#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-১৪
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা
৪৫.
দেখতে দেখতে ছয় মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এই ছয় মাসে তিনটা পরিবার পুরোপুরি পাল্টে গিয়েছে। রাজ, তানভীর আর অজান্তার পরিবারে নেমে এসেছে অমাবস্যার অন্ধকার। প্রিয়জনের হঠাৎ চলে যাওয়াতে বাক্যহীন এই তিন পরিবারের প্রতিটি মানুষ।
তানভীর নিজের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে দুই চোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে বসে আছে।
“নন্দিনী ভাবিনি এভাবে হেরে যাবে তুমি। তোমার জ্বালে তুমিই ফেঁসে গেলে। গত বছর যখন তুমি আমাকে তোমার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবরটা জানালে তখন আমি নিরব ছিলাম। কারণ আমি তোমার প্ল্যানের ব্যাপারে সব জানতাম। তুমি সেদিন রাতে তোমার বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় আমি আড়ালে থেকে সব কথা শুনেছি। হ্যা, বাবা আমাদের সমস্ত সম্পত্তি আমার আর ভাইয়ার ভবিষ্যৎ বাচ্চার নামে সমানভাবে লিখে দিয়েছে। এই কথাটা বাবা আমাকে আর ভাইয়াকে গোপন রাখতে বলেছিল। কিন্তু কোনোভাবে খবরটা তুমি পেয়ে যাও। আর তারপরই আমাদের বাচ্চা নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলে তুমি। আমিও তোমার কাজে শাঁই দিয়েছি। কারণ আমি চেয়েছিলাম তোমার মতো করেই তোমাকে শাস্তি দিতে। আইনের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু তুমি নিজে থেকেই হেরে গেলে। এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে না ফেরার দেশে। বিশ্বাস করো, এমন কিছু চাইনি আমি। তোমাকে ভালো না বাসলেও তোমার মৃ*ত্যু কামনা করিনি কখনো। কি অদ্ভুত খেলা! মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে চেয়েছিলে সম্পত্তির লোভে। অথচ সেই সম্পত্তি পাওয়ার আগেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে তুমি।”
নিজের মনে কথা গুলো বলেই হাত থেকে নন্দিনীর ছবিটা সরিয়ে রাখলো তানভীর। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তানভীরের মন অশান্ত হয়ে আছে। না, নন্দিনীর জন্য নয়। নন্দিনী তার করা পাপের শাস্তি পেয়েছে। স্বয়ং উপরওয়ালা নন্দিনীকে তার করা পাপের শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু তানভীর ভালো নেই। ভালো নেই নিজের করা ভুলের জন্য। ছোট্ট একটা ভুলের কারণে নিজের ভালোবাসাকে আবার হারিয়ে ফেলেছে সে।
৪৬.
রাজের কবরের পাশে বসে আছে রায়ান। চোখ থেকে নির্দ্বিধায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। রায়ানের হাতে রাজ আর রায়ানের ছোট বেলার একসাথে তোলা সাদাকালো একটা ছবি। রায়ানকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাজ। দুজনের মুখেই প্রাণোচ্ছল হাসি। ছবিটা দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলো রায়ান।
“ভাইয়া কোথায় তুই? তোকে ছাড়া আমি ভালো নেই ভাইয়া। হুম, তুই অন্যায় করেছিস। অনেকের জীবন নিয়ে খেলেছিস। তার জন্য ফাঁ*সির দড়িতেও ঝুলেছিস। নিজের চোখে নিজের ভাইকে মর*তে দেখেছি আমি। কিন্তু শত হলেও তুই তো আমার ভাই। আমার আপন ভাই। তোর সাথে তো আমার রক্তের টান আছে। সেই তোকে হারিয়ে আমি ভালো নেই ভাইয়া। ভালো নেই আমি। আমার জীবন থেকে যে একসাথে দুই দুইজন প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেল। কী করে ভালো থাকবো আমি? আমার ভালো থাকার সমস্ত কারণ যে আজ বিলুপ্ত প্রায়।”
৪৭.
গভীর রাত। ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কনকনে শীতের মধ্যেও গায়ে শুধু একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে অজান্তা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে জট লেগে আছে। বোঝাই যাচ্ছে ঠিকমতো এই চুলে চিরুনি লাগানো হয়না আর। ফোলা চোখগুলো লাল টকটকে। যেন র*ক্ত ঝড়ে পড়বে এক্ষুনি। ওষ্ঠদ্বয় মৃদু কাঁপছে। শ্যামলতার মায়াবী মুখখানা বড্ড ভয়ংকর লাগছে আজ।
“অনু! কেমন আছিস বোন আমার? ঐ দূর আকাশের তাঁরা হয়ে ভালো আছিস? কিন্তু দেখ, আমি ভালো নেই রে। একদম ভালো নেই। তোকে ছাড়া কী আমি ভালো থাকতে পারি বল? তুই যে আমার প্রাণভোমরা। আগেকার দিনে নাটকে দেখতাম প্রাণভোমরা হয় মৌমাছি, কাঠি, চাবি। আর এসব নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ বাঁচতো না। আগে এসব দেখে খুব হাসতাম। এ আবার হয় নাকি? মানুষের প্রাণ তো তার শরীরেই থাকে। এসব মৌমাছি, কাঠি, চাবিতে তো মানুষের প্রাণ থাকে না। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, একজন মানুষ নিশ্বাস নিচ্ছে মানেই সে বেঁচে আছে এমন নয়। আমি তো এখন জীবিত থেকেও মৃ*ত। কারণ আমার প্রাণভোমরা যে তুই। সেই তুই তো আর আমার কাছে নেই। নিজেকে খুব ঘৃণা হয় আমার। আমি যদি আর দুই সেকেন্ড আগে ওখানে পৌঁছাতে পারতাম তাহলে তানভীর তোকে মা*রতে পারতো না। আমি একজন ব্যর্থ বোন যে তার আদরের ছোট্ট পরির মতো বোনটাকে বাঁ*চাতে পারেনি। আমাকে মাফ করে দিস বোন। তোর এই ফালতু আপুটা তোকে বাঁ*চাতে পারেনি। আমাকে মাফ করে দিস।”
কথাগুলো বলতেই বলতেই ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে বসে পড়লো অজান্তা। আবারো অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাত হতে লাগলো তার চোখজোড়া থেকে। এই ছয়মাসে এমন কোনো দিন বা রাত নেই যখন অজান্তা অনুর কথা ভেবে কাঁদেনি। অজান্তার বাবা-মা ও ভেঙ্গে পড়েছেন নিজেদের আদরের ছোট মেয়ের এমন অকাল মৃ*ত্যুতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা একটু হলেও স্বাভাবিক হতে পেরেছে। স্বাভাবিক হতে পারেনি শুধু অজান্তা। কীভাবে স্বাভাবিক হবে সে? নিজের চোখের সামনে নিজের বোনের বুকে গু*লি লেগে র*ক্তের ফোয়ারা দেখা, নিজের কোলে নিজের বোনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা, নিজের হাতে নিজের বোনকে কাফনের কাপড়ে ঢেকে দেওয়া, এসব সহ্য করা তো এত সহজ নয়। অজান্তা সেই মেয়ে যে এখনো অবধি সবকিছু সহ্য করে বেঁচে আছে। অবশ্য এই বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে না। অজান্তা তো সেদিনই ম*রে গিয়েছে যখন অনুকে দাফন করা হয়।
অজান্তা কাঁদতে কাঁদতেই অনুর ছবি নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো।
“অনু জানিস? রাজের না ফাঁ*সি হয়েছে। রায়ান নিজে রাজের বিরুদ্ধে তোর হয়ে কেস লড়েছে। রায়ান ছেলেটা খুব অদ্ভুত। প্রথমে প্রতিশোধ নিতে চাইলো। তারপর আবার ভালোবাসার জন্য নিজের ভাইকে ফাঁ*সির দড়িতে ঝুলালো। আমার তো নিজের থেকে বেশি রায়ানের জন্য কষ্ট হয়। আমি তো রাজকে ভালোবেসে বিয়ে করিনি। রাজকে বিয়ে করেছিলাম প্রতিশোধের নেশায়। রাজ জানতো না তুই সেই মেয়ে যাকে ওও ড্রাংক অবস্থায় রেপ করেছিল। কারণ তোর তো প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পাল্টে ফেলেছিলাম আমরা। এরপর আগের বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় বাড়ি করলো বাবা। যার ফলে তোর কালো অতীত সম্পর্কে কেউ জানতো না। আমরা তোকে একটা সুস্থ জীবন দিতে চেয়েছিলাম। তার জন্য যা যা করার সবই করেছি। এজন্যই রাজ তোকে চিনতে পারেনি। তাই তো আমার প্রেমে পাগল হয়ে আমাকে বিয়ে করে রাজ। নিজের অজান্তেই বিয়ে করে নিজের শত্রুকে। যে শত্রু তার ধ্বংসের জন্য এসেছিল তার জীবনে। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু একদিন রাজের অবৈধ কাজের সমস্ত প্রমাণ আমার হাতে চলে আসে। রাজ এসবকিছু জেনে যায়। সেদিন থেকেই রাজ আমাকে ওর জীবন থেকে সরাতে চাইছিল। রাজ চাইলেই পারতো আমাকে ওর রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু রাজ সেটা করেনি। কারণ সে আমাকে বড্ড বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিল। রাজ আগের মতো ছিল না। আমাকে পেয়ে সে সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। কিন্তু আমাকে ওর জীবন থেকে সরানোর জন্য আবারো খারাপ হওয়ার অভিনয় করে। আমি সবই বুঝতাম। কিন্তু কিছু বলতাম না। রাজ ছেলেটা সত্যিই আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু আমি তো ওকে সহ্য ই করতে পারতাম না। তাই ওর প্ল্যান সাকসেসফুল করতে আমিও কৌশলে মা হতে না পারার নাটক করি। কি করতাম বল? তুই যে আমার জীবন ছিলি অনু। তোর জন্য আমি সব করতে পারি। তাই তো একজন মেয়ে হয়েও এত বড়ো নাটক করি শুধুমাত্র তোর জন্য। তোর সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। কিন্তু দেখ আমি ব্যর্থ। সেদিক থেকে রায়ান সফল। রায়ান ওর ভালোবাসার জন্য নিজের ভাইকে শাস্তি দিয়েছে। রায়ান কিন্তু চাইলেই পারতো রাজকে বাঁচাতে। কিন্তু ওও সেটা করেনি। সব ছেলেরা খারাপ হয় না। এই কথাটা রায়ান প্রমাণ করে দিয়েছে।”
চলবে…