মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-০৪

0
539

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৪

#আরশিয়া_জান্নাত

মা আজকে আমার ক্যারিয়ারের ফার্স্ট প্রেজেন্টেশন আছে। দোআ করে দাও তো,,

মায়ের কাছে দোআ চাইতে হয়না মণি। কাছে ছিলি তারপরও চিন্তার কম ছিল না এখন আরো কত দূরে।

তারপর বিড়বিড় করে দোআদূরুদ পড়ে বললেন, ফোনের স্ক্রিনেই ফুঁ দিলেন। আমি স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার মা! সহজ সরল প্রকৃতির খুবই সাধারণ মানুষ। সন্তানদের কাছে মা হয়তো এমনই।

আচ্ছা মা রাখছি, বের হবো। পরে কল দিবো। তুমি মনে করে প্রেশারের ঔষধটা খেয়ে নিও।

আচ্ছা সাবধানে যাস, আর মাথা ঠান্ডা রাখিস।

হুম আস্সালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুমুস্সালাম।

ফোন রেখেই আমি বেরিয়ে পড়লাম অফিসের উদ্দেশ্যে। পথেই ম্যাথিনের সঙ্গে দেখা হলো। সে প্রাণোচ্ছল অভ্যর্থনা জানিয়ে বললো, ইসরা তোমার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা। তুমি কি নার্ভাস?

আমি ঈষৎ হেসে মাথা নাড়লাম।

সে আশ্বস্ত করে বললো, চিন্তা করো না। আজকের মিটিং টা তোমার দেশী। আশা করি এটা তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট হবে।

সিরিয়াসলি?

হুম।

বুঝতে পারছি না রিল্যাক্সড ফিল করবো নাকি আরো ভয় পাবো!

কেন?

আমি আর কিছু বললাম না। আমার ইন্টার্নির অভিজ্ঞতা আমাকে এটাই শিখিয়েছে আপনের চেয়ে পর ভালো! দেখা যায় স্বদেশীর চেয়ে বিদেশিরাই হেল্পফুল বেশি হয়।

ল্যাপটপের ফাইলগুলো আরেকবার চোখ বুলিয়ে প্রজেক্টরে কানেক্ট করে আমি অপেক্ষা করছি ক্লায়েন্টের জন্য। আমরা টিম মেম্বাররা সবাই ডিসকাশন করছিলাম তখনই বস সহ উনারা সবাই উপস্থিত হন।
আমি শুরুতে কিছুটা নার্ভাস হলেও পরবর্তীতে ফ্রিকোয়েন্টলী প্রেজেন্টেশন দেই। তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চেষ্টা করি। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করলাম সেই কোম্পানীর সিইও আমার দিকে শুরু থেকেই এক ধ্যানে চেয়ে আছেন। তার তাকানো টা স্বাভাবিক নয়। কেমন যেন রাগক্ষোভ মিশেলে অদ্ভুত দৃষ্টি।

কফি ব্রেকে সবাই বেরিয়ে গেলেও আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম তখন দেখি আমি ছাড়াও আরও একজন রয়ে গেল রুমে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে উঠে এসে বললো, মিস রুশফিকা কামাল ইসরা!

ইয়েস স্যার?

একটু ভালো করে তাকিয়ে বলুন তো আমার নাকের হাড় সত্যিই কি বাঁকা?

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, স্যরি?

সে সোজা হয়ে বুক টানটান করে দাঁড়ালো। একহাতে চুল ব্রাশ করে বললো, আপনার স্মৃতিশক্তি কি এতো দূর্বল? নাকি ঐ ঘটনাটা তুচ্ছ ভেবেই ভুলে গেছেন।

আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আপনি কি অনুগ্রহ করে খোলাসা করে বলবেন?

আপনি ২৫/৭/২৩ তাং বিকেল ৪:৪৫ মিনিটে শাহ আমানত বিমানবন্দরে বলেন নি আমার নাকের হাড় বাকা? আরো অনেক কথাই তো বলেছেন। মনে পড়লো?

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ওহ আল্লাহ! আপনি সেই লোকটা? এতো ডিটেইলসে কেউ মনে রাখবে, আমি কল্পনাই করিনি,,,

সে দাম্ভিকতার সহিত মাথা উঁচিয়ে বললো, আমার স্মৃতিশক্তি ছোট থেকেই বেশ শার্প। সময় মনে রাখা আমার জন্য সাধারণ ব্যাপার।
যাই হোক, প্রশ্নের উত্তরটা দিন।

আমি তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালাম। লম্বা চওড়া, ফর্সামতোন ছেলে। চুলগুলো ঘনকালো ঝলমলে, ফেইস কাটিং মাশাআল্লাহ। আসলেই নজর কাড়া সুদর্শন সে। কিন্তু কাউকেই আল্লাহ ১০০% পারফেক্ট করে পাঠান না। সেও এই নীতির বাইরে নয়। মন দিয়ে তাকাতে গিয়ে টুকটাক কিছু খুত নজরে পড়লো ঠিকই। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বোধ হলো
সে হয়তো খানিকটা বোকা। নয়তো কোটি টাকার প্রজেক্ট সাইন করতে এসে সেই সম্পর্কিত প্রশ্ন না করে কেউ একদিনের কাকতালীয় ঘটনার রেশ ধরে প্রশ্ন করতে পারে? হঠাৎ মনে পড়লো সেদিন সে নিজের কত গুণগান করেছিল। আমিও তাকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছি। তবে কি সেজন্যই এতোক্ষণ ঐরকম চাহনী নিয়ে তাকিয়ে ছিল!?
তার চোখে চোখ পড়তেই বললো, স্ক্যান করা শেষ? এখন বলুন?

আমি হেসে বললাম, দেখুন সৃষ্টিকর্তা ব্যতিত কেউই ১০০% পারফেক্ট না। মানুষ যে দৃষ্টিতে তাকায় সেই দৃষ্টির উপর দোষগুণ নির্ভর করে।আমি যদি আপনার খুত ধরার দৃষ্টি দেই তবে খুত পাবো, যদি ভালোটা খোঁজার দৃষ্টি দেই ভালো পাবো। এটাই ন্যাচারাল।

সবাই চলে আসায় কথা আর এগোলো না। আমি মনে মনে ধরেই নিলাম, গেল আমার সব গেল। এই লোকটা নিশ্চিত সেদিনের ঝাঁজ তুলবে। যে এই তুচ্ছ ঘটনা মনে রাখতে পারে, তার মানে সে নেগেটিভ এফেক্টই ফেলবে। হাহ!

.

ম্যাথিনের ফোনে ঘুম ভাঙলো আমার। কল রিসিভ করতেই সে বললো, ইসরা তুমিতো ফাটিয়ে দিয়েছ। সবাই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আজকে বিকেলে সবাই কফি ট্রিট চাই!

আমার ঘুম ছুটে গেল মুহূর্তেই, আমি উঠে বললাম, ম্যাথিন তুমি কি সিরিয়াস? মিস্টার আরুশ এসাইন করেছেন?

হ্যাঁ!

আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না,,

কি যে বলো তুমি!

বেশ তবে বিকেলে দেখা হচ্ছে।

আমি থম মেরে বসে রইলাম। দিনটা শুরু হলো একটা ভালো খবর দিয়ে। বাবাকে ভিডিও রেকর্ড করে পাঠালাম। যাক বাবা লোকটা ভেজাল করে নি!

ঘটনা এখানেই শেষহলে পারতো, কিন্তু হলো না। বরং এ যেন ছিল সবেই সূচনা…..

এলাইনার সঙ্গে টুকটাক রান্নার জিনিস কিনে কফিশপে বসলাম। ও বললো, ইসরা আমার কি মনে হয় জানো মিস্টার আরুশ একজন নার্সিসিস্ট! সেজন্যই সে তোমার ঐদিনের বলা কথাগুলো ভুলেনি।

নার্সিসিস্ট?

হ্যাঁ। একটু খুলেই বলি শোনো। একজন Narcissist হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে কারণে অকারণে অনেক গুরুত্বপূর্ন ভাবে, নিজেকে অনেক ভালোবাসে। নিজের গুরুত্ব নিয়ে তার অযৌক্তিকভাবে উচ্চ ধারণা থাকে। অন্যদের কাছ থেকে তারা সবসময় নিজের অত্যাধিক প্রশংসা আশা করে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ন বা অত্যন্ত দামী কেউ হিসেবে প্রকাশ করতে সবসময় চেষ্টা করে। যেকোনো জায়গায় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু নিজের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করে। একজন narcissist ব্যক্তি অন্যদের ওপর সহানুভূতিশীল নাও হতে পারে, নিজে যা চায় সেটা পাওয়ার জন্যে অন্যদের ছোটো করতে হলেও তারা পিছপা হয়না। Narcissism বা আত্মপ্রেম শুধুমাত্র একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, Narcissism মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে এটিকে একটি মানসিক রোগ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া যায়। সমালোচনা সহ্য করতে না পারা, কারো সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে না পারা, স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে না পারা। আর এ ছাড়াও তারা তাদের আশানুরূপ প্রশংসা বা অন্যের মনোযোগ না পেলে অখুশি বা হতাশ হয়ে যেতে পারেন।
এসব হলো তাদের বৈশিষ্ট্য।(তথ্যসূত্র:গুগল)
আশা করি তুমি বুঝতে পারছো?

হ্যাঁ অনেকটাই বুঝতে পেরেছি। উনি আসলেই নার্সিসিস্ট!

আমি বলবো তুমি তাকে চেহারা বা ব্যক্তিগত কোনো বিষয়েই অনেস্ট মতামত বলো না। যেহেতু তুমি তার প্রজেক্টে আছ, এটাই তোমার জন্য শ্রেয়।

আমি বিষয়টা মাথায় রাখবো। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এলাইনা,,

আরেহ ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই। তুমি একটু বসো, এন্ড্রো কল করেছে। আমি কথা বলে আসছি।

আচ্ছা।

আমি মনে মনে হিসাব মেলালাম। শেষে কিনা মিস্টার নার্সিসিস্টের চক্করে পড়তে হলো!!!

কি ব্যাপার বল তো আরুশ? তোর শরীর কি খারাপ? অসময়ে শুয়ে আছিস যে?

না মা আমি ঠিক আছি। কিছু বলবে?

তোর চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?

এমনি ক্লান্ত লাগছে তাই হয়তো

আচ্ছা শোন, সারিকার জন্য একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। তোর বাবা বললো তোকে বলতে। তুই চাইলে কথা এগোবে,,,

মা আমার চেয়ে তোমরা অনেক ভালো বুঝবে।
তবুও তোমরা চাইলে খোঁজখবর নিবো।

তার মা আর কিছু বললো না। নিরবে প্রস্থান করলো। আরুশ মনে মনে বলল, মিস ইসরা আমি বহুবছর নিজেকে ভালোবেসেছি, নিজেকে পারফেক্ট ভেবেছি। সবসময় ভেবেছি আমি সবদিকে ১০০তে ১০০। কিন্তু আপনি আমার এতো বছরের কনফিডেন্স নষ্ট করে দিয়েছেন। আমি এখন আয়নায় তাকাতে পারছিনা। নিজের খুত ব্যতীত কিছুই চোখে পড়ছেনা এখন। আপনার উপর আমার রাগ করা যুক্তিযুক্ত না, কিন্তু আমি রাগ না করেও পারছি না। আপনি হয়তো জানেনও না আপনি আমার শান্তি নষ্ট করে দিয়েছেন। আমি হিংস্র হয়ে উঠছি ভেতরে ভেতরে।

রাদিফ আরুশের সামনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আরুশ থম মেরে বসে আছে। রাদিফ বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বললো, ভুল করে ফেলেছি সিডনী না গিয়ে। ঐ মহীয়সী নারীকে চোখে দেখা হলোনা আমার। সে কিভাবে পারলো বিনা ডিটার্জেন্টে তোকে এমন ধুয়ে ফেলতে!! হোহোহো

আরুশ হাতের গ্লাসটা ছুড়ে মারলো ফ্লোরে। রাদিফ হাসি থামিয়ে আরুশের দিকে তাকালো। এই প্রথম আরুশ এতো রেগে গেছে।

দোস্ত আমি তোর রুদ্ররূপ দেখে ভয় পাচ্ছি।প্লিজ শান্ত হ। এতো হাইপার হবার মতো কিছু ঘটেনি। সে জাস্ট একটা কমেন্টপাস করেছে নাথিং ইলস। এরকম কত কথাই মানুষ বলে ফেলে। সব গায়ে মাখতে আছে?

আরুশ থমথমে গলায় বলবো, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রাদিফ।

কি সিদ্ধান্ত?

আরুশ ক্রুর দৃষ্টিতে চেয়ে বললো, আমার শান্তি ফেরত আনতে হলে তাকে অশান্তিতে ফেলতে হবে।

এটা তোর ভুল সিদ্ধান্ত আরুশ। তুই শান্ত হয়ে বস।

আমি ঘুমাতে পারছিনা, দেখ আমার চোখ কেমন হয়ে গেছে? আমি হতাশ হয়ে গেছি।আমার ভালো লাগছেনা।

তোর আশেপাশে যারা তোকে পছন্দ করে তাদের সঙ্গে মিট কর।তোর কনফিডেন
ট ব্যাক করবে।

এই পৃথিবীর অন্য সব মেয়ে আমার প্রশংসা করলেও কাজ হবেনা।

রাদিফ ভীষণ অবাক হলো, এই আরুশ তার বড্ড অচেনা, কি চলছে তার মনে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে