#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-৫
#লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা
(প্রথমেই পর্ব ৪ এর কথা বলি। গত পর্বে মেডিকেল এর বিষয়টা দুই বছর হবে। এবং প্রথমে আমি দুই বছরই লিখেছিলাম। কোনোভাবে টাইপিংয়ের জন্য দুইয়ের জায়গায় তিন হয়ে গেছে। তার জন্য দুঃখিত।)
১৫.
“আমি অন্তঃসত্ত্বা তানভীর!”
ল্যাপটপে নতুন কেসের ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্রহ করছিল তানভীর। তখনই নন্দিনীর এমন কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো তানভীর।
“মজা করার আর কোনো বিষয় পেলে না?”
“আমি সত্যি বলছি তানভীর। আমি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা।”
নন্দিনীর কথায় তব্দা খেয়ে বসে রইলো তানভীর। বেশ কিছুক্ষণ পর মুখে মুচকি হাসির রেখা টেনে নন্দিনীর দিকে তাকালো তানভীর।
“তাহলে তো এটা খুশির সংবাদ। সবাইকে জানাও এই কথাটা।”
তানভীরের এমন ব্যবহারে নন্দিনী অবাক হলো। সে ভেবেছিল তানভীর রাগ করবে। কারণ তানভীর তো নন্দিনীকে খুব একটা পছন্দ করে না ওর এমন বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য। নন্দিনীর ভাবনায় ছেদ ঘটলো তানভীরের ডাকে।
“কী হলো নন্দু? যাও এই খুশির সংবাদটা সবাইকে জানাও।”
“আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই নন্দিনী হাসিমুখে বাইরে চলে গেল সবাইকে এই খবরটা জানানোর জন্য। তানভীর দরজার দিকে তাকিয়ে পুনরায় মুচকি হাসলো। তারপর আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো।
১৬.
নিজের ডেস্কে বসে থেকে এক মনে কিছু একটা ভাবছে রায়ান। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিছু একটা ভেবে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো রায়ান। তখনই ভেতরে একজন ক্লায়েন্ট প্রবেশ করলো।
রায়ান পেশায় একজন আইনজীবী। রাজের থেকে রায়ান মাত্র এক বছরের ছোট। রাজ পড়ালেখায় তেমন একটা মনোযোগী ছিল না। ছোটো থেকেই রাজের ধ্যান, জ্ঞান সবই ছিল ছবি আঁকা নিয়ে। কিন্তু রায়ান পড়ালেখায় বেশ ভালো। ওর স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হওয়ার। তাই লেখাপড়াও করেছে ‘ল’ নিয়ে। গত বছরই নিজেকে আইনজীবী হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরে রায়ান। তারপর থেকেই রায়ান মোটামুটি ভালো সুনাম অর্জন করেছে মাত্র কয়েক মাসেই।
ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলা শেষ করে কোনো একটা কাজের জন্য বেরিয়ে গেল রায়ান। বের হওয়ার সময় নিজের গাড়িটাও সাথে নিলো না সে। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো তাতে। ব্যাপারটাতে সবাই কিছুটা বিস্মিত হলো। নিজের গাড়ি থাকতে রিকশায় চড়ে যাওয়ার মানেটা কেউ বুঝলো না।
১৭.
পড়ার টেবিলে বসে আছে অনু। হাতে একটা পেন্সিল নিয়ে খাতায় আকিঁবুকিঁ করছে। কিন্তু কী আঁকছে সেটা সে নিজেও জানে না। চোখটা খাতার দিকে থাকলেও মনটা তার অন্যকিছু ভাবতে ব্যস্ত। নিজের কাজগুলো ঠিক হচ্ছে কিনা সেটাই বুঝতে পারছে না অনু। এভাবে খেলতে খেলতে সে নিজেই নিজের জালে আটকা পড়বে না তো! এমন সব অদ্ভুত চিন্তা ভর করেছে তার মাথায়।
দরজায় টোকা পড়ার আওয়াজে ধ্যান ভেঙ্গে গেল অনুর। চোখ দুটো বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে মায়ের ডাকে ঘরের বাইরে চলে গেল সে।
১৮.
আজ সকালে গিয়ে কোচিং আর তিনটা প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে এসেছে অজান্তা। লেখাপড়া থেকে প্রায় দুই বছর দূরে থাকার কারণে এখন ভয় হচ্ছে। সে পারবে তো মেডিকেল পরিক্ষায় টিকতে? মাত্র দুই মাসে কীভাবে পুরো সিলেবাস সম্পূর্ণ করবে সে? এই পরিক্ষায় সে উত্তীর্ণ না হলে জীবন কোন দিকে মোড় নেবে? এমন অনেক কথায় ভাবছে অজান্তা। এইচএসসি এর পর রাজ আর অজান্তাকে পড়তে দেয়নি। রাজকে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসার ফলে নিজের ডক্টর হওয়ার স্বপ্ন সেই দুই বছর আগেই বিসর্জন দিয়েছিল সে। কিন্তু এখন সেই মানুষটাই যখন তার জীবনে নেই, এই তো সময় নিজের স্বপ্ন পূরণ করার। যেভাবেই হোক মেডিকেলে চান্স তাকে পেতেই হবে। মনে মনে এমন প্রতিজ্ঞা করে পড়ায় মনোযোগ দিলো অজান্তা। দিন-রাত এক করে হলেও পুরো সিলেবাস সে সম্পূর্ণ করে তবেই ক্ষান্ত হবে। নয়তো যে তার স্বপ্ন মাঝ পথে এসে আবারো সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় ভেসে যাবে বহুদূরে। যেখান থেকে স্বপ্নকে ফিরিয়ে আর কোনোক্রমেই সম্ভব নয়!
১৯.
এক মনে নিজের হাতে থাকা রংতুলি দিয়ে কিছু একটা আঁকছে রাজ। লাল, নীল, সাদা, কালো, হলুদ, সবুজ সব রংয়ের সংমিশ্রণে কী এমন আঁকছে রাজ? তা সাধারণ মানুষের বোঝার সাধ্য নেই। এ যেন কোনো পেইন্টিং নয়। একগুচ্ছ রংয়ে লেপ্টে থাকা অদ্ভুত ছবি। দেড় ঘন্টা ধরে সবগুলো রং একত্রিত করে এমন বিচ্ছিরি ছবি আঁকবে রাজ তা হয়তো সবার কল্পনার বাইরে। কারণ, রাজের আঁকা প্রতিটা ছবি খুব সুন্দর হয়। তাহলে আজ এমন অদ্ভুত ছবি আঁকার কারণ কী? রাজের আঁকা ছবিটা দেখলে সবাই এই কথাটা বলবে এটা নিশ্চিত। রাজ ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর হঠাৎই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। রাজের এই ছবি আঁকার ঘরে শুধু ছবি আঁকার জিনিসপত্র। তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই। তাই রাজের এমন হাসি প্রতিধ্বনি হতে লাগলো বারংবার। রাজ হাসতে হাসতেই ছবিটার দিকে তাকালো। তারপর নিজের হাতে লেগে থাকা রংয়ের ঘ্রাণ নিতে থাকলো সে। সামান্য রংয়ের ঘ্রাণে উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগলো সে। হঠাৎ কী হলো রাজের? তা সে নিজেও জানে না!
২০.
টাঙ্গাঈল! এই টাঙ্গাঈলেই অবস্থিত বাংলাদেশের বিখ্যাত যমুনা নদী। এই নদীর বিস্তৃতি সুবিশাল। চোখ যতদূর যায় শুধু পানি আর পানি! নদীর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত একটি গ্রামে হুট করে একজন মেয়ের আবির্ভাব হয়েছে। যে কিনা নিজের নাম, ঠিকানা কিছুই বলতে রাজি নয়। শুধু একটা কথায় বারবার বলছে,
“আমাকে বাঁচান। আমার জীবন ঝুঁকিতে আছে। আমাকে একটু ঠাঁই দিন আপনাদের এই গ্রামে। কথা দিচ্ছি কারোর কোনো ক্ষতি করবো না। আমি খুব অসহায় হয়ে এখানে এসেছি। দয়া করে আমার প্রাণ বাঁচান।”
গ্রামবাসী মেয়েটাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলো। একটা সুতির শাড়ি পড়নে তার। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কোনো রকমে একটা বেনি করে রেখেছে। চোখমুখ শুকনো। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। হাতে তেমন কিছু নেই। শুধু একটা কম দামি হ্যান্ড ব্যাগ। মেয়েটাকে দেখে সবার মায়া হলো। তারপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটাকে গ্রামের মাতব্বর রায়হান সাহেবের বাড়ির পাশের উঠোনে তৈরি করা ছোট্ট ঘরে থাকতে দেওয়া হবে তাকে। এবং তার খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব ও রায়হান সাহেবের। যেকোনো সমস্যায় গ্রামের সবাইকে মেয়েটা পাশে পাবে বলেও আশ্বস্ত করলো সবাই। মেয়েটা হাসিমুখে সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রায়হান সাহেবের মেয়ে রিশার সাথে তাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। রায়হান সাহেবের দুই মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলে বিদেশে থাকে পড়াশোনার জন্য। বড়ো মেয়ে নিপার বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এখন শুধু ছোটো মেয়ে রিশা আছে বাড়িতে। রিশার মা আনোয়ারা বেগম খুব মিশুকে স্বভাবের। বাড়িতে নতুন অতিথী পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন তিনি। কিন্তু আনোয়ারা বেগমের শাশুড়ীর মোটেও পছন্দ হয়নি আগন্তুক এই মেয়েকে। চেনা নেই, জানা নেই কোত্থেকে এসেছে এই মেয়ে কে জানে। তাকে আবার নিজের বাড়িতে এনে ঠাঁই দিলো তার ছেলে। সেই মেয়েকে নিয়ে আবার ছেলের বউয়ের এমন আদিখ্যেতা একদমই সহ্য হচ্ছে না মিনু বেগমের। এজন্য সবার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙ্গচি দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে খিল এটে দিলেন মিনু বেগম। সবাই মিনু বেগমের এমন কান্ডে হেসে ফেললো। এ নতুন কিছু না। প্রায়ই মিনু বেগম এমন সব কান্ড করেন যা দেখতে পুরো বাচ্চাদের মতো লাগে।
আনোয়ারা বেগম মেয়েটার সাথে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। একের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। মেয়েটাও হাসিমুখে সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজের পরিচয় দিতে রাজি নয়। নিজের নামটা পর্যন্ত সে বলতে চায় না। আগন্তুক মেয়ের নাম না জানার জন্য আনোয়ারা বেগম নিজেই নতুন নাম দিয়ে দিলো মেয়েটিকে।
“আশা!”
মেয়েটি নিজের নতুন নাম শুনে মুচকি হেসে আবারো কথা বলতে শুরু করলো সবার সাথে।
চলবে…