মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0
584

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-কেমন আছেন মামুন সাহেব?

আচমকা কারো আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় মামুন। কন্ঠটা তার পরিচিত নয়। পেছন ঘুরে রওনককে দেখে তৎক্ষণাৎ ভ্রু কুচকায় সে। তাকে দেখে মামুনের রিয়্যাকশন দেখে মৃদু হাসে রওনক। মামুনের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে রওনক নিজেই আবার বলে,

-ব্যস্ত না থাকলে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।

এই লোকটাকে অর্থাৎ রওনকে কোনোভাবেই এখানে আশা করনি মামুন। তার সঙ্গে চিত্রলেখার বরের কি কথা থাকতে পারে? অনেক চিন্তা ভাবনার পর মামুন বলে,

-বলুন।

-এখানে নয়। আপনি কি একটু কষ্ট করে আমার সঙ্গে আসবেন? কনফিডেন্টশিয়াল কথা তাই পাবলিক প্লেসে বলতে চাইছি না।

মাথা ঝাঁকায় মামুন। রওনক আরও বলে,

-আমার গাড়িটা ওইদিকে আছে চলুন।

বাড়তি কথা বলে না মামুন। রওনকের সঙ্গে তার কোনো কথা না থাকলেও তাকে চিত্রলেখার হাসবেন্ড কি বলতে চায় তা জানার কৌতুহল অবশ্য দমিয়ে রাখতে পারছে না মামুন। সেজন্যই মূলত আপত্তি না করে সঙ্গে যাওয়া। আবার মামুন মনে মনে এটা ভাবে রওনক যা বলতে চায় সেটা কোনোভাবে চিত্রলেখার সঙ্গে সংপৃক্ত কিনা! সবকিছুই ভাবায় তাকে। ভাবনাদের হাতে ঠেলে রওনকের সঙ্গে তার গাড়িতে উঠে বসে মামুন। রওনকের ইশারায় ড্রাইভার গাড়ি চালাতে আরম্ভ করে।

-কেমন আছিস আপা?

চিত্রলেখার ফোন কল পেয়ে তৎক্ষণাৎ রিসিভ করে এই কথাটাই প্রথম জিজ্ঞেস করে লিখন।

-ভালো আছি।

-সত্যি ভালো আছো?

-কখনো আমাকে মিথ্যা বলতে শুনেছিস?

-জানি তুমি মিথ্যা বলো না কিন্তু ঠিকই কথা আড়াল করো। যে কথাটা শুনলে আমরা দুঃখ পাবো সেটা কখনোই আমাদের বলো না, নিজে নিজে একা কষ্ট পাও।

-এভাবে বলছিস কেন লিখন?

-এমনি আপা। তোমাকে মিস করছিলাম তাই হয়ত। সত্যি সত্যি একদিন বিয়ে করে তুমি শশুড়বাড়ি চলে যাবে ভাবতাম কিন্তু দিনটা এত জলদি আসবে তা কখনো ভাবিনি। এভাবে যে আচমকা আসবে সেটাও তো চিন্তা করিনি। বাড়ি ফিরলে তোমাকে দেখতে পাবো না ভাবলেই…

লিখনের গলা ধরে আসে কথাটা শেষ করতে পারে না সে। লাইনের অন্যপাশে চিত্রলেখার গাল বেয়ে ইতোমধ্যেই অশ্রু ঝড়তে শুরু করেছে। খানিক নীরবতার পর লিখন নিজেকে সামনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি কাঁদতেছো আপা?

নিজের কান্না গিলে ফেলার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-ক কই না তো।

-মিথ্যা বলতে পারো না তাও কেন বলো? জানো ধরে পড়ে যাবা। তুমি এত বাজে মিথ্যা বলো আপা, তোমার থেকে চারু বেশি সুন্দর গুছায় মিথ্যা বলতে পারে। ধরতেই পারবা না ও মিথ্যা বলতেছে। আচ্ছা আপা বলো তো তুমি মিথ্যা বলতে পারো না অথচ চারুটা এমন মিথ্যুক কীভাবে হলো?

লিখনের কথা শুনে হেসে ফেলে চিত্রলেখা। হেসে ফেলে বলে,

-একদম আমার চারুকে মিথ্যুক বলবি না। চারু মিথ্যা বলে না।

-বলে আপা অনেক মিথ্যা বলে।

-তুই নিজে বলিস না ভাবছিস?

-ওমা এখন তুমি আমাকে মিথ্যুক বলবা?

-মিথ্যুক বলছি না। আমি জানি আমাকে কষ্ট না দেয়ার জন্য তোরা অনেক কিছুই আমার থেকে আড়াল করে রাখিস। এটাকে মিথ্যা বলে না রে লিখন।

-যেমন তুমি করো।

লিখনের এই কথার পিঠে আর কিছু বলে না চিত্রলেখা। এটা সত্যি, এতগুলো বছরে অনেক কথাই আড়াল করেছে সে ভাইবোনদের থেকে শুধুমাত্র ওদের কষ্ট দিতে চায় না বলে। ভাইবোনের কথা মনে পড়ছিল বলে লিখনকে ফোন দিয়েছে চিত্রলেখা। এখন তো চাইলেই যখন খুশি তখন ভাইবোনের কাছে ছুটে যেতে পারবে না সে। তার জগৎ টা এখন আর কেবল তাই ভাইবোনকে ঘিরে নেই। রওনক নামক একজন মানুষ তার জগতের আধিপত্ত লাভ করেছে। যাকে চাইলেই চিত্রলেখা আর উপেক্ষা করতে পারবে না। কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-খালা, চারু, চয়ক সবাই কেমন আছে আরে?

-তোমাকে ছাড়া যেমন থাকার কথা তেমনই আছে আপা। কেউ মুখে বলে না কিন্তু আমি জানি সবাই তোমাকে অনেক মিস করছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না কয়েকটা দিন পর সবাই ঠিক সামলে উঠবে।

-হুম…

খানিকটা ইতস্ততা নিয়েই লিখন বলে,

-একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপা?

-হ্যাঁ বল।

-তুমি সত্যি ভালো আছো তো? ঐবাড়ির সবাই তোমাকে খুশি মনে আপন করে নিয়েছে তো?

চিত্রলেখা জানতো লিখন তাকে এই প্রশ্নটা করবেই দু’দিন আগে বা পরে। নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-সত্যি আমি ভালো আছি রে। আমাকে নিয়ে একদম ভাবিস না। আমি ভালো আছি।

মানুষ যখন ভালো থাকে না তখন বারবার ভালো আছি বলে নিজেকে, নিজেরে আশেপাশের মানুষগুলোকে বুঝাতে চেষ্টা করে সে ভালো আছে। চিত্রলেখা এখন যেনো সেই কাজটাই করছে। লিখন আর প্রেসার দেয় না। বোনের কথা মেনে নিয়ে বলে,

-যাই হয়ে যাক, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেনো আমি লিখন তোমার ভাই সবসময় তোমার পাশে আছি। তুমি যাই বলবে আমি তাই বিশ্বাস করব যদি সেটা মিথ্যা হয় তবুও সেটাই আমার জন্য সত্যি হবে যদি তুমি বলো। তাই কখনো নিজেকে একা ভাববে না। তোমার লিখন সবসময় তোমার পাশে আছে আপা। চারু, চয়ন এখনো ছোট কিন্তু আমি আছি।

লিখনের সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে চিত্রলেখার। সে জানে, এই পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ তার সঙ্গ ছেড়ে দিলেও এই তিনজন মানুষ যাদের শরীরে একই রক্ত বইছে, চিত্রলেখার সবচাইতে আপনজন, এরা কখনো কোনো পরিস্থিতেই তার হাত ছাড়বে না। লিখনের সঙ্গে কথা বলার পর হালকা লাগছে চিত্রলেখার। হাত থেকে মোবাইল নামিয়ে রেখে সবেই বিছানায় বসেছে সে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরলে দেখে তানিয়ে প্রবেশ করছে। এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে,

-ব্যস্ত? বিরক্ত করলাম না তো?

-একদম না, আসুন না প্লিজ।

-পার্লারের মেয়েরা চলে এসেছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে, এসো।

তানিয়া আগে তার পেছন পেছন চিত্রলেখা হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করে,

-আমি এসব না করলে হয় না?

চিত্রলেখার কথা শুনে থেমে দাঁড়িয়ে তানিয়া বলে,

-এগুলো তো বেসিক। রাতের পার্টির জন্য তৈরি হবার আগে একটু ফেশিয়াল করে নিলে ম্যাকাপটা ভালো সেট হবে ফেইসে।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি কখনো এসব করিনি।

তানিয়া এগিয়ে এসে চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে আশ্বস্ত করে বলে,

-আমি জানি। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শুরু আছে তাই না বলো? আমি আছি তো তোমাকে শিখিয়ে দিতে। আমি চলে যাবার আগে তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিয়ে যাবো যেনো আমি যাবার পর তোমার কোনো সমস্যা না হয়। যেনো কোনো পরিস্থিতে তুমি রওনকের পাশে দাড়াতে পারো। আমি চলে যাবার আগে সব বুঝিয়ে, শিখিয়ে দিয়ে যাবো তোমাকে।

এবারে চিত্রলেখা তানিয়ার হাত ধরে বলে,

-থেকে গেলে হয় না? কোনোভাবেই কি থেকে যাওয়া যায় না? মিশকাত, মীমের জন্যও না?

চিত্রলেখার অবুঝ আবদার শুনে তানিয়ার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তার হাসি দেখে বিভ্রান্ত হয় চিত্রলেখা। হাসি হাসি মুখ করেই তানিয়া বলে,

-থেকে যেতে পারলে কি আর চলে যাবার কথা ভাবতাম? আমি তো থাকতেই এসেছিলাম। চলে যাবার কথা তো কখনো ভাবিনি। যার জন্য, যার হয়ে এসেছিলাম একদিন সবকিছু পেছনে ফেলে সেই তো আমার নেই। যার আমাকে শক্ত আলিঙ্গনে ধরে রাখার কথা সেই তো কখনো আমাকে আগলে রাখেনি তাহলে কার জন্য থাকবো? কিসের আশায় থাকব?

-মীম, মিশকাত এর চাইতে বড় কারণ কি কিছু হতে পারে?

-আমি কখনোই আমার সন্তানদের বাঁধা হিসেবে দেখিনি। ওদের জন্য তো তুমি আর রওনক আছোই। ওদের নিজের বাবা যে আদর ভালোবাসা দিতে পারেনি, রওনক কখনো সেই অভাব ওদের বুঝতে দেয়নি। জন্ম দিয়েছি বলেই আমার কোনো অধিকার নেই রওনকের কাছ থেকে ওদের কেড়ে নিবো।

-আমি তো সবে এলাম। আমি কি পারবো আপনার মতো করে…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না নিয়ে তানিয়া বলে,

-তুমি আমার চাইতে ভালো পারবে আমি জানি। রওনক এমনি এমনি তোমাকে বিয়ে করেনি চিত্রলেখা। তোমার নিজের উপর সন্দেহ থাকলেও রওনকের সিদ্ধান্তের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারো।

-তুবও আমাদের সাথে না হয় থেকে যেতেন।

-থাকতাম যদি আশার কোনো আলো অবশিষ্ট থাকতো। যতদিন ছিল ততদিন ছিলাম। আমার পৃথিবীর সবটা জুড়ে অন্ধকার নেমে আসার পরেই আমি নতুন আলোর সন্ধানে নেমেছি। আমি বাঁচতে চাই চিত্রলেখা। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। আর অন্যের জন্য নয় এবার কেবল নিজের জন্য বাঁচতে চাই। একটা মানুষ যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি শুরু থেকে। যার জন্য নিজেকে উজার করে দিয়েছি। ভালোবেসে যার সন্তানের মা হয়েছি। দিনশেষে উপলদ্ধি করলাম মানুষটা শুরু থেকে কখনোই আমার ছিল না। বিশ্বাস করো, সে যদি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলে মিথ্যা করেও বলো সে শুধু আমার। আমি তার মিথ্যাটাকে সত্যি মেনে নিয়েই থেকে যেতাম। আর সত্যি মিথ্যা খুঁজতাম না।

এরপর আর চিত্রলেখার মুখে কথা জোগায় না। আসলেই তো কিসের আশায় থেকে যাবে তানিয়া! বিয়ের পর একটা মেয়ের জীবনের সবচাইতে বড় খুটি তার স্বামী। যে মানুষটার হাত ধরে সব পেছনে ফেলে নতুন করে জীবন শুরু করে একটা মেয়ে। সেই মানুষটাই যদি নিজের না থাকে তাহলে কিসের আশা থাকবে সে? তানিয়া তো কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। তারও তো বাঁচার অধিকার আছে। ভালো থাকার অধিকার আছে।

চিত্রলেখাকে আপন ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে তানিয়া হাত ঝাঁকি দিয়ে বলে,

-চলো মেয়েগুলো অপেক্ষা করছে অনেকক্ষন হয়। তোমার বর এসে যদি দেখে আমরা এখনো ফেশিয়াল শেষ করিনি তাহলে খবর আছে। কাজের ব্যাপারে কত পাংচুয়াল জানো তো।

চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়। তানিয়া তার হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিয়র শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে আসতেই চিত্রলেখা দেখে তার বিছানার উপর অনেকগুলো ব্যাগ রাখা। একসঙ্গে এতগুলো ব্যাগ দেখে কৌতুহল জাগে চিত্রলেখার মনে। কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে মনে মনে কাউন্ট করে, ২২ টা ব্যাগ। কে রেখেছে এতগুলো ব্যাগ এখানে? কার এগুলো? রওনক কি ফিরে এসেছে? দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় চিত্রলেখা। আড়াইটার বেশি বাজে। রওনক যাবার আগে বলে গিয়েছিল আজ জলদিই ফিরে আসবে কিন্তু কখন ফিরবে সেটা বলে যায়নি। কিন্তু সে ফিরলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই তাকে জানাতো। ফেশিয়াল করতে বসার আগে জাহানারা ফুফুকে চিত্রলেখা নিজেই বলেছিল রওনক ফিরলে যেনো তাকায় জানায়। ব্যাগগুলো কার, কে রেখেছে, এখানে কেনো এমন হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চিত্রলেখার মস্তিষ্কে। আচমকাই চিত্রলেখার সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে চেঞ্জিং রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রওনক। তাকে দেখে অবাক হয়েছে চিত্রলেখা। অবাক হবারই কথা। চিত্রলেখাকে বিছানার কাছে দেখে এগিয়ে আসতে আসতে রওনক বলে,

-টোটাল ৪৫ টা শাড়ি আছে।

-৪৫ টা!

সামান্য অবাক হলেও বিশেষ ভাবে না চিত্রলেখা। বাসার সবাই প্লাস আত্মীয় স্বজনদের জন্য এনেছে হবে হয়ত। কিন্তু চিত্রলেখাকে অবাক হবার চুড়ান্তে পৌঁছে দিতে রওনক বলে,

-তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কিনা।

চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকায় চিত্রলেখা, রওনকের কথা শুনে। ৪৫ টা শাড়ির তার জন্য! এমনিতেই তো আলমারি ভরতি কাপড় চোপড় দিয়ে। এরপর আবার শাড়ি তাও ২ টা বা ৫টা নয় ৪৫ টা! এই লোকের কি মাথায় সমস্যা? মনে মনে ভাবলেও মুখে জিজ্ঞেস করতে পারে না রওনককে আসলেই তার মাথায় সমস্যা আছে কিনা। চিত্রলেখাকে অবাহ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউকে উষ্ণ আলিঙ্গনে। আচমকা রওনকের জড়িয়ে ধরায় এবার যেনো ভেঙে পড়ে চিত্রলেখা। এই মানুষটার স্পর্শে এমন দূর্বল হয়ে যায় কেনো সে? বুকের ভেতর কিছু একটা তোলপাড় করছে। নিঃশ্বাস ভার হয়ে আসতে চাইছে চিত্রলেখার। তা বুঝতে পেরে রওনক চিত্রলেখার কাঁধে মুখ রেখে একদম কানের কাছে গিয়ে বলে,

-এখনো আমি স্পর্শ করলে তুমি কেঁপে উঠছো। এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেনো? আমি তো, তোমার রওনক।

বলেই চিত্রলেখার কাঁধে একটা লম্বা চুমু খায় সে। চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চিবুক ছুঁয়ে মুখ উপরের দিকে তুলে। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে অনুভূতিদের দৌড়াদৌড়ি চলছে। লজ্জায় চিত্রলেখার লাল হয়ে যাওয়া নাকে ছোট করে ঠোঁট ছুঁয়ে রওনক বলে,

-গতকাল ঐ শাড়িটাতে খুব সুন্দর লাগছিল তোমাকে তাই আমার পছন্দ মতো কিছু আড়ং কটনের শাড়ি এনেছি, তোমার জন্য ছোট্ট একটা গিফট। একটু কারেকশন করি। ৪০ টা শাড়ি তোমার আর বাকি ৫ টা আফিফার জন্য।

-আফিফার!

চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট অবাক হওয়া। রওনক বলে,

-হু, গতকাল আফিফা তোমাকে নিজের শাড়ি না পরিয়ে দিলে তো আমি জানতেই পারতাম না নরমাল একটা সুতির শাড়িতে তোমাকে দেখতে এত সুন্দর লাগবে। ঐ শাড়িটা তুমি রেখে দিও। আরেকদিন না হয় আমার জন্য পরো। আর ঐ শাড়িটার এক্সচেঞ্জে নতুন ৫ টা শাড়ি আমার পক্ষ থেকে আফিফার জন্য ছোট্ট একটা গিফট।

রওনকের বাহুবন্ধনে থেকেই চিত্রলেখা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ব্যাগগুলো দেখে নিয়ে বলে,

-ছোট্ট গিফট এটা? ৪৫ টা শাড়ি। কেউ কেউ হয়ত সম্পূর্ন জীবনে ৪৫ টা শাড়ি পরার সুযোগ পায় না আর আপনি বলছেন ছোট্ট গিফট!

-৪৫ না ৪০ টা তোমার।

-এক বালতি দুধ থেকে এক গ্লাস দুধ কেউ খেয়ে ফেললে কি খুব বেশি পার্থক্য হবার কথা?

রওনক মাথা ঝাঁকায়। চিত্রলেখা বলে,

-তেমনি ৪৫ যা ৪০ ও তাই।

ভ্রু কুঁচকে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-সো আর ইউ টেকিং মাই গিফট ওর রিজেক্টিং মি?

মাথা ঝাঁকিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমার সেই সাধ্য কোথায় আপনার দেয়া উপহার উপেক্ষা করব।

চিত্রলেখার জবাব টা পছন্দ হয় না রওনকের। সে চিত্রলেখাকে কোনো কিছুর জন্য জোর করতে চায় না, করবেও না। রওনক দুই হাতে চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে রেখেছিল। একটা হাত এবারে চিত্রলেখার গালে রেখে বলে,

-ইটস ওকে, জোর করে তোমায় কিছুই করতে হবে না। তুমি নিতে না চাইলে আমি সব রিটার্ন পাটিয়ে দিচ্ছি।

চিত্রলেখা রওনকের টি-শার্ট চেপে ধরে বলে,

-প্লিজ এর প্রয়োজন নেই। আপনি শখ করে এনেছেন, অবশ্যই আমি পরবো।

-আমাকে খুশি করতে?

-না, আমি খুশি হয়েই পরবো। এর আগে কখনো কেউ আমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। জীবনে প্রথম কেউ দিলো আমি ফিরে দেই কীভাবে?

রওনক আর কিছু বলে না। হাসি ফুটে ওঠে তার চোয়াল জুড়ে যা চিত্রলেখাও দেখতে পায়। কিন্তু চিত্রলেখাকে নিজের থেকে আলাদা করে না সে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আপনি কখন এলেন?

-অলমোস্ট থার্টি মিনিট হবে।

-আমাকে ডাকেননি কেনো? আমি তো ফুপিকে বলেছিলাম আপনি এলে আমাকে জানাতে।

-আমি খালাকে বলেছিলাম তোমাকে ডিস্টার্ব না করতে। আই উইল ওয়েট ফর ইউ।

চিত্রলেখ আবারও ঘড়ি দেখে জিজ্ঞেস করে,

– নিশ্চয়ই কিছু খাননি, খাবার দিতে বলি?

-তুমি খেয়েছো?

জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে রওনক। সে জানে চিত্রলেখা দুপুরে খায়নি। এমন নয় যে ফেশিয়াল ইত্যাদি করায় ব্যস্ত ছিল সেজন্য খাবার সু্যোগ পায়নি। রওনক বাসায় ফিরে সবার আগে জাহানারাকে জিজ্ঞেস করেছিল চিত্রলেখা দুপুরে খেয়েছে কিনা। চিত্রলেখা একা খাবে না সেটা রওনক জানতো বলেই মিটিং শেষ করে বাইরে খাওয়া দাওয়া করেনি সোজা বাড়ি ফিরে এসেছে চিত্রলেখার কাছে। জবাব না দিয়ে চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়।

-খাওনি কেনো?

-আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

-আমি যদি এখন না আসতাম তাহলে?

-অপেক্ষা করতাম।

-ডন্ট ইউ ডেয়ার। আজ রাগ করছি না কিন্তু এরপর সময় মতো খেয়ে নিবে প্লিজ। আমি জানি তুমি এখানে কমফোর্টেবল না, স্টিল প্লিজ ফর মি ট্রাই টু ম্যাক ইউরসেলফ কমফোর্টেবল।

জবাবে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক তাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,

-আমি নিচে যাচ্ছি। লাবিব এসেছে, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে। খুব খুদা লেগেছে জলদি খাবার দিতে বলো।

-আপনি যান আমি আসছি।

রওনক চলে যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি আমাকে জান বলে ডাকবে কবে?

রওনকের প্রশ্নে চিত্রলেখার বিষম উঠে যায়। তা দেখে হেসে ফেলে রওনক। চিত্রলেখার মুখটা দেখার মতো হয়েছে।

লাবিবের একেবারে পার্টিতে আসার কথা ছিল। কিছু কাজ রয়ে গেছে তাই রওনকের সঙ্গেই চলে এসেছে সে। বিয়ের দিন শেষবার দেখা হয়েছিল তাদের। তারপর আজ আবার মুখোমুখি। লাবিব বরাবরই চিত্রলেখার জন্য একজন ভালো বন্ধু। আর সবসময়ই এমন থাকবে। ফেশিয়াল আর ইত্যাদি করাতে নিয়ে তানিয়ারও আজ দুপুরের খাওয়া হয়নি। সেও রওনকদের সঙ্গেই বসেছে খেতে। তানিয়া, রওনক ও লাবিব একত্র হওয়ায় ওদের কথাবার্তা সব ব্যবসা রিলেটেডই। ওদের কথায় চিত্রলেখার কিছু বলার নেই। সে নিজের মতো খেতে আর ওদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে ব্যস্ত। তিনজন নিজেদের মতো ব্যবসায়িক আলোচনায় এতটাই ব্যস্ত যে কারো নিজের প্লেটের দিকে খেয়াল নেই। চিত্রলেখা তুলে দিচ্ছে আর তারা খাচ্ছে। কিন্তু আলোচনার একপর্যায় তানিয়া বলে,

-তবে রওনক, আমি ভাবছিলাম কি চলে যাবার আগে চিত্রলেখাকে আমার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যাবো।

তানিয়ার কথায় চিত্রলেখার বিষম উঠে যায়। অন্যরা যেটা লক্ষ করেনি সেটা হচ্ছে লাবিবের গলায় খাবার আটকে গেছে। তানিয়া চলে যাবে এর মানে কি! নিজের জায়গা থেকে প্রশ্নটা করতেও পারছে না লাবিব। চুপচাপ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পানি খেয়ে গলায় আটকে যাওয়া খাবার গিলে ফেলে সে। রওনক চিত্রলেখাকে পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে শান্ত হয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আপনার কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।

-শিখিয়ে দিলে অবশ্যই হবে।

চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-হবে না। ম্যাম মানে ভাবী তো ফাইনান্স দেখছেন আমি ফাইনান্সের কিচ্ছু বুঝি না। তাছাড়া আমি অফিস করলে মীম, মিশকাতকে কে দেখব?

কাউকে কিছু বলার সু্যোগ না দিয়ে তানিয়া বলে,

-মীম, মিশকাতকে দেখার লোক আছে বাসায়। প্রয়োজনে আরও লোক হায়ার করা হবে। তুমি ওদের লিগাল গার্ডিয়ান ন্যানি না যে ওদের দেখাশুনার জন্য ঘরে বসে থাকবে, নিজের ক্যারিয়ার বিষর্জন দিয়ে দিবে।

-কিন্তু…

-আগেও তো চাকরী করার পাশাপাশি ভাইবোনদের খেয়াল রেখেছো, রাখোনি?

সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। তানিয়া বলে,

-তাহলে এখন কেনো বসে থাকবে? আমি একদম এলাও করব না। তোমার নিজের পরিচয় ধরে রাখতেই হবে। রওনক জামানের বউ ঘরে বসে থাকবে অসম্ভব! কাল থেকে অফিস যাবে তুমি আমার সঙ্গে। আমি আমার কাজ তোমাকে বুঝিয়ে দিবো আস্তেধীরে।

চিত্রলেখা অসহায়ের মতো রওনকের দিকে তাকালে সে বলে,

-আপাতত ওকে কিছুদিন সময় দাও ভাবী। সবার নিজের স্পেশালিটি আছে। ও ফাইনান্স না দেখলে অন্যকিছু দেখবে যেটা ও ভাবো জানে। তার আগে এই নতুন পরিবেশের সঙ্গে ইউজ টু হোক তারপর থেকে না হয় অফিস জয়েন করবে। তাছাড়া আমারও কোনো প্লান নেই ওকে ঘরে বসিয়ে রাখার। শি ক্যান জয়েন হোয়েন এভার শি ওয়ান্টস টু। জামান গ্রুপ যতটুকু আমার ততটুকু ওরও।

কথা শেষ করে চোখের ইশারায় চিত্রলেখাকে আশ্বস্ত করে রওনক। তা দেখে স্মিত হাসে চিত্রলেখা কিন্তু তার বুঝা হয়ে গেছে এখন না হোক কিছুদিন পরে তবুও তাকে অফিস জয়েন করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এসব ভেবেই চিত্রলেখার মুখের রঙ বদলে যাচ্ছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ঘড়িতে রাত ৮ টা বাজছে প্রায়। যদিও ডিনার পার্টি, সাধারণত এই বাড়ির ডিনার পার্টিগুলো একটু রাত করেই হ্যাঁ। তাই ইনভাইটেড গেস্টরা সাধারণত রাত ৮ টার পর বা ৯ টা নাগাদ আসে কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। ৮ টা বাজছে প্রায় বাজেনি এখনো কিন্তু এর মধ্যেই অনেকে চলে এসেছে। এমন ঘটার পেছনের কারণটা বিশেষ এবং সহজেই অনুমেয়। শিল্পপতি, ব্যবসায়ি রওনক জামানের বউকে সরাসরি দেখার তীব্র আগ্রহ। রওনক যখন নিজের ভেরিফাইড ফেইসবুক একাউন্টে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস আপডেট করেছে তারপর থেকেই সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যদিও সেই পোস্টে রওনক চিত্রলেখাকে ট্যাগ করেছে কিন্তু চিত্রলেখার আইডিটা প্রাইভেট হওয়ায় কেউ তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেনি। তাই সকলের আগ্রহের যেনো কোনো কমতি নেই। রওনকের আগের বিয়ে, ডিভোর্স সম্পর্কে সবাই কম বেশি জানে শুধুমাত্র সরাসরি কথা বলে না এই যা।

আজকের পার্টিতে আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করা হয়নি যেহেতু প্রোগ্রাম বাসায় হচ্ছে। রওনকের একান্তই কাছের কিছু বন্ধু, কিছু বিজনেস পার্টনারস, কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার, আর একান্তই কাছের রিলেটিভ। কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে সাবার বাবাও একজন। যেহেতু তাদের পারিবারি সম্পর্ক গভীর তাই সাবাদের সপরিবারে ইনভাইট করা হয়েছে।

আজকের পার্টি উপলক্ষে একটা বার সেট করা হয়েছে। সব ধনের ড্রিংক্স রাখা আছে, সফট ড্রিংক্সও। সবাই তো আর এলকোহল নেয় না। বারটা পার্মানেন্ট নয় ট্রেম্প্ররারি সেট করা হয়েছে কেবল আজকের পার্টি উপলক্ষে। এদিক সেদিকের কথার পর ঝেড়ে কাশে সাদমান, রওনকের সবচাইতে কাছে বন্ধু সে। একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে, বড় হয়েছে। রওনকের ভালো দিনে যেমন পাশে থেকেছে তেমনি সবচাইতে খারাপ দিনগুলোতেও পাশে থেকেছে। যার জন্য এত আয়োজন তাকে দেখতে আর তর সইছে না যেনো কারো। তাই গল্প, আড্ডা ভেঙে সাদমান জিজ্ঞেস করে,

-তা মিসেস রওনক জামানকে দেখতে আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে?

রওনক নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে। ৮ টা বাজতে চলেছে। এতক্ষনে চিত্রলেখার তৈরি হয়ে যাবার কথা। সন্ধ্যার পর সে নিজেই চিত্রলেখা দেখেনি। তার পছন্দ করে কেনা ড্রেসে চিত্রলেখাকে কেমন লাগছে দেখার অপেক্ষায় রওনক নিজেও। হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাসটা বার কাউন্টারে নামিয়ে রেখে রওনক বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলে,

-আমি দেখে আসছি আর কতক্ষন লাগবে।

সবাইকে রেখে উপরের দিকে অগ্রসর হয় রওনক। তার চন্দ্রকে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লাগছে দেখতে। ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘরে প্রবেশ করে সে। কিন্তু রুমে নেই চিত্রলেখা। ভেতরে এগিয়ে গিয়ে চেঞ্জিং রুমের দরকার নবে হাত রেখে ঘোরালেই খুলে যায়। এখানেই তৈরি হচ্ছে তার চন্দ্র। পার্লার থেকে দু’জন মেয়ে এসেছে সাজিয়ে দিতে। একজন চিত্রলেখাকে সাজিয়ে দিচ্ছে আরেকজন তানিয়াকে। দরজাটা খুলে যেতেই চিত্রলেখার চোখ তার সামনে থাকা বড় আয়নাটায় স্থির হয়। রওনককে দেখে চিত্রলেখার নিঃশ্বাস আটকে গেছে। স্যুট পরা রওনককে সে বহুদিন, বহুবার দেখেছে কিন্তু আজ তাকে দেখতে ভিন্নরকম লাগছে। এই ভিন্নতার কারণ কি? কালো রঙের স্যুটটা রওনকের শরীরে এমন ভাবে ফিটিং হয়ে আছে যেনো এই স্যুটটা একমাত্র তার জন্যই তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে এই স্যুটে সুদর্শন লাগবে না যতটা রওনককে লাগছে। চেষ্টা করেও নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না চিত্রলেখা। সবসময় স্যুটের জন্য টাই পরতে দেখেছে সে রওনককে কিন্তু আজ বো-টাই পরেছে রওনক। ডান হাতে দামী একটা ঘড়ি। পায়ের শু টাই চকচক করছে। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে ব্যাকব্রাশ করেছে। একদিকে চিত্রলেখা অন্যদিকে রওনক। চিত্রলেখাকে দেখে তার গলায় কি যেনো একটা আটকে গেছে। অফ শোল্ডার হোয়াইট রঙের একটা গাউন কিনে এনেছিল রওনক আজকের পার্টিতে চিত্রলেখার পরার জন্য। গাউনটা চিত্রলেখার শরীরের সঙ্গে এমন ভাবে লেগে আছে যা দেখে নিজের চোখ ফেরাতে পারছে না রওনক। কোমড় সমান চুলগুলোকে ঘাড়ের উপর খোপা করা হয়েছে। সাইড থেকে কিছু চুল কার্ল করে দু’পাশে ছেড়ে রাখা হয়েছে। চিত্রলেখার কানে ডায়মন্ডের কানের দুল, হাতে ব্রেসলেট। গলাটা খালি যদিও খালি থাকবে না। রওনক নিজেই আজকের পার্টির জন্য একটা ডায়মন্ডের সেটটা কিনে এনেছিল। গলার সেটটা এখনো পরা বাকি। পার্লারের মেয়েটার হাতেই রয়েছে গলার ভারি ডায়মন্ডের সেটটা। বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে চিত্রলেখাকে দেখার পর হাত বাড়ায় রওনক সেটটা নেয়ার উদ্দেশ্যে। বলে,

-আপনি একটু বাহিরে অপেক্ষা করুন।

মেয়েটা একমুহূর্ত সময় অপচয় না করে ডায়মন্ডের সেটটা রওনকের হাতে দিয়ে চেঞ্জিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়েটা বেরিয়ে গেলেই রওনক এসে চিত্রলেখার ঠিক পেছনে দাঁড়ায়। আয়নায় তার দু’জনই একে-অপরকে দেখতে ব্যস্ত। তৎক্ষণাৎই রওনক সেটটা চিত্রলেখার গলায় পড়িয়ে দেয় না। সামান্য এগিয়ে গিয়ে পাশের ড্রেসিং কেবিনেটে সেটটা নামিয়ে রেখে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে সে। হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার কোমড় স্পর্শ করে। এতেই যেনো চিত্রলেখার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরে গেছে। শিহরনের দোলে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে চিত্রলেখা। আয়নায় সবই দেখছে রওনক। তার স্পর্শে চিত্রলেখার এই বশ হয়ে যাওয়াটা যেনো তাকে আরও বেশি পাগল করে দিচ্ছে। আরও গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছে তার চন্দ্রকে। এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কানের নিচে ঘাড়ে নাক রেখে নিঃশ্বাস টানে রওনক। দামী পারফিউম ও চিত্রলেখার শরীরের ঘ্রান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চিত্রলেখা চোখ মেলতে পারে না। সাহসই হয় না চোখ খুলে রওনকের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখার। চোখ মেললে যে রওনক তার চোখের আহ্বান টের পেয়ে যাবে। চোখ না মেললেও নিজের গায়ে লেপ্টে থাকা গাউন শক্ত করে ধরে রেখেছে চিত্রলেখা যা রওনকের দৃষ্টি এড়ায়নি। চিত্রলেখার কোমড় ছুঁয়ে থাকা রওনকের হাতের স্পর্শ আরও গাঢ় হয়। এবারে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে আলতো করে তার উন্মুক্ত কাঁধে চুমু খায় রওনক। ছোট্ট করে নয় বরং গাঢ় চুমু, গভীর চুমু। সময় নিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে সে। রওনকের ঠোঁটের স্পর্শে চিত্রলেখার ঠোঁট কাঁপতে আরম্ভ করেছে। রওনকের ইচ্ছা করছে এক্ষুনি সে ঐ ঠোঁটের দখল নেয় কিন্তু এসবের জন্য উপযুক্ত সময় এখন নয়। চিত্রলেখাকে দেখবে বলে শহরের নামিদামি ব্যাক্তিরা নিচে অপেক্ষা করছে সেই সঙ্গে প্রেসও এসেছে। আজ তারা দু’জনে প্রথমবারের মতো একত্রে প্রেসের সামনে দাঁড়াবে। ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউও হবে বলা যায়। আজকের তোলা ছবি আগামীকাল সকালের খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনের পাতায় ছাপানো হবে বড় হেডলাইনের সঙ্গে। রওনক জামান সবসময়ই বিজনেস নিজের হট টপিক। তার বিয়েটা কোনো অংশে কম কিছু নয়। নিজেরা প্রথমবার একত্রে সবার সামনে আসা তাই কোনো কমতি রাখেনি রওনক। তার ওয়াইফ হিসেবে যতটুকু সম্মান চিত্রলেখার প্রাপ্য তার চাইতে অধিক দিতে চায় রওনক তাকে। চিত্রলেখার জন্য নিজের সাধ্য ও সামর্থ্যে বাইরে গিয়ে করতে ইচ্ছা করে তার। সম্পূর্ন দুনিয়া এনে পায়ের কাছে বিছিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

রওনক চিত্রলেখার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে মৃদু স্পর্শ করে বলে,

– ইউ আর লুকিং বিউটিফুল।

এক্মুহূর্ত থেমে আরও বলে,

-চোখ খোলো চন্দ্র।

রওনক বলার পরেও চোখ মেলায় সাহস হয় না চিত্রলেখার। রওনক আরও বলে,

-প্লিজ বউ।

তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। রওনকের এই আবেদনের কাছেই বার বার হেরে যায় সে। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখেই তার উন্মুক্ত কাঁধে গভীর করে আবারও আরেকটা চুমু খায় রওনক। চিত্রলেখার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। অঙ্গে যেনো আ গু ন ধরে গেছে তার। কান লাল হয়ে গেছে, নাক লাল হয়ে গেছে। কোনো কিছুই রওনকের চোখ এড়ায়নি। আবার চিত্রলেখার কানে ঠোঁট স্পর্শ করে রওনক বলে,

-আই উইল ম্যাক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিজ। আজকের রাতটা সারাজীবন মনে থাকবে তোমার, আই প্রমিজ ইউ দ্যাট।

চিত্রলেখার কোমড় ছেড়ে দিয়ে গলার সেটটা হাতে নিয়ে পরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ম্যা আই?

চিত্রলেখা কোনো কথাই বলতে পারে না। নিজের সম্মতি জানাতে কেবল মাথা ঝাঁকায় সে। রওনকের উপস্থিতি, তার স্পর্শে শব্দ হারিয়ে ফেলেছে বেচারি। রওনক আর অপেক্ষা না করে চিত্রলেখার খালি গলায় ডায়মন্ড জড়ানো সেটটা পরিয়ে দিতেই তার মুখ গলে বেরিয়ে আসে,

-এবসিলিউটলি গরজিয়াস!

রওনকের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে আজ চিত্রলেখাকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে যদিও তার দৃষ্টিতে চিত্রলেখা সব বেশেই সুন্দর, মুগ্ধকর, চোখ জুড়ানো। চিত্রলেখার ঠোঁট এখনো কাঁপছে। সে হয়ত কিছু বলতে চায় কিন্তু পারছে না। তা আন্দাজ করতে পেরে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলতে চাও?

সম্মতিতে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। রওনক বলে,

-বলো আমি শুনছি।

ঢোক গিলে শুকনো গলা ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। তারা মুখোমুখি নয়। দু’জনের দৃষ্টিই আয়নায় একে-অপরের দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ। রওনক সময় দেয় চিত্রলেখাকে নিজেকে সামলে নিতে। সামান্য সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আফিফার ধারনা আপনি আমাকে ভালোবাসেন।

-আর তুমি কি ভাবো? তোমার কি ধারনা?

চিত্রলেখার মুখে কথা কুলায় না। সে ভাবতে চায় রওনক তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আদৌ কি সেটা সম্ভব? রওনক তো আগেই তাকে জানিয়েছে এই বিয়ের কারণ এরপরেও ভালোবাসা আশা করাটা কি বোকামি হয়ে যাবে না? বেশি বেশি হয়ে যাবে না? এই সম্পর্কে কি চিত্রলেখার রওনকের কাছে ভালোবাসা আশা করা উচিত? এতখানি দুঃসাহস করা কি উচিত হবে তার? চিত্রলেখার পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে রওনক নিজেই আরও বলে,

-আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কে কি ভাবছে তা দিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না চন্দ্র, ট্রাস্ট মি। আমার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট হচ্ছে তুমি কি ভাবছো। তোমার কি ধারনা আমাদের নিয়ে। তুমি যদি মনে করো আমি তোমাকে ভালোবাসি তাহলে বাসি আর যদি ভাবো বাসি না তাহলে…

বাকিটুকু আর বলে না রওনক। এক পা পিছনে সরে গিয়ে বলে,

-আই নো ইউ আর নার্ভাস, টেক ফাইভ মিনিট’স দ্যান কাম। আই ইউল বি ওয়েটিং ফর ইউ।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় রওনক চিত্রলেখাকে রেখেই। নিজেকে সামলে নিতে সময় দিয়ে যায়। রওনক বেরিয়ে যেতেই যেন চিত্রলেখার নার্ভাসনেস বেড়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে আপাদমস্তক দেখতে ব্যস্ত সে। ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে কিন্তু এর আগে কোনো এভাবে সাজেনি সে। এমন পোশাকও পরেনি। গাউনটা অফশোল্ডার হওয়ায় তার কাঁধ ও পিঠের অনেকটাই এক্সপোজ হয়ে আছে। এভাবে বাইরের মানুষের সামনে যেতে পারবে না সে। অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের কারণে এসির নিচে দাঁড়িয়েও ঘামতে শুরু করেছে চিত্রলেখা। রওনককে দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে। এখন আবার একরাশ অস্বস্তি জেঁকে ধরেছে তাকে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে