#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
রওনক এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার চন্দ্রলেখাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তার কান্ডে একদম বোকা বনে যায় চিত্রলেখা। এমন কিছুর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। রওনক এই পর্যন্ত চলে আসবে তার জন্য সেটাই তো আশা করেনি সেখানে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। রওনক কোনো কথা বলে না। নিঃশ্চুপ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে কেবল প্রিয়তমাকে। রওনকের বুকের ধুক ধুক কম্পন চিত্রলেখা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। এতখানি কাছাকাছি আছে দু’জনে যে একে-অপরের প্রতিটা হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে।
রওনক চিত্রলেখাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। বেচারি চিত্রলেখা রওনকের বাহু বন্ধনে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিল। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গিয়েছিল তার। খানিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ধাতস্থ হয় সে। ততক্ষণে কে এলো দেখার জন্য ভেতর ঘর থেকে ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে এসেছে আফিফা। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষের একে-অপরকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখার দৃশ্য দেখে সে ড্রইং রুমের দরজায়ই দাঁড়িয়ে পড়ে আর এদিক এগিয়ে আসে না। মূলত বিরক্ত করতে চায় না বলেই তার থমকে যাওয়া। সন্তপর্ণে পর্দা টেনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ততক্ষণে আফিফার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে চিত্রলেখা। অন্যদিকে রওনকের কোনো বাস্তবতার খেয়াল নেই। সে যেনো তার প্রিয়তমাকে ছাড়তে রাজি নয়। বাহু আলগা হলেই যেনো ফাঁক গলে চিত্রলেখা হারিয়ে যাবে খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যাওয়া পোষ না মানা পাখির মতো। বান্ধবীর উপস্থিতি টের পেয়েই সচিকত হয় চিত্রলেখা কিন্তু তৎক্ষনাৎই দু’হাতে ঠেলে রওনককে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে না। মানুষটা যেভাবে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তাকে, ততে করে চেষ্টা করলেও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না চিত্রলেখার। কিন্তু বুঝতে পারে সে কিছু একটা হয়েছে। অন্যথায় এমন হুটহাট জড়িয়ে ধরবে কেনো মানুষটা তাকে? পরমুহূর্তেই আবার খেয়াল হয় বিয়ে করে নিয়ে যাবার পর থেকে নিজের যে রূপের বহিঃপ্রকাশ করছে মানুষটা তার সামনে। এই লোককে দিয়ে এমন কান্ড আহামরি বড় বিষয় না। তবুও কোথায় গিয়ে যেনো চিত্রলেখা একটা অদৃশ্য খটকা অনুভব করতে পারে। তার অবচেতন মনে সন্দেহের জাগরণ ঘটে। মানুষটা পুরোপুরি ভালো নেই। কিছু তো একটা হয়েছে। আরও খানিকটা সময় দেয় চিত্রলেখাকে রওনককে যাতে করে সে নিজে থেকেই স্বাভাবিক হতে পারে৷ কিন্তু মনে হচ্ছে না রওনক আজ আর তাকে ছাড়ার কোনো পরিকল্পনা করছে। এভাবে তো সারারাত দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই ওভাবে রওনকের বুকে থেকেই চিত্রলেখা মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-আপনি ঠিক আছেন? কি হয়েছে আপনার?
চিত্রলেখার কথায় যেনো বাস্তবতার হদিস হয় রওনকের। এতক্ষণ তার মন, মস্তিষ্ক কোনোটাই যেনো এখানে উপস্থিত ছিল না। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রলেখার মুখটাও সে ঠিকঠাক দেখেনি তবে তার উপস্থিতি অনুভব করেছে। এতেই প্রিয়তমাকে নিজের আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়েছে এক মুহূর্ত অন্যকিছু চিন্তা না করে। তার দেহটা এখানে উপস্থিত থাকলেও সে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল চিত্রলেখার আলিঙ্গনে। চিত্রলেখাও যে তাকে তাল দিয়ে জড়িয়ে ধরবে এতখানি অবশ্য আশা করেনি রওনক।
রওনকের হদিস হলেও সে চিত্রলেখাকে নিজের বাহু থেকে আলগা করে না। ওভাবে জড়িয়ে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
-তুমি আমাকে ছেড়ে চলে আসছো কেনো?
রওনকের কথায় কোথায় যেনো খটকা লাগে চিত্রলেখার। ছেড়ে চলে আসছে এর মানে কি? সে কখন তাকে ছেড়ে চলে আসলো? রওনকের কথার আগাগোড়া ধরতে পারে না চিত্রলেখা। কিন্তু এই কথা ক্লিয়ার হওয়া প্রয়োজন। সবে মাত্র শুরু হওয়া একটা সম্পর্কের শুরুতেই কোনো ভুল বুঝাবুঝিকে স্থান দিতে চায় না চিত্রলেখা। এবারে নিজেকে রওনকের বাহুর বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা চালায় সে। তা টের পেয়ে রওনক বলে,
-আই ওন্ট লিভ ইউ।
-প্লিজ ছাড়ুন আমাকে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
চিত্রলেখার দমবন্ধ হয়ে আসছে শুনে ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও নিজের বাহু আলগা করে রওনক। চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। রওনকের মুখের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রলেখার বুকের ভেতর কিছু একটা হলো। এই কিছু একটা কি তা সে জানে না। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে অদৃশ্য এক সুখানুভূতি খেলে যায় চিত্রলেখার হৃদয়ের ভেতর তার নিজের অজান্তেই। এক মুহূর্ত রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে সামলে নেয় চিত্রলেখা। হাত বাড়িয়ে রওনকের একটা হাত ধরে সে। চিত্রলেখার বাম হাতটা রওনকের ডান হাত স্পর্শ করতেই আহ! মূলক ব্যথা পাবার শব্দ করেও তৎক্ষনাৎই আবার মুখ বন্ধ করে নেয় সে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেয়ালে হাত বারি দিয়েছিল রওনক। সেজন্যই তার হাতে ব্যথা যা রওনক টেরও পাচ্ছে না এখন। এই মুহূর্তে তার জন্য সকল ব্যথা বেদনার উর্ধ্বে হচ্ছে তার চন্দ্রলেখা। রওনককে শব্দ করতে দেখে আগ্রহ ভরে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে?
-নাথিং।
এক সেকেন্ড রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সেই আগের জায়গায়ই হাত ধরে চিত্রলেখা। এবারে আর ব্যথা পেলেও শব্দ করে না রওনক, গিলে ফেলার চেষ্টা করে। চিত্রলেখা রওনকের হাত ধরে তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
-চুপচাপ এখানে বসে থাকুন আমি আসছি।
চিত্রলেখার এমন স্বাভাবিক আচরণে খানিকটা অবাক হয় রওনক তবে তার ভালোও লাগে। ভালো লাগায় ভেতরটা আচ্ছন্ন হতে থাকে।
দ্রুত পা ফেলে কিচেনে চলে যায় চিত্রলেখা। ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে জলদিই ফিরে আসে। পানির গ্লাসটা রওনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-পানিটা খান।
রওনক আপত্তি করে না। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে একটানে সবটুকু পানি খেয়ে গ্লাস ফাঁকা করে। ফাঁকা গ্লাস রওনকের হাত থেকে নিতে নিতে চিত্রলেখা বলে,
-এভাবে একবারে পানি খেতে নেই। তিনবারে খেতে হয় জানেন না?
রওনক কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। চিত্রলেখাও চুপ করে থাকায় ড্রইং রুমে স্তব্ধতা বিরাজমান। এই নীরবতা ভেঙে চিত্রলেখাই জিজ্ঞেস করে,
-আপনি বাসায় যাননি?
রওনকের গায়ে এখনো সকালের পরিধানের কাপড় দেখে চিত্রলেখা ভাবে সে হয়ত বাসায় যায়নি সারাসরি এখানে চলে এসেছে। রওনক কোনো জবাব দেয় না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয় চিত্রলেখার মুখের দিকে। তা দেখে খানিকটা অস্থির লাগে চিত্রলেখার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চিত্রলেখাই জিজ্ঞেস করে,
-আপনি জানলেন কীভাবে আমি এখানে আছি?
এবারেও জবাব দেয় না রওনক।
-কথা বলছেন না কেনো? কখন ফিরেছেন আপনি? আমাকে ফোন করেননি কেনো?
চিত্রলেখা যে জবাব না পেয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছে তা তার কন্ঠে স্পষ্ট। বিষয়টা ভালো লাগছে রওনকের। বিয়ে করে নিয়ে যাবার পর থেকে যে মেয়েটা প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি একটা শব্দও বলেনি তার সঙ্গে অথচ এখন অনর্গল প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করে যাচ্ছে তাকে। চিত্রলেখা তাকিয়ে আছে রওনকের মুখের দিকে। তাদের দৃষ্টি একে-অপরে সীমাবদ্ধ। আচমকাই রওনকের নরম দৃষ্টি খানিকটা শক্ত হয়। নিজের ঘরে দেখে আসা চেকটার কথা মনে পড়ে যায় তার। চিত্রলেখাকে দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে কিছুক্ষণের জন্য। দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে চোয়ালও শক্ত হয় রওনকের খানিকটা। চিত্রলেখার উপর নয়, নিজের মায়ের উপর। হাতের মুঠো শক্ত করে এবারে রওনক পাল্টা প্রশ্ন করে চিত্রলেখাকে,
-হোয়াই ডিড ইউ লিভ মি?
-মানে?
-বাড়ি ছেড়ে আসছো কেনো তুমি?
-বাড়ি ছেড়ে!
বিড়বিড় করে চিত্রলেখা। সে কখন বাড়ি ছেড়ে আসলো? তাকে বাইরে যাবার পারমিশন তো সকালে রওনক নিজেই দিয়ে গেল। তাহলে এখন এমন করছে কেনো কিছুই বুঝতে পারে না বেচারী। চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক তাড়া দেয়।
-এন্সার মি। কে তোমাকে সাহস দিলো আমাকে ছেড়ে আসার? (রওনকের কন্ঠে রাগ, উৎকন্ঠা খানিকটা ভয় ও অসহায়ত্বও টের পায় চিত্রলেখা।)
-আমি আপনাকে ছেড়ে আসিনি।
মিনমিনে সুরে জবাব দেয় চিত্রলেখা। তা শুনে রওনক জিজ্ঞেস করে,
-তাহলে এখানে কি করছো তুমি?
-আপনিই তো সকালে আসতে বলেছিলেন।
-আমি?
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক সন্দিহান দৃষ্টি নিয়ে তাকালে চিত্রলেখা পরিষ্কার করে বলে,
-আপনিই তো সকালে বলেছিলেন আমি চাইলে বের হতে পারি। তাই…
এবারে খেয়াল হয় রওনকের সে নিজেই সকালে বলে গিয়েছিল চিত্রলেখা চাইলে বের হতে পারে। ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারে। চিত্রলেখা তাকে ছেড়ে চলে গেছে এই ভাবনা মস্তিষ্কে উদয় হতেই বাকি সব ভুলে গিয়েছিল সে।
রওনক বলে, কিন্তু তুমি তো তোমার খালার বাসায় যাওনি। কেনো যাওনি?
-বিয়ের পর প্রথমবার বাবার বাড়ি যেতে হয় বরকে সঙ্গে নিয়ে। আপনাকে ছাড়া আমি একা গেলে ওরা সবাই হয়ত আপনাকে ভুল ভাবতো।
-যেমন?
-ভাবতো আমরা গরীব তাই হয়ত আপনি ওটা নিজের শশুরবাড়ি বলে পরিচয় দিতে লজ্জা করছে তাই আমার সঙ্গে যাননি। আর…
বাকিটুকু না বলেই চুপ করে যায় চিত্রলেখা। রওনক আঁচ করতে পেরে নিজেই বলে,
-আর তুমি চাও না তোমার ভাইবোনেরা আমায় ভুল বুঝুক, তাই তো?
দ্রুত মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। সেই সঙ্গে মুখটাও নিচের দিকে করে রেখেছে সে। এতক্ষণে খানিকটা হাসি ফুটে ওঠে রওনকের মুখে। তবুও আর কিছুটা ক্লিয়ার হওয়া দরকার তার। তাই জিজ্ঞেস করে,
-আমি তো তোমায় বলেছিলাম সন্ধ্যের আগে বাসায় ফিরে যেতে। যাওনি কেনো?
-আসলে…
চিত্রলেখার অবশ্য এখানে কোনো দোষ নেই৷ সব দোষ আফিফার। আফিফাই তাকে আটকে রেখেছে। বিকেল গড়িয়ে পড়ার সময়ই চিত্রলেখা বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আফিফা তাকে ফিরে যেতে দেয়নি।
বিকেলের ঘটনা,
চিত্রলেখা বাড়ি ফিরার উদ্যোগ নিলে তাকে বাঁধা দিয়ে আফিফা বলে,
-আজ এখানেই থেকে যা তুই।
আফিফার এমন কথায় কেমন কেমন করে যেন তাকায় চিত্রলেখা। তার চাহনি দেখে আফিফা বলে,
-আরে তোর বর তো এখানে নেই। জরুরী কাজে শহরের বাইরে গেছে হতেই পারে সে আজ ফিরলো না। একা একা ওখানে থাকার চাইতে আজকের রাতটা নাহয় আমার কাছে থেকে যা।
-উনি বলে গেছেন ফিরে আসবেন।
-যদি কোনো কাজে আটকে যায়। তুই তো উনার সঙ্গে কাজ করেছিস। জানিস না? এর আগে কখনো এমন হয়নি একদিনের কাজে গিয়ে ২/৪ দিন আটকে যায়নি?
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায় চিত্রলেখা। এমন হওয়াটা আহামরি অবাক হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। এর আগে বহুবারই এমন হয়েছে। ২ দিনের কাজে গিয়ে ৭ দিন আর ৭ দিনের কাজে গিয়ে ১৫ দিন আটকে গিয়েছিল রওনক দেশের বাইরে। আজও এমন কিছু হলে বিন্দুমাত্র অবাক হবে না সে। কিন্তু তারপরেও চিত্রলেখার মন তাকে সায় দিচ্ছে না। তার মন বলছে মানুষটা ফিরবেই। ২/৪ ঘন্টা দেরি হলেও ফিরবে। কিন্তু লজ্জায় নিজের মনের এই শক্ত মনে হওয়াটা বান্ধবীর মুখের উপর বলতে পারেনি সে।
চিত্রলেখাকে দোনোমনা করতে দেখে পরে আফিফাই বলে,
-যদি চলেও আসে তোকে না পেয়ে তো ফোন করবেই সমস্যা কোথায়? তখন না হয় চলে যাবি।
আফিফার শেষের কথাটা ভালো লাগে চিত্রলেখার। রওনক ফিরে এসে তাকে না পেলে নিশ্চয়ই ফোন করবে। তবুও মনের ভেতর খচখচানি রয়ে যায় খানিকটা। বারবার মস্তিষ্ক তাকে জানায় রওনক বলে গিয়েছিল সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফিরে যেতে। সে ফিরে এসে তাকে যেনো পায়। ফিরে এসে তাকে দেখতে না পেয়ে কি রাগ হবেন মানুষটা? নাকি কষ্ট পাবে? মনের ভেতর খচখচানি, দোনোমনা নিয়েই থেকে যায় চিত্রলেখা। যদিও থেকে যাবার মতো ইচ্ছা তার একদমই নেই তবুও আফিফার জোরের কাছে হাল ছাড়তে হয় তাকে।
থেকে যাবার কারণ বিস্তারিত খুলে বলার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,
-আপনি আমাকে ফোন করেননি কেনো? ফোন করলেই তো আমি নিজেই চলে যেতাম। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হতো না।
-তোমার ফোন কথায়?
-আমার ফোন! ঘরেই আছে।
-কতগুলো কল দিয়েছি জানো? খবর আছে?
নিজের ফোনটা বের করে চিত্রলেখার হাতে দেয় দেখতে। কল লগে দৃষ্টি রাখতেই চিত্রলেখা দেখে রওনকের ডায়েল লগে চিত্রলেখার নাম সবার উপরে। পাশেই দেখা যাচ্ছে ৩৫ বার ডায়েল করা হয়েছে নম্বরটা। একটা হার্টবিট মিস করে চিত্রলেখা। সেই সঙ্গে একবার ঢোকও গিলে সে। তার মনে পড়ে বাবলু ঘুমাচ্ছিল বিকেলে। বাবলুর ঘুম যেনো না ভেঙে যায় তাই নিজের ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল। সেই সাইলেন্ট জেনারেল করার কথা আর মনে ছিল না তার।
-আসার সময় কাউকে কিছু বলে আসোনি কেনো?
-বলেছি তো।
-কাকে বলেছো? খালা তো কিছু বলতে পারলেন না।
-আসলে আমি যখন বের হচ্ছিলাম তখন খালাকে খুঁজে পাইনি। অন্য একজন বলল উনি নাকি গ্রোসারি কিনতে গেছে তাই ঐ মেয়েটাকে বলে এসেছিলাম খালাকে জানাতে।
রওনক আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। বরং বলে, বাসায় চলো, আমি নিতে এসেছি তোমাকে।
-এক মিনিট আমি ব্যাগ নিয়ে আসি।
চিত্রলেখা ভেতরের দিকে চলে যায়। ফিরে আসে বাবলু ও আফিফাকে সঙ্গে নিয়ে। বাড়িতে আজ আফিফার শাশুড়ি নেই। গ্রামের বাড়ি গেছেন। আফিফার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বাবলুকে চিত্রলেখার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নেয় রওনক। তার এই স্বাভাবিক আচরণে মুগ্ধ হয় চিত্রলেখা। বাবলুর গালে চুমু খেয়ে রওনক বলে,
-আঙ্কেল সরি খালি হাতে চলে আসার জন্য। নেক্সট টাইম অবশ্যই আঙ্কেল আপনার জন্য অনেকগুলো গিফটস নিয়ে আসবে।
তবুও রওনকের মন আপত্তি করে। সে তার মানিব্যাগ খুলে কচকচে পাঁচটা হাজার টাকার নোট বের করে বাবলুর হাতে দেয়। এখন বাবলু সব ধরতে পারে। তাই বাবলুর হাতের মুঠোয় টাকাগুলো গুঁজে দেয় রওনক। তা দেখে আফিফা আপত্তি করার চেষ্টা করে বলে,
-প্লিজ এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।
-একদম না, আমার আর বাবলুর মাঝে অন্যকারো হস্তক্ষেপ চলবে না আগেই বলে রাখছি। এটা দিয়ে বাবলু নিজের পছন্দ মতো যা ইচ্ছা কিনবে। তাই না বাবলু?
রওনকের কথা শুনে বাবলু এমন ভাবে হাসছে যেনো সব কথা সে বুঝতে পারছে। আফিফার দিকে তাকিয়ে রওনক আরও বলে,
-আমি একদমই টাকার গরম দেখাচ্ছি না। শো-অফও করছি না। ছোটবেলা থেকে দেখেছি নতুন মেহমানকে গিফট দিতে হয়। বাবলুকে তো আমি আজ প্রথম দেখলাম তাই সে আমার জন্য আজকেই আসা নতুন মেহমান। আমি কেবল আমার করণীয়টা করছি এর বেশি কিছু নয়।
রওনকের এত সাধারণ হওয়াটা, এত সাধারণ আচরণ চিত্রলেখাকে প্রতিমুহূর্ত কেবল মুগ্ধই করে যাচ্ছে। এইসব মুগ্ধতারা চিত্রলেখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে।
বাবলুর গালে আরেকটা চুমু খেয়ে তাকে আফিফার কোলে ফেরত দিয়ে রওনক বিদায় নিয়ে বলে,
-আজ আসছি। অন্যদিন সময় নিয়ে আসবো।
চিত্রলেখা ভীষণ অবাক হয়েছে রওনকের এমন নরম আচরণ দেখে যে বান্ধবীর থেকে ঠিকঠাক বিদায় নেবার কথাটাও তার মস্তিষ্কে আসেনি। ডিনারের সময় হয়ে যাওয়ায় ভদ্রতা বশত আফিফা জিজ্ঞেস করে,
-ডিনারটা করে গেলে খুশি হতাম।
রওনকই জবাবে বলে, দুঃখিত আজ আপনাকে খুশি করতে পারছি না। তবে কথা দিচ্ছি আরেকদিন এসে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করব। আফটার অল আমার একমাত্র বউয়ের বেস্ট ফ্রেন্ডের বাসা মানে আমার আরেকটা শশুরবাড়ি। জামাই আদর নিতে তো অবশ্যই আসবো।
রওনকে জবাব একা চিত্রলেখা নয় আফিফাও খুশি হয়ে যায়। চিত্রলেখা চিন্তা করে পায় না দি রওনক জামান এসব কি বলছে! তার ডিকশনারিডে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করব এই ধরনের শব্দ, কথাও আছে! ওরা বেরিয়ে যাবার আগে আফিফা চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরে নিচু আওয়াজে বলে,
-তুই আমার কথা মিলিয়ে নিস। আমি যা বললাম ঠিক তাই।
চিত্রলেখার মুখে আপাতত কথা নেই। বিষ্ময় আর মুগ্ধতায় এই মুহূর্তে কথা বলতে ভুলে গেছে সে। বিষ্মিত চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে আফিফার বাসা থেকে বেরিয়ে যায় রওনক৷ হাত ধরে রেখেই চিত্রলেখাকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। রওনক গাড়ি চালানো শুরু করতেই চিত্রলেখা বলে,
-একটা প্রশ্ন করি?
চিত্রলেখার কথায় রওনক কোনো কথা বলে না কেবল পাশ ফিরে তাকায়। এতক্ষণ যে মানুষটার কথায়, ব্যবহারে মুগ্ধতায় তলিয়ে ছিল চিত্রলেখা এখন সেই মানুষটার দৃষ্টির চাহনি দেখে মিহিয়ে যায় সে। ঐ চোখের ভাষা বদলে গেছে। ওখানে কুসুম নরম যে ভাব ছিল সেটা বদলে সূর্যের কঠিন তাপ অনুভূতি দেখা যাচ্ছে। মুহূর্তেই মিহিয়ে যায় চিত্রলেখা। করতে চাওয়া প্রশ্নটা গিলে ফেলে ঢোক গিলার সঙ্গে। রওনক একটা কথাও বলে না গাড়িতে।
দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বেড রুমে, মুখোমুখি। রওনকের হাতে চেকের পাতাটা। যা দেখে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। রওনক এখনো কোনো কথা বলেনি। সেই যে আফিফার বাসা থেকে বেরিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে তা এখনো খোলেনি। আর এদিকে রওনকের হাতে চেকের পাতাটা দেখে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না৷ বেশ খানিকটা সময় মৌন যুদ্ধের পর নীরবতা ভেঙে রওনক জিজ্ঞেস করে,
-উইল ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন মি হোয়াট ইজ দিজ?
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
দু’জনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বেড রুমে, মুখোমুখি। রওনকের হাতে চেকের পাতাটা। যা দেখে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। রওনক এখনো কোনো কথা বলেনি। সেই যে আফিফার বাসা থেকে বেরিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে তা এখনো খোলেনি। আর এদিকে রওনকের হাতে চেকের পাতাটা দেখে চিত্রলেখা কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না৷ বেশ খানিকটা সময় মৌন যুদ্ধের পর নীরবতা ভেঙে রওনক জিজ্ঞেস করে,
-উইল ইউ প্লিজ এক্সপ্লেইন মি হোয়াট ইজ দিজ?
একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা। কোনো জবাব না পেয়ে রওনক চেকের পাতাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে চিত্রলেখা আচমকাই তার একটা হাত ধরে বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-এটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
-যে এটা তোমাকে দিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি এর মানে কি? তুমি তো জবাব দিবে না আমাকে তাই তাকেই জিজ্ঞেস করবো।
-না, আপনি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।
-কেনো?
চিত্রলেখা চুপ করে রয়। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক আবার বেরিয়ে যাবার জন্য সামনের দিকে কদম বাড়ালে চিত্রলেখা এবার দুই হাতে তার হাত ধরে রাখে খানিকটা শক্ত করে।
-লিভ মাই হ্যান্ড চন্দ্র৷ আই ওয়ান্ট ড্যাম এন্সার।
-আমি বলছি।
রওনক এটাই চাইছিল। মাকে গিয়ে প্রশ্ন করার আগে সে চাইছিল চিত্রলেখা নিজেই তাকে জানাক ঘটনা কি ঘটেছে। কারণ মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করলে সে যে সত্যিটা বলবে এর কোনো গ্যারান্টি নেই। নিজের মাকে রওনক সবচাইতে ভালো করে চিনে। যদিও সে জানে ঘটনা কি ঘটেছে তবুও চিত্রলেখার মুখ থেকে শুনতে চায় সে।
এবারে রওনক চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে বিছানায় বসায়। নিজে পাশে বসে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-বলো আমি শুনছি।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে চিত্রলেখা বলে, সকালে মা আমাকে ডেকে ছিলেন উনার ঘরে।
-তারপর?
-এই চেকটা দিয়ে…
চিত্রলেখার মন সায় দেয় না রওনককে এসব বলতে। এসব শুনার পর নিশ্চয়ই রওনক চুপ করে বসে থাকবে না তার মতো৷ নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবে যা চিত্রলেখা চায় না। তার জন্য মা-ছেলের ভেতর দ্বন্দ্ব হোক তা একদমই চায় না চিত্রলেখা। মা-ছেলের সম্পর্কের ভাঙনের কারণ হতে নারাজ সে। বেঁচে থাকতে চিত্রলেখার বাবা-মা তাকে এই শিক্ষা দেয়নি। দিলারা জামান যাই বলুক না কেনো চিত্রলেখা তেমন মেয়ে নয় যেমনটা উনি ভাবছেন। নিশ্চয়ই আজ নয়ত কাল উনার এই ধারণা পাল্টে যাবে, এমনটাই আশা করছে চিত্রলেখা।
চিত্রলেখা কিছু বলছে না দেখে রওনক তাড়া দিয়ে বলে, স্পিক আপ চন্দ্র।
-চেকটা দিলেন ব্যস আর কিছু না। নতুন বউকে সবাই গিফট দেয় না? এটাও গিফট।
চিত্রলেখার কথা শুনে তৎক্ষনাৎ হেসে ফেলে রওনক। যদিও এটা হাসার সময় নয় কিন্তু সে না হেসে পারে না। হাসিটা তার নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য চিত্রলেখা বলেছেও একটা হাস্যকর কথা। রওনককে এভাবে হাসতে দেখে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। বেচারী বুঝতে পারে তার মিথ্যা ধরে পড়ে গেছে। হাসতে হাসতেই চেকের পাতা চিত্রলেখার মুখের সামনে তুলে ধরে রওনক। আচমকা যেমন হাসতে শুরু করেছিল, তেমনি আচমকাই হাসি থামি দিয়ে বলে,
-এটা তোমার জন্য গিফট না আমার জীবন থেকে বের করে দেয়ার মূল্য সেটুকু বুঝাবার মতো বোধবুদ্ধি যে আমার আছে তা নিশ্চয়ই তুমিও জানো। এই চেকটা ধরিয়ে দিয়ে কি বলেছে তোমাকে? আমার জীবন থেকে বেরিয়ে যেতে নাকি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে? আর কি অফার করেছে আমার মা তোমাকে?
চিত্রলেখার জবাব দিতে হয় না। রওনক নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলে, আমার জীবন থেকে চলে যাবার জন্য বলা হয়েছে নিশ্চয়ই, দূরে কোথা। আমার নাগালের বাইরে যেনো আমি তোমাকে কখনো খুঁজে না পাই।
রওনকের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে চিত্রলেখা। সে চাইলেও এই মানুষটার কাছ থেকে সত্য গোপন করতে পারবে না। হাজার চেষ্টা করেও মিথ্যা বলতে পারে না চিত্রলেখা। বললেও ধরা খেয়ে যায়। তবে চিত্রলেখা একদমই আশা করেনি রওনক যে মাত্র দু’দিন হলো তার জীবনে এসেছে এই মানুষটাও তার মিথ্যা ধরে ফেলতে পারবে। অবাক হয় চিত্রলেখা।
রাগে রওনকের মস্তিষ্কের ভেতরের প্রতিটা শিরা উপশিরা ফেটে যাচ্ছে যেনো। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে যা খালি চোখেই দ্রষ্টব্য। রওনকের পক্ষে আর নিজের রাগ চেপে রাখা সম্ভব নয়। মায়ের রাগ-অভিমান আছে ঠিক আছে কিন্তু এমন কিছু সে একদমই আশা করেনি। এর জবাব তার চাই। মাকে প্রশ্ন করতে আবার উঠে দাঁড়ায় রওনক। কিন্তু জায়গা থেকে সরতে পারে না । সে সরে যাবার আগেই চিত্রলেখা তার হাত ধরে ফেলে। বাঁধা দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আবার কোথায় যাচ্ছেন?
-মিসেস দিলারা জামানকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি আমার ওয়াইফকে এভাবে অপমান করার মানে কি?
রওনকের ধরে রাখা হাতটা আগের চাইতে আরও শক্ত করে ধরে চিত্রলেখা বলে,
-না আপনি যাবেন না। কাউকে কোনো প্রশ্ন করবেন না দয়া করে।
-প্রশ্ন করব না? তোমাকে, আমার ওয়াইফকে ইন্সাল্ট করা হয়েছে আর আমি জবাব চাইবো না? এতটা কাপুরুষ তো আমি নই যে বসে বসে আমার বউকে অপমানিত হতে দেখবো। ইম্পসিবল।
-কেউ আমাকে অপমান করেনি। কিচ্ছু বলেনি। আপনার কাউকে…
চিত্রলেখা কথা শেষ করতে পারে না এর আগেই রওনক বলে,
-তোমাকে তোমার পরিবার তুলে কথা বলা হয়েছে। তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়েছে। তোমার শিক্ষা, এথিক্স নিয়ে কথা শুনানো হয়েছে আর তুমি আমাকে বলছো আমি কিছু বলবো না।
রওনক সব জানে শুনে তব্ধা খায় চিত্রলেখা। অবাক হওয়াটা চিত্রলেখার চোখ-মুখে ভেসে উঠেছে। তা দেখে রওনক বলে,
-তুমি কী ভেবেছিলে, তুমি আমাকে কিছু বলবে না আর আমি কিছু জানতেও পারবো না? এই বাড়ির দেয়ালেরও কান আছে বুঝলে? ওসব দেয়ালেরাও আমার পর্যন্ত খবর পৌঁছে দেয়। তুমি চাইলেও আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখতে পারবে না, বুঝেছো? নাও লিভ মাই হ্যান্ড। আমাকে আর দায়িত্ব পালন করতে দাও।
চিত্রলখা রওনকের হাত ছেড়ে দেয় ঠিকই কিন্তু তাকে বেরিয়ে যাবার সুযোগ দেয় না। দু’হাত জোড় করে অনুরোধের সুরে মাথা নিচু করে বলে,
-আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি প্লিজ আপনি কাউকে আমার জন্য কিচ্ছু বলবেন না।
চিত্রলেখাকে এভাবে অনুরোধ করতে দেখে রওনকের সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেল মুহূর্তেই। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার জোড় করে রাখা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় রওনক। অনেকটা এক-অপরের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। এবারে রওনক নিজেও মৃদু সুরেই জিজ্ঞেস করে,
-কেনো জিজ্ঞেস করবো না?
-আমি চাই না আমার জন্য আপনার মায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খারাপ হোক। আমি সত্যিই এমন কিছু চাই না। উনার বলা আমাকে সব কথা আমি ভুলে গেছি যখন আপনি আমার হয়ে কথা বললেন সেই মুহূর্তে আমি সব ভুলে গেছি। কারো থেকে আমার কোনো জবাব চাই না সত্যি বলছি। আমি চাই না আমার হয়ে আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করুন, খারাপ ব্যবহার করুন। এসব করলেও তো তার আমার প্রতি খারাপ ধারণাই তৈরি হবে। উনি ভাববেন আমি আপনার কাছে উনার নামে নালিশ করেছি। আপনাদের ঝগড়ার জন্য আমিই দায়ী হবো। এসব দায় আমার চাই না। আপনি কাউকে কিচ্ছু বলবেন না প্লিজ রওনক।
কথা বলতে বলতেই চিত্রলেখার চোখ ভারী হয়ে গেছে, খানিকটা লালও। রওনকের মনের ভেতর তুফান চলছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে আটকে রাখছে।
-আ…আমার বাবা-মা আমাকে খারাপ শিক্ষা দেয়নি বিশ্বাস করুন। আপনার টাকা-পয়সার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আমি…আমি লোভী নই।
এই কথাটা বলতে গিয়ে হোচট খায় চিত্রলেখা। রওনক জানে তার মা চিত্রলেখাকে কি কি বলেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর রওনক জাহানারাকে ফোন করে সব জেনে নিয়েছে। জাহানারা নিজেও অপেক্ষা করছিল রওনকের ফিরে আসবার। জরুরী কাজে সে চট্টগ্রাম গিয়েছিল তাই দিনের বেলায় ফোন করে কাজের মাঝে ছেলেকে বিরক্ত করেননি। কারণ এসব শুনার পর যে রওনক কাজে মন দিতে পারবে না তা জাহানারা ভালো করেই জানতেন। আর জানতেন বলেই সারাদিনে রওনককে কিছু জানানি ফোন করে, বরং তার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করেছেন। অথচ সেই অপেক্ষা করাটাই যেনো কাল হয়েছে।
-বিশ্বাস করুন আমি লোভী নই।
এই কথাটা রিপিট করতেই চিত্রলেখার চোখে ভারী হয়ে থাকা পানি গাল বেয়ে পড়ে। রওনক আর সব সহ্য করতে পারলেও তার চন্দ্রলেখার চোখের পানি সে সহ্য করতে পারবে না। কাউকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবে না সে তবুও চন্দ্রের চোখে পানি চাই না তার। চিত্রলেখার চোখে পানি দেখে রওনকের যেনো কি হলো। হাত বাড়িয়ে দু’হাতের পাতায় চিত্রলেখার মুখ নিয়ে কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার গাল বেয়ে পড়া চোখে পানি নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে শুষে নেয় রওনক। এই চোখের পানি নিচে পরতে দিবে না সে। নিজের ঠোঁট দিয়ে প্রিয়তমার চোখের পানি শুষে নিয়ে রওনক বলে,
-আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না প্লিজ তুমি কেঁদো না। তুমি যা বলবে আমি তাই করব, আই প্রমিজ বউ।
কথা বলতে বলতেই রওনক তার কপাল ঠেকায় চিত্রলেখার কপালে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হবার পর দু’জনে টের পায় তারা একে-অপরের কতখানি নিকটে। রওনকে নিজের এতটা কাছে আবিষ্কার করে আঁতকে ওঠে চিত্রলেখা। শরীর কেঁপে ওঠে তার। অদৃশ্য শিহরণ খেলে যায় চিত্রলেখার অঙ্গ জুড়ে। চিত্রলেখার অঙ্গের কাঁপন টের পেয়ে রওনকের ভেতরে কি যেনো হয়ে গেল। বাম হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার কোমড় জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে। ততটুকু কাছাকাছি, যতটুকু কাছাকাছি আসলে পরে দু’জন মানুষের মাঝে আর কোনো দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে না। রওনকের ডান হাত এখনো চিত্রলেখার গাল স্পর্শ করে আছে। সেই হাতেই রওনক তার চন্দ্রলেখার মুখটা উপরের দিকে তুলে ধরে ঠোঁট জুগলের দখল নেয়। চিত্রলেখা বাঁধা দেয় না। রওনক আলতো স্পর্শে চুমু খেতে থাকে তার চন্দ্রলেখার ঠোঁটে। এক মুহূর্তের জন্যও দখল ছাড়ে না। একই অবস্থায় থেকে কদম বাড়ায় রওনক। দু’কদম এগিয়ে চিত্রলেখা সমেত বিছানায় হেলে পড়ে। চিত্রলেখার কোমড়ে থাকা হাত এবার মাথার পেছন দিকে নিয়ে যায়। প্রথম দিকে আলতো ভঙ্গিতে চুমু খেলেও এখন খানিকটা গতি বাড়িয়েছে সে। চুমুর তালে তালে শুষে নিচ্ছে প্রিয়তমার ওষ্ঠ যুগল। নিজের ঠোঁট দিয়ে প্রিয়তমার ঠোঁটের সুধা পানে ব্যস রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার বুকের কাছে লেপ্টে থাকা শাড়ির আঁচল সরায়। রওনকের স্পর্শে এখনো ধাতস্থ হয়নি চিত্রলেখা। প্রাণপণ চেষ্টায় বিছানা খামচে ধরেছে সে। অনেকটা সময় চিত্রলেখার ঠোঁটে ডুবে থাকার পর রওনক চিত্রলেখার চিবুক, গলায় আলতো চুমু দিতে দিতে নিচের দিকে নামে। চিত্রলেখার বুকে ডুবে থাকা রওনকের একটা হাত যখন তার শাড়ির কুচি টেনে খুলে ফেলে তখন আচমকা চিত্রলেখা বলে ওঠে, আমি এখনো তৈরি নই, প্লিজ।
তৎক্ষণাৎ রওনকের বাড়ন্ত হাত থমকে যায়। উপরের দিকে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খেয়ে পাশে গা এলিয়ে দেয় সে। তাড়াহুড়ো করে রওনক নিজেও আগাতে চায় না। তখন চিত্রলেখাকে কাঁদতে দেখে তার কি যেনো হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি সে। এমনি বিয়ের পর থেকে কি যেনো হয়েছে তার। চিত্রলেখাকে দেখলেই নিজেকে সামলে রাখতে কষ্ট হয় তার। অনেক নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই নিজেকে আটকে রেখেছে রওনক। কষ্ট হচ্ছে তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে সে। চিত্রলেখার অনুমতি ছাড়া কিছুই করবে না রওনক। এমন তো নয় একটা মাত্র রাতের ব্যাপার, একরাত করলাম আর জীবন কেটে গেল। রওনকের সারাজীবন প্রতিটা রাত চিত্রলেখাকে নিজের করে চাই। তার চন্দ্রলেখার দেহের উষ্ণতা চাই। ব্যাক্তিগত অঙ্গের উত্তাপ চাই। আর সমগ্র জীবন পাবার লোভে শুরুর দিকের এই কয়েকটা রাত বিসর্জন দিতে রাজি সে খুশি মনে, নির্ধিদায়। কোনো তাড়া নেই তার। চিত্রলেখার পাশে শুয়ে বড় বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে পরে রওনক। তাকে উঠে যেতে দেখে চিত্রলেখাও উঠে বসে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে,
-কোথায় যাচ্ছেন?
বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে রওনক বলে, শাওয়ার নিতে যাই। তুমি তো এখনই কিছু করতে দিচ্ছো না তাই আপাতত শাওয়ার নিয়েই নাহয় নিজেকে শান্ত করি।
রওনকের কথা শুনে লজ্জায় ম রে যেতে মন চাইছে চিত্রলেখার। ইচ্ছা হচ্ছে গায়েব হয়ে যেতে। লোকটা এমন কেন? যে মানুষটা কথার বানেই তাকে মুহূর্তে ঘায়েল করে ফেলতে পারে সেই মানুষটার হাতে নিজেকে পুরোপুরি সপে দিলে কি করবে সে? জানতে ইচ্ছে হয় চিত্রলেখার। এসব ভাবনা চিত্রলেখার মস্তিষ্কে উদয় হতেই পরমুহূর্তে নিজেকে নিজেই ধমক লাগায় সে। এসব কি আবোলতাবোল ভাবছে সে! নিজের ভাবনার উপর নিজেই অবাক না হয়ে পারে না। আগের চাইতে আরও বেশি লজ্জায় চিত্রলেখার গাল লাল হতে আরম্ভ করেছে। হাত বাড়িয়ে গাল ধরতেই চিত্রলেখা অনুভব করে তার লাল খানিকটা গরমও হয়ে গেছে। চিত্রলেখার নিজের অজান্তেই তার হাত নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে। যেখানে কিছুক্ষণ আগে রওনক নিজের ঠোঁটের উষ্ণতা মাখিয়ে দিয়ে গেছে। নিজের ঠোঁট ছুঁয়েই যেনো চিত্রলেখা রওনকের অদৃশ্য চুমু অনুভব করতে পারছো এখনো। চিত্রলেখার মনে হচ্ছে এখনো রওনকে ঠোঁট তার ঠোঁট স্পর্শ করে আছে। আর ভাবতে পারছে না সে। লজ্জায় সত্যি সত্যি ম রে যেতে মন চাইছে তার। এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সেজন্য বিছানা ছেড়ে আগে শাড়ি ঠিকঠাক করে নেয়। আবার কুচি দিয়ে আঁচল ঠিক করে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ওসব ভাবনা আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য খোলা হাওয়া প্রয়োজন তার তাই বারান্দায় এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। কিছু আকাশ দেখেলেই ওসব চিন্তা-ভাবনা তার মস্তিষ্ক ছেড়ে পালাবে। বারান্দায় এসে খোলা আকাশের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তবুও যেনো রওনক তার মস্তিষ্ক থেকে বেরই হতে চায় না। এই মানুষটাকে কি চিত্রলেখা চাইলেই নিজের ভাবনা থেকে সরাতে পারবে? আদৌ কি সম্ভব? চিত্রলেখা রওনকের কথা ভাববে না তা কি হয়?
চলবে…