#মুগ্ধতার_এক_বিকেল (২২)
কফি শপ থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ একটা ছায়া দেখল অর্পা। সে চমকে গেল। পিছিয়ে গেল দু পা। অনুভব দাঁড়িয়ে। ভীষণ লম্বাটে ছেলেটাকে দেখতে ঘাড় উঁচু করতে হলো ওকে।
“তুমি এখানে…..! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“শোনো অর্পা,তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
“আমার সাথে?”
“হ্যাঁ।”
অর্পা শুকনো ঢোক গিলল। ছেলেটা কি তাকে প্রপোজ করবে নাকি!
অনুভব ভালো মতন পরখ করে নিয়ে বলল,”সায়রা চলে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“ওকে, চলো।”
“কোথায়?”
“কফি শপের ভেতরে।”
একরাশ বিস্ময় সাথে নিয়ে পুনরায় কফি শপের ভেতরে গেল অর্পা। অনুভব দুজনের জন্য পুনরায় অর্ডার করল।
“কী কথা বলবে?”
“খুবই সিরিয়াস।”
অনুভবের চোখ মুখ কেমন সিরিয়াস হয়ে গেল। অর্পা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলল,”আচ্ছা। তবে বলো…।”
“ওকে।”
অনুভব লম্বা করে শ্বাস নিল। যেন নিজের ভেতরটা শুদ্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা।
“স্যার, জুস।”
ওয়েটারের কথায় ধ্যান ভাঙল অনুভবের। অনুভব হাত সরিয়ে দিতেই ওয়েটার জুস রেখে গেল।
“জুস নাও।”
জুস নিল, অর্পা। ছেলেটাকে দেখে ওর সুবিধার মনে হচ্ছে না। অনুভব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল,”একটা খবর দিতে পারবে?”
“কী খবর?”
“তোমার বান্ধবীর বিষয়ে।”
“সায়রার বিষয়ে?”
“হুম।”
অনুভবের মতিগতি তৎক্ষণাৎ না বুঝলেও অর্পা বলল,”বলো কী খবর জানতে চাও।”
“ওর বয়ফ্রেন্ড আছে?”
বয়ফ্রেন্ডের নাম শুনে অর্পা যেন মিইয়ে গেল। মেয়েটার দীর্ঘ দিনের প্রণয়ের স্বাক্ষী ছিল সে।
“কী হলো?”
“আপাতত নেই।”
“আচ্ছা।”
“হুম। তবে বিষয়টা অনেক গভীর।”
“কেমন?”
“ওর সাথে যার সম্পর্ক ছিল তার বিয়ে হয়ে গেছে।”
অনুভব যেন স্বস্তি পেল। হেসে বলল,”তাহলে তো ভালোই।”
অর্পা ভ্রু কুঞ্চিত করে চাইল। অনুভব এবার চোখ মুখ অন্ধকার করে বলল,”বিয়ে কেন হলো?”
“সাঈদ ভাইয়ার মা, তিনি সায়রাকে পছন্দ করতেন না। এর অনেক গুলো কারণ আছে। তবে লাস্ট দিকে যেই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঝামেলা করেছিল সেটা হলো আমিরা।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। কেইস তবে বিশাল ঝামেলার।”
“খুব। তবে খারাপ লাগার বিষয় হলো সাঈদ ভাইয়া বিয়ের আগের দিন সায়রাকে আনতে গিয়েছিল। সায়রা প্রথমে রাজি হয় নি। পরে অবশ্য কল করেছিল। তবে সাঈদ ভাইয়া রিসিভ করে নি।”
“কেন করে নি?”
অনুভবের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। অর্পা চুপ করে রইল কিছু সময়।
“এই ঘটনা আরো করুণ। সাঈদ ভাইয়া সায়রার বাসায় এসেছে এটা জানতে পেরে ওনার মা সু ই সা ইড করতে যান। আর সেটার জন্যই সাঈদ ভাইয়া ছুটে আসেন। পরে আর ফোনের সাথে কানেক্ট হতে পারেন নি। তাই বিয়েটা হয়ে যায়।”
সবটা শুনে অনুভব চেহারার ভঙ্গিমা এমন করল যেন, সে খুবই দুঃখ অনুভব করছে। অথচ বিষয়টি ভিন্ন। সে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে শত সহস্রবার ধন্যবাদ জানাল।
ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরল অনুভব। সায়রা আর তার মাঝে তৃতীয় পক্ষ নেই। এখন মেয়েটার মন চুরি করার পালা। সারাদিনে পরিশ্রম গিয়েছে। তাই নিজের ঘরে এসে সবার আগে শাওয়ার নিয়ে এল। ফ্রেশ হয়ে একেবারে ডিনার করতে বসল। রূপবান ছেলের খাবার বেড়ে দিয়ে শুধালেন,”অফিস কেমন যাচ্ছে?”
“কেমন যাবে। বোরিং টাইম।”
“ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ঠিক হবে না। আমাকে মে রে তবেই শান্তি হবে সবার।”
রূপবান চোখ মুখ অন্ধকার করে রইলেন। ছেলেটা এত বাজে কথা বলে!
খাবারের টেবিলে কথাটা ওঠল। মারুফদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় জুঁই এর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছে। কথাটা শুনে জুঁই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,”পাগল নাকি। আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?”
“সেটাই তো। যার বিয়ের বয়স হয়েছে তার ই বিয়ে দিতে পারছি না। আর আমার চৌদ্দ বছরের বাচ্চা, মেয়ের নাকি বিয়ে দিব।”
জুথির কথার হাসল সায়রা। মিনমিনে কণ্ঠে বলল,”ভাবী তুমি যেন কত বছর বয়সে বিয়ে করেছ।”
সায়রার কথায় মারুফ হাল্কা কেশে ওঠল। জুথি চোখ রাঙিয়ে বলল,”কথা বাদ। সবাই খাওয়া দাওয়ায় মনোযোগ দাও।”
জুথির কথায় আরো একবার হাসল সায়রা। মারুফ আর জুথির প্রেমের বিয়ে। তবে ছেলে মেয়ের সামনে কথা গুলো ওঠলে ভীষণ লজ্জা লাগে।
আমিরা ঘরে বসে ছবির এলবাম দেখছিল। সায়রা শব্দহীন ভাবে পাশে বসল। তবে বুঝে ফেলল আমিরা। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,”মিমি, এসে গেছ।”
“বুঝলি কেমন করে?”
“বুঝি আমি।”
“কীভাবে?”
“তোমার মাঝে মা মা গন্ধ পাই।”
কী আশ্চর্য কথা! আমিরা সায়রার মাঝে মা মা গন্ধ পায়! ওর বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠল যেন। সায়রা আমিরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”পড়াশোনার কী খবর?”
“ভালো।”
“আচ্ছা। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।”
“হুম। চলো ঘুমাই।”
“একটু পর ঘুমাব। তুই ঘুমিয়ে পর।”
“ঠিক আছে।”
আমিরা শুতেই গায়ে চাদর টেনে দিল সায়রা। তারপর বই নিয়ে বসল। সে ভালো একটা প্রিপারেশন নিচ্ছে। সামনে তার অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল সায়রা। হুট করে আসা কলটায় ঘুম ভাঙল ওর। শরীর ব্যথা করছে। চোখেও ঘুম। হাতের সাহায্যে ঘুম নামানোর চেষ্টা করল। ততক্ষণে কল কেটে গেল। ফোন তুলতে তুলতে পুনরায় কল এল। অনুভব কল করেছে! এখন কটা বাজে?
সায়রা ঘড়িতে টাইম দেখতে দেখতে কল আবার কেটে গেল। সকাল হয়ে গেছে! অথচ ওর কোনো তাল নেই। তৃতীয় বার কল এল না আর। সায়রা একটু অপেক্ষা করে নিজ থেকেই কল করল।
“হ্যালো সায়রা,বিরক্ত হলে?”
“না, বলো।”
“ঘুমিয়ে ছিলে?”
“হুম।”
“তাহলে পরে বলছি।”
“না বলো। সমস্যা নেই।”
“আমার সব বন্ধু’রা মিলে পিকনিক প্ল্যান করেছি। তুমি কিন্তু জয়েন করবে।”
“অনুভব, তোমার বন্ধুদের মাঝে আমি….”
“আরে, এটা কোনো ব্যাপার হলো নাকি।”
“না অনুভব। এটা হয় না।”
“কেন হয় না?”
সায়রা একটু ভাবল। তারপর বলল,”ঠিক আছে। আমার সাথে তবে অর্পাও যোগ দিবে।”
“ওকে।”
“আচ্ছা, ডিটেলস পাঠিয়ে দাও।”
“আচ্ছা।”
কল কেটে মাথা চেপে রইল সায়রা। হ্যাং হয়ে আছে। সারারাত পড়ে হয়তো ভোরের আগ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনুভবের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ দিল। শহর থেকে দূরের একটা জায়গা। ওখানে পিকনিক করা হবে। সায়রা অর্পাকে কল করে জানাল। অর্পা ঘুরতে ভীষণ পছন্দ করে। ওদের বন্ধু মহলে তেমন ঘোরা হয় না। আর বন্ধু বলতে ওরা তিনজন। তাই তেমন একটা প্ল্যান করা হয় না। সোনালি এখন দেশে নেই। নতুবা তাকে ও জয়েন করানো যেত।
এই পিকনিকের আয়োজনটা একেবারেই হুট করে মাথায় এসেছে অনুভবের। ও ভেবেছে পিকনিক শেষে সায়রাকে মনের কথা জানাবে। ওর ধৈর্য হচ্ছে না আর। তাছাড়া ভয়ের একটা ব্যাপার ও আছে। যদি সায়রা নতুন করে কারো সাথে সম্পর্ক জড়িয়ে পড়ে! সেই জন্যই অনুভব ঠিক করেছে যতটা সম্ভব, দ্রুত মেয়েটিকে মনের কথা জানিয়ে দিবে। অনুভব মিটিমিটি হাসছিল। আমিন সাহেব শরীর চর্চা করে ফিরেছেন। ছেলেকে ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠতে দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছে।
“অনুভব।”
বাবার কণ্ঠ কানে যায় নি ওর। অনুভব তখনো হাসছে। আমিন সাহেব এবার গলার আওয়াজ ভারী করলেন।
“এই অনুভব।”
বাবার কণ্ঠে চমকে তাকাল অনুভব। দাঁড়িয়ে পড়ল বসা থেকে। লম্বায় তারা সমান সমান। তাই একদম দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিশে যাচ্ছে।
“জি বাবা।”
“হাসছিলে কেন?”
অনুভব চট করেই জবাব দিল,”পিকনিক করব বাবা। তাই সবটা ভেবে হাসছিলাম।”
আমিন সাহেব বিশ্বাস করলেন কী না কে জানে। তবে তিনি প্রসঙ্গের সাথে ঘটনা জুড়ে বললেন,”তুমি নাকি সায়েমের কথার গুরুত্বই দেও না।”
অনুভব চমকে তাকাল। বদ ছেলেটা বাবার কাছে বিচার দিয়েছে!
“যাই হোক, সায়েম আর তুমি প্রায় সম বয়সীই হবে। ছেলেটাকে বন্ধুর মতন ট্রিট করবে। বুঝলে?”
“ঠিক আছে বাবা।”
“তোমাদের প্ল্যানে ওকে এড করলে কেমন হয়?”
অনুভব মুখ শুকনো করে ফেলল। আমিন সাহেব কড়া কণ্ঠে বললেন,”তোমাদের প্ল্যানে ওকে যোগ করে নিবে। বুঝলে?”
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি