মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-১৯

0
518

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১৯

#আরশিয়া_জান্নাত

একটা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের অপেক্ষায় আমরা আমাদের জীবনে অনেক আধার কালো রাত পার করি। অন্ধকার যত গাঢ় ই হোক না কেন এক ফোটা আলো যখন আছড়ে পড়ে সব আধার কেটে যায়। আলোর বিশেষত্বই এটা। আমাদের জীবনে অনেক খারাপ ঘটনা ঘটে। মন ভাঙে, হতাশা আসে। আমরা সবাই হার মেনে ম*রে যাই না। আমরা বেঁচে থাকি, একটা ভালো দিনের অপেক্ষায় সকল হতাশা, মন খারাপ এক পাশে রেখেই জীবনে এগিয়ে চলি।
অতীত পরিবর্তন করা আমাদের হাতে নেই, না আমরা পারি সেটা সহজেই মুছে ফেলতে। তবে আমরা চাইলে বর্তমানটা সুন্দর করতে পারি। অতীতের স্মৃতিকাতরতা ছেড়ে বর্তমানকে নতুন স্মৃতি দিয়ে ভরিয়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ এর জন্য সুন্দর অতীত তৈরি করতে। এটা সত্যি একা এই কাজটা করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় এমন কিছু মানুষের, যারা আপনার সঙ্গী হয়ে সময়টা সুন্দর করে দিবে। ইসরার জীবনে সেই সঙ্গী হয়েছে আরুশ। আরুশ তার সময়টাকে ভালোবাসার রং দিয়ে রাঙিয়ে রাখছে। আরুশ মানুষ হিসেবে খারাপ না। তার এমন কিছু গুন আছে যা আসলেই প্রশংসাযোগ্য। সে নিজের যত্ন করে, সুস্থ থাকার নিয়মকানুন মেনে চলে। নিজেকে ভালোবাসে। আমরা ভাবি এরকম মানুষ বুঝি অন্যকে ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু সত্যিতা হলো মানুষ যখন কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে, তখন নিজের থেকেও বেশি অপর মানুষটার প্রতি যত্নশীল হয়ে যায়। অপরজনের সুখ দুঃখ,সুবিধা অসুবিধামুখ্য হয়ে উঠে। আরুশ ইসরার যত্ন করে। চেষ্টা করে ইসরাকে ভালো রাখতে। ও যেন তার কাছে মনের কথা বলতে পারে তাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বৈবাহিক জীবনে নয় মাস পেরিয়ে গেছে, ইসরা এখন আরুশের সাথে অনেকটা স্বাভাবিক।

এই শুনছেন?

হুম বলো

মা বলছিলেন সারিকা কে গিয়ে নিয়ে আসতে।

তুমি যাবে?

আপনি বললে যাবো।

আচ্ছা রেডি থেকো।

ইসরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরুশ বলল, কিছু বলবে?

কোন শাড়িটা পড়বো?

তোমার যেটা পছন্দ!

এই বেগুনী রঙের টা পড়বো?

পড়ো,

কিন্তু এটা তো এর আগেও পড়ে গেছি। এশ কালারটা পড়ি?

হুম

এই

কি?

মন দিয়ে দেখছেন না কেন? আপনি ফোন নিয়ে বিজি!

দেখেছি তো। সব গুলোই তো সুন্দর যেকোনো একটা পড়ো না?

ইসরা রেগে আগুন হয়ে আরুশে সামনে দাঁড়ালো। ফোনটা টেনে নিয়ে বললো, আমার চেয়ে ফোনটা বেশি জরুরী হয়ে গেছে না?

রুশফিকা ফোনটা দাও। ছোট্ট একটা কাজ নিয়ে এতো মাতামাতির কি আছে বুঝি না। আমরা তো বিয়েতে যাচ্ছি না। জাস্ট যাবো আর ওকে নিয়ে চলে আসবো। তোমার এতো প্রবলেম হলে বাদ দাও যেতে হবেনা। আমি একাই যাচ্ছি। এখন ফোন দাও।

ইসরা ফোনটা ওর হাতে দিয়ে চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে গেল। অভিমানে ওর চোখে পানি চলে এসেছে। মানুষ আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে।হাত থেকে ফোন সরাতেই চায় না। এর বিনিময়ে যত কাজই বাতিল করতে হোক , অনায়েসে বাতিল করবে‌। তবুও ফোন ছাড়বেনা। ইসরা ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। হঠাৎ কোমড়ে পুরুষালী স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে সে। আরুশ ওর ঘাড়ে চিবুক রেখে দুহাতে জড়িয়ে বলে, এই পাগলী কাঁদছো কেন হুম? আমি স্যরি তো, কেঁদো না প্লিজ!

ছাড়ুন আমাকে ধরবেন না। ফোন নিয়েই বিজি থাকুন লাগবে না স্যরি বলার। আমি কে? আপনার ফোন কেড়ে নেওয়ার দুঃসাহস দেখালাম কিভাবে!

আল্লাহ! রুশফিকা কি বলো এসব হুম? তুমি আমার বউ। আমার সবকিছুতে তোমার অধিকার আছে। আমি ঐ সময়ে কি বলে ফেলেছি হুট করে তাই বলে এতো রাগ করবা? স্যরি সোনা।

ইসরা অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রাখে। আরুশ ইসরার কানে ধরে বলল, এই দেখো কানে ধরেছি। আর কখনো এমন হবে না।

আমার কানে ধরে বলছেন?

হুউ আমার কান আর তোমার কানে পার্থক্য কি? যা আমার তা তোমার, যা তোমার তা আমার।

নাটক।

এই রুশফিকা!

বলেন

ভালোবাসি তো,

তো আমি কি করবো?

তুমি এমন মন খারাপ করে রাখলে ভালো লাগেনা আমার।

ফেসবুকে থাকেন ভালো লাগবে। আমার দিকে না তাকালেই হয়।

হাহ! কোন কুক্ষণে যে মুখ টা খুলতে গিয়েছিলাম! ঐসব শয়তানে মুখ দিয়ে বের করিয়েছে, আমার দোষ নেই সত্যি! আমি কখনো আমার বৌকে ঐসব বলতে পারতাম? আমার ১০টা না ৫টা না ১টা মাত্র বউ। প্রমিজ করছি তুমি কিছু বললে আমি ফোন দেখবোনা, তোমার কথা মন দিয়ে শুনবো। হ্যাপি?

হুহ!

সারিকার ৭মাস চলছে। প্রথম বাবু হবার সময় বাপের বাড়ি থাকাটাই রেওয়াজ। ওকে আরো আগেই নিয়ে আসার কথা ছিল, কিন্তু সারিকার বর জাবেদ স্ত্রীকে সঙ্গ ছাড়া করতে নারাজ। সকলের জোরাজুরিতে যদিও সম্মতি দিয়েছে কিন্তু এতে সে ভীষণ নাখোশ। সে একটু বর্ণচোরা ধরনের। শ্বশুরবাড়িতে এক রাতও থাকে না। যত যাই হোক নিজের বাসায় ফিরে যায়।তাই সারিকাকে ওখানে পাঠানোতে তার একটুও মত নেই। সারিকা লাগেজ গুছিয়ে বললো, এই এমন মুখ ভার করে ভাইয়া ভাবীর সামনে যেও না বলে দিচ্ছি! ওনারা কি ভাববে বলো তো?

হুম

কি হুম? হাসো?

হাসি না আসলে কি করবো?

হাসি আসতে হয় না, ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখলেই হয়।

সারিকা, এখানে কি আমরা তোমার প্রপার কেয়ার করতে পারছি না? ওখানে যেতে হচ্ছে কেন?

মায়ের কাছে থাকলে মেয়েদের মন ভালো থাকে,তাই এই নিয়ম করা হয়েছে। এমনিতেই তোমার জ্বালা আমি ওখানে ক’টা দিন থাকতে পারিনা। এখন একটু সুযোগ হলো তাও তুমি টালবাহানা করছো। আমাদের বাসায় থাকতে তোমার এতো অসুবিধা কেন বুঝি না আমি!

জাবেদ মুখ ভার করে বলল, তোমার যা খুশি তাই করো। কিছু বলবো না আমি।

সারিকা ওঠে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো, জাবেদ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সারিকা হেসে ওর মাথাটা বুকে চেপে বলল, তুমি এমন মন খারাপ করে বিদায় দিলে বাবু আর বাবুর মা দুজনেই কষ্ট পাবে। আমাদের বাসা তো অনেক দূরে না। তুমি চাইলেই যখন ইচ্ছে যেতে পারবে‌।

জাবেদ তাকে জড়িয়ে বলল, সাবধানে থাকবে। আর আমায় নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। যখন যা লাগবে ফোন করে বলবে আমি নিয়ে হাজির হবো।

আচ্ছা!

তোমার তো রাতে পা ব্যথা করে, তখন কি করবে?

মিতু আছে তো, ও মালিশ করে দিবে।

ও কি আর রাত বিরেতে বারবার উঠে তোমার সেবা করবে? আমি বলি কি সারিকা…

একদম না, আমি ওখানে যাবো। একদম মত পাল্টাবে না বলে দিচ্ছি।

জাবেদ আর কিছু বললো না।

আরুশ আর ইসরা সারিকাকে নিয়ে একটু আগেই ফিরেছে। মুনা মেয়েকে পেয়ে খুশিতে গদগদ করছেন। মেয়ের ঘরের প্রথম সন্তান আসবে বলে কথা। তাদের সবারই অন্যরকম উচ্ছাস।

সালাম বস! কেমন আছেন?

ভালো আছি, তুমি কেমন আছ?

আল্লাহ রাখছে।

আর কোনো অসুবিধা হয়নি তো?

না বস কি যে বলেন, আপনি থাকতে আমার অসুবিধা হবে?

তুই যে কাজটা করেছিস তার জন্য আমি অনেক সন্তুষ্ট তোর উপর। তাছাড়া তুই বরাবরই আমার প্রিয়। তোর সুবিধা অসুবিধা আমি দেখবো না তো কে দেখবে?

বস একটা কথা বলি?

হুম?

আপনি অনেক ভালো মানুষ।

এই কথা কেন বললি?

মাশুক এর উপর নজরদারী করেছি অনেক, তার সকল ইতিহাস আমার জানা হয়ে গেছে। অতীত বর্তমান কোনোকিছুই বাদ নেই। আপনাকে আমি সবসময় সম্মান করি। আমার মতো একজন মানুষকে আপনি রাস্তা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছেন। আপনার প্রতি আজীবন আমি কৃতজ্ঞ। তবে এখন আপনার প্রতি শ্রদ্ধাও বেড়েছে।

আরুশ হাসলো, হেসে বলল, উসমান তুই আমার চেয়ে আরো বেশি ভালো। তুই বেছে বেছে এমন কালপ্রিট দের শাস্তি দিস যাদের কে এই সমাজ মাথায় তুলে রাখে।

উসমান মাথা নাড়িয়ে বলল, বস আমার একটা ছোট বোন ছিল। অনেক আদরের। ওরে আমি মাটিতে রাখতাম না পিঁপড়া কামড় দিবে ভেবে, মাথায় রাখতাম না পড়ে যায় যদি! সবসময় বুকে পিঠে করে মানুষ করছি। সেই বোনটারে পড়াশোনা শিখাইয়া মানুষ করছি কত কষ্ট করে। ও রূপে গুনে সেরা ছিল। তাই অনেক বড় ঘর থেকে সমন্ধ আসছিল। বিয়ের কথাবার্তাও ফাইনাল হয়। একদিন কলেজ থেইকা ফেরার পথে মেম্বারের ভাই ওরে ধইরা নিয়া যায়,,, তারপর সব শেষ। ঐ ঘটনা শুনে পাত্রপক্ষও বিয়ে ভাইঙ্গা দেয়। আমার বোইনটা দুঃখে গলায় ফাঁ*স দেয়। সেদিন যদি আপনার মতো কেউ আমার বোনের পাশে দাঁড়াইতো আমার বোনটা হয়তো মরতো না,,,

আরুশ ওর কাধে হাত রাখলো। সে চোখ মুছে বলল, বস আমি অনেকের দুয়ারে গেছি কোনো আই*ন আদা*লতে আমার বোনের আ*সামীরে শাস্তি দেয়নাই। সেই থেকে আমি সকল ধ*র্ষিতার ভাই। যখন যেখানে ধ*র্ষক পাই আমিই শা*স্তি দেই। এই কাজটা করে আমার একবিন্দুও অনুতাপ আসে না। দুনিয়ার মানুষ ক্যান যদি আল্লাহও আমারে এর জন্য শাস্তি দেয় আমি হাসিমুখে মাইনা নিমু। তবুও শেষ বিচারের দিন বোইনের সামনে খাড়ায়া মাথা উঁচু কইরা তো কইতে পারমু, বোইন তোর ভাইয়ে প্রতিশোধ নিছে। ঐ জা*নো*য়া*রের মাংস রাস্তার কুত্তারে খাওয়াইছে। তুই খুশি তো?

আরুশ নিজের চোখের পানি মুছল।

বস, ম্যাডামরে কোনোদিন কষ্ট দিয়েন না।

আরুশ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। তারপর পকেট থেকে পাসপোর্ট আর ভিসা দিয়ে বললো, আমি চাই তুই ভালো থাক। এখানে আর থাকতে হবে না। সব বন্দোবস্ত করেছি, ওখানে গিয়ে চাকরি কর, পরিবার বানা। জীবনটা গুছিয়ে নে।

উসমান সালাম জানিয়ে বিদায় নিলো। আরুশ ভাবতে লাগলো মানুষের জীবনটা কত কষ্টের হতে পারে। যে কাজটা রা*ষ্ট্রের আ*ইনের করার কথা সে কাজটা উসমান করছে। হয়তো বাহ্যিকভাবে সে অ*পরাধী তবে আরুশের কাছে সে মোটেও অ*পরাধী নয়। ইনফ্যাক্ট সে আসল হিরো!

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে