#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২৪)
বসার ঘরে অর্পার প্রবেশ ঘটতেই হাত নাড়িয়ে নিজের অবস্থান জানান দিল অনুভব। অর্পা চোখ ছোট ছোট করে চাইল। বরাবর বসে বসল,”তুমি এখানে!”
“হ্যাঁ তো।”
অর্পা মিনমিনে সুরে বলল,”সায়রা কখনো কোনো ছেলে ফ্রেন্ডকে বাড়ির ভেতরে আনে না। এমনকি ওর বয়ফ্রেন্ডকেও আনত না।”
“আচ্ছা, তার মানে কী দাঁড়াল বলো তো।”
“কী দাঁড়াল?”
“আমি কুয়াইট স্পেশাল।”
“ধুর।”
ওদের কথার মাঝে জুথি নাশতা নিয়ে এল। এসে দেখল অর্পা ও বসে আছে।
“কী অবস্থা অর্পা? কখন এলে?”
“মাত্রই এলাম ভাবি।”
“বোসো, আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।”
জুথি চলে যেতেই অর্পা ফিসফিস করে বলল,”তুমি স্পেশাল এর মানে কী বোঝালে?”
“বুঝো নি?”
“না।”
“মানে টা হলো….।”
বাক্যটি পূর্ণ করার আগেই সায়রার আগমন ঘটল। ও জামা বদলে এসেছে। অল্পবিস্তর সেজেছেও। তাকে মনে হচ্ছে,স্বর্গের কোনো হুর। অনুভব হা হয়ে তাকিয়ে। অর্পা একটু কাশল। ওর ধ্যান ভাঙল।
“তুই ও এসে গেছিস। যাক ভালোই হলো। ভাবি ওদের চা।”
“আনছি।”
কিয়ৎকাল পর জুথি সবার জন্য চা নিয়ে এল। অনুভব সম্পর্কে এখনো তেমন কিছু জানে না জুথি। তাই বলল,”তোমরা সবাই একই ভার্সিটির?”
“না, অনুভবের সাথে পরিচয় হয়েছে আহনাফকে পড়াতে গিয়ে।”
“আচ্ছা, সবাই গল্প করো, আমি দেখি ছেলে মেয়ে গুলো ওঠল কী না।”
জুথি চলে যেতেই অনুভব বলল,”আমার বিষয়ে বাসায় জানাও নি?”
“কী জানাব?”
“এই যে আমি তোমার….”
“বন্ধু, এটা তো সবাই জানে।”
“ওও।”
অনুভবের মুখটা ছোট হয়ে গেল। অর্পা মুখ টিপে হাসল। সায়রা চা তুলে নিয়ে বলল,”আমরা কখন বের হচ্ছি?”
“সবাইকে রিসিভ করে বের হতে নয়টা বেজে যাবে।”
“ঠিক আছে। আমি আমিরাকে ডেকে নিই।”
সায়রা আমিরাকে ডাকতে গেল। এদিকে অর্পা হো হো করে হেসে ওঠল।
“হাসলে কেন?”
“অনুভব, তুমি শুধু শুধু ভাব নিলে। দেখলে, সায়রার কাছে শুধুই বন্ধু তুমি।”
“শোনো, বন্ধুত্ব না হলে সেখানে স্পেশাল কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।”
“আচ্ছা, দেখা যাবে তোমার বন্ধুত্ব কতদূর যায়।”
“ধুর, মুডটাই খারাপ করে দিলে। তুমি একটা বিশাল খারাপ বুঝলে?”
অর্পা ভেংচি কেটে চা হাতে তুলে নিল। অনুভব কে ওর ভীষণ ফানি মনে হয়। ছেলেটার জিরাফের মতন লম্বা শরীর। শুকনো একটা ছেলে।
সায়রা আমিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”আমিরা, ওঠ সোনা। আমি বের হবো।”
ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল আমিরা। দু হাত পাশে মেলে দিয়ে বলল,”কটা বাজে মিমি?”
“ছয়টা বেজে গেছে।”
“অহ।”
আমিরা ওঠে পড়ল। সায়রা ওকে জড়িয়ে ধরল বুকের মাঝে।
“মুখ ধুয়ে আয়। আমি একটু পরই বের হবো।”
“ঠিক আছে।”
আমিরা চলে গেল। সায়রা বিছানা গুছিয়ে নিল ততক্ষণে। আমিরা ফিরলে ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এল। সেখানে আগে থেকেই জুঁই, মাহিম ছিল। মারুফ কাজের জন্য শহরের বাইরে অবস্থান করছে।
অনুভবের সাথে মাহিমের ভাব জমে গেছে। বেশ কিছু মাস আগে অনুভবের গাওয়া একটি গান সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে বেশ সাড়া ফেলেছে। অনুভবের অবশ্য অতো খেয়াল নেই। ও ইদানীং সব ছেড়ে ছুড়ে উদাসীন হয়ে বসে আছে। মাহিম অনুভবের সাথে সেলফি তুলে নিয়ে বলল,”আমাদের একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে। বেশ একটিভ গ্রুপ। এটা পোস্ট করলেই আমি ভাইরাল হয়ে যাব।”
অনুভব কেবলই হাসল। অর্পা পাশ থেকে বলল,”তাই? অনুভব তুমি এত বড়ো সিঙ্গার তা তো বলো নি।”
অনুভব বুঝল পিঞ্চ কেটে কথাটা বলেছে অর্পা। ও চোখ রাঙিয়ে বলল,”তোমার মতন দেশদ্রোহী’রা এসব রত্নের মূল্য বুঝবে না।”
“আমি দেশদ্রোহী?”
“অবশ্যই।”
অনুভব আর অর্পা কথা বাড়াতে লাগল। সায়রা এসে ওদের কে থামাল।
“কী রে,তোরা দুজন এমন কথা কাটাকাটি করছিস কেন?”
দুজনের কেউ ই জবাব দিল না। আমিরাকে হাতের ইশারায় ডাকল অনুভব। আমিরা না গিয়েই বলল,”শত্রু, আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”
অনুভব ওঠে এসে ওর পাশে দাঁড়াল। চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,”বন্ধুকে শত্রু বললে?”
আমিরা মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনুভব হেসে ওঠল। সায়রা এবার কথা বলল, “আচ্ছা,আমাদের বের হতে হবে। লেট হচ্ছে।”
“সেটাই, সাবধানে যেও সবাই।”
জুথিকে জড়িয়ে ধরল সায়রা। জুথি দু একটা পরামর্শ দিল। সবটা শুনে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিল ওরা।
এখানে বড়ো গাড়ির চলাচল নেই। রিকশা নিতে হবে। তবে এত সকাল যে রিকশা পাওয়া মুশকিল। শেষমেশ একটা রিকশা পেল ওরা। অনুভব রিকশার ওপরের অংশে ওঠে বসল। অর্পা আর সায়রা বসল সিটে। ওদেরকে বিদায় জানাল সবাই। সায়রার ভালো লাগছে। অনুভব ছেলেটার এই সহজ সরল আচরণ ওকে মুগ্ধ করল। ছেলেটার সাথে অল্প সময়ের আলাপ। অথচ পারফেক্ট বন্ধু হওয়ার সবটুকু ক্ষমতা আছে ওর মাঝে।
বাহাদুর খবর পেয়েছে সায়রা আজ বাসায় নেই। মারুফ ও নেই। সেই সুযোগেই বাড়িতে উপস্থিত হলো। আমিরা তখন সোফায় বসে কার্টুন দেখছিল। বাবাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল ও।
“আমিরা, মামুনি দূরে কেন যাচ্ছ?”
আমিরার শরীর কাঁপছে। বাবাকে তার ভীষণ ভয় লাগে আজকাল। অথচ একটা সময় এই বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে সে।
জুথি দোতলা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। তাকে খবর দিয়েছে জুঁই। মাহিম ছাদে ছিল। সে ও মায়ের কণ্ঠ পেয়ে এসে পড়ল। সবাই কে দেখে চোখ মুখ অন্ধকার করে চাইল বাহাদুর। তাকে সমাদর করার বদলে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে জুথি বলল,”বাসায় কেন এসেছেন?”
“ভাবি, এমন আচরণ কেন করছেন? আমি কিন্তু এ বাড়ির জামাই।”
“এসব কথা আপনার মুখে মানায় না বাহাদুর ভাই। আপনি চলে যান।”
“যাব অবশ্যই। তবে মেয়ের সাথে দেখা করার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে।”
এ কথার বিপরীতে জুথি মৌন রইল। আমিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে। ওর শরীর কাঁপছে।
“আমিরা, এদিকে আসো।”
আমিরা এল না। ও বরং পিছিয়ে গিয়ে জুথির হাত চেপে ধরল। মেয়ের এই আচরণে মনে মনে রুষ্ট হলো বাহাদুর। হয়তো ভেতরে ভেতরে গালিও প্রদান করল। তবে মুখে সেটির প্রকাশ না দেখিয়ে কিছু ব্যাগ পত্র বাড়িয়ে দিল।
“আমিরার জন্য জামাকাপড় এনেছি।”
“এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।”
“আপনাদের কাছে তো কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। তবে মেয়ে যেহেতু আমার, তাই প্রয়োজন অপ্রয়োজন আমি ভালোই বুঝব।”
জুথি আবার চুপ। বাহাদুর দেখতে বলিষ্ঠ। কথাতেও তেজ আছে। জুথি লোকটার সাথে কথায় পেরে ওঠে না। বাহাদুর আমিরার জামাকাপড় গুলো রেখে বলল,”আশা করব, খুব দ্রুত মেয়ে তার নিজের ঠিকানায় ফিরবে। আপনাদের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক ঠিক হবে।”
সায়রা থাকলে প্রতিবাদ করত নিশ্চিত। তবে জুথি সেটা পারল না। সে চুপ করে রইল।বাহাদুর গেল আরো মিনিট পাঁচেক পর। জুথি দ্রুত গিয়ে দরজা বন্ধ করল।
“বাসার দরজা খোলা কেন থাকে? কেউ আর দরজা খুলে রাখবি না।”
সবাইকে এ কথা বলে জুথি মারুফকে কল করল। সবটা শুনে মারুফ ভয়ঙ্কর এক গালি প্রদান করল বাহাদুর ও তার পরিবারকে। এই পরিবারটা ক্রমশই মুখোশ খুলতে শুরু করেছে। অথচ, শুরুর দিকে কী ভালোই না মনে হয়েছিল।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি