবুল।’
আলহামদুলিল্লাহ জয়ধ্বনীতে শুকরিয়া আদায় করলো সবাই। হাসি ফুটলো সকলের মুখে। উর্মির হাতে রাখা মোবাইল টাতে ফোনকলে বর বেশে থাকা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুপুরুষটির মুখেও বিস্তর হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। স্বস্তি পেল, শুকরিয়াও আদায় করলো। বুকের ভেতর পাথরের মতো বোঝা সৃষ্টি করে জমে থাকা কয়েক দিনের দীর্ঘশ্বাস টাও দুঠোঁটে ফাঁক দিয়ে ছেড়ে দিলো চোখ বন্ধ করে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে চলে এসেছে বিদায় মুহুর্ত। মীরা ছোট বাচ্চার ন্যায় অনবরত কান্না করেই চলেছে শওকত রহমানের বুকে মাথা গুঁজে। একবার তো বলেই ফেলেছে সে যাবে না এখান থেকে। শওকত রহমান সহ সবাই সবার মতো বুঝিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মীরাকে সামলানো যাচ্ছে না। নীরবে অশ্রুপাত করে পিতার বুক ভিজিয়ে ফেলেছে। শওকত রহমান আর নিজেকে খোলসে আবৃত করে রাখতে পারেননি, পারেননি পরিবারের কেউ ই। বিদায় বেলায় হু হু করে কেঁদেছেন সকলে।
_________________
রাইফের খোলা বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। জ্ব/লজ্ব/ল করে আলো ছড়িয়ে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার দূর করেছে ধরণী থেকে। মীরার মুখটাও উজ্জ্বল হয়েছে জ্যোৎস্নার রুপালি আলোয়। শিরশিরে হাওয়া এসে শরীর-মন দুটোই জুড়িয়ে দিচ্ছে মীরার।
হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিহিত মীরার রাইফের সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে বর্তমান, সব কিছুই তার অকপটে ভেসে আসছে মনে।
নিয়তি আজ ঠিক সেখানেই দাঁড় করিয়েছে মীরাকে যেখানে সে রাইফকে স্নিগ্ধ ভোরে দেখেছিলো একদিন। ভাবুক মীরা ভাবছে আরো অনেক কিছুই। এই তো ঘন্টা খানেক আগেই যখন মীরা বধু বেশে সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে উপরে উঠছিলো রাজিয়া বেগমের সাথে, হুট করেই রাইফ এসে মীরার বাম দিকটা দখল করেছিলো সর্তপনে। মীরার সহিত পায়ে পা মিলিয়ে সামনে দৃষ্টি রেখে হাঁটছিলো রাইফ। কান্না করার ফলে মীরার ফর্সা মুখ এবং চোখ দুটো লাল বর্ণের তখন।
মীরার নিজ পরিবার ছেড়ে নতুন ঠিকানায় যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো, নরম হৃদয়টা ছে/দন হচ্ছিলো মারাত্নক ভাবে। অসাড় হয়ে আসা টালমাটাল পা দুটো যখন কোনো রকমে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনি রাইফের আগমন আরো বেশি ধরাক করে তুলেছিলো মীরার কোমল হৃদয়। র*ক্তিম হয়ে আসা চোখ দুটি তুলে আড় দৃষ্টিতে একটু রাইফ কে দেখে আবারও সামনে দৃষ্টি দিয়েছিলো সে। রাইফ দাম্ভিকতার সহিত হেঁটে যাচ্ছে পাশে, কোনো হেলদোল নেই তার। ধ্যান জ্ঞান পুরোটুকুই সামনের দিকে। খুব একটা মাথা ঘামায় নি মীরা। স্বাভাবিক ভাবে ছোট ছোট পা ফেলে চুপটি করে হেঁটে যাওয়া মীরা আচানাক তার কনিষ্ঠ আঙুলে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠেছিলো। পাশে ফিরে তাকাতেই রাইফের তী/ক্ষ্ণ নজর ভ্রু উঁচিয়ে সামনে তাকাতে হুকুম করেছিলো সাথে সাথেই। মীরা শুষ্ক অধরে দাঁত কা/মড়ে মাথাটা নুইয়ে নিয়েছিলো তখনি। প্রচন্ড ভাবে কাঁপছিলো মীরার হাত। টালমাটাল পা দুটো থেমে যাবে যেকোনো সময়। রাইফ বুঝেছিলো মীরার কাঁপুনি। রাইফ তার খসখসে কনিষ্ঠ আংগুল দিয়ে আঁকড়ে ধরা মীরার কোমল কনিষ্ঠ আংগুল টা ছেড়ে দিয়েছিলো তক্ষুনি। মীরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো এবার। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস ফেলবে তক্ষুনি মীরার কোমল হাতটা শ’ক্তপোক্ত হাতে ব/ন্দি হয়েছিলো। মীরার ছোট ছোট আংগুলে রাইফ আংগুল গুঁজে দিয়েছিলো মূহুর্তেই। মীরার বন্ধ আঁখিদুটি আরো খিঁচে কুঁচকে গিয়েছিলো ভেতরের দিকে, পা দুটো থেমে গিয়েছিলো সাথে সাথেই। মীরার এমন অবস্থা দেখে রাইফের বৃদ্ধাঙুল মীরার হাতের উল্টো পাশে এদিক ওদিক বুলিয়ে দিচ্ছিলো। সহজ করে তুলতে চেষ্টা করছিলো সে। মীরার নরম হাতে শ/ক্ত একটা চা/প প্রয়োগ করেছিলো মীরার ধমকে যাওয়া পা দুটোকে আবারও সচল করার উদ্দেশ্যে।
মৃদুমন্দ বাতাসে সামনের ছোট চুল গুলো মীরার মুখে এদিক ওদিক খেলা করছে। গোলাকৃতির চাঁদের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হওয়া মীরা কপালের কাছে কারো স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল। তড়িৎগতিতে পাশে তাকাতেই রাইফ কে দেখে বুকে জমা রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে দিলো। মীরার উড়ন্ত খোলা চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো রাইফ। শ্যমবর্ণের মুখটা মীরার কানের কাছে এনে ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে ভরাট গলায় বলল,
-‘জানো মীরা, তুমি আমাকে ওই চাঁদের আলোর মতোই আলোকিত করেছো। আমি আজ পূর্ন মীরা, আমার লাজুকলতা কে পেয়ে আজ আমি সম্পূর্ণ।’
চলবে…..