মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব-১৮

0
536

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১৮

🍁
কোলাহল পূর্ণ ব্যাস্ততম শহরে সবার এতো ব্যাস্ততার মাঝে বোধহয় ব্যাস্ত নেই শুধু দুটি মানুষের। অসল সময় পার করছে দুজন। নিথর দেহ দুটি চি’পকে আছে বিছানার সহিত। উর্মির দৃষ্টি উপরের দেয়ালে, মীরার চোখ বন্ধ। দুজন কি ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না। সময়ের পর সময় যাচ্ছে, কথা বলছে না কেউ ই। নিরবতা ছেদ করলো মীরাই। আঁখি পল্লব বন্ধ অবস্থাতেই মোলায়েম সুরে ডাকলো,

-‘উর্মি?’

দেয়ালে দৃষ্টি রাখা অবস্থাতেই ছোট্ট করে জবাব দিলো উর্মি,

-‘হুম’

-‘তুই উনার ব্যাপারটা কিভাবে জানলি?’

উর্মি কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটালো। এটার অপেক্ষায় ই তো করছে সে। বুঝেও অবুঝের মতো বলল,

-‘কার ব্যাপারে বলছিস?’

-‘ওই লোকটার?’

-‘কোন লোকটা?’

মীরা চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘাড় কাত করে উর্মি দিকে তাকাল ক’ঠো’র দৃষ্টিতে। উর্মি হেসে উঠলো স্ব শব্দে। হাসি হাসি কন্ঠেই টেনে টেনে বলল,

-‘লোকটিইইই, আবার উনানানার। বাপ রে! নাম নেওয়া নিষেধ নাকি?’

-‘বুঝেও কথা ঘুরাচ্ছিস কেনো? আসল কাহিনী বল।’

-‘কোনো কাহিনী নাই’।

-‘তাহলে?’

-‘রাইফ ভাই মাঝে মাঝেই ইনিয়ে বিনিয়ে তোর কথা জিজ্ঞাসা করতো আমাকে। তাই স’ন্দেহ হলো।’

-‘কীরকম?’

-‘এখানে আসতে রাইফ ভাই কে একদিন তোর বারান্দায় তাকিয়ে থাকতে দেখে উনাকে ধমকে উঠেছিলাম। উনি তখন বলল এই বারান্দায় নাকি একটা পরী আছে, যে অলয়েজ বাতাসের সাথে মিশে থাকে। জানিস, রাইফ ভাই নাকি হাওয়াই মিশে থাকা পরীটাকে দেখতেও পাই মাঝে মাঝে। পরীটাকে অনেক দিন হলো দেখে না তাই দেখার জন্য মন আকুপাকু করছিলো তার। খুব আফসোস করতেছিলো দেখা না হওয়ার জন্য।

মীরা বিশ্বাস করলো কি না তা ওর মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সব পরিস্থিতিতে শান্ত থাকে কি ভাবে একমাত্র সেই ভালো জানে। মীরা শান্ত গলাতেই শুধালো,

-‘তারপর?’

-‘তারপর আর কি! আমিও বলে দিছি, ঐ অমূল্য রতন পাইতে ধৈর্য ধরা লাগবে। তাবু পাবে কি না সন্দেহ। বিবাহ করা ছাড়া ধরতে পারবেন না মনে হয়। উনার আবভাব দেখেই বুঝেছিলাম উনি তোকে পছন্দ করে।’

-‘এতোটুকুতেই কিভাবে নিশ্চিত হলি?’

-‘বিয়ের সমন্ধ আসার পর তোর শুকনো মুখ বলছিলো রাইফ ভাইকে নিয়ে তুই ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিস। আমি তোকে চিনি, তুই বিয়ে করবি না বলে যে এতো টেনশনে থাকবি তা বিশ্বাস যোগ্য না। তাই তো সেদিন একটু আন্দাজে ঢিল দিলাম। আহা! তখন তোর মুখটা দেখার মতো ছিলো মীরু। এমন চেহারা দেখিনি কোনো দিন।’

-‘গো’য়েন্দা বিভাগে এখনও যাচ্ছিস না কেনো?’

কথাটা বলে পুনরায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরলো বিছানায়। উর্মি বিজ্ঞদের মতো ভাব ধরে বলল,

-‘ভাবছি রাইফ ভাইয়ের বিয়েটা খেয়েই যাবো।’

-‘উনারও বিয়ে নাকি?’

-‘জানি না। তবে হবে বলেই মনে হচ্ছে। যা টোটকা দিছি না। ঔষধ কাজে লাগবেই লাগবে।’

কিছুক্ষণ নিরব থাকলো মীরা। যথাসম্ভব ধীর কন্ঠে বলল,

-‘ভালো লাগছে না উর্মিমালা। দাদীজানকে খুব মনে পড়ছে। চল আজ একটু দাদীজানের কাছে যাই। যাবি?’

-‘এখন না, ঘুম পাইছে প্রচন্ড। কোল বালিশটা দে। বিকেলে যাবো।’

-‘আচ্ছা।’

__________________

শওকত রহমান আসরের সালাত আদায় করেছেন। বসে আছেন জায়নামাজেই। হাতের আঙ্গুলে তাসবিহ করছেন এক ধ্যানে। দরজা খোলা, মীরা উঁকি দিলো ভেতরে৷ আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো৷ বাবার পাশে বসলো গা ঘেষে। শওকত রহমান মনে মনে আয়াতুল কুরছি পরে ফু দিলেন মেয়ের মাথায়। মীরা মুচকি হেসে শওকত রহমানকে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

-‘আব্বাজান, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বিয়ের সমন্ধটা নাকচ করার জন্য।’

-‘আমার আম্মাজান কেও অসংখ্য ধন্যবাদ।’

-‘আমাকে! কেনো?’

মীরার বিস্মিত মুখাবয়বে শওকত রহমান চোখ বুলালেন। প্রসন্ন কন্ঠে বললেন,

-‘আমার পাশে এসে বসার জন্য। খুব একা লাগছিলো আমার আম্মাজান।’

-‘আপনি কি কিছু নিয়ে টেনশন করছেন?’

-‘কিছুটা।’

-‘বলুন আমাকে।’

-‘আপনাকে যদি সবসময় পাশে রাখতে পারতাম। কিন্তু নিয়ম বলে একটা বিষয় আছে। বিয়ে তো দিতেই হবে। আমরা আর ক’দিন থাকবো দুনিয়ায়।’

-‘আব্বাজান, এভাবে বলবেন না প্লিজ। আল্লাহ আপনাদের নেক হায়াত বৃদ্ধি করে দিক।’

-‘আমিন।’

-‘বিয়ে দিতেই হবে কেনো আব্বাজান? আপনার ছেলে করেই রাখেন না।’

-‘তা কি পসিবল বলেন? আপনার ফুপু রাগ করেছে উনাদের না করাতে। বোন টা আমার ছোট থেকেই গাল ফুলুনি।’

-‘আব্বাজান’

-‘জ্বী’

-‘চলেন আজ একটু দাদীজানের কাছে যাই।’

-‘আজ আমার শরীর টা ভালো না। রাতে ঘুম হয় নি।’

-‘তাহলে কি আমি আর উর্মি একাই যাবো।’

-‘আপনার আম্মা যাবে না?’

-‘না।’

-‘আচ্ছা তাহলে আপনারা দুজন ই যান, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবেন।’

-‘ঠিক আছে। আরেক বার ফু দিয়ে দেন৷ আল্লাহ যেনো সহি সালামতে ফেরত আনে।’

-‘ইন শা আল্লাহ।’

_________________

রাইফ অফিস শেষে বন্ধুদের সাথে আজ একটু বসেছে। এখন ফ্রি হলেও সন্ধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এর জন্য সে ভীষণ এক্সসাইটেড ও বটে। এমন কাজের অভিজ্ঞতা এবার ই প্রথম হবে। না জানি কি হয় কে জানে। সব কিছু তার পরিকল্পনা মাফিক হলেই ভালো৷ বেশ ফুরফুরে লাগছে তাকে। কিছুক্ষণ পর ই চলে যাবে বাসায়। মাকে নিয়ে বেরিয়ে পরতে হবে দ্রুত।

মীরা আর উর্মি ক/বর জেয়ারত করে ক/বরস্থান থেকে বের হয়েছে রাস্তায়। গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে দুজন। উর্মি সাদা রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরলেও মীরার পরনে কালো বোরকা। লাইট জ্বলছে দোকানে দোকানে। সন্ধ্যা হয়েই গেছে। মাগরিবের আজান ভেসে আসছে মসজিদ থেকে। মীরার জন্যই দেড়ি হয়ে গেলো। নূর জাহান বেগমের কবরের পাশে ছলছল নয়নে বসে ছিলো মীরা৷ নীরবে দু ফোঁটা অশ্রু ও ঝড়ে পরে সংগোপনে। বিরবির করে বলতে থাকে মনের না বলা গোপন কথা। উর্মি শুনতে পায় না সে কথা। কিন্তু বুঝতে পারে কথা গুলো খুব কষ্টের।

উর্মি পাশ থেকে দাঁড়িয়ে পরল। পিছিয়ে গেলো কিছুটা। মীরা তাকাতেই বলল,

-‘ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে।’

-‘এখন না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আযান ও দিছে। আব্বাজান রাগ করবে।’

-‘আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছে মীরা। পেট কেমন গুরগুর করছে দেখ। বাইরে থেকে পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে।’

-‘আব্বাজান কে বলে দিবো, পার্সেল নিয়ে যাবে। আয়, নামাজ কাজা হবে আমাদের দেড়ি করলে।’

-‘নামাজ এমনিতেও কাজা হবে। দেখছিস কি জ্যাম? জীবনেও গিয়ে নামাজ পড়তে পারবি না।’

-‘সবসময় বেশি বুঝিস কেনো উর্মিমালা? আয়।’

-‘মীরু, তুই না গেলে না যা। আমি একাই খাবো। তুই চলে যা।’

বলেই হাঁটা ধরলো ফুচকাওয়ালার দিকে। মীরা নিরুপায় হয়ে পেছন পেছন দ্রুত এগিয়ে এলো। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠেছে দু ভ্রুতে। দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকা উর্মিকে তার হিজাব টেনে আটকালো সে। মৃদ্যু ধমকে বলল,

-‘এখানে না। ভেতরের দোকানে চল। বাহিরের টা খাবো না।’

-‘আরে, ভেতরে দাম বেশি। বাহিরের টা মজাও বেশি।’

-‘হ্যাঁ, মজা তো লাগবেই। আন হায়জেনিক জিনিস সবার ই মজা লাগে। ওদিকে চল।’

-‘তাহলে বার্গার ও খাবো। ভেতরের বার্গার হায়জেনিক হয়।’

ঠোঁট চেপে হেসে দিলো উর্মি। মীরার কথার জালে মীরাকেই ফাঁ/সিয়ে বেশ আনন্দ লাগছে তার।

মুখোমুখি বসে উর্মি এবং মীরা। মীরা রয়ে সয়ে খাচ্ছে। ফুচকার স্বাদ গ্রহন করছে পুরোপুরি। এর মাঝে কল করেছিলো বাড়িতে। জানিয়ে দিয়েছে ফিরতে একটু দেড়ি হবে। এক মিনিট কথা বলেই ফোন রেখে সামনে তাকাতেই মীরার চোখ দুটো ছানা বড়া হয়ে গেলো। উর্মির ফুচকার প্লেট ফাঁকা, এখন সে মীরার প্লেট থেকে খাওয়া শুরু করেছে। মীরা দ্রুত টেনে নিলো। চোখ রাঙ্গাতেই উর্মি বলল,

-‘এমন করিস কেনো? একটা খেয়েছি মাত্র।’

-‘এতো দ্রুত কই রাখলি এগুলা?’

-‘পেটে। হি হি’

কথাটা বলেই হেসে দিলো উর্মি। টেবিল থেকে বার্গার হাতে নিয়ে বড় এক কামড় দিবে তক্ষুনি নজরে এলো রাইফকে। এই দোকানেই ঢুকছে সে। পরিচিত মুখ পেয়ে উর্মি চেঁচিয়ে ডেকে উঠবে তৎক্ষনাৎ মীরা উর্মির পায়ে খোঁচা দিলো। বিঘ্ন হলো তার ডাক। উর্মি তাকালে মীরা ইশারায় নিষেধ করল তাকে না ডাকতে। দ্রুত এখানে থেকে চলে যাবে সেটাও বুঝিয়ে দিলো। উর্মি কি আর যাওয়ার মতো মানুষ তাও আবার বার্গার রেখে। খুঁটির মতো শক্ত হয়ে বসেই থাকলো আসনে। এতো স্বাদের বার্গার না খেয়েই কি না যেতে বলে। এতো বড় কথাটা বলতে পারলো মীরা! উর্মি রাইফ কে আরেকবার দেখার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই আঁতকে উঠলো। তার পাশেই যথেষ্ট পরিমাণ দুরত্ব বজায় রেখে বসে আছে রাইফ। উর্মির মৃদ্যু চিৎকারে মীরা তাকাতেই রাইফকে দেখে পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেলো মূহুর্তেই। শ্যমবর্ণের পর-পুরুষটি থেকে নিজেকে আড়াল করতে দ্রুত নীল রংয়ের মাক্স পরে নিলো। ঢেকে গেলো মীরার ফর্সা আদলটুকু। দৃষ্টি ঝুঁকে নিবদ্ধ করলো টেবিলের উপর।
রাইফ মিটিমিটি হাসল মীরার কান্ড কারখানা দেখে৷
উর্মির দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘কেউ বোধহয় আজ আর খাবে না। নাও শুরু করো। তুমি আর আমি খাই।’

কথাটা বলে আর অপেক্ষা করলো না রাইফ। চালাকির সহিত মীরার ফুচকার প্লেট টাই টেনে নিলো নিজের দিকে। গপাগপ মুখে পুরে নিলো একটা। উর্মিও কম না। মীরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘বার্গার ও তো খাবি না তাই না। মাক্স পরেছিস, কিভাবে খাবি। এইটাও আমি খাই।’

রাইফ আর উর্মির কার্যকলাপে আহাম্মক বনে গেলো মীরা। আশ্চর্য কাজ কারবার। লোকটি কই চলে যাবে মীরার মাক্স লাগানো দেখে তা না উল্টো খাওয়া শুরু করেছে। বেহায়া লোক, ভদ্রতা জানে না একটুও।
রাইফ খেতে খেতে উর্মিকে বলল,

-‘বুঝলা উর্মি, মানুষ আমাকে যতটা অভ’দ্র ভাবছে আমি ততটা অভ’দ্র নই। ভদ্রতা জানি বলেই তো তোমার কথা মতো লাল বেনারসি টা কিনেই ফেললাম। খুব মানাবে। একদম লাল টুকটুকে বউ।’

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে