#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩৩
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“এমন কেন হয় মনের ভেতর অনেক কথা থাকে কিন্তু সেগুলো মুখে আসেনা।প্রশ্নগুলোর জবাব আছে।”
“তবে বলতে পারছো না।তাইতো?”
তোশা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো।বারান্দার দিকে হওয়ায় মৃদু আলো পরিবেশকে উজ্জ্বল করেছে।সাহেদ পুনরায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার বয়স জানো কতো?বর্তমানে পঁচাত্তর বয়স।শরীরের চামড়া ঝুলে গিয়েছে।চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়েছে।তোমার থেকে অভিজ্ঞতা বেশী এটা তো মানো মা?”
“জি।”
“জবাব সেই সব প্রশ্নের থেকেও থাকেনা যেগুলো উত্তর সঠিকভাবে গোছানো হয়না।”
“না জবাব আছে তো।”
“তাহলে বলো।”
আন্দোলিত হয়ে উঠলো তোশার ছোট্ট মন।বুকের ভেতর লাব-ডাব শব্দের তীব্রতা বাড়ছে।বড় করুণ সুরে সে শুধালো,
“যদি জবাব না দিতে পারি তাহলে আমাকে মেনে নিবেন না?”
“আমি সেটা বলিনি।কারণ যারা সংসার করবে তাদের সমস্যা না হলে আমার কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু সংসার টিকতে হবে আগে।যে ভালোবাসার দোহাই দিবে সেটা কবীর ও দিশার মধ্যেও অনেক ছিল তোমার বাবা-মায়ের মধ্যেও ছিল।কিন্তু দিনশেষে সকলের পথ ভিন্ন।আমি কখনো চাইবো না বয়সের কঠিনতম সময়ে এসে আমার ছেলেটা একা থাকুক কিংবা দ্বিতীয়বার বিচ্ছেদের য ন্ত্র ণা পাক।”
“আমি এমন না।কবীর শাহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবনে।”
“থাকতে পারে।কিন্তু সবসময় হবে এমন তো নয়।”
নীরবতার চাদরকে অবলম্বন করলো তোশা।বয়সে বড় কেউ যে সহজে ছোট বয়সীদের প্রশ্নের বেড়াজালে আঁটকে ফেলতে পারে তা ক্ষণে ক্ষণে টের পাচ্ছে তোশা।যদি এখানে না আসতো তবে এমন প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হতো না।সাহেদ মেয়েটির মনের কথা বুঝতে পারলো।হালকা কেশে বলল,
“আমার কাছে অথেন্টিক দার্জেলিং টি আছে খাবে?বেশ ভালো বানাই।এরপর না হয় আলোচনা করা যাবে।”
তোশা ঈষৎ হেসে উঠলো।উপর নিচে মাথা দুলিয়ে সাহেদের পিছনে যেতে লাগলো।
(***)
সাধারণ ঘরোয়া পোশাকে অফিসে কবীরকে প্রবেশ করতে খুব কম দেখেছে সকলে।সর্বদা পরিপাটি হয়ে থাকে এই তামাটে লৌহ মানবটি।তবে আজ যেন ব্যতিক্রম হলো।ঘন্টা দুয়েক জিম করে সোজা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অফিসে চলে এসেছে।যদিও পিছনে সুন্দর যুবতীকে এক নজর দেখার স্বার্থটা সবথেকে বেশী।
পিয়ন লোকটিকে পানি আনতে বলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো কবীর।মিনিট দুয়েক পরে তাহিয়া ভেতরে প্রবেশ করলো।পিছনে মায়ের আঁচল ধরে ছোট্ট কন্যাটিও আছে।নীল রঙা ড্রেসটিতে অপরাজিতা লাগছে।
“তাহিয়া,তোমার মেয়ের ভার্সিটি নেই?সারাদিন এমন ঘুরাঘুরি করে কেন?”
“আছে।কিন্তু এখন সে বায়না করেছে বড় হবে।এই কারণে রোজ অফিসে এসে বিষয়গুলো বুঝতে চেষ্টা করে।”
কবীরের দৃঢ় কপালে কয়েকটি রেখার উদয় ঘটলো।এমনিতে সেদিন বাড়ীতে তার বাবা সাহেদের সঙ্গে তোশার ঠিক কী কথা হয়েছে সেটা এখনও জানতে পারলো না।সকালে বাবাকে ডাকতে গিয়ে দেখে তখনও আলোচনা চলছে দুজনের মধ্য।উপরন্তু তোশার ব্যবহারে বেশ পরিবর্তন এসেছে।
“এই মেয়ে বড় হবে?আমার বিশ্বাস হয়না।”
যুবতী তোশা মায়ের আড়ালে চোখ রাঙায় প্রিয় মানুষটিকে।কিন্তু কবীর শাহ তাতে ভয় পায় নাকী?বরং উল্টো সুর ধরে বলল,
“তোশামণিকে শাসন করো তাহিয়া।অভিনয়ের ব্যাপারটা ভুলে যেওনা।আর শেখার সময় আছে।অসময়ে কিছু হয়না।”
“থাক না কবীর।একটু-আধটু থাকুক আমার সাথে।”
“তাহলে শেখা হবেনা।তুমি ওকে কিছু করতেও দিবে না।উল্টো সময় নষ্ট হবে।পড়াশোনায় ঝামেলা হবে।”
“কথাটা তো সঠিক।”
কবীর যেন এই বাক্যের অপেক্ষায় ছিল।হালকা কেঁশে শুধালো,
“আমার অফিসে থাকুক।সেইফ থাকবে এবং বুঝবেও ভালো।”
“ঠিক।কিন্তু ভুল তো করবে অনেক।”
“ভয় নেই তাহিয়া।তোমার মতোন আমিও এই দস্যুকে শাসন করতে পারিনা।অনুমতি থাকলে একটু পর ওকে নিয়েই আমি মেইন অফিসের জন্য বের হবো।”
কবীরের প্রস্তাবে তাহিয়া অকপটে রাজি হয়ে গেলো।কিন্তু তোশা গাইগুই করতে লাগলো।কবীরের সন্নিকটে থাকলে যে তার উদ্দেশ্য সফল হবেনা।কিন্তু মায়ের মুখের উপর মানা করতে পারলো না।ঘন্টা দুয়েক পর কবীরের সঙ্গে প্রধান অফিসের দিকে যাত্রা শুরু করলো।এখন তামাটে পুরুষ পুরোপুরি গোছানো মানুষ।কোথাও যেন খুঁত নেই।ড্রাইভার না থাকায় বেশ সুবিধা হলো তোশার।
“আপনি অনেক চালাক কবীর শাহ।কতোটা সতর্ক ভাবে আম্মুকে বুঝিয়ে দিলেন।এখন নিশ্চয় আমাকে সেক্রেটারী করবেন।এরপর অফিস রোমান্স।”
পুলকিত হয়ে উঠলো তোশার মন।কিন্তু এই ভাবনায় এক সমুদ্র পানি ঢেলে দিয়ে কবীর বলল,
“না ম্যাডাম।আপনি আপাতত বেসিক শিখবেন তাও আমার ম্যানেজারের থেকে।শুধু কীভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে হয় এটা শেখাবে।অন্যকিছু ভবিষ্যতে।”
“কেন?তাহলে তো আমি আম্মুর সাথে ভালো ছিলাম।”
“আগে বলো মাথায় এসব ভূত কোথায় থেকে এলো?এই মেয়ে এতো চিন্তা কীভাবে করো তুমি?আব্বু বলেছে এসব?”
তোশা জ্ব লে উঠে বলল,
“আঙ্কেলের নামে উল্টোপাল্টা ভাবলে খবর আছে।”
“তাই?আব্বুর সাথে এতো মিল হলো তোমার।বেশ, ভাববো না কিছু।তবে সেদিন রাতে কী বলেছে সেটা বলো আগে।”
তোশা নতমস্তকে শুধালো,
“আমার নামে এতোগুলো টাকা কেন রেখেছেন আপনি?”
হাসিখুশি কবীরের মুখটা নিভে গেলো।সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য তাহলে কাজ করতে চাও?আব্বু বলেছে তাইনা বিষয়টা?”
“নাহ-হ্যাঁ।কারণ আছে অন্য।কিন্তু আপনি এতো কেন করেন আমার জন্য?”
“শুনতে চাও?”
“হুঁ।”
গাড়ীটা একপাশে থামিয়ে দিলো কবীর।টান দিয়ে মেয়েটিকে নিজের কাছে নিয়ে এলো।দুজনের উষ্ণ শ্বাস একত্রিত হয়ে উঠলো।খোঁচা শক্ত গাল দ্বারা তোশার নরম গালে আলতো স্পর্শ করলো কবীর।মৃদুমন্দ কণ্ঠে বলল,
“তোমার ভবিষ্যত সুরক্ষিত করে দিলাম।”
“টাকা থাকলে ভবিষ্যত সুরক্ষিত হয়?”
“কিছুটা বেলাডোনা।ভীষণ ভালোবাসি।”
তোশার মন জুড়ে নির্মল বাতাস বয়ে গেলো।কিন্তু আ’হত কণ্ঠে বলল,
“যদি ভবিষ্যত আপনি না হোন তাহলে টাকার সুরক্ষা দিয়ে কী করবো আমি?”
“থাকবো না কেন?”
“জানিনা।আমার খুব ভয় করছে কবীর শাহ।মনে হচ্ছে সামনে অনেক কঠিন কিছু হবে।”
“ভয় নেই।যতোটা কঠিন হবে সামলে নিবো আমরা।”
কবীর মেয়েটিকে নিশ্চিন্ত করতে পারলো না এই কথায়।সে বুঝতে পারছে তার বাবা কিছু একটা বলেছে যার প্রতিফলনে তোশার এমন ভয়।হুট করে মেয়েটা চোখ তুলে তাঁকালো।কী সুন্দর সজীব মুখটা।কবীর শক্ত আঙুল গুলো দ্বারা গালে হাত বুলিয়ে নিলো।চোখ দুটো বন্ধ করে স্পর্শ গুলো অনুভব করতে করতে তোশা বলল,
“কবীর শাহ চলুন আজ, এখুনি বিয়ে করে ফেলি।তা নয় মনে হচ্ছে আমি আপনাকে কখনো পাবো না।”
চলবে।
#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩৪
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“মেয়েদের চোখ ও সমুদ্রের মধ্যে মিল কোথায় আছে জানো?দুটোর জল কখনো শেষ হয়ে যায়না।কেঁদো না বড্ড মিষ্টি লাগছে দেখতে।”
অশ্রু ভেজা চোখ দুটি আকারে সংকুচিত হয়ে উঠলো।রক্তিম নাক দিয়ে লম্বা একটি নিশ্বাস টেনে তোশা আস্তে করে বলল,
“ঢং করেন।”
“তোমার থেকে শিখেছি মেয়ে।বিয়ের ভূত মাথা থেকে আপাতত নামাও।তোমার বাবা দেশে আসছে ছয় মাস পর।তখন সবকিছু সকলে জানবে।”
উচ্ছাসিত কণ্ঠে তোশা শুধালো,
“আব্বু দেশে আসছে?কিন্তু আম্মুকে তো এখনও বিয়ে দিতে পারলাম না।”
“তাহিয়া বিয়ে করতে চায়না।ব্যাপারটা বড় করবেনা।চলো অফিসে লেট হচ্ছে আমার।”
কবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে তোশার গাল দুটি মুছে দিলো।মেয়েটাও সর্বোচ্চ অধিকারে নিজের সিক্ত নাকটি কবীরের টাই তে মুছে নিলো।
তোশার অফিস রোমান্সের স্বপ্নটাও পূরণ হলো না।উল্টো গম্ভীর এক রমণীর সান্নিধ্যে পাঠিয়ে দিলো কবীর।মহিলার নাম মিরা রহমান।দেখতে শুনতে বেশ ভালো।মূলত তোশার চোখে পৃথিবীর সব নারী সুন্দর।নিজ নিজ উপায়ে।
“তুমি কী রোজ অফিসে আসবে তোশা?”
মিরার প্রশ্নে সোজা হয়ে বসলো তোশা।চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
“যেদিন ভার্সিটিতে ক্লাস কম থাকবে অথবা শ্যুটিং থাকবেনা সেদিন আসবো না।”
“তুমি অভিনেত্রী?কীসে অভিনয় করেছো?”
“এখনও শুরু হয়নি অভিনয়।কেবল একটা কন্ট্রাক সাইন করেছি।”
“ভালো লাগে অভিনয়?”
“তেমন একটা না।”
মিরা উষ্ণ এক শ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার মা ভালো অভিনয় জানতেন।অনেক বড় বড় হিরোইনদের সাথে সাইড রোল হিসেবে কাজ করেছেন।যদি ছবি দেখাই চিনতে পারবে।আগের মুভিগুলো দেখা হয়েছে?”
“তেমন একটা না।”
“থাক তাহলে চিনবেনা ছবি দেখেও।”
কথাটি বলে মিরা পুনরায় নিজ কাজে মনোযোগ দিলো।তোশা সৌজন্যতাবসত বলল,
“দেখাতে পারেন।আমি চিনবো হয়তো।”
সুন্দর মিষ্টি করে হাসলো মিরা।ল্যাপটপটি বন্ধ করে নিলো।
“দেখাবো।তোমাকে ভালো লেগেছে মেয়ে।এজন্য কিছু উপদেশ দেই অভিনয়ে স্বাবধানে পা বাড়াবে।পেশাটি যতো উজ্জ্বল ঠিক ততোটাই গভীর।”
“জানি আমি।তাছাড়া হয়তোবা এটাই শেষ অভিনয় হবে।আপনি অভিনয় জগত সম্পর্কে খুব জানেন তাইনা?”
“হুম।”
“কখনো অভিনয় করেছেন?যেহেতু আপনার মা এই পেশায় ছিলেন।”
“করেছি বৈকি।তবে ভালো স্মৃতি নেই।”
“কেন?”
লম্বা একটা শ্বাস নিলো মিরা।যে ঘটনাটি মাথায় চলছে সেটা সে বহুবার বহু মানুষকে বলেছে।
“কেন এর জন্য বিশেষ একটি ঘটনা আছে।আমার বয়স এখন অনুমান করতে পারবে?এইতো পঞ্চাশের কোঠায়।ধরে নাও আজ থেকে সাতাশ বছর পূর্বে বিখ্যাত একজন নায়কের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।সাইড নায়িকা নয় মূখ্য অভিনেত্রী হিসেবে।শুট্যিং একমাস চলল এরমধ্যে সেই অভিনেতার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলো।গোপনে বিয়েও করে ফেললাম।কিন্তু হুট করে শ্যুটিং বন্ধ হয়ে গেলো।খবর নিয়ে জানতে পারলাম যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে পূর্ব থেকে অনেক বড় একজন মন্ত্রীর মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।আমার কথা জানার পর তার প্রথম স্ত্রী শ্যুটিং বন্ধ করে দিলো।ব্যস দুনিয়া ঘুরে গেলো আমার।এরপর সেই মানুষটাও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।অভিনয় তো আর হলো না।বাস্তব জীবনেও কেমন যেন পিছিয়ে গেলাম।বিয়েও হলো না আর মানুষটার সঙ্গে বিচ্ছেদও না।”
মিরা চশমার ফাঁকে আঙুল দিয়ে চোখ মুছলো।তোশা বুঝতে পারলো মহিলাটি এই ঘটনা সবাইকে বলে অভ্যস্ত আছে।ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো ছোট্ট যুবতীর।কতো মানুষের কতো রকম গল্প আছে।বিব্রতবোধ থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে সে উঠে দাঁড়ালো।
“আমি একটু কবীর শাহ এর কাছে যাচ্ছি আন্টি।”
মিরা হেসে বলল,
“স্যারকে তুমি নাম ধরে ডাকো কেন?সে কিছু বলেনা?”
“উহু,বরং ডাকটা ভালোবাসে।”
“তোশা, আমার কাহিনীর আরো একটি রুপ আছে জানো?মানুষটা আমাকে ছেড়ে দেওয়ার মাস দুয়েক পর চমৎকার একজন মানুষের অস্তিত্ব আমার শরীরের ভেতর পেয়েছিলাম আমি।বাবার মতোন সে নিজেও বিখ্যাত একজন অভিনেতা।পথ চলতে তোমার দেখা হতে পারে তার সঙ্গে।নামটা বলবো না।কারণ এবার তুমি তাকে চিনবে।যাকে তার মা-বাবা কেউ পরিচয় দেয়নি নিজেদের।”
“সে কী প্রতীক স্যার?”
মিরা মুখ দিয়ে বিরক্তিকর একটি শব্দ করে বলল,
“প্রতীক হওয়ার প্রশ্ন আসেনা।সে অন্য কেউ।মন বলছে দেখা হবে তোমাদের।”
তোশার মন অবশ্য সেটি বলল না।জোরপূর্বক অধরযুগলে হাসি টেনে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।পথ চলতে গিয়ে মিরা কাহিনী আদৌ সত্য কীনা সেটা খুব করে ভাবতে লাগলো সে।
(***)
“বৃষ্টি কল্লোলকে পছন্দ করে।এজন্য চাচ্ছে তোশার সাথে তুমি সম্পর্কটা ভে ঙে দাও।চাচার প্রেমিকার মামাতো ভাইকে পছন্দের কথা বলতে ওর লজ্জা লাগছে।”
কবীরের ভ্রু দুটো কুঁচকে গেলো।গলার টাই একটু ঢিলে করে নিলো।দিশাকে দেখার পর থেকে যেন শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে তার।
“এসব কথা বলার জন্য এসেছো?আবার সেই দিনে যেদিন তোশা আমার সাথে অফিসে এসেছে?”
চোখ-মুখের পেশী শক্ত করে রেখে দিশা জবাব দিলো,
“হ্যাঁ।বরং তাহিয়াকে ফোন করে ওর থেকে শুনে এসেছি।”
“লাভটা কী এরকম করে?আমি তোমার প্রাক্তন।বিয়েটা ভাঙার সময় এসব মনে ছিলনা?”
“ছিল।কিন্তু তোশার সঙ্গে তোমার পুরোপুরি সম্পর্ক জুড়তে দিবো না আমি।অল্প বয়সী বউ পেয়ে আহনাফকে ভুলে যাবে তুমি?রঙীন রাতের আড়ালে আমার ছেলটা শুধুমাত্র একজন ফেলনা হয়ে থাকবে।”
কবীরের মন চাইলো দিশাকে ক ষি য়ে একটা চড় দিতে।মাঝেমধ্যে তার কাছে অবিশ্বাস হয় এই মানুষটা এক সময় সত্যি তার স্ত্রী ছিল তো?ছিল কিন্তু কোনগুণে কবীরের পছন্দ হয়েছিল তাকে সেটিই রহস্য।
“আহনাফের সাথে তোশার যতোটা ভালো সম্পর্ক সেটির এক আনাও তোমার সঙ্গে নেই।তাছাড়া তোশাকে মানসিক ভাবে এতোটা কষ্ট দেওয়া কতোটা সঠিক?”
দিশা জবাব দেওয়ার পূর্বে দরজা খুলে তোশা প্রবেশ করলো।যুবতীর চোখের রঙ বদলানো খেয়াল হলো কবীরের।দিশা যেন এই সুযোগটির অপেক্ষায় ছিল।আরামে চেয়ারে গা হেলিয়ে বলল,
“কবীর তোমার মনে আছে মালদ্বীপে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা।সেখানে বীচের মধ্যে রাতের বেলায় কতোটা উন্মাদ হয়ে উঠেছিলে তুমি?আহা সেসব স্মৃতি মনে হলে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি।”
কবীর তোশা দুজনে কিছুটা সময় নির্বোধের অনুরুপ দিশার পানে তাঁকিয়ে রইলো।কিন্তু অবাক হওয়াকে দ্রুত কাঁটিয়ে কবীর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তোশাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“অতীত মনে রাখা আমার স্বভাবে নেই দিশা।যদি বলো আগত কিছু স্মৃতির আশায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে আমার মন।বিশেষ করে তোশা আর আমি একটু আগে প্ল্যান করছিলাম কীভাবে বিয়ের পরের দিন গুলো কাঁটাবো।আর কিছু না হোক।আমার বেলাডোনা তোমাকে কখনো সেসব উজ্জ্বল ভালোবাসার চিহ্ন দেখানোর মতোন রুচি রাখেনা।তো ভয় নেই।”
তোশার ছোট্ট মাথায় আগের কথা গুলো না ঢুকলেও প্ল্যানের বিষয়টা ভালো করে ঢুকলো।নিজ মনে মনে সে বলল,
“আমরা এসব প্ল্যান করলাম কখন?স্বপ্নে?”
চলবে।
#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩৫
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
পৃথিবীর সবথেকে বিদ্রুপ জড়িত হাসিটা যেন এইমাত্র হেসে নিলো দিশা।কবীরের কথাগুলোকে তোয়াক্কাও করলো না।বরং চেয়ার থেকে নিজের ব্যাগটা হাতে তুলে বলল,
“তোশা তুমি কবীরের বাবাকে কী বলে ডাকো?নিশ্চয় দাদা কিংবা নানা নয়।সেখানে তোমার মা আঙকেল বলে ডাকে।হয়তো তুমিও তাই ডাকবে।এই একটা জিনিসে বোঝা যায় তোমাদের সম্পর্কের রঙ মাখা ভালোবাসা প্ল্যান করা কতোটা নো ং রা।তোমরা যেটাই বলো না কেন?শেষে বিয়েটা আমি হতে দিবো না।আমি মটেও চাইবো না শেষ জীবনে গিয়ে আমার একমাত্র সন্তানের বাবা কষ্ট পাক।আজ উঠি।”
কবীর বা তোশা দুটো মানুষ যেন মুখে কুলুপ এঁটে রইলো।সুমিষ্ট চেহারায় দিশা নামের মানুষটা কতোটা না সত্য কথা বলল তাদের।তবে এই সত্যটি হজম হলো না প্রেমিক যুগলের।অভিমানে তোশা কবীরকে ছেড়ে বের হয়ে গেলো।দিশা পুনরায় মনকাড়া হাসলো।
“ছোট মরিচের ঝাল যেমন বেশী।ঠিক তেমনটা ওর মতো মেয়েদের আবেগ বেশী।তাই নিজের ভাতিজির কথা চিন্তা করে হলেও সরে যাও সবকিছু থেকে।”
“আমরা রিলেশনে আছি এটা বৃষ্টি তোমাকে বলেছে?”
“হ্যাঁ।ওর রিকোয়েস্টে এখানে আসা।স্বার্থপর হবেনা।সারাজীবন ভাই ও তার পরিবারের জন্য কতোকিছু করলে।এটা শেষ বেলায় এসে ধুঁয়ে দিবেনা আশা করি।”
কবীর নিশ্চুপ।যেন কথা বললে অজানা মহামারী ছড়িয়ে পড়বে।সুগঠিত পেশিবহুল হাত গুলো দ্বারা দিশাকে বাহিরের রাস্তাটি অবশ্য দেখাতে ভুললো না।
“আমার পরিবার দিশা।কী করবো সেই বিষয়ে প্রাক্তনের থেকে নিশ্চয় উপদেশ নিবো না।”
“কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাক্তন আশীর্বাদ স্বরুপ হয়ে থাকে।ভালো উপদেশ গুলো গ্রহণ করো।আসছি।”
“আর ফিরে এসো না।”
অপমানটা গ্রহণ করলো না দিশা তবুও মুখের রঙ পরিবর্তন করে বের হয়ে গেলো।কবীরের মনে হলো দুজন স্বার্থবাদী নারী একা করে চলে গেলো তাকে।
(***)
“মন্দ বলুক সমাজ
তুমি আমারই, হায়, বলবো শতবার
ও আমার বন্ধু গো
চির সাথী পথ চলার,
তোমারই জন্য গড়েছি আমি
মঞ্জিল ভালোবাসার।”
গানগুলোর প্রত্যেকটি লাইন তোশার মনে বিষাদ জুড়ে দিলো।পরনে তার কুঁচি করা সুন্দর একটি জামদানী।আশির দশকের মেয়েদের মতোন করে খোঁপা করা চুলে।এইতো আজ শ্যুটিং এর দ্বিতীয় দিন তার।বেশ ভালো অভিনয় করছে তোশা।কিন্তু ডিরেক্টর সোহান হয়তো তৃপ্ত হতে পারছেনা।তাকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসিয়ে রেখেছে।ব্যক্তিটা অবশ্য অমায়িক।গানের গলা সুন্দর।তোশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকিয়ে দেখছে।সোহান মিষ্টি হেসে বলল,
“গানটা ভালো গেয়েছি তোশা?কী বলো?”
“আসলেও সুন্দর স্যার।”
“যখন সালমান শাহ্ ও মৌসুমির শ্যুটিং চলছিলো এই গানটায় তখন বাবার হাত ধরে এসেছিলাম দেখতে।সেই থেকে আমার প্রিয় গান।তোমাকে আমার কাছে সেই আর্লি এইজের মৌসুমীর মতোন লাগে।মিষ্টি মেয়ে।”
হুট করে কোথাও থেকে প্রতীক এসে তাদের পাশে বসলো।তোশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“নায়িকারা দেখতে মিষ্টি হয় সোহান ভাই।জানেন না কোনো স্পার্ক না থাকলে সে নায়িকা নয়।তোশা অভিনয়ে আরো ভালো করতে হবে।কিন্তু তোমার চেহারা বড় সুন্দর।”
“প্রতীক স্যার।অভিনয় জগতে সব কী সৌন্দর্য নাকী?দক্ষতা বলে কিছু নেই?”
মাথা দুলালো প্রতীক।একটা ছেলে দৌড়ে এসে তাকে কফি দিয়ে গেলো।সেখানে চুমুক বসিয়ে বলল,
“ফিফটি-ফিফটি।দুটোই লাগে।যাই হোক কেমন লাগছে?”
“ভালোই।খারাপ না।”
“আরো ভালো লাগতো যদি এতো কড়াকড়ি নিয়মে না থাকতে।মিস.শাহ তো সব ঠিক করে দিয়েছে।এমনকি তোমার পোশাক গুলোও।”
তোশা কথাগুলোর বিপরীতে অধর প্রসারিত করলো শুধু।কবীরের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে নীরবে বোঝাপড়া চলছে তার।কারণটা অবশ্য দিশা।একটু অভিমানে তোশা ভেবেছিল ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবে মানুষটা।কিন্তু ওইযে পাষাণ হৃদয়ের মানুষ।
“কোথায় হারিয়ে গেলে তোশা?”
“এখানে আছি।”
প্রতীক হালকা ইতস্তত করলো।কিন্তু মেয়েটিকে তো পেতে হবে।এই কারণে নিজের ভালো প্রভাব বিস্তার করার নিমিত্তে বলল,
“আমার আগের কাজগুলো দেখেছো কখনো?কেমন লাগতো আমাকে?”
“হালকা পাতলা দেখেছি।কিন্তু আমার মামী আপনার খুব ফ্যান।”
“একদম ডাই হার্ড ফ্যান কোন নায়কের তুমি?”
তোশা মিনমিন করে বলল,
“সে অভিনেতা নয়।কিন্তু তার ফ্যান আমি।”
প্রতীক উপলব্ধি করতে পারলো মেয়েটা কার কথা বলছে।নিজেকে সর্বোচ্চ শান্ত রেখে বলল,
“মানুষটা কী কবীর স্যার?”
“হ্যাঁ।”
“ভয় করেনা এতো সিনিয়র কাওকে পছন্দ করতে?”
“বুঝলেন কীভাবে?”
“জানি একভাবে।”
তাদের কথার মধ্যিখানে সোহান সিন শ্যুট করার তাড়া দিলো।এবার বেশ ভালো করে অভিনয় করছে তোশা।দৃশ্যের এক পর্যায়ে মেয়েটার খোঁপায় ফুল গুঁজে ভালোবাসা ব্যক্ত করলো প্রতীক।বিনিময়ে তোশার নতমুখে লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো।ঠিক যেন লালচে করঞ্জ।
কবীর দূর থেকে দৃশ্যটি দেখলো।বুকে চিনচিনে ব্যাথা হলো তার?হয়তো।গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়ালো।তোশার আড়চোখের দৃষ্টি অবশ্য তার উপর পড়েছে।মেয়েটা দৃশ্যটি শেষ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো।এতে অবশ্য অভিনয়টি আরো নিখুঁত হলো বটে।
সোহান বৃদ্ধা আঙুল উঁচু করে বলল,
“খুব সুন্দর হলো তোশা।একটু ব্রেক নাও।বিকেলে আবার একটা দৃশ্য আছে।”
“জি ধন্যবাদ।”
তোশা পা চালিয়ে কবীরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।তবে মুখটা এখনও নিচের দিকে।এক হাতে আঁচলটি জড়িয়ে নিচ্ছে।মেয়েটির হাবভাব কেমন যেন অদ্ভূদ।কবীর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“কী সমস্যা?”
ভেঙে ভেঙে বলল তোশা,
“লজ্জা পাচ্ছি।”
“কেন?”
“আপনাকে দেখে।ইশ কতো সুন্দর আপনি।”
কবীর মুখে সংক্রিয়ভাবে হাসি চলে এলো।তবুও গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল,
“তুমি আর লজ্জা?অভিনয় থেকে বের হও।”
“এভাবে বলবেন না।বুঝেন না কেন?নারী হওয়ার চেষ্টা করছি।আপনি এখন আমাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন আমি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলবো।আঁচলে মুখ লুকাবো।আপনি লজ্জা ভাঙিয়ে আরো কাছে আসবেন।এরপর…।থাক আপনি এসব কিছু করেন না।রোমান্স বর্জিত ব্যাটা।”
তোশার কথাটি শেষ হওয়ার সঙ্গে মেয়েটি বাহু ধরে নিজ কাছটায় টেনে নিয়ে এলো কবীর।বুকের সঙ্গে লেপ্টে গেলো যুবতী।আলতো হাতে তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে বলল,
“বেলাডোনা,তুমি কিন্তু লজ্জা পাচ্ছো না।এভাবে আমার দিকে তাঁকিয়ে দেখছো কী?”
তোশা এখনও পলকবিহীন মানুষটিকে দেখছে।লজ্জা সেটা তো দূরের বিষয়।
“কবীর শাহ।আমাদের সম্পর্কটা কী নো ং রা?”
“দিশার কথাগুলো এখনও ভাবছো?”
তোশা সোজা হয়ে একটু দূরে সরে গেলো।আঁচলটা টেনে বলল,
“ভাবার বিষয় নয় কী?কিন্তু নো ং রা তো সেই সব সম্পর্ক যেখানে কাওকে ঠকানো হয়।আমরা কাওকে ঠকাচ্ছি না।হয়তো আপনি আমার বাবা-মায়ের বন্ধু।বয়সে বড়।কিন্তু কী বলেন?ভালো আপনাকে লাগে।শান্তি আপনাকেই লাগে।অথচ সকলে বলে বদলে যাবো।এইযে অনুভূতি।সব শেষ হয়ে যাওয়া এতো সহজ?”
কবীর তোশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বড়দের মতোন কথা বলো না।তোমাকে ছোটখাটো পুতুল হিসেবে ভালো লাগে।চলো আজ রিক্সায় ঘুরবো আমরা।”
“শ্যুটিং আছে যে।”
“ওটা আজ হবেনা।আমি না করে দিবো।এই শাড়ীতেই চলো।”
“আপনি এতো ব্যস্ত।তাও কেন রোজ আমার জন্য সময় বের করেন?ভালোবাসেন এজন্যই তো।আমার জায়গায় অন্য কাওকে নিয়ে আসতে পারবেন?”
“সম্ভব না।এসব ভাবতে হবেনা।আমি ভবিষ্যতের সব ঝড় দেখবো।”
“তাহলে আমাদের সম্পর্ক নো ং রা না।হ্যাঁ ঠিক নো ং রা না।”
তোশা বারংবার কথাটি বলছে।কবীরের বড় মায়া হলো মেয়েটিকে দেখে।কাওকে পছন্দ করে নিজের করতে চাওয়ার মধ্যে হয়তো কোনো নোং’রামি নেই।দুটো মানুষ অসম ভালোবাসাতে জড়িয়ে গিয়েছে।একে অপরের সঙ্গে একটু ভালো থাকা তাদেরও প্রাপ্য।এইযে রিক্সায় হাত ধরে বসে আছে দুজন।কয়েকজন ইতিমধ্যে বাঁকা দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে তাদের।কিন্তু এই কবীর-তোশা প্রেমিক যুগলের সেগুলোর জবাব দেওয়ার সময় আছে নাকী।
নাকে মিষ্টি রজনীগন্ধার সুগন্ধে চিন্তা থেকে ফিরলো কবীর।যুবতী তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।হাত বাড়িয়ে ফুলটিকে দুমড়েমুচড়ে কংক্রিটে রাস্তায় ফেলে দিয়ে স্বস্ত্বি ফিরলো তামাটে পুরুষটির।নিজের বেলাডোনার গায়ে অন্য কারো দেওয়া ফুলের টোকাও দিতে নারাজ সে।কবীরের মন হঠাৎ বলে উঠলো,
“বেলাডোনার প্রতি এতো ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে কীভাবে সে?এমন মায়াতে শেষ হওয়াও ভালো।”
চলবে।