#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১১
🍁
পর পর কেটে গেছে কয়েকটা দিন। আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ যেনো কর্মব্যাস্ততা বেড়ে গেছে সবার। ঘরের এই কাজ সেই কাজ লেগেই আছে একটার পর আরেকটা। বিছানায় বসে শওকত রহমানের সাদা পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করে দিচ্ছে মীরা। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। হাত খোঁপাটা ঢিলা হয়ে পিঠের উপর কোনো রকমে আঁটকে আছে। বাঁধন আগলা হতে পারে যে কোনো সময়। জায়গা করে নিবে পুরো পিঠময়। বা হাতের উল্টো পিঠের সাহায্যে কপাল এবং নাক মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে মুখের উপর আসা কিছু চুল কে কানের পিঠে গুঁজে দিল। এর মধ্যে খাদিজা বেগম রুমে আসলেন। ওয়ারড্রব এর ডয়ার খুলে অপরিষ্কার কাপড় বাছাই করছেন তিনি। যদিও মীরা বেশ পরিপাটি এবং গোছানো স্বভাবের মেয়ে তবুও দুই একটা খুঁজছেন যদি পাওয়া যায় সেই আশায়। মীরা সাদা এবং হালকা রঙের কাপড় বেশি পরিধানের কারণে খুব দ্রুতই ময়লা হয়ে যায়। এদিক সেদিক ওলট পালট করে দুইটা ওড়নার এক কোণায় তরকারির হলুদ দাগ খুঁজে পেলেন। নামাজের হিজাবটাও চেয়ার থেকে নিয়ে মীরার বিপরীত পাশে বসে পরলেন তিনি। মীরা নজর উঁচু করে মুচকি হেসে নজর নামিয়ে নিলো। মাকে স্পষ্ট কন্ঠে জানিয়ে দিল,
-‘আমি গোসলের সময় ধুয়ে দিবো আম্মা। রেখে দাও।’
-‘রেখে দেওয়ার জন্য নেই নি। আজ দুপুরে কি খাবি বল?’
-‘খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা করছে। গরুর মাংস আছে?’
-‘হ্যাঁ আছে।’
-‘আচ্ছা, তাহলে আমি রান্না করি?’
পাঞ্জাবি টা ভাঁজ করে সোজা হয়ে বসল মীরা। এতোক্ষনে পুরো পিঠ সমেত জায়গা করে নেওয়া লম্বা ঘন কালো ঝরঝরে চুল গুলোকে দু হাতের সাহায্যে হাত খোঁপা করে নিলো। খাদিজা বেগম ভাঁজ করা পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে উঠতে উঠতে বললেন,
-‘গরম অনেক কিচেনে। আজ আমি করি। তুই অন্যদিন করিস।’
-‘আমি পারব আম্মা। দেখি কাপড় গুলা দাও।’
খাদিজা বেগম দ্রুত হাত সরিয়ে দূরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু মীরা হুড়মুড় করে লাফিয়ে এসে এক প্রকার ছিনিয়ে নিলো কাপড় গুলো। খাদিজা বেগম রেগে গেলেন। কিন্তু মীরা সেই রাগ কে তোয়াক্কা করলো না একটুও। বাথরুমের দরজা ঠেলে কাপড় গুলো ভেতরে বালতিতে রেখে আমারও লাগিয়ে দিল দ্রুততার সহিত। মাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল কিচেনে।
_________________
জ্ব”লন্ত চুলায় টগবগ করে ফু’টছে গরুর মাংস। ঘর সুদ্ধ লোভনীয় স্বাদের ঘ্রাণ মো মো করছে। এই ঘ্রাণ যে কারো পেট মোচর দিয়ে তুলবে গরম গরম ভাত এর সহিত দু টুকরো মাংস নিয়ে খাওয়ার ইচ্ছায়। পাশের চুলায় চিংড়ি মাছ ভুনা করছেন রাজিয়া বেগম। উনি নিজে চিংড়ি মাছ খান না এলার্জির কারণে। কিন্তু বাবা ছেলে অনেক পছন্দ করেন। এখন তো জাহাঙ্গীর আলম নেই তবুও রোজ নিয়ম করে ছেলের জন্য চিংড়ি মাছ ভুনা করেন। দুই একটা টমেটো দিয়ে ঝাল ঝাল চিংড়ি ভুনাটা ছেলে একটু বেশি পছন্দ করে কি না। খটখট করে আওয়াজ এলো সদর দরজার বাহির থেকে, পরপর দুবার। রাজিয়া বেগম পেছন ঘুরে মেইন দরজার পানে তাকিয়ে আবার সামনে মুখ ফিরালেন। দুই আঙ্গুলে মোচড় দিয়ে গ্যাসের পাওয়ার লো তে নামিয়ে ছুটলেন দরজার দিকে। তিনি জানেন দরজার ওপাশে এখন রাইফ দাঁড়িয়ে আছে। ছোট থেকেই কলিং বেল চাপে না সে। দু আঙুলের সাহায্যে সবসময় টোকা দেয় যেনো ভেতরের কারো ঘুমের ডিস্টার্ব না হয়। হুট করে কলিং বেল এর আওয়াজে চমকেও ওঠেন অনেকে। দরজা খুলে রাইফের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আবার ছুটলেন কিচেনে। যেতে যেতে বলে গেলেন,
-‘একেবারে গোসল করে ফেল আব্বা। গা চুলকাবে দেড়ি করলে।’
রাইফ ডাইনিং এর উপর থেকে গ্লাসে রাখা স্বচ্ছ পানি ঢকঢক করে পান করে তৃষ্ণা মিটাল। বাজার শেষে সোজা সেলুনে গিয়েছিলো সে। চুল এবং দাঁড়ি হালকা কে টে একটু অন্যরকম লাগছে দেখতে। রুমে ঢুকে ফ্যানের সুইচ অন করে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক টানে কালো গেঞ্জি খুলে ছুড়ে ফেলল চেয়ারের উপর। টান টান উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মেদহীন দেহ উন্মুক্ত হলো। বারান্দায় নেড়ে দেওয়া তাওয়াল নিয়ে গোসলে যাবে সে মূহুর্তে নাকে এলো কষানো গরুর মাংসের মাশলা মাখানো ঝাঁজালো ঘ্রাণ। লোভ সামলাতে পারল না কিছুতেই। হাতের তাওয়াল কাঁধে নিয়েই হাঁটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের কাছে এসে দেখে অল্প আঁ চে এখনও রান্না চুলায়। আদুরে কন্ঠে মাকে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আম্মা, ঘেমে গেছো তো। আর কতোক্ষণ লাগবে? তুমি যাও, আমি দেখতেছি।’
ডাল ফোঁড়ন দেওয়ার জন্য কিছু পেঁয়াজ কুচি করছেন তিনি। এক পলক তাকিয়ে জবাব দিলেন,
-‘এইতো শেষ আব্বা। তুই এখন ও গোসলে ঢুকিস নি কেনো?’
-‘মাংসের ঘ্রাণে আর থাকতে পারলাম না আম্মা।’
পাশ থেকে চামচ নিয়ে মায়ের আঁচল দিয়ে সরিয়ে নিলো ঢাকনা। সাথে সাথেই হুড়মুড় করে নাকে প্রবেশ করলো লোভনীয় ঘ্রাণ যা মুখে পানি আনার জন্য যথেষ্ট। এক টুকরো মাংস নিয়েই গরম গরম মুখে পুরে দিয়েছে সে। তাপে তার মুখ ঝলসে যাবার জোগাড়। ফু দিয়ে দিয়ে কোনো রকমে গলাধঃকরণ করতে সক্ষম হলো। রাজিয়া বেগম রেগে গেলেন এমন অবস্থা দেখে। চোখ পাকিয়ে বললেন,
-‘এতো অস্থিরতা কেনো তোর রাইফ? আস্তে ধীরে খেতে পারিস না?’
-‘আহ আম্মা, এতো মজা হইছে তরকারি। ধৈর্য ধরে রাখতে পানি নাই।’
-‘যা এবার গোসলে, নামাজ পড়ে এসে একেবারেই খাবি।’
-‘চিংড়ির বাটিটা দাও একটু এদিকে। এটাও টেস্ট করে যাই। লবন বেশি দিলা না কম দিলা কে জানে!’
এমন কথা শুনে রাজিয়া বেগম রাগ করতে গিয়েও হেসে দিলেন। ছেলে যে লবনের ওছিলা করে মাছ খেতে চাচ্ছে তা উনি ঢের জানেন। তাকে আর বাটিটা দিতে হলো না। রাইফ নিজেই বাটি নিয়ে ঘপাঘপ মুখে পুরে ছুটল গোসলের উদ্দেশ্য। চিংড়ি মুখে থাকা অবস্থাতেই আধো আধো কন্ঠে চেঁচিয়ে মাকে বলল,
-‘ফাস্ট ক্লাস হইছে আম্মা। আর দুইটা খাইতে পারলে ডাবল ফার্স্ট ক্লাস হইতো।’
_________________
যোহরের আজান হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। শওকত রহমান রেডি হয়েছেন পাঞ্জাবি পরে। শেষে পাঞ্জাবী এবং হাতের কব্জিতে একটু আতর মেখে একেবারে তৈরি তিনি। মীরা সমস্ত ঘড় ঝাড়ু দিয়ে মুছে ফেলেছে। আসবাবপত্রের উপর জমে থাকা ধুলো বালিও মুছে একেবারে চকচকে করে তুলেছে। সে সময় খাদিজা বেগম কে নিয়ে কিচেনে ঢুকলেও গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বিশ মিনিট পর ই বেড়িয়ে এসেছে সেখান থেকে। এখন সে সদর দরজার সামনে এক কোণায় চুপটি করে বসে মাথা নিচু করে বাহিরে যাওয়ার জুতা গুলো গুছিয়ে রাখছে সেল্ফ এ। এক জোড়া করে জুতা হাতে নিচ্ছে আর ফ্লোরে বারি দিয়ে জুতায় লেগে থাকা বালু গুলো আলাদা করে উপরে রাখছে। সিঁড়ি বেয়ে কারো নিচে নামার শব্দ পেয়ে দ্রুত ওড়নাটা টেনে নিলো মাথায়। পায়ের শব্দটা খুব কাছাকাছি এসে থেমে গেল। সুন্দর পুরুষালী ঘ্রাণ আসছে নাকে। সেকেন্ড পাঁচেক এর মধ্যে বুঝতে পারল এই ঘ্রাণ টা তার চেনা। এর আগেও পেয়েছে সে এবং মালিক কে সেটাও ঠাহর করতে সক্ষম হলো। এখনও যাচ্ছে কেনো লোকটা! বিরক্তিতে চোখ মুখ শক্ত করলো মীরা। আজ আর নিস্তার নেই লোকটির। যা হবার হবে, কিন্তু অসভ্যতামীর জন্য একটা ধমক দিবেই সে।মাথা উঁচু করে ধমকে উঠবে সে মূহুর্তেই রাইফ ফিসফিস শব্দে ভরাট কন্ঠে বলে উঠল,
-‘আমার থেকে পালিয়ে আর কতো দিন থাকবা মীরা? তোমার নীরবতা পীড়া দিচ্ছে আমাকে। আমার হয়ে যাও প্লিজ’
চলবে…….