#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
সকাল সকাল রিপার ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে লিখন। কি হয়েছে কে জানে! সকাল সকাল ফোন দিয়ে রিপা জানায় সে লিখনদের এলাকাতেই আছে লিখন যেনো চট জলদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসে। গতকাল রাতেও দেখা হয়েছে ওদের হঠাৎ কি হলো যে এই জরুরী তলব! সময় বিলম্ব না করে কোনোরকম তৈরি হয়ে নিয়েই আজ বেরিয়ে পড়ে লিখন, এমনকি সকালের নাস্তাটাও খায়নি। জরুরী কাজ আছে বলে খালি মুখেই বেরিয়ে পড়েছে। অথচ চিত্রলেখা থাকলে এই কাজ করতে পারতো না লিখন। যত জরুরী কাজই থাকুক না কেনো নাস্তা করেই বের হওয়া লাগতো তার। নাস্তা না করে বের হবার মতো দুরসাহস লিখনও করতে পারতো না চিত্রলেখার উপস্থিতিতে। মানুষের উপস্থিতি এমনই জিনিস। একজন মানুষের থাকা না থাকায় অনেক কিছু বদলে যায়। অনেকগুলো জীবন বদলে যায়, বদলে যায় জীবনের গল্পগুলো। ঠিক বদলে যায় না নতুন মোড়ের সংযোগ ঘটে জীবনে।
রিপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগে লিখন। বলা যায় একপ্রকার দৌড়েই এসেছে সে। লিখনকে হাঁপাতে দেখে নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিয়ে রিপা জিজ্ঞেস করে,
-তুমি কি দৌড়ায় আসছো নাকি?
হাঁপাতে হাঁপাতেই লিখন জবাব দেয়, হু।
-কেন?
-তুমি দাঁড়ায় আছো তাই।
-আমি দাঁড়ায় আছি তো কি হইছে? আমাকে কি ছেলেধরা তুলে নিয়ে যাবে নাকি যে তোমাকে দৌড়ায় আসতে হবে।
লিখন আর জবাব করে না, পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নেয়া। এই সুযোগেই রিপা বলে,
-জরুরী কথা আছে তোমার সঙ্গে।
-সব শুনবো আগে রিকশা নিই, এলাকা থেকে বের হই তারপর সব শুনছি।
রিকশাটা এলাকা ছেলে নিউমার্কেটের দিকে অগ্রসর হলে লিখন জিজ্ঞেস করে,
-বলো এবার তোমার জরুরী কথা শুনি।
রিপা সিরিয়াস চাহনি নিয়ে পাশ ফিরে লিখনের মুখের দিকে তাকায়। প্রেমিকার চোখের চাহনি দেখে খানিকটা সন্দেহ হয় তার কিন্তু ঘটনা কি হতে পারে ভেবে কিছু পায় না সে। লিখনকে অবশ্য আবার কিছু জিজ্ঞেস করা লাগে না। রিপা নিজেই বলে,
-রওনকের ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বোনের কি সম্পর্ক?
-কোন রওনক ভাই? তার সাথে আমার বোনের কেন কোনো সম্পর্ক থাকতে যাবে?
-সম্পর্ক তো অবশ্যই আছে। সম্পর্ক না থাকলে কি এভাবে হুট করে কেউ বিয়ে করে নেয়?
-বিয়ে!
লিখনের বুঝতে একটু সময় লাগে রিপা রওনক জামান তথা চিত্রলেখার বরের কথা বলছে।
-ও আচ্ছা তুমি আপার বস মানে জামান গ্রুপের সিইও রওনক জামানের কথা বলছো?
-তো আর কার কথা বলবো? তোমার বোনের তো তার সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে।
-হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তাকে কীভাবে চিনো?
-আমার বাবা ব্যবসায়িক সুত্রে জামান গ্রুপের সঙ্গে আছেন। রওনক ভাইকে আমি আমার জন্মের পর থেকে চিনি। গতকালই ভাইয়া তার ফেসবুক আইডিতে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তোমার সঙ্গে দেখা করে বাসায় যাবার আরও অনেক পরে দেখেলাম রওনক ভাই যাকে বিয়ে করেছে সে আর কেউ নয় চিত্র আপা, তোমার বোন।
-ওহ!
লিখন বুঝতে পারে না এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত। রিপাও চুপচাপ হয়ে যায় আর কিছু বলে না। আচমকা কথার মাঝে চুপ করে যেতে দেখে লিখন জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে এমন চুপ হয়ে গেলে যে? সব ঠিক আছে তো?
-না, কিছু না। তুমি আমার কথায় রাগ করো না যেন। আমি ভাবলাম আপার হয়ত রওনক ভাইয়ার সঙ্গে আগে থেকেই কোনো সম্পর্ক ছিল তাই এভাবে বিয়ে করে ফেললেন দু’জনে। রওনক ভাইকে তো ছোটবেলা থেকে চিনি এভাবে হুটহাট বিয়ে করে ফেলার মতো মানুষ সে নয়। তাই খানিকটা খটকা লাগলো। সেই কৌতূহল থেকেই ছুটে এলাম জানতে। তুমি রাগ করোনি তো?
-না।
এই প্রসঙ্গে তারা কেউ আর কথা বাড়ায় না। তবে মনে মনে রিপা খানিকটা বিচলিত। চিত্রলেখার জন্য খানিকটা চিন্তাও হয় তার। রওনকদের বাড়ির কারো কথা ভাবছে না সে এই মুহূর্তে। বরং তার মস্তিষ্ক জুড়ে আছে সাবা। নিজের আপন মায়ের পেটের বোনকে রিপা চিনে। সাবা যে এত সহজে রওনকের পিছু ছাড়বে না তা রিপার অজানা নয়। রওনককে দু’দিন ধরে নয় অনেক বছর ধরে পছন্দ করে সাবা। আসলে পছন্দ নয়। রওনকের পাওয়ার, নাম, টাকা পয়সা দেখে তাকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে আছে সে। দি রওনক জামান নামটার যে পাওয়ার রয়েছে সেটা সাবার চাই। পৃথিবীতে রওনকের নামের ব্যবহার একমাত্র তার বউ সবচাইতে বেশি করতে পারবে। মিসেস রওনক জামানই এই নামের দাবীদার হতে পারবে। এই নাম, ফেইম আর পাওয়ারের ভীষন লোভ সাবার। যেকোনো কিছুর বিনিময়েই হোক না কেনো সাবার রওনককে চাই-ই চাই। রওনককে পাবার জন্য চিত্রলেখাকে আঘাত করতেও দুইবার ভাববে না সাবা। আর রিপার ভয়টা এখানেই। সাবা নিজের জেদের বসে চিত্রলেখার কোনো ক্ষতি না করে ফেলে। লিখন আর কথা বাড়ায় না, কিছু জিজ্ঞেসও করে না কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারে রিপা কিছু ভেবে বিচলিত হয়ত এই মুহূর্তে তাকে বলতে চাইছে না। সেজন্য আগবাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। সময় হলে বা রিপার মন চাইলে সে নিজে থেকেই বলবে।
চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে আছে দিলারা জামানের সামনে। কিঞ্চিৎ ভয়ে হাটু কাঁপছে তার। এই ভয় বা হাঁটু কাপাকাপির কারণ তার জানা নেই। খানিকক্ষণ আগে নিজের ঘরে বসে ছিল চিত্রলেখা। রওনক বেরিয়ে যাবার পরপরই তানিয়াও অফিস চলে গেছে। মীম, মিশকাত চলে গেছে স্কুলে। এই মুহূর্তে বাসায় আছে দিলারা জামান, জাহানারা আর চিত্রলেখা। যদিও হেল্পিং হ্যান্ডেরা অনেকজনই আছে। এত মানুষের উপস্থিতিতেও নিজেকে একা লাগছে তার। যতক্ষণ রওনক ছিল ততক্ষণ অবশ্য নিজেকে একা লাগেনি কিন্তু রওনকটা বেরিয়ে যাবার পর থেকেই আর কিছু ভালো লাগছে না তার। নিজেকে অনেক নিঃসঙ্গ লাগছে। একাই ঘরে বসেছিল সে আচমকা জাহানারা উপস্থিত হয়ে জানায় শাশুড়ী তাকে তলব করছে। এই কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করেছে তার। সেই কাপাকাপি এখনো চলছে। দিলারা জামান বসে আছেন একটা সিঙ্গেল সোফা চেয়ারে। উনার বসার ভঙ্গিটা ভীষণ রিলাক্সিং। আয়েশ করে বসে আছেন তিনি পেছন দিকে হেলান দিয়ে। চিত্রলেখা উনার থেকে কম করে হলেও পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। দিলারা জামানের ভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি কলেজের প্রিন্সিপাল। চিত্রলেখা সেই কলেজেই পড়ালেখা করে। সে হয়ত বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে ফেলেছে তাই তাকে শাস্তি দেবার জন্য ডাকা হয়েছে। দু’জনের একজনের মুখেও কথা নেই। চিত্রলেখার সঙ্গে জাহানারাও এসেছিল কিন্তু দিলারা জামান তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওর সঙ্গে আমি একান্তে কথা বলতে চাই এই বাক্য দিলারা জামানের মুখ গলে বের হতেই সেখান থেকে প্রস্থান করেছে জাহানারা। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর দিলারা জামান বলেন,
-সামনে এসো।
শাশুড়ীর আদেশে এক কদম সামনে আগায় চিত্রলেখা। দিলারা জামান উনার অপসিটে থাকা চেয়ার ইঙ্গিত করে বলেন,
-ওখানে বসো।
চিত্রলেখা নিঃশব্দে পা বাড়ায়। এগিয়ে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। সে বসতেই তাকে পুলিশের মতো জেরা শুরু করেন। উনার প্রথম প্রশ্নটাই হচ্ছে,
-তোমার বাবা কি করেন? ব্যবসা না কোনো ছোটখাটো চাকরী?
এমন প্রশ্নে খানিকটা বিব্রত হয় চিত্রলেখা। তার বিব্রত হওয়াটা চোখেমুখে ভেসে উঠেছে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে দিলারা জামান তাগাদা দিয়ে বলেন,
-এন্সার মি। কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে।
জবাব দিতে হিমশিম খায় চিত্রলেখা। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে মিনমিনে সুরে বলে,
-আমার বাবা নেই।
-নেই বলতে? তোমাদের ছেড়ে চলে গেছে নাকি মারা গেছে। স্পষ্ট করে কথা বলো।
-মারা গেছেন?
-ও! আই সি। আর তোমার মা, সে কি করেন? হাউজ ওয়াইফ না কিছু করেন?
-আমার মাও মারা গেছে।
-তুমি তাহলে এতিম!
এতিম শব্দটা যেন দিলারা জামান ভীষণ তাচ্ছিল্য ভরে উচ্চারণ করলেন। কথাটা বুকের ভেতর গিয়ে গভীর আঘাত করলো তাকে। চিত্রলেখার মনে পড়ে না শেষ কবে কেউ তাকে এভাবে এতিম বলেছিল। তার এতখানি জীবনে এর আগে কেউ তাকে এভাবে এতিম বলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি। খালা কোনোদিন বলা তো দূরের কথা বুঝতেও দেয়নি ওরা এতিম। চিত্রলেখার চোখ ভার হয়ে আসতে চাইলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলায় সে। এই ধরনের কথায় কেঁদে ফেলার মতো বয়স তার নেই। তাছাড়া অল্পে কেঁদে ফেলার স্বভাব চিত্রলেখার নেই। দিলারা জামান উনার প্রশ্ন করা চালিয়ে যান।
-তোমার কি আর ভাইবোন আছে?
মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। তৎক্ষণাৎই তিনি জিজ্ঞেস করেন,
-কয় ভাইবোন তোমরা? তোমার বড় কেউ কি আছে?
-চারজন, আমিই সবার বড়।
-হুম, তোমরা তো এতিম তাহলে তোমাদের দেখাশুনা কে করেছে? আই মিন ফাইনানশিয়াল দিকটা কীভাবে ম্যানেজ করেছো?
-আমরা আমার খালার কাছে মানুষ হয়েছি।
-আই সি, খালার কাছে আশ্রিতা থেকেছো। আমার ছেলের রুচির এত অধপতন কবে হলো?
দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে চিত্রলেখা। জীবনে অনেকবার তাকে এতিম শব্দটা শুনতে হয়েছে। এতে অবশ্য তার আপত্তি নেই কিন্তু আশ্রিতা শব্দটা কখনো শুনতে হয়নি তাকে, আজই প্রথম। কারো মুখ থেকে শুনতে যে এই শব্দটা ধারালো অস্ত্রের চাইতেও বেশি আঘাত করতে পারে তা জানাছিল না চিত্রলেখার, আজই প্রথম টের পেলো কি ধারালো এই একটা শব্দ। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে সক্ষম। চিত্রলেখার কানে আশ্রিতা শব্দটাকে পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য শুনাচ্ছে। মনে হচ্ছে এর আগে কেউ তাকে এমন জঘন্য কথা বলেনি। গা কাঁপুনি দিয়ে কান্না আসতে চাইছে তার কিন্তু চিত্রলেখা কাঁদবে না। তাকে দুঃখ দেয়া সহজ হলেও কাঁদানো ভীষণ কঠিন।
-রওনকের সঙ্গে তোমার পরিচিয় হলো কীভাবে? কতদিনের পরিচয় তোমাদের?
-আমি উনার কোম্পানিতে চাকরী করতাম।
-কি বললে তুমি? তুমি আমাদের কোম্পানির ইমপ্লই!
দিলারা জামানকে দেখে বুঝা যাচ্ছে উনি অবাক হয়েছে চিত্রলেখার পরিচয় শুনে। অবাক হওয়া সুরেই বলেন,
-ও মাই গুডনেস!
এক মুহূর্ত থেমে তিনি আরও বলেন, দেখো মেয়ে আমি এত ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলতে পারবো না তাই সরাসরিই বলছি। তুমি যদি টাকা-পয়সার লোভে আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে থাকো তাহলে আমাকে বলতো পারো। আমি বুঝতে পারছি তোমার পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়, অভাবে বড় হয়েছো। ভাইবোনদের মধ্যে তুমি সবার বড় সো ছোটদের দায়িত্ব তোমার উপর। আমি বুঝি বিশ/ত্রিশ হাজার টাকার বেতন দিয়ে এতগুলো মানুষের পেট চালানোটা কষ্টটকরই বটে। তাই হয়ত ভেবেছো পয়সাওয়ালা কাউকে ফাঁসিয়ে নিতে পারলে একনিমিশেই তোমার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। অবশ্য ঠিকই ভেবেছো। আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না খারাপও বলছি না। বাবা-মা মরা এতিম মেয়ে। তোমাকে তো ভালো-মন্দ শেখানোর মানুষ ছিল না তাই ভালোটা শিখতে পারোনি। যা করার করে ফেলেছো ওসব নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাচ্ছি না বরং তোমাকে সুন্দর একটা অফার দিচ্ছি। আমি তোমাকে একটা চেক লিখে দিচ্ছি। চেকটা নিয়ে রওনককে কিছু না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমার ছেলেকে আমি সামলে নিবো। পুরুষ মানুষের কি আছে বউ একটা গেলে আরেকটা আসবে। রওনকও আবার বিয়ে করে নিয়ে নতুন করে সংসার করবে। অবশ্যই তোমার মতো কারো সঙ্গে নয়। আমার ছেলের বউ হবার কোনো যোগ্যতাই তোমার নেই। রওনকের বউ হতে নূন্যতম একটা স্ট্যান্ডার দরকার বুঝলে। কবুল বললাম বিয়ে হলে গেল আর বিয়ে হয়ে গেছে বলেই যে এই বিয়ে বয়ে বেড়াতে হবে এর কোনো মানে হয় না। তোমাকে তো আমার ছেলে অন্যদের সামনে প্রেজেন্টও করতে পারবে না। কেনো যে আমার ছেলেটা তোমার মতো নাম পরিচয়হীন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে গেলো আমি বুঝতেই পারছি না। আমার ছেলে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো একটা কাজ করে ফেললো আমি মানতেই পারছি না। যাগ গিয়ে যা হবার তা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সময় আছে সব ঠিক করে নিতে পারবো। এখনো সব কিছু হাত ফোঁসকে বেরিয়ে যায়নি। চেকটা নিয়ে তুমি বিদায় হও আমার ছেলের জীবন থেকে।
ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিলারা জামান আরও বলেন, আমার কথা শেষ হয়েছে এখন তুমি আসতে পারো।
চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ালে দিলারা জামান বাঁধা দিয়ে আরও বলেন, এক মিনিট দাঁড়াও।
উঠে গিয়ে উনার বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চেক বই বের করে তাতে কিছু লিখেন। স্বাক্ষর করে চেকের পাতাটা ছিঁড়ে চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
-এক কোটি টাকার চেক লিখে দিলাম আশা করি এই টাকা দিয়ে তোমার ও তোমার ভাইবোনদের জীবন সুন্দর ভাবেই কেটে যাবে। অবশ্য তোমার মতো মেয়ের মূল্য এত বেশি নয় কিন্তু কি করবো বলো আমার মনটা বড় তাই কার্পন্য করলাম না টাকা দিতে। এর পরেও যদি কিছু লাগে আমাকে জানাবে কেমন?
চিত্রলেখার হাতের কাছে চেকটা ধরে রেখেছেন দিলারা জামান। তবুও হাতের মুঠ খুলে চেকের পাতাটা নিচ্ছে না দেখে এবারে তিনি জোর করেই চেকটা চিত্রলেখার হাতে গুঁজে দিলেন। আর বলেন,
-ইউ ক্যান গো নাও।
চিত্রলেখা যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দেই বেরিয়ে গেলো। দিলারা জামানের ঘরের দরজা দিয়ে বের হতেই চিত্রলেখা জাহানারার মুখোমুখি পড়ে। চলে যেতে বলা হলেও রুমের বাইরে ঠিকই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। জাহানারাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। কিন্তু কোনো কথা হয় না তাদের। নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। মেকি হেসে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হয় চিত্রলেখা।
রওনকের ফেরার কথা ছিল সন্ধ্যা নাগাদ। কিন্তু তার ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গেছে। বাসায় ফিরেই সরাসরি নিজের ঘরে গিয়েছে সে বউকে দেখতে। চিত্রলেখাকে দেখার জন্য রীতিমত ছটফট লাগছে তার। একটু জড়িয়ে ধরার জন্য অস্থির বিস্থির লাগছে। কিন্তু নিজের ঘরে আসতেই রওনক দেখে চিত্রলেখা এখানে নেই। হয়ত বাথরুমে আছে চিন্তা করে গায়ের কোটটা খুলে রাখে। পানি খাবার জন্য গ্লাস হাতে নিলেই তার দৃষ্টি আটকায় গ্লাসের পাশে থাকা একটা ভাঁজ করা কাগজে। রওনক দেখেই বুঝতে পারে এটা কোনো সাধারণ কাগজ নয়। এইধরনের কাগজের সঙ্গে পরিচিত সে। আচমকাই বুকের ভেতরটা মোচড়ে ওঠে তার। গ্লাস্টা নামিয়ে রেখে কাগজটা হাতে নেয় সে। ভাঁজ খুলতেই দেখে একটা চেকের পাতা। স্বাক্ষর দেখে রওনকের বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না এই চেকটা কার। সময় ঘনায় কিন্তু তার চন্দ্রের দেখা মিলে না। খানিক সন্দেহ হয় রওনকের। সে গিয়ে বাথরুমের দরজার নবে হাত রেখে ঘুরাতেই দরজাটা খুলে যায়। চিত্রলেখা এখানে নেই। বেরিয়ে এসে বারান্দার ডু মারে রওনক কিন্ত এখানেও নেই তার চন্দ্রলেখা। চেকের পাতাসহ নিচে নেমে আসে সে। ড্রইং রুমে তার সঙ্গে দেখা হয় জাহানারার। তাকে দেখেই রওনক জিজ্ঞেস করে,
-চন্দ্র কোথায় খালা?
-ছোট বউ তো তার ঘরেই আছে।
-ঘরে নেই খালা। লাস্ট কখন দেখে ছিলে ওকে?
-সকালে, ভাবী…
জাহানারা বাকি কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই রওনক চেকের পাতাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-মা এটা দিয়ে আমার চন্দ্রকে চলে যেতে বলেছে তাই না?
জাহানারা মাথা নিচু করে ফেলে। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না রওনক। বেরিয়ে যেতে নিলে পেছন থেকে জাহানারা জিজ্ঞেস করেন,
-এই তো এলে আবার কোথায় যাচ্ছো?
-বউকে আনতে যাচ্ছি খালা।
রওনক চিত্রলেখাকে খুঁজতে বেরিয়ে গেলে পেছনে জাহানারা মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন, আল্লাহ আপনি সহায় হোন। মেয়েটা যেনো সহি সালামতে থাকে আপনি দেখবেন মাবুদ।
চিত্রলেখা কখন বেরিয়ে গেছে তিনি বলতেই পারবেন না। বেশ কয়েকবার গিয়ে দরজা নক করেছিলেন, খাবার জন্য ডেকেছিলেন কিন্তু চিত্রলেখা দরজা না খোলায় ফিয়ে এসেছেন তিনি। মন ভালো নেই তাই হয়ত একা থাকতে চায় ভেবে আর বিরক্ত করেননি কিন্তু এদিকে যে উনার চোখ ফাঁকি দিয়ে মেয়েটা বাড়ি থেকেই বেরিয়ে গেছে তা জাহানারা বলতেই পারবেন না। এখন আফসোস লাগছে উনার। চিন্তাও হচ্ছে চিত্রলেখার জন্য।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
সারাদিন নিজের ঘর থেকে বের হয়নি সাবা। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। এমনকি সারাদিন ঘরের দরজাও খোলেনি। কিছু খায়ওনি। সানজিদা বেগম বেশ কয়বার মেয়ের দরজায় কান পেতে ছিলেন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা শুনতে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। সারাদিন পর নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সাবা। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচেন যেন সানজিদা বেগম। এমন মেয়ের মা হয়ে বেচারি যেনো ফেঁসে গেছেন। প্রায়ই মনের ভেতর খানিকটা আফসোসের জন্ম হয়। তার পেটে থেকে জন্ম নেয়া মেয়েটা এমন ব দ হলো কেনো? উনার ছোট মেয়ে রিপা তো এমন হয়নি। ভালো মেয়ে, ভালো মানুষ হবার যত গুণ আছে সব রিপার মধ্যে বিদ্যমান। যার ছিটেফোঁটাও বড়জনের মধ্যে নেই।সাবাটা এমন কেনো হলো! দুঃখ লাগে উনার। দীর্ঘশ্বাসও আসতে চায় বুক উপচে। কিন্তু নিজের পেটে ধরা সন্তান যতই বদমেজাজি হোক না কেনো ফেলে তো দিতে পারবেন না। এত কষ্ট সহ্য করে জন্ম দিয়েছেন তো আর ফেলে দেবার জন্য নয়।
মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে সানজিদা বেগম উনার পাশে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা অল্প বয়সী কাজের মেয়ে মুক্তাকে বলেন,
-জলদি গিয়ে খাবার গরম করে টেবিলে দে।
সাবা এগিয়ে এসে মায়ের পাশে ধপাস করে বসে শরীর ছেড়ে দেয়। সানজিদা বেগম পাশ ফিরে মেয়ের মুখের দিকে তাকালে সাবাই আগে বলে,
-আমাকে কড়া করে এক কাপ কফি দিতে বলো তো।
-সে না হয় বললাম। কিন্তু তুই আমাকে বল এটা কোনো কাজ করলি তুই?
হাই তুলতে তুলতে সাবা বলে, কি করলাম?
-কি করছিস তুই জানিস না?
-কাম অন আম্মু। এসব ড্রামা বাদ দিয়ে কি বলতে চাও স্ট্রেইট বললেই পারো। আমি জানি কি জানি না সেটা তো শুনলেই বুঝতে পারবো।
ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সানজিদা বেগম বলেন,
-সারাটা দিন আমাকে এভাবে টেনশন দেয়ার অর্থ কি?
-আমি তোমাকে কখন টেনশন দিলাম? হোয়াট রাবিস আর ইউ টকিং এবাউট?
-আই এমন নট টকিং এনি রাবিস, ইউ আর ডুইং রাবিস। সারাদিন ঘরের দরজা দিয়ে বসেছিলি এটা কি আমাকে টেনশন দেয়া নয়?
-আমি আমার বেডরুমে আছি এটা নিয়ে তুমি কেনো টেনশন করবে?
-টেনশন করব না বলছিস? তোর জন্য আমি টেনশন করব না? আমি তোর মা, তোর জন্য টেনশন করব না?
-আবার ড্রামা করছো তুমি আম্মু। আমি জানতে চাইছি কেনো টেনশন করবে? এমন তো নয় যে আমি বাসার বাইরে ছিলাম আমাকে ফোনকলে পাওয়া যাচ্ছিলো না সারাদিন তাই টেনশন করেছো। এমন হলে মানতে পারতাম। কিন্তু সেটা তো নয়। আমি বাসায়ই ছিলাম সারাদিন। ইনফ্যাক্ট নিজের ঘরেই ছিলাম এরপরেও তোমার টেনশন করার কারণ কি আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু বুঝাও প্লিজ। আর বুঝাতে না পারলে কিছু বলো না।
ফস করে আবারও একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সানজিদা বেগম বলেন,
-তুই গতকাল রাতে ভাঙচুর করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলি গরম মাথায়। এরপর বাসায় ফিরে কারো সঙ্গে কোনো কথা বললি না। ভালো-মন্দ কিছু বললি না। ওখানে কি হয়েছে না হয়েছে কিচ্ছু জানালিও না। রওনক সত্যি সত্যি বিয়েটা করেছে কিনা এসব কিছু না জানিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলি। সেই দরজা সকালেও খুলিসনি। সমস্তদিন পার করে এখন বেরিয়ে এসেছিস। তোর এমন কান্ডে আমার টেনশন হবে না? টেনশন হবার মতো কিছু করিসনি তুই?
সোজা হয়ে বসে সাবা বলে, কাম অন আম্মু। আমাকে তুমি চেনো না? নিজের কোনো ক্ষতি করতে কখনো দেখেছো আমাকে? মাথা গরম হয়ে গেলে একটু ভাঙচুর করি এটা সত্যি কিন্তু নিজের ক্ষতি করার মতো মেয়ে আমি নই। আমাকে তো তুমি জন্ম দিয়েছো। এত বছর বড় করার পরেও চিনতে পারোনি? সেজন্যই বলি আমি তোমার না পাপার মেয়ে। আমার পাপাই আমাকে ভালো চিনে। তাকে দেখো তো আমাকে নিয়ে তোমার মতো অহেতুক চিন্তা করছে কিনা। সে ঠিকই চিলে আছে কারণ সে জানে তার মেয়েও চিল করছে। রাগ হবে ভাঙচুর করব মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে, ব্যস। এত টেনশন করার কিছু নেই। এত বেশি টেনশন করলে তুমি পাপার আগে বুড়ো হয়ে যাবে বুঝলে? তারপর তোমাকে আমার মা কম দাদী বেশি লাগবে দেখতে। সো তুমিও চিল করো
সানজিদা বেগম কিঞ্চিৎ রাগি রাগি দৃষ্টি করে মেয়ের দিকে তাকালে তার ঐ তাকানোকে উপেক্ষা করে সাবা বলে,
-প্লিজ এখন তুমি যাও আগে আমাকে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে দাও। শরীরটা কেমন টলছে আমার এখনো।
উঠে যাবার উদ্যোগ নিয়েও বসে রন সানজিদা বেগম। শরীর টলছে শুনে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, শরীর টলছে কেনো? তুই কি স্লিপিং পিলস নিয়েছিলি?
-না নিলে এত ঘুমালাম কীভাবে দিনভর?
-এসবের মানে কি? রওনক…
সানজিদা বেগমকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে সাবা বলে,
-রওনক যা করেছে করেছে। আপাতত ওসব নিয়ে ভাবছিনা আমি।
-তাহলে কী ভাবছিস?
-রওনককে আমার হতেই হবে। রওনক আমারই হবে বাই হুক ওর বাই কুক। ওকে আমি এত সহজে ছাড়ছি না। মিসেস রওনক জামান আমিই হবো এখন না হয় ক’দিন পরেই সই কিন্তু হবো আমিই। আমার পছন্দের জিনিস অন্য কেউ নিয়ে নিবে তা আমি বেঁচে থাকতে কোনোদিন হতে দিবো না। রওনক এই সাবার হবেই।
মেয়ের কথা শুনে সামান্য ঘাবড়ে যান সানজিদা বেগম। খানিক ধরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, কী করবি তুই?
মৃদু হেসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সাবা বলে, এখনই তোমাকে কোনো টেনশন করতে হবে না। যখন করব তখন দেখা যাবে। এখন আর কোনো কথা বলো না তো। যাও আমার কফিটা বানিয়ে আনো। আই নিড এ কাপ কফি ব্যাডলি।
সানজিদা বেগম কড়া করে দু’টো কথা বলতে চেয়েছিলেন মেয়েকে। কিন্তু এই মুহূর্তে বলে লাভ নেই ভেবে থেমে গিয়ে নিজেকে সংযত করেন। পরে এই বিষয়ে বুঝািয়ে বলা যাবে। এটা সাবার নতুন নয় অনেক পুরোনো অভ্যাস। নিজের মন মতো কিছু না হলেই সে স্লিপিং ট্যাবলেট খেয়ে মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়। কিন্তু আজ স্লিপিং ট্যাবলেট খাওয়ার চাইতে সানজিদা বেগমের বেশি টেনশন লাগছে মেয়ের কথা শুনে। এখন কেবল মাথায় এই ভাবনাই আসছে সাবা সামনে কী করবে? নিজের মেয়েকে তো তার অচেনা নয়। এই মেয়ে যে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে কি করতে পারে তা সানজিদা বেগম ভালো করেই জানেন। এসব ভেবেই মনের ভেতর আপাতত কু ডাকছে উনার। দুশ্চিন্তার ছাপ কপালে নিয়েই কিচেনে যান উনি মেয়ের জন্য কফি বানাতে। এই মুহূর্তে এক কাপ চা উনারও দরকার। মেয়ের কথাবার্তা শুনে মাথা ধরে গেছে একদম। মস্তিষ্কে চাপ পড়েছে। চা খেলে যদি এই চাপ কমে কিছুটা।
একাই বসেছিল সাবা কফির অপেক্ষায়। তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হয় রিপা। তাকে কাজের মেয়েটা জানিয়েছে সাবা ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। তৎক্ষনাৎ খবরটা দিতে পারেনি নইলে রিপাও মাকে বলা সাবার কথাগুলো শুনতে পেতো। সোফায় হেলান দিয়ে চোখের উপর হাত রেখে প্রায় আধা শোয়া ভঙ্গিতে বসে শুয়ে আছে সাবা। সন্তপর্ণে এগিয়ে এসে অন্যপাশের সোফায় বসে রিপা। সে ভেবেছিল সাবা হয়ত তার আগমন টের পায়নি। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ঐ অবস্থায় বসে থেকেই রিপাকে চোখ মেলে না দেখেই সাবা বলে,
-কিছু বলতে চাইলে বলে ফেল নয়ত নিজের ঘরে যা। বিরক্ত করিস না আমাকে।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে রিপা বলে,
-তুমি রওনক ভাইয়ের আশা ছেড়ে দাও। উনাদের বিরক্ত করো না। ওদের ভালো থাকতে দাও।
ছোট বোনের কথা শুনে একদমই হকচকায় না সাবা। চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসে সে। রিপার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলে,
-কি বলতে চাইছিস?
-তুমি রওনক ভাইকে বিয়ে করার আশা ছেড়ে দেও। উনার বউটা অনেক ভালো। তার কোনো ক্ষতি করো না প্লিজ।
-তুই চিনিস নাকি মেয়েটাকে? মেয়েটা কেমন, কি করত না করত ডিটেইলস কিছু জানিস পাস্ট সম্পর্কে? আমাকে বল তো সব শুনি। মেয়েটার কি আগে কোনো বয়ফ্রেন্ড-ট্রেন ছিল নাকি? একটু ডিটেইলস বল তো যা জানিস।
সাবার কথা শুনে ভরকে যায় রিপা। সে কি বলতে চাইলো আর সাবা তাকে কি জিজ্ঞেস করছে। নিজেকে সামলে নিয়ে রিপা বলে,
-আমি কীভাবে চিনবো? আমি চিনি না রওনক ভাইয়ের বউকে।
-না চিনলে জানলি কীভাবে মেয়েটা ভালো?
-উনাকে নাই চিনতে পারি কিন্তু রওনক ভাইকে তো চিনি। ভালো মেয়ে না হলে কি রওনক ভাই বিয়ে করতো নাকি? যাকে নয় তাকে কি রওনক ভাই নিজের বউ বানাবে?
-তার মানে বলতে চাইছিস আমি ভালো মেয়ে নই তাই রওনক আমাকে বিয়ে করেনি।
-সেটা আমার চাইতে তুমি ভালো জানো আপু।
সাবার এই মুহূর্তে একদম রিপার সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে এমনিতেই মনে মনে ছক কষতে ব্যস্ত তাই এই মুহূর্তে কারো সঙ্গেই কোনো ধরনের তর্কে জড়ানোর মুড নেই তার। তাই আর এই প্রসঙ্গে কথা না টেনে বরং কথার ইতি টানতে সাবা বলে,
-তোর কথা শুনতে ভালো লাগছে না। আমার সামনে থেকে উঠে যা, গেট লস্ট।
রিপাও তর্কে জড়ায় না। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে বিনাবাক্যব্যয়ে। কিন্তু চলে যাবার আগে আরেকবার বলে,
-যা বললাম মাথায় রেখো। ওরা বিয়ে করে সুখে আছে, ওদের সুখে থাকতে দাও। কারো কোনো ক্ষতির কারণ হয়ও না। ওদের ভালো থাকতে দাও।
সাবাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই প্রস্থান করে রিপা। পেছনে সাবা আবার আগের ভঙ্গিতে শুয়ে বসে চোখ ঢাকে হাতে। রওনককে সে এত সহজে ছাড়বে না। যেকেনো মূল্যে সে রওনকের বউ হয়েই ছাড়বে। তার রওনককে চাই-ই চাই। সেজন্য হাজারটা মেয়েকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার আগে দু’বার ভাবার অবকাশ নেই তার।
চিত্রলেখা ও আফিফা কথা বলছিল। আচমকাই পরপর তিনবার এক নাগাড়ে কলিংবেল বেজে ওঠায় সতর্ক হয় দু’জনেই। এই সময় আফিফার বাসায় আসার মতো কেউ নেই। আফিফার বর শান্ত থাকে চট্টগ্রাম। এখানে আফিফা তার শাশুড়ি ও ৬ মাসের বাচ্চা নিয়ে থাকে। পরপর কয়েকবার কলিংবেল বাজায় আফিফা দরজা খোলার জন্য উঠতে নিলে তার হাত ধরে বাঁধা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-দাঁড়া আমি দেখি।
-আমি দেখছি তো।
-বললাম তো আমি দেখি।
চিত্রলেখা আর আফিফার আপত্তি শুনে না। বিছানায় থেকে নেমে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতেই দরজার দিকে আগায়। পীপহোলে চোখ রেখে সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা খুলে দেয় সময় বিলম্ব না করে। চিত্রলেখা দরজা খুলে দিয়ে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে বিস্মিত কন্ঠে যেই বলে,
-আপনি!
রওনক এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তার চন্দ্রলেখাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তার কান্ডে একদম বোকা বনে যায় চিত্রলেখা। এমন কিছুর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। রওনক এই পর্যন্ত চলে আসবে তার জন্য সেটাই তো আশা করেনি সেখানে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। রওনক কোনো কথা বলে না। নিঃশ্চুপ আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে কেবল প্রিয়তমাকে। রওনকের বুকের ধুক ধুক কম্পন চিত্রলেখা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। এতখানি কাছাকাছি আছে দু’জনে যে একে-অপরের প্রতিটা হৃৎস্পন্দন টের পাওয়া যাচ্ছে।
চলবে…