মাতাল হাওয়া পর্ব-৫৬+৫৭

0
566

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আচমকাই চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। কিছু টের পাবার আগেই চিত্রলেখা অনুভব করে রওনক পেছন থেকে নিজের আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে। শাওয়ার দেয়ার ফলে রওনকের শরীর জুরে হিমশীতলতা বিরাজ করছে। রওনকের দেহের উষ্ণতা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে চিত্রলেখা। যার ফলে চিত্রলেখার অঙ্গের ভেতর অদৃশ্য এক কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে যা জানান দিচ্ছে আজ আর চিত্রলেখার রক্ষে নেই। একটা কঠিন সর্বনাশ বুঝি ঘটেই যাবে। এসব ভাবতেই চিত্রলেখার হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করেছে। হাটুর কাপাকাপি মুহূর্তেই চিত্রলেখার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। রওনকের ভাবনা মস্তিষ্ক থেকে কিছুক্ষণের জন্য জেড়ে ফেলতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল সে কিন্তু এতে লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি। রওনকের ভাবনা তো দূরের কথা স্বয়ং রওনককেই সে নিজের থেকে বেশিক্ষণের জন্য দূরে রাখতে সক্ষম হয়নি।

রওনক আলতো ভঙ্গিতে চিত্রলেখার উন্মক্ত কাঁধে, ঘাড়ে, কানের পেছনে ছোট্ট ছোট্ট টানে নাক ঘষে দেয়। চিত্রলেখা টের পায় তার ভেতর অজানা এক ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘূর্ণিঝড় আজ হয়ত তাকে দূর অজানায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঝুল বারান্দার কোমড় সমান গ্রীল দেয়া আছে। নিজেকে সামলে নিতে চিত্রলেখা সেই গ্রীল আঁকড়ে ধরে শক্ত হাতে। কিন্তু কাজ হয় না বিশেষ। রওনকের এই ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শ তাকে পাগল করে দিচ্ছে। চিত্রলেখা অনুভব করতে শুরু করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিশেষত্ব। এই যে অধিকার সমেত পবিত্রতার সহিত ছুঁয়ে দেয়া অন্য কোনো সম্পর্কে নেই। অন্য আর সব কয়টা সম্পর্কে হাজারটা নিষিদ্ধতার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর একে-অপরকে এই ছুঁয়ে দেয়ার মধ্যে পবিত্রতা নিহিত।

রওনকের পাগল করা স্পর্শের মাঝে হারিয়ে যেতে নিয়েও নিজেকে টেনে ধরে চিত্রলেখা। সামান্য টেনেই বলে, আ…আমি শাওয়ার দিয়ে কাপড় বদলে আসি।

চিত্রলেখার কানের পেছনে নাক ডুবিয়ে রেখেই রওনক বলে, আরও কিছুক্ষণ এভাবেই থাকো প্লিজ। আমি আরেকটু তোমাকে ফিল করতে চাই, প্লিজ। প্লিজ চন্দ্র।

রওনকের এমন আকুল আবেদনের কাছে হেরে যেতে বাধ্য হয় চিত্রলেখা। এমনিতেও মনে হচ্ছে না এমন স্পর্শ পাবার পর কদম চালিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে সে। তাই রওনকের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দেয় চিত্রলেখা। যা হয় হোক, আর কোনো আপত্তি নেই তার। এর বেশি সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবেও না। অন্যরকম এক আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে চিত্রলেখা। হাতের মুঠো আরও শক্ত হয়ে গেছে তার।

বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখার কানের পেছনে নাক ঘষার পর ছোট্ট করে একটা চুমু বসিয়ে চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল মিলায় রওনক। কিন্তু নিজের হাতের বাঁধন আলগা করে না। যেভাবে জড়িয়ে ধরেছিল সেভাবেই জড়িয়ে রাখে নিজের সঙ্গে। তবে এতক্ষণ রওনকের হাত চিত্রলেখার পেটের কাছে শাড়ির উপরে থাকলেও এখন একটা হাত শাড়ির নিচ দিয়ে চালান করে দিয়েছে। আলতো করে চিত্রলেখার নরম পেটে হাত রাখে সে। তবে হাত নাড়াচাড়া করে না। দেখতে না পেলেও রওনক ঠিকই অনুভব করতে পারছে তার চন্দ্র, তার স্পর্শের আবেশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল মিলিয়ে রেখেই রওনক তার স্বাভাবিক সুরে কথা বলে।

-দেখো আজকের চাঁদটা কত সুন্দর।

রওনকের কথায় চিত্রলেখার হদিস হয়। আবেশে বন্ধ হয়ে থাকা চোখের পাতা মৃদু ভাবে খুলে আসমানের দিকে তাকায়। অন্ধকার আকাছে বুক জুড়ে থাকা চাঁদটা আসলেই সুন্দর। চাঁদ তো সবসময়ই সুন্দর কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে চাঁদটাকে বেশি সুন্দর লাগছে, দেখতে। কিন্তু কেনো? রওনক দেখিয়ে দিলো বলে? তার বলায় কি চিত্রলেখার চোখে চাঁদের সৌন্দর্‍্য্য বেড়ে গেল। অবাক লাগে চিত্রলেখার। স্মিত কন্ঠে চিত্রলেখা সম্মতি প্রকাশ করে বলে,

-হুম্‌ সুন্দর।

-সুন্দর তবে…

-তবে কী?

চিত্রলেখার কন্ঠে স্পষ্ট কৌতুহল। তা টের পেয়ে রওনক জবাব দিতে বিলম্ব করে না।

-আমার চন্দ্রের চাইতে বেশি না। আমার চন্দ্রের কাছে এই চান্দের সৌন্দর্য্যও ম্লান।

লজ্জায় আপনাআপনিই চিত্রলেখার গাল লাল হলো, সঙ্গে খানিকটা গরমও হলো। চিত্রলেখা টের পায় রওনকের তাকে দেয়া কমপ্লিমেন্টের কারণেই তার গাল লাল হয়েছে। লজ্জায় কলিজা কাঁপছে বেচারীর। এমনও হয় নাকি? গল্প, উপন্যাসে পড়েছে পুরুষ চরিত্র, নারী চরিত্রের কাছাকাচি এলে তার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরে আজ যেনো সত্যি সত্যি চিত্রলেখার সঙ্গে তাই হচ্ছে। রওনকের স্পর্শে তার অঙ্গে অঙ্গে শুধু কাঁপন নয় আ গু ন ধরে গেছে। নিজ অঙ্গের এই আ গু ন কি দিয়ে নিভাবে চিত্রলেখা!

রওনক চিত্রলেখার গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে রাখে বেশ অনেকক্ষণ। চিত্রলেখা বুঝতে পারে আজকের মতো হয়ত সে বেঁচে গেছে রওনকের পুরুষালি থাবার হাত থেকে। একটুর জন্য নিজের সবটুকু রওনকের ধৈর্য্যের কাছে সমর্পণ করতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল চিত্রলেখা কিন্তু আচমকাই রওনক থেমে যাওয়ায় তাকে এখনই নিজের সবটা উজার করে দিতে হচ্ছে না। কিন্তু হৃদয় গহীনে কোথাও গিয়ে চিত্রলেখা জানে খুব বেশিদিন সে নিজেকে রওনকের এসব পুরুষালি স্পর্শের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আজ নয়ত কাল নিজেকে উজার করে দিবে সে। সেই সময় সন্নিকটে ভেবে বুকের কাঁপন বাড়ে চিত্রলেখার।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নীরবতা ভেঙ্গে রওনক জিজ্ঞেস বলে,

-তোমাকে এই শাড়িটাতে চমৎকার লাগছে চন্দ্র।

রওনকের মুখ গলে বেরিয়ে আসা প্রতিটা কমপ্লিমেন্ট চিত্রলেখার বুকের ভেতর গভীর করে দাগ কাটে, ভালো লাগার দাগ। এই জীবনে চিত্রলেখাকে কমপ্লিমেন্ট দেবার মতো তার কোনো ব্যাক্তিগত মানুষ কখনই ছিল না যদিও মামুনের কাছে চিত্রলেখা বিশেষের চাইতেও বিশেষ ছিল সবসময় হয়ত এখনো আছে কিন্তু চিত্রলেখা কখনো নিজের সীমানার বাইরে গিয়ে মামুনকে নিয়ে ভাবেনি। ভালোই হয়েছে ভাবেনি। মামুনকে নিজের জীবনে বিশেষ জায়গা দেয়ার পর চিত্রলেখাকে যদি রওনকের বউ হয়েই আসতে হতো তখন এই জীবনটা বিষের চাইতেও বেশি তেতো হয়ে যেতো এর চাইতে ভালোই হয়েছে চিত্রলেখা কখনো মামুনকে প্রশ্রয় দেয়নি, তাকে কখনো মিথ্যা আশা দেয়নি। নাহলে রওনকের কাছ থেকে এই মুহূর্তে পাওয়া প্রতিটা স্পর্শ চিত্রলেখাকে ভেতরে ভেতরে মে রে ফেলতো। যদিও এখনো সংশয় বিন্দুমাত্র কম নেই চিত্রলেখার ভেতর। সবসময় শুনেছে দেহের মিলনের চাইতে হৃদয়ের মিলন বেশি জরুরী সম্পর্কে। কিন্তু রওনকের সঙ্গে চিত্রলেখার এই সম্পর্কের কোথাও ভালোবাসার ছিটেফোঁটা নেই। সে রওনককে তাকে ভালো না বাসার জন্য দোষ দেয় না অবশ্য। সে তো নিজেই রওনককে ভালোবাসে না। ভালোবাসা, চারটা বর্ণ, চারটা কার চিহ্নের সম্বনয় তৈরি একটা ছোট শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা! পৃথিবীর সবচাইতে গভীর সমুদ্র প্রশান্ত মহাসাগরকেও হার মানায় যেনো। আসলে ভালোবাসার গভীরতা কি কখনো পরিমাপ করা সম্ভব? চিত্রলেখার মন তাকে জবাব দেয়, না সম্ভব নয়। অথচ রওনকের সঙ্গে তার সম্পর্কে ভালোবাসা নামক এই গভীরতাটাই নেই। অন্যদিকে রওনকের পুরুষালি স্পর্শের আবেশে হারিয়ে যাওয়া থেকেও নিজেকে আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার। এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা কি জানা নেই চিত্রলেখার। তবে সে জানে সে অনৈতিক কিছু করছে না, আর না নিজেকে কোনো অবৈধ কিছুর সঙ্গে জড়িয়েছে। যে কারণে আর যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেনো রওনকের সঙ্গে চিত্রলেখার সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃত, ধর্ম মতে সঠিক। তাই এই কাছে আসায় কোনো ভুল দেখতে পায় না চিত্রলেখা। যদিও বিনে ভালোবাসায় এতখানি এগিয়ে যেতে মনের ভেতর অজানা খচখচানির উপস্থিতি টের পায় তবু চিত্রলেখা অনুভব করতে পারে নিজের উপর থেকে ধীরে ধীরে কন্ট্রোল হারাচ্ছে সে। খুব বেশি সময় আর সে নিজেকে রওনকের পুরুষালি স্পর্শের হাত থেকে আড়াল করে রাখতে পারবে না। এক্ষুণি যদি রওনক ইন্ধন দেয় চিত্রলেখা হয়ত বিনাবাক্যব্যয়ে তার ইন্ধনে সাড়া দিবে। দু’জনে মিলে একাকার হয়ে যাবে আকাশের ঐ চাঁদকে সাক্ষী রেখে। পৃথিবীর কেউ জানবে না এক বিছানায় দু’জনের গাঢ় নিঃশ্বাস একে-অপরে বিলীন হয়ে যাবে।

-কিন্তু আমার যতটুকু মনে পড়ে এই শাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনি। তুমি কি শপিং করতে গিয়েছিলে?

রওনকের কথার শব্দেই নিজের চিন্তার জগৎ থেকে দপ করে বাস্তবতায় আছড়ে পড়ে চিত্রলেখা। এতক্ষণ নিজের অজান্তে কি সব ভাবছিল সে ভেবে মনে মনে লজ্জায় লাল হয় সে। বউকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক চিত্রলেখার কানের পাতায় ছোট্ট করে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে,

-বললে না?

আচমকা রওনকের ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। টেনে বলে,

-ক…কী?

-খুব বেশি আমার ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছো বুঝি? আমি কি খুব জ্বালাচ্ছি তোমাকে?

লজ্জায় চিত্রলেখার মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায় না। রওনকের এমন কথার কি জবাব দিবে সে? বললে তো সত্যিটা স্বীকার করা হয়ে যাবে এরপর তো লজ্জায় মানুষটার সামনে দাঁড়াতে পারবে না আর। রওনক বুঝতে পেরে এই বিষয়ে আপাতত আর লজ্জা দেয় না চিত্রলেখাকে। আগের প্রশ্নটা আবার করে সে,

– এই শাড়িটা আমি তোমার জন্য কিনি। তুমি কি শপিং করতে গিয়েছিলে?

-না না, এটা আফিফার। আমি তো থ্রিপিস পড়েই ওর বাসায় গিয়েছিলাম। আমাকে থ্রিপিসে দেখে জোর করে নিজের শাড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল…

বাকি কথা বলতে পারে না চিত্রলেখা, থেমে যায়। রওনক তার কথার সুর টেনে বলে,

-কী বলল?

একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা বলে, নতুন বউদের নাকি সবসময় শাড়ি পড়ে সেজেগুজে থাকতে হয়।

-কেন? কার জন্য?

রওনক ইচ্ছা করে প্রশ্নটা করেছে। চিত্রলেখার পেটের উপর থাকা রওনকের স্থির হাতটা সামান্য নড়াচড়া করে। এই সামান্য স্পর্শেই চিত্রলেখা থরথর করে কাঁপতে লাগে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-বরের জন্য।

-আচ্ছা, তা তুমি কার জন্য শাড়ি পড়েছো?

চিত্রলেখা জবাব না দিলে রওনকের স্পর্শ গভীর হয়।

-বলো কার জন্য শাড়ি পরে নিজেকে সাজিয়েছো?

-আপনার জন্য।

আচমকাই চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় রওনক। চিত্রলেখার লম্বা চুলের খোপা হাতের টানে খুলে দেয় যার ফলাফল কিছু চুল উড়ে এসে চিত্রলেখার কপাল দখল করতে চাইলে তাদের নিজের আঙ্গুলের টানে কানের পেছনে গুঁজে দেয় রওনক। তারপর হাত বাড়িয়ে চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরতেই তাদের শুভ দৃষ্টি হয় যেনো। চিত্রলেখার ঐ গভীর চোখের চাহনী থেকে কিছুতেই নয়ন সরাতে পারে না রওনক। অবশ্য সে চায়ও না নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। চিত্রলেখাকে দেখার জন্য সর্বক্ষণ উতলা হয়ে থাকে তার ঐ নয়ন। বউয়ের চিবুক স্পর্শ করে চোখে চোখ রেখেই রওনক বলে,

-এই সাধারণ একটা সুতির শাড়িতে তোমাকে দেখতে ঠিক কতখানি সুন্দর লাগছে তা ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই চন্দ্র কেবল এতটুকু বলতে পারি…

সামান্য থেমে চিত্রলেখার কানের কাছে মুখ নিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমি ম রে যাচ্ছি তোমাকে নিজের করে একটু ছুঁয়ে দেয়ার লোভে। আমার পুরুষত্ব পু ড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে তোমাকে পাবার আশায়। এই কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। আমি চাই তোমাকে, নিজের সবটুকু জুড়ে।

চিত্রেলেখার কি হলো কে জানে। আচমকাই নিজের কম্পিত দেহটা সে রওনকের উপর ছেড়ে দেয়। বুঝতে পেরে রওনক ওখানেই থেমে যায়। হয়ত আচমকাই বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করে কিন্তু তার চেষ্টা বিফলে যায়। রওনক অনুভব করে তার চন্দ্রলেখা হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছে। আনন্দে রওনকের পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়তে আরম্ভ করেছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে চন্দ্র, আমার কোনো তাড়া নেই। ইউ ক্যান ট্যাক টাইম। আমরা আস্তেধীরে আগাবো না হয়।

রওনকের কথা শুনে আরও বেশি লজ্জা করছে চিত্রলেখার। মাথা তুলে তাকাতেই পারবে না যেনো আর। চিত্রলেখার হাতের বাঁধন আলগা হলে রওনক ছোট্ট করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,

-আমরা কি আজ কথা বলেই পেট ভরে ফেলবো? বিকেলের পর কিচ্ছু খাওয়া হয়নি আমার। খিদে পেটের ভেতর যুদ্ধ চলছে বউ।

রওনকের কথা শুনে চিত্রলেখা চোখ বড় করে তাকায়। চিত্রলেখার মুখের আচমকা পরিবর্তন দেখে হাসি পায় রওনকের। চিত্রলেখা বলে,

-আমি এক্ষুনি খাবার দিচ্ছি।

চিত্রলেখাকে ব্যস্ত হতে দেখে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি বলছি আমাদের ডিনার লাগাতে। খাবার সার্ভ করতে করতে তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো কেমন?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। আর অপেক্ষা না করে দ্রুত বাথরুমের দিকে আগায় সে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আবজাব ভেবেছে অথচ মানুষটা না খেয়ে আছে সেদিকে খেয়ালই নেই তার। মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করে চিত্রলেখা নিজের এমন দায়িত্বহীন কাজের জন্য। এমন বেখায়ালি তো সে কখনোই ছিল না তাহলে আজ কি হয়েছে তার? এই সব কি রওনকের প্রভাব? রওনককে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছে না যেনো চিত্রলেখা।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রাতের ঐ ঘটনার পর রওনকের সামনে দাঁড়াতেও লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইছে চিত্রলেখার। জীবনে এর আগে কখনো সে এত লজ্জার সম্মুখীন হয়নি। এই ধরনের লজ্জার মুখে যে একদিন তাকেও পরতে হবে তা চিত্রলেখা তার অবচেতনেও ভাবেনি কখনো। মানুষের জীবন আসলেই তার চিন্তা ভাবনার উর্ধে। যা কখনো চিত্রলেখা নিজের জন্য চিন্তা করেনি, চায়নি আজ না চাইতেই সব পাচ্ছে। আবার আচমকা এত কিছু পেয়ে ভয়ও লাগছে বুকের ভেতর কোথায় একটা এই ভেবে এত সুখ তার কপালে সইবে তো শেষপর্যন্ত? নাকি অজানা কোনো তুফান এসে তার জীবনের এত সুখ সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! এসব ভাবলেই অস্থিরতায় চিত্রলেখার বুকের ভেতরটা একটা অজানা ভয়, শঙ্কায় কেমন কেঁপে ওঠে। তবু চিত্রলেখা নিজেকে সামলে নেয়। এমনিতেও তার জীবনটা এই পর্যন্ত মসৃণ ছিল না তাই ভবিষ্যৎ টাও যে অনেক বেশি মসৃণ হবে তা সে খুব একটা আশা করে না। হলে ভালো নাহলেও সে ভয় পাবে না, শক্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তার তো কেবল নিজের কথা ভাবলে চলবে না।

আজ রাতে বাসায় পার্টির আয়োজন করেছে রওনক, নিজের বিয়ে উপলক্ষে। কাছের একান্তই পরিচিত ও আপন জনদের সঙ্গে চিত্রলেখার পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। একটু আগেই জাহানারা এসে জানিয়ে গেছে টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়ে গেছে সবাই ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। রওনক তৈরি হয়ে টাই হাতে বেরিয়ে আসে। চিত্রলেখার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে টাই টা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-আজও কি আমায় বলে দিতে হবে কীভাবে টাই বাঁধতে হয়?

কেবল মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা, মুখে কিছু বলে না। রওনকের টাই বাঁধতে ব্যস্ত চিত্রলেখা মুখ তুলে না তাকালেও বেশ অনুভব করতে পারছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দৃষ্টি তার দিকে স্থির হয়ে আছে। তাকাবে না তাকাবে না করেও একবার চোখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। তৎক্ষণাৎই আবার চোখ সরিয়ে নেয় সে। তা দেখে রওনকের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। চিত্রলেখার টাই বাঁধা হয়ে গেলে সে পেছন দিকে সরে যেতে চেষ্টা করলে আচমকাই হাত বাড়িয়ে রওনক চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের বাহুবদ্ধ করে নেয়। রওনকের আচমকা কান্ডে অবাক না হয়ে পারে না চিত্রলেখা। আচমকা স্পর্শে চিত্রলেখার শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়। নিজেকে কাহিল লাগে চিত্রলেখার। ইচ্ছা করে নিজ দেহের সবটুকু রওনকের উপরে ছেড়ে দিতে। কিন্তু অজানা লজ্জা, শঙ্কায় ইচ্ছা করলেও এমনকাজ করতে পারে না সে। নিজেকে সামলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়েই রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে কেবল। রওনকও কিচ্ছুক্ষণ সময় নেয়। যা বলতে চায় তা বলার আগে খানিকটা সময় চোখের পিপাস মিটায়। রওনকের ঐ গভীর চোখের চাহনিতে প্রথমে হারিয়ে গিয়েছিল চিত্রলেখা তারপর আচমকাই হদিশ ফিরে পেয়ে রওনকের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে রওনক বলে,

-একটু চোখ ভরে তোমায় দেখতে দাও প্লিজ। এভাবেই থাকো কিছক্ষণ আমার কাছে।

ইশ! রওনকের এই প্রতিটা আবদারের শেষে প্লিজ বলাটা চিত্রলেখার গায়ে কাটা দেয়। ভাইবোনেরা কখনোই কোনোকিছুর জন্য সেভাবে আবদার করেনি তার কাছে কিন্তু এই মানুষটা জীবনে আসার পর থেকে আবদারের বহার বসিয়ে দিয়েছে। তার সব আবদার যেনো এই এক চিত্রলেখার কাছেই। তারউপর তার বলার ধরণ। অমন করে বললে কেউ না করতে পারে কখনো? আর কেউ পারলেও চিত্রলেখা কখনো পারবে না। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার আর চেষ্টা করে না, চুপ করে নিজেকে রওনকের বাহুবন্ধনেই ছেড়ে দেয়। বেশ কিচ্ছুক্ষণ এক মনে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওভাবে থেকেই রওনক বলে,

-আজ বাসায় পার্টি আছে।

সতর্ক হয় চিত্রলেখা। জানতে চায়,

-কিসের পার্টি?

-তোমার ওয়েলকাম পার্টি।

-আমার জন্য!

চিত্রলেখা যে অবাক হয়েছে তা তার চোখ মুখে স্পষ্ট। অবাক না হয়ে কি পারা যায়? তাকে ওয়েলকাম করার জন্য পার্টি দেয়া হচ্ছে এসবও এই জীবনে পাওনা ছিল চিত্রলেখার? স্মিত হেসে রওনক বলে,

-রওনক জামান বিয়ে করেছে এই খবর দেশবাসী জানবে না তা কি হয়?

চিত্রলেখার অবাক হওয়া যেনো বাড়লো। রওনক একটা হাত সামনে এনে চিত্রলেখার কপালের উপরে এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দেয়। তার হাতটা এসে চিত্রলেখা গাল স্পর্শ করলে পরে রওনক বলে,

-তুমি এখনো বুঝতে পারছো না কার বউ হয়ে এসেছো।

চিত্রলেখা জানে সে কার জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে কিন্তু এখনো এটা বুঝে উঠতে পারেনি রওনকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পরমুহূর্ত থেকে চিত্রলেখার জীবনটা ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেছে। এখন আর সে সাধারণ চিত্রলেখা নেই। কবুল বলে রওনকের বউ হবার পর থেকে তার জীবনটা রওনকের সাথে অতপ্রত ভাবে জড়িয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখন সে মিসেস চিত্রলেখা রওনক জামান, যে রওনক জামানের ছবি, নিউজ প্রায় প্রতিদিনই নিউজপেপারের বিজনেস পাতায় পাওয়া যায়। এখন থেকে রওনকের পাশাপাশি চিত্রলেখার ছবিও যদি খবরের কাগজে ছাপা হয় সেটা খুব বেশি অবাক হবার মতো কোনো ঘটনা হবে না। কিন্তু এই বিষয়গুলো চিত্রলেখা এখনো ভেবেই দেখেনি। এসব তার ভাবনাতে আসেইনি। নিজের চিন্তা ভাবনার উর্ধে গিয়ে জীবন যাপন হচ্ছে তার।

রওনক বলে, আজকের পার্টিতে পরার জন্য তোমার ড্রেস, অর্নামেন্টস সব আলমিরাতে রাখা আছে। বিকালে বিউটিশিয়ানরা চলে আসবে তোমাকে সাজাতে। তুমি তৈরি হয়ে নিও। আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি, কাজ সেরে সোজা বসায় চলে আসবো পার্টির আগেই।

চিত্রলেখা কিছু বলে না। রওনকের বলা প্রত্যেকটা কথা মেনে নেয় বিনাবাক্যব্যয়ে। এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-সবাই আমাদের জন্য নাস্তা টেবিলে অপেক্ষা করছে।

-চলো যাই।

বেরিয়ে যাবার আগে রওনক আরও বলে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

-কি কথা?

-আমরা দু’জন কি নিচের দিকে কোনো ফ্ল্যাটে শিফট হয়ে যাবো?

চিত্রলেখা আবারও অবাক হয় কিন্তু এবারে আর মুখ বন্ধ করে রাখে না। জিজ্ঞেস করে,

-কেনো? এখানে থাকলে কি সমস্যা?

এক মুহূর্তের জন্য চিত্রলেখা ভাবে রওনক হয়ত তাকে তার পরিবারের সঙ্গে রাখতে চায় না। কিন্তু চিত্রলেখার মনের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি তো লিফটে উঠতে ভয় পাও। বাইরে গেলে বারবার সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতে কষ্ট হবে। আমি চাই না তোমার কোনো কিছু নিয়ে কষ্ট হোক। আমরা সেকেন্ড ওর থার্ড ফ্লোরে শিফট হয়ে যেতে পারি। এতে করে তোমাকেও কষ্ট করে এতগুলো সিড়ি বেয়ে নাইন্থ ফ্লোরে উঠে হবে না।

-শুধু আপনি আর আমি?

-হু, শুধু আমরা দু’জনে। বাকিরা এখানেই থাকলো। দূরে তো কোথাও যাচ্ছি না। একই বিল্ডিংএ থাকবো জাস্ট ফ্লোর আলাদা।

-তারপর আপনার মা ভাববে আমি আপনাকে বশ করে ফেলেছি। আমার ইশারায় চলেন আপনি। আজ ঘর আলাদা করেছি, কাল বাড়ি আলাদা করব, এরপর হয়ত দেশও আলাদা করে ফেলবো। আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। বা দেখা গেল আপনার সম্পত্তি বাগিয়ে নিলাম।

-কি যাতা বলছো এসব!

-আপনার কাছে যাতা লাগলেও বাকিরা এমনটাই ভাববে। একবার ভেবে দেখুন তো অন্যদের দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে আমি, আপনার অফিসে চাকরী করেছি। সবাই কি ভাববে জানেন? চাকরী বাহানা ছিল। চাকরী করতে গিয়ে বড়লোক বসকে ফাঁসিয়েছি আমি। ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি তার টাকা-পয়সার লোভে। কেউ বিশ্বাসই করবে না স্বয়ং রওনক জামান আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কেউ কেউ হয়ত ভাববে আপনার টাকার লোভে বিয়ের আগেই এক বিছানার আপনার সঙ্গে…

রওনক তৎক্ষণাৎ চিত্রলেখার মুখে হাত রাখে। এসব শুনতে চায় না সে। রওনক জানে চিত্রলেখা কি বুঝাতে চাইছে, বলতে চাইছে। সে নিজেও জানে তার পরিবার, আত্মীয় মহল তাদের এই বিয়েটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিবে না কিন্তু এতে রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। তবে সে ভুলেও ভাবেনি চিত্রলেখা তার মস্তিষ্কের ভেতর এসব ভাবনা পালছে। চিত্রলেখার মুখ চেপে ধরে রওনক চেঁচিয়ে ওঠে,

-জাস্ট শাটআপ চন্দ্র।

নিজের মুখ থেকে রওনকের হাত সরিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমি না হয় চুপ করে গেলাম কিন্তু অন্যদের তো আপনি আটকাতে পারবেন না। বাকিরা ঠিকই এমনটাই ভাববে। এর চাইতে জঘন্য কিছু ভাববে।

রওনক শক্ত হাতে চিত্রলেখার বাহু ধরে তার চোখে চোখ রেখে বলে,

-কে কি ভাবছে বা ভাববে তাতে আমি রওনক জামানের কিচ্ছু যায় আসে না। আই ডন্ট গিভ এ ফা ক টু দেয়ার থিংকিং, অল আই কেয়ার জাস্ট হোয়াট ইউ থিংক আবাউট আজ বিইং টুগেদার।

ডান হাতটা চিত্রলেখার গালে রেখে রওনক আরও বলে, প্লিজ তুমি অন্তত এভাবে ভেবো না আই রিকুয়েষ্ট টু ইউ। তুমি না চাইলে আমরা কোথাও যাবো না, এখানেই থাকবো। আই প্রমিজ বাট স্টপ থিংকিং লাইক দ্যাট।

চিত্রলেখা এই প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না। বরং নিজের কন্ঠের স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বলে,

-চলুন, সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

নাস্তার টেবিলে দিলারা জামান চিত্রলেখাকে দেখে আগের দিনের মতোই কোনো কথা বলেননি। রাগে উনার শরীর রি রি করছেন কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ হতে দেননি। উনি ভেবেছিলেন পথে কাটা সহজেই উপড়ে ফেলেছেন কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। উনার প্লান ব্যাক ফায়ার করেছে দেখে রাগ হয়েছেন। টেবিলে বসেই রওনক আগে চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয়। তা দেখে সভাবশুলভই চিত্রলেখার মুখ ফোঁসকে বেরিয়ে আসে,

-খালি পেটে আগেই চা খাচ্ছেন কেনো? এসিডিটি হয়ে যাবে তো। আগে নাস্তা করুন, পরে চা খাবেন।

কথা শেষ করতেই চিত্রলেখা লক্ষ করে রওনক অদ্ভুত এক হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে চোখের ইশারায় চিত্রলেখা জানতে চায় কি? রওনক কিছু বলে না। হেসে কেবল চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। ততক্ষণে চিত্রলেখা খেয়াল করে অন্যরা সবাই এখানেই উপস্থিত আছে। টের পেয়েই লজ্জা পেয়ে যায় সে। তানিয়া টিটকারির সুরে বলে,

-দেখলে জাহানারা খাল এতদিনে রওনক জামানকে শাসন করবার মানুষ চলে এসেছে।

তানিয়ার টিটকারি শুনে মুখ চেপে হাসেন জাহানারা। তবে এটাও লক্ষ করেন দিলারা জামান মোটেও এসব পছন্দ করছেন না। আপাতত আর কাউকে তোয়াজ করবে না তানিয়া। তার জীবনের লম্বা একটা সময় নষ্ট হয়েছে। তাই এই মুহূর্তে শাশুড়ির পছন্দ অপছন্দকে আমলে নেয় না সে।

আজকের নাস্তায় রুটি সবজি ডিম পোচ, মালেট, সেদ্ধ হয়েছে। সাধারণত ঘি দিয়ে ভাজা মচমুচে পরোটা বানানো হয়। আজ ঘি ছাড়া রুটি দেখে দিলারা জামান জিজ্ঞেস করেন,

-কিরে জাহানারা পরোটা করিসনি কেনো?

আজ রুটি করার আইডিয়াটা চিত্রলেখার ছিল। সেই জাহানারকে বলেছিল সবার জন্য রুটি করতে শুধু মিম, মিশকাতের জন্য ঘি দিয়ে পরোটা হবে। চিত্রলেখার নাম শুনলে খুশি হবেন না তা বুঝতে কিছু বাকি নেই কারো। তাই জাহানারা চিত্রলেখার নাম না নিয়ে বলেন,

-ঐ ভাবলাম সবসময় তো পরোটাই খাওয়া হয় তাই আজ…

জাহানারাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-মা, আমিই ফুপিকে বলেছি আজ সবার জন্য রুটি করতে। পরোটাও হয়েছে তবে মিম, মিশকাতের জন্য। বাকি আপনাদের সবার জন্য রুটি করিয়েছি।

চিত্রলেখার দিকে তাকানোও না তিনি। জাহানারার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

-কিরে জাহানারা আমি কি মরে গেছি নাকি যে আমার বাড়ির নাস্তায় কি বানানো হবে সেই সিদ্ধান্ত বাইরের মানুষ নিচ্ছে। নাকি তোরা ভাবছিস আমি সংসারের হাল ছেড়ে দিয়েছি?

দিলারা জামানের সূক্ষ্ম খোঁচাটা ঠিকই টের পায় চিত্রলেখা। রওনক যেনো কিছু না বলে সেজন্য আগেই তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। জাহানারাকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে চিত্রলেখা নিজেই শাশুড়িকে জবাব দিয়ে বলে,

-সরি মা, আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করে নেয়া উচিত ছিল। আপনারা সবাই ব্যস্ত কারো নিজের ডায়েটের দিকে খেয়াল নেই। আপনার ডায়াবেটিক্স আছে সেই সঙ্গে হাই প্রেসার, ভাবী এমনিও ডায়েটে থাকেন, আর উনি তো সবসময় চা বেশি খায় এতে এসিডিটির সমস্যা হতে পারে। তাই সবার দিক বিবেচনা করে ভাবলাম প্রতিদিন প্রতিদিন ঘি দিয়ে ভাঁজা পরোটা খেলে সবারই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। মিম, মিশকাত ছোট ওদের এক্সট্রা এনার্জি দরকার তাই ওদের জন্য ঘি দিয়ে পরোটা হবে। অতিরিক্ত জ্যাম পারুটি খেলে ওদের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে। তাই সবার ডায়েটের দিকে খেয়াল রেখেই নাস্তার ম্যেনুতে পরিবর্তন এনেছি।

দিলারা জামানের রাগ বেড়েই চলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

-তুমি কি ডায়েটিশিয়ান হয়েছো নাকি?

-ডায়েটিশিয়ানের ডিগ্রি নেই তবে কার জন্য কোনটা ভালো সেটুকু জানি।

-আমার ভালো আমি জানি, বাইরের কাউকে আমার ভালো মন্দ ভাবতে হবে না।

এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রওনকের পক্ষে আর চুপ করে শুনা সম্ভব নয়। এবার আর চিত্রলেখাকে সুযোগ না দিয়ে রওনক বলে,

-ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন তুমি যাকে অলরেডি দু’বার বাইরের লোক বলেছো সে আসলে কিন্তু বাইরের লোক নয়। আমার ওয়াইফ, এই বাড়ির বউ। তবে একটা কথা ভুল বলোনি, আমার মনে হয় এখন তুমি সংসারের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা নিতে পারো। তোমাকে রিপ্লেস করার সঠিক মানুষ এসে গেছে। ইউ ক্যান বি রিল্যাক্স নাও। মিহোয়েল মাই ওয়াইফ ক্যান টেকঅফ অল ইউর রিসপন্সিব্লিটিস।

ছেলের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারেন না রওনক। চোয়াল শক্ত করে দিলারা জামান বলেন,

-কি বলতে চাইছিস তুই? একটা পরিচয়হীন রাস্তার মেয়ের হাতে আমি আমার এত যত্নে গড়া সংসার ছেড়ে দিবো?

রওনক আর নিতে পারছে না। এমনিও আগের দিনের ঘটনা সে ভুলে যায়নি। শুধুমাত্র চিত্রলেখার অনুরোধের কাছে চুপ করে আছে সে। নয়ত এতক্ষণে এই বাড়িতে তুফান ডেকে ফেলতো সে। কিন্তু এই মুহূর্তে যা হচ্ছে এসবও আর মুখ বুজে সহ্য করবে না সে। হাতের মুঠো অলরেডি শক্ত হয়ে গেছে তার যা চিত্রলেখার দৃষ্টি এড়ায়নি।

-ইনাফ…

এই একটা শব্দের বেশি বলতে পারে না রওনক। সে আর কিছু বলে এর আগেই চিত্রলেখা তার মুঠো বদ্ধ করা হাত চেপে ধরে খানিকটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিচু কন্ঠে বলে,

-বাচ্চারা দেখছে প্লিজ।

মিম, মিশকাতের দিকে তাকিয়ে রওনক থেমে যায়। নিজের রাগ চেপে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। এতক্ষণে দীদার এমন কঠিন আচরণ দেখে ওদের দু’জনেরই চোখ বড় হয়ে গেছে। এর আগে কখনো ওরা ওদের দীদাকে এভাবে রাগ করতে দেখেনি। চিত্রলেখা এমন ভাব করে যেনো কিছুই হয়নি। মিম, মিশকাততে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,

-জলদি দু’জন লক্ষি বাচ্চার মতোর গ্লাস খালি করে ফেলো তো দেখি। আজ মিমি তোমাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

চিত্রলেখার কথার মাঝে তানিয়া বলে,

-আজ ড্রাইভারই ওদের নামিয়ে দিয়ে আসুক তুমি বাসায় থাকো। রাতে পার্টির জন্য আমি পার্লারের এপেয়ন্টমেন্ট নিয়েছি আমাদের দু’জনের জন্য। ওরা চলে আসবে একটু পরেই।

অবাক হয়ে চিত্রলেখা বলে,

-এত জলদি? পার্টি তো রাতে।

-ওরা আসবে আমাদের ফেশিয়াল, মেনিকিউর, পেডিকিউরের আর এক্সেটরা করতে। বিকেলে বিউটিশিয়ানরা আসবে তোমার ম্যাকভারের জন্য।

মুখটা ছোট্ট করে ও করে চিত্রলেখা কিন্তু কোনো শব্দ করে না। আর কেউ কোনো কথা বলেনি। রওনকের চায়ের কাপ খালি হলে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বলে,

-আরেক কাপ প্লিজ।

এটা রওনকের তৃতীয় কাপ চা চলছে। নাস্তা করতে করতেই দু’কাপ চা খেয়েছে সে। চিত্রলেখা আপত্তি করে না। রওনক সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে মিম, মিশকাতের নাস্তা করা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। দু’জনকেই বলে,

-তোমরা ব্যাগ নিয়ে আসো আজ চাচ্চু তোমাদের স্কুল দিয়ে আসবে।

চাচ্চুর কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গেই দু’জনে নিজেদের ঘরের দিকে দৌড় লাগায় স্কুল ব্যাগ আনতে। রওনক চায়ের কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর সবাইকে বিশেষ করে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে বলে,

-মিসেস দিলারা জামান, গতকাল আপনি একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন। ভেবেছেন কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। কিন্তু আপনি হয়ত ভুলে গেছেন এই বাড়ির দেয়ালেরও কান আছে আর এসব দেয়ালেরা আমার কাছে সব রিপোর্ট পৌঁছে দেয়। এই বাড়িতে কেউ কাশলেও সেটা আমার পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

দিলারা জামান একবার জাহানারার দিকে তাকান। রওনক বলতে থাকে,

-আমার ওয়াইফ চায় না এই বিষয়ে আমি আপনাকে কাউন্টার দেই তাই বেশি কিছু বলবো না শুধু এতটুকু বলবো এরপর এমন কিছু করার আগে একটু চিন্তা ভাবনা করে নিলে আমি খুশি হবো। আমার ওয়াইফকে মাত্র এক কোটি টাকার চেক দেয়ার আগে আপনার ভাবা উচিত ছিল কাকে কি দিচ্ছেন। যে নিজেই কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তাকে এক কোটি টাকা দেয়াটা নেহাৎ হাস্যকর নয়কি? আশাকরি এরপর এমন চাইল্ডিস কাজ করা থেকে বিরত থাকবেন।

চিত্রলেখা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। রওনকের ইচ্ছা করছিল সে আরও অনেক কিছু বলে কিন্তু তার চন্দ্র তাকে অনুরোধ করায় এর বেশি আগায়নি সে। নয়ত তার চন্দ্রকে অপমান করার জন্য নিজের মাকেও ছেড়ে কথা বলতো না সে। বউয়ের চোখ থেকে হাসি পেয়ে যায় রওনকের। সকলের উপস্থিতিতেই এক কদম কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলে,

-আমার একটা জরুরী মিটিং আছে। ওটা শেষ করেই চলে আসবো।

চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায়।

মিম, মিশকাত তাদের স্কুল ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলে রওনক দু’জনকে দু’হাতে ধরে আসছি বলে দরজার দিকে আগায়। চিত্রলেখাও ওদের সঙ্গে গেইট পর্যন্ত আসে। রওনককে গেইটের কাছে আসতে দেখে তার ড্রাইভার এগিয়ে আসলে বাচ্চাদের এগিয়ে দিয়ে বলে,

-তোমরা নামো আমি আসছি।

ড্রাইভার বাচ্চাদের নিয়ে লিফটে উঠে গেলে রওনক চিত্রলেখার দিকে তাকায়। রওনকে আচমকা এভাবে তাকাতে দেখে নার্ভাস হয় চিত্রলেখা। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,

-আপনার জন্য চা দিয়ে দিয়েছি।

চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে তার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বউয়ের গালে আলতো চুমু খেয়ে রওনক বলে,

-থ্যাংকিউ লাভ।

চিত্রলেখা চোখ বড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে অবাক হওয়া অবস্থায় রেখেই হাসি হাসি মুখ করে বেরিয়ে যায় রওনক। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা। আচমকাই অসম্ভব গরম লাগছে তার। নিজের গালে হাত রাখলে টের পায় পুরের যাচ্ছে যেনো সব রেখে কেবল রওনকের ঠোঁট যে জায়গাটা স্পর্শ করেছে সেখানেই জ্বর এসেছে তার। সেই সঙ্গে তার বুকের ভেতর তবলা বাজচ্ছে। এইসব অনুভূতি নিয়েই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা যতক্ষণ না তানিয়ে এসে ডাক দেয় তাকে। তানিয়ার ডাকেই চেতন ফিরে পায় সে।

-কি ভাবছো? অনিথিং রং?

মুখ দিয়ে কথা বের হয় না চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায় সে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে