#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)
-সরি বউ…
আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না চিত্রলেখা রওনককে। আচমকা কি হলো তার! এগিয়ে গিয়ে রওনকের ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে রওনক নিজেও তাল দেয় চিত্রলেখার ঠোঁটের ডেউয়ে। লম্বা সময় তারা একে-অপরের ঠোঁটের মায়ায় আটকে থাকার পর নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসলে অক্সিজেন টানতেই যেন সামান্য বিরতি নেয়। তবুও কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। চিত্রলেখাের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস টানে দু’জনেই। দু’জনের দৃষ্টিই একে-অপরে সীমাবদ্ধ।
চিত্রলেখাকে সামলে ওঠার কোনো সময় দেয় না রওনক। আদরে আদরে অস্থির করে দিতে ব্যস্ত হয়। এতগুলো দিন দূরে থাকাটা যেনো পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে সে। কখনো কোনো পুরুষের সংস্পর্শে না আসা চিত্রলেখাে রওনককে নিজের ভেতর পেয়ে পৃথিবীর সব কিছু যেনো ভুলে গেছে। এই মুহূর্তে রওনক, তার ছুঁয়ে দেয়া ছাড়া অন্যকিছুই ভাবতে পারছে না সে। রওনক যত গভীর ভাবে তাকে ছুঁয়ে দিতে, তার চিহ্ন রাখতে ব্যস্ত চিত্রলেখার অঙ্গে সে যেনো ততই মরিয়া হয়ে উঠছো আরেকটু বেশি তাকে কাছে পাবার নেশায়। একটা লম্বা সময় একে-অপরের উষ্ণ নরম অঙ্গে জড়িয়ে থাকার পর, একে-অপরকে নিজের সর্বোচ্চ কাছে পাওয়ায় যেনো দু’জনের শান্তি হয়েছে। চিত্রলেখাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেই বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে দম ধরার চেষ্টা করছে রওনক। চিত্রলেখারও একই অবস্থা। বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখাকে বুকে নিয়ে শুয়ে থাকার পর রওনক উঠে বসে। তাকে বিছানা থেকে নামতে দেখে নিজের চোখ বন্ধ করে ফোলে চিত্রলেখা। মাথার উপর কম্বল টেনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। তা দেখে রওনক মুচকি হেসে চেঞ্জিং রুমে চলে যায় বিবস্ত্র অবস্থাতেই। পেছনে চিত্রলেখা তাকে দেখলো কি দেখলো না তাতে তার কিছু যায় আসে না। এখন আর তাদের মাঝে অদেখা কিছু নেই। ফ্রেশ হয়ে একটা ট্রাউজার প্যান্ট ও টি-শার্ট পরে বেরিয়ে আসে সে। চিত্রলেখা এখনো কম্বলের নিচে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। এগিয়ে এসে তার মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে বলে,
-এসো।
-কোথায়!
অবাক হওয়া চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট। গায়ের উপর থাকা কম্বলটা শক্ত করে ধরেছে সে যেনো হাত ফঁসে পরে না যায়। বলা তো যায় না রওনক নিজেই ধরে টান দিলো। এই লোককে দিয়ে কোনো ভরসা নেই। চিত্রলেখার অবস্থা দেখে হাসি পেলেও হাসে না সে।
-তোমার হাটতে কষ্ট হবে। চলো আমি ক্লিন করিয়ে দেই। তারপর ঘুমাবো।
রওনকের কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়ে সে। এই লোক তাকে ক্লিক করিয়ে দিবে! সে কি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফেলেছে নাকি? তাড়াতাড়ি বলে,
-কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই ক্লিন হয়ে নিতে পারবো।
-ট্রাস্ট মি তুমি একদম হাটতে পারবে না। আমি জানি তোমার ভীষণ পেইন হচ্ছে। প্লিজ লেট মি হেল্প। আমি একদম বিরক্ত করবো না তোমাকে জাস্ট ক্লিন হতে হেল্প করব, নো দুষ্টুমি আই প্রমিজ।
রওনকের কথা শুনে লজ্জায় আবারও লাল হয়ে যেতে শুরু করেছে সে। নিজেকে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত চিত্রলেখা এতক্ষণ লক্ষ করেনি রওনক হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছে। ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা বাথ্রবটা এগিয়ে ধরে বলে,
-এটা পরে নাও।
তর্কে যায় না চিত্রলেখা। বাথ্রবটা তার হাত থেকে নিয়ে বলে,
-আপনি পেছনে ঘুরে দাঁড়ান।
-ট্রাস্ট মি চন্দ্র এমন কিছু বাকি নেই যা আমি দেখিনি। সব দেখা হয়েছে গেছে আমার।
-প্লিজ!
-ওকে ফাইন।
বাধ্য হয়েই পেছন ঘুরে দাঁড়ায় সে। এমনিতেই নিজের বউয়ের লজ্জা পাওয়া সম্পর্কে ধারণা আছে তার। এখন আর নতুন করে আর লজ্জা দিতে চায় না। কিছুক্ষণ আগেই অন্তরঙ্গ হয়েছে তারা তবুও লজ্জায় ম রে যাচ্ছে চিত্রলেখা। সত্যিই তার মাথায় কোনো দুষ্টু বুদ্ধি নেই একমুহূর্তে। চিত্রলেখা যেনো ফ্রেশ হয়ে জলদি ঘুমাতে পারে সেজন্যই হেল্প করতে চায়। সে নিজেও প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতে চায়। কতগুলো রাত চন্দ্রলেখাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে হয়েছে তাকে। সেই সব রাতের অপেক্ষাও পুষিয়ে নিতে চায় যতটা সম্ভব কাছাকাছি থেকে।
-হলো?
-এই এই তাকাবেন না প্লিজ।
কয়েক সেকেন্ড পরেই চিত্রলেখা আবারও বলে,
-হয়ে গেছে।
রওনক পেছন ফিরতেই দেখে চিত্রলেখা বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। অবাক হয়ে চিত্রলেখা জানতে চায়,
-কি করছেন?
-তোমার হাটতে কষ্ট হবে। আমি নিয়ে যাচ্ছিস।
-সমস্যা নেই, আমি হাটতে পারবো।
-পারবে জানি তবুও আমি তোমায় একটু পেম্পার করতে চাই।
-কিন্তু…
-হুঁশ।
আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে। বাথরুমে এসে তাকে কমডের উপর বসিয়ে দেয়ার পর রওনককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিত্রলেখা বলে,
-আপনি বাইরে যান।
-আই ওয়ান্ট টু হেল্প ইউ।
-একদম না।
চিৎকার করে ওঠে চিত্রলেখা। হাত তুলে সারেন্ডার করে রওনক বলে,
-ওকে ফাইন। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। তবে তুমি ক্লিন হয়ে আমায় ডাকবে, আমি এসে তোমায় নিয়ে যাবো। একদম হাটবে না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।
চিত্রলেখাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে যায় সে। একটা নতুন বেড কভার নিয়ে রুমে ফিরে এসে বিছানায় থাকা বেডশীটটা পাল্টে ফেলে সে। বিছানা তৈরি করে নেয় দু’জনে ঘুমাবে বলে।
চিত্রলেখা বাথরুমের দরজা খুলতেই দেখে দরজার অন্যপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। তাকে দরজা খুলতে দেখেই এগিয়ে এসে কিছু বলার বা করার সুযোগ না দিয়েই আবার পাঁজা কোলে তুলে নেয়। অহেতুক আর হাত পা ছোড়বার চেষ্টা করে না চিত্রলেখা। রওনকের বুকে মাথা রেখে নিচু সুরে বলে,
-আমার সত্যিই কষ্ট হবে না এতটুকু পায়ে হেটে যেতে।
-আমি জানি কষ্ট হবে না তবুও আমি তোমায় নিজের কাছাকাছি রাখতে চাই। তোমার একটু খেয়াল রাখতে চাই। একটু আদর-যত্ন করতে চাই।
চিত্রলেখা আর কথা বলে না তার ভীষণ ক্লানত লাগছে। এমনিতেই শরীর ভাঙছে তার সূক্ষ্ম ব্যথায়। এই ব্যথার কথা চাইলেই কাউকে বলা যায় না। এই ব্যথা যেমন কষ্টের তেমনি সুখেরও। অত্যান্ত ব্যাক্তিগত সুখের ব্যথা। হাত বাড়িয়ে রওনকের গলার কাছে জড়িয়ে রেখেছে সে। ঘরে ফিরে এসে চিত্রলেখাকে বিছানায় নামিয়ে দিতেই সে অবাক হয়ে বলে,
-বেডশীট!
-আমি বদলে দিয়েছি।
-ওটা কোথায় রেখেছেন? আমাকে দিন আমি ধুয়ে দেই আমি।
চিত্রলেখাকে জোর পূর্বক বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রওনক বলে,
-তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। ওটা আমি ক্লিন করে ফেলব। অন্যকেউ দেখতে পাবে না, চিন্তা করো না তুমি।
আপত্তি করতে চায় চিত্রলেখা। কেমন লজ্জার কথা সে থাকতে তার রক্তের দাগ লেগে থাকা বেডশীট রওনক পরিষ্কার করবে? ভাবতেই তো লজ্জায় পানিতে ডু বে ম রে যেতে মন চাইছে তার। এরপর মুখ দেখাবে কীভাবে তাকে সে? চিত্রলেখাকে চিন্তায় বিভোর হতে দেখে এগিয়ে গিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে রওনক বলে,
-একদম লজ্জা পাবে না। তোমার করা আর আমার করা একই কথা। আমি তুমি তো আর আলাদা নই।
লাইট বন্ধ করে দিয়ে এবারে সে নিজেও চিত্রলেখার পাশে ছুঁয়ে পরে গা ঘেষে। তাকে টেনে নেয় অনেকটা নিজের বুকের উপর। বলা যায় চিত্রলেখার শরীরের বেশিভাগ অংশ, ভার রওনকের শরীরের উপর। আরও একবার বউয়ের মাথায় চুমু খায় সে। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
-তুমি একটু সর্তক থেকো।
-কেনো?
-খেয়াল রেখো তোমার পিরিয়ড মিস যায় কিনা। হলে আমায় জানাবে।
-মানে!
-আমরা প্রকেটশন নেইনি চন্দ্র। তোমার কনসিভ করার চান্স আছে। তাই বলছি একটু সর্তক থেকো।
রওনকের কথা শুনে দাঁতে ঠোঁট কাটে চিত্রলেখা। এতক্ষণ তো ব্যাপারটা তার মাথাতেই আসেনি। আসলেই তারা প্রটেকশন ব্যবহার করেনি। তৎক্ষনাৎই মনে মনে নিজের মাসিকের তারিখ হিসাবে করে ফেলে। হিসাব অনুযায়ী তার কনসিভ করার সুযোগ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে বাচ্চা নেয়ার জন্য কি তৈরি সে? বাচ্চা যদি চলেও আসে তাহলে কি হবে? তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি সেটাই তো এখনো জানে না সে। এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে বাচ্চার ভবিষ্যতের কি হবে? ভাবতেই যেনো বুক কেঁপে ওঠে তার। কিন্তু এই বিষয়ে রওনকের কি ধারনা সেটা জানা দরকার। জিজ্ঞেস করবে কি করবে না দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-আপনি চান? মানে যদি আমি কনসিভ করে ফেলি তাহলে…
চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রওনক বলে,
-তোমাকে পাবার পর আমার আর কিছু পাওয়ার বাকি শুধু একটা বাচ্চা ছাড়া। আমার রক্ত তোমার গর্ভে আসবে সেই দিনের অপেক্ষায় আমি।
মনে মনে খানিকটা নিশ্চিত হয় চিত্রলেখা। সে ভালো করেই জানে এই পরিবারে সে অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু রওনক বাচ্চা চায়, তার সঙ্গে চায় এই কথা তার মুখে শুনে খানিকটা স্বস্তি লাগছে এটা ভেবে তার সন্তানকে অনাকাঙ্ক্ষিত বা অগ্রহণ যোগ্য বলে দাবী করতে পারবে না কেউ। চিত্রলেখার চোয়াল জুড়ে ছোট্ট করে হাসি ফুটে উঠেছে। তার বন্ধ চোখের পাতায় গভীর হয়ে ঘুম নামতে আরম্ভ করেছে। তাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে লাগে রওনক নিজেও। গত ২৫ টা রাত তার ঠিকঠাক ঘুম হয়নি এই নারীর অনুপস্থিতিতে। আজ যেনো অনেক রাতের ক্লান্তি কাটার রাত।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)
ইদানিং চিত্রলেখার সময় কাটে মিম ও মিশকাতের পেছনে ছোটাছুটি করে। শাশুড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। নানাভাবে সে চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। তাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নন দিলারা জামান। যদিও এতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। এর মধ্যেও বেশ কিছুদিন সাবা এই বাড়িতে এসেছে। চিত্রলেখা চেষ্টা করেছে তাকে এড়িয়ে চলার। রওনক নিজেই তাকে বলেছে সাবা নিজে এসে কথা বলতে চাইলেও কোনো প্রয়োজন নেই কথা বলার। যদিও একজন মানুষ সামনে থেকে এসে কথা বলতে চাইলে তাকে কীভাবে ফিরে দিয়ে সে? এটা তো অভদ্রতা দেখায়। অন্যদিকে রওনকের কথাও অমান্য করতে পারছে না সে। তানিয়ার ভিসা প্রসেসিং চলছে। জলদিই সে আমেরিকা চলে যাবে। এর মধ্যেই লইয়ারকে দিয়ে মিম ও মিশকাতের লিগ্যাল গার্ডিয়ানশীপ রওনক ও চিত্রলেখাকে দিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে রাদিন বিশাল সিনক্রিয়েট করেছে বাড়িতে। যদিও রওনক একদম রা করেনি। ১ মাসের উপরে হতে চলল মেস্কিকো ও সিঙ্গাপুরের কাজ সেরে দেশে ফিরেছে রওনক। ফিরে আসার পর থেকে নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই ডিউরেশনে খুব কম সময় পেয়েছে তারা একে-অপরের সঙ্গে কাটানোর। এনিয়ে অবশ্য মন খারাপ করেনি চিত্রলেখা। সে জানে রওনকের উপর কাজের কত চাপ যাচ্ছে। চারদিনের জন্য গাজীপুর গিয়েছিল রওনক। আজই ফিরে আসার কথা তার। কিন্তু কখন ফিরবে সেটা জানায়নি। চিত্রলেখা ধরেই নিয়েছে গাজীপুর থেকে ফিরে অফিসে যাবে সরাসরি। অফিস সেরে একেবারে রাতেই হয়ত বাসায় ফিরবে। গতকাল রাত থেকে শরীরটা ভালো নেই তার। রাতে দু’বার বমি হয়েছিল। শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে। দু’দিন ধরে খাওয়া দাওয়ায় অরুচি ধরেছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর টের পেয়েছে মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে টের পাচ্ছে শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। কম্বলটা মাথার উপর টেনে রেখেছে সে। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে। এত বেলা পর্যন্ত কখনই শুয়ে থাকার অভ্যাস নেই তার। চিত্রলেখাকে নিচে না দেখতে পেয়ে ৮ টার দিকে একবার তার ঘরে এসেছিল জাহানারা। মাথা ব্যথার কথা জানিয়ে বলেছিল জাহানারা যেনো নিজে গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসে। তার উপর দায়িত্ব আসার পর থেকে এই পর্যন্ত একদিনও মিম, মিশকাতকে একা স্কুলে যেতে হয়নি। আজ শরীর ভালো নেই অন্যথায় সে নিজেই সঙ্গে যেতো। তবুও সে চায় না বাচ্চারা একা স্কুলে যাক। তাই জাহানারাকে বলেছে সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তার কথা মতো সে নিজে গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে এসেছে। নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করলে চিত্রলেখা বলেছিল আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবে সে। পরে উঠে খেয়ে নিবে। আবার ঘুমিয়ে পরলেও সেই ঘুম গাঢ় হয়নি তার। মাথার যন্ত্রণায় ঘুম গাঢ় হচ্ছে না। তবুও নিজেকে কম্বলের নিচে আটকে রেখেছে। চোখের সামনে অন্ধকার থাকায় আরাম লাগছে সামান্য। আধো ঘুম অবস্থায় রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়েছে সে। হয়ত জাহানারা এসেছে। রওনক না থাকলে সে ঘরের দরজা লক করে না। আর রওনকের কথাতেই ব্যস্ততার মধ্য দিয়েও একটু পরপর এসে চিত্রলেখাকে দেখে যায় জাহানারা। বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে বাসায় ফিরে আসার পর তার ঘরে এসে তাকে দেখে গেছে। কথা বলেনি। দরজার কাছে এসে তাকে দেখে আবার চলে গেছে। এখন আবার এসেছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পায় সে। হয়ত তাকে দেখে চলে গেছে। আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কেউ একজন পেছন দিকে বিছানায় উঠে কম্বলের নিচে চলে আসে। চিত্রলেখা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজোড়া হাত তাকে জড়িয়ে ধরে। মানুষটার হাত তার শরীরের সংস্পর্শে আসতেই টের পায় কে এসেছে। রওনককে এক্ষনই আশার করছিল না সে। মনে মনে তো ধরেই নিয়েছিল মানুষটার ফিরে আসার জন্য তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। অন্তত সারাদিন। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা তার সঙ্গে, একদম কাছাকাছি। তাকে জড়িয়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্টে। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে কম্বলের নিচেই রওনকের দিকে ঘুরে তার বুকে মাথা রাখে চিত্রলেখা। রওনক কিছু বলে না৷ বউকে জড়িয়ে নেয় বুকের ভেতর। চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-এত দেরি করলেন কেনো?
-অপেক্ষা করছিলে বুঝি?
জবাব দেয় না সে। লজ্জা করে তার মুখ ফুটে অপেক্ষার কথা বলতে। তার কি আদৌ এই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করার অধিকার আছে? এই মানুষটাকে তো তার পাওয়ারই কথা নয়। সে তো কোনোভাবেই এই মানুষটার যোগ্য নয়। চিত্রলেখা কোনো জবাব না দেয়ায় রওনক বলে,
-তোমার শরীর গরম কেনো? জ্বর এসেছে?
রওনকের বুকে মুখ রেখেই ডানে বামে মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা।
-তাহলে কী হয়েছে? রাতে খাওনি কেনো?
এমন প্রশ্ন শুনে অবাক না হয়ে পারে না। সে রাতে খায়নি একথা তার জানার কথা নয়। কীভাবে জানলো সে? গতরাতে তাদের কথা হয়নি। রওনক কীভাবে জানলো সে রাতে খায়নি প্রশ্নটা করবে এমন সময় চিত্রলেখা অনুভব করে তার পেট পাক দিয়ে বমি আসতে চাইছে। আচমকাই মাথা থেকে কম্বল সরায় সে৷ রওনক জিজ্ঞেস করতেই নেয় কি হয়েছে কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা দৌড় লাগায় বাথরুমের দিকে। বসে না থেকে রওনক নিজেও পেছন পেছন যায়। বাথরুমে ঢুকতেই দেখে চিত্রলেখা কমোডের সামনে নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বমি করছে। যেহেতু সে রাতে কিছু খায়নি তাই বমি হয়ে পানি ছাড়া কিছুই বের হচ্ছে না তার পেট থেকে। রওনক এগিয়ে এসে চিত্রলেখার চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। চুল যেনো মুখের সামনে না যায় সে চেষ্টা। আরেক হাতে পিঠ হাতড়ে দেয়। চিত্রলেখা বমি করে পেটের পানি বের করে শান্ত হলে পরে রওনক জিজ্ঞেস করে,
-আর করবে?
বমি করে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে মুখে কিছু বলতে পারে না সে। কেবল মাথা ঝাকায়। রওনক কমোড ফ্লাশ করে দিয়ে চিত্রলেখাকে তুলে কমোডের উপরেই বসিয়ে দেয়। বেসিন কাউন্টারের কাছে গিয়ে একটা ছোট টাওয়াল ভিজিয়ে নিয়ে চিত্রলেখার কাছে ফিরে আসে।
কুলি করার জন্য পানিয়ে এগিয়ে দেয় সে চিত্রলেখাকে তারপর ভেজা টাওয়াল দিয়ে যত্নের সাথে বউয়ের মুখ মুছে দেয়। পরিষ্কার করা হয়ে গেলে চিত্রলেখাকে হাতের উপর কোলে তুলে নিয়ে রুমে ফিরে আসে। বিছামায় নামিয়ে দিয়ে কম্বলটা গায়ের উপর টেনে দিয়ে তার কপালে একটা চুমু খায় সে ছোট্ট করে। তারপর হাটা ধরে চেঞ্জিং রুমের দিকে। মিনিট বিশেক পর শাওয়ার নিয়ে কাপড় বদলে বেরিয়ে আসে সে। ফিরে এসে আবার চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরে রওনক। চিত্রলেখার চুলে নাক ঘষে বলে,
-ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখছি রাতে দেখিয়ে আসবো।
চোখ বন্ধ রেখেই চিত্রলেখা বলে,
-প্রয়োজন নেই। এমনি ভালো হয়ে যাবো আমি।
-আমার মনে হয় একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
-সত্যি লাগবে না।
রওনক হয়ত কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে ইতস্ততবোধ করছে। তা আন্দাজ করতে পেরেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-কিছু বলতে চান?
-আমি ভাবছিলাম মেবি তুমি কনসিভ করেছো তাই তোমার শরীর খারাপ লাগছে। খাওয়া দাওয়া করতে পারছো না, বমি হচ্ছে তাই আর কি।
রওনকের কথা শুনে চিত্রলেখার বুকের ভেতর কিছু একটা ধড়াস করে ওঠে। মানুষটা ডেস্পারেটলি নিজের ফ্যামিলি চায়। একটা বাচ্চার কত ইচ্ছা তার! কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে পরে চিত্রলেখা বলে,
-সরি।
-কেনো?
-আম… আমার ইয়ে হয়ে গেছে। আজ ২ দিন চলছে। সেজন্যই শরীরটা খারাপ লাগছে। আমি আমি কনসিভ করিনি।
ইয়ে বলতে চিত্রলেখা কি বুঝাতে চেয়েছে তা ভালো করেই বুঝতে পারছে রওনক। এখনো তার সামনে লজ্জা পায় সে। তাই তো পিরিয়ড শব্দটা উচ্চারণ করতেও এত দ্বিধা তার। রওনক অবশ্য জোর করে না। আস্তেধীরেই নাহয় লজ্জা ভাঙবে। তার কোনো তাড়া নেই। একটা গোটা জীবন পরে আছে তাদের একত্রে পাড়ি দেয়ার।
রওনককে চুপ করে থাকতে দেখে চিত্রলেখা আবারও বলে,
-আই এম সরি।
-তুমি সরি বলছো কেনো?
-আমি কনসিভ করিনি।
-তো!
-আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি।
-কে বলল পারোনি? যার আসার সে তার সময় মতো আসবে৷ না আসা পর্যন্ত আমরা নাহয় চেষ্টা করতে থাকবো। বোকা মেয়ে।
এক মুহূর্ত চুপ করে রওনক আরও বলে,
-এখন খাবার দিয়ে যেতে বলছি। কিছু খাওয়ার পর ঔষধ খাবে কেমন?
-না প্লিজ! আমি কিছু খাবো না।
-খেতে তো হবেই। তুমি নিজে না খেতে চাইলে আমি জোর করে খাওয়াবো।
-প্লিজ!
চিত্রলেখার প্লিজকে তোয়াক্কা না করে রওনক উঠে বসে জাহানারাকে ফোন করে বলে ঘরেই তাদের দু’জনের খাবার দিয়ে যেতে।
খাওয়া শেষ করে মুখ ভার করে রেখেছে চিত্রলেখা। রওনক হাসতে হাসতেই মুখ মুছে দেয় তার। জাহানারা এসে সব নিয়ে গেলে পরে রওনক এক গ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি বসে৷ আরেক হাতে থাকা ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বলে,
-নাও, খাও।
অন্য দিকে মুখে ঘুরিয়ে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-খাবো না।
-সুন্দর করে বলছি খাও নয়ত কিন্তু আমি জোর করে খাওয়াতে জানি।
বাধ্য হয়েই ঔষধ টা খেয়ে নেয় সে। পানির গ্লাসটা বেডসাইড টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে রওনক এগিয়ে গিয়ে পিঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে চিত্রলেখাকে কাছে ডাকে। সে কাছে যেতেই তাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে নেয়। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
-এভাবেই থাকো কিচ্ছুক্ষণ।
রওনকের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-আজ অফিস যাবেন না?
-না।
-কেনো?
-আমার বউ অসুস্থ। তার খেয়াল রাখার চাইতে জরুরী কোনো কাজ নেই আপাতত আমার।
চিত্রলেখা মুখে কিছু বলে না। কেবল শব্দহীন হাসে। এই মানুষটার বলা কথা তার ভেতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। শিহরণের দোলা দিয়ে যায়। আবার ভয়ও লাগে তার। সারাজীবন সব এমনই থাকবো তো নাকি এইসব কিছু সাময়িক!
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৭০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)
সবেই কোচিং শেষ করে বাসায় ফিরছে চারু। মেইন রোড ছেড়ে এলাকার গলিতে ঢুকেছে। প্রতিদিন এদিক দিয়ে যাওয়া আসার সময় সতর্কভাবে চারিদিকে চোখ বুলায় সে। কোথাও মামুনকে দেখা যায় কিনা সেই আশায়। কিন্তু চিত্রলেখার বিয়ের কথা জানার পর সেদিনের পরে আর মামুনকে দেখতে পায়নি সে এলাকায়। মানুষটা যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মামুন নিজের ইচ্ছায় হারিয়েছে তাই তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হারিয়ে যাওয়া মানুষ খুঁজে পাওয়া গেলেও যে নিজে থেকে হারায় তাকে হাজার চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া যায় না। মামুনের ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। তাছাড়া আর কোথায়ই বা খুঁজবে সে মামুনকে? তার বাড়িতে গিয়ে আচমকা জিজ্ঞেস করলে সবাই আড়চোখ করে তাকাবে। তাই ধৈর্য্য ধরে রাখে সে নিজে থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই চারুর।
প্রতিদিনের মতোই আনমনে সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই এদিক সেদিক চোখ বুলাচ্ছে সে। যদিও জানে মামুনের দেখা মিলবে না। একটু পরপর ফস ফস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতেই বাড়ি দিকে আগায় সে৷ কিন্তু আচমকাই মাঝামাঝি এসে তার কদম থমকে যায়। গলির মোড়ের টং দোকানের সামনেই রাখা মামুনের বাইকটা। সেটাকে অনুসরণ করে টং দোকানের ভেতরে তাকাতেই চায়ের কাপ হাতে বসা মামুনকে দেখতে পায় সে। নিজের চোখের দেখা বিশ্বাস করতে নিজের সাথেই যুদ্ধ করতে হয় তাকে। চারুর পায়ের কদম আপনাআপনিই ধীর গতিতে আগাচ্ছে সামনের দিকে। ছোট ছোট কদম ফেলে বাইকটার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। মামুন এখনো চারুকে দেখতে পায়নি। সে ব্যস্ত গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক বসাতে বসাতে টং দোকানে উপস্থিত সকলের সঙ্গে খোশগল্পে মজতে। সে টেরই পায়নি মাত্র কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে চারু নামক মেয়েটা এক পৃথিবী মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ এখনো বিশ্বাস হয় না তার। চারু মনে করে সে বড় করে চোখের পলক ফেললেই মামুন গায়েব হয়ে যাবে। ঐ যে সিনেমায় দেখায় না ঠিক সেরকম৷ সিনেমায় যেমন দেখায় নায়িকা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অপলক নায়ককে দেখতে পায় চোখের সামনে। যেই সে পলক ফেলে ওমনিই নায়ক ধোঁয়া হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যার সহজ অর্থ নায়িকা এতক্ষণ নিজের কল্পনায় দেখছিল তার প্রিয় মানুষটাকে। চারুর মনে হয় সে নিজেও এই মুহূর্তে একই কাজ করছে। মামুনকে এক নজর দেখতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার বক্ষপিঞ্জরে। সেই তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই চোখের সামনে মামুনকে তার বাইকটা কল্পনা করছে সে। সে যদি এক্ষুনি চোখ বন্ধ করে আবার খুলে তাহলেই দেখবে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। না মামুন আর না তার বাইক। সব হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আরও কিচ্ছুক্ষণ মামুনকে দেখতে চায় সে। হাওয়া মিলিয়ে যাওয়ার আগে আরও কিচ্ছুক্ষণ চোখের শান্তি করে নিতে চায়। সত্যি সত্যি কবে দেখা হবে তার তো কোনো ঠিক নেই। তাই এই মুহূর্তে কল্পনাই ভরসা। অথচ কল্পনা অবিকল বাস্তবতার মতোই অনুভূতি দিচ্ছে চারুকে। সে হাত বাড়িয়ে মামুনের বাইকের উপর হাত রেখেছে। আচ্ছা স্বপ্নে বা কল্পনায় কিছু ছুঁয়ে দেয়া যায়? অনুভব করা যায়? অথচ সে করতে পারছে। এই যে হাতের নিচে থাকা বাইকটা অনুভব করতে পারছে। একবার কি চোখটা বন্ধ করে দেখবে মামুন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কিনা! দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে চারু। তার হাত জোড়া এখনো মামুনের বাইকের উপর রাখা। চোখ বন্ধ অবস্থায় এখনো সে অনুভব করতে পারছে বাইকটা। তার মানে এখনো সব ভ্যানিস হয়ে যায়নি। নিশ্চয়ই সে চোখ মেললেই মামুন নাই হয়ে যাবে সঙ্গে তার বাইকটাও। কিচ্ছুক্ষণ সময় নেয় চারু চোখ মেলার আগে। চাইলেই তো সারাদিন সে এখানে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। বরং পরিচিত কেউ তাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফেলার আগে বাড়ি যেতে হবে। অন্যথায় সে বাড়ি পৌঁছানোর আগে তার মাঝ রাস্তায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকার খবর হয় লিখন নয় খালার কান অব্দি পৌঁছে যাবে। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তেধীরে সময় নিয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সব আগের মতোই আছে। মামুন, তার বাইক কোনোটাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগে চারুর বুঝতে কি হচ্ছে। এখনো বাইকটা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি মামুনের মুখের উপর। এসব কল্পনা নয় বরং বাস্তব। বুঝতে পেরেই চোখ বড় হয় চারুর। তার নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে আসে।
-মামুন ভাই!
বলেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। চারুর এক ডাকেই এদিকে তাকায় মামুন। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই তাদের দু’জনের চোখে চোখ পরে। চারু এখনো মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে আছে। মামুন এদিক তাকিয়ে চারুকে দেখতে পেয়ে, এদিকেই তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। কারো কোনো নড়াচড়া নেই। কিছুটা সময় নিয়েই যেনো দু’জন দু’জনকে দেখে নেয়। চারু ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। সে যেনো নড়তে ভুলে গেছে। হাঁটতে ভুলে গেছে। কথা বলতে ভুলে গেছে। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। সবই যেনো ভুলে গেছে সে এই মুহূর্তে। অন্যদিকে সগতিক হয় মামুন। অন্যদের উপস্থিতিতে তার এভাবে চারুর দিকে তাকিয়ে থাকাটা অনুচিত, মন্দ দেখায়। এতক্ষণে পাশে বসে থাকা কেউ কেউ মামুনের দৃষ্টি লক্ষ করে চারুর দিকে তাকিয়েছে। কেউ কেউ চারুর মুখে মামুনের নাম শুনে তৎক্ষনাৎই হয়ত তাকিয়েছে। হাতে থাকা চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে সে। পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে টাকা এগিয়ে দেয় চায়ের বিল পরিশোধ করতে। টং দোকানদার গফুর আলী আপত্তি করে বলেন,
-না মামুন ভাই আজকা আপনের থে ট্যাকা পয়সা লমু না। আমার পক্ষর থে আপনারে টিট। কতদিন পর আইলেন কন তো। আপনেরে ছাড়া কি আমার দোকানর আড্ডা জমে কওন তো?
গফুরের কথায় হেসে দিয়ে মামুন বলে,
-না গফুর ভাই তোমাদের মামুন আর বেকার নেই। বিনা পয়সায় সে কারো থেকে কিছু নেয় না এখন আর।
জোর করেই গফুরের হাতে টাকাটা গুঁজে দেয় সে। মামুনের কণ্ঠটা কেমন যেনো পাল্টে গেছে। আগের সেই অলসতা, চঞ্চলতা নেই তার কন্ঠে। একটা নতুন ভারিক্কি এসেছে যেনো সেই জায়গায়। আগে কখনো এমন শুনায়নি তার কথা। হঠাৎ এত পরিবর্তন কিসের? এগিয়ে এসে চারুর মুখোমুখি দাঁড়ায় মামুন। এক পলক চারুর বিষ্ময়ে বড় হয়ে থাকা চোখে চোখ পরে তার। পরক্ষণেই চারুর খৈ হারা নয়ন থেকে চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছো চারু?
মামুনের প্রশ্নে যেনো চারুর ভেতর কিছু একটা হলো। ধড়াস করে ওঠে ভেতরটা। এতক্ষণে সে খেয়াল করেছে মামুনের কেবল কন্ঠেই পরিবর্তন আসেনি। আপাদমস্তক মানুষটাই যেনো পাল্টে গেছে অনেকখানি। এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাক মামুন আর আগের মামুনের ভেতর চোখে ধরা পরার মতো পরিবর্তন পরিলক্ষিত। সবসময় কপালের উপর চুল ফেলে রাখা মামুনের আজ কপালে চুল নেই। বরং হাতের মুঠোয় ধরতে পারা লম্বা চুলগুলো কেটে ছোট করে ফেলেছে সে। আর্মি কাটে যথেষ্ট ডিসেন্ট লাগছে তাকে দেখতে। অথচ আগে তার গেটআপে ডিসেন্ট টাচ ছিল না। সবসময় একটা এলাকার বখাটে ছেলে ভাব দেখা যেতো তার পোশাক-আশাকে। যদিও সে কখনোই বখাাটে ছিল না কিন্তু খানিকটা সেরকমই বেশ ভুষায় থাকতো আর কি। অথচ আজ তাকে দেখে ওরকম লাগছে না। মনে হচ্ছে এ যেনো অন্য কোনো মানুষ। যে অবিকল মামুনের মতো দেখতে। তার পরণে নীল রঙের জিন্স। সাদা শার্টের উপর একটা আরামদায়ক নীল রঙের হুডি পরে আছে সে। টং দোকানের ভেতর বসে থাকা অবস্থায় হুডিটা তার মাথার উপরে টানা ছিল। এগিয়ে এসে চারুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে নিজেই হুডিটা নামিয়েছে। তখনই এই আমূল-পরিবর্তনটা চারুর দৃষ্টিতে ধরা পরেছে। এই যে মাস তিনেকের ব্যবধানে তার সামনে ভিন্ন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আজ কিন্তু চারু কি এই পরিবর্তিত মানুষটার অপেক্ষায় ছিল? সে তো তার সেই আগের মামুন ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। যার চোখে কেবল মায়ার জন্য অস্থিরতা প্রকাশ পেতো সবসময়। মায়াকে নিজের করে পাবার ব্যাকুলতা দেখা যেতো। অথচ আজ এই মানুষটার চোখে তো দূরের কথা, চোখের কোনো কোণাতেও মায়ার অস্তিত্ব নেই। মামুন ভাই কি তাহলে তার মায়াকে ভুলে গেছে? এই অল্প সময়ের ব্যবধানে! এত অল্প সময়ে কি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায়? এখন কি তাহলে সে আর মায়া মায়া করে অস্থির হবে না? ব্যাকুলতার সুর তুলবেন না? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কি এতে চারুর খুশি হওয়া উচিত? সে কখনো তার চেতন বা অবচেতনে মামুনের জীবনে তার মায়ার জায়গা নিতে চায়নি। আবার সবসময় তাকে মায়া মায়া করে অস্থির হয়ে থাকতে দেখেও মন খারাপ লাগতো তার। একটা কেমন বিষন্নতায় ভেতরটা ছেয়ে থাকতো। এমন কেনো লাগতো তার? তাহলে কি সে মনে মনে মামুনের জীবনে মায়ার জায়গাটা চায়?
আপন মস্তিষ্কে আবোলতাবোল ভাবতে ব্যস্ত চারুর খেয়ালই নেই মামুন তাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। অনেকক্ষণ কোনো জবাব না পেয়ে মামুন ছোট্ট করে নরম সুরে আবার ডাকে,
-চারু!
এবারে যেনো ধ্যান ভেঙে বেরিয়ে আসে চারু অজানা কোনো অতল থেকে। হুড়মুড় করে জিজ্ঞেস করে,
-জি, মামুন ভাই? কিছু বলছিলেন আপনি?
-জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছো তুমি?
চারু চুপ করে তাকিয়ে রয় মামুনের মুখের দিকে। তাকে করা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তার মুখে,
-এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি মামুন ভাই? এভাবে কেউ কিছু না বলে গায়েব হয়ে যায় বলুন তো? আমি কত খুঁজেছি আপনাকে আপনি জানেন? এগলি, ওগলি করে কোনো গলির মোড় বাদ রাখিন। কেবল আপনার বাড়ি যাওয়াটা বাদ আছে। এমন লুকিয়ে ছিলেন কেনো? কার থেকে লুকিয়ে ছিলেন বলুন তো?
আগুনের ফুলকির মতো চারুর মুখ গলে বেরিয়ে আসা এক একটা প্রশ্নের তৎক্ষনাৎ জবাব দেয় না মামুন। স্মিত হাসে সে, যে হাসির কোনো শব্দ নেই কেবল চোখে দেখা যায় মানুষটা হাসছে।
-এখানে আর কার জন্য পরে থাকবো বলো তো? আমার কি নিজের বলতে কেউ আছে এখানে? কিছু কি অবশিষ্ট আছে? কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। সেজন্যই তো নিজেকে খুঁজে পেতে রাজ পথে নেমেছি আমি। ছুটে চলছি দিক থেকে দিগান্তর।
-কে বলল কেউ নেই?
অন্যদিকে তাকিয়ে সামান্য ধরা গলায় মামুন বলে,
-মায়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সব চেলে গেছে চারু। আমি শূন্য হয়ে গেছি। আমার ভেডরটা ফাঁকা হয়ে গেছে।
-আমার দিকে তাকান মামুন ভাই।
মুখটা ঘুরিয়ে এনে চারুর মুখের দিকে তাকায় সে। তারা দু’জনে মামুনের বাইকের দু’পাশে দাঁড়িয়ে। মামুন চোখ মেলে তাকালেই তাকে চমকে দিয়ে চারু বলে,
-আমাকে কি আপনার চোখে পরে না মামুন ভাই? আপনি কি দেখতে পান না আমাকে? আমার সব ব্যাকুলতা…
তৎক্ষনাৎই চোখ সরু হয় মামুনের। তা দেখে মাঝপথেই কথা বন্ধ হয়ে যায় চারুর। এই ধরনের কথাবার্তা মামুনের পছন্দ হচ্ছে না। নিচের দিকে চোখ নামিয়ে নিয়ে সে বলে,
-বাড়ি যাও চারু। অনেকক্ষণ হয় রাস্তায় দাঁড়ায় আছো। খারাপ দেখায় মানুষ দেখতেছে, বাড়ি যাও।
-মামুন ভাই…
-বাড়ি যাও চারু।
আর কিছু বলে না চারু। মামুন তার থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে৷ তার চোখে চোখ রাখছে না। সে কি বুঝতে পারছে চারুর ভেতরকার ভাঙন। নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে মিনমিনে সুরে জিজ্ঞেস করে,
-আমাদের কি আর দেখা হবে না মামুন ভাই?
-জানি না। হলেও হতে পারে।
-আপনি কি আবার চলে যাবেন?
-হ্যাঁ।
ঝট করেই মুখ তুলে মামুনের মুখের দিকে তাকায় চারু। কিন্তু মামুন তাকায় না৷ তার দৃষ্টি অন্যপাশের রাস্তার দিকে। না তাকালেও বুঝতে পারে চারুর দৃষ্টি তার মুখের উপর। সে মুখটা এদিক ঘুরালে দেখতে পেতো চারুর চোখে ভার হওয়া পানির উপস্থিতি। নিজের কন্ঠের স্বাভাবিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করে চারু বলে,
-কই যাবেন আপনি?
-সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি বাড়ি যাও।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না চারু। তৎক্ষনাৎই বাড়ির দিকের রাস্তা মাপা শুরু করে। দ্রুত কদম ফালায় সে সামনের দিকে। জলদি সরে যাবার প্রচেষ্টায় যাতে করে পেছনে দাঁড়িয়ে মামুন যেনো টের না পায় তার গাল বেয়ে ইতোমধ্যে অশ্রুর বন্যা বইতে আরম্ভ করেছে। নিজের চোখের পানি সে কাউকে দেখাতে চায় না। এমনকি যার জন্য এই পানি তাকেও নয়।
পেছনে দাঁড়িয়ে মামুন একবার চারুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
চলবে…