মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-০৩

0
608

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৩

#আরশিয়া_জান্নাত

আরুশ কখনো কারো প্রেমে পড়েছিস?

হ্যাঁ রোজই তো পড়ছি,,

রাদিফ বিরক্ত হয়ে বলল, নিজের উপর বাদে?

অত সময় কই?

তাও যা বললি। আমি তোর মতো মানুষ এই জীবনে একটাই দেখছি!

তুই কার প্রেমে পড়লি আবার?

তোদের অফিসে একেকটা স্টাফ চোখ ধাঁধানো সুন্দর!

তোর চোখে মেয়ে মানেই সুন্দর। ওদের দিকে নজর দিস না। এজ এ ওনার আমি চাইবো না আমার স্টাফদের দিকে কেউ কুনজর দিক!

এহহ আসছে বড়! আমি কুনজর দেই? এটা হচ্ছে প্রেমময় দৃষ্টি,,

শব্দ বদলালেই অর্থ পরিবর্তন হবেনা।

কেন ডেকেছিস বলে ফেল।

আমি পরশু বিজনেস ট্রিপে ফরেন যাচ্ছি। তুই কি ফ্রি আছিস?

না রে রিসেন্ট কিছু প্রজেক্টে বেশ খাটতে হচ্ছে। এখন সময় দিতে পারবোনা।

তুই থাকলে সুবিধা হতো। অলমোস্ট ১মাস ওখানে থাকতে হবে,, তুই এর মধ্যে সুযোগ হলে জয়েন করিস।

ওকে ট্রায় করবো।

রাদিফ চলে যেতেই আরুশ ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো। আরুশের বাবা আমজাদ রহমান কেবিনে এসেই মৃদু চিৎকার করে বললেন, আরুশ তোর সাহস কি করে হয় আমার গ্র্যান্টেড করা প্রজেক্ট রিজেক্ট করতে? আমি এখনো মরে যাই নি, এখুনি এতো খবরদারি তোর?

আরুশ হেসে বললো, ওহ আব্বু কতবার বলি চিৎকার চেঁচামেচি করোনা। আমার কানের ক্ষতি হলে কি হবে বলোতো? আর এই যে এমন ভ্রু কুঁচকে রাগী স্বরে কথা বলছো এতে আমার চোখ আর মন কষ্ট পাচ্ছে। এসবে কতো টা প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছো?

আমজাদ রহমান বিমূঢ় হয়ে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। রাগে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আরুশ উঠে গিয়ে বাবাকে টেনে তার চেয়ারে বসালো। কোমল গলায় বলল, আব্বু ব্যাপারটাকে পার্সোনালী নিও না। তোমার ইগো হার্ট করার উদ্দেশ্য আমার ছিল না। তুমি একটু তাকিয়ে দেখো আমি কেন রিজেক্ট করেছি। আরুশের হিসেব নিকাশ শুনে আমজাদ সাহেব বুঝলেন এই প্রজেক্টটা আসলেই তাদের জন্য লাভের চেয়ে লসটাই বেশি দিতো।তবু নিজের আত্মঅহং তাকে নত স্বীকার করতে দিলোনা। তিনি গম্ভীর গলাতেই বললেন, এবারের মতো তোর গোস্তাখি সহ্য করলাম। নেক্সটবার আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করবিনা।

হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো একাই হ্যাঁ বলেছিলাম, তারপর আপনি না বলেছেন তাই না?

আমজাদ সাহেব মিথ্যে রাগ ভেঙে হোহো করে হেসে উঠলেন।

মা আমি একাই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না, রোজ অনেকেই এই এয়ারপোর্ট দিয়ে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তুমি এমন মরা কান্না জুড়ে দিলে কেন?

মণি তুই একটু পরেই বিদেশ বিভূইয়ে চলে যাবি। আমি চাইলেই তোকে বুকে নিতে পারবোনা। আমার বড় মেয়ে তুই কত আদরের,,,,

মা শান্ত হও,

ছোট মামা মাকে টেনে বলল, আপা এমন করিস না, সবাই যদি এভাবে কেঁদেকেটে ওকে পাঠাই ও নরম মন নিয়ে একা যাবে কিভাবে?

আমি আমার একঝাঁক আপনজনদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি অন্য দেশে, অন্য এক ভুবনে!

ইমিগ্রেশন পার হয়ে চোখ মুছে সামনে ফিরতেই এক লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। ভদ্রতাসূচক স্যরি বলে উঠতেই সামনের মানুষটা ঝরঝরে গলায় বলে উঠলো, ইটস ওকে ম্যাম। আসলে এমন হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট ছেলে দেখলে যে কেউই ধাক্কা খাবে স্বাভাবিক।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। বলে কি লোকটা আমি যে চে তার গায়ে পড়েছি!

এক্সকিউজ মি! এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। এখানে আপনার গুড লুকিং মোটেও ম্যাটার করেনা,,,

আরেহ ব্যাপার না লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।মানুষের মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সৌদর্য নিতে পারে না স্বাভাবিক।

স্ট্রেইঞ্জ! আপনি দেখতে অতোটাও হ্যান্ডসাম নন যে কারো মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিবে। তার উপর আপনার নাকের হাড়টা একটু বাঁকা দেখতে কেমন যেন টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো। আপনার ভ্রুর উপরের কাটা দাগটা দেখে মনে হচ্ছে এলাকার সস্তা মাস্তান। আর রইলো হাইট ওমন হাইট আমাদের গ্রামের লাতু মুন্সির ও আছে। তো নিজেকে আহামরি কেউ ভাবা বন্ধ করুন। যত্তসব!

আমি কথাগুলো বলে প্লেনে উঠলাম, ঐ লোকটা ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দেখে বুঝলাম ভালোই জব্দ হয়েছে। কেমন আজিব মানুষে ভরপুর এই পৃথিবী। নিজেকে ভাবে কি সে! জাস্টিন ট্রুডো ও তো এতো অহঙ্কার করে না নিজের সৌন্দর্য নিয়ে।

আরুশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই প্রথম, জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে মুখের উপর এতোগুলো কথা শুনিয়ে গেল। এই পর্যন্ত সে যেখানেই গেছে সবসময় মুগ্ধ চোখ দেখেই অনভ্যস্ত সে। সবার আকর্ষণের মূলকেন্দ্র হয়ে উঠা আরুশকে একটা অচেনা মেয়ে এতোগুলো খুঁত বলে গেল? আরুশ ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে নিজের চেহারার দিকে তাকালো। সত্যিই কি তার নাক দেখতে টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো? হাড় বাকা? ছোটবেলায় বেঞ্চের কোণায় ব্যথা পেয়ে কেটে যাওয়া দাগটা দেখলে এলাকার সস্তা মাস্তান মনে হয়? একটা পুঁচকে মেয়েঔ হাইটে যে তার বুক অবধিও আসবেনা সেই কি না এতো কটু কথা শুনিয়ে গেল তাকে? আরুশও নিজেকে বললো, রিল্যাক্স আরুশ রিল্যাক্স। টেক এ ডিপ বেথ,,,,,

সিডনীতে প্রথম কয়েক দিন আমার কেটে গেল নানান ব্যস্ততায়। এরমাঝে এলাইনা নামক টার্কিক মেয়ের সঙ্গে আমার বেশ ভালোই ভাব হলো। বলতে গেলে ও আমাকে অনেক হেল্প করেছে। আমি স্থির হয়ে বসতে সপ্তাহখানেক সময় লাগলো। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে কফি মগ হাতে বেলকনীতে বসলাম। কাচ গলে যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই অচেনা মানুষের বসতি, এখানে আমার আপন কেউ নেই। একটা অচেনা দেশ অচেনা শহরে আমি আজ ২ সপ্তাহ বাস করছি। সবসময় বাসায় ফিরে মায়ের তৈরি করা খাবার এখানে টেবিলে সাজানো থাকেনা, না থাকে ছোট ভাইবোনদের খুনসুটি আর আড্ডা। আমি সবাইকে মিস করি চরমভাবে, এলাকার সেই কালোসাদা মিশেলে বিল্লিটাকেও রোজ মনে পড়ে। মনে হয় যখন ফিরবো এরা সব থাকবে তো? যাদের ফেলে এসেছি, তারা আমার মানসপটে যতোটা অমলিন ততোটা অমলিন হয়ে দেখবো তো আবার? আমি জানিনা আমি এতো ইমোশনাল কবে হলাম। দেশে থাকতে দেখা যেত বেশিরভাগ সময় আমি নানা কাজে ব্যস্ত থেকেছি, সবার সঙ্গে আমার আলাপচারিতাও বিশেষ স্মৃতিবহুল নয়। তবে দূরে এসে কেন ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর সকলকিছুই মনে পড়ছে?
আমি আমার জীবনের একটা জঘন্য ঘটনা ভুলতে কত কি করেছি, স্কুল বদলেছি, শহর বদলেছি, এখন দেশ পর্যন্ত বদলালাম। অথচ সেই ঘটনা বদলাতে পারলাম না, না পারলাম বিস্মৃতি ঘটাতে।

আমি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। স্বপ্ন ডাক্তার হবো। তাই বাবার পারমিশন নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। পড়াশোন প্রতি তীব্র অনুরাগ ছোটবেলা থেকেই আমার মাঝে দৃশ্যমান ছিল বলেই সবাই বেশ আদর করতো আমায়। আমিও প্রাণপণে চেষ্টা করতাম নিজের বেস্টটা দেখাতে। বাবা আমার জন্য আমাদের স্কুলের বেস্ট স্যার এপয়েন্ট করেন। সপ্তাহে তিনদিন আমি সেই স্যারের বাসায় প্রাইভেট ব্যাচে পড়তাম। সত্যি বলতে স্যারের সুখ্যাতি ছিল অনেক। ফিজিক্স হোক কিংবা হায়ার ম্যাথ সব এতো সহজসাবলীল ভাবে বোঝাতেন, আয়ত্ত করতে বিশেষ কসরত করতে হতোনা। আমি তখন সেই স্যারকে মনেপ্রাণে সম্মান করতাম। আমার প্রিয় স্যারের তালিকায় সে ছিল প্রথম।
কিন্তু কে জানতো এক সময় এই স্যারকেই এতো ঘৃণা করবো? এই স্যারের জন্যই ভেতরে ভেতরে এতো মুষড়ে পড়বো?
এই বিখ্যাত স্যারটা যেবার জাতীয় পর্যায়ে ক্যামিস্ট্রির জন্য বিশেষ সম্মাননা পেলেন, আমি কত আনন্দিত হয়েছিলাম। স্যারের জন্য নিজে চয়েজ করে আড়ং থেকে ৭হাজার টাকার পাঞ্জাবি আর শাল কিনে গিফট করেছিলাম। সবাইকে কত গর্ব করে বলতাম আমার স্যার কত বেস্ট! আহা একসময় কত ভক্তই না ছিলাম তার। এই শ্রদ্ধাভাজন সম্মানীয় ব্যক্তিটা কেন আমার চোখে এতো নীচে নামলো? কেন আমার জীবনে একটা গভীর কালো দাগ লেপন করে গেল? সেই ঘটনা আমি আমার মায়ের কাছেও কখনো বলিনি। না বলেছি আমার কাছের কোনো বান্ধবীকে। আমি একা একাই বয়ে চলেছি কতগুলি বছর।

আমাকে যখন কেউ বেস্ট বলে, কিংবা আইডল হিসেবে দাঁড় করায়। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে মরি। আমার ভেতরটা অট্টহাসিতে ফেঁটে বলে, তুই বেস্ট না ইসরা। তুই কলঙ্কিনি। তোর চরিত্রে কলঙ্কের গাঢ় প্রলেপ আঁকা। ওরা যেদিন জানবে তোকে ঘেন্নায় ছুঁড়ে ফেলবে। আজ যারা তোর এতো প্রশংসা করছে তারাই তোর নাম শুনলেই নাক ছিটকে থুতু ফেলবে।
আমি মনকে আশ্বস্ত করি কেউ জানবে না, কখনোই জানবেনা। আমি তো কাউকে জানাইনি। তখন সে বলে উঠে, তোর বর তো জানবে। যেদিন সে বুঝবে তুই সতী নস, তোর দেহ ইতোপূর্বেই কেউ খুবলে খেয়েছে। কি ভাবছিস তখনো সব গোপন থাকবে?

আমি কানে দু হাত চেপে ধরি। নিজের বিবেকের দংশনে ব্যথায় নীল হয়ে যাই। আমার ইচ্ছে করে এই অপবিত্র দেহটাকে শেষ করে দেই। আমি নিজেকে ঘেন্না করি। ভীষণ ঘেন্না করি। এই কলঙ্কিত শরীরটার ভার আমার অসহনীয় লাগে।

মানুষের গড় আয়ু তো কমে গেছে তাই না? অল্প বয়সেই কত জন মরে। আমি মরি না কেন? আমার কেন আয়ু ফুরায় না? শরীরটা তো অপবিত্র হয়েছে বহু আগেই, আ*ত্ম*হ*ত্যা করে সত্ত্বাটাকে আর নষ্ট করতে চাই না। শেষ বিচার দিবসে আমি তো চাই আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদেকেটে সবটা নালিশ করতে। মহাপাপী হলে কি আর দাঁড়ানোর মুখ থাকবে? সবাই ঘৃণা করলেও তো মহানুভব রব তো সবজানেন। তিনি নিশ্চয়ই আমায় ঘৃণা করবেন না, তাই না?

আমি কাচের বদ্ধ ঘরটায় গুমড়ে কেঁদে উঠি। আমার একাকিত্ব আমাকে আরো বেশি স্মৃতিকাতর করে তোলে। আমি মুষড়ে যাই। এই পৃথিবীতে আমাকে সামলানোর কেউ নেই কেউ না,,,,,

হ্যালো সাকু? একটা সিরিয়াস কথা বলতে কল করেছি মন দিয়ে শোন।

কি বলবি বল?

আমার নাকের হাড় কি বাঁকা? দেখতে টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো?

ভাইয়া এই প্রশ্নটা আর কয়বার করবি? বলেছি তো না,,

একটু ভালোমতো দেখে বল।আমার ছবি আছেনা? নাকি ভিডিও কল দিবো?

উফফ ভাইয়া রোজ একবার একই কাহিনী রিপিট করিস না অসহ্যকর! আগে ছিল এক যন্ত্রণা সারাক্ষণ নিজের গুণগান করতি। এবার সিডনি গিয়ে হলো আরেক যন্ত্রণা। কে কি বললো ওতেই এমন নেতিয়ে পড়া তোর কাছ থেকে আশা করা যায় না ভাই!

আরুশ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ওসব তুই বুঝবিনা সাকু। এই প্রথম কেউ আমায় এভাবে বলেছে। এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য অনেক কঠিন।

নিন্দুকের কথায় পাত্তা দিচ্ছিস কেন?

ভুলতে পারছি না,,ঘুমাতে গেলেও ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। স্বপ্নেও দেখছি সে ওমন ভ্রু কুঁচকে রাগী গলায় বলছে আপনি দেখতে মোটেও আহামরি নন,,,,,

সারিকা ফোন মিউট করে এসাইনমেন্ট লিখতে শুরু করলো। ওদিকে আরুশ একই কথা রিপিট করেই যাচ্ছে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে