#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৫
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আগের দিনে মেয়ে দেখাটা অন্যরকম ছিল।এখন তো বেশীরভাগ ছেলেদের মেয়ে পছন্দ করা থাকে।”
“তা ঠিক বলেছেন ভাই।এইযে আমার তাকে যখন দেখতে গেলাম তখন বড় করে ঘোমটা দিয়ে সামনে আনা হলো।আমার মা বারবার বলে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে।এদিকে লজ্জা করছে।তবুও খুব কষ্টে জিজ্ঞেস করেছিলাম বয়স কতো?তখন ছিল তার বারো বছর।আমার সাতাশ।এমনই পার্থক্যে তো বিয়ে হতো।”
নানার মুখে পাত্রী দেখতে যাওয়ার ঘটনা শুনে তোশার মনটা আরো ভেঙে গেলো।পূর্বে এতো বয়সের পার্থক্যে বিয়েটা সহজ থাকলে সে কেন সেই সময় জন্ম নিলো না?কবীর শাহ না হয় এভাবে তাকে দেখতে গিয়ে নিজের ঘরনি করে নিয়ে আসতো।হুহ,সব জায়গায় কেমন দুঃখের আবহাওয়া।
কলির বাবা নেয়ামতের সঙ্গে ইতিমধ্যে কবীরের বাবা সাহেদের বেশ ভাব জমে গিয়েছে।তাহিয়ার বাবাও এই দুজনকে বেশ সঙ্গ দিচ্ছে।আর যেসব নারীরা আছে তারা একপাশে বসে পুরুষদের আলোচনা শুনছে।পুরো ঘটনায় কেউ যদি নিরব থেকে থাকে তবে সে কবীর শাহ।এক মনে খেতে ব্যস্ত।তোশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহিয়া বলল,
“কী ব্যাপার তোশা মা?খিদে লাগেনি?এখানে এসে খেয়ে নাও।”
“কিন্তু আম্মু।”
তাহিয়া তোশার গড়িমসি বুঝতে পারলো।কবীরের পাশের চেয়ার ব্যতীত আর কোনো চেয়ার খালি নেই।
“সমস্যা নেই তোশামণি।কবীরের পাশে এসে বসো।আমি তোমাকে খেতে সাহায্য করছি।”
তোশা একটু হেঁটে কবীরের পাশে এসে বসলো।আনমনে দুজনের হাঁটুর ঠোকাঠুকি হলো।তোশার পুরো শরীর জুড়ে যেন বিদ্যুৎের ছুটোছুটি চলছে।ব্যক্তিটার সংস্পর্শে এলে এমন সহ্যহীন অনুভূতি হয় কেন?কবীরের অভিব্যক্তি বোঝা গেলো না।সে নিজ ছন্দে খেতে ব্যস্ত।তাহিয়া নিজ প্লেট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে কবীর বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমি ওকে সাহায্য করছি তাহিয়া।বসো ওখানে।”
“সমস্যা নেই কবীর।ওর শুধু মাছটা খেতে সমস্যা।”
“আমি পারবো বসো ওখানে।”
কবীরের ধীর স্থির কণ্ঠে তোশার অভিমান যেন আরো বৃদ্ধি পেলো।লোকটা তাকে দয়া দেখাচ্ছে?বিষয়টা বুঝতে পেরে মাছটা প্লেটে অবধি তুললো না তোশা।উল্টো মাংস নিয়ে ধীরে ধীরে খেতে লাগলো।হুট করে নিজ প্লেট থেকে কাঁটা ছাড়ানো মাছ কবীর তোশার প্লেটে তুলে দিলো।ছোট্ট করে বলল,
“খেয়ে দেখো।ভালো লাগবে।”
“দয়া?”
“ধরে নাও তাই।”
সবকিছু ভেঙে কান্না পাওয়ার অনুভূতিটা ফিরে এলো তোশার মনে।সে এতোটাও বাচ্চা নয়।মায়ের চিন্তা, ভালোবাসা সে বুঝে।কিন্তু কবীরের এরকম খেয়াল রাখার মানে কী?শুধু সৌজন্যেবোধ?হয়তোবা তাই।
(***)
কবীর ও কলির বিয়ে ঠিক হয়েছে।গত তিনদিন ধরে যতোবার কথাটি মনে হয় তোশার ততোবার বেঁচে থাকার শক্তি সে হারিয়ে ফেলছে।সর্বদা বুকের ভেতর কেমন জ্ব লে পু ড়ে যায়।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে।খাওয়ার রুচিটাও কমছে।মেয়ের এরকম অবস্থা দেখে তাহিয়া ভীষণ চিন্তিত।এই কারণে আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে।
“বেশী কিছু নয়।সাধারণ ভিটামিনের অভাব দেখা দিয়েছে শরীরে।খাওয়া দাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে।তাছাড়া ওর উঠতি বয়স।এখন মন মস্তিস্কের রুপ কতোভাবে বদলাবে।”
“এমনি সমস্যা নেই তো ডক্টর?”
“নাহ।আমি ভিটামিন লিখে দিচ্ছি।তোশা ঠিকমতো খেও কেমন।”
হাসিমুখে মাথা দুলালো তোশা।শরীরের ডাক্তার কী জানবে মনে কী চলে?তাহিয়া তোশার হাতখানা ধরে বাহিরে বের হয়ে এলো।
“আম্মু তোমাকে এই হসপিটালের লোকগুলো চিনে কীভাবে?সবাই বেশ পরিচিত দেখছি।”
“কারণ কলির অপারেশনের সময় এসেছিলাম অনেকবার তাই।”
“কলি আন্টির অপারেশন?কী হয়েছিল তার?”
“জরায়ুতে টিউমার।সেটা কেঁ টে ফেলে দিয়েছে।”
থেমে গেলো তোশা।চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো তার।উত্তেজিত কণ্ঠে সে মায়ের উদ্দেশ্যে শুধালো,
“তাহলে সে মা হবে কীভাবে?বিয়ে কেন ঠিক করলে তোমরা?”
“বিষয়টা কবীরের পরিবার জানে।”
“তবুও তারা মেনে নিলো?কেন?”
“কারণ কবীরের আর বাচ্চা না হলেও ভালো হবে।যেহেতু একজন ছেলে আছে।”
তোশা শুকনো ঢোক গিললো।কম্পিত কণ্ঠে শুধালো,
“কার ছেলে আছে?”
“কবীরের।তুমি হয়তো ছোট শাহ কে এখনো দেখেনি।বাচ্চাটা বেশ চুপচাপ।”
“তিনি বিবাহিত?তার স্ত্রী কোথায়?”
“ডিভোর্স হয়েছে।”
তোশা এগুনোর শক্তিটুকু পাচ্ছে না।কবীর বিবাহিত ছিল সে কোনোদিনও সেটা শুনেনি।এমনকী একটা ছেলেও আছে?তোশার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।মাথায় তীব্র ব্যাথা শুরু হলো।চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হওয়ার পূর্বে নিচে বসে পড়লো সে।তাহিয়া পিছন ফিরে মেয়ের এই দশা দেখে ছুটে গেলো।
“কী হলো তোশামণি?খুব খারাপ লাগছে?”
“আম্মু আমার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে।”
অন্যকিছু বলার পূর্বে পুরোপুরি জ্ঞান হারালো তোশা।
(***)
“ও জ্ঞান হারালো কেন?কোনো গুরুতর সমস্যা?”
“কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো না খেয়েছে,না ঘুমিয়েছে।আমি এজন্য ডাক্তারের কাছে এনেছিলাম।”
কবীর ঘুমন্ত তোশার দিকে তাঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।কিছু বিষয় এখন মটেও আবেগ,বয়সের দোষ মনে হচ্ছে না।যা তার তামাটে কপালের রেখার সৃষ্টি করলো।মেয়েটা যদি সত্যিই তাকে ভালোবাসে?ছোট বয়সে কী না পাওয়ার ধাক্কা সামলাতে পারবে?মেয়ের এমন দশাতে তাহিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গিয়েছে।বাড়ীর সকলে দেখতে এসে ফিরে গিয়েছে দশ মিনিট হলো।
“তাহিয়া তুমি ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে নাও।ভালো লাগবে।মেয়ের টেনশন নিওনা।”
“গলা দিয়ে নামবেনা।”
“রিলাক্স তাহিয়া কিছুই হয়নি।যাও তুমি।”
সত্যিই তাহিয়ার একটু নির্জনতা প্রয়োজন ছিল।অন্তত মেয়ের জন্য ঠিকঠাক সুস্থতা কামনা করতেও।সে বাহিরে চলে গেলে তোশার পাশে এসে বসলো কবীর।আলতো হাতে কপালের চুলগুলো এলেমেলো করে দিলো।ধীর কণ্ঠে বলল,
“এতো ভালোবাসা নিয়ে কেন আগে এলে না বেলাডোনা(অর্থ সুন্দর নারী)?বয়স কমানোর মন্ত্র তো জানা নেই।তাছাড়া আমি জীবনে অনেক এগিয়ে গিয়েছি।ছেলে আছে।বিবাহিত ছিলাম।তবে তোমার মতোন সতেজ ফুলকে রোদে পুড়ে যাওয়া পাথরটি কীভাবে আগলে নেয় বলো তো।”
জীবনের সবথেকে সাহসী কাজটা হয়তো আজ করলো কবীর।ঘুমন্ত তোশার হাতের পিঠে আস্তে করে চুমো খেলো।সে জানে এটা কেউ জানলে ছি: ছি: এর বন্যা বয়ে যাবে।তবে সে কামনা নিয়ে এই স্পর্শ করেনি।ব্যস তাকে যে রমণী এতো ভালোবাসে সেই রমণীকে মনের ভেতর থেকে মায়া দেখিয়ে স্পর্শ করেছে।যা কখনো কেউ জানবেনা।স্বয়ং ঘুমন্ত সতেজ ফুলটিও না।
চলবে।
#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৬
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আমি খুব ঘেমে গিয়েছি তোশামণি।লজ্জা লাগছে।”
“কল্লোল ভাইয়া লজ্জা পাও কেন?সকলে তোমার পোশাক দেখে বুঝবে যে খেলার মাঠ থেকে দৌড়ে এসেছো।তোমার ছোট মাথা এটা বুঝলো না?”
কল্লোল চোখ দুটো ছোট ছোট করে তোশার পানে তাঁকালো।চশমার আড়ালে অবশ্য সেটা বোঝা গেলো না।তার থেকে বয়সে ছোট হয়ে কীনা মেয়েটি বলছে ছোট মাথা?
“এখন কেমন আছো তোশা?ধরো এটা তোমার জন্য।”
“চকলেট কেন?”
“হসপিটালে রোগী দেখতে এলে কিছু একটা নিয়ে আসতে হয়।তুমি তো বাড়ীতেই চলে যাবে একটু পরে।সেজন্য কী নিয়ে আসবো ভাবছিলাম।”
উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো তোশা।মনোমুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য গ্রহণ করলো কল্লোল।এই হাসির অনুরূপ ছন্দ আজকেই খুঁজে বের করবে সে।
“রোগীকে দেখতে কেউ চকলেট নিয়ে আসেনা।যাই হোক আম্মু কোথায় গেলো?”
“ডক্টরের কাছে হয়তো।আমার হাসপাতালে এলে কেমন যেন লাগে?নিজেও তো একদিন ডক্টর হবো তাইনা?”
“হবে তো।আমি বিজনেস করবো।কবীর শাহ এর সাথে প্রতিযোগীতা করে।”
“কবীর আঙকেল?আচ্ছা তাকে তো দেখলাম।”
মুখের রঙ আরো কয়েক ধাপ ঘোলা করে তোশামণি জবাব দিলো,
“সে তো সব জায়গায় আছে।”
(***)
মায়ান একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে।তাহিয়ার সামনে রিসিভ করতে কেমন বিব্রোতবোধ হচ্ছে কবীরের।তার ভুল সে যদি তোশার ব্যাপারটি না জানাতো তবে এমন কল করতো না।এদিকে তাহিয়ার ফোনে কল করার সাহস মায়ানের নেই।তাহিয় আড়চোখে স্ক্রিনে ভেসে উঠা বিদেশি নাম্বারটি দেখে শুধালো,
“মায়ান এতো কল করছে কেন কবীর?তোশার ব্যাপার বলেছো?”
“হ্যাঁ।এখানে আসার আগে বলেছি।”
“ওহ।দেখবে বলবে যে তাহিয়া একজন কে য়া র লে স মাদার।আমি সত্যি বুঝিনি তোশার শরীরটা এমন হয়ে যাবে।”
“বলবেনা।ও জানে তুমি কীভাবে আগলে রেখেছো মেয়েকে।তেমন কিছু হয়নি।শুধু একটু হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করো মেয়েকে।”
তাহিয়া কিছু একটা নিয়ে প্রচন্ড উশখুশ করছে।যেন না বলতে পারলে শান্তি মিলছেনা।কপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো টিস্যু দিয়ে মুছে নিলো।এখনও বেশ সুন্দর দেখা যায় তাকে।কবীর অবশ্য বিষয়টি বুঝতে পেরে শুধালো,
“কিছু বলবে তাহিয়া?”
“হ্যাঁ।ভুলভাবে নিওনা।এতো দামী গিফট তোশাকে কেন দিয়েছিলে?বিষয়টি আমাকে খুব বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল।”
কবীরের ভেতর থেকে উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো,
“লকেটটিতে ওকে খুব সুন্দর মানাতো এজন্য দেওয়া।তুমি রাখতে দিও তোশাকে।”
“কিন্তু তাও।আচ্ছা ওটা তো মায়ান দেয়নি?”
“মেয়েকে কিছু দিতে মায়ানের কখনো আমার বাহানা লাগবেনা তাহিয়া।”
হাঁটতে হাঁটতে তারা কেবিনের কাছে এসে পড়েছে।এমন সময় তোশার হাসিমাখা মুখটা দরজার কাছ থেকে কবীরের দর্শন হলো।শত শত জলকণা সমেত সমীরণ যেন কবীরকে স্পর্শ করে গেলো।একটি হাসিতে এতোটা মুগ্ধতা লুকিয়ে থাকতে পারে?উহু,লুকিয়ে কোথায়?ওইযে প্রকাশে আছে।যে কেউ মনোযোগ দিলে মুগ্ধ হতে বাধ্য।কবীরের মনে যখন শান্তির বাতাস বয়ে যায় তখন সামনে বসে থাকা কিশোরীর মনে দুঃখ
অগ্ন্যুৎপাতকালে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত গলিত প্রস্তরাদির মতোন গড়িয়ে পড়তে থাকে।
“তোশামণি চলো।এখন আমাদের বাড়ী যাওয়ার সময়।কল্লোল ওকে উঠতে সাহায্য করো তো।”
কল্লোলের পূর্বে কবীর তোশার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো।কিন্তু মেয়েটি পুরোদস্তুর তামাটে পুরুষটিকে উপেক্ষা করে কল্লোলের হাত ধরলো।তাহিয়া জিনিস পত্র নিয়ে তোশার আরেক পাশে ধরে তাকে বেড থেকে নামিয়ে দিলো।কবীর এখনও বিষয়টি হজম করতে ব্যস্ত।
“কবীর তুমি একটু তোশাকে ধরবে?আমি গাড়ীটা পার্কিং এড়িয়া থেকে বের করে আনতাম।”
জবাব না দিয়ে তোশাকে এক হাত দিয়ে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো কবীর।ফলস্বরুপ কল্লোলকে হাত ছাড়তে হলো।
“তুমি যাও তাহিয়া।আমি নিয়ে আসছি ওকে।কল্লোল তোমারও স্পোর্টস ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে।এগিয়ে যাও।”
কল্লোল মাথা দুলিয়ে এগিয়ে গেলো।এরকম নির্জনতার অপেক্ষায় ছিল কবীর।তোশাকে গম্ভীর সুরে বলল,
“হাত ধরতে কী সমস্যা ছিল?কল্লোলের সামনে বিষয়টি কেমন হলো না?”
“আপনি বিবাহিত?”
“এটা আমার প্রশ্নের জবাব হলো না।আমি বিবাহিত এটা আজ জানলে নাকী?”
প্রশ্নটি করে নিজেই থমকে গেলো কবীর।খানিকটা হতবিহ্বল কণ্ঠে শুধালো,
“আমার ডিভোর্স হয়েছে।ছেলে আছে বিষয়টা তুমি এতোদিন জানতেনা তোশা?”
“যদি বলি না।”
“আজ জানলে?”
“হ্যাঁ।”
কবীর পূর্বের সবকিছু মনে করলো।এতোদিন যে ভালোবাসা নিয়ে কথা হতো সেখানে ছেলে সমন্ধে একটি প্রশ্নও তোশা করেনি।এমন নয় বিষয়টি প্রথম মাথায় এলো
পূর্বেও এসেছে।কিন্তু সত্যি যে তোশা এতো বড় কিছু জানবেনা তা বুঝতে পারেনি।মলিন হাসলো কবীর।
“আমাকে এখন ঘৃ ণা করছো তাইনা তোশামণি?বিশ্বাস করো বুঝিনি যে এতো বড় বিষয়টি জানবেনা।এ কারণে তখন হাত ধরলেনা?”
তোশা কিছু বলল না।লিফটের ভেতর ঢুকে যেতে হলো তাদের।আশেপাশে আরো মানুষ থাকায় কবীর একটি কথাও বলেনি।কিন্তু পুনরায় নির্জনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেকি দাম্ভিক সুরে বলল,
“দেখলে আমি যে তোমার অনুভূতিকে মোহ,মায়া এবং আবেগের নাম দিতাম।কতোটা সত্য ছিল না।তুমি আমাকে ভালোবাসোনি।”
তোশা পূূর্বের মতোন নিশ্চুপ হয়ে থাকলেও এবার কবীরকে দেখলো।ব্যক্তিটা খুব লম্বা।তবুও তোশা মাথা এলিয়ে নাক টেনে কবীরের শরীরের ঘ্রাণ নিলো।গাড়ীর কাছে পৌঁছানো অবধি দুটো প্রাণ আর কোনো বাক্য বিনিময় করলো না।
(***)
ঘড়িতে এখন দুপুর তিনটে বেজে বিশ মিনিট।ভীষণ ক্লান্ত অনুভব হচ্ছে কবীরের।অথচ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং আছে।গতকাল থেকে মনটায় খড়া নেমেছে তার।কবীর নিজের সঙ্গে অভিনয় করেনা।সে জানে তোশার প্রতি পূর্বে ভালো লাগা থাকলেও এখন সেটা রুপ বদলে যাচ্ছে।একসময় নিজে অস্বীকার করলেও এখন মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে সে নিজ থেকে বিশ বছরের ছোট মেয়ের মায়াতে জড়িয়েছে।এই কারণেও বিয়েতে হ্যাঁ বলেছিল।সেদিন থেকে যা খারাপ লাগা ছিল মনের ভেতর তা গতকাল বৃদ্ধি পেয়েছে তোশার অবজ্ঞাতে।অবশ্য যা হওয়ার ঠিক হয়েছে।
“স্যার আপনি তো লাঞ্চ করলেন না।মিটিংটা শুরু করবো কখন?”
কবীরের এসিস্ট্যান্ট নাহিদ দরজার বাহির থেকে কথাটি শুধালো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে কবীর জবাব দিলো,
“এখুনি শুরু করবো।”
“জি স্যার।”
নাহিদ ফিরে যাওয়ার আগে কিছু একটা মনে হতে থেমে গেলো।পুনরায় বলল,
“স্যার একটি মেয়ে এসেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে।সম্ভবত কোথাও দেখেছি তাকে।”
কবীরের ভেতর এলেমেলোভাবে আন্দোলিত হয়ে উঠলো।সে সোজা হয়ে বসে বলল,
“নিজের নামটা কী বলেছে সে?”
“তোশা।”
“সে কোথায় এখন?”
“আপনি ব্যস্ত ছিলেন দেখে রিসিপশনে বসিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু সবেমাত্র বের হয়ে গেলো।”
কবীর একটুও অপেক্ষা করলো না।তৎক্ষনাৎ ফোনটা টেবিল থেকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।
“নাহিদ মিটিংটা দুই ঘন্টা পরে হবে।”
হন্তদন্ত হয়ে বাহিরে বের হয়ে এলো কবীর।এপাশ ওপাশে দেখলো কোথাও তোশা আছে কীনা।তার এই অফিস এড়িয়াটি খুব বড়।চারিধার পরিষ্কার বাতাবরণ।লাঞ্চ টাইম শেষ হওয়ায় বাহিরে দারোয়ানরা ব্যতীত কেউ নেই।দূরে এক জায়গায় ছিমছাম শরীরে মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো কবীর।কিশোরী মেয়েটির বাহু শক্ত করে ধরতে সময় লাগলো না।
“তোশা তুমি এখানে কেন?”
“আপনি না ব্যস্ত ছিলেন শুনলাম।”
“তোমার আগে কোনো ব্যস্ততা নেই।আমাকে না বলে চলে যাচ্ছিলে কেন?”
কবীর হয়তো খেয়াল করেনি সে কী বলে ফেলেছে।কিন্তু তোশার ঠোঁট দুটোর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হলো।এইযে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অফ হোয়াইট রঙের স্যুট পরনে পরিপাটি পুরুষটি কী এই মাত্র সবকিছুর উপরে তাকে রাখলো?পুরুষটির গা থেকে আসা মন মাতানো সুগন্ধে মনটা ভরে গেলো তার।এগিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো।
“একটু নিচু হবেন কবীর শাহ?আপনি অনেক লম্বা।”
“কেন বলো তো।”
“হোন না নিচু।”
কবীর কথামতোন নিচু হলো খানিকটা।তোশা নিবারণ হাতের ত্বকের সাহায্য তামাটে পুরুষটির কপালের ঘাম মুছে দিলো।নরম তুলতুলের হাতের ছোঁয়ায় কবীরের সবকিছু ভুলে যাওয়ার মতোন অবস্থা।তোশা সবথেকে সুন্দর হাসিটি দিয়ে বলল,
“আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এলাম।নতুন করে পরিচিত হবো দুজনে।”
চলবে।
#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৭
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“বন্ধুত্ব কী সমান সমান বয়সে হয়না?আমি তোমার অনেক বড় তোশামণি।সেটা কেন ভুলে যাও?”
“আপনার সঙ্গে প্রেম করা যাবেনা,বন্ধুত্ব করা যাবেনা।এটা যাবেনা,ওটা যাবেনা।তো করবো কী আমি বলেন?নিষ্ঠুর লোক।”
“এভাবে থাকো।কথা বলো। কয়দিন পর কলির সঙ্গে বিয়ে হলে..।”
কবীর কথাটি সম্পূর্ণ করার পূর্বে অসহায় চোখে তার পানে তাঁকালো তোশা।কয়দিন ধরে ঠিকমতো না খাওয়ার দরুণ ছোট মেয়েটি আরো শুকিয়ে গিয়েছে।কবীর উষ্ণ শ্বাস ফেললো।মেয়েটির কাছে যদি এসব আবেগ হয়েও থাকে তবে তার কাছে তো তা হবেনা।বরং অনুভূতি তীব্র দ ং শ নে সে শেষ হয়ে যাবে।তোশা খুব নিষ্প্রাণ গলায় শুধালো,
“বন্ধুত্বও করবেন না?”
“খাবার ঠান্ডা হচ্ছে খেয়ে নাও।”
“ইশ,খাওয়ার জন্য মনে হয় শেষ হয়ে যাচ্ছি।ভাতের অভাব আছে তো আমার।”
তামাটে পুরুষটি পুরোদস্তুর অবাক হয়ে গেলো।মেয়েটি যেন চোখের সামনে বড় হচ্ছে সঙ্গে কথার খই ফুটতে শুরু হয়েছে।অগত্যা কবীর তোশাকে চেয়ার টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো।একটি প্লেটে খাবার নিয়ে চামচ দিয়ে তা তোশার সামনে তুলে ধরলো,
“শুধু বড় বড় কথা মুখে।”
“বলেন না বন্ধুত্ব করবেন কীনা।”
“করবো।ধরো খেয়ে নাও।”
তোশা খুশিমনে কবীরের হাত থেকে খেয়ে নিলো।এমন সময় তার স্বপ্ন পুরুষটি প্রচন্ড রকমের আজব কাজ করে বসলো।নিজেও একই চামচ দিয়ে খাবার খেলো।এটা কী নেহাৎ অবচেতন মনের কাজ?
“তোশামণি আজ কী বলে বাড়ী থেকে বের হলে?তোমার আম্মু বের হতে দিলো?তাও এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে?”
“আজকেও বলেছি ফ্রেন্ডরা কেএফসিতে যাবো।”
“বুঝিনা তোমরা টিনেজাররা এতো টাকা কোথায় পাও।আমাদের সময় তো মা-বাবা ঘুরতে গেলে টাকা দিতে চাইতো না।পুরো সপ্তাহ জমিয়ে এরপর চিড়িয়াখানায় যেতাম।খাওয়া বলতে ওইযে বাদাম।”
“আপনার-আমার পুরো একটা জেনারেশন গ্যাপ তাইনা?”
“যাক অবশেষে বুঝলে তো।”
“কিন্তু একটা ব্যাপারে আপনাকে একটু শুধরে দিতে চাই আমি।আমার ফ্রেন্ডরা সত্যি কেএফসি তে এখন।ওদের পুরো খরচ আমি দিয়ে দেই।”
“তুমি এতো পাও কোথায়?”
“আমিও টাকা জমাতে জানি।হুহ কী মনে করেছেন?”
কবীর সরু চোখে কিশোরীকে দেখলো।মেয়েটা উচিতের চেয়ে বেশী চঞ্চল।কিন্তু ছদ্মবেশ ধরে থাকে।তোশার এতো কাছে বসে থাকা কবীরের মনে ঝড় সৃষ্টি করেছে।সে কখনো ভাবেনি সাধারণ বাচ্চার প্রতি অনুরাগ তৈরী হবে তার।কবীর জানে এখন চিন্তাধারা অনেক দূরে চলে যাবে।মেয়েটার সান্নিধ্য আরো কামনা করবে মন।
“লিটল চেরি এখন কেমন বোধ করছো?শরীর সুস্থ তো?”
“আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম আপনার বিয়ে ও ছেলে আছে সেই কথাটি শুনে।”
খুব সহজ সরল স্বীকারোক্তি তোশার।কণ্ঠসুরে তীব্র অভিমানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।পাশে বসে থাকা বৃহদাকার কবীর শাহ এর দৃঢ় শক্ত হাতকে আঁকড়ে ধরে বলল,
“আপনি বিয়ে কেন করেছিলেন?আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না।”
“মানে?”
“বিয়ে কেন করলেন?আমার জন্য অপেক্ষা করতেন।আবার একটা বাবুও আছে।বয়স কতো ওর?দেখতে কেমন?আমাকে মা বলবে তো?”
” লিটল চেরি তুমি আবার ভুলভাল বকে চলেছো।কলির সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
“হবেনা বিয়ে।”
কবীরের কপালে কয়েকটি ভাঁজ পড়লো।সে একটু কেশে বলল,
“কিছু করেছো তুমি?”
“আরে না।মন বলছে আমার।”
‘হায়রে মন।কতো কথা বলে।এখন তাড়াতাড়ি শেষ করেন খাবার।”
“খাচ্ছি তো।জবাব দিলেন না যে বিয়ে কেন করলেন?আবার ডিভোর্স কেন হলো?”
“সেটা জানা তোমার জন্য জরুরি নয়।”
“বলতে হবে।”
“তুমি একটু বেশী বাচ্চামো করছো না?আমি বা কেন শুনে যাচ্ছি।”
“ইশ, আমার মনের মতোন আপনি অনেক কথা বলেন।বিয়ে কেন ভাঙলো?একটা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না।”
“তোতাপাখি চুপ।এতো কথা বলো না।”
“আপনি জবাবগুলো দেন।”
কবীর দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।কিশোরী বয়সী মেয়েরা এমনিতে চঞ্চল হয়।তাছাড়া মানুষ যার প্রতি আসক্ত থাকে তার সংস্পর্শে এলে আরো বেশী প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠে।
“বিয়ের বয়স হলো তাই করেছিলাম।”
“প্রেম করেছিলেন?”
“আমি,তাহিয়া,মায়ান ও…।”
নামটা বলতে গিয়ে কবীর নিশ্চুপ হয়ে গেলো।তোশার ক্লাস টিচার দিশা।এমনিতে বাচ্চা মেয়েটি আবেগপ্রবণ।জানলে কিছু না কিছু বেফাঁস বলে বা করে ফেলবে।এই কারণে নিশ্চুপ থেকে দিশার অন্য নাম নিলো।
“টগর একই কলেজে পড়তাম।ক্লাসমেট ছিলাম এই কারণে কিছুটা প্রেমের বিয়ে।দ্বিতীয়বার লন্ডনে যাওয়ার আগে বিয়ে হয়।এরপর কয়েকদিন পর ছেলে জন্ম নেয়।সব ঠিক ছিল।কিন্তু ও বদলে যাওয়া শুরু করলো।আমিও ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।একসময় ও ছেলের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করলো।শেষে ঝগড়া গুলো বিচ্ছেদের রুপ নিলো।
” ভালো হয়েছে।তাহলে আপনার স্ত্রীকে আম্মু চিনে?”
“চিনে।এই ব্যাপারে কথা বাদ।আমার চলে যেতে হবে।মিটিং আছে তো।”
“জি।”
তোশা মাথা দুলিয়ে প্লেটের খাবারটা শেষ করলো।কবীর মেয়েটিকে একদম বাচ্চার মতোন সামলে রাখছে।মায়া,অনুভূতি তো তৈরী হয়েই গিয়েছে।
“কবীর শাহ শুনেন।”
“জি বলেন।”
তোশা একটু ইতস্তত করলো।এরপর আস্তে করে কবীরের কাঁধে মাথা রাখলো।গম্ভীর শ্বাস নিয়ে বলল,
“ভালোবাসি আপনাকে কবীর শাহ।খুব খুব।আমার বয়স, সন্তান থাকা কিংবা ডিভোর্স হওয়া নিয়ে কোনো কিছুতে অভিযোগ নেই।আবেগ বলবেন না অনুভূতিকে।”
“আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরো কোন অধিকারে?”
“তোশামণির নিজস্ব অধিকার আছে কবীর শাহ এর প্রতি।”
“আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে লিটল চেরি।”
দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তোশা।কিছু বলতে যাবে এর পূর্বে পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,
“তুমি এখানে কী করছো তোশা?”
চমকে পাশ ফিরে তাঁকালো তোশা।মুখে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে বলল,
“দিশা ম্যাম আপনি?”
চলবে।