#মায়ার_বাঁধন
#পর্ব-৫(শেষ)
#আমিনুর রহমান
অর্পিতা আসার পর থেকেই অয়নকে নিয়ে আমার চিন্তাটা অনেক কমে এসেছে এই জিনিসটাতে বাবা মা অনেক খুশি হয়েছেন। প্রতিটা বাবা মাই তাঁর সন্তানকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে চায়। আমি যেমন আমার ছেলেকে সবসময় হাসতে দেখতে চাই আমার বাবাও তেমনি সবসময় আমার চোখেমুখে আনন্দ দেখতে চায়। অয়ন এখন কথা বলতে শিখে গিয়েছে। কয়মাস হবে অর্পিত অয়নের দায়িত্ব নিয়েছে? বেশিদিন তো হয়নি। এই কয়েক মাসেই অয়ন অর্পিতা মা হিসেবে মেনে নিয়েছে। অয়নতো জানে না যে তাঁর আসল মা কে? যার কাছ থেকে মায়ের আদর পাবে তাকেই তো মা হিসেবে মেনে নিতে বাঁধ্য সে। অয়ন যখন অর্পিতাকে মা বলে ডাকে তখন অর্পিতাও অনেক খুশি হয়। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে এই দুজন মানুষের ভালো লাগার মুহূর্ত গুলো দেখি আর আফসোস করি। এভাবেই যদি অর্পিতা অয়নকে সবসময়ের জন্য মায়ের আদর দিতো তাহলে কতোই না সুখের হতো আমার পৃথিবীটা। জানি না কতোদিন এভাবে অর্পিতা তাঁর দায়িত্ব পালন করবে। চাকরি দেওয়ার সময় শর্ত ছিলো অয়ন যখন বুঝতে শিখবে তখন তাকে সত্যটা বলে দিবো। তখন অর্পিতা চলে গেলে তাকে আটকাবো না। অয়ন যখন জানতে পারবে অর্পিতা তাঁর আপন মা না,তাঁ আপন মা তাকে এক বছর বয়সে ছেড়ে চলে গিয়েছে তখন অয়নের ভিতরটাতে কি হবে এটা মনে হতেই বুকের ভিতর এক অসহ্য ব্যথা অনুভব করি। তবে সস্তির বিষয় এটাই অয়ন তখন বড় হবে,সব বুঝবে। তাই সে বাস্তবতাকে মেনে নিবে কষ্ট হলেও।
দুইমাস পর,
আমি আমার কাছের একজন মানুষকে অর্পিতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিলাম,সে খোঁজ নিয়েছেও। ততদিনে অনিমা ঢাকায় চলে এসেছে। যখন আমি অর্পিতা সম্পর্কে জানলাম তখন নিজের অজান্তেই তাঁর জন্য খারাপ লাগতে লাগলো,চোখের এককোণে জল জমে গেলো।
অর্পিতা খুব গরিব ঘরের মেয়ে ছিলো। সে যখন অনেক ছোট ঠিক তখনই তাঁর বাবা মা তাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায়। সে তাঁর মামার কাছেই বড় হয়েছে। অনেক অভাব অনটন তাকে সহ্য করতে হয়েছে। অর্পিতা তাঁর মামার মেয়ের থেকে একটু সুন্দর ছিলো যে কারণেই তাঁর মামী তাকে খুব খারাপ চোখে দেখতো,ভালোবাসতো না। তবে তাঁর মামা তাকে অনেক ভালোবাসতো। একসময় সে বড় হলো। সে যখন কলেজে পড়ে তখন একটা ছেলের সাথে তাঁর রিলেশন হয়ে যায়। ছেলেটার যেহেতু কোনো টাকা পয়সার অভাব ছিলো না তাই অর্পিতা সহজেই তাঁর সাথে জড়িয়ে পড়ে। কারণ অর্পিতা তখন বিশ্বাস করতো টাকার চেয়ে এই দুনিয়ায় বড় কিছু নাই। তাই সে যখন দেখলো এতো ধনী পরিবারের একটা ছেলে তাকে ভালোবাসতে চাইছে তখন সে না করলো না। কারণ সেও একটু বিলাসিতা চায়।
অর্পিতা ছেলেটার প্রতি এতোই দুর্বল ছিলো যে, সে যখন যা বলতো অর্পিতা তাই করতো। হঠাৎ করেই ছেলেটা অর্পিতার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য উঠে পড়তে লাগলো। তবে এই বিষয়টাতে অর্পিতা খুব শক্ত ছিলো। তাই সে রাজী হলো না এবং বলল যা হবে সব বিয়ের পরে, বিয়ের আগে এসব করা যাবে না। অর্পিতাকে যখন ছেলেটা গোপনে বিয়ে করলো তখন আর অর্পিতার কোনো সংশয় থাকলো না। সে ছেলেটার মন রক্ষার জন্য ফিজিক্যালি রিলেশন করলো। অর্পিতা ভাবল বিয়ে যখন করেছি তখন এটা করায় যায়। তাই সে এতোকিছু ভাবলো না এটা নিয়ে। কিন্তু কয়েক মাস পর যখন সে বুঝতে পারলো সে মা হতে চলেছে তখন তাঁর খুশির সীমা রইলো না। কারণে জীবনে সে সন্তানের জননী হবে এর থেকে খুশির সংবাদ আর কি হতে পারে? কিন্তু এই সন্তানের বাবা কে এটাতো কেউ জানে না। সবাইকে তো জানাতে হবে। হাসানকে যখন সবকিছু বলল তখন হাসানের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। অর্পিতা হাসানকে চাপ দিতে লাগলে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা সবাইকে জানাতে, আর এদিকে হাসান অর্পিতাকে চাপ দিতে লাগলে সন্তানটা নষ্ট করার জন্য। অর্পিতা সফল না হলেও হাসান ঠিকই সফল হলো। অর্পিতাকে সে মেনে নিলো না বরং অর্পিতার পেটের বাচ্চাটাকে সে মেরে ফেলল। অথচ অর্পিতা নিজের সন্তানকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখেছিলো। হাসান যে অর্পিতাকে এভাবে ধোঁকা দিবে কখনো ভাবতে পারেনি। সেই থেকে মেয়েটা এমন হয়ে গেছে। অনেকেই জেনে গিয়েছিলো অর্পিতার বাচ্চা নষ্ট করার ব্যাপারটা। সো হাসানের কথা সবাইকে বলেছিলো কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি। আর হাসানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেনি। কারণ হাসানরা অনেক প্রভাবশালী, টাকা পয়সারও কোনো অভাব ছিলো না। অর্পিতাকে সবাই ঘৃণার চোখে দেখতে লাগলো। একসময় তাঁর মামীর ওপর বিরক্ত হয়ে তাঁর মা নিজেই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। এরপর কিছুদিন তাঁর খালার বাসায় ছিলো। সেখানেও সে খুব ভালো ছিলো না। কেউ তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে চায় না। ঠিক তখনই আমার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়।
অর্পিতার অতীতটা আমি কখনো নাড়া দিতে চাইনি। কিন্তু যখন তাঁর অতীত জানলাম তখন অনেক খারাপ লাগার মাঝেও ভালো লাগলো এটা ভেবে যে অর্পিতার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সে অয়নের কাছেই থেকে যাবে সবসময়ের জন্য,অয়নের মা হয়ে। অয়ন যেমন তাঁর হারানো মায়ের আদর পাবে অর্পিতাও তেমন তাঁর হারিয়ে যাওয়া অয়নকে পাবে।
অফিসে বসে অয়ন আর অর্পিতার কথা ভাবছিলাম। কেনো জানি অয়নের সাথে সাথেও অর্পিতা মেয়েটা নিয়েও ভাবতে অনেক ভালো লাগার কারণটা আমার কাছে অজানা। হঠাৎ করেই দেখলাম অনিমার মেসেজ। মেসেজ দেখে কিছুটা থমকে গেলাম। সে আমার অফিসের দ্বিতীয় তলায় বসে আসে। আমি তাঁর মেসেজ পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তাঁর সাথে দেখা করলাম। চেহারাটা আগের মতোই আছে তবে কিছুটা শুকিয়ে গেছে। অনেক সুন্দরও হয়েছে। তবে আমি সেদিকে নজর দিলাম না। প্রায় দেড় বছর পরে দেখা তাই ভদ্রতার খাতিরেই বলতে হলো।
“কেমন আছে?”
জবাবে অর্পিতা বলল,
“ভালো আছি। অয়ন কেমন অাছে?”
“ভালো আছে। কেনো এসেছে?”
“তুমি তো বলেছিলো ঢাকায় থেকে এক ছাদের নিচের চাকরি করলে তোমার কোনো সমস্যা হবে না। তাই আমি ট্রান্সফার হয়ে এখানে এসেছি। আমি আবার আমার সংসারটা ফিরে পেতে চাই।”
“চাইলেই কি সব ফিরে পাওয়া যায়? তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো। যেই সময়টাতে তোমাকে অনেক প্রয়োজন ছিলো সেই সময়টাতে তুমি আমার সঙ্গ দাওনি। যেই সময়টাতে আমার সন্তানের একজন মায়ের দরকার ছিলো সেই সময়টাতে তুমি তাঁর মা হয়েও তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। তখন আমার সন্তানের বয়স ছিলো মাত্র এক বছর। এখন তো আমার তোমাকে দরকার নেই। আমি তোমাকে ছাড়াই ভালো থাকতে শিখে গিয়েছি। আমার সন্তানেরও তোমাকে দরকার নেই।”
“তুমি তো বলেছিলে তোমার কাছে আসলে তুমি মেনে নিবে সেজন্যই তোমার কাছে এসেছি। আমি তো এখন তোমাদের সাথে থাকবো বলেই সব ভুলে তোমার কাছে এসেছি। আমি আমার ছেলেটাকে যে একটা বছর মায়ের আদর একটা বছর দিতে পারিনি সেটা এখন দিতে চাই।”
তখন বলেছিলাম কারণ পরিস্থিতি ভিন্ন ছিলো কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা আমার অনুকূলে। আর তুমি যে আরও বিলাসিতার জীবন যাপনের জন্য আমার কাছে আসোনি এটার কি গ্যারান্টি আছে? কারণ তুমি জানতে পেরেছো আমার বাবা আবার আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়েছে। আমার বাবার একমাত্র সন্তান আমিই। তুমি অভাবের দোহায় দিয়ে,নিজের ক্যারিয়ারের দোহায় দিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু যখনই জানতে পারলে চাকরি করে তুমি যেভাবে বেঁচে থাকতে পারবে তাঁর থেকে শতভাগ আরাম আয়েশে আমার কাছে বেঁচে থাকতে পারবে ঠিক তখনই তুমি চলে আসলে,বিষয়টা তো এমনও হতে পারে না? আর সবচেয়ে বড় কথা কি জানো? অয়ন তাঁর নতুন মা খুঁজে পেয়েছে। তুমি জন্ম দিয়েও অয়নের মা হতে পারোনি। কিন্তু কেউ একজন আছে যে মানুষটা জন্ম না দিয়েও অয়নের মা হয়ে উঠছে। অয়ন জানে না কে তাকে জন্ম দিয়েছে। বড় হয়ে যখন জানবে তুমি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তখন তোমার প্রতি ওর মনে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। আর আমি চাই না কোনো সন্তান তাঁর মাকে ঘৃণা করুক। আমি আমার সন্তানের জন্য মা পরিবর্তন করতে পারবো না। সে এখন যাকে মা হিসেবে জানবে,ভবিষ্যতেও সেই তাঁর মা থাকবে। আর ভুলেও কখনো আদালতের সাহায্য নিয়ে আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না,তুমি সফল হতে পারবে না। কারণ সবাই জানে তুমি তোমার সন্তানের সাথে কি করেছিলো। আর টাকার সাথেও পেরে উঠবে না। জানোই তো টাকার অনেক জোর,অন্তত এই সব কোটকাচারির বিষয়ে।”
অনিমা চলে যায়,তাঁর চোখের পানিটাও আমার সিদ্ধান্তটা বদলাদে পারেনি। সে যখন চলে যাচ্ছিলো তখন তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট অনুতাপ দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি জানি না তাঁর শেষ পরিণতি কি তবে। তবে আমার তাকে এভাবে দেখে খারাপ লাগছিলো। তবে সত্য এটাই আমি তাকে এর থেকে ভালোও দেখতে পারি না।
বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে মা আমাকে ডেকে নিয়ে বলল,
“তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। অনেক কষ্টে মেয়েটাকে রাজী করিয়েছি। মেয়েটা তোর ছেলেকে মেনে নিবে। এইবার কিন্তু আর না করতে পারবি না। মেয়েটাকে আমার আর তো বাবার অনেক পছন্দ হয়েছে।”
মায়ের কথাটা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। ঠিক তখনই মা আমাকে বলল,
“তোর জন্য কাকে পছন্দ করেছি সেটা না জেনেই এমন মুখ বানালি? অর্পিতাকে রাজী করিয়েছি। আমি আর তোর বাবা তোর অতীত সম্পর্কে সব বলেছি। আমরা তোকে সুখী দেখতে চাই। তুই যখন অয়ন আর অর্পিতাকে একসাথে খেলা করতে দেখিস তখন তোকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ মনে হয়। তাই মেয়েটাকে সারাজীবনের জন্য এই বাড়িতে রেখে দিতে চাই।”
আমি নিজের অজান্তেই মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা কানেকানে বলল,যা এবার মেয়েটার কাছে যা। গিয়ে একটু রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করো।
অর্পিতা অয়নের সাথে খুনসুটি করছিলো আমাকে দেখে কেনো জানি সে লজ্জা পেলো। এর আগে এমনটা হয়নি কখনো। আমি কোনোরকম ভনিতা না করে বললাম,
“বাবা মা কিছু বলেছে আপনাকে?”
“না তো কি বলবে?”
“কিছুই বলেনি?”
“না,শুধু বলল এই বাড়িতে সারাজীবনের জন্য থেকে যেতে।”
“আপনি কি বলেছেন?”
“আমিও হ্যাঁ বলে দিয়েছি। তবে আপনার জন্য শুধুমাত্র অয়নের জন্য।”
আমি চলে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই অর্পিতা বলল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“নিজের রুমে,ঘুমাবো।”
“যেতে হবে না,এখানেই ঘুমান। অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম,বাচ্চার দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছি,বাচ্চার বাপের দায়িত্বটাও নেওয়া উচিত। না হলে বাচ্চার বাপের সাথে অন্যায় করা হবে।”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা কি?”
“আপনার কথামতো এখানেই ঘুমাবো।”
“ঘুমান টুমান আর যাই করেন না কেনো আরেকটা বাচ্চা নেওয়ার কথা যেনো স্বপ্নেও ভাবেন না। তাহলে আমি চলে যাবো।”
আমি কিছু বললাম না,শুধু মুচকি হাসলাম। অনুভব করলাম আমার থেকে অয়নকে সে বেশি ভালোবাসে। আমি তাঁর পাশে গিয়ে তাঁর হাতে হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। আমি ব্যর্থ হলেও অর্পিতা ব্যর্থ হলো না সে ঠিকই আমার হাতে হাত রাখলো আর বলল।
“সমস্যা নেই,আমি ভালোবাসতে জানি।”
সমাপ্ত।