মাতৃত্বের স্বাদ পর্ব – ৪

0
2164

#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-৪
#লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

১২.

“রাজ!”

একটা মেয়েলি কন্ঠের চিৎকার শুনে ছিটকে সরে গেল রাজ আগন্তুক মেয়েটির থেকে। দরজার কাছে রিংকি দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিমূর্তির ন্যায়। রাজ এখানে রিংকিকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললো,

“রিংকি তুমি এখানে।”

রিংকি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রাজের কথা শুনে।

“কেন? আমাকে এখানে দেখে বুঝি খুব অবাক হলে? অবাক হওয়ার তো কিছু নেই রাজ। আমাদের তো এই নাইট ক্লাব এই প্রথম পরিচয় হয়েছিল।”

“কিন্তু তুমি তো অনেক দিন এখানে আসোনি।”

“হ্যা আসিনি। আজ বন্ধুদের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু এসেই যে এমন চমকপ্রদ কিছু দেখবো সেটা ভাবিনি।”

“রিংকি তুমি ভুল ভাবছো।”

তখনই পাশের মেয়েটা রাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“কে এই মেয়ে রাজ?”

রাজের উত্তর দেওয়ার আগেই রিংকি বললো,

“আমি কে সেটা বাদ দাও। কিন্তু তুমি কে?”

“আমি রাজের গার্লফ্রেন্ড!”

কথাটা শুনেই রিংকি রাজের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

“ছিঃ রাজ ছিঃ। তুমি এত খারাপ? প্রথমে নিজের স্ত্রীকে ছাড়লে। তারপর আমার সাথে সম্পর্ক করে আমাকে অন্তঃসত্ত্বা বানালে। আর এখন আরেকটা মেয়ের সাথে নতুন করে রিলেশন! মানুষ এতটা নিচ কীভাবে হতে পারে সেটা তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। এতদিন তুমি আমাকে ঠকিয়েছো। এবার দেখ তোমার সাথে ঠিক কী কী হয়!”

কথাটা বলেই রিংকি কাঁদতে কাঁদতে ক্লাব থেকে বের হয়ে গেল। রাজ রিংকির যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে।

“রাজ ঐ মেয়েটা যা যা বললো সব সত্যি?”

“রিয়া প্লিজ চুপ করো। আমি পরে তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। এখন আমাকে যেতে হবে।”

রাজ কোনো রকমে ওর গাড়ির চাবিটা টেবিলের উপর থেকে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ক্লাব থেকে। পার্কিং লটে এসে গাড়ি বের করে সোজা চলে গেল রিংকির ফ্ল্যাটে। রিংকিকে আটকাতে হবে। রিংকি যদি কোনোভাবে পুলিশের কাছে যায় তো রাজের সব শেষ হয়ে যাবে। এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই। কখন কী করে রাজকে ফাঁসিয়ে দিবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভয়ে এই শীতেও রাজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দ্রুত গাড়ি ড্রাইভ করে রিংকির ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই হতাশ হলো রাজ। দরজায় তালা ঝুলছে। তার মানে রিংকি এখনো বাসায় আসেনি। তাহলে সে গেল কোথায়?

এসব ভেবেই রাজের গলা শুকিয়ে আসছে। এখন কোথায় গিয়ে রিংকিকে খুঁজবে সে, এটা ভাবতে ভাবতেই গাড়িতে গিয়ে বসলো রাজ।

১৩.

“মা আমি আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করতে চাই।”

অজান্তার মুখে এমন কথা শুনে রেহেনা বেগম আর অনু দু’জনেই অনেক খুশি হলো।

“সত্যি বলছিস তুই আপু?”

“হ্যা অনু। আমি নতুন করে সবটা শুরু করতে চাই।”

“গতকাল তোর বাবার সাথে কথা বললাম তোর বিষয়ে। তোর বাবা তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন তো তুই ঘুম। আজকে বাবার সাথে কথা বলে নিস অজান্তা।”

“আচ্ছা মা বলবো।”

“তোর বাবাও বললো তোকে আবার পড়াশোনা শুরু করতে।”

“কিন্তু আপু তুই কী নিয়ে পড়াশোনা করবি?”

“যেহেতু আমি সাইন্স থেকে এইচএসসি দিয়েছি। এবং আমার রেজাল্ট ও ভালো ছিল। তাই আমি মেডিকেল এ পড়তে চাই।”

“বাহ্। দারুণ সিদ্ধান্ত। সামনেই মেডিকেল এর এডমিশন। এখনো দুই মাস বাকি। এই দুই মাস তুই কোচিং করে প্রিপারেশন নে। আমি শিওর তুই চান্স পাবিই ইনশাআল্লাহ।”

অনুর কথা শুনে মুচকি হাসলো অজান্তা।

“আগেই এতটা ভাবিস না বোন। আমি প্রায় তিন বছর পড়াশোনা থেকে দূরে ছিলাম। এখন আদৌ আগের মতো ভালো পড়াশোনা করতে পারবো কিনা সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি।”

“আরে চিল। আমি জানি তুই পারবি। শুধু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর এই কয়েকদিন। বাকিসব ভুলে পড়াশোনায় ফোকাস কর।”

“হ্যা তাই করবো। অনেক তো অন্যের জন্য সময় নষ্ট করলাম। এবার সময় এসেছে নিজেকে নিয়ে ভাবার।”

“তাহলে তুই অনুর সাথে গিয়ে পছন্দ অনুযায়ী কোচিং, প্রাইভেটে ভর্তি হয়ে আয়।”

“আচ্ছা মা ঠিক আছে। আগামীকালই অনুর সাথে গিয়ে আমি ভর্তি হয়ে আসবো।”

কথাটা বলেই অজান্তা ফুরফুরে মেজাজে নিজের ঘরে চলে গেল। তিন দিন পর আজ অজান্তা নিজের ঘর থেকে বাইরে বের হয়েছে। আগের তুলনায় আজকে অজান্তাকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখে রেহেনা বেগম আর অনু ভীষণ খুশি। এখন সবটা নতুন করে শুরু করার পর আর কোনো ঝামেলা না আসলেই হয় অজান্তার জীবনে এটাই প্রার্থনা করছে রেহেনা বেগম উপরওয়ালার কাছে।

১৪.

ভার্সিটির ক্যাম্পাসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অনু আর রায়ান। কেউ কারোর সাথে কথা বলছে না। দু’জনেই কথা বলতে চাইছে। কিন্তু একটা অদৃশ্য দেয়াল ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যার জন্য চাইলেও অনুর কথা রায়ান শুনতে পারবে না। আর রায়ানের কথা অনু শুনতে পারবে না। অনু খুব করে চাইছে যেন রায়ান নিজে থেকে ওকে কিছু বলে। অন্যদিকে রায়ান ভাবছে, কোন মুখে অনুর সাথে কথা বলবে সে। মনে মনে এতকিছু ভাবার জন্যই দশ মিনিট ধরে একে-অপরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো কথা বলতে পারছে না কেউ। তখনই অনুর এক ক্লাসমেট রাইমা অনুর কাছে এসে বললো,

“এই অনু তুই এখানে কী করছিস? সেই তখন থেকে আমি তোকে খুঁজছি।”

“কেন রাই? কী হয়েছে? তুই আমাকে খুঁজছিস কেন?”

“আগামী পরশু আমার জন্মদিন। তো আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি ভার্সিটির পাশের ক্যাফেতে একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করবো। তুই হলি আমাদের সবার বিশেষ অতিথি।”

“কেন রে? জন্মদিন তোর। আর বিশেষ অতিথি আমি কেন?”

“কারণ তুই ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে অনেক সচেতন। আমরা সবাই ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়েও কখনো তোকে টপ টেন থেকে সরাতে পারিনি। তাই আমার জন্মদিনের সকল আয়োজন তুই নিজে করবি।”

“ওহ্ আচ্ছা এই ব্যাপার। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব করে দিবো।”

তখনই রাইমার নজর গেল রায়ানের দিকে। রায়ান রাইমার বয়ফ্রেন্ড সায়েমের ফ্রেন্ড।

“আরে রায়ান ভাইয়া যে। এই নিন ইনভাইটেশন কার্ড। আপনিও আসবেন কিন্তু।”

কথাটা বলেই রাইমা রায়ানের দিকে একটা ইনভাইটেশন কার্ড এগিয়ে দিলো। রায়ান কার্ডটা নিয়ে বললো,

“আসতে পারবো তার নিশ্চয়তা দিতে পারলাম না। তবে চেষ্টা করবো।”

“এটা কেমন কথা ভাইয়া? আপনাকে আসতেই হবে। এমনিতেও আপনি সায়েমের অনেক ভালো বন্ধু। তাই আপনাকে তো আসতেই হবে।”

রাইমার কথা শুনে রায়ান হেসে বললো,

“আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন আমি আসি।”

কথাটা বলেই রায়ান একবার অনুর দিকে তাকিয়ে চলে গেল। অনু ও একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাইমার সাথে অন্যদিকে চলে গেল।

এতক্ষণ দাঁড়িয়েও কেউ কারোর সাথে কথা বলতে পারলো না। এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে? সেটা জানা নেই অনুর।

একদিকে অনু ভাবছে রায়ান ইগো দেখিয়ে ওর সাথে কথা বললো না। এটা নিয়ে কষ্ট পেয়ে চুপ করে গেল সে। আরেকদিকে রায়ান অনুতাপের আগুনে পুড়ছে প্রতিনিয়ত। নিজের বড়ো ভাইয়ের জন্য নিজের ভালোবাসাকে হারানোর মতো কষ্ট বোধ হয় আর কোনোকিছুতে নেই এটাই ভাবে রায়ান। বাড়িতে গিয়েও চুপচাপ থাকে। রাজকে দেখলেই সেই জায়গা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় রায়ান। তবে আজ অনু চাইলেই কথা বলতে পারতো। কিন্তু রায়ানও ভাবছে অনু হয়তো ইগো দেখিয়ে ওর সাথে কথা বলেনি।

দু’জন দুই প্রান্তে শুধু মনের মধ্যেই একের পর এক উল্টাপাল্টা ভেবে যাচ্ছে। এই ভাবনার ফল কতটা তেতো হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সম্পর্কের অবনতির জন্য একটা ভুল সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। যা অনু আর রায়ান ইতোমধ্যেই করে ফেলেছে। দু’জনেই কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কেউ কারোর সাথে কথা বলছে না। শুধু নিজেদের মধ্যে এক পাহাড় সমান অভিমান আর অভিযোগ জমিয়ে রেখেছে। এই পাহাড় সমান অভিমান আর অভিযোগ কতদিনে শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কিনা এটাই এখন দেখার বিষয়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে