#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১০
🍁
ধরনীর বুকে আঁধার ঢেলে সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মাগরিবের সালাত আদায় শেষে শওকত রহমানের সাথে হালকা নাস্তা করে আজ অনেক দিন পর পড়ার টেবিলে বসেছে মীরা। বাড়ি এসেছে থেকে পড়ালেখা গোল্লায় উঠেছে। আর তিন মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। এমনিতে এই তিন মাসকে অনেক সময় মনে হলেও দেখতে দেখতে যে কিভাবে চলে যাবে বুঝতেও পারবে না। চেয়ারে বসে ডিপার্টমেন্ট এর নোটবইটা খুলল। ভ্যাপসা গরম আজ। মাথার উপর ভনভন করে ঘোরা বৈদ্যুতিক ফ্যান টাকে মীরা মনে মনে হাজারো ক’টুক্তি আর ঠেলা গাড়ির সাথে তুলনা করতেও ছাড়ল না। বৃষ্টি হওয়াটা খুব দরকার বলে মনে হচ্ছে মীরার। মাথায় জড়ানো ওড়নাটা খুলে গলায় ঝুলিয়ে রাখল। পাশের জানালা হতে শিরশির করে বাতাস এসে একটু স্বস্তি দিচ্ছে তাকে। চেয়ারের উপর পা তুলে আরাম করে বসে কলম টা আঙ্গুলের ফাঁকে গুজল। নিঃশব্দে মনোযোগের সহিত লাইনের পর লাইন পড়ছে আর টুকটাক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো ঝটপট লিখেও ফেলছে৷ খাদিজা বেগম এর মাঝে এক কাপ কফি দিয়ে গেছেন পাঁচ মিনিট হলো। কিন্তু গরমে মীরা কফির মগে হাত ও দিচ্ছে না। ঠান্ডা হলে শরবতের মতো একেবারে গিলে ফেলবে নাকি কে জানে! পড়তে পড়তে হঠাৎ বেখেয়ালি তে নজর থেমে গেলো টেবিলের এক কোনায় রাখা ছোট্ট আয়নাতে। সাথে সাথেই তার মানস্পটে ভেসে ওঠে দুপুরের ঘটনা। কেমন ইতর একটা লোক, সমস্যাটা কি তার? আর এতো অভদ্রই বা কেনো? আরেক দিন দেখা হোক, তুলে আছাড় মা|রতে ভুলবে না বলে পণ করে বসল। মাথা থেকে যতই বের করতে চাচ্ছে ততই তার সাথে ঘটা অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ সমূহ পর্যায় ক্রমে হানা দিচ্ছে মস্তিষ্কের নিউরনে। প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ, লজ্জাকর পরিস্থিতি। পরের দিন লোকটির শেষ মূহুর্তের কথাটা আর সেদিন ছাদে বলা কথাটা দিয়ে কি বোঝাতে চায় সে? মীরা জানে সে কি বুঝাতে চায়, কিন্তু এতো কিছু করেও যে লাভের লাভ কিছু হবে না সেটা ভেবে মুচকি হাসে মীরা। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে একটা থিউরি পড়লো কয়েক বার এবং বারবার। উহু কাজ হচ্ছে না। মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই। ঢুকবে কি ভাবে, মীরার মস্তিষ্ক জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখন যে সেই অসভ্য লোকের বসবাস। যা ধীরে ধীরে হৃদমাঝারে এ জায়গা করে নেওয়ার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। মীরা ঘূনাক্ষরেও টের পাচ্ছে না সেটি।
