#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-৭
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা
২৪.
রাজকে গ্রেফতার করেও পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। কারণ রিংকিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর সকল তথ্য রিংকির কাছে। তানভীর অনেক চেষ্টা করেও রিংকিকে খুঁজে বের করতে পারেনি। পরবর্তীতে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে রাজকে ছেড়ে দেয়। রাজ হাসিমুখে জেল থেকে বের হয়ে তানভীরের দিকে চোখ রেখে বলে,
“নাম মাত্র পুলিশ অফিসার। সামান্য একটা কেস সলভ করতে পারে না।”
তানভীর শান্ত চোখে শুধু রাজের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কিছুই বলেনি। রাজ চলে যাওয়ার পর তানভীর নতুন করে রিংকিকে খোঁজার জন্য লোক লাগায়। কিন্তু একুশ দিন পরেও রিংকির কোনো খোঁজ না পেয়ে তানভীর হতাশ হয়ে যায়। কিন্তু হাল ছাড়ে না। একজন পুলিশ অফিসারের এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়া মানায় না। মোটেও মানায় না। তাই নতুন করে আবার ইনভেস্টিগেশন শুরু করে তানভীর এবং তার টিম মেম্বাররা।
২৫.
অজান্তা এক মনে পড়ছে। রাজের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদের প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। এর মধ্যে রাজ একবার জেলে গিয়েছে এই খবরটা অনু অজান্তাকে জানিয়েছিল। কিন্তু অজান্তা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যেন রাজের যা হয় হোক, তাতে অজান্তার কিচ্ছু যায় বা আসে না। সে নিজের মতো পড়ালেখায় ব্যস্ত। তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে আর কতদিন? যতোই বাবা-মা হোক। তবুও এবার অজান্তার উচিত নিজের জন্য কিছু করা। নিজের বাবা-মাকে নিজের উপার্জনে কিছু দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা সবারই থাকে। অজান্তারও আছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন মেডিকেলে চান্স পাওয়া। তাই এখন অজান্তার ধ্যান, জ্ঞান সব পড়া পড়া আর পড়া!
২৬.
নন্দিনীর প্রেগন্যান্সির তিন মাস চলছে। এখন আগের তুলনায় অনেক কম বাইরে যায় নন্দিনী। বন্ধুবান্ধবদের সাথে চলাফেরা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। এখন শশুর বাড়ির সবার সাথে ভালোই কাটছে দিনকাল। সবাই নন্দিনীর প্রেগন্যান্সির কথা শুনে খুশি৷ আগের তুলনায় নন্দিনীর ব্যবহার অনেকাংশে ভালো হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে তানভীর নিজেও খুশি। এমন একটা সুখী পরিবারই তো চায় সবাই।
২৭.
রায়ান আর অনু সামনাসামনি বসে আছে। দুজনের চোখ দুজনের দিকে। রায়ানের অনুরোধে অনু আজ ভার্সিটিতে না গিয়ে রায়ানের অফিসে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনু নিজেই বললো,
“কেন ডেকেছো আমায়?”
রায়ান অনুর চোখের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো,
“ভালোবাসি তাই!”
“মানে?”
“মানে আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
“কিন্তু আমাদের সম্পর্ক শেষ।”
“অনু প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে সত্যি অনেক বেশি ভালোবাসি। আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে। অন্যায় করেছে আমার ভাই। আমি তো অন্যায় করিনি। তাহলে আমার ভাইয়ের শাস্তি আমি কেন পাবো?”
“কারণ ঐ পরিবারে বউ হয়ে গিয়ে আমি সংসার করতে পারবো না।”
“আমি যদি পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায় তাহলে?”
“আমাকে যে তুমি তোমার ভাইয়ের মতো ছেড়ে যাবে না তার কী গ্যারান্টি আছে?”
“এটুকু বিশ্বাস নেই তোমার আমার উপরে? তুমি কী সত্যি আমাকে ভালোবাসো না অনু?”
রায়ানের এমন আটকে যাওয়া কন্ঠস্বর শুনে অনুর ও প্রচন্ড খারাপ লাগছে। অনু নিজেও ভালো নেই রায়ানকে ছাড়া।
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমার জীবনে আবার ফিরে আসবো। কিন্তু এই কথা ততদিন অবধি তুমি কাউকে জানাবে না যতদিন পর্যন্ত আপু নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। ওকে?”
অনুর কথা শুনে রায়ান খুশিতে অনুকে কোনোকিছু না ভেবেই কথা দিলো,
“ঠিক আছে। অজান্তা ভাবির স্বপ্ন যেদিন পূরণ হবে তারপরই আমি তোমাকে নিজের বউ করে নিয়ে আসবো। তার আগে নয়।”
রায়ানের কথা শুনে অনু হেসে বললো,
“ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে।”
“তাহলে এতদিন দূরে ছিলে কেন অনু? আমার যে এতদিন তোমাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হয়েছে।”
“আমার কাছে যে আর কোনো উপায় ছিল না রায়ান৷ আপুর কষ্ট ভারাক্রান্ত মুখ আমি দেখতে পারছিলাম না। তখন তোমার সাথে রাগের বশবর্তী হয়ে সম্পর্ক শেষ করি। কিন্তু এখন আপুও মুভ অন করার চেষ্টা করছে। আর আমিও তোমাকে ছাড়া ভালো নেই। ভালোবাসার মানুষটা কাছে না থাকলে যে ভালো থাকা যায় না সেটা আমি তোমার থেকে দূরে গিয়ে বুঝতে পেরেছি। আর কখনো আমি তোমার থেকে দূরে যাবো না কথা দিচ্ছি।”
অনুর কথা শুনে রায়ান কিছু একটা ভাবলো। তারপর মুচকি হেসে অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভালোবাসি জান। খুব খুব খুব ভালোবাসি তোকে। তুই থাকলেও আমি তোকে ভালোবাসি। আর তুই না থাকলেও আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি।”
রায়ানের এমন শীতল কন্ঠের কথা শুনে অনু হাসলো। এমন একটা মানুষকে ছেড়ে গিয়েছিল ভাবতেই রাগ হয় নিজের উপরে। আবার কষ্ট ও হয়। রাগ আর কষ্ট! এই দুইয়ের সংমিশ্রণে যে অনুভূতি সেটা ব্যক্ত করা প্রকৃত অর্থে বেশ কঠিন।
২৮.
রাজ আজও রং আর তুলি নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে। দুই চোখে ক্রোধ আর ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি। হঠাৎই পেইন্টিং এর উপর লাল রং দিয়ে ক্রস চিহ্ন এঁকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
“অজান্তা! তোমাকে আজও একইভাবে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি মানুষ। তুমি কেন পাখি হয়ে ডানা উড়াবে? তোমার এই উড়ন্ত স্ববাব আমার মোটেও পছন্দ না। তোমার কী মনে হয়? তোমাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি? উহুম, না জানু। আমি তোমাকে ছাড় দিয়েছি। ছেড়ে দেইনি। আমি দেখতে চাই তুমি কতটা উড়তে পারো। যেদিন তোমার ডানা ঝাপটানো বেশি হবে সেদিন নিজ দায়িত্বে সেই ডানা ছেঁটে দিয়ে তোমাকে আবার আমার বক্ষপিঞ্জিরাতে ঠাঁই দিবো। আর সাথে শাস্তি তো আছেই। তুমি আমাকে ঠকিয়ে ঠিক করোনি জানু। এর জন্য তো তোমাকে শাস্তি পেতে হবেই। খুব কঠিন শাস্তি দিব আমি তোমাকে। কিন্তু তখন আর তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না। ছেড়ে যাওয়ার সকল পথ আমি বন্ধ করে দিবো।”
কথাটা বলেই রাজ একটা ছবির দিকে তাকালো। চোখ দুটো ছলছল করছে। যেন এখনই দু’ফোটা অশ্রু চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। বিশেষ করে রাজদের মতো ছেলেদের একদম কাঁদতে নেই। তাদের জন্য কাঁদা যে নিষিদ্ধ!
২৯.
রায়হান সাহেবের বাড়িতে আশা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সবার মন জয় করে ফেলেছে। এখন এই বাড়িতে কেউ আসলে বুঝতেই পারবে না আশা এই বাড়ির আশ্রিতা। রিশার সাথে আশার সখ্যতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। দুই বান্ধবী এখন এক মুহূর্ত একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকে না। আশাকে বাইরের একটা ঘরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেও পরে রিশার সাথে থাকার অনুমতি দেন রায়হান সাহেব। আনোয়ারা বেগম আশাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসেন। রায়হান সাহেবের বড়ো মেয়ে নিপা প্রথম যখন আশাকে দেখে তখন একটু সন্দেহের চোখে দেখলেও পরবর্তীতে আশার অমায়িক ব্যবহার দেখে খুশি হয়েছেন। কিন্তু বাড়ির সবার মন জয় করতে পারলেও আশা মিনু বেগমের মন গলাতে পারেনি এখনো। মিনু বেগম সব সময় কটমট চোখে তাকায় আশার দিকে। প্রথম প্রথম মিনু বেগমের এমন ব্যবহারে কষ্ট পেলেও পরে আশা লেগে পড়ে মিনু বেগমকে খুশি করার জন্য। কিন্তু মিনু বেগমকে আশার কাছে খুব কঠিন মনের মানুষ মনে হয়। এখন পর্যন্ত একটুও মন গলাতে পারলো না। তবুও নিরাশ না হয়ে আশা মিনু বেগমকে নানাভাবে খুশি করার চেষ্টা করে, হাসানোর চেষ্টা করে। সব মিলিয়ে আগন্তুক মেয়েটি নিজের মিষ্টি হাসি আর অমায়িক ব্যবহার দিয়ে সহজেই সবার মনে জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আশা নামক আগন্তুক মেয়েটি আসলে কে? এবং কী চায়? সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আশার আসল পরিচয় জানার জন্য। তবে এই বিষয়ে আশাকে কিছু বললেই সে এড়িয়ে যায়। মন খারাপ করে চুপচাপ বসে থাকে। তাই আর কেউ কিছু বলে না আশার পরিচয় নিয়ে। সবাই চায় আশা নিজেই যেন সবাইকে বলে, কে সে? কী তার উদ্দেশ্য?
চলবে…