মাতাল হাওয়া পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0
568

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আজকের পার্টির জন্য বানানো বার কাউন্টারের সঙ্গে সামান্য সাইড হেলান দিয়ে হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল রওনক। যদিও আড্ডায় মশগুল বলা যায় না। একটু পরপরই অন্যদিকের সিড়ির দিকে দৃষ্টি যাচ্ছে তার চন্দ্র এসেছে কিনা দেখতে। এতক্ষন সময় লাগার কথা নয় যদিও তবুও অপেক্ষা করছে সে। চিত্রলেখা নার্ভাস রওনক জানে। এমন পার্টি এর আগে কখনো এটেন্ড করেনি সে। তাই তার নার্ভাস হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চিত্রলেখার পরিস্থিতি আন্দাজ করেই তাকে সময় দিচ্ছে রওনক। সবে তো রাত হয়েছে তাড়া নেই কোনো। যদিও আকজকের রাতটা তার জন্য স্পেশাল তবুও কোনো কিছু নিয়েই চন্দ্রকে তাড়া দিবে না সে।

-দেয়ার শি ইজ মিসেস রওনক জামান।

সাদমানের মুখে মিসেস রওনক জামান শুনেই পাশ ফিরে সিড়ির দিকে তাকায় রওনক। ব্যস, আর কথা বলতে পারে না সে। রওনকের দৃষ্টি তার চন্দ্রের দিকেই আটকে গেছে। তবে এই মুহূর্তে কেবল রওনক নয়, পার্টিকে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি চিত্রলেখার দিকে আটকে আছে।

-ড্যাম গর্জিয়াস…

এতটুকুই বেরিয়ে আসে রওনকের মুখ গলে। এর বেশি কিছু বলতে পারে না সে। নিজের জায়গায় স্থির হয়ে গেছে সে। রওনকের পছন্দ করা গাউনটা পরে আসেনি চিত্রলেখা। এখন রওনক বুঝতে পারছে তৈরি হবার পরেও চিত্রলেখার বেরিয়ে আসতে এত সময় কেনো লেগেছে। চিত্রলেখার পরনে একটা কালো রঙের জর্জেটের টিস্যু শাড়ি। চিত্রলেখা হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ করেনি, মেকাপও চেঞ্জ করেনি অবশ্য প্রয়োজন হয়নি। মেকাপে স্মোকি আই করা হয়েছে যা এই জর্জেট ফিনফিনে টিস্যু শাড়িটার সঙ্গেও দারুন লাগছে দেখতে। অর্নামেন্টসও আগেরটাই কেবল বদলেছে পরনের কাপড়। গাউনটার বদলে শাড়ি পরে এসেছে সে। জর্জেট শাড়িটার সম্পূর্ণ আঁচল, জমির নিচের দিক থেকে উপরে অর্ধকটা, বুকের কাছের অংশে ছোট ছোট স্টোন বসানো। তাই ফিনফিনে জর্জেট শাড়ি হলেও পেটের কাছটায় সামান্য অংশ ব্যতীত আর কিছুই তেমন একটা বুঝা যাচ্ছে না। ব্লাউজের হাতা কনুই পর্যন্ত যদিও জর্জেট হওয়ায় হাত বুঝা গেলে ইতস্তত লাগছে না চিত্রলেখার আগের মতো। অন্তত গাউনটার মতো তো নয়। গাউনের তো হাতাই ছিল না। কথায় আছে নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো। কেবল হাতাটাই নয় চিত্রলেখার পিঠটাও ভিজিবল এই ব্লাউজে তবে উন্মুক্ত নয়। কালো হওয়ায় সুবিধা হচ্ছে শরীরের অংশ খানিকটা বুঝা গেলে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। এটাই স্বস্তি। বোট গলা হওয়ায় ব্লাউজের সামনের অংশ দিয়ে চিত্রলেখা বুকের কাছের অংশ বুঝা বা দেখা যাচ্ছে না। ঐ গাউনটায় চিত্রলেখাকে ঠিক যতখানি সুন্দর লাগছিল দেখতে এই মুহূর্তে কালো রঙের জর্জেট টিস্যু শাড়িটাতে আরও হাজারগুন বেশি আউট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড লাগছে তাকে দেখতে, অন্তত রওনকের দৃষ্টিতে। বাকি কার কাছে কেমন লাগছে তাতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। হি ড্যাম কেয়ার’স। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার ঠোঁট জুড়ে থাকা ডার্ক রেড লিপস্টিক। ঐ লাল লিপস্টিক যেনো চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছে রওনককে। এক্ষুনি গিয়ে ঐ ঠোঁট জোড়া দখল নেয়ার তাগিদ অনুভব করে রওনক। কিন্তু সে তো নড়তেই পারছে না এগিয়ে যাবে কীভাবে? চিত্রলেখাকে দেখার পর সব ভুলে গেছে যেনো। সংশয়ে, অজানা আতংকে চিত্রলেখা এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নেমে নিচে আসবে কিনা বুঝতে পারছে না। এত মানুষের ভীড়ে তার দৃষ্টি একজোড়া চোখকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে, রওনক। এই বাড়িতে থাকার তার একমাত্র ভিত্তি, পরিচয়, কাছে মানুষ।

সাদমান আলতো করে রওনকের কাঁধে ঝাঁকি দিলে নিজের ভাবনার জগৎ রেখে বাস্তবতায় ফিরে আসে সে। পাশ থেকে সাদমান বলে,

-গো, শি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।

হাতে থাকা ওয়াইনের গ্লাসটা বার কাউন্টারের উপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে যায় চিত্রলেখার দিকে। এত সব অপরিচিত মুখের ভীর ঠেকে রওনককে এগিয়ে আসতে দেখে স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে চিত্রলেখার মুখ জুড়ে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ এটা ভেবেও অস্থির লাগে যদি তার দেয়া ড্রেস পড়েনি বলে রাগ হয়? রওনক কি বুঝবে ম রে গেলেও চিত্রলেখা ঐরকম শরীর দেখানো ড্রেস পরে এত মানুষের সামনে আসতে পারে না। এমনিতে শাড়িটা পাতলা ফিনফিনে ধরনের, এদিক সেদিক দিয়ে শরীর বুঝা যাচ্ছে এতেই লজ্জায় চিত্রলেখার মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে ঐ ড্রেসটা পরলে সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় কেঁদেই ফেলতো সে। চিত্রলেখা ভেবে রেখেছে রওনক রাগ হলে প্রয়োজনে সারাদিন রাত ঐ ড্রেস পরে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। রওনক যদি একটু আগের মতো করে তার উন্মক্ত শরীরে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় তাতেও আপত্তি করবে না কিন্তু এত মানুষের সামনে ঐ ড্রেস সে পরতে পারবে না। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় রওনক। রওনককে এতখানি কাছাকাছি দেখেই বুকের ভেতর কিছু একটা তবলা বাজাতে শুরু করেছে চিত্রলেখার। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। রওনক কি রাগ হয়েছে তার উপর? নাকি বিরক্ত হয়েছে? তার মুখের ভাব দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। চিত্রলেখা কিছুই বুঝতে পারছে না। তাকে অবাক করে দিয়ে রওনক হাত বাড়িয়ে একটা হাত চিত্রলেখার কোমড়ে রেখে তাকে কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করে গালে চুমু খায়। রওনকের কান্ডে পার্টিতে উপস্থিত সবাই হাত তালির সঙ্গে নানারকম উৎসাহ, উৎফুল্ল মূলক শব্দ করে। খুব বেশি সময় নেয় না রওনক। যদিও তার ইচ্ছা হচ্ছে পার্টিকে গু ল্লি মে রে চিত্রলেখাকে নিয়ে ঘরে চলে যেতে। দীর্ঘ সময়ের জন্য ঐ লাল ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে রাখতে। ততক্ষন ছাড়বে না যতক্ষণ না তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চিত্রলেখাকে কিছু বলে না সে। পাশে দাঁড়িয়ে বাম হাতটা চিত্রলেখার শাড়ির ভেতর দিয়ে তার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছাকাছি টেনে নেয় প্রিয়তমাকে। তার কান্ডে অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে রওনকের মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। লজ্জায় ম রে যেতে মন চাইছে তার। সবাইকে দেখছে তাদের অথচ রওনকের যেনো কিচ্ছু যায় আসে না। সে বরং সবাইকে দেখাতেই ব্যস্ত চিত্রলেখা তার, একান্তই তার ব্যাক্তিগত।

রওনকের চোখের ইশারায় লাবিব সব লাইট অফ করে দিয়ে কেবল তাদের দু’জনের উপর একটা স্পটলাইট জ্বেলে দিয়েছে। উপস্থিত সকলের চোখ এখন তাদের দু’জনের দিকে স্থির। পেছন থেকে কেউ একজন রওনকের হাতে একটা মাইক দিয়ে দেখে। অন্ধকারে দেখা যায়নি ওটা কে ছিল। মাইকটা মুখের কাছে নিয়ে রওনক এতক্ষনে মুখ খুলে বলে,

-লেডিস এন্ড জ্যান্টেলম্যান হিয়ার প্রেজেন্ট মাই বিলাভেট ওয়াইফ, বেটার হাফ চন্দ্র আই মিন চিত্রলেখা রওনক জামান। আই থ্যাংকিউ অল ফর বিইং হিয়ার উইথ আজ এন্ড টু গিভ আজ ইউর লাভ এন্ড ব্লেজিংস। থ্যাংকিউ ফর ইউর প্রেজেন্স ইটস মিন্স এলট। প্লিজ ইঞ্জয় ইউর সেলফ।

রওনকের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কড়তালিতে চারিদিক মুখোরিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে লাইটস অন করে দিলে তারা দু’জনে একত্রে নিচে নেমে আসে। ওরা নিচে নেমে আসলে সবার আগে এগিয়ে আসে সাদমান। চিত্রলেখার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে কি করবে ভেবে রওনকের মুখের দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলে চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে সাদমানের হাতে হাত রাখতেই মাথা ঝুকিয়ে আলতো করে চিত্রলেখার হাতের উপরের দিকে ছোট্ট করে সৌজন্যমূলক চুমু দিয়ে সাদমান বলে,

-লুকিং গর্জিয়াস।

চিত্রলেখা বুঝতে পারে না ঠিক কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে। রওনক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সাদমানের দিকে। তার হাত থেকে চিত্রলেখার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে,

-শি ইজ মাই ওয়াইফ।

-এন্ড শি ইজ মাই সিস্টার-ইন-ল।

-ফা…গেট অফ ম্যান।

আরও অনেকেই উপস্থিত থাকায় স্লাং ইউজ করতে নিয়েও করে না রওনক। তার অবস্থা দেখে সাদমান বলে,

-গেটিং জেলাস ম্যান।

-অফকোর্স আই ডু।

চিত্রলেখা বুঝতে পারে না আসলে এখানে কি হচ্ছে। সাদমান রওনককে বিরক্ত করতেই মূলত এমনটা করেছে। এছাড়া অন্যকোনো ইন্টেনশন নেই তার। অনেক বছরের বন্ধুত্ব তাদের। ভাইয়ের মতো সম্পর্ক। সাদমান কখনই কোনো স্টুপিড কাজ করে এই সম্পর্ক নষ্ট করবে না তা রওনক নিজেও জানে। অন্যদের সবার সঙ্গে চিত্রলেখাকে পরিচয় করিয়ে দেয় রওনক। অফিসের কেউ কেউ চিত্রলেখাকে হয়ত চিনতে পেরেছে কিন্তু রওনকের উপস্থিতিতে কারো সাহস হয় না কানাঘোষা করার। বসের বউকে নিয়ে গসিপ করলে যে চাকরী থাকবে না তা সবাই জানে। আর মন্দা চাকরীর বাজারে নিজের চাকরীর মায়া সবারই আছে। আর বাকি যারা জানে না চিত্রলেখা যে রওনকের অফিসেই চাকরী করত তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তবে তারা চিত্রলেখাকে চিনতে, জানতে তার সম্পর্কে শুনতে আগ্রহী। তবে সবাই রওনকের পার্সোনালিটি সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। তার জিনিসে কেউ চোখ দিলে সেই চোখ উপড়ে ফেলতে দুইবার ভাববে না সে আর সেখানে তার বউয়ের দিকে নজর দিলে সেই ব্যাক্তিকে দুনিয়া থেকে গা য়ে ব করে দিতে এক সেকেন্ড সময় নিবে না সে। এমনি এমনি এত বড় ব্যবসা ধরে রাখেনি সে। রওনক জামানের হাত যে কত বড় তা সবার অজানা হলেও কম বেশি সবাই বুঝে রওনক জামান চাইলে তার এক ইশারায় কি করতে পারে। রওনক জামান পারে না এমন কোনো কাজ নেই। সবাই সম্মান করে তবে ভয়ও কম পায় না। রওনকের জামানের ব্যাড সাইডে আসতে রাজি নয় কেউ। তার সাথে সম্পর্ক ভালো মানে সব ঠিক। উনিশ বিশ হলেই সর্বনাশ। সবার সামনে কুল, জ্যান্টেলম্যান্ট দি রওনকের জামানের ভেতরটা যে এতখানিও পরিষ্কার নয় তা অনেকে আন্দাজ করতে পারলেও কখনো মুখ ফুটে তা প্রকাশ করার দুঃসাহস করে না।

ড্রিংসের গ্লাসের ট্রে নিয়ে একটা ছেলে এগিয়ে এলে একজন চিত্রলেখাকে ড্রিংক্স নিতে বললে সে কনফিউশনে পড়ে যায় কি করবে। সে এসব খায় না বলাটা কি উচিত হবে? সবাই নিশ্চয়ই অন্যভাবে দেখবে তাকে। এটা নিশ্চয়উ রওনক পছন্দ করবে না। কি করবে বুঝতে পারছে না এমন দৃষ্টি নিয়ে রওনকের দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছিল রওনক। সাদমান বাহু ধরে হালকা ধাক্কা দিকে তার দিকে তাকালে সাদমান ইশারা করলে চিত্রলেখার দিকে তাকায় সে। রওনকেরই একপার্টনারের ওয়াইফ ড্রিংক্স অফার করছে চিত্রলেখাকে। তার চোখ থেকে যা বুঝার বুঝে গেছে রওনক।

-এক্সকিউজ মি।

বলেই বার কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় রওনক। বার কাউন্টারে থাকা ছেলেটাকে ইশারা করতেই সে একটা ওয়াইনের গ্লাস এগিয়ে দেয় তাকে। সেটা নিয়ে চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সে। ওয়াইনের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় চিত্রলেখাকে নেয়ার জন্য। অবাক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। সে ভাবতেই পারেনি রওনক তাকে এভাবে এসব খাবার জন্য বলবে। চিত্রলেখার চোখ দেখে হাসি পেয়ে যায় রওনক। কিন্তু এইমুহূর্তে সে হাসে না। নিজের হাসি সামলে চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,

-এটা নিতে পারো ফ্রুটিকার গ্রেপ জুস এতে কোনো এলকোহল নেই। আমি নিজেই এলকোহল নেই না তোমাকে অফার করব ভাবলে কীভাবে? সবাই ভাববে আমরা ওয়াইন খাচ্ছি আসলে ইটস জাস্ট এ সিম্পল জুস।

রওনকের কথা শুনে এবার চিতলেখার ঠোঁট জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে। আবার সে অবাক না হয়েও পারে না। সে জানতোই রওনক এলকোহল নেয় না। আগের রাতেই তার এক কথায় বারান্দা দিয়ে সিগারেটে গোটা প্যাকেট ফেলে দেয়ার আগে দু’বার ভেবেনি। যত দেখছে সে রওনককে ততই অবাক হচ্ছে। রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে ওয়াইন মানে জুসের গ্লাসটা নিয়ে তার চোখ চোখ রেখে একটা সিপ নেয় চিত্রলেখা। অথচ তাকে দেখে মনে হচ্ছে সত্যি যেনো ওয়াইন খাচ্ছে। চিত্রলেখার এমন এটিটিউডে ইম্প্রস না হয়ে পারে না রওনক। এক্ষুনি সব ফেলে চন্দ্রকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে মন চাইছে তার। যেখানে তাদের কেউ বিরক্ত করতে পারে না। যেখানে তার একে-অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গে জড়িয়ে রাখতে পারবে ঘন্টার পর ঘন্টা। রওনক নিজেকে চিত্রলেখার ভেতর হারিয়ে ফেলতে পারবে। যতবার চিত্রলেখার দিকে তাকিয়েছে এই পর্যন্ত রওনকের ইচ্ছা হয়েছে ঐ ঠোঁটে একটা চুমু খায় সে। ছোট্ট করে নয় গভীরভাবে, দীর্ঘ সময় নিয়ে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

দিলারা জামান নিজের ঘর থেকে বের হোননি। তানিয়া অনেকবার করে অনুরোধ করেছিল শাশুড়িকে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পার্টি জয়েন করতে। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা একবার যেই মুখে না বলে ফেলেছেন সেই সিদ্ধান্ত বেঁচে থাকতে পরিবর্তন করবেন না। তানিয়ার এতদিনের সংসার জীবনে এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে তার ভালো মতো চেনা। তাই কয়েকবার অনুরোধ করার পর সে নিজেও হাল ছেড়ে দিয়েছে। তার নিজের পার্টিতে উপস্থিত থাকাটা জরুরী। দিলারা জামানের অনুপস্থিতিকে কেউ আড়চোখে দেখার আগে কিছু একটা বাহানা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তাকে। সাপের মতো ফনা তুলে নিজের ঘরে বসে আছেন দিলারা জামান। এইমুহূর্তে তার রাগ বেশি হচ্ছে এই ভেবে তার নিজের ছেলে একটাবার এসে তাকে ডাকেনি। তার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। একটা বাইরের মেয়ে আজ তার চাইতে বেশি হয়ে গেল বিষয়টা হজম হচ্ছে না উনার। রাগে ফুলতে থাকা দিলারা জামানের রাগের আ গু নে ঘি ডালতেই যেনো সাবার আগমন ঘটলো। রুমের দরজা লক করাছিল না। তানিয়া চলে যাবার পর একবার ভেবেছিলেন ভেতর থেকে লক করে দিবেন কিন্তু যদি রওনক আসে সেই ভাবনায় আর লক করেননি। রওনক আসেনি তবে সাবা এসেছে। দরজা ঠেলে ভেতর প্রবেশ করে দিলারা জামানের কাছাকাছি এগিয়ে যেতে যেতে সাবা খানিকটা খোচা মারা কন্ঠে বলে,

-কংগ্রাচুলেশন্স আন্টি।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সাবার দিকে তাকিয়ে দিলারা জামান জিজ্ঞেস করেন,

-ফর হোয়াট?

এগিয়ে এসে দিলারা জামানের মুখোমুখি একপায়ের উপর আরেক পা তুলে দিয়ে বসে সাবা বলে,

-আপনার ছেলে বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে এসেছে। পার্টি করে সবাইকে সেটা জানাচ্ছেও। ইউ মাস্ট বি ভেরি হ্যাপি টুডে।

মুখটাকে বাংলার পাঁচ বানিয়ে দিলারা জামান বলেন,

-ওহ কাম অন সাবা। এই বিয়ে আমি মানি না। নাম পরিচয়হীন একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলেই আমি আমার বাড়ির বউ বলে মেনে নিবো না। ঐ মেয়ে এই বাড়ির বউ সেদিন হবে যেদিন আমি ম রে যাবো। আমি বেঁচে থাকতে সেটা কোনোদিন সম্ভব নয়।

-কিন্তু আপনার ছেলে সেটা মানবে বলে মনে হয় না আন্টি। আপনি টেরও পাননি রওনক আমাকে করা প্রমিজ ব্রেক করে আরেকটা রাস্তার মেয়েকে বউ করে নিয়ে এসেছে।

নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাবা আরও বলে,

-আই ইউল নট লেট হার টেক মাই ম্যান আওয়ে আন্টি। আপনার ছেলে একটা না হাজারটা বিয়ে করলেও আমাকে ওর বিয়ে করতেই হবে। এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে হি উইল বি মাইন, অনলি মাইন।

দিলারা জামান নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে সাবার একটা হাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন,

-আমি তোমার সঙ্গে আছি ডিয়ার।

সাবা দিলারা জামানকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ আন্টি।

রওনকের পাশ থেকে একমুহূর্তের জন্যও সরছে না চিত্রলেখা। অফিসের কিছু মুখ ব্যতীত কাউকে চিনে না সে। এমনকি কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদেরকেও না। কে কি জিজ্ঞেস করবে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে, যদি ভুলভাল কিছু বলে ফেলে এই ভয়ে আরও রওনকের দৃষ্টির আড়ালে যাচ্ছে না সে। তানিয়া এগিয়ে এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

-বউটাকে কিচ্ছুক্ষণের জন্য আমাকে ধার দাও। আমি আমার সার্কেলের সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিই।

চিত্রলেখার হাত তানিয়ার হাতে দিয়ে রওনক বলে,

-শি ইজ অল ইউর’স নাও।

তানিয়া চিত্রলেখাকে নিয়ে সরে গেলেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় সাবা। ডার্ক বোটল গ্রীন কালার একটা অফশোল্ডার ড্রেস পরেছে সে। ড্রেস্টটার লেন্থ তার মিড থাই পর্যন্ত। অফশোল্ডার হওয়ায় সাবার ক্লিভেজের খানিকটা উঁকি দিচ্ছে। মিড থাই থেকে শুরু করে সাবার লম্বা পা-গুলো সম্পূর্ন উন্মুক্ত। ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একই কালারের পেন্সিল হিল পরেছে, এতে আরও লম্বা লাগছে সাবাকে দেখতে। ডার্ক ড্রেসের সঙ্গে মিল রেখে ডার্ক মেকাপ নিয়েছে। ডার্ক মারুন কালার লিপস্টিক লাগিয়েছে ঠোঁটে। যেকোনো পুরুষ চোখে সাবাকে এক কথায় সে ক্সি লাগছে দেখতে। যেকোনো পুরুষ বারবার ফিরে তাকাবে তার দিকে। কিন্তু রওনক সেই তাগিদ অনুভব করে না। সাবাকে কখনোই তার দৃষ্টিতে আকর্ষনী লাগেনি। তিলত্তমার পরে রওনকের দৃষ্টিতে যদি কাউকে আকর্ষনী লেগে থাকে সে একমাত্র চিত্রলেখা। সেজন্য তাকে ডার্ক মেকাপ নিতে হয় না, বডি রিভেলিং ড্রেস পড়তে হয় না। চিত্রলেখার ঠোঁটে লিপস্টিক না থাকলেও সেই ঠোঁট আকুল নিবেদনে রওনককে ডাকে সবসময়। চিত্রলেখা যদি বোরখা পরে নিজেকে ডেকে রাখে তবুও রওনকের শরীর তাকে জড়িয়ে ধরতে, উষ্ণ আলিঙ্গে নিতে নিশপিশ করে। দ্বিতীয় কোনো নারীকে দেখে রওনকের শরীরে কিচ্ছু হয় না। এক চিত্রলেখাকে দেখলেই তার নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হয়, ভীষণ কষ্ট। পাজরের হাড় বেরিয়ে আসার মতো কষ্ট। চিত্রলেখাকে নিজের করে নিয়ে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত অনেক কষ্ঠে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। কিন্তু আর না। আজ আর সে নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না। চিত্রলেখাকে তার চাই-ই চাই। চিত্রলেখার সবটা তার চাই। আর পারবে না সে সন্যাসি হয়ে থাকতে। তিলত্তমা চলে যাবার পর ৬ বছর সে কখনো কোনো নারী শরীরের চাহিদা অনুভব করেনি। কখনো কোনো বেগানা নারীকে নিজের সংস্পর্শে আসতে দেয়নি। সংস্পর্শে আসা তো দূরের কথা ভাবেওনি কারো কথা। সাবা নানাভাবে চেষ্টা করেছে তাকে বিছানায় নিয়ে যাবার কিন্তু কোনোদিন সফল হয়নি। আবার বিয়ে করার কথা কখনো ভাবেনি রওনক। এক চিত্রলেখাকে দেখেই মনে হয়েছিল নিজেকে সে আরেকটা সুযোগ দিতে পারে। হয়ত চিত্রলেখা তাকে তার মতো করে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে, বুঝবে। যেমনটা সে তিলত্তমার কাছে আশা করেছিল। ভুলেও সে চিত্রলেখাকে তিলত্তমার সঙ্গে তুলনা করে না। রওনকের জীবনে এই দুই নারী সবসময় বিশেষ হয়ে থাকবে বলা বাহুল্য চিত্রলেখা এখন তার সবটা জুড়ে বিরাজমান। একসময় তিলত্তমা তার যতটুকু জুড়ে ছিল আজ চিত্রলেখা তার চাইতে অনেক বেশি জুড়ে আছে। তিলত্তমা চলে যাবার পর নতুন করে কেউ তার জীবনে আসবে সেটা রওনক কখনো ভাবেনি আর এভাবে এসে তাকে বশ করে ফেলবে সেটা তার চিন্তার অন্তরালে ছিল। একসময় রওনক যেটা ভাবেনি আজ সেটা তার জীবনের বাস্তবতা। একমুহূর্তের জন্যও চিত্রলেখা তার মস্তিষ্ক থেকে সরে না, রওনক সরাতেও চায় না। চিত্রলেখায় বিভোর থাকতে তার ভালো লাগে। এভাবেই থাকতে চায় সে।

সাবা সরাসরি এগিয়ে এসে রওনককে জড়িয়ে ধরে। বলা যায় বেহায়ার মতো নিজেকে রওনকের শরীরের উপর ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করে। রওনক চাইলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে কিন্তু এত মানুষের মধ্যে হয়ত এমনটা করা উচিত হবে না তাই সৌজন্যের খাতিরে হালকা করে জড়িয়ে ধরে আবার তৎক্ষণাৎই ছেড়ে দিয়ে নিজের কোট ঠিক করতে করতে চিত্রলেখার দিকে তাকালে তাদের একে-অপরের দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে। তানিয়ার সঙ্গে থাকলেও অন্যদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চিত্রলেখার চোখ বার বার এদিকেই তাকাচ্ছে রওনককে দেখতে। সাবার রওনককে জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা চিত্রলেখা দেখেছে তা তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। খারাপ লাগায় মুখ সাদা হয়ে গেছে বেচারির। তা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে রওনক। সে এটাই চায়। রওনক নিজে যতখানি চিত্রলেখায় আসক্ত হয়ে গেছে, সে চায় চিত্রলেখাও ততখানিই তার প্রতি আসক্ত থাকুক ইনফ্যাক্ট আরও বেশি আসক্ত করতে চায় সে চিত্রলেখাকে তার প্রতি।

সাবা কিছু বলার আগে রওনকের পেছন থেকে লাবিব এগিয়ে এসে তাকে কানে মুখে কিছু বলে। কি বলেছে তা শুনতে পায়নি সাবা। লাবিব কিছু বলার পর রওনক ওখান থেকে চলে যাবার চেষ্টা করলে তার একটা হাত ধরে বাঁধা দিয়ে সাবা বলে,

-আমি মাত্রই এলাম কোথায় যাচ্ছো তুমি?

-আমার কিছু স্পেশাল গেস্ট এসেছে আই নিড টু এটেন্ট দ্যাম। আই এম সিওর ইউ উইল ম্যাক ইউর শেলফ কম্ফোর্টবেল হিয়ার।

আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে সাবার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লাবিবের সঙ্গে চলে যায় রওনক। পেছনে দাঁড়িয়ে রাগে ফস ফস করতে লাগে সাবা। তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রিপা বলে,

-এভাবে সবার সামনে নিজেকে অপমান না করলেও পারো আপু। যেটা তোমার না সেটার দিকে হাত বাড়িও না। অপমান ছাড়া কিছুই পাবে না। এখনো সময় আছে নিজেকে সামলে নাও। রওনক ভাই কখনো তোমার হবে না। এই সত্যিটা মেনে নাও এবার।

সাবার ইচ্ছা করে কষে ছোট বোনের গালে একটা থা প্প র লাগায় সে। কিন্তু এখন নয়। সে হাতে মা র বে না রিপাকে নিজের কাজ দিয়ে মা র বে। যেদিন সবার সামনে রওনক তাকে মেনে নিবে, বিয়ে করে বউয়ের পরিচিয় দিবে সেদিন রিপাকে এর উপযুক্ত জবাব দিবে এর আগে নয়। চোয়াল শক্ত করে রিপার দিকে তাকিয়ে সাবা বলে,

-হি ইউল বি মাইন।

শক্ত পদক্ষেপে প্রস্থান করে সাবা। সাবাদের সপরিবারে দাওয়াত করা হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে কিছু জরুরী কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছেন আশরাফ আহমেদ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে আসতে মন সায় দেয়নি সানজিদা আহমেদের। উনারা সবাই ধরেই নিয়েছিলেন রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে হবে। রওনককের আপত্তি ছিল তা সবাই জানতো কিন্তু সে যে এমন কাজ করবে, এভাবে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে তা কেউ ভাবেনি। রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে হলে এর থেকেও বড় পার্টি হবার কথা ছিল। অথচ সেই রওনকের বউয়ের ওয়েকাম পার্টি অথচ বউটা সাবা নয় ভেবে আসতে মন চায়নি সানজিদা আহমেদের। আশরাফ আহমেদ ঢাকায় থাকলে হয়ত সম্পর্কের খাতিরে, ব্যবসার খাতিরে তাদের দু’জনকে আসতে হতো। কিন্তু আশরাফ সাহেব না থাকায় সুযোগ পেয়ে তিনি নিজেও আসেননি। দুই মেয়েকেও বলেছিলেন প্রয়োজন নেই আসার কিন্তু সাবা তো সাবাই। নিজের বেহায়াপনা দেখানোর জন্য হলেও আসবে। এই বাড়িতে আসতে তার কারণ লাগে না। অন্যদিকে রিপা মন থেকেই এসেছে রওনককে তার নতুন জীবনের জন্য শুভেচ্ছা জানাতে। রিপা একটুও রাগ হয়নি রওনক সাবাকে বিয়ে করেনি বলে। বরং খুশিই হয়েছে বলা যায়। নিজের বোনকে সে চিনে। রওনকের অতীত সম্পর্কেও অনেকটা জানা আছে তার। রিপা কখনোই চায়নি রওনকের জীবনে সাবার মতো কেউ আসুক। এখন ভাবলে রিপার মনে হয় চিত্রলেখাই রওনকের জন্য উত্তম জীবন সঙ্গী। যতটুকু সে লিখনের কাছে শুনেছে সবসময় তা থেকে এটাই মনে হয় রিপার, রওনকের জন্য চিত্রলেখার চাইতে ভালো কেউ হতেই পারে না।

তানিয়া তার সার্কেলের লোকজনের সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যস্ত। কিছুক্ষন আগে রওনক লাবিবের সঙ্গে কোথায় যেনো চলে গেল। তারপর পনেরো মিনিটের মতো হয়ে গেছে এখনো তাকে দেখেনি সে। এক/দুবার এদিক সেদিক খুঁজলেও না পেয়ে পরে এদিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে। তার জন্য এত আয়োজন, তার উচিত এসবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেয়া। যদিও তার সময় লাগবে তবুও সে চেষ্টা তো করতেই পারে। সেই চেষ্টাটা নাহয় এখান থেকেই আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শুরু হোক। সকলের উপস্থিতিতে আচমকাই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ চিত্রলেখাকে। পেছন থেকে একজোড়া হাত এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরতেই তার বুঝতে অসুবিধা হয় না এই হাত জোড়া কার। এত মানুষের উপস্থিতিতে রওনক ছাড়া কারো সাহস নেই তাকে জড়িয়ে ধরে। অবশ্য চিত্রলেখার বুঝা হয়ে গেছে কারো উপস্থিতিতে তো দূরের কথা আড়ালে আবডালেও রওনক দ্বিতীয় কাউকে এলাও করবে না তাকে স্পর্শ করে। রওনকের উপস্থিতিতে নিজেকে এতখানিই সুরক্ষিত অনুভব করে সে। আচমকা সবার উপস্থিতিতে রওনক এভাবে জড়িয়ে ধরায় লজ্জা গ্রাস করে ফেলে চিত্রলেখাকে। ওদের দেখে পাশে উপস্থিত সবাই-ই মুচকি হাসছে। নিজেকে সামলে নেয়ার বৃথা চেষ্টা করে মিনমিনে কন্ঠে চিত্রলেখা বলে,

-কি করছেন! সবাই দেখছে তো।

চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখে রওনক বলে,

-দেখুক, আই ডোন্ট কেয়ার।

লজ্জায় মাটির ভেতর হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে চিত্রলেখার। বউ লজ্জা পাচ্ছা বুঝতে পেরে বেশি একটা সময় নেয় না রওনক। চিত্রলেখাকে এর চাইতে আরও শতশুন বেশি লজ্জা দিবে সে আজ তবে এখন নয়, আর এখানে নয়। বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছে সে নিজেদের জন্য। ওসব হবে তাদের ব্যাক্তিগত মুহূর্তে। চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখেই রওনক বলে,

-আই হ্যাভ এ সারপ্রাইজ ফর ইউ।

-সারপ্রাইজ! (চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট অবাক হওয়া টের পাওয়া যায়।)

-ইয়েস।

রওনক চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,

-পেছনে দেখো।

রওনকের আদেশ মতো পেছন ঘুরতেই খুশি ও আনন্দে চিত্রলেখার চোখ চকচক করে ওঠে নিজের ভাইবোন ও খালাকে দেখে। এমন একটা মুহূর্তের জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না সে। মনে করা তো দূরের কথা আশাও করেনি চিত্রলেখা আজকের পার্টিতে রওনক তার পরিবারের কাউকে ইনভাইন্ট করবে। কেবল লিখনরাই নয় আফিফাও এসেছে বাবুলকে নিয়ে। খুশিতে চিত্রলেখার চোখে পানি এসে পড়েছে। তা দেখে রওনক চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

-একদম কাঁদার চেষ্টা করবে না। তোমাকে কাঁদানোর জন্য এই সারপ্রাইজ প্লান করিনি আমি। তোমার হাসি মুখ দেখব বলে এত আয়োজন।

রওনকের আবদার মতো তার দিকে একটা অশ্রু ভেজা হাসি দিয়ে চারুকে জড়িয়ে ধরে চিত্রলেখা। আজ সকালে রওনকের কোনো বিজনেস মিটিং ছিল না। সে গিয়েছিল চিত্রলেখার জন্য সারপ্রাইজ প্লান করতে। চিত্রলেখাকে সে ভালো করেই চিনি। এই মেয়ের বুক ফাটবে তবু মুখ ফুটবে না। ইচ্ছা করলেও মুখ ফুটে বলবে না তার পরিবারকে ইনভাইট করার কথা। কিন্তু চিত্রলেখা বলুক বা না বলুক রওনক জানে তার চন্দ্র কি পেলে খুশি হবে তাই তো নিজে গিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে। সবার জন্য শপিং করেছে। আসার সময় ওদের সালুনে দিয়ে গিয়েছিল তৈরি হতে। যেনো আজকের পার্টিতে ওদের বেমানা না লাগে। ওরা যেনো ইতস্ততবোধ না করে। ড্রাইভারকে দিয়ে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল ওদের নিয়ে আসতে। যদিও লিখন আপত্তি করেছিল তাকে এত কিছু করতে হবে না ওরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিতে পারবে কিন্তু রওনক কারো আপত্তি শুনেনি। তার একটাই কথা চিত্রলেখার খুশির জন্য, মুখের হাসির জন্য সে সব করতে পারে। চিত্রলেখাকে খুশি করতে রওনকের এত আগ্রহ দেখার পর লিখন আর আপত্তি করেনি, বোনের খুশির জন্য সব মেনে নিয়েছে। অন্যথায় এখানে আসতে অনেক বেশি ইতস্তত লাগছিল তার। এই পরিবেশ তাদের জন্য নয় তা ভালো করেই জানে লিখন। চিত্রলেখা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের ভাইবোনদের নিয়ে।

-রওনক ভাই।

-আরে রিপা যে কখন এলি তুই?

পরিচিত কারো কন্ঠ শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ পাশ ফিরে তাকায় লিখন। তৎক্ষণাৎই লিখন ও রিপার একে-অপরের চোখে চোখ পরে। রওনক রিপার সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দেয়। সবার উপস্থিতিতে লিখন ও রিপা কথা বলে না। নিজ নিজ অবাক হওয়া চেহারা সামলে নেয়। যদিও রিপা তেমন একটা অবাক হয়নি। সে আগে থেকেই জানতো হয়ত লিখনের সঙ্গে তার এখানে দেখা হবে। অবাক হয়েছে লিখন যা তার চোখ-মুখে স্পষ্ট পরিলক্ষিত। কিন্তু এখানে রিপার সঙ্গে কথা বলার কোনো চেষ্টা করে না সে। রিপা এখানে কি করছে, রওনকের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সব জানার সুযোগ পাবে তাই আপাতত চেপে যায়।

খানিকটা রওনকের কাছাকাছি চেপে এসে চিত্রলেখা কণ্ঠস্বর একদম খাঁদে নামিয়ে কথা বলে যেনো অন্যকেউ শুনতে না পায়। কাছাকাছি আসতে নিয়ে রওনকের শরীরের সঙ্গে চিত্রলেখার শরীর ঘেষে খানিকটা। ফিসফিসে আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

-থ্যাংকিউ সো মাচ।

-ইশ এতবড় সারপ্রাইজের বিনিময়ে শুধু থ্যাংকিউ? আরও বেটার কিছু কি পেতে পারি না আমি?

-কি চাই বলুন।

-যা চাই দিবে?

-যা বলবেন তাই।

-অলরাইট।

চিত্রলেখার হাত ধরে জোরে কেশে রওনক বলে,

-এক্সকিউজ মি প্লিজ, আমরা একটু আসছি।

লাবিব ও তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রওনক ইশারা করে লিখনদের খেয়াল রাখতে। আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে চিত্রলেখাকে নিয়ে উপরে চলে যায় সে। নিজের ঘরে প্রবেশ করে তৎক্ষণাৎই দরজার সঙ্গে চেপে ধরে চিত্রলেখাকে। কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই রওনক চিত্রলেখার লিপস্টিকে লাল হয়ে থাকা ঠোঁট জোড়ার দখল নেয়। অনেকক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিল সে। পার্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখবে বলে ভেবে রেখেছিল কিন্তু যেই চিত্রলেখা নিজে থেকে তার কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে কথা বলল। মৃদুভাবে গা ছুঁয়ে দিল হয়ত অবচেতনেই। যেই চিত্রলেখার নিঃশ্বাস রওনকের কান স্পর্শ করলো ব্যস রওনকের সেলফ ডিফেন্স ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তখনই। আর নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না সে। খুব বেশি কিছু না হোক অন্তত ঐ ঠোঁট জোড়ার দখল তার চাই-ই চাই। চিত্রলেখা বুঝে উঠতে পারে না কি হচ্ছে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ঠোঁট জোড়া বেদখল হয়ে গেছে। রওনকের আচমকা আক্রমনে প্রথমে চিত্রলেখার চোখ বড় হয়। ৩ সেকেন্ড সময় লাগে চিত্রলেখার কি ঘটছে তা বুঝতে, ধাতস্থ হতে। সে চাইলেই এখন আর নিজেকে রওনকের স্পর্শ থেকে আলদা করতে পারবে না। সেই চেষ্টাও করে না অবশ্য। বড় হয়ে থাকা চোখ গুলো রওনকের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শের আবেশে বন্ধ করে নেয়। হাত বাড়িয়ে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরে নিজেও তাল মেলায় রওনকের ঠোঁটের তালে। এই ঠোঁট রওনক ততক্ষণ না ছাড়ার পন করেছে যতক্ষণ না তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আজ চিত্রলেখার রেহাই নেই। আগের চাইতে আরও হিংস হয় সে। তার হাত চলে গেছে চিত্রলেখার শাড়ির ভেতরে। রওনকের স্পর্শ যেনো আরও পাগল করে দিচ্ছে চিত্রলেখাকে। এই পাগলামী, উন্মাদনার শেষ কোথায় চিত্রলেখার জানা নেই। তবে তার মন্দ লাগছে না এভাবে নিজেকে রওনকের কাছে সপে দিতে, রওনককে নিজের দখল দিতে একটুও খারাপ লাগছে না। উষ্ণ ভালো লাগায় অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরছে তার। আরও কিছু চাই তার, আরও বেশি কিছু।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

পার্টির অবশিষ্ট সময় চিত্রলেখা আর রওনকের চোখে চোখ রাখতে পারেনি। মুখ তুলে তার দিকে তাকাতে পারেনি লজ্জায়। এভাবে সে রওনকের ঠোঁটের উষ্ণ আহবানে সাড়া দিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারেনি। এখন লজ্জায় ম রে যেতে ইচ্ছা করছে। পার্টির প্রায় শেষের দিকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনক লাবিবকে সঙ্গে করে নিজের ঘরের অফিসে বসেছে। কি যেনো জরুরী কাজ পরে গেছে তার। ওরা পার্টি ছেড়ে যাবার কিচ্ছুক্ষন পর তানিয়াও ওদের জয়েন করেছে। চিত্রলেখা এখন বসে আছে তার নিজের ঘরে। পার্টিতে পরা শাড়িটা এখনো খোলেনি সে। রওনকের আবদার, সে ফ্রি না হওয়া অব্দি যেনো চিত্রলেখা এই শাড়িতেই থাকে। মেকাপটাও ছাড়েনি সে। বলা যায় এক কথায় পার্টির গেটাপেই আছে সে এখনো, রওনকের অপেক্ষায়। মেহমান সব চলে গেছে প্রায় ঘন্টা খানিক আগে। রওনক বলেছিল লিখনদের রাতটা থেকে যেতে কিন্তু এতে রাজি হয়নি নারগিস বেগম। এমনিতেই ওদের বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। এবাড়িতে আসার পর থেকেই অজানা এক অস্থিরতায় অস্থির হয়ে আছেন। কতক্ষনে বাড়ি ফিরে যাবেন সেই চিন্তায় ছিলেন আসার পর থেকে। তারউপর একটা বিষয় উনার খটকা লেগেছে। রওনকের মা তথা চিত্রলেখার শাশুড়ি উনাদের সঙ্গে দেখে করেননি। যদিও সবাইকে বলা হয়েছে ইনার শরীর ভালো নেই তাই পার্টি জয়েন করতে পারছেন না, তবুও একটা খটকা থেকেই যায়। আগবাড়িয়ে নারগিস বেগম কিছু জিজ্ঞেসও করেননি। তবে এই বিষয়ে চিত্রলেখার সঙ্গে কথা আছে উনার। চিত্রলেখা জানে তার ভাইবোন, খালার মনের অবস্থা তাই কাউকে জোর করেনি থেকে যাবার জন্য। রওনকের আদেশে তার ড্রাইভার ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসে। যদিও লিখন বলেছিল ওরা উবার নিয়ে নিবে কিন্তু রওনককে বুঝায় সে সাধ্য কার আছে?

নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রীল ধরে সামনের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর একটা ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছে, কখন আসবে রওনক। তার অপেক্ষাতে ইতি টেনে আচমকাই চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে রওনক। সামান্য কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। তার কাঁধে মুখ রেখে রওনক বলে,

-আই মিসড ইউ বউ।

চিত্রলেখার গাল লাল হয়। লজ্জা পাওনা দ্বিগুণ হয়। রওনক তার হাতের বাঁধন শক্ত করে আগের চাইতে আরও বেশি। পাশের ঘরেই ছিল সে। অথচ রওনকের আচরণে মনে হচ্ছে কতদিন পর দেখা তাদের। এইসব অনুভূতি যেনো লজ্জাই দেয় চিত্রলেখাকে। বউকে লজ্জা পেতে দেখে আরেকটু বেশি লজ্জা দিতে চিত্রলেখার কানের নিচে চুমু খায় সে। চিত্রলেখার মনে হয় তার শরীরে শিহরনের ঢেউ খেলে গেল। এর আগে কখনো এমন অনুভব হয়নি তার। রওনক কাছাকাছি থাকলে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় চিত্রলেখার। এক মুহূর্ত সময় দিয়ে চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘোরায় রওনক। চিবুক স্পর্শ করে মুখ উপরে তুলে ধরে। কিন্তু লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। আজ একের পর এক যা হচ্ছে এরপর আর রওনকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার সাহস করতে পারছে না চিত্রলেখা। মনে হচ্ছে সে চোখ মেলে রওনকের চোখের দিকে তাকালেই আজ একটা অঘটন ঘটে যাবে। যে অঘটনের পূর্বাভাস রওনক তাকে দিয়ে রেখেছে। কি হতে যাচ্ছে বা হতে পারে ভেবেই চিত্রলেখার গলা শুঁকিয়ে আসছে আসন্ন ঘটনার চিন্তায়।

-চোখ খোলো চন্দ্র।

রওনকের কথায়ও চোখ খোলে না চিত্রলেখা। দুষ্টু হাসি হেসে বলে,

-আই সোয়ার এক্ষন চোখ না খুললে আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো।

রওনকের হুমকি শুনে তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায়। চিত্রলেখার চোখের অবস্থা দেখে হাসি পায় রওনকের। কেমন বড় হয়ে গেছে আতংকে। এই মেয়েটা এমন কেনো মনে মনে ভাবে সে। এতক্ষন চিত্রলেখার দুই বাহু ধরে রেখেছিল সে। ডান হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার চোয়াল স্পর্শ করে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে। দু’জনের একজনও অপরজনের দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরায় না। যেনো একে-অপরের চোখে আটকে গেছে তারা। আচমকাই রওনক বলে,

-আই এম সরি।

চোখ সরু হয় চিত্রলেখার। হঠাৎ এই সরির কারণ ধরতে পারে না সে। তাকে অবশ্য খুব বেশি একটা ভাবতেও হয় না। রওনক নিজেই বলে,

-একটা জরুরী কাজ পরে গেছে। আমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে। টিকেট বুক করা হয়ে গেছে। সকাল ৮ টার ফ্লাইট।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-হয়ত ৭ থেকে ১০ দিন লেগে যাবে আমার ফিরতে। আমি চেষ্টা করব জলদি ফিরে আসার। আমি ফিরে আসার পর আই ইউল রিয়েলি ম্যাক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিজ।

এতক্ষনে বুঝতে পারে চিত্রলেখা, রওনক তাকে বারবার বিশেষ কিছুর ইংগিত দিয়েছে সেটাই পিছিয়ে গেছে। সেজন্যই এই সরি বলা তার। একটা নতুন বিদেশি ব্যভারেজ বাংলাদেশে খুব জলদিই লঞ্চ করবে রওনক। সেই সংক্রান্ত কিছু কাজেই তাকে মেক্সিকো যেতে হচ্ছে। গাজীপুরে রওনকের কারখানায় তৈরি করা হলেও কাঁচামাল আসবে মেক্সিকো থেকে। এই প্রোডাক্ট লঞ্চের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছে সে। এই প্রোডাক্টটা মার্কেটে আসার পর কোম্পানির সেল কয়েকগুন বেড়ে যাবে। কয়েক দফায় ল্যাব টেস্ট করা হয়ে গেছে। কাঁচামাল ফ্যাক্টরিতে আসার অপেক্ষায় এদিকে সবরকম প্রস্তুতি নেয়া শেষ। কাঁচামাল আসার আগে ফেইস টু ফেইস আরেকটা মিটিং করতে হবে। রওনক চেষ্টা করেছিল মিটিংটা অনলাইনে সেরে ফেলতে কিন্তু কিছু কাজ থাকে যা চাইলেই অনলাইনে করা যায় না। ফেইসভ্যালুর একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া তাকে ঐ কোম্পানির ফ্যাক্টরিতেও যেতে হবে। আর এই প্রজেক্টটা রওনকের জন্য অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ন তাই কোনো চান্স নিতে চায় না সে। অন্য কিছু হলে পোসপন করে দেবার আগে দুইবার ভাবতো না।

চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-রাগ করেছো?

জবাবে কেবল মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমি জানি এই সময়টা আমার তোমার সঙ্গে থাকা উচিত বাট আই এম ইন এ টাইট সিচুয়েশান।

এক মুহূর্ত কিছু ভেবে রওনক আরও বলে,

-এক কাজ করলে কেমন হয়?

-কি?

-তুমি আমার সঙ্গে চলো।

-আমি!

-হ্যাঁ, সারাদিন তো আর আমি কাজে বিজি থাকবো না। ফ্রি টাইমে আমরা আমাদের মতো ঘুরে বেড়ালাম। এ মিনি হানিমুন।

-কিন্তু…

-কি?

-আমার তো পাসপোর্ট, ভিসা কিচ্ছু নেই।

-ও শীট!

আবার কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করে রওনক বলে,

-লাবিবকে বলে যাবো আমি ফিরে আসার আগেই যেনো তুমি তোমার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাও। ওকে?

চিত্রলেখা আবারও মাথা ঝাঁকায় সম্মতিতে। আচমকাই চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ভেতরে ফিরে যেতে যেতে রওনক বলে,

-চলো ঘুমিয়ে পড়ি। ৮ টার ফ্লাইট আমার, ৫টার আগে বের হতে হবে।

চিত্রলেখাকে চেঞ্জিং রুমের দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে রওনক আরও বলে,

-থ্যাংকিউ।

-কেনো?

-আমার কথা রেখেছো। শাড়িটা পাল্টে ফেলোনি।

-ওহ!

চিত্রলেখার থেকে দু’হাত পেছনে সরে গিয়ে রওনক বলে,

-বাই দ্যা ওয়ে তোমার তো আজ এই শাড়ি পরার কথা ছিল না। আমার যতটুকু মনে পড়ে তুমি গাউন পরেছিলেন।

চিত্রলেখা নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

-আসলে হয়েছিল কি… আ আমি ওসব কখনো পরিনি তা তাছাড়া ঐ গাউনটায় সব দেখা যাচ্ছিল তাই তাই ওটা পরে বের হবার সাহস হয়নি আমার। সবাই তাকিয়ে থাকতো। আম আমি…

-কিন্তু ওটার সঙ্গে তো একটা এক্সট্রা পার্ট ছিল উপরের, তোমার শোল্ডার ডাকার জন্য। আমি স্পেশিয়ালি অর্ডার দিয়ে বানিয়েছি।

-কিহ! (কি তা একটু জোরেই বের হয়ে আসে চিত্রলেখার মুখ ফসকে।)

-হ্যাঁ, ওটা উপরে পরলে তোমার শোল্ডার দেখা যেতো না।

-কিন্তু আমাকে তো ওটা দেয়াই হয়নি। আমি আরও ভাবলাম ওভাবেই নিচে যেতে হবে সেজন্যই তো লাস্ট মোমেন্টে এই শাড়িটা…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি ভাবলে কীভাবে একটা অফ শোল্ডার গাউন পরে এত মানুষের সামনে তোমাকে যেতে দিবো আমি তাও যে ড্রেসে তোমার ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে এমন একটা ড্রেস। এই জিনিস শুধু আমি দেখবো, আমি। কেউ তোমার নগ্ন শরীরের দিকে তাকানোর আগে তার চোখ তুলে ফেলবো।

ভালো লাগা ও লজ্জার সংমিশ্রিত এক অদ্ভূত অনুভূতি অনুভব করে চিত্রলেখা। তার নার্ভাসনেস টের পেয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, আমি তো দেখেছি ব্যস আর কেউ না দেখলেও চলবে। তবে এই শাড়িটাতেও কোনো অংশকে কম কিছু লাগেনি তোমাকে। ইউ অয়েরা লুকিং আউস্টেন্ডিং টুডে। এখন যাও চেঞ্জ করে নাও তারপর শুয়ে পরি।

রওনক চেঞ্জ করতে যেতে বলার পরেও দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-তাহলে বলে ফেলো।

-আমি আপনাকে এয়ারপোর্ট দিয়ে আসি।

-দিয়ে আসতে চাও?

সম্মতিতে দ্রুত মাথায় ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-ঠিক আছে অবশ্যই যাবে। প্রথমবার কেউ আমাকে সি অফ করতে এয়ারপোর্ট যাবে। আই এম এক্সাইটেড।

-আরেকটা কথা।

-আরও একটা?

-হু

-বলো।

-ওখান থেকে আমি খালার বাসায় যাই?

-আমি না করলে যাবে না?

কিছু বলে না চিত্রলেখা কেবল মাথা নুইয়ে ফেলে। তা দেখে এগিয়ে এসে তাকে নিজের আলিঙ্গনে নিয়ে বলে,

-কোথাও যাবার জন্য তোমাকে আমার পারমিশন নিতে হবে না বউ। তোমার যেখানে খুশি যাবে। জাস্ট আমাকে জানিয়ে গেলেই হবে কোথায় যাচ্ছো যেনো আমার টেনশন না হয়, ব্যস এতটুকু করলেই চলবে।

রওনকের বুকে মাথা রেখেই মাথা ঝাঁকায় সে। চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-আরেকটা কাজ করতে পারো। আমি যেহেতু থাকছি না তুমি চাইলে কয়টা দিন ওখানে থেকে আসতে পারো।

-সত্যি!

অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে রওনকের বুক থেকে মাথা তুলে মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তার নাক টেনে দিয়ে বলে,

-একদম সত্যি। শুধু খালার কাছেই নয় চাইলে আফিফার কাছেও থেকে আসতো পারো। শুধু আমি ফিরে আসার আগে চলে এসো তাহলে হবে।

-কিন্তু আমি চলে গেলে মীম, মিশকাতকে কে দেখবে।

-ওদের দেখাশুনার জন্য লোক আছে চন্দ্র। তুমি ওদের কেয়ার টেকার ন,ও গার্ডিয়ান। হয়ত সম্পর্কে চাচী তবে একচুয়েলি ওদের মা তুমি। যেমন আমি চাচা হয়েও ওদের বাবা। নিজেকে সময় দাও। মীম, মিশকাতের জন্য তোমাকে নিজের খুশি সেক্রিফাইজ করতে হবে না। আমি দিবোও না তোমাকে এই কাজ করতে। বুঝতে পেরেছো?

হাসি হাসি মুখ করে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। আরও একবার তার নাক টেনে দিয়ে রওনক বলে,

-দ্যাটস মাই গার্ল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে