#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৬)
সায়রা বাসায় ফিরে জানতে পারল গতকাল বাহাদুর এসেছিল। এসে জামাকাপড় দিয়ে গেছে। ও রেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কল করল।
“কী মনে হয় আপনাদের? আমাদের সাথে তামাশা করেন?”
“ভদ্র ভাবে কথা বলো সায়রা। আমিরা আমার মেয়ে। আমি তার সাথে দেখা করার পূর্ণ অধিকার রাখি।”
“ও তো চায় না আপনার সাথে দেখা করতে।”
“সেটা তো তোমাদের করা ব্রেন ওয়াশের জন্য।”
“আচ্ছা? এত দরদ আপনার? বিয়েটা কেন করলেন? আপার মৃত্যুর পর মেয়েটার ওপর আ ঘা ত কেন করলেন? বের কেন করে দিয়েছিলেন?”
কথা গুলো বলার সময় সায়রা প্রায় চিৎকার করে ওঠল। আমিরা ওর সন্তানের থেকে কম নয়। মেয়েটিকে নোংরা উদ্দেশ্য ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এরা। কল রেখে সায়রা কেঁদে ফেলল। ওর ভয় হয়। ভীষণ ভয় লাগে আজকাল। মনে হয়, আমিরাকে রক্ষা করতে পারবে না ও। কিছুতেই পারবে না।
হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে অনুভব। সায়েম অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারা দিন সে অভুক্ত ছিল। ছেলেটা এত গাঁধা যে সাথে নাকি টাকা নিয়েও যায় নি। অনুভবের মাথা গরম। সেই তপ্ততা নিয়ে সে বার বার এদিক সেদিক করছে। খানিক বাদে আমিন সাহেবের প্রবেশ হলো। তিনি ছেলের সামনে এসে গর্জে পড়লেন না। তবে চোখের ভাষায় নিজের রাগ প্রকাশ করে গেলেন। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেল দুর্বলতা আর ভয় থেকে এমনটা হয়েছে। আমিন সাহেব বের হয়ে ছেলেকে বললেন,”বাইরে এসো অনুভব।”
অনুভবের চোখে মুখে অসহায়ত্ত্বের ছায়া। ও যে কীভাবে কাজটা করে ফেলল। তাছাড়া সায়েম যে এমন গাঁধা হবে তা কে জানত?
বাবা ছেলে যেন দুটি পাহাড়। অনুভবের কেয়ারলেস অবস্থা দেখে আমিন সাহেবের রাগ বেড়ে গেল।
“তুমি এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কেন অনুভব? ছেলেটার যদি বড়ো কিছু হয়ে যেত? সাথে নিতে চাও নি ঠিক আছে। তাই বলে এভাবে ফেলে যাবে? অচেনা একটা স্থানে?”
অনুভবের মাত্রই খেয়াল হলো বিষয়টা। সে যে কী এক কাজ করে ফেলেছে তা সত্যিই লজ্জার। ও মাথাটা নামিয়ে বলল,”সরি বাবা।”
“আমাকে নয়, সায়েমকে গিয়ে সরি বলো। তোমাকে বোঝা হয়ে গেল অনুভব। তুমি সত্যিই কোনো কাজের নয়।”
আমিন সাহেব বেরিয়ে গেলেন। অনুভব বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হতাশ হলো। সে নিজেই নিজেকে বোঝাতে পারে না। ও ধীরে স্বস্তে হসপিটালের ভেতরে এল। ডাক্তারের থেকে জেনে নিল কথা বলা যাবে কী না। অনুমতি পেয়ে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করল অনুভব। সায়েম চোখ বন্ধ করে আছে। স্যালাইন চলছে। অনেকটা সময় যাওয়ার পর অনুভব অনুতপ্তের সুর মেলে দিয়ে বলল,”সায়েম, সরি। আমি আসলে বুঝে ওঠতে পারি নি। আর তুমি সাথে টাকা পয়সা রাখবে না?”
সায়েম চোখ মেলে তাকাল। তার বুক ধরফর করছে এখনো। সে আসলে এই দিকে একটু ভীতু। অচেনা পরিবেশে গুলিয়ে ফেলে সব কিছু। মানি ব্যাগ ও যে কখন কীভাবে পড়েছে জানে না। অনুভব বুঝল সায়েমের জবাব দিতে কষ্ট হচ্ছে। ও হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করে বলল,”পরে, এখন আর কিছু বলা লাগবে না। রেস্ট করো।”
পিকনিক শেষ করার পর সাতদিন পেরিয়ে গেছে। এই কয়েকটা দিন অনুভবের সাথে সায়রার দেখা হয় নি। আজ যখন আহনাফকে পড়াতে এল তখন দুজনের দেখা। সায়রা অন্যমনস্ক। হুট করেই ওর দেহের সাথে মাথা ঠুকে গেল। ধ্যান ফিরলে ও বলল,”সরি।”
“এমন উদাসীন ভাবে কোথায় যাচ্ছ?”
সায়রা মৃদু হেসে বলল,”আদালতে যাব।”
“আমিরার বিষয়টা?”
“হুম।”
অনুভব অল্পবিস্তর জানে এই সম্পর্কে। এই যে আমিরার বাবার করা অত্যাচার ও এখন মেয়ের প্রতি অতি দরদ দেখানো এসব সম্পর্কে সে জেনে নিয়েছিল অর্পার থেকে। সায়রাকে প্রশ্ন করতে ওর ইচ্ছা হয় না। মনে হয়, এই বুঝি কোনোভাবে মেয়েটিকে কষ্ট দিয়ে ফেলবে।
আদালতের সামনে রিকশা থামল। ভাড়া দিয়ে যেই না ভেতরে যাবে ওমনি অনুভবের জিরাফ দেহটা দৃশ্যমান হলো। সায়রা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলেছে। আমিরা হাত নাড়িয়ে অনুভবকে হাই জানাচ্ছে। দুজনের মাঝে যে শত্রুতা ভাব ছিল তা স্কুলে গিয়ে মিটিয়ে নিয়েছে অনুভব। এখন আমিরা আর অনুভব বন্ধু।
“তুমি এখানে কী করছ?”
“এলাম।”
“কিন্তু কেন?”
“আমার বন্ধুর জন্য।”
তারপরই আমিরা আর অনুভব হাই ফাই করল। সায়রা মাথা নাচিয়ে বলল,”বাহ, দুজন বন্ধু হয়ে গিয়েছ।”
অনুভব উত্তর না দিয়ে বলল,”কেইসের কতদূর?”
“লং প্রসেস। চলছে কাজ।”
“আসলে ওর বাবার মতলবটা কী?”
ইশারায় ব্যাপারটি থামিয়ে দিল সায়রা। অনুভব বুঝল আমিরার সামনে এ রকম আলোচনা ঠিক হবে না। ও আর প্রশ্ন না করে ভেতরে চলে এল। আদালতের কাজ শুরু হলো। বাহাদুরের চোখ মুখ অন্ধকার। সায়রা এক পলক তাকিয়ে আওড়াল,”নেশাখোর একটা।”
যুক্তির ওপর যুক্তি দিয়ে কেইস চলছে। তবে বাহাদুর সুবিধা করতে পারছে না খুব একটা। তাই ওর পথ আটকে দিয়ে বলল,”সায়রা তুমি খুব বাড়াবাড়ি করলে?”
“বাড়াবাড়ির অনেক কিছুই দেখেন নি বাহাদুর ভাই।”
“ভালোই ভালোই আমিরাকে ছেড়ে দাও।”
“জীবন থাকতে নয়। আপনাদের নোংরা খেলাতে তো কখনোই নয়।”
সায়রা এগিয়ে যাচ্ছিল। বাহাদুর আবার পথ আটকে দিল।
“কী চাও বলো?”
“কী দিতে চাচ্ছেন বলেন?”
সায়রার বিপরীত প্রশ্ন। বাহাদুর মাথা ঠান্ডা করে বলল,”টাকা দরকার? আচ্ছা পেয়ে যাবে।”
সায়রার হাসি পেল। এই লোক গুলো সম্পর্ক মাপে টাকা দিয়ে। ও গলার সুর উঁচু না করেই বলল,”আমি সম্পর্ক বিক্রি করি না বাহাদুর ভাই। আপনি বিগড়ে গিয়েছেন। আমার কষ্ট হচ্ছে আপা আপনাকে ভালোবেসেছিল।”
এই কথায় ইষৎ কেঁপে ওঠল বাহাদুরের দেহ। তবে যখনই বিদঘুটে ঘটনার স্মরণ হলো সে যেন পুরোই বদলে গেল। অশান্ত মেজাজে বলল,”তোমাদের মূল্য দিতে হবে। সবাইকে মূল্য দিতে হবে।”
বাহাদুরের কথায় একটু ও পাত্তা দিল না সায়রা। ও বরং নিজেকে ঠান্ডা করে বেরিয়ে এল। আমিরা আর অনুভব আইসক্রিম খাচ্ছে। সায়রা আসতেই অনুভব থমথমে গলায় বলল,”তোমার জন্য আনি নি। তুমি তো খাবে না।”
সায়রা হেসে ওঠল। ও জানে অনুভব কথাটি দ্বারা কী বুঝিয়েছে। বইমেলায় উপহার না নেওয়ার জন্যই অনুভব কথা গুলো বলেছে। তবে সায়রা মন থেকে চায় অনুভব নামের উদাসীন ছেলেটার জীবনেও কোনো লক্ষ্য আসুক। যার জন্য ভীষণ দায়িত্বশীল আর কর্মঠ হয়ে ওঠবে ছেলেটা। অথচ ও যদি জানত, ওর এই চাওয়াটা সৃষ্টিকর্তা আগেই কবুল করে দিয়েছিল। অনুভব নামক অলস ছেলেটার জীবনেও লক্ষ্য এসেছে। আর এই লক্ষ্যের নাম সায়রা। যার জন্য জনম জনম পাগলামি করতে চাইবে অনুভব। যাকে পাওয়ার জন্য নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে সে। কখনো অভিমানে, কখনো বা ভালোবাসায়। আর এই ভালোবাসার জন্য মানুষ নিজের প্রাণ দিতে ও নিতে উভয়ই পারে। তাহলে
হয়তো কখনোই সায়রা চাইত না অনুভব নামের উদাসীন হেংলা ছেলেটাও ভীষণ দায়িত্বশীল হয়ে উঠুক।
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি