মাতাল হাওয়া পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭

0
587

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক কখন গিয়ে পৌঁছাবে সেই চিন্তায় মনে মনে বারবার তটস্থ থাকছে চিত্রলেখা। নিশ্চয়ই পৌঁছে তাকে ফোন করবে। সেজন্য ফোনটা হাতের কাছে কাছেই রাখছে। কয়েকবার চেকও করেছে ফোনটা জেনারেল করা আছে কিনা। চার্জ আছে কিনা। যদি চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যায় আর তখন রওনক ফোন করে তাকে না পায়। সেজন্য ফোনে ফুল চার্জ করে রেখেছে। সকাল সকাল এসে নিজে রুটি আলু ভাজি করে ভাইবোন ও খালাকে নিয়ে নাস্তা করেছে। লিখনকে বাজারে যেতে বলেছিল কিন্তু তার জরুরী ক্লাস আছে বলে সে কোনো রকম নাস্তা করেই বেরিয়ে গেছে। তাই চয়নকে বাজারে পাঠিয়েছে আজ বিরিয়ানি রান্না করার পরিকল্পনা চিত্রলেখার। তিনরাত নিজের চিরচেনা এই ঘরে ছিল না চিত্রলেখা অথচ তার মনে হচ্ছে কতশত রাত সে এই ঘরে থাকেনি। নাস্তার পর লিখন বেরিয়ে গেলে পরে চয়নকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা এখন নিজের ঘরে বসে আছে। তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে চারু। আজ সে কোথাও যাবে না। পড়াশুনা থেকে ছুটি নিয়েছে। চিত্রলেখাও কিছু বলেনি। চারুর জন্য চিত্রলেখা তার মায়ের চাইতে কোনো অংশে কম নয় তাই সেও বাঁধা দেয়নি। বরং নিজেই ভেবেছে সে তো কয়টা দিন আছেই এখানে একটা দিন তার কাছেই থাকুক চারু। দু’দিনের দূরত্বে যত কথা জমেছে সব বলবে দু’বোনে। রওনক চলে আসার পর আবার কবে আসতে পারবে কে জানে। এবার না হয় রওনক নিজেই বলেছে এখানে এসে থাকতে পরে যদি সে অনুমতি না দেয়! এভাবে এসে থাকার সুযোগ পরে যদি না পাওয়া যায়! সবসময় তো নিজের ঘর-সংসার ফেলে চাইলেও চিত্রলেখা আসতে পারবে না।

চিত্রলেখার কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে চারু কিন্তু ঘুমায়নি সে।

-আপা!

-হু

-জানো আপা সেদিনের পর মামুন ভাই আর আমাদের বাড়ি আসেনি।

চিত্রলেখা কেবল শুনে মুখে কিছু বলে না। মামুনের জন্য খারাপ লাগে তার। আর কেউ না জানলেও সে জানে তার প্রতি মামুনের ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। তার নিজের দূর্ভাগ্য সেই ভালোবাসা সে গ্রহণ করতে পারেনি। হয়ত মামুন তার জন্য নয় বলেই সে কখনো মামুনকে, মামুনের ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে পারেনি, গ্রহণ করার কথা ভাবেনি।

লিখন আর রিপা একে-অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। লিখনের এমনিও কিছু বলার নেই। সে শুনতে চায়, জানতে চায় রিপার সঙ্গে রওনকের সম্পর্ক কি। রিপা ভালো করেই জানে লিখন কি জানতে চায় তার কাছে। সব বলার আগে খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রিপা বলতে শুরু করে,

-রওনক ভাইয়ের বাবা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। এছাড়াও জামান গ্রুপের শেয়ার হোল্ডার আবার বাবা। বিজনেস পার্টনার বলতে পারো।

-আগেরদিন তাহলে বলোনি কেনো এসব কথা আমাকে?

-আসলে তুমি এত ডিস্টার্ব ছিলে আমি তোমাকে আরও ডিস্টার্ব করতে চাইনি সেজন্য তখনই কিছু বলিনি।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-এর বাইরে কি আর কিছু আছে রিপা যা আমার জানা উচিত কিন্তু তুমি আমাকে বলছো না, আমি টেনশন করব ভেবে।

লিখনকের কথা শুনে থমকে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাকায় রিপা। চোখে থাকা রাউন্ড শেপের চশমা ঠিক করার চেষ্টা করার বাহানায় নিজের নার্ভাসনেস লুকানোর চেষ্টা করে। যদিও রিপার উত্তরে লিখন সন্তুষ্ট নয় তারপরেও আর ঘাটে না সে এই বিষয়ে। রিপাকে সে খুব ভালো করেই চিনি। যদি সে কিছু আড়াল করেও থাকে তাহলে ভালোর জন্যই করেছে। লিখন কখনো দেখেনি রিপা জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করেছে। তাই আর এই বিষয়টায় বাড়তি কথা বলে না। রিপার নিজের যখন উপযুক্ত মনে হবে সে নিজেই তাকে সব জানাবে। শুধু লিখনের একটাই চিন্তা ওর বোনটা ভালো থাকলেই হলো। রিপা সম্ভবত লিখনের মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে তাই সামান্য কাছাকাছি এগিয়ে এসে একটা হাত ধরে বলে,

-তোমার চিন্তাটা আমি বুঝি লিখন। কিন্তু আপাকে নিয়ে চিন্তা করা এবার তুমি বাদ দিতে পারবো। আপার জন্য তোমার না ভাবলেও চলবে।

অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে রিপার দিকে তাকায় লিখন। অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে,

-আমার বোনের জন্য আমি চিন্তা করব না?

-তুমি আর চিন্তা না করলেও চলবে লিখন। রওনক ভাই আছে আপার জন্য।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে রিপার দিকে তাকিয়ে থাকে লিখন। কি বলতে চাইছে সে। লিখনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। রিপা নিজেই উত্তর করে তার দৃষ্টির জিজ্ঞাসা টের পেয়ে।

-রওনক ভাই মানুষটা খাটি লিখন। সে কখনো মাঝপথে আপার হাত ছাড়বে না। মানুষটার দায়িত্ববোধের কোনো সীমা নেই। আপাকে সে কখনো হেলায় ফেলবে না বরং অনেক ভালোবাসবে সবসময় এতটুকু আমি তোমাকে গ্যারিন্টি দিয়ে বলতে পারি তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

-আমার বোন মানুষটাই এমন রিপা। পর কেও আপন করে নেবার গুন আছে আমার বোনের কিন্তু আমার চিন্তাটা তুমি বুঝবে না। রওনক জামান আর আমার বোন দু’জন দুই পৃথিবীর মানুষ। আমার বোনটা একদম সরল। কেউ চাইলে খুব সহজেই আপার সরলতার সুযোগ নিতে পারবে। কষ্ট পেলেও আমার বোন উফ করবে না, কাউকে কিচ্ছু বলবে না।

-আমাদের ঘটনাও কিন্তু একই লিখন। আমরা দুইজনও দুই পৃথিবীরই মানুষ।

-কিন্তু আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। জেনে বুঝে পরিকল্পনা করে আগাচ্ছি। আপার বিয়েটা আচমকা হয়েছে। সবাই যতই বলুক আপা ঐ লোকটাকে ভালোবাসে আমি তা বিশ্বাস করি না। আমার বোনকে আমি চিনি। এই বিয়ের পিছনে কোনো একটা কিন্তু আছে রিপা। আপা না বললেও আমি বুঝি আমার বোন আবার নিজেকে সেক্রিফাইজ করেছে আমাদের জন্য। কেউ আমার বোনের সরলতার সুযোগ নিচ্ছে, নিবে এই বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না কখনো পারবোও না।

-প্লিজ লিখন আই রিকুয়েস্ট ইউ ট্রাস্ট দ্যাম। আপার উপর বিশ্বাস রাখো সে না ভেবে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত এমনি এমনি নেয়নি নিশ্চয়ই। তাছাড়া রওনক ভাই থাকতে এমন কিচ্ছু হবে না। কেউ আপার সুযোগ নিতে পারবে না এই ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। সে কাউকে সেই সু্যোগই দিবে না। দেখবে আপাকে সবরকম প্রতিকূলতা থেকে আগলে রাখবে। তুমি অহেতুক চিন্তা করো না। একটু ভরসা করেই দেখো।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে লিখন। মনে মনে ভাবে, সে নিজেই যে আমার বোনের সরলতার, সমস্যার সুযোগ নিচ্ছে না তার কি গ্যারান্টি আছে? হতেই পারে এই বিয়েটা লোক দেখানো। এই বিয়ের পেছনে অন্য কিছু লুকিয়ে আছে। লিখন খুব ভালো করে জানে আড়ালে অন্য কিছু থাকলেও চিত্রলেখা কখনোই তাকে সেটা জানাবে না। চিত্রলেখাকে কারো সঙ্গে নিজের চিন্তা, দুশ্চিন্তা শেয়ার করে না। বিশেষ করে ভাইবোনদের কিছু জানায় না সে দুশ্চিন্তা করবে বলে।

বিকেল থেকে চিত্রলেখার দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এখন পর্যন্ত সে রওনকের থেকে কোনো আপডেট পায়নি। গিয়ে পৌঁছেছে কিনা কে জানে। পৌঁছে থাকলে নিশ্চয়ই তাকে একবার ফোন করতো সে। নাকি করতো না? চিন্তা করে ভেবে কিছু কুলকিনারা করতে পারে না সে। কতক্ষন লাগবে তার মেক্সিকো গিয়ে পৌঁছাতে? প্লেন তো অনেক দ্রুত যায় তাহলে কি সারাদিনেও গিয়ে পৌছেনি সে! প্লেনটা ঠিকঠাক গিয়ে পৌঁছেছে তো! পথে কোনো বিপদ হয়নি তো! অনেক সময়ই তো দেখা যায় আকাশ পথে প্লেন ক্রাশ করেছে এমন কিছু হয়নি তো! কথায় আছে শূন্য মস্তিষ্ক হচ্ছে শয়তানে ঘর। চিত্রলেখার আপাতত কিছু করার নেই এক রওনকের জন্য দুশ্চিন্তা করা ছাড়া। এক ভাবনা থেকে আরেক ভাবনার উদয় হচ্ছে তার মস্তিষ্কে। সেইসব ভাবনা থেকেই যত্তসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা এসে তার মস্তিষ্কে খুটি গাড়ছে। আবার এও মনে হচ্ছে রওনক হয়ত পৌঁছে গেছে ইচ্ছা করেই তাকে ফোন করেনি। হয়ত তাকে জানানোটা জরুরী কিছু নয়। তাকে জানানোটা কি আসলেই জরুরী? কে সে? রওনকের আইনত বিবাহিত স্ত্রী কিন্তু এর বাইরে তার জীবনে চিত্রলেখার স্থান কোথায়? জানা নেই চিত্রলেখার। এই মুহূর্তে এসব কথা সে ভাবতেও চাইছে না। দুশ্চিন্তাদের দুই হাতে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু এতে বিশেষ কাজ হয় না। দুশ্চিন্তা একবার মস্তিষ্কে বাসা বাঁধতে পারলে সহজে দূর করা যায় না।

রাত ৮টা বাজে সবেই অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়েছে লাবিব। ব্লেজারের বুক পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায় বাধ্য হয়েই বাইকটা সাইড করে দাঁড় করায়। রওনক দেশে না থাকলে লাবিবের কাজের চাপ বেড়ে যায় শতগুন। তাকে রওনকের হয়ে অনেক কাজ সামাল দিতে হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আজ সারাদিনে রওনকের হয়ে তাকে তিনটা মিটিং এটেন্ড করতে হয়েছে। দুটো মিটিং এ তানিয়া ছিল তার সঙ্গে। জরুরী কিছু হতে পারে ভেবেই ফোনটা বের করে হাতে নেয় সে। স্ক্রিনে ভাসা চিত্রলেখার নাম দেখে সময় বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎই রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে,

-কি করতে পারি মিসেস সিইও এর জন্য।

লাইনের অন্যপাশ থেকে আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-তোমাকে বিরক্ত করলাম বুঝি?

-একদমই নয়। কি হয়েছে চিত্রলেখা তোমাকে চিন্তিত শুনাচ্ছে? এনি প্রবলেম?

-না মানে জানতে চাইছিলাম তোমার কি উনার সঙ্গে কথা হয়েছে? না মানে উনি কি গিয়ে পৌঁছেছেন? আমাকে এখনো কিছু জানাননি। হয়ত গিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। ফোন করার সুযোগ পাননি। তোমাকে নিশ্চয়ই জানিয়েছেন কিছু?

-টেনশন হচ্ছে বুঝি হাসবেন্ডের জন্য?

-না না তেমন কিছু না প্লেন করে গেলো তাই একটু…

চিত্রলেখাকে আমতা আমতা করতে শুনে হেসে ফেলে লাবিব। মৃদু হেসে বলে,

-ইটস ওকে চিত্রলেখা। তোমার হাসবেন্ড তুমি টেনশন করতেই পারো। এতে ইতস্ততবোধ করার কিছু নেই। হি ইজ অল ইউর’স।

জড়তাদের হাতে ঠেলে এবারে চিত্রলেখা পরিষ্কার কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-তোমার সঙ্গে কি উনার কথা হয়েছে?

-স্যার তো এখনো গিয়ে পৌঁছেনি।

-এখনো পৌঁছায়নি?

-উঁহু, অলমোস্ট ২০ ঘন্টার ফ্লাইট। ভোরে গিয়ে পৌছাবেন। হোটেলে চেক ইন করতে করতে সকাল হবে।

-ওহ!

-তুমি টেনশন করো না। স্যার পৌঁছে গেলে সবার আগে তোমাকেই ফোন করবেন। উনি জানেন তুমি টেনশন করছো। উনার ফোন কলের অপেক্ষায় আছো।

“আসলেই কি উনি জানেন?” মনে মনে ভাবে চিত্রলেখা মুখের আর প্রশ্নটা করে না। এতক্ষনে খানিকটা ইজি লাগে চিত্রলেখার। ফ্লাই টাইম সম্পর্কে আইডিয়া ছিল না তার। টেনশনে মাথা কাজ করছিল না একবার গুগল করে দেখবে। রওনককে জিজ্ঞেসও করেনি সে কখন গিয়ে পৌছাবে। না জেনেই অহেতুক চিন্তা করছিল। লাবিবকে ফোন করে বিরক্ত করায় নিজেরই খারাপ লাগছে। খানিকটা লজ্জাও লাগছে।

-রাখছি তাহলে।

-চিত্রলেখা শুনো।

-হুম!

-তোমার কিছু লাগলে বা যেকোনো প্রয়োজন আমাকে বলতে পারো। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন তোমার খেয়াল রাখতে। তাই কিছু দরকার হলে আমাকে বলতে লজ্জা করো না কেমন? আমি ২৪ ঘন্টা তোমার সার্ভিসে এভেইলেবল আছি। একটা ফোন করলেই বান্দা হাজির হয়ে যাবে তোমার খেদমতে।

-থ্যাংকিউ।

-ইটস ওকে, ইটস মাই ডিউটি। আলসো রেস্পন্সিব্লিটি এজ এ ফ্রেন্ড। জাস্ট রিমেম্বার আই এম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ।

মৌন হেসে লাইন কাটে চিত্রলেখা। লাইন কাটার পরেও কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে রয় সে। কখন রওনক ফোন করে জানাবে সে সুস্থ ভাবে পৌঁছে গেছেন। এতটুকু জানার জন্যই অস্থির লাগছে চিত্রলেখার। এর আগে কখনো এরকম লাগেনি তার, কখনো না।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

তিনটা রাত যেন শত শত রাতের সমান। আজ ৩ রাত পরে একত্রে নিজেদের ড্রইং রুমের মেঝেতে আসন পেতে খেতে বসেছে ওরা সবাই। অথচ সবারই মনে হচ্ছে কতশত রাত তারা একত্রে খেতে বসে না। চিত্রলেখা নিজের হাতে ওদের বেড়ে খাওয়ায় না। দুপুরে লিখন বাসায় ছিল না বলে বিরিয়ানি রান্নার প্রস্তুতি নিয়েও সেটা রাতের জন্য রেখে দিয়েছিল। চার ভাইবোনের মধ্যে লিখনটা সবচাইতে বেশি বিরিয়ানি ভক্ত। এই ছেলেকে বছরের ৩৬৫ দিন বিরিয়ানি খেতে দিলেও এর অভক্তি আসবে না। তাই লিখনকে রেখে দুপুরবেলায় বিরিয়ানি রান্না করে খেতে মন সায় দেয়নি চিত্রলেখার। লিখন যখন সমস্তদিনের ব্যস্ততা শেষ করে বাসায় ঢুকে তখন প্রথমেই তার নাকে বিরিয়ানির সুবাস লাগতেই সে সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে চিত্রলেখাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, আলু বেশি করে দিয়েছে কিনা। এই ছেলের সব একদিকে আর বিরিয়ানির আলু আরেকদিকে। বিরিয়ানির আলুকে লিখন যতটা ভালোবাসে ততটা রিপাকে ভালোবাসে কিনা সন্দেহ!

খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায় লিখন বলে,

-তুমি যেহেতু কয়দিন আছো এক কাজ করি। সময় করে কাল পরশু বাসা দেখে ফেলি। কি বলো আপা?

লিখনের কথায় প্লেট থেকে মুখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। খালু আলটিমেটাম দিয়েছিল এই মাসেই বাড়ি খালি করে দিতে। একমুহূর্ত লিখনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চিত্রলেখা পূনরায় নিজের প্লেটে মনোযোগ দিয়ে বলে,

-বাসা দেখার কোনো প্রয়োজন নাই।

-মানে!

অন্য সবার দৃষ্টি এখন খাওয়া রেখে চিত্রলেখার মুখের দিকে। আরেক লোকমা খাবার মুখে পুড়ে দিয়ে মুখ তুলে একবার একে একে সবার মুখ দেখে নিয়ে লিখনের দিকে স্থির হয়ে বলে,

-বাসা ছাড়তে হবে না। তোরা এখানেই থাকবি।

-কীভাবে?

-যেভাবে থাকতেছিস সেভাবে।

-আপা! খালু আমাদেরকে বাড়ি খালি করে দিতে বলছে।

-বলছিল। এখন আর বলবে না। বাড়ি খালি করতে হবে না।

চিত্রলেখার কথার আগামাথা কিছুই ধরতে পারে না কেউ। এদিকে চিত্রলেখা সংশয়ে ভুগছে। সে কি বলবে এই বাড়ির মালিক এখন সে! সবাই কি ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে দেখবে? অফিসের বসকে বিয়ে করে রাতারাতি বাড়ির মালিক হয়ে গেছে সে। নিশ্চয়ই অন্যরা ব্যাপারটা স্বাভাবিক বা সুন্দর চোখে দেখবে না। সবার ভেতর একটা ধারণাই তৈরি হবে। টাকার জন্য বিয়েটা করেছে সে। কিন্তু এটা তো সম্পূর্ণ সত্য নয়। টাকার লোভে সে রওনককে বিয়ে করেনি। টাকা পয়সার কোনো লোভ নেই তার। নিজের জন্য কিচ্ছু চাই না। এটা সত্যি রওনক তাকে কথা দিয়েছে তার ভাইবোনদের সব সবস্বপ্ন পূরন করতে পাশে থাকবে। কিন্তু সেটার মানে কি এই হয় যে টাকার লোভেই বিয়েটা করেছে সে! হয়ত চেতন মনে নয় কিন্তু চিত্রলেখার অবচেতন মন এটা বুঝে গিয়েছিল রওনককে বিয়ে করলে তার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। কারণ পার্থিব জীবনের যেকোনো সমস্যা অর্থের বিনিময়ে সমাধান করা যায়। আর রওনকের সেই ক্ষমতা আছে। সে চাইলে একটা চুটকি বাজিয়ে চিত্রলেখার জীবনের সব সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে আর বলা যায় করে দিচ্ছেও। এই যেমন এইবাড়িটাই তো প্রমাণ। রওনক যখন জানতে পারলো চিত্রলেখাদের বাড়ি খালি করার আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে সে বাড়িটাই কিনে ফেলেছে তাও চিত্রলেখার নামে। একটা কার্ড ধরিয়েছে দিয়েছে সে চিত্রলেখাকে যার কোনো লিমিট নেই। এমন জীবনের কথা তো চিত্রলেখা তার স্বপ্নেও কখনো ভাবি। অথচ আজ সব সত্যি। সব অসম্ভবকে রওনক ঠিক সত্যি করে দেখাবে তার জীবনে এটা চিত্রলেখা জানে। সে যে জিনিসের যোগ্য নয় রওনক তাকে তার যোগ্যতার চাইতে বেশি দিয়েছে, দিচ্ছে হয়ত ভবিষ্যতেও দিবে। অন্তত ততদিন যতদিন তারা একত্রে আছে।

-আপা!

-হু?

-তুমি কি কিছু লুকাইতেছো?

চিত্রলেখার মন একবার বলে সব বলে দিবে আবার মনে হয় এইমুহূর্তে কিছু বলা হয়ত ঠিক হবে না। তাই আপাতত কিছুদিন বিষয়টা চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মনে মনে।

-খালুর সাথে কথা হইছে আমার। আমি রিকুয়েস্ট করে বলছি আমাদের একবছর সময় দিতে৷ একবছর পর বাড়ি খালি করে দিবো।

-আর খালু মেনে নিলো তোমার কথা?

-হ্যাঁ।

এবারে লিখনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নারগিস বেগম বলেন,

-সে তো বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছিল। তার টাকা দরকার। তাইলে তোর কথা এমনি এমনি মেনে নিলো?

-এমনি এমনি মানে নাই। আমি বলছি অন্য কোথাও থাকলে তো ভাড়া দিয়েই থাকা লাগবে। আমি নাহয় ভাড়া বাবদ যে টাকাটা আসে সেটা প্রতিমাসে দিয়ে দিবো। তারপর একবছর পরে বাড়ি খালি করে দিবো। এই কথা শুনে পরে রাজি হইছে।

লিখন আরও কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও বলতে পারে না। তার আগে চিত্রলেখা বলে,

-এত কথার কি আছে আমি বুঝতেছি না। অন্য কোথাও থাকলে তো ভাড়া দিয়েই থাকা লাগবে। এখানে থাকলে সমস্যা কই? ভাড়া দিয়েই থাকবি তোরা। এখানে সবাই পরিচিত। তোরা দুইজন নিজ নিজ লেখাপড়া নিয়ে সারাদিন বাসার বাইরে থাকিস। বাসায় থাকে এক খালা আর চারু। দুইজন মেয়ে মানুষ পরিচিত জায়গায় থাকাই তো ভালো তাই না? আশেপাশের সবাই পরিচিত। যেকোনো দরকারে বা বিপদে আগায় আসবে। এত কথার কিছু নাই। আমি খালুর সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধান করে ফেলছি। আর ভাড়ার টাকা নিয়ে কাউকে চিন্তা করা লাগবে না। ওটা আমি বুঝবো।