_______________________
পড়ন্ত বিকেল। সূর্যের তাপ মলিন হয়ে এসেছে পৃথিবীর বুকে। আকাশ পরিষ্কার, মেঘ গুলো থোকায় থোকায় নানা রঙে সেজেছে আজ। শহরের আভিজাত্য এক রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডার পসরা বসিয়েছে রাইফের বন্ধু মহল। অফিস শেষেই একত্রিত হয়ে খোশগল্পে মেতেছে তারা। এক গল্প দিয়ে শুরু করলে আগামাথা বাদ দিয়ে অন্য গল্পে গিয়ে থামে।ব্যাক্তিগত থেকে রাজনৈতিক কোনোটাই বাদ নেই যেনো। এখন আপাতত আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু রাইফ এবং তার ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া লাজুকলতা। ফাহাদ, পল্লব এবং রাজন এর একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছে রাইফ। তিনজন কে টেক্কা দিয়ে চতুরতার সহিত রাখঢাক করে কথা বলছে, এই একটা বলে তো অন্যটা চেপে যায়। পল্লব ধৈর্য রাখতে পারছে না কিছুতেই। হাঁসফাঁস করছে আদ্যোপান্ত জানার জন্য। রাজন পায় তো রাইফের পেটে ঘু’ষি দিয়ে সমস্ত কথা বেড়িয়ে আনে। ফাহিম শেষে ধৈর্য রাখতে না পেরে রাইফের গা ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে পুরো ঘটনা জানার জন্য। এদের অবস্থা দেখে নিরবে হাসে রাইফ। বন্ধুদের হৈ হুল্লোড়ে না পেরে অবশেষে মুখ খুলে বলল,
-‘আরেহ ভাই, থাম এবার। এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো?’
-‘তুই শালা একেবারে সব বললে কি আমাগো এতো উতলা হওয়া লাগে?’
পল্লবের কাঠকাঠ কথাতে রাইফ মাথা চুলকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-‘তোরা মেয়েটা কে যেমন ভাবছিস তেমন না। আলাদা, একেবারেই আলাদা। ওর নীরবতা স্বভাবটাই আমাকে টানছে বেশি। ওর সাধারণ বেশভূষা, ওকে অসাধারণ করে তুলেছে।’
ফাহাদ গলা টেনে কথার মাঝে ফোঁড়ন কা’টল,
-‘ওহ….হো মিঁয়া, দেখতে হইব তাইলে আজকেই।’
-‘আমি দেখা পাচ্ছি না আবার তুই! ‘
-‘কেনো দেখতে পাচ্ছিস না? সে কি বিদেশ থাকে? কোন গলির মাইয়া? ক খালি একবার, এই পল্লব এখনি হাজির করব।’
-‘আগলা ভাব নেওয়া বন্ধ কর পল্লু। কাজের কাজ কিছুই করতে পারবি না।’
রাজনের মুখে ‘পল্লু’ ডাকটা শুনেই ক্ষেপে উঠল পল্লব। বসা থেকে উঠে তেড়ে গেলো রাজনের দিকে। ফাহাদ দ্রুততার সহিত ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে মাঝে ঢুকে বাধা প্রদান করে শান্ত করল দুজন কে। ভার্সিটি থাকা কালীন সেম ডিপার্টমেন্ট এর এক ব্যাচ জুনিয়র মেয়ের সাথে ভাব হয়েছিলো পল্লবের। মেয়েটা সবার সামনেই মিষ্টি সুরে “পল্লু” বলে ডাকত। কিছু দিন যেতে না যেতেই মেয়েটি বিয়ে করে ফেলে অরেক জন কে। পল্লবের কচি মন তখন ছ্যাঁ’কা খেয়ে ব্যাকা হয়ে মুষড়ে পরার জোগাড়।তখন থেকে মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে এই নামে ডেকে ক্ষে’পিয়ে দেয়। রাইফ এবং ফাহাদ কে উদ্দেশ্য করে অভিযোগ জানিয়ে পল্লব বলল,
-‘মামা, ওই যদি আরেক বার পল্লু ডাকে, আমি কিন্তু ওর বোন রে নিয়া ভাগমু।’
পল্লবের কথা শুনে বাকি তিন জন হো হো করে হেসে দিলো একজোগে। রাইফ মিটিমিটি হেসে চুপচাপ শুনেই যাচ্ছে, এই গন্ডগোল থামানোর কোন তাগিদ তার মাঝে নেই। আরাম করে হেলান দিয়ে বসল আরো। এমন একটা ভাব যেনো সে খুব উপভোগ করছে এটা।
ফাহাদ এবার উচ্চস্বরেই ধমকে উঠল,
-‘থামবি নাকি কি’ক খাবি তোরা। ফাও পেচ্যাল পেরে আসল কাহিনী শুনতে দেস না।’
ফাহাদের ধমক আর নিজেদের বোকামিতে চুপসে গেলো রাজন এবং পল্লব। তিন জোড়া চোখ এক সাথে দৃষ্টি ঘুরালো রাইফের দিকে। ফাহাদ টেবিল চাপড়ে রাইফকে মৃদু ধমকে বলল,
-‘বলবি তুই, নাকি আরো তোষামোদ করা লাগবো?’
-‘হাইপার হচ্ছিস কেনো! গন্ডগোল করলি নিজেরা, দোষ হচ্ছে আমার!’
-‘এখন বল।’
-‘এই কয়েক দিনে যা বুঝলাম, নিজের মাঝেই মত্ত থাকতে পছন্দ করে বেশি। ভীষণ ম্যাচিউর একটা মেয়ে।’
-‘বোন আছে?’
কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই মাথা ঘুড়িয়ে সবার নজর গেলো পল্লবের উপর। এই পল্লবটা সারাদিন এর বোন তো ওর বোন নিয়ে পরে থাকে। ফাহাদের তো মন চাচ্ছে এখনি একে উপর থেকে নীচে ফেলে দিতে। তারপর কারো বোনের উপর গিয়ে পরুক, মনের সাধ মিটে যাক।
-‘কথা হয় রাতে?’
হুট করে রাজনের খাঁপছাড়া প্রশ্ন শুনে রাইফের চক্ষু কোটর বাহিরে আসার জোগাড়। যেখানে সে দেখা পাওয়ার জন্য সেই সকাল থেকে বসে ছিলো রাস্তায়, কতো রজনী অপেক্ষায় কাটিয়েছে ছাদে, কতো রাত গেছে নির্ঘুম তার হিসেব নেই, আর এই রাজন টা বলে কি? সব সময় এতো এডভান্স কেনো চিন্তা করতে হবে ওর? বিশ্রী গালি দিতে ইচ্ছে করছে ওকে। মুখটা আলাভোলা করে রাজনের গাল টেনে রাইফ আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
-‘কথা কেনো, দেখাও হয়। এক সাথে বসে গল্প করি, চন্দ্র বিলাস করি। রান্না করে খাওয়ায় নিজ হাতে। আজ ডেটিং এ আসবে একটু পর। এমন ই তো শুনতে চাইছিলি, এবার হ্যাপি?’
রাইফ এর কথা শুনে ফাহাদ হতাশার শ্বাস ফেলল। বন্ধু যে এখনও ঝুলে আছে তা ঠিক বুঝতে পারছে। পল্লব আসনে হেলান দিয়ে ভাবুক কন্ঠে আফসোস করতে করতে বলল,
-‘এমন কথা বলিস না বন্ধু, আত্মাটা ধ্বক প্বক করে একটা বউ এর জন্য।’
রাজন হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
-‘সারাদিন বোন বোন ই করিস, বউ জুটাইতে পারবি না।’
তৎক্ষনাৎ সবাই হো হো করে হেসে উঠলো সমস্বরে। এই আড্ডা কখন থামবে তা ওদের জানা নেই। এইযে রাইফ থেকে এখন পল্লবের বউ পর্যন্ত আসল সেটা হয়তো এক সময় সালমান খান সিঙ্গেল কেনো সেই প্রশ্নে গিয়ে থামবে। এভাবে চলবে তাদের কথার ফুলঝুড়ি।
চলবে…