#মায়া
#পর্ব_০১
#ওয়াহেদ_মাহমুদ
অনেক প্রতিক্ষার পরে আজ জন্ম নিয়েছে এক ফুটফুটে শিশু। দশ বছর অপেক্ষার পর। কিন্তু ওয়াহেদ সাহেবের মুখে বিন্দু মাত্র খুশির ছাপ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ওয়াহেদ সাহেবকে তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার কথা। মুখে বিষন্নতার কারণ হলো পুত্র সন্তান না হয়ে কন্যা সন্তান হয়েছে। অনেক আশা ছিলো একটা পুত্র সন্তান হবে। কন্যা সন্তান কে কোলে না নিয়ে বাসা থেকে বাইরে চলে যায় ওয়াহেদ সাহেব। রাতে বাসায় ফিরে এসে মেয়েটাকে এক নজর দেখলেন না।
ওয়াহেদ সাহেবের স্ত্রী সুরাইয়ার বুঝতে বাকি থাকলো না ওয়াহেদ কেন এমন করছেন। সুরাইয়া, স্বামীর পাশে গিয়ে বসে থাকলেন তারপর বলে উঠলেন দেখো ছেলে আর মেয়ে কি আসে যায় সন্তান তো আমাদের। এতো বছর পরে একটা ফুটফুটে সন্তান হয়েছে হাসিমুখে মানিয়ে নাও প্লিজ। দেখো আমাদের মেয়েটা কতটা সুন্দর হয়েছে। একদম তোমার মতো হয়েছে। অত্যন্ত একবার কোলে নিয়ে দেখো।
স্ত্রী সুরাইয়ার অনুরোধে মাহমুদ সাহেব নিজের কন্যা সন্তান কে একবার নিজের বাহুতে নিলেন। কিন্তু মুখে হাঁসির বিন্দু মাত্র ছাপ দেখা যায় না। স্ত্রীর অনুরোধে সন্তান কে কোলে নিয়েছে। নিজের থেকে নিজের স্ত্রী কে বেশি ভালোবাসে। আর সেই জন্যই তো বিয়ের দশ বছর পরেও সন্তান না হওয়ার কারণে তার সাথে আছে। না হলে তো ডিভোর্স দিয়ে দিতেন। কোলে নিয়ে দুই মিনিট পরে আবার রেখে দিলেন।
সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন আর যাওয়ার সময় মিষ্টির দোকান থেকে তিন কেজি মিষ্টি কিনলেন। মিষ্টি ক্রয় করার ইচ্ছা ছিলো না ওয়াহেদ সাহেবের কিন্তু কি করার আছে। অফিসের সবাই জানে ওয়াহেদ সাহেবের সন্তান হয়েছে কিন্তু ছেলে নাকি মেয়ে তা জানেন না। এখন যদি, অফিসের সবাই কে মিষ্টি মুখ না করানো হয় তাহলে সবাই ওয়াহেদ সাহেব কে কিপ্টা ভাববে। তাই ফর্মালিটিজ মেইনটেইন করার জন্য মিষ্টি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। ওয়াহেদ সাহেব সবার উদ্দেশ্যে মিষ্টি বিতরণ করছেন।
অফিসে মানুষকে খোঁচা মেরে কথা বলা একটা লোক আছে যারা নাম আফজাল হোসেন। তার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে শুধু খোঁচা মেরে কথা বলা। মুখ বেঁকিয়ে তিনি ওয়াহেদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বললেন। শুনলাম আপনার নাকি মেয়ে সন্তান হয়েছে। কি আফসোস এতো বছর পরে জন্ম তাও আবার মেয়ে হয়েছে, ছেলে না। আমি আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম আরেক টা বিয়ে করেন। আপনার এই স্ত্রী কে ডিভোর্স দিয়ে দিন। কিন্তু তখন আপনি আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। তখন আমার কথা শুনলে এখন পরিস্থিতি অন্য রকম হতো।
এমনিতেই ওয়াহেদ সাহেব তার কন্যা সন্তান মেনে নিতে পারছে না। তারপর আফজাল হোসেন তার মাথায় মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আরো অনেকেই বলছেন মেয়ের থেকে যদি ছেলে হতো তাহলে ভালো হতো। অনেক বছর পর সন্তান তাও আবার মেয়ে। মেয়ে মানুষ করে বিয়ে দিতে গিয়ে তো বুড়া হয়ে যাবেন। তারপর আবার মেয়ের বিয়ে অনেক খরচ। কিন্তু ছেলে হলে নিজের জীবন নিজেই করে নিতো।
অনেকেই অনেক কথা বলছেন।এসব বিষয় নিয়ে ওয়াহেদ সাহেব বেশ রেগে আছে। রাগান্বিত অবস্থায় বাসায় এসে সুরাইয়াকে পরিষ্কার ভাবে বলে দিলেন আমি দ্বিতীয় বিয়ে করবো। তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দশ বছর তোমার সাথে একসাথে ছিলাম কিন্তু আমাকে সন্তান দিতে অক্ষম হয়েছো। হাঁসি মুখে তোমার সাথে সংসার করেছি। এখন তোমাকে আমার ডিভোর্স দিতে হবে।
সুরাইয়ার মুখে কোনো কথা নেই। কি বলবে বুঝতে পারছে না। যার সাথে এতোটা বছর ধরে সংসার করছে। তাকে কিভাবে অন্য মেয়ের হাতে তুলে দিব। কান্না কন্ঠে সুরাইয়া বললো তোমার খুশিতে আমার খুশি। তুমি যদি চাও দ্বিতীয় বিয়ে করবে তাহলে আমি কোনো বাঁধা দিবো না। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ রাখবে প্লিজ?
হ্যাঁ বলো সুরাইয়া আমি চেষ্টা করবো তোমার কথা রাখার। কি কথা বলো?
আমি চায় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার বাসায় থাকতে। তোমার কাছে থেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চায়। এখন যদি আমি সারাজীবনের জন্য বাসায় চলে যায় তাহলে আমাকেও বিয়ে দিয়ে দিবে। তোমার মতো আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। আমাকে আর আমার সন্তানকে তোমার বাসায় থাকতে দাও। চিন্তা করো না আমাকে আর আমার সন্তানের খরচ তোমার বহন করতে হবে আমি। আমি নিজেই কিছু একটা করবো।
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে ওয়াহেদ সাহেব বললেন। আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা তোমাকে মেনে নিতে হবে। সে যেটা বলবে সেটাই করতে হবে।
সুরাইয়া তখন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ওয়াহেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন তুমি কোনো চিন্তা করো না। তোমার দ্বিতীয় স্ত্রী যেটা বলবে সেটাই হবে।
স্বামীর বিয়ের জন্য বাসা থেকে সবাই মেয়ে খুঁজছে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কারণ অনেক আগে থেকেই বাসা থেকে বলেছে আরেকটি বিয়ে করতে। কিন্তু কারোর কথা মেনে নেয়নি ওয়াহেদ। প্রথম প্রথম বাসার সবাই কে সুরাইয়া পছন্দ করলেও আস্তে আস্তে তাকে কেউ পছন্দ করতেন না। কারণ সুরাইয়া সন্তান দিতে অক্ষম। দশ বছর পরে যখন সন্তান হবে এটা শুনে ওয়াহেদ সাহেব অনেক খুশি হলেও খুশি টা বেশিক্ষণ ছিল না। কারণ হলো মেয়ে সন্তান।
এক সপ্তাহ পর আজ ওয়াহেদের বিয়ে। বাসার সবাই অনেক আনন্দ করছে। সব আত্মীয় আজ বাসায় এসেছে। বিয়ে বলে কথা সবাই আনন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একমাত্র খুশি বিহীন মুখ সুরাইয়ার। পৃথিবীর কোনো মেয়ে চায় না তার স্বামী দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করুক। ওয়াহেদ সাহেব ঘরে বসে ছিলেন। এমন সময় সুরাইয়া ওয়াহেদের কাছে গিয়ে বললো।
আমি কি আজ তোমায় সাজিয়ে দিতে পারি?
ওয়াহেদ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে বললেন। আচ্ছা ঠিক আছে দিতে পারো।
সুরাইয়া নিজের হাতে নিজের স্বামী কে সাজিয়ে দিলেন। সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে বললেন, তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে একদম সেদিনের মতো সুন্দর লাগছে যেদিন বর সেজে আমাকে নিতে এসেছিলে।
দুপুর নামাজের পর সবাই বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সুরাইয়ার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই যায়নি। কারণ স্বামীর বিয়ে কিসের জন্য যাবে। সবার সামনে হাসিমুখে থাকলেও ভিতরে ভিতরে তার কলিজা টা পুড়ে যাচ্ছে। সবাই চলে গেলেও সুরাইয়া বাসায় থেকে যায়। কারণ স্বামীর বাসর ঘর সাজানোর দায়িত্ব টা সুরাইয়া নিজের হাতে নিয়েছে। বাসর ঘর সাজাতে সাজাতে সুরাইয়ার মনে মনে ভাবে ওয়াহেদের সাথে বিয়ের সময় ও এই ঘরে বাসর সাজানো হয়েছিল। বোউ সেজে তখন এই বাসায় এসেছিলেন। কিন্তু আজ নিজের স্বামীর বাসর ঘর তৈরি করে। বাসর ঘরে আজ অন্য মেয়ে বোউ সেজে বসে থাকবে।
বাসর ঘর সাজিয়ে সুরাইয়া বসে আছে আর পুরোনো দিনের কথা মনের মধ্যে কল্পনা করছে। হঠাৎ করে সুরাইয়ার কাছে ফোন আসে বিয়ের উদ্দেশ্যে যে গাড়িতে ওয়াহেদ ছিল সেই গাড়িটা এক্সিডেন্ট করছে। ওয়াহেদ এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে। একটা পা কেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে। আর কোনো দিন হাঁটতে পারবে না। কথাটা শোনার পরে সুরাইয়ার কাছে কল্পনার মতো মনে হচ্ছে।
হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দে সুরাইয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এতোক্ষণ সুরাইয়া বুঝতে পারে এটা বাস্তবতা না শুধু স্বপ্ন ছিল।
গাড়ির শব্দ শুনে সুরাইয়া দৌড়ে গাড়ির কাছে চলে যায়। তারপর ওয়াহেদের কাছে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে বলে তোমার তো কিছু হয়নি ঠিক আছো। এটা দেখে বিয়ে বাড়ির সবাই অবাক, হচ্ছে টা কি।
এটা দেখে সুরাইয়ার শ্বশুরি সুরাইয়ার হাত ধরে টানতে টানতে অন্য রুমে নিয়ে গিয়ে মুখে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়। আর কড়া ভাবে বলে দিলেন আমার পিছন তুমি ছেড়ে দাও। তুমি কি মনে করো আমার ছেলের নতুন জীবন তুমি ভেঙ্গে দিবে? নতুন বোউ এর আশেপাশে তোমাকে না দেখি। আর যদি কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করো তাহলে এই বাসা থেকে তোমার লাশ বাহির হবে। এটা বলে সুরাইয়ার শ্বশুরি রুম থেকে বাহির হয়ে যায়।
সুরাইয়া রুমের মধ্যে নিজের মেয়ে পূর্ণতা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। আর বলতে থাকে সব দোষ তোর। সন্তান বাদেও আমি সুখি ছিলাম কিন্তু তোর জন্মের পর থেকে সব উল্টা পাল্টা হয়ে গিয়েছে। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দিয়ে নতুন বিয়ে করছে। এখন আমি তোকে নিয়ে কোথায় যাবো বল। আত্মহত্যা করেও তো আমার শান্তি হবে না। তোকে দেখার মতো কেউ নেই এই বাসায়। অবহেলা পেয়ে পেয়ে তুই মারা যাবি।
নতুন স্ত্রীকে সবার সবাই বরণ করে নিচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি বাকি সবার খুশিতে সুরাইয়ার কান্নার আওয়াজ কারো কানে গিয়ে পৌঁছায় না। আর পৌঁছে বা কি হবে সুরাইয়ার কান্নায় কারো যায় আসে না। কারণ এই বাড়িতে সুরাইয়ার কোনো অধিকার নেই।
সুরাইয়া নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে ওয়াহেদের বাসর ঢুকে যায় সবার সামনে দিয়ে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। বাহিরের সবাই অবাক। ওয়াহেদ আর নতুন স্ত্রী দেখে অবাক তারপর সুরাইয়া নতুন স্ত্রীর ঘোমটা খুলে দিয়ে বলে তুমি যদি,,,,,,,
চলবে,,,,,,