#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-৬
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা
২১.
“I’m Raped!”
সামনে বসে থাকা মেয়েটির কথা শুনে তানভীর ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। বোরকা পরিহিতা একটা মেয়ে চোখেমুখে দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে আছে চেয়ারে। একটা ওড়না দিয়ে কোনো রকমে মুখ ঢেকে রেখেছে মেয়েটি। হাতে একটা স্মার্টফোন আর ছোট হ্যান্ড ব্যাগ।
তানভীর মেয়েটাকে দেখে একটা খাতা আর কলম বের করলো পাশের ড্রয়ার থেকে। তারপর মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“পুরো ঘটনা খুলে বলুন।”
তানভীরের কথা শুনে মেয়েটা মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে বলতে আরম্ভ করলো,
“আমি রিংকি। বাড়ি মিরপুরে। আমার বিগত কয়েক মাস আগে, এই প্রায় আট/নয় মাস আগে রাজ নামের একটি ছেলের সাথে পরিচয় হয় একটা নাইট ক্লাবে। তারপর প্রায়ই আমাদের দেখা হতো ক্লাবে। একদিন ডান্স পার্টনার হিসেবে আমি রাজের সাথে ডান্স করি। তারপর থেকেই আমাদের টুকটাক কথা হতো। একদিন রাজ আমাকে প্রপোজ করে। আমারো রাজকে ভালো লেগেছিল। তাই হ্যা বলি। এরপর একদিন রাজ হুট করেই আমাকে নিয়ে একটা হোটেলে যায়। আর সেদিন জোরপূর্বক সে আমার সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ হয়। আমি অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ওর থেকে রক্ষা করতে পারিনি। সেদিন রাজ সবটা ভিডিয়ো আকারে রেকর্ড করে। আর আমাকে হুমকি দিতে থাকে ভিডিয়ো ভাইরাল করবে এই বলে। এভাবে একাধিকবার সে আমার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করে। এক সময় আমার শরীর খারাপ হলে আমি ডক্টরের কাছে যায়। ডক্টর আমাকে বেশ কিছু টেস্ট করতে দেয়। তখনই জানতে পারি আমি প্রেগন্যান্ট। এখন আমি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি রাজকে এই কথাটা জানায় এবং বলি আমাকে বিয়ে করতে। রাজ যে বিবাহিত ছিল সেই কথাটা আমি জানতাম না। তাই সে আমাকে বিয়ে করতে নারাজ। আমি পুলিশের কাছে যাবো বললে সে আমাকে এবং আমার অনাগত সন্তানকে শেষ করে ফেলবে বলেও হুমকি দেয়।”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো রিংকি। তানভীর রিংকির সব কথা নোট করে ওর দিকে তাকালো।
“আপনার আগেই উচিত ছিল আমাদের কাছে আসা। কিন্তু এতদিন দেরি কেন করলেন?”
“আমি ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করে আমি আপনাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি। দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে।”
“আচ্ছা আপনি শান্ত হোন। আপনার নাম, ঠিকানা এবং যোগাযোগের নাম্বার দিয়ে যান। আমি আমার টিমের সাথে কথা বলে খুব শীঘ্রই এর একটা ব্যবস্থা নিব ইনশাআল্লাহ।”
“স্যার আমি সুবিচার পাবো তো?”
“ধৈর্য ধরুন। এমন কেস অহরহ আসে আমাদের কাছে। আমরা প্রকৃত দোষীকে ধরলেও টাকার বিনিময়ে জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায় অনেকে। তাই আপনার প্রয়োজন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রমাণ।”
“আমার কাছে ওর হুমকি দেওয়ার সমস্ত কল রেকর্ড, ম্যাসেজের স্ক্রিনশর্ট আর সেই ভিডিয়োটা আছে।”
“সেগুলো সাথে করে এনেছেন?”
“না। আমি এক প্রকার পালিয়ে এখানে এসেছি। ঐ পেনড্রাইভটা এখন আমার কাছে নেই।”
“ঠিক আছে। আপনি আগামী পরশু সকল প্রমাণ নিয়ে এখানে আসবেন। ততক্ষণে আমি আমার টিম নিয়ে রাজ নামক সেই আসামীকে খুঁজতে শুরু করবো। বাকি আর কোনো তথ্য প্রয়োজন হলে আমরা নিজে থেকেই আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। এখন আপনি আসতে পারেন।”
“জি আচ্ছা।”
কথাটা বলেই রিংকি দুশ্চিন্তা এবং ভয় মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসলো। এখন বাসায় যাওয়া ওর জন্য নিরাপদ না। তাহলে এখন কোথায় যাবে রিংকি? ভাবতে ভাবতেই উল্টো পথে হাঁটা দিলো সে।
২২.
“এই অনু আজ রায়ান ভাইয়া তোর সাথে দেখা করতে আসেনি ক্যাম্পাসে?”
রাইমার কথায় অনু ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“না।”
“কেন? আগে তো প্রায় প্রতিদিন আসতো। রায়ান ভাইয়াকে দেখে মনে হতো সেও যেন আমাদের ভার্সিটিরই একজন। তোর খাতিরে আমাদের ভার্সিটির মোটামুটি সবাই এখন রায়ান ভাইয়াকে চেনে। কিন্তু এখন কী ভাইয়ার কাজের চাপ বেশি?”
“ওর সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই রাই।”
অনুর কথা শুনে রাইমা বিস্ময়কর চাহুনি নিয়ে তাকালো ওর দিকে।
“এসব তুই কী বলছিস দোস্ত? তোরা না একে-অপরকে অনেক ভালোবাসিস?”
“সব ভালোবাসা কী পূর্ণতা পায়?”
ক্যাম্পাসের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে অনু। পাশেই রাইমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে।
“কিন্তু তোদের সম্পর্কের কথা তো সবাই জানে। তোদের পরিবারও জানে তাই না?”
“হ্যা। কিন্তু এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা আর সম্ভয় নয়।”
“কিন্তু কেন?”
“সব ‘কেন’ এর উত্তর হয় নারে। কিছু কিছু ‘কেন’ তৈরি হয় শুধুমাত্র গোলকধাঁধায় আটকানোর জন্য। আর এই গোলকধাঁধা ভাঙ্গতে প্রয়োজন সেই মানুষটাকে যাকে ঘিরে এত প্রশ্ন।”
“দিন দিন তুই কেমন জানি হয়ে যাচ্ছিস রে অনু। এত কঠিন কঠিন সব কথা বলিস যে আমার ছোট মাথায় এই কথাগুলো ঢুকতেই পারে না।”
রাইমার কথায় অনু একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।
“সময় আসুক। তুই ও এমন কথার অর্থ বুঝবি এবং নিজেও আমার মতো গম্ভীর হয়ে কথাগুলো আরেকজনকে বলবি। আমরা সবাই যে সময়ের দাস!”
“হয়েছে হয়েছে। তোকে আর এত ভাষণ দিতে হবে না। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো আছি। তোর মতো হওয়া লাগবে না আমার। কিন্তু রায়ান ভাইয়া সত্যি অনেক ভালো ছেলে। তার ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখ। একটা সম্পর্ক তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। অথচ সেই সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য একটা মিথ্যা কথা কিংবা একটা ভুল বোঝাবুঝিই যথেষ্ট। তাই বলছি, যা করবি ভেবেচিন্তে কর অনু।”
“আচ্ছা থাক। আমি বাড়িতে যাই। ভালো লাগছে না কিছু।”
“সাবধানে যা।”
“হুম। আসি”
“বাই বাই”
“বাই”
রাইমার থেকে বিদায় নিয়ে অনু বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটা রিক্সা ডাকলো। তারপর তাতে চড়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো অনু।
২৩.
ছাদের রেলিং ধরে এক মনে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অজান্তা। মৃদু বাতাসের তালে তালে অজান্তার মাথার চুলগুলো খেলা করছে। মাঝে মাঝে কিছু চুল অজান্তার চোখমুখে এসে বারি খাচ্ছে। অজান্তা সেই চুলগুলো সরাচ্ছে না। সে তো এখন এসব বুঝতেই পারছে না। নিজের জীবনের গতিবেগ নির্ণয় করতে ব্যস্ত এখন অজান্তা। ইন্টারে ওঠার পর প্রথম রাজের সাথে ওর পরিচয় হয়। একটা সম্পর্কের শুরু হয় প্রথম দেখা থেকে। তারপর আসে ভালোলাগা, মুগ্ধতা, টান, মায়া, ভালোবাসা। আর সর্বশেষ বিচ্ছেদ! অজান্তা তো চেয়েছিল সম্পর্কটাকে ভালোবাসা অবধি সীমাবদ্ধ রাখতে। কিন্তু মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না বলে আজ তার ভালোবাসার মানুষটা ভালোবাসার সম্পর্ককে বিচ্ছেদের রূপ দিয়েছে। রাজ চেয়েছিল অজান্তাকে সবার আড়ালে রাখতে। শুধুমাত্র নিজের করে রাখতে চেয়েছিল অজান্তাকে। তাই তো ভার্সিটি বা মেডিকেলেও চান্স নিতে দেয়নি৷ বোকা অজান্তা নিজের ভালোবাসার জন্য স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা সব বিসর্জন দিয়েছিল। কিন্তু যে মানুষটার জন্য এত আত্মত্যাগ। আজ সেই মানুষটা তার ভালোবাসার মূল্য দিলো না। একটা সন্তানের জন্য তাকে ছেড়ে দিলো। এই কথাটা বিশ্বাস করতে খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছে অজান্তার।
মাগরিবের আজানের আওয়াজ পেয়ে মাথায় কাপড় টেনে চোখের কোণের পানি মুছে নিচে নেম গেল অজান্তা। আজ থেকে আর কোনো বেঈমানের কথা ভাববে না সে। একদমই ভাববে না রাজ নামক সেই মানুষটার কথা যে তার গুরুত্ব বোঝেনি, তাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেনি।
চলবে…