#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-১৩
#রহস্য উন্মোচন পর্ব -২
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা
৪৩.
“রাজ!”
হ্যা রাজই সেই ব্যক্তি যার জন্য অনু নিজের সতিত্ব হারিয়েছে। হারিয়েছে সাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার কারণ। অনুর চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে আজ অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে।
তানভীর অনুর মুখে রাজের নাম শুনে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। চোখেমুখে হাজারো বিস্ময় নিয়ে রায়ানের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা অবাক হলো তানভীর। রায়ান মেঝের দিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কোনো বিস্ময় নেই। বরং রায়ানের সারা মুখ জুড়ে রাগের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
চারিদিকের নিরব নিস্তব্ধ শব্দবিহীন জায়গাটাকে আবারো কথার ঝুলি দিয়ে মুখরিত করে তুললো অনু। রায়ানের সামনে গিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
“তুমি তো সব জানতে রায়ান তাই না? তুমিই তো আপুকে সাহায্য করেছো সব সময়। কিন্তু এখানে তুমিও নিজের স্বার্থের জন্য এসেছো। আপুর বিয়ের সময় থেকেই তুমি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিলে। কিন্তু আমি কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। অন্তত ভালোবেসে কাছে যাওয়ার মতো ভরসা পেতাম না। কারণ আমার সেই কালো অতীত। আর সেজন্যই তুমি যখন আমাকে প্রপোজ করলে আমি সরাসরি না করে দিই। এতে তোমার ইগো হার্ট হয়। ফলস্বরূপ তোমার আবেগঘন ভালোবাসা রুপান্তরিত হয় জেদ এবং প্রতিশোধে। প্রতিশোধের নে*শায় তুমি আমার কাছে আসলে। ভালোবাসার দাবি নিয়ে বারংবার আমার সামনে এসে আমাকে দুর্বল করে দিলে। তখনো অবধি আমি কিচ্ছু জানতাম না। সরল মনে আবারো বিশ্বাস করে ফেলি তোমাকে। যে কিনা আমারই শত্রুর আপন ছোট ভাই। তুমি আমার জীবনে এসে আমাকে ভাঙতে চেয়েছিলে। তোমার সেই ইচ্ছা যখন পূর্ণ হতেই যাচ্ছিল তখনই এক ঝটকায় সবটা পরিবর্তন হয়ে যায়। সেই ঝটকা টা হলো আপু।”
রায়ান এখনো চুপ করে আছে। তানভীর অনুকে প্রশ্ন করলো,
“অজান্তা? অজান্তা এসবের ভেতরে কীভাবে আসলো?”
তানভীরের কথা শুনে অনু হাসতে লাগলো। যেন তানভীর খুব মজার কোনো কথা বলেছে। কোনো রকমে হাসি থামিয়ে অনু বললো,
“এই সবকিছুর আসল মাস্টার মাইন্ড তো আপু। সত্যি বলতে রাজ খুব চালাক। নিজেকে আড়ালে রেখে কার্য সিদ্ধি করে। আমি তো জানতামই না কে সেই মহান ব্যক্তি যে কিনা আমার এত বড়ো সর্বনাশ করেছে। কিন্তু আমার আপু সব জানতো। কীভাবে জানতো? সেটা অবশ্য আমি জানি না। আপু সবকিছু জেনেই রাজকে বিয়ে করেছিল শুধুমাত্র প্রতিশোধের বশবর্তী হয়ে। রায়ান ও রাজের এই বিষয়ে কিচ্ছু জানতো না। রাজ এতটাই চালাক যে ওকে ধরা খুব কঠিন। কিন্তু!”
অনুর কথার মাঝেই রায়ান বলে উঠলো,
“কিন্তু অজান্তা আপুও কম চালাক নয়। রাজ ভাইয়া আর অজান্তা আপুর ব্যাপারটা এমন ছিল যে, বাঘা তেতুল আর বুনো ওল। কেউ কারোর থেকে কম যায় না। সোয়ানে সেয়ানে টক্কর যাকে বলে। অজান্তা আপু বয়সে ছোট হলেও তার বুদ্ধিশক্তি তুখর। আপু আগে থেকেই রাজ ভাইয়ার ব্যাপারে যেমন জানতো। তেমনি আমার এই প্রতিশোধের ব্যাপারেও জেনে গিয়েছিল। তাই কৌশলে আমাকে সবকিছু জানায়। ঠিক তখন থেকেই আমি আবারো অনুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। তখনই শপথ করি, ভাইয়াকে সবকিছুর শাস্তি পেতে হবে। সেই শাস্তির ব্যবস্থা আমি নিজে করবো।”
অনু আবারো বলতে শুরু করলো,
“আমিও রাজের বিষয়ে তখন জানতে পারি যখন রায়ান আর আপু একদিন গভীর রাতে ছাদে গিয়ে কথা বলে। সেদিন আমার ঘুম হুট করেই ভেঙ্গে যায়। তাই আপুর পেছন পেছন আমিও ছাদে আসি। সেই সময় আপু আর রায়ানের কথাগুলো শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিই রাজকে শেষ করার। ঠান্ডা মাথায় মার*তে চেয়েছিলাম আমি রাজকে। তাই কৌশলে আমি রিংকিকে খু*ন করে দোষ চাপিয়ে দিই রাজের উপরে। রিংকিকে তো এমনিতেও মর*তে হতোই। কারণ সে নিজেও ভালো ছিল না। রিংকির জন্যই তো রাজ আমার আপুকে ঠকিয়েছে। হ্যা, আপু এই সম্পর্ক থেকে একদিন অবশ্যই বের হতো। কিন্তু রিংকির জন্য আপু সমাজের কাছে খারাপ হয়েছে। আজ যদি সত্যি সত্যি আমার আপুর সুখের সংসার হতো রাজের সাথে, তাহলে এই রিংকির জন্য সেটা নষ্ট হতো। আজ অজান্তার সংসার নষ্ট করবে। কাল অজান্তার মতোই আরেকজন মেয়ের সংসার ভাঙবে। তাই রিংকির মতো এমন সমাজের কীটগুলোকে বাঁ*চিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।”
তানভীর এতসব শুনে অবাকের উপরে অবাক হচ্ছে। কি থেকে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। সব যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
“পিকচার আভি বাঁকি হ্যায় মেরা দোস্ত। সবার মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, ঝামেলা তো আমাদের মধ্যে। তাহলে আমি এত এত খু*ন কেন করলাম? কারণটা খুব সহজ। এখানে মোট ৩৫ টি মানুষের কঙ্কাল আছে। সবগুলোই ছেলে। যে সে ছেলে নয়। বড়োলোক বাপের বখে যাওয়া সন্তান সবাই। এদের প্রত্যেকের নেশা ছিল ড্রা*গস নেওয়া এবং গ্যাং রেপ করা। যারা মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তাই তো আমি নিজের হাতে সবাইকে মে*রে সেই মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে তাদেরই পরিবারকে খাইয়েছি। যে পরিবার একটা সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে ব্যর্থ সেই পরিবারের জন্য এটাই প্রাপ্য।”
অনুর এহেন কথা শুনে শুধু তানভীর নয়। রায়ানও যেন শক ৪৪০ ভোল্টের শক খেল। অনুর এমন পাগ*লামির কথা কেউ জানতো না। এমন কি অজান্তা ও নয়। মানুষের মাংস? তাও আবার ছেলেদেরকে মে*রে তাদেরই পরিবারকে খাওয়াইছে। এমন অস্বাভাবিক মস্তিষ্কের একজন আর যাইহোক সুস্থ স্বাভাবিক কেউ হতে পারে না।
হঠাৎই অনু অস্বাভাবিক হয়ে গেল। আশেপাশের সবকিছু ভেঙ্গেচুরে একাকার অবস্থা করে ফেললো মুহূর্তের মধ্যেই। রায়ান দৌড়ে অনুকে ধরতে গেলে অনু গান তাক করে রায়ানের দিকে। সাথে সাথে দুই পা পিছিয়ে যায় রায়ান।
“খবরদার কেউ আমার সামনে আসবে না। নয়তো খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।”
রায়ান অসহায় কন্ঠে অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“অনু প্লিজ এমন করো না। নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করো আদালতের কাছে। আমি কথা দিচ্ছি তোমার শাস্তি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনবো আমি। আর তারপর একসাথে নতুন করে জীবন শুরু করবো আমরা দুজন।”
“এই এই একদম চুপ থাকো। এই অনুর কারোর কোনো করুণার প্রয়োজন নেই বুঝতে পেরেছো?”
“অনু দয়া করে গানটা আমার হাতে দিয়ে দাও। নয়তো যেকোনো মুহূর্তে একটা দু*র্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
তানভীরের কথা শুনে অনু দম ফাটানো হাসিতে ফেটে পড়লো। তানভীর আর রায়ান চুপ করে অনুর করা কান্ডগুলো দেখছে।
“আরে এখনো তো কিছুই হয়নি। তোমরা আমার ডেরায় এসেছো। আর এখানে যারা আসে তারা কেউ জী*বিত ফিরে যেতে পারে না বুঝেছো। এখন তো তোমাদেরও ম*রতে হবে।”
কথাটা বলেই অনু তানভীরের দিকে গু*লি ছুড়লো। সাথে সাথে তানভীরকে অন্য পাশে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রায়ান। রায়ানের এহেন কাজে অনু রেগে তেড়ে গেল ওর দিকে।
“রায়ান। এতকিছুর মাঝেও একটা কথা সত্যি। ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে। গেম খেলতে খেলতে কখন যে তোমার মায়ায় পড়ে গেলাম বুঝতেও পারিনি। তোমার থেকে দূরে সরার পর বুঝতে পারি, এই আমি ভীষণ বাজেভাবে তোমার মায়ায় আটকে গিয়েছি। কিন্তু সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায়? না, সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। তবে তুমি আমার নও তো আর কারোর নও।”
কথাটা বলেই অনু রায়ানের দিকে গান তাঁক করলো। সাথে সাথে গু*লির বিকট আওয়াজ আর হৃদয়বিদারক চিৎকারে সবকিছু আবারো নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল।
৪৪.
অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষা করছে সবাই। আজ নন্দিনীর ডেলিভারি হবে। সকাল থেকেই কেমন হাসফাস করছিল নন্দিনী। কিন্তু রাত প্রায় আটটার দিকে নন্দিনীর ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথায় ছটফট করতে করতে বাড়ির সবাইকে ডাকে সে। তারপরই নন্দিনীকে নিয়ে তানভীরের পরিবারের লোকজন হসপিটালে আসে। নন্দিনীর বাবা-মা ও এসেছেন। কিছুক্ষণ আগে নন্দিনীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তানভীরের বড়ো ভাবি মাহিফা বারবার কল দিচ্ছে তানভীরকে। কিন্তু তানভীর কল ধরছে না। এমন একটা অবস্থায় এখানে তানভীরের থাকা খুব জরুরি। আর সেখানে তাকে ফোনেই পাওয়া যাচ্ছে না।
একটু পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে সবার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সাদা এপ্রোন পড়া একজন মহিলা ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসলেন।
“কংগ্রাচুলেশনস আপনাদের পরিবারে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের আগমন ঘটেছে।”
তখনই একজন নার্স নরম তোয়ালে মুড়িয়ে একটা ছোট্ট পরিকে মাহিফার হাতে তুলে দিলো।
“আচ্ছা পেশেন্ট এর হাসবেন্ড কোথায়?”
“তানভীরকে কলে পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো কোনো কেসের কাজে আটকে গিয়েছে।”
মাহিফার কথায় ডক্টর হিমা থমথমে গলায় বললো,
“বাচ্চা তো একদম সুস্থ আছে। কিন্তু!”
ডক্টরের কথায় সবাই ভয় পেয়ে বললো,
“কিন্তু কী? আর নন্দিনী কেমন আছে এখন?”
“একটা খারাপ খবর আছে। আমরা পেশেন্ট অর্থাৎ নন্দিনীকে বাঁচাতে পারিনি। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার হার্টবিট ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এদিকে প্রচুর ব্লা*ড লস হয়। পালস্ রেটও একদম কমে আসে। আমাদের মাফ করবেন। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি পেশেন্টকে বাঁচানোর। কিন্তু আমাদের হাতে আর কিছু করার ছিল না। আমরা দুঃখিত।”
কথাটা বলেই ডক্টর হিমা আর নার্স মাথা নিচু করে চলে গেল। এদিকে তানভীর আর নন্দিনীর পরিবারের প্রতিটা মানুষ পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। এমন কিছুর জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতেই একটা মেয়ে তার মাকে হারালো। এর থেকে হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কি-ই বা হতে পারে!
চলবে…