#মিস্টার_নার্সিসিস্ট (পর্ব-১২)
#আরশিয়া_জান্নাত
সবাইকে ইনভাইট করা হয়েছে?
নাহ, সবেই কল করা শুরু করেছি।
আম্মু বলছিল যারা কাছে কিনারায় আছেন তাদের বাসায় আপনি চাইলে কার্ড পাঠাতে পারেন, এসব আপনার জন্য।
আচ্ছা!
আরুশ টুকটাক কাজ সেড়ে বের হয়ে গেল। ইসরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, হয়তো আরুশ শেষের দিকেই একটু যা শুনেছে। নয়তো সে ঠিকই প্রশ্ন করে বসতো।
ইসরা একে একে সবাইকে কল করে দাওয়াত দিলো, এন্ড্রো, এলাইনা, ম্যাথিনসহ বেশ কিছু কলিগকেও জানাতে ভুললো না। ফোন রেখে রেডি হতে হবে, আজ সে নিজের বাসায় ব্যাক করবে, ওখান থেকেই বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান হবে। ইসরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকাল প্রায় ৫টা বেজে গেছে। এ কয়দিনে এখানে বেশ কিছু অভ্যাসগড়ে উঠেছে। চায়ের সুখ্যাতি থেকে বিকেলের চা তাকেই করতে হয়, চায়ের পাশাপাশি বাবার সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের আলোচনা। আমজাদ সাহেব মনমতোন এক সঙ্গী পেলেন যেন। শাশুড়ির সাথে এটা ওটা কত কি রান্না শেখা, দুজনে মিলে নতুন নতুন পদও আবিষ্কার করে ফেলে। ইসরা খুব সহজেই মানুষের মন জয় করতে পারে। তাই শ্বশুড় শাশুড়ির সঙ্গে মিশে যেতে তার বিশেষ অসুবিধা হয়নি। যতো দূরত্ব তার কেবল আরুশ নামক মানুষটার সাথে। আরুশের সঙ্গে ওর কথা বলতেও অনীহা। কেননা ও সবার বেলা ভালো কথা বললেও আরুশের বেলা কেমন যেন উল্টো কথা বলে ফেলে, ফলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওর সঙ্গে বিনা প্রয়োজনে কথা বলবেনা। আরুশ ও তাকে বেশি ঘাটে না। দুজন মানুষ একই ছাদের নীচে, একি বিছানায় থেকেও যেন সহস্র মাইল দূরের বাসিন্দা। কেউ কাউকে চিনে না, জানে না অথচ তারা একে অপরের জীবনসঙ্গী!
ইসরা বহুবার বলেছে এভাবে হয়না, এখন সেটা বলতেও বিরক্ত লাগে। আরুশের এক কথা সে বিয়ে ভাঙবেনা। পরিবারের সবাগ বিয়ের অনুষ্ঠানটার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল বলেই দ্রুত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।
এই দুই মাসের বৈবাহিক জীবনে আরুশের প্রতি মায়া মমতা জন্মানোর মতো বিশেষ কিছুই ঘটেনি। না সে এমন কিছু করেছে যাতে আরুশের মনে জন্মাবে। এ এক নিরস নির্জীব দাম্পত্য জীবন। ইসরা অপেক্ষায় আছে আরুশ বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিবে, হয়তো সেটা খুব শীঘ্রই ঘটবে। কিন্তু সে জানে না আরুশের মনে ঠিক তার উল্টো হাওয়া বইছে,,
ইসরা তৈরী হয়ে নীচে নামতেই আমজাদ সাহেব বললেন, চলে যাচ্ছো বৌ মা?
মুনা হেসে বললো, যাচ্ছে না, চলে আসবে। এই তো ক’টা দিন তারপর তোমার মেয়ে তোমার কাছেই ফিরে আসবে। বৌ মা এমন অভ্যাস করেছো তুমি তোমার বাবা তো এখনই খেই হারিয়ে ফেলছে,,,
ইসরা তাদের কদমবুসি করে বললো, আসি মা। আপনারা নিজেদের খেয়াল রাখবেন কেমন?
সাবধানে যেও।
ইসরা আরুশের সঙ্গে গাড়িতে উঠলো। পুরো রাস্তা কেউ কারো সঙ্গে কথা বললো না। ইসরা গাড়ি থেকে নামার আগে বললো, দেরী করে বাসায় ফিরবেন না।
হুম।
আরুশ, এখনো সময় আছে। আমার কথাটা এক…..
কথাটা শেষ করবার আগেই আরুশ তার মাথার পেছনে হাত দিয়ে টেনে ঠোঁটে গভীর চুম্বন করলো। ইসরা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। আরুশ সোজা হয়ে বসে চুল ঠিক করে এমন ভাব নিলো যেন কিছুই হয় নি। ইসরা নিজের ঠোঁটে হাত চেপে বলল, এটা কি হলো! এটা কি করলেন?
আরুশ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি গাড়ি থেকে নামবেন? নাকি আমার সান্নিধ্য ছাড়তে ইচ্ছে করছে না? গাড়ি কি বাসার দিকে ফেরাবো?
ইসরা দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে গেল। আরুশ মুচকি হেসে ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
ইসরা গেইটের ভেতর ঢুকে বুকের বাঁ’পাশ চেপে ধরলো। হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেছে বহুগুণ। আরুশ এমনটা কেন করলো! সে তো এমন করার কথা না!!!
আরেহ ইসরা মামণি যে, এখানে দাঁড়াইয়া আছ কেন?
দারোয়ান চাচার কথায় হুঁশ ফেরে তার, আস্সালামু আলাইকুম চাচা, কেমন আছেন?
ওয়ালাইকুমুস্সালাম ভালো আছি মা, তুমি ভালো তো?
জ্বি চাচা ভালো।
বলেই ইসরা ভেতরে ঢুকে গেল।
।
খালি বেডটার দিকে তাকিয়ে আরুশের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ইসরার সঙ্গে তার সম্পর্ক অন্য পাঁচটা হাজবেন্ড ওয়াইফের মতো নয়। কিন্তু একটা অস্তিত্ব ঠিকই অভ্যাসে পরিণত হয়, মায়ায় জড়িয়ে থাকে। আরুশ বেলকনীতে বসে ভাবতে থাকে, বিয়ের দিনের কথা। বিয়ের প্রপোজালটা পাঠানো হয়েছিল বেশ কয়েকদিন আগেই। ইসরার পরিবারের সঙ্গে আলাপচারিতা হয়, ওর দাদীর বেশ পছন্দই হয় তাকে। ভদ্রমহিলা বেশ আনন্দের সাথেই বলেছিল,দাদু ভাই আমার নাতনীটা বড় আদরের, আমার বড় ছেলের ঘরের প্রথম সন্তান। তাই বলতে পারো ও আমার নয়নের মণি। আমি কখনোই চাই না ও বিদেশে পড়ে থাকুক। আমি মরে গেলে ওরে কেউ দেশে ফিরাইতে পারবেনা এ আমি হলফ করে বলতে পারি। আমার ইচ্ছে আমি যে দেশে মরমু, যে শহরে আমার কবর হবে সে ঐ শহরে বসবাস করুক….
কয়েকদিনের পরিচয়ে মানুষটাকে ভীষণ মনে ধরেছিল তার। তাই তো তার এক কথাতেই ওমন পরিস্থিতিতে কবুল বলতে ২য় বার ভাবে নি সে।
ইসরার প্রতি তার রাগ অনেক ছিল, সে ভেবেছিল ইসরাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিবে,যন্ত্রণা দিবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। দাদীকে হারানোর পর ইসরা যেভাবে মিইয়ে পড়েছিল সেটা দূর থেকে দেখে আরুশের মনে মায়া জন্মে যায়।
ধীরে ধীরে আরুশ টের পায় ইসরা স্বাভাবিক না। ওর লাইফে নিশ্চয়ই কোনো ট্রমা আছে। কিন্তু সেটা কি সে জানে না। ইসরা সবসময় তাকে বলে ওকে চুজ করে আরুশ ঠকেছে, জেদের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরুশ বুঝে উঠতে পারেনা একটা এডুকেটেড ভদ্র ফ্যামিলির মেয়ে, যার কি না জ্ঞানে গুণে কোথাও কমতি নেই। সে কেন নিজেকে এমন তুচ্ছ ভাবে? প্রেজেন্টেশনের দিন যে আত্মবিশ্বাসী মেয়েকে সে দেখেছে জীবনসঙ্গী হয়ে সেই মেয়েটাই কেন এতো নড়বড়ে? এখানে রহস্য কি?
আরুশের সন্দেহ আরো গাঢ় হয় সে পুনরায় সব স্মৃতি ভাবতে থাকে। আরুশ সোজা হয়ে বসে দ্রুত হিসাব কষতে শুরু করে, সেই রাতে সে যখন ওকে প্রথম ছুঁয়েছিল ও কি বলেছিল?
স্যার বলে কি তাকেই সম্বোধন করেছিল নাকি অন্য কাউকে? জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকবার সময়ও একই কথা বলছিল, এমনকি সবসময় স্বপ্ন দেখে যখন কাঁদে ঐ একটা বাক্যই বলে। সে তো কখনোই ইসরার উপর স্বামী হবার অধিকার খাটায় নি। না ২য় বার স্পর্শ করার চেষ্টা করেছে। তবে ইসরা কাকে ভয় পায়? কার কাছে আকুতি মিনতি করে? আরুশ বিচলিত হয়ে উঠে। মস্তিষ্কে জোর দেয়, তারপর মনে পড়ে সেদিন বিকেলে ও ফোনে বলছিল, সে পবিত্র নয়! তবে কি কোনোভাবে সে এবইউজের স্বীকার হয়েছিল? সেই স্মৃতিই কি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে?
আরুশ আন্দাজে কিছু ছক আঁকে, যুক্তিতর্ক মিশিয়ে সমাধান করতে চায়। কিন্তু জট খোলার সলিড ক্লু তার হাতে নেই। ইসরাকে সরাসরি বললেও বিশেষ লাভ হবে না এ সে ভালো করেই জানে। আরুশ নিরাশ হয়ে কোচে হেলান দেয়। আপনমনেই বলে উঠে, রুশফিকা আপনি আমার অমীমাংসিত প্রহেলিকা! আমি আপনার গোলকধাধা সলভ করতে গিয়ে আপনাতে মোহাচ্ছন্ন হচ্ছি। আপনার প্রভাব তীব্রভাবে আঘাত হানছে আমার মনে, অথচ আপনি বেখবর!!
।
মাঝরাতে ইসরার ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে যখন দেখে অপরপাশে কেউ নেই মনটা কেমন যেন করে উঠে। ইসরা উঠে বসে, হাতরে ফোনটা নেয়। নোটিফিকেশন চেক করে হতাশ হয়। আরুশ তাকে একটা কল ও করলো না, টেক্সট ও করলোনা? নিশ্চয়ই শান্তিতেই আছে, ইসরার অনুপস্থিতি ভালোই ইনজয় করছে।
মনটা কেমন তেতো হয়ে উঠে। হঠাৎ ইসরার মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসে। সে আরুশের শান্তির ঘুম নষ্ট করতে আরুশের নাম্বারে কল করে।
একবার রিং হতেই আরুশ কল রিসিভ করে। ইসরা অবাক হয়ে বলে, আপনি জেগে ছিলেন ঘুমান নি?
আরুশ ইষৎ হেসে বলল, আমায় মিস করছিলেন বুঝি? এখুনি বরকে চোখে হারাচ্ছেন?
ইসরা ভ্রু কুঁচকে বলল, মোটেও তেমন নয়।
তবে মধ্যরাতে কল করার কারণ কি?আমি বুঝি তো আমাকে মিস না করে থাকা অসম্ভব।
ইসরা হেসে বলল, আমি আপনাকে বিরক্ত করতে কল করেছিলাম, মিস করতে আমার বয়েই গেছে।
তাই নাকি?
জ্বি ঠিক তাই।
তা নিজের ঘুম ছেড়ে আরেকজনকে বিরক্ত করায় বিশেষ লাভ কি আছে?
পৈশাচিক আনন্দ আছে।
ও আচ্ছা!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরুশ বলল, রুশফিকা!
হুম?
আমি আপনাকে মিস করছি। অনেক বেশিই মিস করছি। আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারছিনা আপনাকে ছাড়া,,,
আরুশের কন্ঠে কি ছিল ইসরা জানে না, তবে তার চোখের কোণটা ভরে আসে নোনাজলে। একটা সূক্ষ্ম শিহরণে আবেগ উতলে উঠে। ইসরা ফোন রেখে কাঁদতে থাকে। ওর মনে হতে থাকে ও এমন আবেগঘন কথাবার্তা ডিজার্ব করে না, আরুশের মতো কেউ একজন তাকে পরোয়া করছে, তার সঙ্গে মরিয়া হয়ে সংসার করতে চাইছে; ওর নির্লিপ্ততা নিরবে মেনে নিচ্ছে;
এসব অন্যায়। ও আরুশের কাছ থেকে সত্যিটা লুকিয়ে ওর সঙ্গে অন্যায় করছে। আরুশ যখন সবটা জানবে নিশ্চয়ই ওকে ধোঁকাবাজ বলবে? বলবে, আপনি নিজে এতো বড় খুঁত নিয়ে বেঁচে থেকে আমার খুঁত ধরলেন? আমারটা তো তাও নিজের হাতে নেই, কিন্তু আপনার টা তো এরচেয়ে শতগুণ জঘন্য! আপনার স্পর্ধা কি করে হয় আমার পাশে থাকার?
ইসরা বুঝতে পারে বাহ্যিকভাবে সে আরুশকে এড়িয়ে গেলেও ওর মনের কোথাও না কোথাও এই মানুষটা ঠিকই আসন পেতে বসে আছে,,,,আরুশের অনুপস্থিতি তাকেও কম পোড়াচ্ছে না।
চলবে,,,