-কেমনে বুঝবা তুমি? তুমি তো এখন আর চাকরী করতেছো না।

-আমি কখনো বললাম চাকরী ছেড়ে দিছি? ছুটিতে আছি, চাকরী ছাড়িনি।

উপস্থিত কেউ আর কোনো কথা বলে না। যদিও লিখনের কাছে জিজ্ঞেস করার মতো অনেক প্রশ্নই ছিল কিন্তু এইমুহূর্তে আর এসব কথা তুলে না সে। নারগিস বেগমও বাচ্চাদের সামনে আর কিছু বলেন না।

লাবিবের কাছ থেকে জানার পরেও ভালো লাগছে না চিত্রলেখার। যদিও এখন সে জানে রওনক এখনো বিমানে আছে। তবুও মনের ভেতর সামান্য অস্থিরতা কাজ করছে। মানুষটা সুস্থ মতো পৌছে গেছে জানতে পারলেই আর কোনো চিন্তা থাকবে না তার। বিছানায় কার্নিশ ঘেষে পিঠে বালিশ দিয়ে বসেছে চিত্রলেখা। তার হাতে উপন্যাসের বই। রওনকের ভাবনায় উপন্যাসে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছে না সে, তবুও চেষ্টা করছে মনোনিবেশ করার। চারু বড়বোনের কোল ঘেষে শুয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে।

-আপা!

আচমকা চয়নের ডাকে দুই বোনই বই থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকায়।

-খালা তোমাকে ডাকে।

-আচ্ছা।

বইটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে। চিত্রলেখা চারুকে বলে,

-তুই পড়তে থাক আমি আসতেছি।

খালার ঘরে এসে চিত্রলেখা দেখে নারগিস বেগম বিছানায় বসে আছেন। এগিয়ে এসে খালার মুখোমুখি বসে সে। খালা কিছু বলার আগে নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আমাকে ডাকলা কিছু বলবা?

-দরজাটা আটকে দিয়ে আয়।

চিত্রলেখা তৎক্ষনাৎ কিছু বলে না। খালার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গিয়ে দরজার ছিটকিনি আটকে দিয়ে ফিরে এসে পূর্বের জায়গায় বসে। নারগিস বেগমের চোখ-মুখে সিরিয়াসনেস। এবারে তিনি নিজেই জিজ্ঞেস করেন,

-সত্যিটা কি চিত্রলেখা?

-কোন সত্যি খালা?

-মানুষটার সঙ্গে এত বছর সংসার করলাম। উনাকে আমার চাইতে ভালো কেউ চিনে না। সামান্য কয়টা ভাড়ার টাকার জন্য উনি রাজি হবেন না। একবছরের ভাড়ার টাকায় যা পাবেন তার চাইতে ডের বেশি একমুঠে পাবেন বাড়িটা বিক্রি করে দিলে। বাহানা করে ভাইবোনদের বোকা বানাতে পারলেও আমারে তুই বোকা বানাইতে পারবি না। আমি তোকে পেটে ধরিনি, তোর মাও না খালা হই। কিন্তু খালা তো মায়ের মতোই তাই না? আমিও তোদেরকে নিজের সন্তানই ভাবি। কি লুকাইতেছিস তুই?

একনাগাড়ে কথা বলে থামেন নারগিস বেগম। জবাবের জন্য চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। চিত্রলেখা নিজেও জানতো। বাহানা করে ভাইবোনদের থেকে সত্য গোপন করতে পারলেও খালার চোখে সে ধুলা দিতে পারবে না। এই মানুষটা ঠিকই আন্দাজ করে ফেলবে। চিত্রলেখা আর চেষ্টাও করে না কিছু গোপন করার। আপাতত সবাইকে না হোক অন্তত খালাকে সত্যিটা তার জানানো দরকার। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা বলে,

-খালু বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে খালা।

-তাহলে আমরা এখনো এই বাড়িতে কেন?

-এই বাড়িটা এখন… আমার নামে।

তৎক্ষনাৎ কথা বলেন না নারগিস বেগম। চিত্রলেখা নিজেই বলে,

-উনি বাড়িটা আমার নামে কিনে নিয়েছেন খালুর থেকে।

উনি বলতে চিত্রলেখা কার কথা বুঝিয়েছে তা বুঝতে সময় লাগেনি নারগিস বেগমের। খালার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চিত্রলেখা আরও বলে,

-আমি উনাকে বলিনি বাড়ি কিনতে। উনি নিজে থেকেই করেছেন কাজটা আমাকে কিছু না জানিয়েই। এক্ষুনি লিখনদের কিছু বইলো না খালা। আমি নিজেও এখনো ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারি নাই। ওরাও নিতে পারবে না। আগে আমাকে একটু সহজ হইতে সময় দাও। তারপর নাহয় ওদের বলবো। ততদিন কথাটা নিজের মধ্যেই রাখো প্লিজ!

সম্মতিতে মাথা ঝাকান নারগিস বেগম। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করেন,

-তুই ঐ বাড়িতে ভালো আছিস তো?

খালার প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। অভ্যন্তরীণ কিছু কি টের পেয়ে গেছেন তিনি? কিন্তু সে তো কাউকে কিছু জানায়নি। এমনকি আফিফাকেও নয়। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি ভালো আছি।

-সত্যি ভালো আছিস?

-এভাবে বলতেছো কেন?

-মায়ের মন তো সন্তানের জন্য সবসময় কেমন কেমন করে তাই জিজ্ঞেস করতেছি।

-তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। সত্যি, ভালো আছি খালা।

-ঐ পরিবারের সবাই তোকে মেনে নিছে তো?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় না চিত্রলেখা। খালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চিন্তাটা হয়ত আন্দাজ করতে পারছে তাই খালাকে আশ্বস্ত করে বলে,

-আমার হঠাৎ বিয়ে করাটা তোমাদের জন্য যেমন অবিশ্বাস্য ছিল, ঐ বাড়িতেও একই ঘটনা। সবার স্বাভাবিক হইতে কিছুটা সময় দরকার খালা। এছাড়া সত্যি আমি ভালো আছি এই তোমাকে ছুঁয়ে বলতেছি। উনি আমার অনেক খেয়াল রাখেন। এতখানি যতখানির হয়ত আমি যোগ্যও না।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন নারগিস বেগম। এই নিঃশ্বাসের কারণ কি ধরতে পারে না চিত্রলেখা। তবে আন্দাজ করে তার দুশ্চিন্তায় হয়তো। এই প্রসঙ্গে খালা ভাগ্নির দুজনের একজনও আর কথা বাড়ায় না।

সারারাত ঘুম হয়নি চিত্রলেখার। জোর করে ঘুমানের চেষ্টাও করেনি সে। বই পড়েই রাত পাড় করেছে। ফজরের আজান দেয়ায় বই রেখে উঠেছে সে। ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় ফিরে এসে আবারও বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজেছে অনেকক্ষণ হয়। ভোরে আলো ফুটতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। মোবাইল ফোনটা পেটের উপরেই রাখা। যদিও ফোন হাতের কাছে রাখার অভ্যাস নেই তার তবুও আজ ফোনটাকে দৃষ্টির আড়াল করছে না। আচমকা মেসেজ টিউনের শব্দ কানে আসতেই ফোন হাতে নিয়ে উঠে বসে। চিত্রলেখা এর আগে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতো না। সে বলতেও পারবে না রওনক কখন তার ফোনো হোয়াটসঅ্যাপ ইন্সটল করে দিয়েছে। এবাড়ি বসার পর খেয়াল করেছে। মেসেজটা হোয়াটসঅ্যাপেই এসেছে। নোটিফিকেশন পেয়ে তৎক্ষনাৎ হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে সে। একটা ফরেন নম্বর। ইনবক্সে ঢুকতেই দেখে লেখা,

❝মাত্র পৌঁছালাম। একটা ডিনার মিটিং আছে, ওটা শেষ করে হোটেলে গিয়ে তোমায় ফোন করব। ততক্ষণ একটু শান্তি করে ঘুমিয়ে নাও। সারারাত অনেক টেনশন করেছো বরের জন্য। এখন রেস্ট করো। জলদিই আমাদের কথা হবে বউ।❞

রওনকের মেসেজটা পড়তেই চিত্রলেখার চোয়াল জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে। কাছে না থেকে মানুষটা বলতে পারে কেউ তার জন্য ভাবছে। লাবিব ঠিকই বলেছিল সে পৌঁছেই তাকে জানাবে। তাহলে কি সত্যি সত্যি চিত্রলেখা, রওনক জামানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ?

রওনকের মেসেজের বিপরীতে কিছু একটা লেখা উচিত তার। কিন্তু কি লিখবে সে? চিন্তা ভাবনা করে রিপ্লাইতে চিত্রলেখা লিখে দেয়,

❝নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি কলের অপেক্ষায় থাকবো।❞

আর অপেক্ষা না করে ফোনটা মাথার কাছে নামিয়ে রেখে বইটাও অন্যপাশে রাখে। এতক্ষণে চোখ ভার হয়ে ঘুম আসছে তার। দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। এখন আর কোনো চিন্তা নেই তার, রওনক ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গেছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না প্লিজ)

এক সপ্তাহ ওবাড়ি থেকে এইবাড়ি ফিরে এসেছে চিত্রলেখা। সাত দিনের দিন রওনক জানিয়েছিল খুব সম্ভবত ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে সে। তাই এবাড়ি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চিত্রলেখা। যদিও সে চাইলেই রওনক ফিরে আসার দিন পর্যন্ত ওবাড়িতে থাকতে পারতো কিন্তু ইচ্ছা করেই থাকেনি। দুটোদিনই তো দেখতে দেখতেই চলে যাবে। কিন্তু ১০ দিন অতিবাহিত হয়ে যাবার পরেও সে ফিরে আসেনি। বরং মেক্সিকোর কাজ শেষ করে তাকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছে। মেক্সিকো থাকা অবস্থায় সারাদিনে ফোন কল না হলেও অন্তত একটা এসএমএস পাঠিয়েছে রওনক তাকে কিন্তু সিঙ্গাপুর যাবার পর থেকে একটা কল তো দূরের কথা এসএমএসও পায়নি সে। এমনকি রওনক যেদিন সিঙ্গাপুর গিয়েছে। যাবার পরেও চিত্রলেখাকে কিছু জানায়নি। পৌঁছেছে কিনা সেই খবরটাও না। পরবর্তীতে লাবিবের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল রওনক ঠিকঠাক পৌঁছে গেছে। কাজে ব্যস্ত আছে তাই যোগাযোগ করার সময় পাচ্ছে না। প্রথমে বুঝলেও যত দিন ঘনিয়েছে অজানা এক অভিমান চিত্রলেখার বুকের ভেতর বাসা বেঁধেছে। এত কিসের ব্যস্ততা একটা মানুষের? সে নিশ্চয়ই খাওয়া, ঘুম, গোসল, বাথরুম বাদ দিয়ে দেয়নি। এত কিছুর মধ্যে কি অন্তত ১ মিনিটের জন্য একটা কল দেয়া যায় না? খুব বেশি কিছু কি আশা করে ফেলছে সে? হয়ত। হয়ত খুব বেশিই আশা করে ফেলছে। এতখানি আশা করা তার উচিত হচ্ছে না। বিয়েটা সত্যি হলেও কিছু শর্তের ভিত্তিতে হয়েছে। এসব ভুলে গেলে তার চলবে না। যতদিন গড়িয়েছে দিনকে দিন মন মরা হয়ে যাচ্ছে সে। যতবার সুযোগ পায় হোয়াটসঅ্যাপ চেক করে রওনক ফোন করল কিনা বা একটা এসএমএস। খুব বেশি না অন্তত এতটুকু লিখে পাঠাক সে ভালো আছে। কিন্তু এতটুকুও সে পায় না। প্রতিদিনই একরাশ নিরাশা নিয়ে ঘুমাতে যায় সে একলাই। মধ্যে রাত পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করে হঠাৎ কখন ঘুমায় নিজেও টের পায় না। কতদিন ভেবেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে রওনক তার পাশে শুয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই আশায় প্রতিদিনই সকাল হয় তার কিন্তু রওনক আর ফিরে না। এভাবেই এক একটা দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। আজ ২৫ দিন হয় এখনো ফিরে আসেনি রওনক। এমনকি একটা কলও আসে না। একদিকে অভিমানের পাহাড় জমেছে তার বুকে। অন্যদিকে ভয়ও লাগে মানুষটা ঠিক আছে তো! সুস্থ আছো তো! তার ফিরতে আরও দেরি হলেও সমস্যা নেই চিত্রলেখার। সে শুধু একবার নিজের কানে মানুষটার কন্ঠ শুনতে চায়। জানতে চায় সে কেমন আছে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রওনকের কথা ভাবতে ব্যস্ত চিত্রলেখা। শীত বেড়েছে। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। বৈরি হাওয়া তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গায়ে কোনো গরম কাপড় জড়ায়নি সে। সুতির একটা থ্রি-পিস তার পরণে। গেল বছরের চাইতে এবছর বেশি শীত পরেছে। ঠান্ডায় তার হাড় কাপা শুরু করলেও চিত্রলেখার ইচ্ছা করছে না ভেতরে ফিরে যেতে বা গিয়ে গরম কাপড় নিয়ে আসতে। ঠান্ডা থেকে আশ্রয় নিতে নিজেকেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে সে। কিন্তু এতে কি আর ঠান্ডা মানে? চিত্রলেখা যখন উদাস মনে তার ব্যাক্তিগত পুরুষের অনুপস্থিতিতে বিরহে বিভোর ঠিক সেই মুহূর্তে একজোড়া হাত তাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। পুরুষালী হাত জোড়া খুব শক্ত করে পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়েছে। ভয়ে চিত্রলেখার কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও তৎক্ষনাৎই সামলে যায় সে। যখনই বুঝতে পারে তার সকল অপেক্ষাদের অবসান হয়েছে, নিজেকে ছেড়ে দেয় তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখা মানুষটার উপর। আশ্রয় খুঁজে তার বুকে। এই মানুষটার একটু উষ্ণতা পাবার অপেক্ষাতেই তো ছিল সে এতগুলো দিন। অতঃপর এতসব দিনরাত পেরিয়ে চিত্রলেখাদের অপেক্ষাদের ছুটি মিললো। তবুও সে এখনো অভিমানে অটল। বিশাল অভিমানের এক পাহাড় জমেছে তার হৃদয়ে। তাই কথা বলছে না সে। পেছন ঘুরে তাকাবেও না। বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখাকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার পর রওনক বলে,

-আবার তুমি গরম কাপড় ছাড়া এভাবে ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছো?

একদম রা করে না চিত্রলেখা। এতক্ষণ মনে হয়েছে সে হয়ত স্বপ্ন দেখছে কিন্তু রওনকের কন্ঠ কানে আসতেই টের পায় সে স্বপ্ন দেখছে না। সত্যি সত্যিই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার বাহুতে আছে সে। এই মানুষটার আলিঙ্গনে নিজেকে সপে দিতেই তো তার এত অপেক্ষা। এই মুহূর্তটাকে ধরে রাখতেই যেন চোখ বন্ধ করে নেয় সে। চিত্রলেখা কোনো জবাব না দেয়ায় রওনক নিজেই বলে,

-বউ! কথা বলবে না আমার সাথে?

এবারেও জবাব দেয় না সে। আরও কিছুক্ষণ চিত্রলেখাকে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখার পর তাকে নিজের দিকে ঘুরায়। তৎক্ষনাৎই দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে ফেলে চিত্রলেখা। তার চোখের ঐ অপেক্ষা রওনককে দেখাতে লজ্জা করছে। প্রথমে কিছুক্ষণ কোমড় জড়িয়ে থাকার পর একটা হাত আলগা করে চিত্রলেখার চিবুকের নিচে রেখে মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরে। আঙ্গুলের উপর চিবুক রেখেই চিত্রলেখার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খায় রওনক। দু’চোখের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার পর আলতো ভাবে ছোট্ট করে ঠান্ডায় মৃদু কাঁপতে থাকা চিত্রলেখার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় সে। কিন্তু তবুও চোখ মেলে তাকায় না চিত্রলেখা। এখনো রওনককে দেখেনি সে। দেখার সাহস হচ্ছে না তার। যদি সে চোখ মেলতেই দেখে সব স্বপ্ন। আদৌতে রওনক ফিরে আসেনি। এই জড়িয়ে ধরা, ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়া, উষ্ণতার সবটাই যদি তার স্বপ্ন হয়? আপাতত এই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না সে। হোক স্বপ্ন বা নিজের কল্পনায় তবু আরও কিছুক্ষণ এই মানুষটার আলিঙ্গনে থাকতে চায় সে। আরও কিছুক্ষণ এই উষ্ণতায় নিজেকে মাতিয়ে রাখতে চায়। চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে রওনক। এতেও কোনো নড়চড় নেই চিত্রলেখার। তাকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে থাকা ব্লেজার কোর্টটা খুলে পাশেই ফেলে দেয় সে। চিত্রলেখার পাশে বসে আবারও জিজ্ঞেস করে,

-চোখ খুলবে না তুমি? দেখবে না আমায়?

এবারে জবাব না দিলেও মৃদু ভাবে মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। আচমকাই মৃদু ধাক্কায় তাকে পেছন দিকে বিছানায় ফেলে দিয়ে রওনক নিজে কাছাকাছি চলে আসে। একদম কাছাকাছি। এতখানি কাছাকাছি যে দু’জনের নিঃশ্বাস এক হতে কেবল মুহূর্তের অপেক্ষা। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার গালে নাক ঘষে দেয় সে। এতেই যে চিত্রলেখার নিজেকে মাতাল লাগে। অসহ্য ভালো লাগায় ভেতরটা ছেঁয়ে যেতে থাকে তার। এই স্পর্শের জন্যই তো ম রে যাচ্ছিল সে। এই মানুষটার নিঃশ্বাসের অভাবেই তো নিজেকে ফাঁকা লাগছিল তার। চিত্রলেখার গাল, চোয়াল জুড়ে নাক ঘষে কানের কাছে গিয়ে নিচু ও ধরা কন্ঠে রওনক অনুরোধের সুরে বলে,

-প্লিজ চন্দ্র চোখ খোলো। তাকাও আমার দিকে একবার। দেখো আমি ফিরে এসেছি।

এবাবেও মাথা ঝাকায় সে।

-প্লিজ!

চিত্রলেখার মৌনতাদের সঙ্গ দিয়ে তার বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রুর উপস্থিতি দেখা যায়। প্রিয়তমার গালে চোখের পানির অস্তিত্বের উপস্থিত রওনককে আরও বিচলিত করে তোলে। ঠোঁট দিয়ে সেই অশ্রু শুষে নেয় সে গড়িয়ে পড়ার আগে। চিত্রলেখার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে রেখেই রওনক বলে,

-প্লিজ চন্দ্র দেখো আমায়।

বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখার দেহের কাছাকাছি থেকে উঠে আসে রওনক। হাত ধরে চিত্রলেখাকেও তুলে বসায়। নিজের দু’হাতে চিত্রলেখার হাত নিয়ে বলে,

-একবার চোখ খুলে দেখো আমি এখানেই আছি। সত্যি সত্যি ফিরে এসেছি। তুমি কোনো স্বপ্ন দেখছো না। চোখ মেললেই আমি হারিয়ে যাবো না।

রওনকের কথা শেষ হতে না হতেই চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। তার মনের সংশয় কীভাবে বুঝে মানুষটা! চোখ মেলতেই চিত্রলেখা দেখে সত্যি সত্যি তার সামনে মানুষটা হাটুর উপর বসে আছে। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখেই তার হাতের পাতায় চুমু খায় রওনক। হাত দু’টো এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে তার। এক-এক করে দু’হাতের পাতাই ঘষে দেয় সে গরম করার প্রচেষ্টায়। সেখানেই থেমে থাকে না সে। চিত্রলেখার পায়ের পাতা নিজের হাতে তুলে নিলে তৎক্ষনাৎ তড়িৎ গতিতে পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। রওনক তার শক্ত হাতে ধরে রেখেছে সেখান থেকে ছোটার উপায় নেই। বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে রওনক বলে,

-প্লিজ পায়ে হাত দিবেন না।

চিত্রলেখার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পা গরম করার জন্য আলতো ভাবে ঘষে দিতে থেকেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কেনো?

-প্লিজ আপনি পায়ে হাত দিয়েন না।

-আমি পায়ে হাত দিলে কি হবে?

-জানি না। প্লিজ ছেড়ে দিন।

বাম পা টা ছেড়ে দিয়ে ডান পায়ের পাতা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আলতোভাবে ঘষতে থেকেই চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে রওনক বলে,

-স্বামী স্ত্রীর পায়ে হাত দিলে পাপ হয় এসব সিনেমার ডায়লগ একদম দিবে না বলে দিচ্ছি। তুমি আপাদমস্তক আমার। তাই তোমার গাল ছুঁয়ে দিলে যেমন আমার পাপ হবে না তেমনি পা ছুলেও পাপ হবে না।

চিত্রলেখাকে আরও চমকে দিয়ে তার পায়ের পাতায় আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় রওনক। ব্যস, এতেই চিত্রলেখা গলে পানি হয়ে গেছে। জ্বলন্ত মোমের মতো গলতে শুরু করেছে সে। নিজ দেহে আর বল পাচ্ছে না সে। রওনক এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার মুখটা দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে একদম কাছাকাছি গিয়ে থামে। তার নিঃশ্বাস চিত্রলেখার ঠোঁটের উপর আছড়ে পড়ছে এতেই যেনো কেঁপে সারা হচ্ছে সে। ঠোঁট ছুঁই ছুঁই অবস্থাতেই রওনক চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে বলে,

-সরি বউ…

আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না চিত্রলেখা রওনককে। আচমকা কি হলো তার! এগিয়ে গিয়ে রওনকের ঠোঁট জোড়ার দখল নেয় সে। একমুহূর্ত সময় বিলম্ব না করে রওনক নিজেও তাল দেয় চিত্রলেখার ঠোঁটের ডেউয়ে। লম্বা সময় তারা একে-অপরের ঠোঁটের মায়ায় আটকে থাকার পর নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসলে অক্সিজেন টানতেই যেন সামান্য বিরতি নেয়। তবুও কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। চিত্রলেখাের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস টানে দু’জনেই। দু’জনের দৃষ্টিই একে-অপরে সীমাবদ্ধ।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে