#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২২
সকালের মিঠে রোদ ঝলমলে করে তুলেছে ধরনীর বুক। আধোখোলা জানালার গ্রিল ভেদ করে সূর্য রশ্মি উঁকি দিয়ে সাদরে জায়গা করে নিয়েছে মীরার মুখাবয়বে। গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন সে। ডান হাত টা চোখের উপর রেখেছে সূর্যের আলোয় যেনো ঘুমের ব্যাঘাত না হয় তার। পাশেই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে উর্মি। সাধারণত মীরা নিয়ম মাফিক দশটা-সাড়ে দশটার মাঝেই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু কাল ঘুমাতে ঘুমাতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছে। এতো দেড়িতে ঘুমানোর কারণ ও আছে বৈকি।
ফাইনাল পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিলাপের ডেট দিয়েছিলো রাজিয়া বেগম রা দেখে যাওয়ার পরের দিন ই। তাই সেদিন ই ঢাকা চলে গিয়েছিলো। চার দিন ছিলো হলে। গতকাল রাত্রে ফিরেছে মীরা। গাজীপুর চৌরাস্তার অসহ্যকর জ্যাম এর জন্য ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। তার উপর অনেক ক্ষণ গল্পগুজব করে সবার সাথে কা’টিয়েছে সময়। উর্মিও চলে এসেছে, তাই আড্ডাটা আরো বেশি জমে উঠেছিলো।
দেড়ি করে ঘুমানোর ফলে কোনো রকমে চোখ কচলে ফজরের সালাত আদায় করে আবার শুয়ে পরেছে মীরা। খাদিজা বেগম এসেছিলেন কয়েক বার ডেকে তুলতে। গভীর নিদ্রায় দুজনকে দেখে ডেকেও আর ডাকতে পারেননি।
বালিশের নিচে রাখা সেলফোন টাতে এলার্ম বেজে চলেছে। এই বার নিয়ে তিন বার হয়ে গেলো। মীরা পিটপিট করে কোনো রকমে চোখ খুলে মোবাইল হাতরে কর্কশভাবে বেজে ওঠা এলার্ম অফ করে দিলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলো। দুপাশে হাত টা/না দিয়ে আবারো হেলান দিয়ে আধো শোয়া হলো। শরীর টা আজ বড্ড বিছানা টা/নছে মীরার। আলসেমি যেনো ছাড়ছেই না। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে অনেক। এক দিকে পেট ভর্তি ক্ষুধা, অন্য দিকে চোখ ভর্তি ঘুম। সময় নিলো বিছানা ছাড়তে।
খোলা চুল গুলো হাত খোঁপা বেঁধে ধীরে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। মীরার লাগানো শখের পাতা বাহার গাছ গুলো কেমন নেতিয়ে গেছে এই কদিনে। শুকিয়েও গেছে অনেক পাতা। শুকনো পাতা গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল হলো হাত দুটো ফাঁকা ওর। ঢাকায় গিয়েছিলো বলে খুলে রেখেছিলো রাজিয়া বেগমের দেওয়া সরু বালা দুটো। রাইফের কথাও মনে পড়ে গেলো মনিকোঠায়। খাদিজা বেগমের ডাক কানে আসাতে আর ভাবতে পারলো না বেশিক্ষণ। উর্মিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দ্রুতপদে মায়ের কাছে ছুটলো সে।
খাদিজা বেগম ড্রয়িং রুমে কুশিকাটার কাজ নিয়ে বসেছেন সকাল সকাল। মীরাকে দেখে সুতা গুলো এক পাশে রেখে দিলেন। এক চিলতে হাসি দিয়ে বললেন,
-‘পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কখন খাবি? উর্মি উঠেছে?’
মীরা মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। জড়িয়ে ধরে ধাতস্থ গলায় বলল,
-‘উঠছে আম্মা। ফ্রেশ হতে গেছে।’
-‘আচ্ছা, তাহলে বস। ও চলেই আসবে, তুই খাওয়া শুরু কর। আমি দিচ্ছি ডাইনিং এ।’
-‘আম্মা, এভাবেই বসে থাকো কিছুক্ষণ। তোমাকে এভাবে ধরে থাকি একটু। ভালো লাগছে খুব।’
খাদিজা বেগম মেয়ের আচরণে খুব খুশি হলেন। মনটা ভরে উঠলো পরম মমতায়। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন, কাছে টেনে নিলেন আরেকটু।
উর্মি এসে বসলো মীরার পাশে। ফ্রেশ হয়ে এলেও এখনও ঘুম ঘুম ভাব পুরোপুরি কাটেনি তার। হাই তুলে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,
-‘মীরু, এবার ছাড়। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে আমার।’
খাদিজা বেগম উর্মির দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখালেন। কন্ঠে কিঞ্চিৎ রাগ মিশিয়ে বললেন,
-‘সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমালে তো ক্ষুধা লাগবেই। আরেকটু ঘুমিয়ে একেবারে দুপুরে উঠতি দুজন।’
রাগ দেখিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সাথে তাড়াহুড়োও দেখা যাচ্ছে তার আচরণে। উঠতে যাবেন তখনি মীরা টে’নে ধরলো। সে নিজে উঠে বলল,
-‘আমি আনছি আম্মা, তুমি বসো।’
উর্মি খাদিজা বেগমের কথা শুনে বলল,
-‘বকো না মামি, রাতে ঘুম হয়নি তো। এই দেখো, না ঘুমানোর জন্য চোখের নিচে কালি পরে গেছে।’
মীরা কিচেন থেকে হাতে দুইটা প্লেট নিয়ে আসতে আসতে কন্ঠ সামান্য উঁচু করে বলল,
-‘ফজরের নামাজ টাও পরে নি আম্মা। আমার থেকে বেশি ঘুমিয়েছিস তুই। আমার কালি পরলো না, আর তোর পরে গেলো? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পেলি না উর্মিমালা!’
-‘কাজা নামাজ পরে নিবো। আর শোন, তোর স্কিন টোন আর আমার টোন এক না। আমার টোন টা কালি কালি বুঝছিস। এজন্য ঘুমাতে হয় একটু বেশি বেশি।’
উর্মির কথার পরিপ্রেক্ষিতে মীরা আর খাদিজা বেগম হেসে দিলো এক সাথে। উর্মির পাশে বসে রুটির প্লেট টা ওর হাতে দিলো মীরা। ডাইনিং আর বসবে না, এখানেই বসে খাবে। পরোটার ছোট্ট এক টুকরোর সাথে ডিম নিয়ে মুখে দিলো। চিবুতে চিবুতে বলল,
-‘আরো বেশি বেশি ঘুমা, বেশি বেশি কালি কালি হবি।’
-‘উল্টা বলিস কেনো?’
-‘উল্টা বললাম কোথায়! তুই দেখ। আমি কম ঘুমিয়ে যদি স্কিন টোন ভালো হয়, তাহলে বেশি ঘুমিয়ে স্কিন টোন কালি।’
উর্মি ক্ষে/পে গেলো মীরার উপর। বোঝায় একটা আর বোঝে আরেকটা। বলেছে তো ওর স্কিন ভালো না। তারপরেও কথা প্যাচাচ্ছে! খাজিদা বেগম দুজনের তর্ক দেখে থামাতে লাগলেন। মীরা আলাভোলা মুখ করে কথার জালে ক্ষে/পিয়ে দিচ্ছে উর্মিকে। জমে উঠেছে রাতের ন্যায় আরেক দফা আড্ডার পসরা।
___________
আকাশি রংয়ের শার্ট পরিহিত সুঠাম দেহের অধিকারী রাইফ অফিসিয়াল কাজ করছে নিজের ডেস্কে। চোখ তার সামনে রাখা কম্পিউটারের স্কিনে। কাজের ফাঁকে ধোঁয়া উড়ানো কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে ছোট্ট করে। এর মধ্যে মুঠোফোন টা বেজে উঠলো। ধ্যানমগ্ন রাইফের ধ্যান ভাঙলো তৎক্ষনাৎ।
ফোনটা প্যান্টের বা দিকের পকেট থেকে বের করে হেলান দিলো, গা ছেড়ে আরাম করে বসলো।
ফাহাদের নাম্বার ভাসছে স্কিনে। বৃদ্ধ আংগুলের সাহায্যে সোয়াইপ করে কানে নিলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,
-‘বল।’
-‘যাবি নাকি আজ রাইডে? দূরে যাওয়ার প্লান আছে আজ।’
-‘আজ সম্ভব না। হাতে কাজ আছে একটা।’
রাইফের হাতে আজ কাজ নেই, তবুও অজ্ঞাত মিথ্যে কথাটা বলতেই হলো। ফাহাদ স্বাভাবিক ভাবেই নিলো রাইফের বিষয়টি। আরো কিছুক্ষণ টুকিটাকি কথা বার্তা বলে ফোন রাখল। রাইফ কালো হাত ঘড়িতেটাতে চোখ বুলিয়ে আশে পাশে তাকালো। ছুটির সময় চলে এসেছে, শেষ সময়ের কাজ টুকু সম্পূর্ণ করার জন্য আবারও হাত দিলো কম্পিউটারের মাউস এ।
____________
পড়ন্ত বিকেলে অলসতা কা’টাতে মীরা চা বানাচ্ছে কিচেনে। উর্মি ডেকে চলেছে রুম থেকে। চুলার আঁ/চ কমিয়ে ছুটলো রুমের দিকে। মীরা গলার স্বর কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল,
-‘কি হয়ছে, গন্ডারের মতো ডাকছিস কেনো?’
-‘তোর কল আসছে। তিনবার বাজলো।’
মীরা ফোন হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল,
-‘কে?’
-‘আননোন নাম্বার।’
-‘তাহলে থাক। কে না কে। দরকার হলে আবার করবে।’
-‘তিন বার করেছে মীরু। প্রয়োজনেই করেছে।’
মীরা মাথা নেড়ে বলল,
-হ্যাঁ, সেটাও ঠিক বলছিস।
কথাটা বলেও কল দিচ্ছে না মীরা। কেনো যেনো ইচ্ছে করছে না কল দিতে। এমনিতেই ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না, তার উপর আননোন নাম্বার। যার দরকার সে আবার কল দিবে বলে উঠে দাঁড়াতেই ভোঁ ভোঁ করে ভাইব্রেট হয়ে রিংটোন বেজে উঠলো। এগারো ডিজিটের শেষ দুই ডিজিট নয়-দুই। উর্মির দিকে তাকাতেই দেখলো উর্মিও তাকিয়ে মীরার দিকে। ইশারায় দ্রুত রিসিভ করতে বলল সে। কল কে’টে যাবে সে মূহুর্তে দ্রুত রিসিভ করল। কানে নিয়ে ধরে থাকলো অপর প্রান্তের কথা শোনার জন্য। কি ব্যাপার, কিছু বলছে না কেনো? মীরার রাগ হলো, স্বাদের মালাই চা বানানো বাদ দিয়ে এখানে কে না কে কল করেছে, তার তামশা দেখবে নাকি এভাবে। বিরক্ত হয়ে কান থেকে ফোন সরানোর জন্য উদ্যত হতেই কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো ভরাট গলার আদেশ করা কন্ঠস্বর,
-‘মীরা, ছাদে আসো একটু। বেশি না, পাঁচ মিনিটের জন্য। অপেক্ষা করছি আমি।
টুট টুট শব্দ করে বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ। মীরার মুখাবয়বে স্পষ্ট বিস্ময় ভাব ফুটে উঠেছে। উর্মির দৃষ্টি গোচর হলো সেটা। তড়িৎগতিতে মীরার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে? মীরা চেহারা স্বাভাবিক করে বলল,
-‘আমি পারবো না যেতে।’
-‘কোথায় যাবি?’
-‘ছাদে।”
মুচকি মুচকি হেসে আহ্লাদে আট খানা হয়ে উর্মি বলল,
-‘রাইফ ভাই?’
মীরা কোনো জবাব দিলো না। হনহন করে হাঁটা ধরলো কিচেনে। বললেই হলো নাকি? কেনো যাবে সে? যাবে না।
উর্মি ছুটলো মীরার পেছন পেছন। কমিয়ে দেওয়া চুলার আঁচ টা মিডিয়াম করে দিলো মীরা। উর্মি তার কাছে এসে বলল,
-‘এখানে এলি যে, যাবি না?’
-‘না।’
মীরার স্পষ্ট জবাব। উর্মি বিস্ময় কন্ঠে বলল,
-‘আল্লাহ মীরু! আজ বাদে কাল উনি তোর হাসব্যান্ড হবে। আর তুই তার কথা শুনছিস না!’
-‘যেদিন হবে সেদিন শুনবো। আমি পারবো না যেতে। তুই জানিস লোকটা কেমন অস/ভ্য!’
-‘কেমন অস/ভ্য? কি করেছে?’
উর্মি কথায় বিস্ময়? মীরা মুখ ফসকে হাতে চুমু দেওয়ার কথা বলতে গিয়েও সামলে নিলো।
আমতা আমতা করে বলল,
-‘উল্টা পাল্টা কথাতে লজ্জায় ফেলে আমাকে।’
মীরার এহেন কথাতে উর্মির বিস্ময় ভরা মুখটাতে দু’ষ্টমির হাসি ফুটে উঠলো। কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-‘ওহহোওওও, শুরু হয়েছে তবে।’
মীরা ভ্রু কুচকে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ রাঙ্গালো। চারটা কাপ নিয়ে চা ঢালবে সে মূহুর্তে উর্মি একটা সরিয়ে ফেলল। মীরা তাকাতেই বলল,
-‘তুই তো ছাদে যাবি। চা খেলে দেড়ি হবে। তুই যা আমি চা নিয়ে যাচ্ছি মামু মামির কাছে।’
মীরা যাবে না বলে আবারও টে’নে নিলো কাপ। উর্মি মৃদুস্বরে ধমকে উঠলো। বলল,
-‘যাবি না কেনো আশ্চর্য! দুই দিন পর যখন বিয়ে হবে তখন লুকাবি কিভাবে? তুই না গেলে রাইফ ভাই যে রকম মানুষ, বাসায় চলে আসবে। বুঝিস তখন।’
মীরা উর্মির কথাতে একটু দমল। হ্যাঁ, উনার কাজ কর্মের কোনো নিশ্চয়তা নেই। হুটহাট কি করে বসে বলা যায় না। যদি বাসায় এসে বলে বসে মীরাকে দরকার, তখন কি করবে সে। লজ্জায় পরে যাবে বাবা মার সামনে। ছিহ ছিহ, এমন টা না হোক। মীরা আরেকটা কাপ সরিয়ে দুইটা কাপে চা ঢাললো। মীরার হাতে দিয়ে বলল,
-‘আব্বাজান আর আম্মাকে দিয়ে আয় দ্রুত।’
-‘আমার চা? শুনে রাখ মীরু, আমি চা খাই। শুধু খাই বললে ভুল হবে, নে*শা উঠলে বালতিতে করে খাই৷ আর তুই কি না আমাকে চা দিচ্ছিস না!’
-‘ছাদ থেকে এসে খাবি। আয় দ্রুত। আমার সাথে যাবি তুই।’
উর্মি আশ্চর্য হলো আরেক দফা। কথা বলার জন্য ঠোঁট দুটো ফাঁক করবে তখনি হনহন করে পাশ কেটে চলে গেলো। যেতে যেতে বলল,
-‘তুই না গেলে আমিও যাবো না ফাইনাল।’
চলবে…..
#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৩
🍁
গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ মুখে এগিয়ে যাচ্ছে মীরা এবং উর্মি। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। ছাদের কাছাকাছি আসতেই ধীর হলো মীরার হাঁটার গতি। কিছুটা পিছিয়ে গেলো উর্মির থেকে। পা ফেলছে কোনোরকমে, অবশ অবশ লাগছে মীরার। উর্মির জোর করে পরিয়ে দেওয়া লাল ওড়নাটা টেনে মাথাটা পুরোপুরি ঢেকে নিলো। ঢিপঢিপ করে কাঁপছে হৃদয়।
রাইফের সামনা সামনি হতে মীরার এখন সংকোচ হয় অনেক। যে লোকটাকে সে জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে বলেছিলো, সে সত্যি সত্যি স্বপ্ন টাকে বাস্তব করে দিচ্ছে কয়েক দিনের ব্যাবধানে।
ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকেই তাকিয়ে রাইফ। তার গভীর চোখ দুটো প্রেয়সীর অপেক্ষায়। পায়ের আওয়াজ শুনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাইফ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাতে রাখা মুঠোফোন পকেটে গুজলো।
ছাদের দরজা দিয়ে উর্মি ঢুকল প্রথমে। তাকে দেখা মাত্র রাইফের মুখটা ভারাক্রান্ত হলো। আসতে বলল মীরাকে আর এলো কে? এই মেয়েটা এবার সত্যি সত্যি ওর ঘরে আনতে হবে। সময় দিচ্ছে তো, গায়ে লাগছে না ওর। রাগ হলো খানিক, বিরক্তও হলো সাথে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে উর্মির পেছন তাকাতেই ছলাৎ করে উঠলো বুকের বা পাশটা। ওইতো কাংখিত নারী, পরনে সাদা সালোয়ার-কামিজের সাথে মাথায় লাল ওড়না। কি স্নিগ্ধ সুন্দর লাগছে। ধবধবে সাদা মেঘের মাঝে যেনো মীরার লাল ওড়না পেঁচানো আদলটুকু রক্তিম সূর্য ন্যায় দীপ্তি ছড়াচ্ছে চতুর্দিক।
সাদা পোশাকে পবিত্র লাগছে ভীষণ। লালের মাঝে ফর্সা মুখাবয়ব টা ফুটে উঠেছে বেশ।
নীচু দৃষ্টিতে এগিয়ে আসা মীরা আকাশি রঙের শার্ট পরিহিত রাইফকে এক পলক দেখেছে। নজর নিম্নে আবদ্ধ করেই উর্মির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রাইফ এর সাথে বেশ ব্যাবধান নিয়েই দাঁড়িয়েছে সে।
হাসি মুখে উর্মির সাথে কুশল বিনিময় করে রাইফ এর চোখ ঘুরে ফিরে মীরার দিকেই ছুটে যাচ্ছে। মন ভরে দেখার জন্য ছটফট করছে চোখের কালো মনিটা।
কিন্তু একটা সুক্ষ্ণ বিপত্তি দেখা দিলো। মাঝে উর্মি দাঁড়ানোতে ঠিক মতো দেখতেও পাচ্ছে না রাইফ। গুনে গুনে পাঁচ দিন পর দেখা, আর এই মেয়ে কিনা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে, রাইফের উঁকি মেরে দেখা লাগছে। হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো। রাগ হলো সাথে বিরক্তও। জোরপূর্বক মুখে বোকাসোকা একটা হাসি ঝুলিয়ে ভণিতা না করে সরাসরি রাইফ উর্মিকে বলে উঠলো,
-‘এখানে কেনো আসছো উর্মি? কাবাব মে হাড্ডি হতে?’
-‘আমি হাড্ডি হতে চাই নি রাইফ ভাই। আমাকে জোর করে বানানো হইছে।’
মীরা মাথা নিচু করেই গাল ফুলালো কিন্তু কিছু বলল না। রাইফ পুনরায় উর্মিকে বলল,
-‘তাহলে তোমার ইচ্ছা নেই কাবাবের হাড্ডি হওয়ার?’
কন্ঠে জোর দিয়ে জবাব দিলো উর্মি,
-‘মোটেও না। আমি ওতোটাও মীর জাফর না যে আপনাদের মাঝে এসে দাঁড়াবো।’
তাৎক্ষণিক বা ভ্রুটা উঁচু করে রাইফের সহজ সরল জবাব,
-‘দাঁড়িয়েই তো আছো।’
উর্মি দ্রুত দুজনের মাঝ হতে সরে আসলো। সত্যি সত্যি সে যে বেখেয়ালি তে দাঁড়িয়ে আছে দুজনের মাঝে বুঝতেই পারে নি। লজ্জা পেলো কিন্তু প্রকাশ করলো না। মীরার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বলল,
-‘মীরা পেছনে আসছে জন্য পেছনে পরছে৷ দোষ ওর।’
মীরা চোখ বড়সড় করে উর্মির দিকে তাকালো। রাইফ কথা বাড়ালো না। সময় নষ্ট হচ্ছে, এখন কথার প্রেক্ষিতে কথা বাড়ালে ওর নিজের ই লস। তাই সুক্ষ্ণ কৌশলের সহিত বলল,
-“দোষ আমার, আমার ই উচিত ছিলো ওপাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এবার তাহলে কি করা উচিত তোমার বলো তো?
উর্মি রাইফের কথার ধরণে হেসে দিলো। মীরা বারংবার উর্মিকে মাথা নেড়ে না করছে। অনুরোধের সুরে বলল ,
-‘উর্মি, এটা করিস না। যাবি না, প্লিজ যাস না।’
উর্মি কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,
-‘পেয়েছিস কি দুজন। একজন নিচে ঠেলে তো আরেক জন উপরে। এ ভাই, তোরাই নিচে যা। আমি এখানে থাকি।’
মীরা এগিয়ে গেলো উর্মির দিকে। আবারো অনুরোধ করছে যেনো চলে না যায়। কিন্তু উর্মির চেহারা বলছে সে মীরার মতামত কে গ্রাহ্য করছে না একটুও। রাইফ সুক্ষ্ণ ইশারা দিলো উর্মিকে যার অর্থ
‘ভালো মেয়ের মতো এবার ফটাফট একটা দৌড় দাও তো বাসার দিকে।’
বুদ্ধিদীপ্ত উর্মি ইশারার মানে ধরে ফেলল সহজেই।
মূহুর্তেই দ্রুত পায়ে মীরাকে পাশ কেটে চলে গেলো, মীরা বাঁধা দেওয়ার সময় টুকু পর্যন্ত পেলো না। তাজ্জব বনে গেলো উর্মির কান্ডকারখানা দেখে। ভয় মিশ্রিত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকলো সিঁড়ির দরজার দিকে। কি হবে এখন? উর্মি বাসায় গেলে আব্বাজান যদি জিজ্ঞাস করে মীরার কথা তখন কি ও বলে দিবে রাইফের সাথে ছাদে থাকার কথা! ছিহ ছিহ! এ কেমন পরিস্থিতিতে পরলো ও। চোখ নামিয়ে নিতেই হুট করে উর্মি আবারও দৌড়ে প্রবেশ করলো ধপাধপ শব্দ করে। মীরার সম্মুখে এসে বলল,
-‘টেনশন করিস না। আমি সিঁড়িতেই বসে আছি তোর জন্য।’
কথাটুকু বলেই উর্মি যেভাবে তড়িৎগতিতে এসেছিলো সেভাবেই প্রস্থান করলো সেখান থেকে৷ মীরা স্বস্তি পেলো, কিন্তু রাইফের কথা ভেবে অস্থির মনটাকে স্থির করতে পারলো না পুরোপুরি। সময় কে/টে গেলো কিছুক্ষণ ওভাবেই। রাইফ রেলিং এ হেলান দিয়ে
নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে ডেকে উঠলো,
-‘মীরা?’
রাইফের দিকে তাকালো না মীরা। দৃষ্টি নিচে রেখেই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো,
-‘জ্বী’
-‘ভ/য় পাচ্ছো?’
মীরা অকপটে স্বীকার করলো। ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘কিছুটা’
-‘কিছুটা না, অনেকটায় মনে হচ্ছে। দেখি, এদিকে আসো।’
রাইফের ইশারায় নির্দেশ করা জায়গায় দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি করে দাঁড়ালো মীরা।
রাইফ মুচকি হাসলো। কৌতূহল সুরে শুধালো,
-‘আমাকে ভয় পাচ্ছো?’
মীরা নিশ্চুপ। এখানে আর কে আছে যে উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে! রাইফ জানে ওর প্রশ্নের উত্তর মীরা দিবে না। মীরার দুরুদুরু মনটা হালকা করতে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
-‘ফর্ম ফিলাপ কমপ্লিট?’
-‘জ্বী।’
-‘কখন আসছো বাসায়?’
-‘রাতে।’
-‘এক্সাম কবে হওয়ার সম্ভাবনা?’
-‘এক দু মাস পরেই।’
রাইফের মুখাবয়ব ভাবুক হলো। কিছু ভেবে ভরাট গলায় শীতল কন্ঠে পুনরায় ডেকে উঠলো,
-‘মীরা?’
মীরা কেঁপে উঠলো। সবাই তো ওকে মীরা বলেই ডাকে। কিন্তু রাইফের গলায় মীরা ডাকটা তাকে শিরশিরে অনুভূতি দেয়। কেঁপে তুলে শিরা উপশিরা। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে জবাব দিলো সে,
-‘জ্বী’
রাইফের পুরুষালি কন্ঠস্বর আদেশ সূচকে বলল,
-‘আমার দিকে ঘুড়ে দাঁড়াও।’
মীরার কি হলো জানে না। ননীর পুতুলের ন্যায় ঘুরে রাইফের সামনাসামনি হয়ে দাঁড়ালো।
রাইফ এক কদম এগিয়ে এলো মীরার দিকে। আপাদমস্তক পরখ করলো মীরার। ওড়নার একটা সুতা কখন থেকে টেনেই যাচ্ছে সে। রাইফ নম্র গলায় বলল,
-‘সুতাটাকে রেহাই দিয়ে একটু আমার দিকে তাকাবা?’
মীরা সুতা ছেড়ে দিলো সাথে সাথেই। রেহাই তো দিলো ঠিকি কিন্তু রাইফের দিকে তাকাতে পারলো না। রাইফ কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে আরো শীতল কন্ঠে বলল,
-‘আজ আর তোমাকে লজ্জায় ফেলবো না মীরা। শুধুই দেখবো। একটু দেখি তোমাকে?
রাইফের কন্ঠ থেকে শুরু করে চোখে মুখে আকুল আবেদন ঠিকরে পরছে মীরাকে দেখার। তীব্র মনোবাসনা বেঁধেছে বুকের ভেতর। আরো এক কদম এগিয়ে নম্র কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে পুনরায় বলল,
-‘মাথাটা তোলো প্লিজ, তাকাও আমার দিকে।’
মূহুর্তেই বশবর্তী হলো রাইফের ঠন্ডা কন্ঠের আকুল আহ্বানে। মিশমিশে কালো পল্লবের আঁখিদ্বয় মেলে তাকালো রাইফের পানে। নজর আবদ্ধ হলো রাইফের শান্ত স্থির চোখ দুটিতে। অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে রাইফ। মুখে তার অনিন্দ্য সুন্দর মুচকি হাসি লেপ্টে আছে। দুষ্ট মিষ্ট চাহনি নেই আজ। খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি, পরিপাটি চুল। আকাশি রংয়ের শার্ট আঁটসাঁট ভাবে লেগে আছে বলিষ্ঠ দেহে। উপরের দু বোতাম খোলা। হাত দুটো কালো প্যান্টের পকেটে গুজে দাম্ভিকতার সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। মীরার ডাগর ডাগর চাহনিতে মুচকি হাসি প্রসস্থ হলো রাইফের। মীরা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। রাইফের আজকের চেহারা এবং চোখদুটোতে ভালোলাগা ফুটে ওঠেছে, প্রেয়সীর নজরে নজর রেখে আচ্ছন্ন হয়েছে ভালোবাসায়। প্রকৃতিতে শিরশিরে হাওয়া বইছে। তুলোর মতো পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। নীলাভ বিশাল আকাশের নীচে ছাদে দাঁড়িয়ে দুজন। একজন লজ্জায় টুইটুম্বুর হয়ে নজর ফিরিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে তো অন্যজন অপলক নয়নে মন জুড়িয়ে নিচ্ছে। আসলেই কি জুড়িয়ে যাচ্ছে? যদি জুড়িয়েই যেতো তবে কেন একের পর এক অবাধ্য ইচ্ছে গুলো হানা দিচ্ছে তার হৃদয় কুঠরে! মাঝের সামান্য ব্যাবধান টুকু ঘুচিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ক্রমশ বাড়ছে কেনো তবে? পারছে না আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে, পাচ্ছে না ওড়নার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা চুল গুলো কানে গুজে দিতে। এই যে দেখছে, দেখেই যাচ্ছে তবুও মন ভরছে না কিছুতেই। রাইফের মনে হচ্ছে তু/লে বাসায় নিয়ে রেখে দিতে। আরাম করে বসে দেখা যাবে। চুপটি মেরে বসে থাকা মীরাকে রাতদিন ভর দেখবে সে।
সময়ের পর সময় চলে যাচ্ছে, রাইফ এর নজর সরছেই না মীরার থেকে। কখনও নাকে, গালে, চোখে তো কখনও মীরার সরু পাতলা গোলাপি অধরে।
রাইফের অনিমেষ চাহনিতে মীরার সংকোচ বাড়তে থাকল। কাঁচুমাচু করে রাইফের দিকে তাকিয়ে অনুমতি নেওয়ার স্বরে বলল,
-‘এবার যাই?’
রাইফ দুদিকে মাথা নাড়ালো। তার অর্থ ‘না’। মীরা বাধ্যগত মেয়ের মতো আবারও নিরব হলো। রাইফ পকেট থেকে হাত বের করে বলল,
-‘আমার নাম্বারটা সেভ করে নিও। রাতে কল দিব।’
মীরা মাথা তুলে তাকালো। চোখে চোখ রেখে ধীর আওয়াজে বলল,
-‘আপনি আমার নাম্বার কবে নিলেন, কার কাছ থেকে নিলেন?’
রাইফ জবাব দিলো না। রহস্য ময় বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললো শুধু। মীরার মনে জাগা একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় থেকেই। রাইফের জবাব না পেয়ে মীরা পুনরায় শুধালো,
-‘আমিতো তখন কথা বলি নি, কি করে বুঝলেন কলে আমি ছিলাম?’
রাইফ বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করল। মাথাটা মীরার দিকে ঝুঁকে উল্টো প্রশ্ন করল,
-‘আমার লাজুকলতা ব্যাতীত তোমাদের বাসায় কল রিসিভ করে নিরব থাকার মতো কি কেউ আছে মীরাবতী?’
রাইফের মুখে উচ্চারিত ‘লাজুকলতা এবং মীরাবতী’ সম্বোধন শুনে মীরা লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ খিঁচে ফেলল তৎক্ষনাৎ। এখানে আর কোনো ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না সে। কোনো রকমে মিন মিন করে বলল,
-‘আসছি।’
রাইফের জবাবের অপেক্ষা না করেই মীরা ঘুরে হাঁটা শুরু করলো। মীরার লজুক মুখ দেখে রাইফের মুখে অমায়িক হাসি ফুটলো। দুষ্টমি খেলা করলো মস্তিস্কে। কন্ঠ উঁচু করে ডেকে উঠল,
-‘মীরা?’
প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকাল মীরা।
রাইফ ডান হাত টা বুকের বা পাশে নিলো। ইশারায় বুকের বা পাশটা দেখিয়ে দুষ্টমি মাখা কন্ঠে বলে উঠলো,
-“দেড়ি কিসের তবে, দ্রুত এসো। বুকের বা পাশ টা শুধুই তোমার জন্য বরাদ্দ। অপেক্ষায় তোমার জন্য।’
চলবে……