#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১১
#আরশিয়া_জান্নাত
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টে বসে প্রিয়ন্তি বলল, ভাইয়া আপনারা হানিমুন প্ল্যান করছেন না কেন? কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসুন?
ফাহিম বলল, আপি তোর কোথায় যাওয়ার ইচ্ছে?
ইসরা চুপচাপ পরোটা মাংস খেতে লাগলো। সবার দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ ব্যাপারটা অনুধাবন করে বলল, আমি এসব নিয়ে কখনোই ভাবিনি।হানিমুনে যাওয়ার দরকার ই বা কি?
তুই এমন কেন আপি? যাক তোর থেকে এসব আশা করাও বোকামি। দুলাভাই আপনার প্ল্যান কি?
আরুশ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, দার্জিলিং যাবো।
ইসরা চমকে আরুশের দিকে তাকায়, আরুশ ওর দিকে এক পলক চেয়ে খাওয়ায় মন দেয়।
ওয়াও ভাইয়া! দারুণ জায়গা চুজ করেছেন।
প্রিয়ন্তির কথায় আরুশ মুচকি হাসলো। খাওয়া শেষে আরুশ বলল, আজ বিকেলে তোমরা রেডি থেকো আমরা বেড়াতে যাবো।
ইসরা রুমে এসে বলল, দার্জিলিং নিয়ে আপনার ফ্যান্টাসী আছে?
না থাকলে হানিমুনে ওখানে যাওয়ার প্ল্যান করতাম?
ইসরা নিজের টেবিলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু ডায়েরীটা তো ওপেনলি রাখা নেই, ড্রয়ারে রাখা। আরুশ কি কোনোভাবে সেটা পড়েছে?! নাকি এটা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার?
আরুশ ওর দিকে ফিরে বলল, এমন ভ্রু কুঁচকে আছেন কেন? কোনো সমস্যা?
নাহ, কিছু না।
রুশফিকা?
হুম?
আপনি কখনো ডাক্তার দেখিয়েছেন? আপনি বোধহয় অনেক দুঃস্বপ্ন দেখেন।
নাহ।
আমার মনে হয় দেখানো উচিত। আমি একটা রাত আপনাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেখিনি। সবসময় ঘুমের মাঝে এমন করেন,, ব্যাপারটা স্বাভাবিক না।
আপনার অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পারছি…
এখানে আমার সুবিধা অসুবিধার কথা হচ্ছেনা। আমার পাশের মানুষটা ভালো নেই, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও এটা চিন্তা করার মতো বিষয়! আর আপনি তো আমার ওয়াইফ, আপনার বিষয়ে আমার কনসার্ন আরো বেশি থাকবে।
ইসরা আরুশের চোখের দিকে তাকালো, একজোড়া শান্ত নিবিড় দৃষ্টি। ঐ চোখের তাকালে মনেই হয় না মানুষটা আপন নয়; প্রতিশোধের জন্য তাকে বিয়ে করেছে। বরং মনে হয় এই মানুষটা পরম বিশ্বস্ত কেউ। যার সামনে চাইলেই মনটা খুলে রাখা যাবে, সে পড়ে নিক ভেতরের সবকথা। কোনো ভয় নেই!
আচ্ছা মিস্টার আরুশ, লাইফ পার্টনার নিয়ে আপনার এক্সপেক্টেশন কি ছিল? মানে কেমন কল্পনা করতেন আগে?
আরুশ সোফায় গা এলিয়ে বললো, লাইফ পার্টনার নিয়ে আসলে এক্সপেক্টেশন রাখা ঠিক না। এতে বিয়ের পর মনঃক্ষুন্ন হয়। মানুষ অনেক কিছু কল্পনা করে ফেলে বলেই পরবর্তীতে হতাশায় ভুগে। তাই ওরকম কিছু ভাবি নি।
এখনো কিছু ভাবেন না? আমার থেকে কি আশা করেন?
আরুশ এবার সামনে ঝুকে বসলো, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কি যেন ভাবলো। তারপর বলল, একটুখানি শান্তি ব্যস,,,,
ইসরা চেয়ারে বসে পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, আমার মনে হয় না আপনার জীবনে আমি আসার পর থেকে আপনি সেটা পেয়েছেন। যে মানুষটা প্রথমদিন থেকেই আপনার জীবনে অশান্তির মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছ থেকে এমনটা আশা করছেন?
একটা কথা কি জানেন, আমরা মানুষরা ভীষণ অদ্ভুত রকমের। আমাদের মনটা কখন যে কোথায় আটকা পড়ে আমরা বুঝি না। আপনি আমার অশান্তির মূল কারণ এই কথাটা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু এটাও চরম সত্যি শান্তির মূল উৎস ও আপনিই।
কিভাবে?
ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনি আমার সঙ্গে অশান্তিতে আছেন, এটাও আমার জন্য এক প্রকার শান্তি।
ইসরা ওর কথা শুনে হেসে ফেলল। হাসিমুখেই বলল, আপনি মোটেও শান্তি পাচ্ছেন না আরুশ। এটা জাস্ট আপনার মুখের কথা। আমি বলি কি শুনুন,,
আরুশ দাঁড়িয়ে শার্ট ঝেড়ে চুল ঠিক করে বলল, আপনার একই কথা রিপিটেডলি শোনার ইচ্ছে এবং সময় আমার নেই। ঐ ব্যাগটায় একটা শাড়ি আছে, ওটা পড়ে তৈরি হয়ে নিন।
আমি শাড়ি পড়ে কোথাও যেতে পারবোনা।
আপনার মতামত জিজ্ঞাসা করেছে কে?
আমি আপনার কথা মানতে বাধ্য নই।
অবাধ্য ও নন। ২০মিনিট সময় দিচ্ছি,শাড়ি পড়ে ফেলুন। নয়তো,,,
নয়তো?
এমন কিছু ঘটবে যা আপনি কখনোই চাইবেন না।
ইসরা আর কথা বাড়ালো না। উঠে শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নিলো। এই লোকের বিশ্বাস নেই কি থেকে কি করে ফেলে!!
আরুশ হেসে বাইরে চলে গেল।
মিনি বাংলাদেশ স্বাধীনতা কমপ্লেক্সে সবাই ঘুরেফিরে অনেক মজা করলো। প্রিয়ন্তি আর ওর কাজিন রাইসার ফটোশ্যুট করতে করতে ফাহিম বিরক্ত হয়ে বললো, আমি ঘুরতে আসছি নাকি তোদের কামলা খাটতে?
রাইসা বলল, একটু ভালো ছবি তুলতে পারিস বলে এভাবে বলিস। বোনদের ছবি তুলতেই তোর যত কষ্ট, ক্যাম্পাসের মেয়েদের ছবি তুলতে কষ্ট হয় না।
ফাহিম পাশে তাকিয়ে দেখলো ইসরা আর আরুশ কাছে কিনারে আছে কি না তারপর দাত কিড়মিড় করে বলল, রাইসানী আপি দুলাভাইয়ের সামনে ইজ্জত নষ্ট করিস না।
মুখ বন্ধ রাখতে হলে ছবি তুলতে থাক।
আহসান মঞ্জিলের সিঁড়িতে বসে ইসরা তার ভাইবোনদের কান্ড দেখছে। এরা টিকটক করা নিয়ে এতো বিজি! মেজাজটাই গরম হয়ে যায়।
আপি বসে আছিস কেন, দাঁড়া কাপল ফটো তুলি, দুলাভাই আপির পাশে দাঁড়ান।
অগত্যা মেকি হাসি ঝুলিয়ে পারফেক্ট কাপলের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হলো। আরুশ ও এই সুযোগে নিজের ইচ্ছেমতোন পোজে ইসরার সঙ্গে ছবি তুলিয়ে নিলো,,,
ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে যায়। আরুশ তাদেরকে বাসায় ড্রপ করে ইসরাকে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরলো।
।
বৌমা,
জ্বি বাবা?
তোমার শাশুড়িকে দেখছি না কোথায় সে?
পাশের বাড়ির রোকসানা আন্টির সঙ্গে হাটতে বেরিয়েছেন। কিছু লাগবে বাবা?
মাথাটা ধরেছে বুঝলে, একটু চা করে দিও তো।
আচ্ছা বাবা এখুনি আনছি।
ইসরা চা বানিয়ে শ্বশুড়কে দিলো। তার শ্বশুড় আমজাদ রহমান গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। চেহারায় সবসময় কেমন রাগী রাগী ভাব থাকে।কিন্তু তার শাশুড়ি হাসিখুশি। সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকে। শ্বশুড়ের সঙ্গে তার বিশেষ আলাপ হয়না, সচরাচর দেখাও হয়না। যদিও রোজ অফিস থেকে ফিরে ইসরার খবর নেন, কিন্তু সামনা সামনি তেমন কথা বলেন না। আজকে সিত্তুল মুনা বাসায় নেই বলেই হয়তো চায়ের আবদারটা রেখেছেন। ইসরা তাই যত্ন করেই চা টা করলো।
চা ভালো হয়েছে?
হুম
আলাদা মনে হচ্ছে?
আমজাদ সাহেব আরেক চুমুক দিয়ে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিশেষ কোনো উপাদান খুজে পেলেন না। ইসরা হেসে বলল, বাবা আমি কি আপনার মাথা ম্যাসাজ করে দিবো?
না ঠিক আছে,,
ইসরা তার সামনে বসে পেপারটা হাতে নিয়ে বলল, দেশের অবস্থা কোন দিকে যে যাচ্ছে! আপনার কি মনে হয় ভাগ্যের চাকা ঘুরবে?
আশা নেই। দিনদিন যে হাল হচ্ছে। তার উপর মেধাবী সব ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। ভাগ্য বদলানোর মানুষ কই?
দেশের যাবতীয় ঘটনাবলী নিয়ে বেশ ভালোই কথাবার্তা জমে উঠলো। ইসরা একটা একটা করে টপিক তুলে দেয়, আমজাদ সাহেব বিস্তর আলোচনা করেন। এসব বিষয়ে নিজের মনোভাব বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন বটে!
ইসরা চায়ের কাপটা নিয়ে উঠে যাচ্ছিলো তখন তিনি বললেন, বৌ মা বললে না তো চায়ে আলাদা কি দিয়েছিলে?
ইসরা হেসে বললো, বাবার জন্য মেয়ের এক চিমটি ভালোবাসা!
আমজাদ সাহেবের মনটা আনন্দে ভরে গেল।
।
হ্যালো রুশু?কেমন আছিস?
ভালো আছি তুই কেমন আছিস?
এই তো ভালোই।
কোথায় আছিস এখন?
রাজশাহীতে। দেশে ফিরলি কবে?
এই তো মাস খানেক হলো।
হঠাৎ কি মনে করে কল দিলি? সবকিছু ঠিকঠাক তো?
এমনভাবে বলছিস যেন এমনি খোঁজ নেই না?
নাহ সেটা বলিনি। তোর রেফারেন্সেই তো আমার জবটা হলো, তোকে ওরকম ভাবতে যাবো কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোনো কাজে আসতে পারি কি না সেটা ভেবে।
নাহ তেমন কিছু না, আগামী শুক্রবার আমার বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আমি চাই তুই উপস্থিত থাকবি ভাবীসহ,,,
তুই বিয়ে করছিস অবশেষে!! হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! আমি অবশ্যই আসবো, ভরপেট খাবো। তোর বিয়ে বলে কথা!
বিয়ে ব্যাপারটা সুন্দর মিদাত, এটা একটা পবিত্র সম্পর্ক। কিন্তু আমার মতো অপবিত্র কারো জন্য এই পবিত্র সম্পর্ক মানায় বল? পরিস্থিতির স্বীকারে হওয়া বিয়েটার এখন আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করছি জাস্ট!
এভাবে বলিস না রুশু! তুই অপবিত্র না। ইনফ্যাক্ট এমন ঘটনার স্বীকার কোনো মেয়েই অপবিত্র না। অপবিত্র তারা যারা এই কাজটা করে!
সবাই তোর মতো ভাববে না। আমার মনে এখনো ভয় উনি যখন জানতে পারবেন ঘেন্নায় না ছুড়ে ফেলেন। এজন্যই বিয়ে করতে চাই নি কখনো।
সব পুরুষকে এক ভাবিস না। অনেকের কাছেই অতীত ম্যাটার করে না। আর যদি কখনো সে এই পরিপ্রেক্ষিতে তোকে ছেড়েও দেয় ভেবে নিস সে তোর জন্য সঠিক ছিল না। ভরসা রাখ আল্লাহর উপর।
আমার কথা ছাড়, যা বলেছি মাথায় রাখিস ভাবীকে নিয়ে ২দিন আগেই চলে আসবি। আমি অপেক্ষা করবো।
ইনশাআল্লাহ।
ফোন রেখে মিদাত ভাবতে থাকে ইসরার কথা।মেয়েটা কি কঠিন সময়ই না পার করেছে, আল্লাহ যদি এবার একটু সুখ নসীব করে!!
ইসরা পেছনে ফিরে দেখে আরুশ দাঁড়িয়ে আছে। ইসরা ভীষণ চমকে যায়, কখন এসেছে সে? আরুশ কি তবে সব শুনে ফেলেছে?
চলবে,,,