#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২০
🍁
হতবিহ্বল নয়নে সামনের দৃশ্য দেখে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিলো মীরা। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে পরখ করলো বাসার সবাই উপস্থিত এখানে৷ ফুপুজান ও চলে এসেছেন। বুঝতে আর বাকি রইলো না কিছুই।সবটাই তার সামনে পরিষ্কার। বাসার সদস্য ব্যাতিত আরো তিন জন উপস্থিত। প্রবীণ লোকটি কে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনে না, দেখেও নি সে। বসে থাকা মহিলাটাকে দেখেছে মাঝে মাঝে। মীরা এদের দুজনকে স্পষ্ট ভাবে না চিনলেও শিনা টান টান করে বসে থাকা অভ’দ্র, বেহা’য়া, দু’ষ্ট দু’ষ্ট কথার জালে ফাঁ/সানো রাইফকে সে চিনে ঠিকই। পাশে বসা মহিলাটা যে তার মা আজ এক সাথে দেখে নিশ্চিত হলো। দুজনের চেহারায় মিলও রয়েছে অনেক। মীরার রাগ হলো খানিক। যার জন্য দেড়ি করে বৃষ্টিতে ভিজে এলো জুবুথুবু হয়ে, সেই আগে ভাগে এসে বসে আছে একেবার তাদের বাসার ভেতর৷ তাও আবার অতিথি হয়ে। “যেখানে বা’ঘের ভ!য় সেখানেই সন্ধ্যা হয়” প্রবাদ টা আজ খাপে খাপ মিলে গেছে তার সাথে। এতো কিছুর ভেতর আরো আশ্চর্য হচ্ছে মীরা। এখানেই আসবে, অথচ তার ভাব ভঙ্গিতে একটুও বোঝা যায় নি। কি ধু’র’ন্ধর লোক একটা! উর্মিও কম অবাক হয়নি রাইফ এবং রাজিয়া বেগম কে দেখে। কেমন টেক্কা দিলো রাইফ তাদের! উর্মি অবশ্য খুশিও হয়েছে বেশ। যাক, ঘটনা তাহলে ঘটেছে। তার টোটকা লেগেছে জায়গা মতো। এবার দুজনের মিল হবেই হবে।
মীরার চোখ পরলো খাদিজা বেগমের চোখে। তিনি আশ্বস্ত করলেন, স্বাভাবিক হতে বললেন ঘাড় নেড়ে। ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো। জড়তার সহিত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল মীরা,
-‘আস সালামু আলাইকুম।’
-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
উচ্চস্বরে সালামের জবাব দিলো প্রায় সবাই। কিন্তু একজনের সালাম টা ছিলো দীর্ঘ এবং সবার থেকে একটু উচ্চ আওয়াজে। মুচকি হাসি লেপ্টে আছে তার চোখে মুখে। মীরাকে কাছে ডাকলেন ইশারায়। মীরা নজর ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাতেই উনি মাথা নাড়লেন। ছোট ছোট পা ফেলে রাজিয়া বেগমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আর এক হাত পরিমাণ দূরেই বসে আছে রাইফ। কেমন বেহা/য়ার মতো তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। এতো মানুষের মাঝেও তার ধ্যান পুরোটুকুই মীরার উপর। রাজিয়া বেগম মীরার হাত ধরে পাশে বসাতে চাইলেন। কিন্তু মীরা কাঁচুমাচু করে বাধা দিলো, আমতা আমতা করে বলল,
-‘আমার শরীর ভেজা আন্টি। আমি বরং এখানে বসি।’
সোফার এক কোনা থেকে বেতের মোড়া টেনে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসবে তখনি রাজিয়া বেগম তার দিকে মোড়াটা টেনে কাছে আনলো। হাসি লেপ্টেই আছে তার মুখে প্রথম থেকে। ইশারায় বসতে বলল তাকে। মীরা রাজিয়া বেগমের পাশে বসলো উশখুশ করতে করতে।
মীরার বুক ধরফর করছে। স্বাভাবিক নেই তার হৃদ স্পন্দন। এ মূহুর্তে একটু বেশি তার গতি। এই যে পাশেই বসে রাইফ, খুবই নিকটে। প্রথম দিনের সেই পুরুষালী ঘ্রাণ টা আজ ও তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। এতোটা কাছাকাছি তাদের অবস্থান পরিবারের সবার সামনেই, এমনটা তো তো সে এতো দ্রুত আশাই করে নি।
রাজিয়া বেগম খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন মীরাকে। থুতনিতে স্নেহের হাত রেখে শুধালেন,
-‘কেমন আছো মীরা মা?’
শুষ্ক অধর যুগল জ্বিহবার ডগার সাহায্যে ভিজিয়ে মীরা মিহি কন্ঠে বলল,
-‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম মামনি।’
-‘মাফ করবেন অপেক্ষা করানোর জন্য। জ্যাম ছিলো, তাই একটু দেড়ি হয়ে গেছে।’
রাজিয়া বেগম তার বিপরীত পাশে বসা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-‘বড় ভাই, দেখছেন। এই হলো মীরা। যার জন্য আসছি। মাশাল্লাহ, কি সুন্দর দেখতে তাই না!
প্রবীণ লোকটি রাইফের বড় চাচা। গাল ভর্তি হাসি দিয়ে ভারী গলায় বললেন,
-‘মা শা আল্লাহ!। খালাম্মার মতো দেখতে অনেকটা। তাই না শওকত ভাই।’
শওকত রহমান হাসলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘জ্বী ভাই। আম্মাজানের মতোই দেখতে আমার এই আম্মাজান। শুধু দেখতে না, কাজে কর্মেও অনেক মিল।’
-‘মীরাকে দেখেই আমার খালাম্মার কথা মনে পড়লো। কি স্নেহটাই করতেন আমাকে। দেখা হলেই ডেকে বলতেন, এই জয়নুল, বাসায় আসো না কেনো? আসো, একটু আলাপ করি৷’
এক কথার প্রেক্ষিতে অনেক কথায় অতীতের স্মৃতি চারণ করতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো সবাই। কিন্তু মীরার অস্বস্তি হচ্ছে খুব। বোরকার নিচের অংশ টুকু জবজবে ভেজা। এই অবস্থাতে এখানে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বসা। তার উপর নিলজ্জর মতো রাইফের অবাধ্য দৃষ্টি আরো বেশি অস্বস্তি তে ফেলছে তাকে। রাইফের দিকে না তাকিয়ে ও বুঝতে পারছে তার চাওনি। কি করে পাচ্ছে এতো গুলো মানুষের সামনে এভাবে তাকিয়ে থাকতে? একটু তো লজ্জা শরম করা দরকার! আমতা আমতা করে মীরা রাজিয়া বেগমকে কিছু বলবে সে মূহুর্তে রাইফ এর কন্ঠ কানে আসলো। রাজিয়া বেগম কে বলছে সে,
-‘আম্মা, এবার ছাড়ো ওকে। ভেজা শরীরে ঠান্ডা লাগবে।’
রাইফের কথো শোনা মাত্রই মীরার কেনো যেনো জেদ হলো খুব। দেখেছে ভেজা ঠিক আছে, উনাকেই কেনো মাতব্বরি করে বলতে হবে আম্মা ওর ঠান্ডা লাগবে। ঢং! কি ভাববে সবাই। ছিহ্, মুখ ই দেখাতে পারবো না কাউকে। ইচ্ছা তো করছে এই লজ্জায় দৌড়ে চলে যেতে এখান থেকে, কিন্তু যাবে না সে। উনার কথাতেই কেনো যেতে হবে? রাজিয়া বেগম মীরার পায়ের দিকে লক্ষ্য করে তাড়াহুড়ো করে বললেন,
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভিজে গেছো তো। দেখেছো আমার কাজ। মনেই ছিলো না। যাও, চেঞ্জ করে নাও দ্রুত।’
মীরা রাইফের পানে আড়চোখে তাকালো একবার। এই লোকটা কি ঠিক হওয়ার না নাকি! এখনও কেমন ড্যাবডাব করে তাকিয়েই আছে। মীরার হালকা পাতলা জেদ এবার উঠে গেলো তুঙ্গে। রাইফ কে শোনানোর জন্য মিষ্টি মিহি কন্ঠটা একটু উঁচু করে রাজিয়া বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,
-“অস্থির হবেন না আন্টি। ঠিক আছি আমি। এতো সহজে ঠান্ডা আমার লাগবে না।’
বলতে দেড়ি, মীরার হাঁচি আসতে দেড়ি না। একবার হাঁচি দিয়েই ক্ষান্ত হলো না সে। পর পর তিনবার। রাইফ তার দমফা/টা হাসি চা;পা’লো কোনো রকমে। কিন্তু উর্মি আর সেটা পারলো না। হেসে দিলো শব্দ করে। মীরা লজ্জা পেলো, ভীষণ লজ্জা। চোখ উঁচু করে তাকালো না কারো দিকেই। ধীরে সুস্থে ওঠে হাঁটা ধরলো রুমের দিকে। মীরার মনে হচ্ছে রুমটা হাজার মাইল দূরে। এতো সময় লাগছে কেনো যেতে?
______________
মীরা বসে আছে নরম বিছানায়। পিঠে ছড়িয়ে থাকা আধো ভেজা খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ছে। বাহির থেকে গল্প গুজব, হাসি ঠাড্ডার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে। উর্মি বারান্দায় কাপড় নেড়ে দিয়ে রুমে এসে বসতেই খটখট করে মৃদু শব্দ হলো দরজায়। মীরা পেছন ঘুরে তাকিয়ে দ্রুত ওড়নাটা মাথায় টেনে নিলো। উর্মি চেঁচিয়ে বলল,
-‘খোলা। ভেতরে আসেন।’
শওকত রহমান রুমে প্রবেশ করলেন। সাথে খাদিজা বেগম ও পেছন পেছন আসলেন তার সহিত। দরজা লাগালেন নিঃশব্দে। শওকত রহমান বসলেন মেয়ের পাশে। খাদিজা বেগম চেয়ার টে’নে বসবেন সে মূহুর্তে শওকত রহমান বললেন,
-‘তুমি বসছো কেনো? যাও, পরে এসো। বাবা-মেয়ের আলাপে থাকা যাবে না।’
খাদিজা বেগম গাল ফুলালেন। তার মেয়ের সাথে কথা বলবে আর তাকেই রাখতে চাচ্ছে না? শওকত রহমান প্রিয় সহধর্মিণীর মলিন মুখটা দেখে কিঞ্চিৎ হাসলেন। খাদিজা বেগম রাগে বি/স্ফো/রণ হওয়ার আগেই বললেন,
-‘ভুল হয়ে গেছে আমার। আর গাল ফুলিয়ো না। বসো।’
খাদিজা বেগম বসলেন। এর মাঝে উর্মিও বসে পরলো মামুজানের গা ঘেষে। শওকত রহমান তাকাতেই উর্মি বলে উঠলো,
-‘আমি কি বেশি হলাম নাকি মামুজান। একটু বসি? অল্প একটু’
আগে যদিও সুন্দর মতো বসা ছিলো। যখন দেখল শওকত রহমান কিছু বলছে না, আরাম করে পা তুলে বসলো উর্মি।
শওকত রহমান ধীরে সুস্থে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘আপনি বুদ্ধিমতী মেয়ে আমার। উনারা কেনো এসেছেন নিশ্চয় বুঝাতে হবে না আপনাকে। রাইফ ছেলেটা দেখতে-শুনতে, আদব-কায়দায় ভালো। পাঁচ তলায় থাকে। ভালো জব ও করে। আপনার কি পছন্দ হয়? আমি কি কথা আগাবো আম্মাজান?
শওকত রহমান কথাটা শেষ করতেই উর্মি ধুমধাম হ্যাঁ বলে ফেলল মীরার আগেই। তিন জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহাম্মক হলো সে। বুঝলো সুক্ষ্ণ একটা ভুল সে করে ফেলেছে। তাই তো দ্রুত জিভ কে/টে বলল,
-‘আমার জন্য না। মীরার জন্য হ্যাঁ। ভুল বোঝেন কেনো?’
সবার দৃষ্টি আবার গেলো মীরার উপর। খাদিজা বেগম মেয়ের আরো নিকটে আসলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-‘তোর বাবার কথা বুঝতে পারছিস? দেখ মা, বিয়ে কিন্তু করতেই হবে। ছেলেটা আসলেই ভালো। তারপরেও তোর যদি অসুবিধা থাকে বলে দে। আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ‘
মীরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তবে সে বুঝতে পারছে আম্মা এবং আব্বাজানের পছন্দ হয়েছে তাদের। পছন্দ না হলে কখনও রাইফকে ভালো বলতেন না, তার হয়ে কথাও বলতেন না।
শওকত রহমান তাগদা দিলেন। বাহিরে অপেক্ষা করছে তারা। মীরা নিচু গলায় বিচক্ষণতার সহিত উত্তর দিলো,
-‘আপনার যদি পছন্দ হয় তবে আমার কোনো আপত্তি নেই আব্বাজান।’
মেয়ের আচরনে সন্তুষ্ট হলেন শওকত রহমান। মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছেন বলে ভেতর ভেতর গর্বিত অনুভব ও করলেন। কাছে টেনে চুমু আঁকলেন মেয়ের কপালে। মীরার জবাব আরেকটু পরিষ্কার ভাবে শোনার জন্য বললেন,
-‘আমি কি তবে তাদের হ্যাঁ বলে দিবো আম্মাজান?’
-‘জ্বী। দিতে পারেন।’
কন্ঠ কাঁপছে মীরার। জড়িয়ে যাচ্ছে কথা। ঢোক গিলে চোখ বুজে নোনা জল গুলো আর বাহিরে আসতে দিলো না সে। হজম করে নিলো তখনি। বাবা মাকে ছেড়ে তার চলে যাওয়ার প্রহর চলে এসেছে যে খুব নিকটে।
চলবে….
#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২১
🍁
গম্ভীরমুখে ড্রয়িং রুমে বসে রাইফ। বাহির টা তার বিস্তৃত নীল আকাশের মতো শান্ত হলেও ভেতর উত্তাল ঢেউ এর মতোই অশান্ত। অস্থির হয়ে উঠেছে বক্ষপিঞ্জর। ডামাডোল বাজছে বুকের বা পাশে। ভেতর জুড়ে চরম উত্তেজনাও কাজ করছে তার। মীরা যদি না করে দেয় তবে কি করবে সে? কিভাবে মানাবে? মীরার এমন জবাবে সে কি রাগ করবে নাকি হৈচৈ করবে? নাকি শান্ত হয়ে বসেই থাকবে? মাথা শূন্য লাগছে তার। কিছুই জানে না সে, বোঝেও না এবং বুঝতেও চায় না। শুধু জানে তার শান্তি চাই, এই এক জীবনে শান্তি পেতে হলে মীরাকে তার চাই ই চাই।
শওকত রহমান বেরিয়ে আসলেন। সবার নজর গেলো উনার উপর। মূল আকর্ষণ এখন তিনি। কি জবাব হতে পারে মীরার? তার চেহারা দেখে তো বোঝা যাচ্ছে না একটুও। রাইফের নজর গেলো শওকত রহমানের পেছন পেছন আসা উর্মির উপর। মুখটা একেবারে শুকনো লাগছে, বিষন্ন হয়ে আছে। তাহলে কি! না না, অসম্ভব! যেখানে সে ভাবতেই পারছে না সেখানে মেনে নিবে কি করে? র/ক্তি/ম গম্ভীর চোখ দুটো নিস্তেজ হয়ে আসছে চিন্তায়। একবার পলক ঝাঁপটিয়ে আবার খুললো। শওকত রহমান বসে রাইফের দিকে একটু তাকিয়ে তার বড় চাচার পানে তাকালেন। ধাতস্থ গলায় বললেন,
-‘আলহামদুল্লিল্লাহ ভাইসাব। আমার আম্মাজান সম্মতি দিয়েছেন। যেখানে আমার আম্মাজানের কোনো অসম্মতি নেয় সেখানে আমারও কোনো অসুবিধা নেই। একটা পবিত্র সম্পর্কে আমরা এখন বাঁ/ধা পরতেই পারি।’
সমস্বরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো সবাই। রাইফের শুষ্ক হৃদয়ে শওকত রহমানের ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা কথাটা গ্রীষ্মের ত/পদা/হে হাঁসফাঁস অবস্থাকে হঠাৎ আসা এক পশলা বৃষ্টির মতো তার হৃদয়টা কে শীতল করে তুললো। এতোক্ষণের তী;ক্ষ্ণ য/ন্ত্র/ণা দেওয়া চাপা দীর্ঘশ্বাস টা অধর যুগল কিঞ্চিৎ ফাঁকা করে ছেড়ে দিলো ধীরে ধীরে। কপালের উপর জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছে নিলো বা হাতের উল্টো পিঠে। মীরার ময়াময়ী মুখটা দেখতে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হামলে পরলো মনের গহীনে। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়াও আদায় করে নিলো দ্রুত।
শওকত রহমানের কথার প্রেক্ষিতে হাসি ফুটেছে সবার মুখেই। ব্যাস্ত হয়ে পরেছেন যার যার মতো আনন্দ ভাগাভাগি করতে। উর্মিও বসে এক কোণায়। রাইফের চোখ চোখ পারতেই এক গাল হেসে দিলো। রাইফ মিছেমিছি রাগের আভা ফুটে তুললো মুখে। এই মেয়ে বড্ড পাঁজি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। না জানি কার ঘাড়ে পরে ওর নাজেহাল করে ছাড়ে।
সানজিদা বেগম খুশিতে আত্নহারা। তিনি তো ভাতিজির এই উত্তরের জন্য কখন থেকে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে যাচ্ছেন। দ্রুত গিয়ে মিষ্টি এনে মিষ্টি মুখ করালেন সবাইকে।
রাজিয়া বেগম ছুটলেন মীরার রুমের দিকে। খুশিতে মীরাকে জড়িয়ে মিষ্টি একটা আদর দিতে ইচ্ছা করছে তার। মীরা মাত্র দাঁড়িয়েছে বিছানা থেকে তখনি পেছন থেকে কারো আচানাক স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। পেছন ঘুরে রাজিয়া বেগমের হাস্যজ্বল মুখ দেখে সেও ছোট্ট একটা মুচকি হাসি ফোটাল মুখে। রাজিয়া বেগম কাছে টানলেন, ছোট্ট করে একটা চুমু বসালেন মীরার কপালে। মমতা ভরা কন্ঠে বললেন,
-‘আমি যে কি খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না মীরা। আমার একটা মেয়ে পেলাম আমি।
মেয়ে না থাকার আফসোস আমার আর নেই।’
মীরা কি বলবে ভেবে পেলো না। কথার প্রেক্ষিতে একটা মিষ্টি মুচকি হাসি ফেরত দিয়ে চুপচাপ থাকায় উত্তম মনে করলো সে।
________
সবাই নৈশভোজে বসেছে এক সাথে। হরেক রকম সুস্বাদু খাবারে ডাইনিং ভর্তি। খাদিজা বেগম খাবার পরিবেশন করছেন। কখন কার কি দরকার তাতেও নজর রাখছেন।
মীরা অনুপস্থিত। এক সাথে খাওয়ার জন্য ডেকেছিলো সবাই, কিন্তু মীরা অনুরোধ করেছে সে পরে খাবে। শওকত রহমান মেয়ের মনের অবস্থা বুঝে আর জোর করেননি।
আনন্দ ফুর্তি, হাসি ঠাড্ডা, খোশ গল্প চলছে অনেক ক্ষণ। এতো কিছুর ভেতর মীরা একবারও তার নিজস্ব রুমের বাহিরে আসে নি। মীরার কেমন যেনো আজ খুব সংকোচ হচ্ছে রাইফের সামনে আসতে। এইতো সন্ধ্যায় ও রাইফের প্রতি স্বাভাবিক ছিলো তার অনুভূতি। কিন্তু এখন যেনো পাহাড়সম লজ্জা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে। নাম না জানা কিছু অনুভূতি মনের কোণায় বাসা বেঁধেছে। এই অনুভূতি গুলো য/ন্ত্র/ণা দিচ্ছে না ঠিকই, আবার তাকে স্বাভাবিক থাকতেও দিচ্ছে না। অনুভূতি গুলো স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, মীরা আজ রাইফের নজরে নজর রাখতে পারবে না কিছুতেই।
__________
রাজিয়া বেগম বিদায় বেলায় শওকত রহমানের কাছে আবদার করে বসেছেন মীরাকে আংটি পরিয়েই রেখে যাবেন তিনি। শওকত রহমান প্রথমে দ্বীধায় ভুগছিলেন অনেক। তার একমাত্র বোন জামাই কে রেখে কিভাবে এই কাজ টা সম্পন্ন করবেন। আত্নীয় স্বজনকে বলার ও তো একটা ব্যাপার আছে। অবশেষে ফোনে উর্মির বাবা যখন জানালেন তিনি আসছেন তাদের বাসায়, তখন দ্বীধা খানিকটা কে/টে গেলো তার। সম্মতি রাখলেন রাইফের আম্মার প্রস্তাবে।
রাজিয়া বেগমের পাশেই জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে মীরা। তার পাশেই সামান্য ব্যবধান রেখে বসেছে রাইফ। বলিষ্ঠ দেহের পুরুষটা দাম্ভিকতার সহিত মাথা উঁচু করে বসে থাকলেও মীরা নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে যথাসম্ভব। মাথা তার অবনত। হালকা গোলাপি রঙের ওড়নার কোণা খুঁটিয়ে যাচ্ছে নিরবে।
নিজের হাতের চকচকে আংটি টা খুলে মুঠোয় নিলেন রাজিয়া বেগম। রাইফ কে ইশারায় ডেকে তার হাতে দিলেন আংটিটা। হাস্যজ্বল কন্ঠে বললেন মীরার হাতে পরিয়ে দিতে। রাজিয়া বেগমের কথা শুনে মীরা আরষ্ঠ হলো, ভীষণ ভাবে কেঁপে উঠলো তার কোমল তনুমন। কোলের উপর রাখা হাত দুটো জড়িয়ে নিলো আনমনে।
রাইফের সংস্পর্শ পেতে চলেছে সে। প্রথম ধা/ক্কা লাগাটা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও এই প্রথম জেনে শুনে, সুস্থ মস্তিস্কে আংগুলে আংগুল স্পর্শ হবে দুজনের। মীরার ঘাম ছুটলো ভেবেই। ধ্ব’কধ্ব’ক করে কাঁপছে আত্মা। রাইফ স্থির বসে। দুই আংগুলের সাহায্যে ঘুরাচ্ছে আংটিটা। মীরার দিকে আড় চোখে তাকালো একবার। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সরু দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল তার গুটিয়ে যাওয়া লাজুকলতা কে। এই যে মেয়েটার ফর্সা কোমল হাত দুটো কাঁপছে রাইফের স্পর্শ পাওয়ার ভ’য়ে তা কি এই মেয়ে বুঝতে পারছে! বুঝলে নিশ্চয়ই লুকিয়ে ফেলত এতোক্ষণে। রাইফ মৃদু হাসলো। মীরার লজ্জা মিশ্রিত আদল যে রাইফ এর বক্ষপিঞ্জর এফো/ড় ওফো/ড় করে তোলে তা কি সে আদ্যও বোঝে!
রাজিয়া বেগম তাগদা দিলেন রাইফকে। রাইফ সোজা হয়ে পিঠ টান টান করে বসলো। স্বভাব বশত চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করে হাতটা প্যান্টের পকেটে ঢুকালো। রাজিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আংটি টা ওর হাতে হবে না আম্মা। আর আংটির চেয়ে তোমার চুড়ি দুটো সুন্দর বেশি। ওটা তুমিই পড়িয়ে দাও।’
সুচতুর ভাবে মীরার অস্বস্তি থেকে রেহায় দিলো রাইফ। ধীরে ধীরে হালকা হলো মীরা। রাইফের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে ভালো লাগাও কাজ করলো তার। রাজিয়া বেগম ছেলের কথায় যুক্তি আছে ভেবে আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন না। হাতের চকচকে স্বর্ণের চিকন বালা দুটো খুলে মীরার কোমল হাতে পড়িয়ে দিলেন। জ্ব/লজ্ব/ল করছে মীরার হাতে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে দেখতে৷ বালা দুটো যেনো ওর হাতের ই অপেক্ষায় ছিলো সম্পূর্ণ সৌন্দর্য প্রকাশের।
আত্নীয়তার বন্ধনে আব,দ্ধ হয়ে খোশ গল্পে মেতে উঠছে যার যার মতো। রাইফ সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মীরার কাছাকাছি এলো আরেকটু। বেখেয়ালি মীরা, রাইফের হঠাৎ কাছে আসাতে থমকে গেলো। মীরার ভ/য় মিশ্রিত মুখের পানে তাকিয়ে রাইফ চাপা স্বরে ফিসফিস করে ডেকে উঠলো,
-‘মীরা’
মীরা ঘন পাপড়ির আঁখি পল্লব তুলে তাকালো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিলো,
-‘জ্বী’
রাইফ আরেক বার দেখে নিলো সবাইকে। নাহ, কেউ তাকিয়ে নেই তাদের দিকে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে নে/শা/লো কন্ঠে বলল,
-‘আমাদের প্রথম স্পর্শ টা আমাদের ব্যাক্তিগত হোক। তোমার অনুভূতি গুলো আমি আরো নিকট দেখে উপলব্ধি করতে চাই। এই কাঁপাকাঁপা কোমল হাতে আমার অধর ছোয়াতে চাই শক্ত করে।’
কান গরম হলো মীরার। লজ্জায় তৎক্ষনাৎ নুইয়ে নিলো মাথা। উড়না টেনে আড়াল করলো গোলাপি আভা ফুঁটে ওঠা মুখাবয়ব। কাঁপা কাঁপা হাত দুটো লুকিয়ে ফেলল ওড়নার ভেতর। মীরার আড়াল করা লাজুক মুখশ্রী দেখার লোভ হলো রাইফের। সময় নিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে গলা খাঁকারি দিতেই মীরা বেখেয়ালি নজর আবারও রাইফের দিকে ঘুরে গেলো। রাইফ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো খানিক ক্ষণ। মীরা নজর ঘুরিয়ে নিবে সে সময় আকস্মিক রাইফের ঠোঁট গোল হলো, ফু দিলো মীরার চোখে মুখে। মীরার পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো। নেত্র পল্লব বন্ধ হলো সয়ংক্রিয় ভাবে।
চলবে…