#মাতৃত্বের স্বাদ
#পর্ব-১২
#রহস্য উন্মোচন পর্ব-১
#লেখায়-নামিরা নূর নিদ্রা
৪১.
তানভীরকে নিজের ফার্মহাউসে দেখে রায়ান কিছুটা অবাক হয়ে ওর কাছে গেল।
“তানভীর তুমি এখানে?”
“আরে রায়ান তুমি এখানে কী করছো?”
“এটা আমার ফার্মহাউস।”
“কী? সত্যি?”
“হ্যা। কিন্তু তুমি এখানে কেন?”
“আমার মোবাইলে একজন কল করে বললো কেসের ব্যাপারে কথা বলবে। তাই এই ঠিকানায় আসতে বলেছে।”
“আমাকেও একই কথা বলে ডাকা হয়েছে এখানে।”
“কিন্তু কে ডাকলো আমাদের? কোথায় সে?”
তখনই পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,
“আমিই ডেকেছি আপনাদের।”
তানভীর আর রায়ান পেছন ফিরে একজন বোরকা পরিহিতা মেয়েকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।
“কে আপনি?”
“বলবো। আগে ভেতরে চলুন। ফার্মহাউসটা যেহেতু রায়ানের। তাই সদর দরজার চাবি তার কাছেই আছে রাইট?”
“হ্যা। ঠিক আছে। ভেতরে চলো তোমরা।”
কথাটা বলেই তানভীর, রায়ান আর আগন্তুক মেয়েটি ফার্মহাউসের ভেতরে চলে গেল। এরপর সোফায় তিনজন মুখোমুখি হয়ে বসলো।
“এবার বলো কে তুমি?”
“আমি রাইসা। রিংকির ছোট বোন।”
মেয়েটার কথা শুনে রায়ান আর তানভীর একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললো,
“তাহলে এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?”
“বলছি। সব বলছি। তার আগে আমাকে আপনারা কথা দিন। যেন আমার বোনের খু*নের সুষ্ঠু বিচার হয়।”
“অবশ্যই বিচার হবে। তুমি নির্দ্বিধায় আমাদের সবটা বলো।”
মেয়েটা নিজের মুখের নিকাব খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
“রিংকি আপুর ছোট বোন আমি। আমাদের বাবা-মা নেই। দুজনেই অনাথ আশ্রমে বড়ো হয়েছি। একসময় আপু আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সিলেট থেকে ঢাকায় আসে একটা কাজের আশায়। আমি সিলেটেই রয়ে যাই। আপু ঢাকায় এসে কাজ খুঁজে পেয়েছিল ঠিকই৷ তবে কি কাজ সেটা আমি জানতাম না। আপু নিয়ম করে প্রতি মাসে আমাকে টাকা পাঠাতো। আমি একটা ভাড়া বাসায় থাকতাম। আপু মাঝেমধ্যে এসে আমার সাথে দেখা করে আবার চলে যেতো৷ এভাবেই দিন চলতে লাগলো। আমিও পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম। আপু আমার জন্য সবসময় চিন্তা করতো। আমার যেন কোনো সমস্যা না হয় তার সব ব্যবস্থা করতো। আমাকে খুব ভালোবাসতো আমার আপু। আপু কি এমন কাজ করে যার জন্য এত এত টাকা পায় সেটা জিজ্ঞাসা করলে এড়িয়ে যেতো। আমিও আর কিছু বলিনি৷ বিশ্বাস ছিল আমার আপু খারাপ কিছু করবে না। কিন্তু একদিন আমার সমস্ত ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে আপু আমাকে বলে, সে ঢাকায় একটা বারে ড্যান্স করে। আপু দেখতে সুন্দর হওয়ায় অনেকের কুনজর ছিল তার উপরে। টাকার জন্য আপু পরে নিজের সতিত্ব বিসর্জন দেয়। এভাবেই আপুর ভার্জিনিটি নষ্ট হয়। হ্যা, পুরো বিশ্বের কাছে আমার বোন চরিত্রহীনা। তবে আমার কাছে আমার বোনই সেরা। কারণ এতসব কিছু আপু শুধু আমার জন্য করেছে। নিজের জন্য কেউ এমন করতে পারে না। আপুর প্রাণ ছিলাম আমি। তাই আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই নিজেকে বিলিয়ে দেয় সবার কাছে। এসব জানার পরে আমি রাগে, কষ্টে, ঘৃণায় আপুর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ এমন টাকা চাইনি আমি। আমি খুব সাধারণভাবে বাঁচতে চেয়েছি। তবুও আমার জন্য আপু এসব করেছে। আপুর এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দোষী মনে হতো। তাই লজ্জায় আপুর সাথে কথা বলার সাহস হয়নি। আপু চেয়েও যোগাযোগ করতে পারেনি আমার সাথে। একদিন সরাসরি সিলেটে আমার কাছে এসে আপু কান্নাকাটি করে মাফ চায়। এছাড়া আপুর কাছে আর কোনো অপশন ছিল না বলেও জানায় আমাকে। হাজার হোক, আপন বোন তো। তাই আর কথা না বলে থাকতে পারিনি। এর মধ্যেই জানতে পারি আপু অন্তঃসত্ত্বা। বিয়ের আগেই অন্তঃসত্ত্বা হওয়া কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। আপু আমাকে বলে, রাজ নামের একটা ছেলের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আর এই সন্তান তারই। সে আপুকে বিয়ে করবে বলেছে। আমি সবটা শুনে চুপ করে যাই। কিছুই করার ছিল না আমার। সব ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎই একদিন রাতে আপু আমাকে কল দেয়। সচারাচর আপু এত রাতে আমাকে কখনোই কল দেয় না। তাই আমি ভয় পেয়ে সাথে সাথে কল রিসিভ করি। আপু আমাকে জানায়, ওর জীবন সংকটে। আমি যেন খুব দ্রুত পুলিশ নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসি। আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। ভয়ে মাথা কাজ করছিল না। আমি পুলিশ না নিয়ে একাই চলে যাই আপুর দেওয়া লোকেশনে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেই গোডাউনে পৌঁছানোর পর আমি দেখি, চারিদিকে অনেক ছেলে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সাবধানে ভেতরে চলে যাই। কি মনে করে মোবাইলের ভিডিয়ো অন করে রেখেছিলাম। আর ঠিক তখনই একটা মেয়ে আপুর গলা কেটে দেয়। নিজের চোখের সামনে বোনকে মরতে দেখেছি। এর থেকে কষ্টের আর কিছুই হতে পারে না। আমি চেয়েও বাঁচাতে পারিনি আমার বোনকে। ঐ সময় আমি আপুকে বাঁচাতে গেলে নিজেও মরতাম। কিন্তু আমার তো আপুর খু*নের বিচার চাই। তাই সেদিন শত কষ্ট লুকিয়ে পালিয়ে যাই টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলে আমার কেউ নেই। কিন্তু নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য অচেনা এক শহরে পাড়ি জমাই। ভাগ্যক্রমে সেখানে আমি এতদিন সুরক্ষিত ছিলাম।”
কান্নারত অবস্থায় কথাগুলো বলেই থামলো রাইসা। তানভীর আর রায়ান বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। সামনে বসে থাকা এই মেয়েটাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। তখনই রায়ানের টনক নড়লো। রায়ান কৌতুহলি হয়ে প্রশ্ন করলো,
“ওয়েট ওয়েট। তুমি কী বললে? রিংকিকে কোনো মেয়ে মেরেছে?”
“হ্যা।”
“তার মানে রাজ রিংকিকে মারেনি?”
“না। সেখানে রাজকে আমি দেখিনি।”
“তাহলে সেই মেয়েটা কে ছিল?”
“আমার কাছে ভিডিয়ো ক্লিপ আছে। এই পেন ড্রাইভে সব রেকর্ড করা আছে।”
“রায়ানের কাছে ল্যাপটপ ছিল। তাই তাড়াতাড়ি পেন ড্রাইভ অন করে ভিডিয়ো ক্লিপটা দেখে চমকক উঠলো। ভিডিয়োতে এমন কিছু দেখবে তা কেউ কল্পনাও করেনি। মেয়েটাকে দেখে পিলে চমকে উঠলো তানভীর আর রায়ানের।”
“এটা কীভাবে সম্ভব?”
“আমি তো এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না তানভীর।”
রাইসা ওদের দুজনের কথা বুঝতে না পেরে বললো,
“কী হয়েছে?”
রায়ান কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কিছু না। রাইসা তুমি চিন্তা করো না। তোমার বোনের খু*নি অবশ্যই শাস্তি পাবে। তবে তুমি কোর্টে সাক্ষী দিতে পারবে তো?”
“হ্যা পারবো।”
“ঠিক আছে। তোমার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের। আজ থেকে তুমি এখানেই থাকবে। সঠিক সময়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে তোমাকে। আমরা রাতে এসে তোমাকে পাহারা দিবো। এখন আমাদের যেতে হবে। আসছি।”
“ঠিক আছে।”
তারপর রায়ান আর তানভীর চলে গেল। রাইসা চোখ মুছে নিজের বোনের ছবির দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রইলো। অঝোর ধারায় পানি পড়ছে রাইসার চোখ থেকে। আজও খুব আফসোস হয় নিজের বোনকে বাঁচাতে না পারার জন্য। কতটা অপারগ হলে একজন বোন তার আপুকে বাঁচাতে পারে না? সেটা হয়তে রাইসা ছাড়া আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। নিজের বোনের অকালে প্রাণ হারানের জন্য নিজেকেই দোষী মনে করে রাইসা। সেদিন হয়তো সে আর একটু আগে পৌঁছাতে পারলে তার বোন বেঁচে যেতো। সারাজীবন এই আফসোস আর কষ্ট নিয়েই বাঁচতে হবে রাইসাকে। বোনের খু*নিকে শাস্তি দিতে পারলে একটু হলেও শান্তি পাবে সে। তাই নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও রিংকির খু*নিকে শাস্তি দিবে রাইসা। মনে মনে এমন প্রতিজ্ঞাই করলো রাইসা।
৪২.
সেই গোপন কুঠুরিতে একে-অপরের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে আছে তিনজন। অবয়ব দেখেই বোঝা যাচ্ছে দু’জন ছেলে। আর একজন মেয়ে।
মেয়েটার চোখমুখ লাল হয়ে আছে।
“তোমরা এখানে এসে ভালো করোনি। নিজেদের মৃত্যু ডেকে এনেছো তোমরা।”
“জাস্ট শাট আপ অনু। একদম চুপ করে থাকো তুমি।”
রায়ানের চিৎকারের আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগলো ঘরে চারকোণে। তানভীর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
“কেন করলে এমনটা অনু? কেন নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করে দিলে? এত এত মানুষকে মে*রে কী শান্তি পেলে তুমি? এতগুলো প্রাণ নিয়ে খেলার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?”
রায়ানের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো অনু। তারপর নিজের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
“সবার আগে আসি অধিকার নিয়ে। আচ্ছা বলো তো মেয়েদের জীবন নষ্ট করার অধিকার ছেলেদের কে দিয়েছে? জানতে চাও তোমরা আমি কেন এমন করলাম?”
“হ্যা জানতে চাই।”
তানভীরের কথা শুনে নিজেকে শক্ত করে অনু বলতে শুরু করলো,
“সবে মাত্র এসএসসি দিয়েছি। ছোট থেকেই দেখতে সুন্দর ছিলাম। বিধায় অনেকের খারাপ দৃষ্টি আমার দিকে ছিল। আমি এসব বুঝতে পারিনি। কারণ সর্বক্ষণ ছায়ার মতো অজান্তা আপু আমার পাশে ছিল। একদিন আপু পেট ব্যাথায় বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না। আম্মুও খালামনির বাড়িতে গিয়েছে। এজন্য কোচিং থেকে একাই বাড়ির পথে হাঁটা ধরি। তখনই আমার জীবন তছনছ করে একজন ছেলে আমাকে কিডন্যাপ করে নিজের আস্তানায় নিয়ে যায়। আর তারপর? তারপর আমি আমার সবচেয়ে বড়ো সম্পদ আমার ভার্জিনিটি হারায়। ছেলেটার নেশা ছিল মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলার। তাই সুন্দরী কম বয়সী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের শারিরীক চাহিদা মেটাতো সেই জানো*য়ার। আর সেই সকল মেয়েদের তালিকায় আমার নামটাও যুক্ত হয়। জানতে চাও? কে সে?”
অনুর কথা শুনে রায়ান আর তানভীর দুজনেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ান কোনো কথা বলতে পারছে না। তানভীর কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কে সে?”
অনু চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে নিয়ে কিছুক্ষণ নিরব রইলো। তারপর যার নাম বললো তার নাম শুনে তানভীর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
চলবে…