#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-২
#আরশিয়া_জান্নাত
আকাশে আজ তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। ঝলমল করছে তারা ভর্তি আকাশ। আকাশে এমন তারার মেলা বসলে মাঝেসাজে ঘষে পড়া তারা দেখা যায়। আমি মনে মনে সেই প্রতীক্ষায় আছি যেন।
নক্ষত্রের পতন দেখার মাঝে আনন্দ খুঁজে পাওয়া নির্মম মনের প্রকাশ কি না জানি না। তবে কিছুক্ষেত্রে আমরা সবাইই নির্মম। আমি চাই এমন ঝলমল করতে থাকা বিশেষ নক্ষত্ররা খসে পড়ুক এমনভাবে যেন তার ধ্বংসাবশেষে ধূলোয় উড়া ছাই ব্যতিত কিছুই না হয়।
হঠাৎ ফোনে টিউন বাজতেই ধ্যান ভাঙ্গে আমার। আমি কল রিসিভ করে কানে তুলতেই মিদাত প্রফুল্ল স্বরে বলে, রুশু কই আছিস?
কেন?
গুড নিউজ আছে। আমি তোর বাসার সামনে, চটজলদি নীচে আয়।
পারবোনা।
আচ্ছা আমিই আসছি।
ছাদে আছি, চলে আয়।
নাহ ছাদে যাবো না। ছাদে তুই মানুষ কম ভুত বেশি লাগস।
তাহলে এখন দেখা হবেনা। আমি জরুরী কাজে ব্যস্ত আছি।
মিদাত আকাশের দিকে চেয়ে বলল, ওহ এই ধ্যানে বসছোস। তুই আর নামবিনা, আমি বরং আন্টির সাথে আড্ডা দেই।
এজ তোর মর্জি।
মিদাত ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলে গেইটের ভেতর ঢুকলো। এই বাড়ির গেইটে ঢুকতে তার ভীষণ ভয় লাগে। ইসরার বাবা ফয়েজ আহমেদ শখ করে ইয়া বিশাল এক কুকুর পালেন। দিনের বেলায় সেটা শেকল দিয়ে বাধা থাকলেও রাতে খোলা থাকে। তবে এখন সন্ধ্যারাতে কোন হালে আছে আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। মিদাত তাই উঁকি দিয়ে দেখল কুকুরটা কোথায় আছে। তখনই দারোয়ান চাচা গোঁফে তা দিতে দিতে বললেন, আরেহ মিদাত বাবাজী যে। উঁকি দিয়া কি দেখো?
না চাচা তেমন কিছু না। দেখছিলাম জন কোথায়।
ওহ, বড় সাহেব তারে নিয়ে হাঁটতে বের হইছেন। চিন্তার কারণ নাই। নিশ্চিন্তে যাও।
ধন্যবাদ চাচা।
মিদাত নিশ্চিন্ত মনে ভেতরে ঢুকলো। ইসরাদের ডুপ্লেক্স বাড়িটায় এর আগেও সে বহুবার এসেছে। যতবারই আসে ওর মনে হয় কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছেই। কিন্তু তার দূর্বল স্মৃতিশক্তি স্পেসিফিক পরিবর্তনটা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ। ইসরার বাসায় তার মা বাবা আর দুই ভাইবোন বাদেও আরো ৩জন আছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যক্তি হলেন তার দাদী রাশেদা বেগম। তাকে দেখলেই চশমার ফাঁক দিয়ে যেমন চোখ করে তাকাবে, যেন সে বিরাট কোনো অপরাধ করে হাজতবাসী থেকে পালিয়ে এসেছে। এমনিতে ড্রইং রুমে কেউই থাকেনা, শুধু ড্রইং রুম কেন কেউ যদি পুরো বাড়িও চষে ফেলে মনে হয়না কেউ টের পাবে। এতোই নিরব থাকে এই বাড়িটা। মিদাত মাঝেমধ্যে ভাবে চোর এসে সব চুরি করে নিয়ে গেলেও কেউ খবর পাওয়ার কথা না।
আরেহ মিদাত ভাইয়া যে? কেমন আছেন?
ভালো আছি তুমি কেমন আছ?
ভালো আছি। আপির সাথে দেখা করতে এলেন বুঝি?
হুম। ফাহিম, আন্টি কোথায়?
আম্মুর সুগার ফল করেছে, উনি এখন রুমেই আছেন। আপনি বসুন আপিকে খবর দিচ্ছি।
না থাক আমি তাহলে ছাদেই যাই। ও সেখানে আছে।
কফি পাঠাতে বলে দেই তাহলে?
বেশ!
মিদাত অগত্যা না চাইতেও ছাদের দিকে রওয়ানা হলো।
কি রে তোর আন্টির সাথে আড্ডা দিলি না? ছাদেই এলি?
ঢং করিস না। একটু নীচে নামলে কি বেশি ক্ষতি হতো?
আমি আকাশের দিকে তাকিয়েই বললাম, গুড নিউজটা বল?
মিদাত আমার মুখোমুখি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, মাশুক স্যারের খোঁজ পেয়েছি। তিনি এখন নরসিংদী পৈত্রিক নিবাসে আছেন। ওখানের একটা স্কুলে হেডমাস্টার হয়েছেন শুনলাম। পাশাপাশি গবেষণায় ও ব্যস্ত আছেন
উনার ছেলেমেয়ে?
ছেলে দুটো ঢাকায় আছে, আর মেয়ে বিবাহিত। বরের সাথে সিলেট থাকে।
ওহ! বলা যায় গোছানো পরিবার?
অনেকটাই তাই। ছেলেরা ভালো জব করছে, তিনিও ভালো পজিশনে আছেন। মন্দ নেই কিছুই। গোছানো পরিবারই বলা চলে।
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, এদের জীবন অগোছালো হয় না। যারা অন্যের জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকে, তারা দুঃস্বপ্ন দেখেনা।
তোর প্ল্যান কি এখন?
পতন দেখতে চাই….
রুপা দু মগ কফি আর প্যাটিস নিয়ে ছাদে এলো। টি টেবিলে সেসব দিয়ে চলে যেতেই মিদাত বলল, বাহ্যিকভাবে আমরা মানুষকে যতোটা হ্যাপি ভাবি মানুষ ততোটা হ্যাপিও হয় না
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। মিদাত কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, পাপ বাপকেও ছাড়েনা বুঝলি। মানুষ তার কর্মফল কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীতেই ভোগ করে।
ভণিতা না করে খুলে বল।
স্যারের স্ত্রী ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। তার মেয়ের বিয়ের বয়স ১২ পেরোলেও সন্তান নেই। এ নিয়ে বেশ ঝাক্কি পোহাতে হয়। ওভারিয়াতে প্রবলেম আছে এমন কথাও শুনলাম। বলা চলে তার কাছের নারীরা ভালো নেই,,,
এমন ফল তো আমি দেখতে চাই না।ওদের উপর নয় আমি চাই তার উপর গজব পড়ুক। তার দেহ পচুক। তার হাত, লোভাতুর চোখ, হিংস্র হাসি সব খসে পড়ুক,,, আমিতো পারলে তাকে আস্ত পুড়িয়ে মারতাম। জঘন্য কীট সে!
রুশু!
আমি চোখের পানি মুছে ওর দিকে চেয়ে বললাম, He abused me badly Midat. I can’t sleep at night. Still I can feel those touches…..
মিদাত ধীর গলায় বলল, আমি জানি রুশু। আর জানি বলেই তাকে খুঁজে বের করেছি। এখন কি করতে হবে তাই বল।
তোকে ঝামেলায় ফেলবো না। তুই নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস দে। বাকি যা করার আমি করবো।
চলে যাচ্ছিস কবে?
নেক্সট উইক।
যোগাযোগ রাখিস, ভুলে যাইস না।
তোকে ভুলব? অসম্ভব।
রুশু শোন, আমাদের লাইফে ঘটা ঘটনাগুলোর পেছনে আমাদের হাত থাকেনা। আমরা জাস্ট সতর্ক থাকতে পারি। কিন্তু যা হবার তা হবেই। নিয়তি বদলানো যাবেনা। তাই বলি সেই ট্রাজেডি থেকে বের হয়ে আসার ট্রায় কর। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ব্যাক কর।
আমি হাসলাম। হেসে বললাম, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করার জন্যই দেশ ছাড়ছি। এদেশে আমি থাকতে চাইনা মিদাত।
দোষটা দেশের না রে, দেশটার মানুষদের।
সে যাই হোক। তোকে ধন্যবাদ দিয়ে দায়সারা হবোনা। তোর কাছে ঋণী থাকাটাই বেশ।
ঐ দেখ,,,
আমি আকাশে চেয়ে দেখলাম একটা তারা খসে পড়ছে। মিদাত হেসে বললো, ভালো মানুষের মুখোশধারী দামী নক্ষত্রের ও পতন হোক।
।
আরুশ এই পৃথিবীতে মায়ের পর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে। তার মতে নিজেকে ভালোবাসাই একমাত্র সলিড ভালোবাসা। এতে ভালো ব্যতীত খারাপ কিছুই ঘটেনা। অন্যকে ভালোবাসলে কষ্ট পাওয়ার, ধোঁকা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও নিজের বেলা সেই চান্স থাকে না। এতে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে।
আরুশ নিজের প্রতি খুব কনসার্ন। সে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক্সারসাইজ করে, গ্রীন টি পান করে। তিনটি সাদা জিনিস সে খুব কম গ্রহণ করে, চিনি, ময়দা এবং লবণ! শরীরের যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেনা। এমনকি রাগ বা টেনশনকেও দূরে রাখে পাছে চেহারায় বলিরেখা পড়ে যদি! প্রাকৃতিক উপাদান ব্যতিত ক্যামিক্যাল কিছুই ব্যবহার করেনা। ফজরের নামাযসহ কোনো ওয়াক্তই কখনোই মিস করেনা, কেননা ষনামায পড়লে চেহারায় নূর আসে। রাত ১০টায় সে ঘুমিয়ে পড়ে। যাতে চোখের উপর ক্লান্তি বা ডার্ক সার্কেল না পড়ে। রোজ একটা করে আপেল আর কমলা তার মেনুতে থাকবেই। মানুষের মন খারাপ হলে সাধারণত প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়, এক্ষেত্রে আরুশ আয়নার সামনে বসে নিজের সঙ্গেই সময় কাটায়। যখনই আয়নায় নিজের মুখ দেখে সব মন খারাপ,টেনশন ভ্যানিশড হয়ে যায়। মুগ্ধ দৃষ্টিতে হেসে বলে, ইয়া আল্লাহ এতো সুন্দর সৃষ্টি তোমার! আমিতো বিমোহিত। কি বলে যে তোমার প্রশংসা করি! তুমি আসলেই অনন্য সৃষ্টিকর্তা,,, মোট কথা আরুশ সত্যিকার অর্থে একজন নার্সিসিস্ট! যে নিজের জীবনের অনেকটা সময় নিজেকে দেখেই পার করে!
আরুশের মা সিত্তুল মুনা ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন, আরুশ আসবো?
আরুশ উঠে গিয়ে মাকে টেনে রুমে এনে কোচে বসালো।মায়ের হাঁটুর কাছে বসে বলল, মা তোমার ছেলের ঘরে আসতে অনুমতি চাইতে হয়?
কি করছিলি?
জানো তো কি করি আমি!
বাবা সবসময় নিজেকে এতো দেখতে নেই। বদনজর লাগে,,,
আমি বদনজর কাটানোর দোআ পড়ি প্রতিবার,,,ক্বারিন ব্যাটাও নজর দিতে পারবেনা।
তার মা ছেলের কথা শুনে ভুবন ভুলিয়ে হাসতে লাগলেন। আরুশ বললো, মা তুমি অনেক সুন্দর। ভাগ্যিস আমি তোমার মতোই হয়েছি!
বাবা বাহ্যিক সৌন্দর্যই আসল না। এমন অনেকে আছে যারা দেখতে সুন্দর না হলেও মনের দিক দিয়ে তাদের শুভ্রতা অন্য সবকিছুকে ম্লান করে দেয়। আমি সবসময় চাই তুমি মনের দিক দিয়েও তেমনি পবিত্র হও। আর অপরকে সম্মান করতে শেখো।
নিজেকে ভালোবাসা মানে অন্যকে হেয় করা বোঝায় না মা। আমি জানি প্রতিটা মানুষ একেক দিকে সুন্দর।
কিন্তু অনেকেই ভেবে বসে যে নিজেকে অধিক ভালোবাসে সে অন্যকে ভালোবাসতে পারেনা,,,
তবে আমি জানি আমার ছেলে তেমন নয়। সে নিজের মতো না হোক সবাইকে ঠিকই ভালোবাসতে জানে।
আরুশ মিষ্টি করে হাসলো। মুনা ছেলের দিকে স্নেহার্দ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, আল্লাহুম্মা বারিকলাহু!
চলবে,,,,