মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
707

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-২০

#আরশিয়া_জান্নাত

খাটের কোণে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে ইসরা। কেঁদেকেটে চোখমুখ ফুলে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো, শাড়ির আঁচল অনাদরে পড়ে আছে মেঝেতে। ইসরা হাঁটুতে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদছে।
আজ সেই দিন যেদিন তার জীবনে সেই দূর্বিষহ ঘটনাটা ঘটেছে। প্রতিবছর এই দিনটায় ইসরা পাগলের মতো কান্না করে। ও যতোই চায় তাং টা ভুলে যাবে কোনো না কোনোভাবেই ঠিকই চোখে পড়ে। আছড়ে পড়ে হৃদয়ের করুণ আর্তনাদ, দমবন্ধ করা অসহায়ত্ব।
মেয়েরা শরীর কেন্দ্রীয় অতীত ভুলতে পারেনা। কে তাকে কিভাবে ছুঁয়েছে, হোক সেটা ভীড়ের মাঝে অনাকাঙ্খিত খারাপ স্পর্শ কিংবা আপন কারোর লোলুপ দৃষ্টি। মেয়েরা কিচ্ছু ভুলে না। ভুলতে পারেও না। আপনি খোঁজ নিলে জানবেন এখনো সেই নোংরা স্পর্শের ঘটনা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে এমন বহু মেয়ে আছে। ঘৃণায় অপমানে গোসলে সাবান রগড়াতে রগড়াতে চামড়া ছিড়ে ফেলে, তবুও যেন সেই স্পর্শের দূর্গন্ধ যায় না! এমন নয় তাদের জীবনে বিশেষ পুরুষ আসে না, কিংবা তারা ভালোবাসে না কোনো পুরুষকে। অবশ্যই বাসে, বাবারূপী, ভাই রূপী সন্তানরূপী পুরুষদের অনেই বেশিই ভালোবাসে।
ইসরা আরুশকে ভালোবাসতে শুরু করেছে, সবকিছু জেনেও যে মানুষটা তাকে মেনে নিয়েছে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ তার মনে। আরুশ তাকে সময় দিয়েছে, শরীরি প্রণয় তাদের শুরুতেই হয়নি। নারী পুরুষের মাঝে সৃষ্টিলগ্ন থেকে যে আকর্ষণ আছে, তারা একেসঙ্গে কিছুদিন থাকলে আবেগতাড়িত হবেই। এটাকে কেউই অস্বীকার করতে পারবেনা। ইসরাও নারীসত্বা তার বেলাও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আরুশের প্রতি তার আকর্ষণ তেমনি যেমনটা আরুশের তার প্রতি রয়েছে। অতীতের খারাপ অভিজ্ঞতায় সে ভাবতো স*মের ব্যাপারটা বুঝি খুবই কষ্টদায়ক বা যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি। এটাতে মেয়েরা কেবল ব্যথিত হয়, লাঞ্ছিত হয়। একটা ভয়ঙ্কর ফোবিয়া তৈরি হয়েছিল তার মনে। কিন্তু আরুশ তাকে বুঝিয়েছে, প্রথমবার রিয়েলাইজ করিয়েছে এটা মোটেও নরকীয় নয়। বরং জীববৈচিত্র্যতা টিকিয়ে রাখতে সৃষ্টিকর্তার তৈরী করা এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি। এই একটা সুখের অভাবে জান্নাতের মতো জায়গায়ও আদম সুখী ছিল না। মানুষ কেন জীবকূলের কেউই এটা অগ্রাহ্যকরতে পারবেনা। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মাত্রই অপর লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা, আবেগের বশে মিলিত হওয়া। ইসরা ধ*র্ষিতা মানেই সে এই আবেগের বহির্ভূত কেউ হয়ে গেছে তেমনটা ভাবা ভুল। যদি আরুশ তাকে সময় না দিয়ে প্রথমদিনই স্বামীর অধিকার হরণ করতো, কিংবা মনে অনুভূতি জন্মানোর আগেই কিছু করে বসতো তবে তার মাঝে আর মাশুকের মাঝে তফাৎ থাকতো না। ইসরা আরুশকে বুঝেছে, তার সান্নিধ্যে থেকে মনের মাঝে অনুভূতি পুষেছে। মনে থাকা শঙ্কাটা যেদিন পুরোপুরি শেষ হয়েছে সেদিনই সাড়া দিয়েছে প্রিয়তমের ডাকে।
তবে বিস্মৃতি ঘটেনি, ক্ষতে মলমের প্রলেপ পড়েছে কেবল।

রুশফিকা?

ইসরা মাথা উঁচু করে চায়, তার সামনে উদগ্রীব হয়ে হাঁটু গেড়ে বসা মানুষটা তার জীবনে মিরাক্যাল হয়েই এসেছে। নয়তো ইসরা কি কখনো ভেবেছিল তাকে কেউ পবিত্র ফুল ভেবে কুড়িয়ে নিবে অঞ্জলি দিতে! ভালোবাসায় মুড়িয়ে পরম যত্নে আগলে নিবে? কখনোই ভাবেনি। বরং সবসময় ভেবেছে যখনই প্রকাশ হবে ঘৃণায় ছুঁড়ে ফেলবে, হয়তো মুখদর্শন ও করতে চাইবেনা কখনো। আরুশ তার জীবনে শ্রেষ্ঠ উপহার হয়েই এসেছে,,,,
আরুশ ব্যতিব্যস্ত স্বরে ওর মুখটা দু হাতে তুলে বলল, রুশফিকা কি হয়েছে? এমন করে কাঁদছো কেন?

আরুশের আদুরে গলায় ইসরার বুক ভেঙে আসে, তার কান্নার গতি বাড়ে। বারবার মনে হয় সে কেন পারলো না এই মানুষটাকে একটা শুদ্ধ শরীর দিতে,,,,

রুশফিকা এভাবে কেদো না প্লিজ। শরীর খারাপ লাগছে? কেউ কিছু বলেছে? কি হয়েছে বলবে তো? আমার কষ্ট হচ্ছে তোমায় এমন দেখে।

আরুশ আপনি এতো ভালো কেন বলুন তো? আমি নিজেই নিজেকে মেনে নিতে পারিনা, আপনি কিভাবে মেনে নিলেন? আমায় ছুঁতে ঘেন্না হয়না আপনার?

আরুশ ওকে বুকে চেপে বললো, এই বোকা মেয়ে কি বলো এসব? একদিন বলেছি না আমার কাছে তুমি অনেক পবিত্র। এসব বাজে কথা আর কোনোদিন বলবেনা।

আরুশ আজকেই সেই দিন যে দিন ঐ লোকটা…..

হুশশ আর কোনো কথা না। ঐটা জাস্ট একটা দুঃস্বপ্ন। তোমার ঘুম ভেঙে গেছে, ঐ স্বপ্নের কথা ভুলে যাও।

ইসরা আরুশকে শক্ত করে জড়িয়ে বললো, আপনার মতো মানুষ খুব কম হয়। আপনার মতো করে যদি সবাই ভাবতো হয়তো কেউ বেঁচে ফিরেও সু*ই*সাইড করতো না। আমি খুব ভাগ্যবতী বলেই আপনাকে পেয়েছি,,,

আমি যদি বলি তুমি ধৈর্য ধরে বেঁচে ছিলে বলেই শেষটা সুন্দর হয়েছে? একটা কথা কি জানো রুশফিকা আমাদের জীবনে যে দূর্ঘটনা ঘটে তাতে আমাদের হাত থাকেনা। তবে যদি ঐ সময়ে ধৈর্য হারিয়ে আমরা হতাশ হয়ে জীবনটা শেষ করে দেই তবে সব শেষ হয়ে যায়। ভালো কিছু হবার পথটা আর থাকেনা। প্রথম ঘটনাটা তোমার জীবনটা হয়তো এলোমেলো করেছে, কিন্তু ২য় টা তোমার আখিরাতটাও শেষ করতো। তাই আমি মনে করি ধৈর্য ধরে যে টিকে থাকে সেই শেষ হাসিটা হাসে। আমি জানি আমাদের চারপাশে সেই পরিবেশ নেই। তবুও বলবো টিকে থাকুক তারা। রুখে দাঁড়াক। আশেপাশের মানুষরাও নিজেকে বদলাক। তাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াক। ধ*র্ষিতাকে নয় বরং ধ*র্ষক কে ঘৃণা করুক। তুমি বেঁচে ছিলে রুশফিকা, তুমি ভুল পথে পা বাড়াও নি। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি। তুমি বেঁচে ছিলে বলেই আমি তোমায় পেয়েছি। তুমি অনেক বিশেষ রুশফিকা, অনেক বেশিই বিশেষ।

ইসরার ভেতরটা শান্ত হয়ে আসে, আরুশের কথা শুনে মনের মাঝে অচেনা প্রশান্তি বিরাজ করে।

বৌমা আমি বলি কি তুমি বরং তোমার শ্বশুরকে বলো সে যেন বাকিটা জীবন পত্রিকা পড়েই কাটিয়ে দিক। আমার সঙ্গে থাকতে হবে না তার।

মা কি হয়েছে বলবেন তো?

সারাজীবন অফিসের কাজ নিয়ে বিজি ছিল। আমার জন্য সময়ই হয়নি তার। এই যে আমরা চট্টগ্রামে আছি, দুনিয়ার কত প্রান্ত থেকে মানুষ এই শহরের উপর দিয়ে ঘুরতে যায়। অথচ তোমার বাবা আজ পর্যন্ত আমাকে কোথাও নেয়নি। আমি জোর করে করে সব জায়গায় গেছি, আর সে টাকা দিয়েই উদ্ধার হয়েছেন। নিজে যায়নি। এখন তো সময় আছে ভেবেছি এখন অন্তত ঘুরে বেড়াই। নাহ জনাবের কাছে পত্রিকা পড়া, খবর দেখা এসবই মুখ্য হয়ে গেছে। বেরসিক লোক একটা!

ইসরা মাথা নাড়িয়ে বলল, না না বাবা এ আসলেই আপনার অন্যায়। আপনার উচিত মা কে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো।সাংসারিক দায়িত্বের বাইরেও আপনার কিন্তু মায়ের প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।

বৌমা তুই তোর শাশুড়ি মায়ের পক্ষ নিচ্ছিস, আমি কি অন্য কারো জন্য খেটেছি? ওদের সুখের জন্যই তো দিনরাত এক করে খেটেছি তাই না?

বাবা আমি মানছি আপনি সবার ভালোর জন্য ব্যস্ত ছিলেন। এখন তো অবসর আছে, যান না মা কে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন।

হুম এখন সারিকা কে এই অবস্থায় রেখে আমরা বুড়ো বুড়ি ঘুরতে যাবো! লোকে কি বলবে,,

এই আমি কি বলেছি আমাকে নেপাল নিয়ে যাও? আমার কি আক্কেল নেই আমার ঘরে পোয়াতি মেয়ে আছে! অন্তত বিকেলে আমার সঙ্গে হাঁটতে তো বের হতে পারো।

আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। আমি শান্তিতে ঘরে বসে আছি তোমার সহ্য হচ্ছে না। বেশ বিকেলে হাঁটতে বের হবো তবুও খুশি থাকো।

মুনা বিজয়ের হাসি দিয়ে বললেন, হুম খুশি।

ইসরা হাসিমুখে তাদের রুম থেকে বের হয়ে গেল। দরজা পেরিয়ে খানিকটা এগোতেই হঠাৎ হেচকা টানে চমকে উঠে চিৎকার করতে যাবে অমনি আরুশ ওর মুখ চেপে বললো, আরেহ আমি!

ইসরা ওর হাত সরিয়ে বললো, এমন করার মানে কি আরুশ? আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানেন!

আরুশ ওকে আলতো হাতে দেয়ালে চেপে দু হাতের মাঝে রেখে বলল, কি করবো বলো তুমি আদর্শ বৌমা হবার দায়িত্ব পালনে এতোই ব্যস্ত বরের যে ফেরার সময় হয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই!

আমিতো রুমের দিকেই যাচ্ছিলাম। একটু অপেক্ষা করা যায় না?

আরুশ ওর গলায় নাক ঘষে বলে, নাহ এক সেকেন্ড ও অপেক্ষা করা যায় না‌।

ঢং আর কি, দেখি সরুন তো, বাবা-মা রুমে আছেন সারিকাও আছে। কখন কে চলে আসে। আপনার একদম আক্কেল নেই।

আরুশ ওকে কোলে তুলে বলল, তোমার তো আক্কেল আছে, হাতের কাছে থাকলেই পারো।

ইসরা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে মনে মনে বললো, কেউ যেন না দেখে আল্লাহ!!

আরুশ দরজা লক করে তাকে বেডে শুইয়ে কপালে ছড়িয়ে থাকা এলোচুল সরিয়ে বললো, একটা কথা বলবে রুশফিকা, কি ম্যাজিক করেছ বলো তো? আগে সবসময় নিজেতে মত্ত ছিলাম, এখন তোমাতে মত্ত হয়ে আছি‌। যতোই দেখি মন ভরে না। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তোমার মাঝে ডুবে থাকি!

কেউ বোধহয় আপনার চোখে জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে। তাই আমার ত্রুটি দেখেন না। এই দেখুন গালে দুটো ব্রণ উঠেছে,কেমন বিচ্ছরি লাগছে!

আরুশ তার দু গালে গভীর চুমু দিয়ে বললো, উহু এটাও সুন্দর। আমার বেগমের কোনোকিছুই অসুন্দর না…

তাই না?

হুম ঠিক তাই…

হসপিটালের করিডরে জাবেদ অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। একটু পরপর উপরের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, আল্লাহ সারিকাকে সাহায্য করুন।

ইসরা ব্যাপারটা খেয়াল করে আরুশকে বললো, এই দেখেছেন ভাইয়া কি করছে?

সে তো কমই করছে, আমি হলে এতোক্ষণে….

কি করতেন?

যাকে অনেক ভালোবাসি সে কষ্টকর একটা সময় পার করছে, এটা ভাবলেই তো কলিজায় পানি থাকে না। তার উপর এইসব যে সিরিয়াস কেইস!!

নার্স বের হয়ে সুসংবাদ দিলো সারিকার মেয়ে হয়েছে, মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছেন।
জাবেদ খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। সবার মাঝে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে গেল।

ছোট ছোট লাল হাত পা, ছোট্ট একটুখানি মুখ। সদ্য জন্ম নেওয়া নবজাতক কোলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম হলো তার। ইসরা সারিকার মেয়েকে কোলে আপ্লুত হয়ে গেল। ছোট বাচ্চা এত্ত কিউট হয় মাশাআল্লাহ!!

আরুশ ওর কানে কানে ফিসফিস করে বললো, কি ভাবছো এরকম একজন আমাদেরও চাই?

ইসরা লজ্জায় লাল হয়ে বলল, আপনিও না একদম বেশি! আমি কখন বলেছি এটা?

ওমা আমি কি করলাম আবার? তোমার চেহারা দেখে যে কেউ বুঝবে তুমি এটাই চাইছো,,,

আপনি চাইছেন এটা বললেই হয়।

হ্যাঁ চাইছি তো, আমার ছোট্ট একটা রুশফিকা আসুক। তুমি চাও না?

ইসরা মাথা উপর নীচ নাড়ালো। আরুশ হেসে বলল, রুশফিকা লজ্জা পেলে তোমায় এত্ত কিউট লাগে,, হায়ইইইই

🌸সমাপ্ত🌸

(এই প্রথম পরিশিষ্ট পার্ট লিখলাম না। ঐটা লিখলে অনেকেই কনফিউজড হয়ে বলেন ঐসব কোত্থেকে এলো, মাথার উপর দিয়ে গেলো ইত্যাদি! যাই হোক, গল্পটা কেমন ছিল কমেন্ট করবেন। যারা এই তুচ্ছ মানুষটার গল্প পড়ে লাইক কমেন্ট করে পাশে ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ভুলত্রুটি ক্ষমাপ্রার্থনা। সবাই ভালো থাকবেন আর আমার জন্য দোআ করবেন।অনুগ্রহ করে তাড়াহুড়ো করে শেষ করেছি বলবেন না। ধন্যবাদ। Happy Reading💙)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে