মাতৃত্বের স্বাদ পর্ব – ৮

0
1758

#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-৮
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা

৩০.

হসপিটালের মর্গে একটা বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে প্রায় আঠারো দিন ধরে। এক থানা থেকে অন্য থানা, এমন করে চট্টগ্রামের প্রত্যেকটা থানায় লাশের খবর জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো খবর পাওয়া যায়নি লাশের ব্যাপারে। কারণ চট্টগ্রামের এই ঘটনার সাথে সম্পর্ক আছে ঢাকার পুলিশদের ও!

কিছুক্ষণ আগেই তানভীরসহ ওদের টিমের বেশ কয়েকজন চট্টগ্রামের হসপিটালে এসেছে। এসেই চট্টগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিস্টার রাফি ইসলামের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো তানভীর। তানভীর আর রাফি দু’জন কলেজ জীবনের বন্ধু। একসাথে ট্রেনিং এ গেলেও দু’জনের পোস্টিং হয় আলাদা আলাদা থানায়। গতকাল রাতে রাফির সাথে কথা বলার সময় তানভীর জানতে পারে বিগত আঠারো দিন ধরে একটা বেওয়ারিশ লাশ মর্গে পড়ে আছে। কথাটা শুনে তানভীরের কিছুটা সন্দেহ হয়। তারপর রাফির থেকে জানতে পারে লাশটা একটা মেয়ের। এবং মেয়েটি গর্ভবতী ছিল। কথাটা শুনেই তানভীর চমকে যায়। মেয়েটির ছবি চাইলে রাফি কিছুক্ষণ পর মেয়েটার ছবি পাঠায় তানভীরকে। তখনই তানভীরের সন্দেহ ঠিক হয়। হ্যা, মেয়েটা আর কেউ নয়। মেয়েটা রিংকি! গতকাল রাতেই তানভীর তার টিমকে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হয়। হন্তদন্ত হয়ে তানভীর মর্গে ঢুকে লাশ দেখেই শিউরে ওঠে। এমন মর্মান্তিক মৃত্যু তাও কিনা একজন গর্ভবতী মেয়ের! যে রিংকিকে মেরেছে সে আদৌও মানুষ তো? এমন অনেক কথা তানভীরের মাথায় ঘুরছে।

“ধন্যবাদ রাফি। আমি এই মেয়েটাকে অনেক দিন ধরে খুঁজছি। যদিও এমন অবস্থায় আশা করিনি। আমি কী এখন এই লাশটাকে আমাদের মর্গে নিয়ে যেতে পারি।”

“অবশ্যই পারো। কিন্তু তার আগে কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করতে হবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে চলো।”

এরপর সবকিছু শেষ করে তানভীরসহ বাকি সবাই ঢাকায় ফিরে আসে।

রাজের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দেখে আশেপাশের সবাই কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। এই বাড়িতে কখনো কোনো পুলিশ আসেনি। এই প্রথম এই বাড়িতে পুলিশ এসেছে। তাই সবাই অবাক!

“রাজ কোথায়?”

একজন পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে রাজের মা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উঠেই পুলিশকে দেখে চমকে উঠলো মিসেস রাফিয়া বেগম।

“আমার বাড়িতে পুলিশ কেন? আর রাজকে কী দরকার আপনাদের?

” সেটা রাজকেই বলবো। ডাকুন তাকে।”

“রাজ তো বাড়িতে নেই।”

“কোথায় গেছে?”

“গতকাল রাত থেকে বাড়িতে আসেনি।”

“কিন্তু কোথায় গেছে সেটা বলে যায়নি?”

“রাজ ওর ফার্মহাউসে আছে।”

“ঠিক আছে। রাজকে কেউ কিছু বলবেন না আমাদের বিষয়ে। যদি বলেন তাহলে আপনাদের জন্যেও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। তাই সাবধান!”

ওয়ার্নিং দিয়ে সবাই বের হয়ে গেল। রাজের মা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। কী এমন করেছে তার ছেলে? যার জন্য আজ তার বাড়িতে পুলিশ এসেছে!

জিপে বসে তানভীর ওর সহকর্মী শিহাবকে বললো,

“শিহাব রাজের ফোন নাম্বার ট্র্যাক করো। কোনোভাবেই যেন রাজ আমাদের হাত ছাড়া না হয়।”

“ওকে স্যার।”

রাজের ফার্মহাউসের সামনে এসে দরজায় কড়া নাড়তেই দরজা আপনাআপনি খুলে গেল। সবাই কিছুটা অবাক হয়ে হাতে পিস্তল নিয়ে সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকে রাজকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও রাজ নেই।

“স্যার কোথাও তো রাজকে পেলাম না।”

“যাবে কোথায় রাজ। ওকে তো খুঁজে বের করবোই। চারিদিকে ছড়িয়ে যাও তোমরা। সবগুলো ঘরের প্রত্যেকটা কোণা খুঁজে দেখো। একটা কোণাও যেন বাদ না যায়। বুঝেছো সবাই?”

“ইয়েস স্যার।”

সবাই প্রতিটা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। আপাতত সবগুলো ঘর খোঁজা শেষ। কিন্তু রাজকে কোথাও কেউ পায়নি। আশার আলো নিভতে নিভতে পুনরায় জ্বলে উঠলো তখন, যখন একটা ঘরের ফ্লোরের নিচে গোপন ঘরের দরজা দেখতে পেল তানভীর। তানভীর খুব সতর্কতার সাথে দরজার হুক ভেঙ্গে ফেললো। তারপর সবাই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই হতভম্ব হয়ে গেল!

রাজ একটা চেয়ারে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। না অজ্ঞান হয়নি। মদ্যপান করে নেশায় বুদ হয়ে আছে সে। হাতে রং লেগে আছে। পুরো ঘরে রং, তুলি, কাগজ, পেইন্টিংয়ের ছড়াছড়ি। সবগুলো পেইন্টিং দেখা গেলেও একটা পেইন্টিং কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কাপড় সরাতেই সেদিনের পেইন্টিং টা চোখে পড়লো সবার। এটা সেই পেইন্টিং যেটা রাজ এঁকেছিল সেদিন রাতে। একমুঠো রং লেপ্টে আছে শুধু। এরমধ্যেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো তানভীর। এতগুলো রংয়ের মধ্যে একটা আবছা মেয়ের অবয়ব আঁকা। আর এক কোণে ছোট্ট করে “R” লেখা। তানভীর তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারলো এই পেইন্টিং টা কেসের সাথে জড়িত। তাই পেইন্টিংটা এভিডেন্স ব্যাগে নিয়ে নিলো। তারপর রাজকে না ডেকেই তিনজন মিলে জিপে বসিয়ে থানায় নিয়ে গেল তাকে। তানভীর রাজের সাথে থানায় গেলেও এই গোপন ঘরে চারজনকে রেখে গেল সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্য। সবাই চলে যেতেই একটা ছায়া মুচকি হেসে সরে গেল ফার্মহাউস থেকে।

৩১.

রাতের আঁধারে অজান্তাদের বাড়িতে একজন ঢুকলো। কালো হুডি, কালো জিন্স, কালো জুতা, এক কথায় নিজেকে কালো রংয়ে সাজানো ব্যক্তিটি আসলে কে সেটা বোঝার উপায় নেই। তবে অবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা কোনো ছেলের অবয়ব। অজান্তাদের বাড়িতে কোনো ছেলে নেই। আর এই ব্যক্তিটি এই বাড়ির কেউ না। সে এসেছে একজনের সাথে দেখা করতে। ছাঁদের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন। একজন মেয়ে অবয়ব। আর একজন ছেলে অবয়ব। দুজনের মুখেই রহস্যময় হাসি।

“ধন্যবাদ তোমাকে। আমাকে সাহায্য করার জন্য।”

“আরে না না। ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে ছোট করো না। এটা আমার দায়িত্ব। আমি চেষ্টা করবো এই খেলার শেষ পর্যন্ত তোমার সাথে থাকার।”

“অন্যায়কে প্রশয় দিতে নেই৷ সে নিজের আপন কেউ হলেও না। কথাটা তোমাকে দেখে সবার বিশ্বাস করা উচিত।”

“নিজের লোক যখন বেঈমানী করে তখন পিঠ দেয়ালের সাথে ঠেকে যায়।”

“এই শহরে সবাই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে। চোখের পলকে সবাই রূপ বদলায়। চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়!”

“সময় এসে গেছে মুখোশ উন্মোচনের। এই প্রতিশোধ তোমার একার নয়। এই প্রতিশোধ আমাদের সবার।”

“কাজে লেগে পড়। একটা প্রমাণ ও যেন আমাদের হাত ছাড়া না হয়।”

“আচ্ছা।”

“এখন তুমি যাও। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।”

“ওকে দেখে রেখো। খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ সে। হাসতে হাসতে মারতেও পারে। তবে ওকে আর কোনো ভুল স্টেপ নিতে মানা করো। আমরা আছি ত ওর পাশে।”

“হ্যা। ওও যা শুরু করেছে। তাতে ওকে একটু বোঝাতে হবে। তবে আর নয় এমন সহজভাবে বোঝানো। এবার ওর ভাসাতে-ই ওকে বোঝাবো আমরা।”

“আসি।”

“নিজের খেয়াল রেখো।”

“তুমিও।”

কথাটা বলেই ছেলেটা অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেল। মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গায়ে ভালো মতো চাদর জড়িয়ে নিচে নেমে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে একটা ডায়েরি নিয়ে বসে পড়লো সে।

“আজ আমরা আমাদের লক্ষ্য পূরণের প্রথম ধাপ পার হয়েছি। এই খেলা মোটেও সহজ নয়। নিজের জীবন বাজি রেখে আমরা সবাই আগুন নিয়ে খেলতে নেমেছি। জানিনা ভবিষ্যতে কি হবে। তবে আমি বা আমরা কেউ থামবো না। শাস্তি সবাইকে পেতে হবে। প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ! কোনো না কোনোভাবে আমাকেও শাস্তি পেতে হবে। তার জন্য আমি প্রস্তুত। কিন্তু সবার আগে বাকিদের শাস্তির ব্যবস্থা করবো আমি। এই রহস্য উন্মোচন হবে খুব শীঘ্রই। এক এক করে সবার মুখোশ উন্মোচন করবো আমি। এই খেলায় কেউ বিনা স্বার্থে আমাকে সাহায্য করছে না। মিস্টার আগন্তুক তুমি নিজেও এতটা ভালো নও যতটা তুমি দেখাও। সবাই সবার সুযোগ নিচ্ছে। শুধু একজন কোনো অন্যায় না করেও ফেঁসে গেল। তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। প্রস্তুত হও সবাই। নিজেদের মৃত্যুকে সরাসরি দেখার জন্য প্রস্তুত হও তোমরা।”

কথাটা বলেই ডায়েরি বন্ধ করে পাশের দুজন মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে