#মিস্টার_নার্সিসিস্ট (পর্ব-১০)
#আরশিয়া_জান্নাত
ঘন্টাখানেক আগে ইসরা নিজের বাপের বাড়িতে আসে। তার সঙ্গে শাশুড়ি এলেও আরুশ আসেনি। ইসরাকে পেয়ে তার ভাইবোন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে। ইসরা সবার সঙ্গে আলাপচারিতা সেড়ে নিজের রুমে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুজে ভাবতে লাগলো গত কিছুদিনে ঘটনা। সেদিনের পর আরুশ তাকে এড়িয়ে গেছে সবসময়। বাসায় কখন আসে কখন যায় টের পাওয়া যায়না। ইসরাও সেদিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো চলতে থাকে। ইসরা অনেক ভেবেছে আরুশকে তার অতীত সম্পর্কে বলার ব্যাপারে। কিন্তু এখন আর সেই ইচ্ছে নেই। ও এই সত্যিটা আপন সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে। এখন এতবছর পর অন্য একজনকে বললে যদিও ডিভোর্সটা সহজেই হবে, কিন্তু তার বাবা মায়ের সাথে সাথে অন্য সবাইও সেটা জানবে। ইসরা এই কঠিন বাস্তবতা থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়ায়। ও চায় না কেউ জানুক, কেউ ওকে ঐ উপনামে ডাকুক।
সাথে এ ও ভাবে ডিভোর্সটা সে নিজে দিবে। এখানেও বাধা হয়ে দাড়ায় দাদীর শেষ ইচ্ছেটা। তার দাদীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে এই বিয়েটা সে করেছে। দাদীর মৃত্যুর পর যদি সে এটা ভেঙে দেয় কেমন হবে! সবচেয়ে সহজ উপায় আরুশ তাকে ছেড়ে দিক। তখন তার কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না। ইসরার নিজেকে স্বার্থপর বা নিজের গা বাঁচানো মেয়ে মনে হলেও এই একটা অপশন ই বেস্ট হয়ে সামনে দাঁড়ায়।
কিন্তু আরুশের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে না কাজটা সহজ হবে। সে মূলত আজ এসেছে সিডনী ব্যাক করার কথাটা মায়ের কানে তুলে বাজিয়ে দেখতে।
কি রে মণি এখানে এসে শুয়ে আছিস যে? শরীর খারাপ নাকি?
নাহ এমনিই,
তারপর বল ওখানে সব ঠিকঠাক তো?
হুম। মা একটা কথা বলি?
বল?
আমি কি জব কন্টিনিউ করতে পারবোনা? এতো কষ্ট করে ভালো পজিশনে গেছি। বিয়ে করে সব জলাঞ্জলি দিবো?
এটা কি কথা হলো ইসরা? তোর জব করতে হলে এখানেই কিছু কর, বিদেশ যেতে হবে কেন? বিয়ের পর কি আর চাইলেই সব করা যায়? কিছু ধরাবাধা তো থাকে নাকি?
তাই বলে,,,
জামাই কি বলে এই ব্যাপারে?
উনাকে কিছু বলিনি।
ভালোই হয়েছে বলিস নি। এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেল তো। মন দিয়ে সংসার কর, বাচ্চা নে ওদের মানুষ কর। নারীদের সবচেয়ে পারফেক্ট জব এটাই। এখানেই আসল সফলতা।
মা, আমার ভুল হয়েছে আগ পিছ না ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে। ভেবেচিন্তে বিয়ে করলে এসব ব্যাপার আগেই ক্লিয়ার হয়ে যেত।
মণি! সত্যি করে বল তো তুই কি এই বিয়েতে খুশী না? আরুশের সাথে তোর বনিবনা হচ্ছে না?
ইসরা বিরস গলায় বলল, হুট করে বিয়ে হয়েছে, এখানে দুই দিনেই কি ভালোবাসা হয়ে যাবে? মিলমোহাব্বত হয়ে যাবে? এমনভাবে বলছো যেন আমি মানুষ না রোবট। বিয়ে করলাম আর বর বলতে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
হাহাহা সময় যাক সব ঠিক হয়ে যাবে। সবে তো বিয়ে হলো। দেখবি ধীরে ধীরে মায়ায় জড়াবি, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে। কোনো সম্পর্কই শুরুতে গভীর হয় না মা। ভাগ্যে যা হবার ছিল হয়েছে। এখন তোদের দায়িত্ব হলো সম্পর্কটার সঠিক পরিচর্যা করা।
আমার হাতে আরো ৫ মাস আছে মা। আমি এই সম্পর্ককে এর বেশি সময় দিবো না। এর মধ্যে যদি মন বদলায় তো সংসার করবো, নয়তো সিডনী ব্যাক করবো। তোমাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখছি। এরপর আমায় দোষ দিতে পারবেনা।
শারমিন আহমেদ মেয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তার মেয়ে কি বলছে এসব! পরক্ষণেই হেসে বললেন, দেখা যাক! মেয়ে মানুষের মন বদলাতে কতক্ষণ? বিয়ের পর মেয়েরাই দ্রুত আবেগী হয়।
হ্যালো আরুশ, বৌমাকে ওখানে আমি রেখে এসেছি। তুই অফিস থেকে গিয়ে নিয়ে আসিস।
আচ্ছা।
আগে জিজ্ঞাসা করে নিস থাকতে চায় কি না ক’টা দিন।
যদি থাকতে চায় রেখে আসবো?
হ্যাঁ।
তুমি জিজ্ঞাসা করে এলেই তো হতো। আমাকে জড়াচ্ছ কেন?
এটা কি কথা? আমি জিজ্ঞাসা করবো কেন। তোর বৌ তুই জিজ্ঞাসা করবি।
তুমি তো সবসময় দাদীর পারমিশন নিয়েই বাপের বাড়ি গেছ, ও পারমিশন নিয়ে যায়নি? বলেনি থাকার ইচ্ছে আছে কি না?
ওখানে যাওয়ার প্ল্যানটা আমার ছিল। আমি ওকে সাথে করে নিয়ে গেছি। এখন যদি তোর বৌ ছাড়া চলে তবে থাকুক সে ওখানে। অপশনটা তোর জন্যই তুলে রেখেছিলাম, এখন দেখি ছেলে আমার তার বাপের মতোই বেরসিক হয়েছে!
আরুশ গাল ফুলিয়ে বলল, আমি বেরসিক?
অবশ্যই। ইনফ্যাক্ট তোর বেরসিকের স্কেল তোর বাপের চেয়ে আরো কয়েক ধাপ উপরে। মা বলে কি সত্যিটা এড়িয়ে যাবো! সত্যি সবসময় সত্যিই হয়। এখন সেটা নিজের পেটের সন্তানের বেলা হোক কিংবা স্বামীর বেলা। সত্যি কখনৈই বদলাবে না।
আরুশ ফোন রেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। সব সত্যভাষী আমার নসীবেই জুটেছে? এই পৃথিবীতে আর কারো মা-বৌ সত্যি কথা বলে না?
এই কয়দিনে ইসরার সঙ্গে কথা বন্ধ থাকলেও মায়ের জন্য কল করতে হলো আরুশ কে।কয়েকবার রিং হবার পরো ইসরা কল রিসিভ করলো না। আরুশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবার কল দিলো। এবার কল রিসিভ হতেই ইসরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল, হ্যাঁ বলুন।
আরুশ গলা পরিষ্কার করে বলল, আপনি ঘুমাচ্ছেন! কয়টা বাজে?
এমনিই ঘুম এসেছে শুয়ে পড়েছি। কেন ফোন করেছেন?
আপনি কি আজকে ওখানে থাকবেন নাকি নিতে আসবো?
নিতে আসবেন কেন?
আসবো না বলছেন?
অবশ্যই আসবেন। আসবেন না কেন?
মানে কি? নিজেই বলছেন নিতে আসবেন কেন, আবার নিজেই বলছেন আসবেন না কেন!
হ্যালো রুশফিকা আপনি কি শুনছেন নাকি ঘুমিয়ে পড়েছেন? হ্যালো?
আরুশ বুঝে পেল না তার এই মুহূর্তে কি করা উচিত। বাসায় একা ফেরা মানে মায়ের কাছ থেকে আরো কিছু কথা শোনা। আবার রুশফিকাও তাকে ভালো করে কিছু বললো না। অবশেষে রুশফিকার বাসার উদ্দেশ্যেই ড্রাইভ করা শুরু করলো।
।
একটা চারকক্ষ বিশিষ্ট মাঝারি ফ্ল্যাট বাসা। সামনে এডজাস্ট ডাইনিং ড্রইং এ কাঠের টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। সেখানেই মূলত প্রাইভেট ব্যাচ পড়ানো হয়। সেই সকাল ৭টা থেকে ১১টা অবধি ৪টা ব্যাচ পড়ে যায়। বিকেলেও আরো ২ ব্যাচে পড়ে। ভেতরের দুই রুমের দরজা প্রায়ই বন্ধ থাকে। সেখানে স্যারের ফ্যামিলি থাকতেন। সেদিন ইসরা পড়তে এসে দেখে সবেই দু একজন এসেছে। ও ভাবলো হয়তো ও আগে চলে এসেছে বাকিরা লেট করছে। তাই অতো মাথা না ঘামিয়ে ২য় বেঞ্চে গিয়ে বসলো। স্যার তখনো আসেননি, ভেতরের রুমে আছেন হয়তো। বইপত্র খুলে ইসরা পড়ছিল হঠাৎ ভারী গলায় স্যার বললেন, কি ব্যাপার তুমি এখানে?
নিরবতায় হঠাৎ শব্দ শুনে ইসরা চমকে উঠে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে এতোক্ষণ যে কয়জন ছিল তারাও এখন নেই। কখন গেল ওরা? ইসরা জিজ্ঞাসু গলায় বলল, স্যার আজকে কি আমাদের পড়ার কথা ছিল না?
মাশুক স্যার ওর পেছনের বেঞ্চে বসে বললেন, আজকে তো ছুটি, রাফি কে তো বলে দিয়েছি। তোমাকে বলেনি?
না স্যার আমি জানলে তো আসতাম না। আচ্ছা আমি তাহলে চলে যাচ্ছি।
কেমন এক দৃষ্টিতে তাকে পরোখ করে আগের মতোই ভারী গলায় বললেন,এসে গেছ যখন বসো। তুমি না সেদিন বলছিলে স্লাইড ক্যালিপার্স আর স্ক্রু গজের ব্যবহার টা শিখতে চাও। বসো আজকে শিখিয়ে দেই। এরমধ্যে তুমি ঝটপট ছকটা একে ফেলো। আমি যন্ত্র দুটো নিয়ে আসছি। ইসরা খাতা বের করে ছক আঁকছিল। তখন ভেতর থেকে স্যার বলে উঠলেন ইসরা সামনের রুমের টুলটা নিয়ে একটু এদিকে আসো তো। উপর থেকে নামাতে হবে।
ইসরা সরলমনেই টুলটা নিয়ে ভেতরে যায়। কারণ তার ধারণা ছিল ভেতরে স্যারের পরিবার আছেন। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর তার ভুল ভাঙে, তখন আর কিছু করার থাকে না।
সেই চার দেয়ালের বদ্ধ ঘরে মাশুক নামক নর*প*শুটা নিজের ভালো মানুষের মুখোশ খুলে তার উপর হা*ম*লে পড়ে, তার দানবীয় জোরের কাছে ইসরার শক্তি যৎসামান্যই ঠেকে। তার উপর ঘটনার আকস্মিকতায় তার মস্তিষ্ক কাজ করাই যেন বন্ধ করে দিয়েছিল। যখন হুশ ফেরে সর্বনাশ হয়ে যাবে, ইসরা কত আকুতি মিনতিই না করে উঠেছিল। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ স্যার।
মাশুক বিরক্ত হয়ে ওর মু*খে কা*প*ড় ঢু*কি*য়ে দেয়। হাত দুটো ওড়না দিয়ে বেঁ*ধে হিং*স্র*ভাবে কুলষিত করতে থাকে ফুলের মতো পবিত্র ষোড়ষীকে,,,,
প্যান্টের চেইন লাগাতে লাগাতে বিদঘুটে হাসি মুখে ঝুলিয়ে বললেন, এখানে যা ঘটেছে তা প্রকাশ করে নিজেকে কল*ঙ্কিত করবার মতো স্টুপিড তুমি না। আর বললেও আমার কিছুই হবে না, জানো তো আমার অনেক বড় বড় লোকের সঙ্গে হাত আছে। আমার কিছু না হলেও প্রকাশিত হলে ক্ষতি যা হবার তোমার হবে। তোমার রেপুটেটেড ফ্যামিলির ইজ্জত যাবে। So, use your intelligent mind to take the right decision.
সর্বাঙ্গে কলঙ্ক লেপন করা সেই হাতটা এখনো যেন বিদঘুটে ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর প্রতিটা অঙ্গ।
ইসরা ঘুমের মাঝেই কেঁপে কেঁপে কেঁদে উঠে। নিজের অসহায়ত্বের কথা তীব্রভাবে উপলব্ধি করে হাতপা ছুড়তে থাকে, নিজেকে বাঁচাতে অস্থিরভাবে ছটফট করতে থাকে। সে কেন পারছেনা নিজেকে মুক্ত করতে, কেন গলা দিয়ে শব্দটাও বের হয়নি সেদিন। কেন সে শক্তিতে পেরে উঠেনি? কেন,কেন? হঠাৎ একটা ডাক কানে আসে,
রুশফিকা! রুশফিকা! শান্ত হোন কিচ্ছু হয়নি, ভয় পাবেন না আমি আছি তো,,,,
বহুবছর পর ইসরা সেই বাক্যটা শুনে, আধারে ভয় পেলে তার বাবা যখন বলতো……ভয় পেয়ো না আমি আছি তো! সেই একই বাক্য আজ অন্য একজন বলছে। ইসরা শান্ত হয়ে সম্বিত হয়, জেগে উঠে চোখ মেলে তাকায়, চোখে তার এখনো পানি। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে আছে,, ইসরা তাকিয়ে দেখে আরুশ ওর সামনে চিন্তিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। একহাত মুঠোয় রেখে অন্য হাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে পরম মমতায় বলছে, দুঃস্বপ্ন ছিল ওটা, ভুলে যান। কিছু হয়নি, সব ঠিক আছে।
ইসরার মনে হতে থাকে, সত্যিই যদি ওটা কেবলি দুঃস্বপ্ন হতো আজ জীবনটা এতোটা কঠিন হতো না।
চলবে,,,,