#মিহিদানা ৩
তুশার পা নড়ল সে। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। দরজা খুলল কাজের মেয়েটা। কে এসেছে বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটা কাকে যেন বসিয়ে বাবা মায়ের ঘরে টোকা দিল। নাহ, দিহান আসেনি। এলে তো তার ডাক পড়ত!
ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে এলো তুশার। বিস্বাদের ক্লান্তি। বহুদূর হেঁটে হেঁটে গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসার ক্লান্তি৷ এলোমেলো স্বপ্নরা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে থাকল তার ওপর।
কতক্ষণ পর জানে না, তন্দ্রা কেটে গেল কারো ডাকে। চোখ খুলে প্রথমে চিনতে পারল না মানুষটাকে স্বপ্নদৃশ্যের মতো সবকিছু আবছা।
মানুষটা দিহানের মা!
তারপর কী যেন হয়ে গেল…ওকে মা বাবা এসে বার কয়েক জিজ্ঞেস করলেন, সে দিহানকে সত্যিই বিয়ে করতে চায় কি না। আজই বিয়ে দিতে চাইলে করবে কি না..ইত্যাদি। দিহানের মা এসেও দু’বার সবকিছু খুলে বলে ওর মতামত নিয়ে গেলেন। তুশার না করার মতো সাহস নেই। সে নিশ্চিতভাবে ‘হ্যাঁ’- ই বলল।
তখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো ঝিলমিল করছে, আর আকাশে তারার আলো। একফালি চাঁদও উঠেছে। বাঁকা চাঁদ৷
কাজি ডেকে বিয়ে পরানো হয়ে গেল। ওরা বলল, আজই নিয়ে যাবে তুশাকে। একটা রাত থাকুক ওরা একসাথে। কাল তো দিহান চলেই যাচ্ছে।
তুশার কাছে সব সাঁঝবেলার মতো আবছা মনে হচ্ছে। এমনও স্বপ্ন হয়? নাকি সে ভুল দেখে যাচ্ছে?
বাবা মা যখন তাকে চোখের পানিতে বিদায় দিচ্ছেন, তখন তুশা যেন কান্নার বোধটাও হারিয়েছে। দিহানকেও ঠিকঠাকমতো দেখেনি। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তার গা ঘেঁষে, অথচ মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না তুশা।
****
দিহান গাড়িতে বসে তুশার দিকে একবার তাকাল। মনে হচ্ছে কোনো জাদুকর শক্তিশালী মন্ত্র পড়ে তাকে সম্মোহন করে ফেলেছে। অদ্ভূত আচরণ করছে মেয়েটা!
দুপুরে খেতে বসে বাবার সামনে তুশার কথাটা মা বলে ফেলেছিল। বাবা বিষ্ময় আর খুশির চোটে গলায় খাবার আটকে ফেলেছিল। বাবা আর তুশার বাবা ভালো বন্ধু৷ বাবা তো এক কথায় রাজি। “এত মেয়ে খুঁজলাম, তুশা মামনির কথা মনে পড়ল না কেন? কত ভালো একটা মেয়ে! চেনাজানার মধ্যে আছে। দিহানকেও পছন্দ করে। তাহলে ফেলে রেখে লাভ কী? দিহান ফিরতে ফিরতে ওর বিয়ে হয়ে যাবে। তখন যদি এমন মেয়ে না পাই? হাতে আছে আরও ছত্রিশ ঘন্টা। বিয়ের দেয়ার একটা চেষ্টা করাই যায়। কী বলো?”
মা কিছুটা আপত্তি করতে চাইলেও দিহানের দিকে তাকিয়ে থেমে গিয়েছিলেন। ওর চেহারায় স্পষ্ট সম্মতি।
তুশার বাড়ির দিকে যেতে যেতে হঠাৎ দিহানের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়।
অনেকদিন আগের কথা। তখন তুশারা সবে নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে। দিহান বেস্ট ফ্রেন্ড হারিয়ে কয়েকদিন খুব অস্থির হয়ে আছে। সময় আর কাটে না৷ এত কথা জমে গেছে তুশাকে বলার! কী করে বলবে? ওদের বাড়িতে যেতে যে ঘন্টাখানেক সময় লাগে!
এক বিকেলে থাকতে না পেরে দিহান সত্যিই তুশাদের বাড়ির দিকে চলল। বাড়ি পর্যন্ত যেতে হলো না, ওই এলাকায় পৌঁছেই তুশার দেখা পাওয়া গেল। কোচিং থেকে ফিরছে। একটা ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। হাসছে, হাত নাড়ছে, ছেলেটা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
দিহানের এত রাগ হলো, বলার মতো না। দুদিনেরই নতুন বন্ধু জুটেছে? আর সে কিনা এদিকে কষ্টে অস্থির হয়ে আছে! অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই সে দু’জনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে “এক্সকিউজ মি!” বলে তুশার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছিল নিজেও জানে না৷ অনেকটা পথ যাওয়ার পথ তুশা জোর করে থামিয়েছিল তাকে। খুব আশ্চর্য হয়ে বলেছিল, “দিহান! তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? এমন করলে কেন?”
সেদিনকার কথা আর কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে ওদের ভাব হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরার সময় সে তুশাকে একটা ক্যাডবেরি কিনে দিয়েছিল, যেটার অর্ধেক আবার তুশা তাকে খাইয়েছিল।
কিন্তু যতই ভাব হোক, চোখের আড়ালের সাথে সাথে মনের আড়ালও হয়ে গিয়েছিল তাদের মাঝে। তবে সেটা হয়তো শুধুই দিহানের দিক থেকে। তুশা হয়তো তখন থেকেই তাকে…
আচ্ছা, দিহানেরও কি মনের কোনো কোণে সুপ্ত বাসনা ছিল না তুশাকে আবারও নিজের করে পাওয়ার..? সেটা হোক বন্ধু কিংবা…
নইলে কাবিননামায় সই করার সময় থেকে তার এত ভালো লাগছে কেন?
****
তুশার প্রথম চমকটা ভাঙল বৃষ্টির ছাটে। দিহানদের বাড়িতে ঢোকার পরপরই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাকে একা দিহানের ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেছে অন্যরা। বাইরে কে কী করছে কে জানে! ঘরটা একসময় চেনা ছিল তার। আজ কতকিছু বদলেছে! ফার্নিচার, বেডশীট, দেয়ালের রঙ, বইপত্র, আর মানুষটা? মানুষটাও কি ভেতরে ভেতরে অনেকটা বদলেছে?
এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে সে। মৃদু একটা আলোর পর্দা ঝুলে আছে চোখের সামনে। জানালা বন্ধ কেন? খুলে দিল তুশা। সাথে সাথে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগল চোখেমুখে।
জ্যেষ্ঠ প্রায় শেষ৷ বছরের প্রথম মৌসুমী বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে ধরণী। আর তুশার মন?
হঠাৎ কোথা থেকে যেন একঝাঁক নুপুরের আওয়াজ ভেসে এলো। ঝুম…ঝুম…ঝুম…কেউ নাচছে বৃষ্টির তালে তালে। সব কি তুশার মগজে হচ্ছে? সে কি বেশি খুশিতে পাগল হয়ে গেছে?
****
ঠিক আর পাঁচটা বাসরের মতো রাতটা শুরু হলো না মোটেও। প্রচুর ট্রলি। তাতে রাজ্যের জিনিস গোছানো হচ্ছে। মা যেন পারলে বাড়িটা তুলে দেয়।
দিহানের সব ভালো জামাকাপড়, নতুন কেনা জামা প্যান্ট, প্রিয় পারফিউম, জুতো, শুকনো খাবার, আচারের বয়াম, ঔষধ, আরও কত কী প্যাক হচ্ছে! তুশা বুঝতে পারছে না সাহায্য করবে কি না।
ওকে সেই ঘর থেকে বসার ঘরে নিয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ল দিহানের বোনেরা৷ ওর আপন বোন নেই, সব চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো বোন। ভাবি ভাবি করে একাকার সব! কয়েকজনের সাথে তুশার ছোটোবেলায় আলাপও হয়েছে। ওর ভীষণ লজ্জা লাগছে। হঠাৎ এরকম পরিবেশে এসে পড়বে কে জানত!
রাত প্রায় বারোটায় দুজনকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে ফেলার নির্দেশ দেয়া হলো। তুশা ততক্ষণে বিয়ের শাড়িটা বদলে সুতির জামা পরেছে। মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়েছে কী করবে বুঝতে না পেরে।
দিহানের সাথে এতক্ষণ তার কোনো কথা হয়নি। ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে প্রথম কথাটা দিহান জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?”
তুশা এতক্ষণে হেসে ফেলল। “কথাটা কি বিয়ের আগে জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো না?”
“না মানে…”
“মেসেজটা তো প্র্যাঙ্কও হতে পারত!”
ফ্যাকাসে হয়ে গেল দিহানের মুখ। “প্র্যাঙ্ক? মানে? তুমি বলতে চাইছো…”
তুশা মিষ্টি করে হেসে ফেলল। “আরে না, কথার কথা বললাম। সেরকম হলে কি বিয়ে করতাম নাকি?”
“তবুও তুুশা তুমি সত্যিটা বলো প্লিজ।”
“তার আগে বলো তোমার কি আমার জন্য কোনোরকম অনুভূতি আছে?”
দিহান কী উত্তর দেবে! সে নিজেই বুঝতে পারে না কিছু।
দিহানের খুব খাটুনি যাচ্ছে ক’দিন। চেহারায় ক্লান্তি বসে গেছে। তুশার মায়া হয়। বলে, “ঘুমাও আজ।”
দিহান একটু অবাক হয়, “ঘুমাবো? কাল তো চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে সময় কাটানো হবে না…”
“অনন্তকালের জন্য যাচ্ছো?”
“না, তবুও…”
কয়েকটা নিরব মুহূর্ত ঝুলে থাকে ভ্যাপসা প্রকৃতির মেঘের মতো। তারপর বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। তুশা ঝাপিয়ে পড়ে দিহানের বুকে। বৃষ্টির পর ঝড়।
একটা বৃষ্টিঝরা স্নিগ্ধ রাতের শেষের সকালটা মুচকি হাসে। ততক্ষণে সকল দ্বিধা কেটে গেছে দিহানের। সে এখন চাইলে তুশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। হ্যাঁ সে ভালোবাসে। এ এক রাতের ভালোবাসা নয়। সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা, যাকে খুঁচিয়ে না তুললে হয়তো এর অস্তিত্ব অজানা থেকে যেত নিজের কাছেও।
সমাপ্ত