মাস্টারমশাই পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
7

#মাস্টারমশাই (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

শিউলি সবার সঙ্গে এসে পুকুরপাড়ে ভিড় জমায়। এতক্ষণে জলিলের স্ত্রীর মৃত দেহ পাড়ে তোলা হয়েছে। স্থানীয়রা পুলিশ ডাকবে বলেও ডাকেনি। এই কথাটি শিউলির কানে যেতে সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। দাদী যখন বলছিলো পুলিশ খবর দিবে তখন সে অবাক হয়েছিলো। যেখানে তার বিষ্ময়ের মাঝে লুকানো ভয়টা দাদী দেখতে পায় না। জলিলের স্ত্রী সাতার জানতো না। তাই স্বাভাবিকভাবে সবাই ধরে নেয় ভুল করে এখানে পড়ে গিয়েছে। হয়তো ছেলের পড়ালেখা নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সাথে কথা বলতে এসেছিলো। মাস্টারমশাই ঘরে না থাকায় পুকুর পাড়ে এসে হয়তো বসেছিলো। তাই অসাবধানতাবসত পড়ে মা রা গিয়েছে। এজন্য পুলিশ ডাকলে সে এসে লাশ নিয়ে গিয়ে কাটা ছেঁড়া করবে। এই ঝামেলায় কেউ যেতে চায়নি।

শিউলি এসব শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। জলিলের স্ত্রীর মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে সে অদ্ভুত এক হাসি দেয়।তার স্মৃতিতে ভেসে উঠে সে কিভাবে কথা বলার ছলে তাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছে। হ্যাঁ কাজটি শিউলি করেছে। এই মহিলা মাস্টারমশাইকে নোংরা ইশারা করতো। সে প্রায়ই আসতো তার কাছে। শিউলি এবং মাস্টারমশাই যখন ঘনিষ্ঠ সময় কাটাচ্ছিলো সেই মূহুর্তে সে তার এত ঘন ঘন আসার কারণ জানতে চাইলে মাস্টারমশাই এড়িয়ে যায়। তবে একদিন তাদের ঝগড়া দেখে শিউলি না জিজ্ঞেস করে পারে না। অতঃপর মাস্টারমশাই জানায়, এই মহিলা তাকে বাজে প্রস্তাব দিচ্ছে। তাতে রাজি না হওয়ায় এখন বদনাম করার ভয় দেখাচ্ছে। এসব নিয়ে মাস্টারমশাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। মাস্টারমশাইয়ের চিন্তিত এবং ভয়মিশ্রিত রূপ শিউলির পছন্দ হয় না। সে তো তাকে তার শরীর মন সব দিয়ে দিয়েছে। সারাজীবন অবহেলা পাওয়া মেয়েটি একটু ভালোবাসা পেয়ে পুরোটা উজাড় করে দিয়েছে তার মাস্টারমশাইকে। তার এমন ভয়, চিন্তা তার সহ্য হবে না যে। তাই তো সে হিংস্র হয়ে উঠলো। হ্যাঁ হিংস্র। তাই খুব সহজেই ভয়কে জয় করে ঐ মহিলাকে পুকুরে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে পেরেছে শিউলি।

এই কথা অবশ্য মাস্টারমশাইও জানে। কাজটি করে ভয়ে ছুটে শিউলি তার কাছেই গিয়েছিলো। মাস্টারমশাই সব শুনে শিউলিকে ভয় পেতে বারণ করেছে। সে তাকে ভালোবেসে আদর করে দেয়। এই সেই আদর যা শিউলি কখনো কারো কাছে পায়নি। এই আদর, ভালোবাসার জন্যই তো সে এতবড় কাজ করলো। মাস্টারমশাইয়ের চিন্তার কথা ভেবে শিউলি এটা করায়, মাস্টারমশাই খুশি হয়ে তাকে কাচের চুড়ি উপহার দেয়। সেই চুরি পেয়ে শিউলি আরও খুশি হয়ে যায়। খুব খুশি হয়ে যায়। তাই খুব সহজেই ভুলে যায়, সে কতবড় কান্ড ঘটিয়েছে।

এভাবেই একটি খু ন দূর্ঘটনা রূপ পায়। ধীরে ধীরে শিউলি এবং মাস্টারমশাইয়ের ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। অতঃপর এলো সেদিন যেদিন পদ্ম মাস্টারমশাইকে অপবাদ দিলো। তার এই চোর অপবাদ মাস্টারমশাইয়ের মতো এত ভালো এবং সৎ মানুষের সহ্য হয়নি। সে খুব ভেঙে পড়ে। তার মনে হয় সে এই গ্রামের মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। তাই তো চলে যায়।

বর্তমান,
এসব ভেবে শিউলি খুব ভেঙে পড়ে। তার সমস্ত রাগ পদ্মর উপর গিয়ে পড়ে। মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হলে হয়তো তার রাগটা কমতো। তবে এবার তার রাগ কমার নয়। তাই তো পরবর্তী দিন পদ্মকে স্কুল শেষে পুকুরপাড়ে ডাকে শিউলি। যদিও শিউলিকে খুব একটা পছন্দ নয় পদ্মর। তবে সে এমনভাবে ডাকলো যে না এসে পারলো না। পদ্ম এসে দেখে শিউলি পুকুরপাড়ে উদাস হয়ে বসে আছে। এটা দেখে তার পাশে এসে বসে। এবং বলে,“ডাকলে যে?”

“মাস্টারমশাইকে চোর বানালি কেন?”
এটা শুনে পদ্ম অবাক হয়। সে কিছুটা রাগ নিয়ে বলে,“বাহ্। মাস্টারমশাই যাবার আগে তার প্রিয় ছাত্রীকে কথাটি বলে গিয়েছে। তা সত্যি বলেছে না মিথ্যা?”

“মানে?”
শিউলি অবাক হয়। এখানে পদ্ম যা বলা তা শোনার জন্য শিউলি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে বিষ্ময়ে তার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। পদ্ম বলে,“আমি তাকে চোর বানাতে চাইনি। আমার বাবা, মা আমার সম্মানের কথা ভেবে তাকে চোর বানিয়ে অপমান করেছে। লোকের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছে। যাতে সে চলে যায়।”

“কি!”
শিউলি অবাক হয়ে যায়। এখানে পদ্ম জানায় মাস্টারমশাই তার সঙ্গে জোর জবরদস্তির চেষ্টা করেছে। যদিও প্রথমে আকারে ইঙ্গিতে ভালোবাসার কথা বলতো তবে পদ্ম গুরুত্ব না দেওয়ায় শেষমেশ জোর করেছে। মাস্টারমশাই তাকে বাড়ি গিয়ে পড়াতে চায়নি, সে চেয়েছিলো পদ্ম যাতে তার কাছে শিউলির মতোই আলাদা পড়ে। কিন্তু পদ্মর বাবা, মা রাজি হয়নি। অতঃপর কোনভাবে পদ্মকে প্রেমে না ফেলতে পেরে মাস্টারমশাই তার সঙ্গে খারাপ করার চেষ্টা করেছে। এটা শুনে শিউলি বিশ্বাস করতে চায় না। সে পদ্মর গালে থাপ্পড় মারে। রাগান্বিত গলায় বলে,“এটা হতে পারে না। আমার মাস্টারমশাইয়ের নামে মিথ্যা কথা বলবি না।”

“আমার মাস্টারমশাই?”
পদ্ম উপহাস করে হেসে কথাটি বলে। অতঃপর বলে,“আসলেই?
তোর মতো একটা মেয়ের সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের এত ঘনিষ্ঠতা দেখে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো। তবে লোকজন তোদের নিয়ে কথা বলেনি কেন জানিস? কারণ একটাই তুই কুৎসিত। মাস্টারমশাইয়ের মতো সুদর্শন মানুষ পঁচা শামুকে মুখ দিবে না। এটাই সবাই ভাবছিলো। কিন্তু ঘটনা তো উল্টো। সেদিনের ঘটনার পরই আমি বুঝেছি সে কত বড় চরিত্রহীন। তাই বুঝলাম সে তোকে খুব ফাঁসিয়ে নিয়েছে৷”
এটা নিতে না পেরে পদ্মকে ধাক্কা দিতে যাবে শিউলি তখনই পদ্ম তাকে ধরে নেয়। অতঃপর বলে,”দেখ তুই ভুল করছিস। মাস্টারমশাই তোকে বোকা বানিয়েছে। তোর মতো একজনকে কেউ ভালোবাসতে পারে বল? হয়তো সে তোর সঙ্গে নোংরামি করবে বলে এতটা মিশেছে।”

“মিথ্যে। আমার মাস্টারমশাই আমাকে খুব ভালোবাসে। সে খুব শীঘ্রই ফিরে আসবে৷ আমাকে বিয়ে করতে আসবে।”
এটা শুনে পদ্ম শব্দ করে হেসে দেয়। সে খুব জোরের সঙ্গে শিউলিকে জানায়,“তুই বড় বোকা হয়ে গেছিস শিউলি। বোকা তুই। আমি কোন মিথ্যা বলিনি। সত্যি বলেছি। আর শোন সেদিন যে জলিলের স্ত্রী মা রা গেল তার সঙ্গেও মাস্টারমশাইয়ের খারাপ সম্পর্ক ছিলো।আমার বাবা তার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে। গ্রামে আরও দুই একজনের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিলো। সে খুব কৌশলে নিজের সুন্দর কথা দ্বারা মেয়ে এবং মহিলাদের তার প্রতি আকৃষ্ট করে। আর হ্যাঁ সে অপমানিত হয়ে যায়নি। তার বদলী হয়েছে এটা নিশ্চিত হয়েই সে আমার সঙ্গে জোর জবরদস্তি করার চেষ্টা করেছিলো। অতঃপর সে গেছে। তুই বোকা হয়ে গেছিস। অনেক বড় বোকা।”

এটা বলে পদ্ম চলে যায়। এই কথা শুনে শিউলি হতবাক হয়ে যায়। পদ্ম যাবার আগে অবশ্য বলে যায়,“তুই তার মোহে এত পাগল হয়ে গেছিস যে এসব খবর জানিসই না। এলাকায় এসব নিয়ে বেশ কথা হয়। যদিও সরাসরি বলে না। তবে কানাঘুষা কম হয় না।”

শিউলি সেখানেই বসে পড়ে। সে বিশ্বাস করতে পারে না। তার মাস্টারমশাই। তার ভালোবাসা। এতগুলো বছরে প্রথম সে ভালোবাসার স্পর্শ, ভালোবাসার অনুভূতি পেয়েছিলো। সব মিথ্যা ছিলো। শিউলির বিশ্বাস হয় না কিছুই। কিছুতেই হয় না।

___

অতঃপর ধীরে ধীরে শিউলি সমস্ত সত্যি জানতে পারে। পদ্মর কথাই সত্যি। মাস্টারমশাই অর্থাৎ মাহফুজ হাওলাদার আগে থেকেই বিবাহিত। তার দুইটি সন্তানও রয়েছে। তবে চরিত্রের দোষ রয়েছে। সে নারীদেহের প্রতি খুবই আকৃষ্ট। সে নিজের চমৎকার বাচনভঙ্গি দিয়ে খুব সহজে মেয়েদের নিজের বশে নিতে পারে। সে যে স্থানেই বদলি হয়ে যায় সেখানেই এমন দুই একটি ঘটনা ঘটায়। এসব তথ্য জানতে পদ্ম শিউলিকে সাহায্য করেছে বেশ। সবকিছু জেনে শিউলি একদম ভেঙে পড়ে। এদিকে তার মনের খবর না জানা বাবা এবং দাদী তার জন্য বিয়ের পাত্র হিসাবে এবার চল্লিশ বছরের দুই স্ত্রী থাকা একজনকে যোগাঢ় করে। শিউলি এসব জেনে আরও ভেঙে পড়ে। শিউলি সেই পুকুর পাড়ে আসে। একদিন এই পুকুর পাড়ে সে মাস্টারমশাইয়ের প্রেমে অন্ধ হয়ে একজনকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো। আজ সে নিজে ডুবতে এসেছে। আগেও একবার এসেছিলো। তবে সেদিন মাস্টারমশাই তাকে বাঁচিয়েছে। ঐ জঘন্য মানুষটি সেদিন কত সুন্দর না কথা তাকে বলেছিলো।তার চোখে শিউলি সুন্দর। অথচ সব মিথ্যে ছিলো। মিথ্যে। এসব ভাবতে ভাবতে শিউলি পানিতে ঝাপ দিতে নেয়। না এবার মাস্টারমশাই বাঁচায় না তবে এবার সে নিজেই থেমে যায়। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে মনেমনে বলে,“আমি তো পাপী। অনেক পাপ করেছি। আবার একটা পাপ কেন করতে যাচ্ছি?
এটা করে তো আমি ঐ লোকটাকে সুযোগ করে দিচ্ছি আমার মতো অসহয় অন্য এক মেয়েকে ঠকানোর। তাকে ব্যবহার করার। পাপ যেহেতু করেছি এবং করবোই সেহেতু তাকে খুঁজে বের করে শেষ করে দেই বরং। এটাই বেশ হবে।”
এটা বলে শিউলি অদ্ভুত এক হাসি দেয়। পাগলের মতো হাসি। সেই রাতেই সে গ্রাম ছাড়ে।

পরিশেষে, কুৎসিত বলে এক পুরুষের সঙ্গে মেয়েকে আলাদা সময় কাটাতে দেওয়া বাবা এবং দাদী জানতে পারে শিউলির পরিনতি। সে কুৎসিত হতে পারে। কিন্তু মেয়ে তো। তাই তার মেয়ে হওয়ার সুযোগ কেউ একজন নিয়েছে। সেই সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের নোংরা রূপও প্রকাশ পায়। অন্যদিকে শিউলি তার খোঁজে তার বাড়ির উদ্দেশ্য পাড়ি জমায়। হয়তো সে খুব শীঘ্রই মাস্টারমশাইয়ের মুখোমুখি হবে। সেখানে হয়তো শিউলি প্রতিশোধ নিয়ে, নিজেই নিজেকে শেষ করে দিবে। তবে সেটা আদৌ সে পারতে তো? জানা নেই। পরিবার, সমাজ, পরিস্থিতি শিউলির মানসিক অবস্থা আগেই খারাপ করে দিয়েছিলো। বাকিটুকু মাস্টারমশাই জীবনে এসে করে দিয়েছে। তাই তো খু ন করতে শিউলি দু’বার ভাবলো না। অবশেষে হয়তো একদিন পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে শিউলি। সেদিনের আগে মাস্টারমশাইয়ের থেকে তার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যাবে কি-না জানা নেই।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে