#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৯
#আরশিয়া_জান্নাত
বৌমা, আজকে তোমার দাদী শাশুড়ি আর ফুফু শাশুড়িরা আসবে। তাই রান্নার দিকটা তোমাকেই দেখতে হবে, পারবে না?
মেনু কি ঠিক করা হয়ে গেছে আন্টি?
হুম, মা তো পোলাও খেতে পারেন না তাই আতপ চালই হবে, চিকেনের ৩টা আইটেম হবে, বিফ থাকবে, ইলিশ মাছের দোঁপেয়াজা। আর ডেজার্টে জর্দাভাত আর ফিরনি। টেনশন করোনা তোমায় শুধু রাধতে হবে, তোমাকে সাহায্য করার জন্য দুজন থাকবে। এটা জাস্ট রেওয়াজ হিসেবে ধরে নাও।
ইসরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এমনিতে রান্না নিয়ে তার প্যারা নেই। তবে এখানে কে কেমন পছন্দ করে সেটাতো জানেনা। নতুন পরিবারে এলে এক্সপার্ট রাধুনীও প্রথম প্রথম ভয় পায়। সে তো তার সামনে কিছুই না,,,
রান্নার পাট চুকাতে প্রায় দুপুর একটা বেজে গেছে। রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে শাশুড়ি মায়ের কথামতো লাল রঙের একটা শাড়ি সাথে হালকা গয়না পড়ে সাজগোজ করে নিলো। সিত্তুল মুনা দরজায় করে বললেন, বৌ মা আসবো?
জ্বি আন্টি আসুন।
আন্টি ডেকো না বোকা মেয়ে, মা বলো। মাশাআল্লাহ! খুব সুন্দর মানিয়েছে তো শাড়িটা।
আরুশকে কল করেছ? ও কখন আসবে বলেছে?
নাহ আন্টি মানে মা, আমি সবেই তৈরি হয়ে বসলাম।
আচ্ছা ওকে কল করে বলে দাও যেন দ্রুত বাসায় আসে। সবাই একসঙ্গে লাঞ্চ করবে।
আচ্ছা।
ইসরা ফোন হাতে তুলতেই মনে পড়লো তার কাছে আরুশের ফোন নাম্বার নেই! কখনো কল করার প্রয়োজন ই হয়নি, না আরুশ কখনো তাকে কল করেছে। এখন সে কোত্থেকে তার নাম্বার যোগাড় করবে! শাশুড়িকে বললে তিনি আবার কি না কি ভাবেন। এমনিতেই তিনি একটু সন্দেহ করছেন আরুশের কর্মকান্ডে। বহুক্ষণ ভেবেও ইসরা কিনারা করতে না পেরে অবশেষে প্রিয়ন্তিকে কল করে। ওকে বলে মায়ের কাছ থেকে নাম্বারটা নিয়ে যেন তাকে দ্রুত দেয়। প্রিয়ন্তিও বোনের কথামতো নাম্বার পাঠিয়ে দেয়। দু’বার রিং পড়ার পর আরুশ কল রিসিভ করে বলে, হ্যালো রুশফিকা!
ইসরা কিছুটা অবাক হয়, পরক্ষণে ভাবে এটা অস্বাভাবিক নয়। সাবলীল গলায় বলে, মা বলেছেন আজকে দুপুরে লাঞ্চটা বাসায় করতে। ফুপিরা সবাই আসবেন,,,
আমাদের বাসার কথা বলছেন?
তো কার বাসার কথা বলবো?
মা বললেন যে? কোন মা?
আপনার মা আর কি!
আপনিতো আন্টি ডাকতেন। তাই কনফিউজড হয়ে গেছি,,
ইসরা শ্বাস ফেলে বলল, আপনাকে কনফিউজড করার জন্য স্যরি। আসলে আন্টি চাইছিলেন উনাকে মা বলে ডাকি। তাই,,,
আমি খুশি হয়েছি এতে। ধন্যবাদ..
ইসরা আর কিছু বললো না। নিরব হয়ে রইলো। আরুশও কল কাটলোনা, যেন কলে ইসরা আছে এটা ভাবতেও অন্যরকম প্রশান্তি লাগছে।
আচ্ছা রাখছি।
ওকে। রুশফিকা শুনুন,
জ্বি?
আপনার কিছু লাগবে?
নাহ,
আচ্ছা!
ফোন রেখে আরুশ ফোনের দিকে চেয়ে রইলো। এই নাম্বারটা থেকে এই প্রথম অনাকাঙ্খিতভাবে কল এসেছে বলে কথা…
আরুশের ছোট ফুপী হাসির ছলে বলেই ফেললেন, বড় ভাবী আমাদের বৃষ্টি কি ওরচেয়ে বেটার অপশন ছিল না? আমাদের অমন রাজপুত্রের মতো ছেলেটার পাশে ওকে বিশেষ মানায় নি।
ইসরা তখন ডাইনিং এ খাবার পরিবেশন করছিলো। কথাটা বিশেষ গায়ে মাখলোনা। ও জানে ও আহামরি নয়, আরুশের পাশে বেমানান বলাটা অস্বাভাবিক না। তাই আপন মনেই সব প্লেট সাজাচ্ছিলো। আরুশের দাদী হাফিসা বেগম বললেন, জাতের মাইয়া কালা হইলেও ভালা। তোর ভাসুরের মাইয়া বৃষ্টির খালি রংটাই আছে ডক নাই। তার চেয়ে বড় কথা হইলো যার মনে যারে ধরে। আমার নাতির মনে যারে ধরছে তারেই বিয়া করছে। আমার বিশ্বাস আমার নাতির পছন্দের মাইয়া নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ না,, এখন আজাইরা কথা তুইলা মনমেজাজ বিগড়াইস না।
তা যা বলেছেন আম্মা, আরুশ যখন আমাকে এসে বলেছে ওর ইসরাকেই চাই। আমিতো ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। আমার ছেলের চোখ নিজের থেকে সরে বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দে গেছে। এতেই আমি খুশি হয়ে গেছি! তাছাড়া ইসরার রূপেগুণে কম নয়। আজ সব রান্না ও করেছে।
ছোট ফুপী টিপ্পনী কেটে বলল, রান্নার সুবাস দেখেই প্রশংসা করার কিছু নেই। খেয়ে দেখতে হয়। সবে তো বিয়ে হলো, দেখি কয়েক মাস পরেও এমন করেই বলতে পারো কি না।
দোআ করো ভাই যেন বড় মুখ করে বলতে পারি, তোমার ভাতিজার বৌ ভালো।
সবাই একসঙ্গে খেতে বসলেও ইসরা বসলো না। সবাইকে পরিবেশন করতে লাগলো। যদিও তাকে জোর করা হয়েছিল তাদের সঙ্গেই বসতে। কিন্তু ইসরা বসেনি। আরুশ ইচ্ছে করেই অল্প অল্প করে খাচ্ছিলো। সবাই রান্না নিয়ে বেশ প্রশংসা করলেও ছোট ফুপী ভুল ধরতেই বিজি ছিলেন। সবাই এতে বিরক্ত হলেও কিছু বললোনা। খাওয়া শেষে হাফিসা বেগম বললেন, নাতবৌ হাত দাও দেখি।
ইসরা সংকোচে হাত বাড়াতেই তিনি হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেয়ে বললেন, আল্লাহ তোমার ঘর আলো করে রাখুক।
তারপর দু’হাতে সোনার বালা পড়িয়ে বললেন, আমাদের তো যত্ন করে খাওয়ালে এবার আমার নাতির পাশে খেতে বসো দেখি। আমার দাদুভাই তোমার সাথে খাবে বলে মুরগির মতো ঠোকরাই ঠোকরাই অল্প অল্প করছ খাচ্ছে।
তার কথা শুনে আরুশ বিষম খেলো। সবাই হেসে উঠে গেল। হাফিসা তাকে আরুশেয পাশে বসিয়ে প্লেট এগিয়ে খাবার দিলো। নাও দাদুভাই তোমার বৌ তোমার পাশেই দিছি, এখন একটু পেট ভইরা খাও।
আরুশ প্লেটের দিকে চেয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। যেন প্লেট থেকে চোখ সরালেই কেউ খাবার নিয়ে যাবে,,,
ইসরা বলল, রান্না কি ভালো হয়নি? খেতে কষ্ট হচ্ছে?
নাহ খারাপ হয়নি। সবাই নিশ্চয়ই আপনার মন রাখতে মিথ্যে বলেনি?
আপনার থেকে জানতে চেয়েছি। সোজাসাপটা উত্তর দিলেই হয়,
আরুশ হঠাৎ তার পাত থেকে লোকমা তুলে ইসরার গালে তুলে বলল, নিজেই খেয়ে দেখুন কেমন হলো।
ইসরা খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। আরুশ এটা কি করলো!
এক লোকমা খেলে মানুষ পানিতে পড়ে যায়, দেখি হা করুন আরেক লোকমা দেই।
ইসরার অপেক্ষা না করে আরুশ আরেক লোকমা তুলে দিলো।
।
বিকেলের চায়ের আড্ডায় সবাই মত্ত থাকলেও আরুশের মনোযোগের মূলবিন্দু ছিল ইসরা। ইসরাকে আজ সত্যিই বৌ বৌ লাগছে। কি সুন্দর হেসে হেসে সবার সঙ্গে কথা বলছে, চা নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছে। দাদীর পাশে মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। ফোন নিয়ে বিজি এমন ভাব ধরে এককোণে বসে থেকেও সুযোগে বেশ কিছু ছবি তুলে নিতে ভুললো না। তবে দুঃখজনক ব্যাপার ইসরা একবারও ভুলেও তার দিকে তাকায় নি। চা দেওয়ার সময় যা একটু চোখে চোখ পড়েছিল।আরুশ গ্যালারিতে একটা ফোল্ডার ক্রিয়েট করলো। নাম দিলো “রাব্বাতুল বাইত”…..
সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ইসরা যখন রুমে এসে বসে দেখে বেডের উপর একটা শপিং ব্যাগ রাখা। ইসরা কৌতুহলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ভাবতে থাকে খুলে দেখবে কি না। পরক্ষণে মনে হয় আরুশ রেখেছে হয় তো। অন্যের জিনিস পারমিশন ছাড়া ধরা ঠিক হবে না। তাই ব্যাগটা যথাস্থানে রাখতে যেতেই আরুশ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ওটা আপনার জন্যই। খুলে দেখুন।
ইসরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল, আমার জন্য?
জ্বি!
হঠাৎ?
হঠাৎ আবার কি! গিফট দিতে দিনক্ষণ লাগে নাকি? তাছাড়া বিয়ের রাতেও গিফট দেওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম নিয়ে নেই।
ইসরা বক্সটা খুলে দেখলো ডায়মন্ডের খুব সুন্দর একটা নেকলেস। আরুশ বললো, পছন্দ হয়েছে?
হুম, ডিজাইনটা খুব সুন্দর। আপনার চয়েজ আছে বলতেই হয়! শুধু লাইফ পার্টনার চুজিং এ ভুল করে ফেলেছেন…
বলেই চুপ হয়ে যায় সে। মনের কথাটা এভাবে বেরিয়ে আসায় সে নিজেও ভীষণ চমকে যায়।
কথাটা শুনে মুহূর্তেই আরুশের মেজাজটাই বিগড়ে যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ দমানোর বৃথা চেষ্টা করে।
ইসরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, স্যরি স্যরি আমি কথাটা ভুলে,,,,
কথাটা শেষ করবার আর সুযোগ পায় না, আরুশ রেগে তাকে দেয়ালে চেপে ধরে। চোয়ালশক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, সবসময় কেন এমনটা করতে হয় আপনার? আমার সামনে কি ভুলেও ভালো কথা আসেনা? হাসিমুখ হয়না? সবার সামনে তো ঠিকই ভালো থাকেন, হাসিখুশি থাকেন। কাকে কখন কি বলতে হয় সব বোঝেন। তবে আমার বেলাই সব তিক্ত কথন কেন বেরোয় আপনার মুখ দিয়ে?
ইসরা চোখ বন্ধ করে খিচে দাঁড়িয়ে থাকে। আরুশ এতো জোরে তাকে দেয়ালে চাপার দরুন পিঠে বেশ জোরেই ধাক্কা খেয়েছে। তার উপর যেভাবে দুই বাহু ধরেছে এখুনি না খসে পড়ে যায়,,,
ইসরা ব্যথাতুর গলায় বলল, আমি ব্যথা পাচ্ছি আরুশ।
আরুশ হাত আলগা করে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর গলায় বলল, আমিও ব্যথা পাই রুশফিকা! আমারও যন্ত্রণা হয়….
তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে যায়। ইসরা নিজের কপাল চাপড়ে বলে, আমি আসলেই টক্সিক হয়ে গেছি। সবসময় বিষকামুড়ের মতো বিষাক্ত কথা ছড়াই। যত ভাবি উনার সামনে সংযত থাকবো, সত্যি কথা কম বলবো, ততোই বাজে কথা বের হয় আমার মুখ দিয়ে। উফ!!
চলবে,,,