#মায়াদেবের_মায়া
#পর্ব_৭
#তাহমীম
মুনিয়া আহমেদ একটা শব্দ ও বের না করে নিঝুমকে হাত ধরে টেনে একটা রুমে নিয়ে যায় আর দরজা বন্ধ করে দেয়।
নিঝুম অবাক হয়ে
-” আম্মু কি হয়েছে এমন করছো কেন? আর দরজা বন্ধ করলে কেনো?
-” কেন এসেছিস এই খানে?
-” কি আজব আমার নানা বাড়িতে আমি আসতে পারবো না?
-” তোর দাদা আমায় সব বলেছে। তুই নাকি মায়াকে বলতে এসেছিস তুই তাকে ভালোবাসিস?
-” হ্যা আম্মু। কিন্তু……
-” তোর লজ্জা করলো না হ্যা বলতে? আমাকে কি কথা দিয়েছিলি ভুলে গেছিস? আমানের কি হবে একবার ভেবে দেখেছিস? ও যদি বুঝতো তাহলে আগেই বুঝতো সুইসাইড করতো না। আমার বড় ভাইটা মারা যাবে আমানের কিছু হলে। আমার এমন সুন্দর পরিবারটাকে নষ্ট করে দিস না। এখন সবার মুখে হাসি আছে। তুই মায়াকে এইসব বলার পর আর কিছুই ঠিক থাকবে না নিঝুম। তোকে আমি ত্যাগ শিখিয়েছি মানুষকে কষ্ট দিতে শিখায়নি।
নিঝুম তুচ্ছ একটা হাসি দিয়ে
-” আম্মু ত্যাগ করতে বলছো? নিজের প্রান ত্যাগ করে কেউ বাঁচতে পারে? মায়া তো আমার প্রান আম্মু। সেই ছোট্ট থেকে আমি ভালোবাসি মায়াকে। আমি তো তাও ত্যাগ করে দিলাম। তোমার কথায় আর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রানও ত্যাগ করে দিলাম আর কি চাও তুমি আম্মু? আর কি চায় সবাই আমার কাছ থেকে? আমার অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে আম্মু আর কেউ তা টের ও পাচ্ছে না। তারপর ও তুমি আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছো? হ্যা আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছিলাম মায়াকে সব বলে দিবো কিন্তু বলতে পারিনি। সবার মুখের দিকে তাকিয়েই বলতে পারিনি। তুমি নিশ্চিন্তেই থাকতে পারো আম্মু মায়াকে আমি আর কিছুই বলবো না । আমি চলে যাবো সবার থেকে দূরে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি আমি আমেরিকায় চলে যাবো।
নিঝুম আর কিছু বলার আগেই ঐশি শিকদার এসে দরজায় নক করে
-” আপা কি হয়েছে কোন সমস্যা?
মুনিয়া আহমেদ তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে
-” না ভাবি কোন সমস্যা না। নিঝুম বাড়িতে যা এলোমেলো করে এসেছে সব। তাই আরকি কিছু বাড়ির কথা বলছিলাম।
নিঝুম আর কিছু না বলে বেড়িয়ে যায় মায়াদের বাড়ি থেকে কান্না আসছে ভিষণ নিঝুমের কিন্তু ছেলেদের কাঁদা বারণ।
দুদিন হলো নিঝুম মায়াদের বাড়িতে আসছে না। মায়া অস্থির হয়ে আছে নিঝুমের জন্য। কালকে মায়ার গায়ে হলুদ আর আজকে সে অন্য একজনের জন্য অস্থির বিষয়টা সত্যিই কেমন কিন্তু মায়া আর পারছে না। মায়াদেব কি শেষ অব্দি বলবে না? মায়াকে সে ভালোবাসে!মায়া আর কিছু না ভেবে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে নিঝুমদের বাড়ির উদ্দেশ্য।
মায়া বসে আছে আমির চৌধুরীর পায়ের কাছে। কান্না করছে আমির চৌধুরীর পায়ে ধরে। আমির চৌধুরীর চোখে ও পানি। আমির চৌধুরী সব জেনে ও কিছু বলতে পারছে না মায়াকে। কারন নিঝুম বলেছে মায়াকে কিছু বললে নিঝুমের মরা মুখ দেখবে। মুনিয়া আহমেদ নির্বাক হয়ে বসে আছে পাশেই। চেয়ে ও পারছে না কিছু বলতে। এখন যে জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। মুনিয়া আহমেদের নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে আজ। তিনটে জীবন সে শেষ করে দিয়েছে। নিঝুম তাদের ছেড়ে চলে যাবে। মুনিয়া আহমেদের সাথে কথা বলেনা নিঝুম দুদিন হলো। মায়ার বিয়ের দিন নিঝুম চলে যাবে আমেরিকায়। মুনিয়া আহমেদও কান্নায় ভেঙে পড়ে।
গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে মায়া বলে
-” আংকেল কেউ জিজ্ঞেস করলে আপনাকে প্লিজ বলবেন না আমি নিঝুমদের ওখানে গিয়েছিলাম।
.
.
.
মায়ার বিয়ে একটু পরেই মায়াকে সাজানো হয়েছে। নিঝুম শেষ বারের মতো দেখতে এসেছে তার মায়াবতীকে। কি অপরুপ লাগছে তার মায়াকে। ঠিক যেমনটা নিঝুম কল্পনা করতো মায়াকে ঠিক তেমন। হয়তো তার চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। মায়া নিঝুমকে এই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধীর পায়ে নিঝুমের কাছে এসে
-” কেমন লাগছে আমায়?
নিঝুমের চোখের কোনায় পানি টলমল করছে। তাও নিঝুম একটু হেসে
-” বেহেশতের হুরের মতো লাগছে।
বলেই মায়ার কপালে একটা চুমু দেয় আর এক মুহুর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে চলে আসে নিচে।একটু দাঁড়িয়ে আমানকে দেখছে নিঝুম কতো খুশি আমান। নিঝুম শেষ বার উপরে তাকিয়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। বাড়িতে গিয়ে ব্যাগ গুলো নিয়ে রওনা দিবে সে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে আমেরিকায়।
মায়া অবাক হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। নিঝুম তার কপালে চুমু দিয়েছে পরম যত্নে৷ এই ছোঁয়ায় সে অগাধ ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছে। কাছে পাবার বাসনা পেয়েছে। আবদ্ধ করে রাখার ইচ্ছে পেয়েছে।
নিঝুম খুব কান্না করছে দাদার দু-হাটুতে মাথা রেখে। আমির চৌধুরী বসে আছে চেয়ারে নিস্তব্ধ হয়ে। নিঝুম ফ্লোরে বসে দাদার কোলে মাথা রেখে
-” দাদু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে দাদু। আমি কি করবো দাদু আমার যে মনে হচ্ছে এখনি দম বন্ধ হয়ে যাবে। দাদু মায়া ( কথা আটকে যায় কান্নায়) দাদু আমার মায়ার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। দাদু আমার মায়া। ছোট মানুষের মতো কান্না করছে নিঝুম। আমির চৌধুরী চোখের পানি ফেলছে আর নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষন পর নিঝুম উঠে দাঁড়ায়। আমি চলে যাবো দাদু আমি এই খানে থাকলে বাঁচবো না। আমার চলে যেতেই হবে। নিঝুমের পরিবার কেউই বিয়েতে যায়নি নিঝুম চলে যাবে বলে। ওরা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে নিঝুমের এই অবস্থা দেখে।
আমির চৌধুরী নিঝুমের হাত ধরে
-” দাদু ভাই যাসনা দাদু ভাই আমার যে একা লাগে এমনিতেই, তুই চলে গেলে আমি থাকবো কি করে?
নিঝুম ব্যাগ গুলো নিয়ে
-” আমার যেতেই হবে দাদু ভাই। আমি এই খানে থাকলে মরে যাবো।
হঠাৎ দরজা থেকে মুনিয়া আহমেদ চিৎকার দিয়ে নিঝুমের কাছে এসে
-” বাবা যাস না তুই। যাস না তুই বাবা। নিঝুম মুনিয়া আহমেদকে সরিয়ে বের হয়ে যায়।
নিঝুম গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়।
আমির চৌধুরীর আর কোন শব্দ না পেয়ে সবাই আমির চৌধুরীর দিকে তাকাই আমির চৌধুরী চুপ হয়ে বসে আছে। অনি আমির চৌধুরীকে ধরতেই আমির চৌধুরী নিচে পড়ে যায়।
.
.
.
🍂🍂 পাচঁ বছর পর 🍂🍂
নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে এয়ারপোর্টে গাড়ির জন্য। এই পাঁচটা বছরে সে কারো সাথেই যোগাযোগ করেনি। কিন্তু হঠাৎ তার দাদুকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তাই কাউকে না বলেই চলে আসে দেশে। নিঝুম একটা টেক্সি নিয়ে সোজা চলে যায় বাড়িতে। পাচঁ বছরে অনেক কিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে অনেক কিছুই। নিঝুম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। মায়া ও হয়তো অনেক বদলে গেছে এই পাচঁ বছরে। মায়ার হয়তো বাচ্চা ও হয়েছে মায়ার মতো দেখতে। নিঝুমের বাড়ির সামনে ফুলের বাগানটা নেই বললেই চলে। কেমন ময়লা হয়ে আছে একটা ফুল ও নেই গাছ ও নেই তেমন। এই বাগানে নিঝুম আর মায়া খেলা করতো। আজকে সেই বাগান আর বাগান নেই।
নিঝুম ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ডুকতেই অনি নিঝুমকে দেখে ভাইয়া বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে । নিঝুম অনিকে ধরে
-” কেমন আছিস?
-” ভালো ভাইয়া তুমি কেমন আছো?
-” ভালো অহনা কোথায়?
-” অহনার বিয়ে হয়ে গেছে।
-” ওহ, অনেক বদলে গেছে সব, তুই ও বড় হয়ে গেছিস।
মুনিয়া আহমেদ ও ছুটে এসে নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে
-” তোর এতো অভিমান আমাদের এই ভাবে ভুলে যেতে পারলি? এই ভাবে দূরে যেতে পারলি। আমরা কতো চেষ্টা করেছি তোর সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু তুই তার কোন উপায় রাখিস নি। কেন করলি এমন তুই নিঝুম? আমাকে ক্ষমা করতে পারিসনি তুই?
নিঝুম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
-” কেমন আছো আম্মু?
-” আমরা কেউ ভালো নেই বাপ তোকে ছাড়া।
-” দাদু কেমন আছে আম্মু? দাদু কোথায়? আমি দাদুর সাথে দেখা করতে এসেছি।
অনি হঠাৎ করে বলে উঠে
-” দাদু নেই ভাইয়া। তুই যেদিন চলে গেছিলি তখনি দাদু স্টোক করেছিলো। আর……
-” কি বলছিস এই সব অনি নেই মানে? দাদু কোথায়? আমার দাদুর কিছু হতে পারে না। আমি সব তচনচ করে ফেলবো দাদুর কিছু হলে। আমার দাদু কোথায় বল অনি
বলেই কান্না করে হাটু গেড়ে বসে পরে ফ্লোরে।
মুনিয়া আহমেদ ছেলের এই অবস্থা দেখে বলে উঠে
-” তোর দাদু মায়ার কাছে।
নিঝুম মুখ তুলে মুনিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে
-” মায়ার কাছে মানে?
-” মায়া সেদিন বিয়ে করেনি আমানকে। বাসা থেকে পালিয়েছিলো। আর এই দিকে তোর চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি তোর দাদু স্টোক করে। আমরা সবাই তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। অনেক দিন হাসপাতালে ছিলো তোর দাদু। ব্রেইন স্টোক করে প্যারালাইজড হয়ে যায়। এর কদিন পরই মায়া ফিরে আসে। আর এসে দেখে তুই আমেরিকায় চলে গেছিস। তারপর মায়া তোর দাদুকে নিয়ে যায়………..
আর কিছু বলার আগেই নিঝুম উঠে দৌড়ে বের হয়ে যায় মায়াদের বাড়ি যেতে……
চলবে…….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।