মাতাল হাওয়া পর্ব-৫০+৫১

0
545

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

শেষরাতে চিত্রলেখার ঘুম হয়েছে ছাড়া ছাড়া। হয়ত জায়গা পরিবর্তনের জন্য এমনটা হয়েছে। হুট করে জায়গা পরিবর্তন হয়ে এডজাস্ট হতেও খানিকটা সময় লাগে। প্রথমে অবশ্য গভীর ঘুম হয়েছিল তার কিন্তু মাঝরাতে যে অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে এরপর চিত্রলেখার চোখের পাতায় ঘুম নামতে সময় লাগাটা স্বাভাবিক ব্যাপারই। অবচেতনে বারবার মনে হয়েছে এই বুঝি রওনক আবার তাকে নিজের আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল তাদের মাঝে। এই আতংকেই চিত্রলেখার ঘুম আর গাঢ় হয়নি। কারো বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়াটা টের পেয়েছে চিত্রলেখা। কিন্তু তৎক্ষণাৎই চোখ মেলে তাকায়নি সে। বুঝতে পারে রওনক উঠেছে হয়ত। এই ঘরে এমনিতেও তারা দুইজন ব্যাতীত আর কেউ নেই। সকাল সকাল নববিবাহিতের ঘরে অন্য কারো আসার কথাও না। রওনক বাথরুমে ঢুকে গেছে টের পেয়েই চোখ মেলে তাকায় চিত্রলেখা। রুমের লাইট এখনো নিভানো। পাশ ফিরে দেখে তার ধারণাই ঠিক, রওনক উঠে গেছে। সময় দেখার জন্য মোবাইল হাতে নিলেই দেখে ভোর ৬টা বাজে। চিত্রলেখার ঘুম পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে আজ আর এখন ঘুম আসবে না বেশ বুঝতে পারছে অবশ্য আর চেষ্টাও করে না সে ঘুমাবার। পিঠে বালিশ দিয়ে উঠে বসে। বেশ কিছুক্ষণ পর টাওয়ালে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে রওনক। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,

-আমি কি তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম?

স্নিগ্ধ রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে যেনো চিত্রলেখা। এত কাছ থেকে এর আগে কখনো কাউকে দেখা হয়নি তার। চিত্রলেখার মন তাকে বারবার জানান দেয় সামনে বসে থাকে এই সুপুরুষ একান্তই তার ব্যাক্তিগত। এই মানুষটার উপর একচ্ছত্র তার অধিকার। স্থির নয়নে রওনককে দেখতে ব্যস্ত চিত্রলেখার মুখের সামনে তুড়ি বাজায় রওনক। আচমকা শব্দে দৃষ্টির স্তব্ধতা কাটে চিত্রলেখার। নিজের কাজেই লজ্জা পেয়ে যায় সে। থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বললেন?

মৃদু হাসে রওনক। চিত্রলেখার কপালের উপর চলে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,

-আমার জন্য তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো বুঝি?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। মুখে বলে, আমার তো সকাল সকালই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। সকালের নাস্তা বানানো, দুপুরের রান্না করা কত কাজ থাকে এই সময় আমার।

রওনক যেনো আরেকটু কাছ ঘেষে বসলো। চিত্রলেখার কানের নিচে হাত রেখে স্পর্শ করে বলল,

-অভ্যাস পরিবর্তন করো। এখন আর তোমাকে সকাল সকাল উঠতে হবে না। আরাম করে ঘুমাবে যতক্ষণ তোমার মন চাইবে। কেউ কিচ্ছু বলবে না। এইবাড়িতে কারো সাহস নেই আমার বউকে প্রশ্ন করে।

-আর আপনার মা?

প্রশ্নটা ইন্টেনশনালি করেনি চিত্রলেখা। মুখ ফোঁসকে বেরিয়ে গেছে। রওনক স্বাভাবিক থেকেই জবাব দেয়,

-মাকে আমি সামলে নিবো। তাছাড়া কিছুদিন গেলেই দেখবে সে তোমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছে। তোমাকে চিনতে শুরু করলে, জানতে শুরু করলেই ভালোবেসে ফেলবে।

চিত্রলেখা ভাবলেশহীন চাহনি করে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবে, “আসল মানুষটার ভালোবাসাই তো কখনো আমার ভাগ্যে ঝুটবে না তাহলে অন্যরা আমাকে ভালোবাসলো কি বাসলো না তাতে কি আসে যায়?”

চিত্রলেখাকে ভাবলেশহীন তাকে থাকতে দেখে বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে, কি ভাবছো এতো?

-হ্যাঁ!

-কি ভাবছো এতো?

-না, কিছু ভাবছি না।

-আচ্ছা ঠিক আছে থাকো তাহলে আমি বের হচ্ছি।

-এত সকালে কোথায় যাচ্ছেন?

-দুটো রাউন্ড মেরে আসি। এই বডিটা তো এমনি এমনি বিল্ড হয়নি। মেইনটেইন করা লাগে তো। এমনি দিন জোগিং এর পর জিমে যাই আজ জিম যাবো না কয়টা রাউন্ড দিয়েই চলে আসবো। তুমি ততক্ষণে আরেকটু ঘুমিয়ে নাও। ইউ উইল ফিল ফ্রেশ।

চিত্রলেখা লক্ষি মেয়ের মতো শান্ত ভঙ্গিতে রওনকের কথা শুনে মাথা ঝাঁকায়। বউকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই এগিয়ে গিয়ে কপালে চুমু খায় সে। আচমকা রওনকের চুমু খাওয়ায় চিত্রলেখার চোখ বড় হয় তা দেখে রওনক বলে, আমার খুব বেশি হলে এক ঘন্টা লাগবে। এসে তোমার হাতে এককাপ চা খাবো, বানিয়ে রেখো প্লিজ।

চিত্রলেখা মুখে কিছু বলতে পারে না। কেবল মাথা ঝাঁকায়। তবে মনে মনে ভাবে “এই চায়ের জন্যও বুঝি আমাকে বিয়ে করেছেন।” রওনক মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়। যাবার আগে তার হাতের ভেজা টাওয়ালটা চিত্রলেখার হাতে দিয়ে বলে,

-রেখে দিও।

চিত্রলেখা ওখানেই বসে থেকে রওনকের যাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।

চিত্রলেখাকে রান্নাঘরে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাহানারা। এগিয়ে এসে মমতাময় আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় আদরের রওনক বধূকে। ব্যস্ত হয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চিত্রলেখাকে বসিয়ে দিয়ে বলেন,

-তুমি আসতে গেলে কেন? আমাকে আওয়াজ দিলেই তো হতো। কিছু লাগবে মা তোমার?

চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে জাহানারা জোরপূর্বক আবার বসিয়ে দেয়। বসে থেকেই চিত্রলেখা বলে,

-আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না আমার জন্য। আমার কিছু লাগবে না। আমি শুধু উনার জন্য চা বানাতে এসেছি।

-রওনকের জন্য?

মাথায় ঝাঁকায় চিত্রলেখা। জাহানারা বলে,

-চা তো বানানো হচ্ছে তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। রান্নার কাজের জন্য লোক আছে। তুমি শুধু আরাম করো।

-না না আমিই বানাবো। উনি আমার হাতে বানানো চা খাবেন বলে গেছেন। আমি বানাই প্লিজ। কোথায় কি রাখা আছে আমাকে দেখিয়ে দিলেই হবে। আমি নিজেই বানাতে পারবো।

জাহানারা আর কথা বাড়ায় না। নিজে পাশে দাঁড়িয়ে চাপাতি, দুধ, চিনি এগিয়ে দেয়। চিত্রলেখা খুব যত্নের সাথে চা বানায়। চা বানাতে বানাতেই জাহানারার সঙ্গে কথা হয় তার। টুকটাক সবার সম্পর্কে কমবেশি বলেন জাহানারা। শুধু চা বানিয়েই ক্ষ্যান্ত দেয় না চিত্রলেখা। জাহানারার সঙ্গে নাস্তা বানানোতেও হাত লাগায়। অন্য আরো দু’জন কাজের লোক আছে যারা কেবল রান্নার কাজই করে। জাহানারা কেবল দেখাশুনা করে। তাকেও নিজের হাতে কিছু করতে হয় না তেমন একটা। তার দায়িত্ব কাজের লোকেরা ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা সেটা খেয়াল রাখা। সবাইকে দিয়ে কাজ করানো, সবার সবকিছু ঠিক মতো হচ্ছে কিনা সবকিছু তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব জাহানারার। নাস্তা বানানো কাজে হাত লাগাতে লাগাতে রওনকের কি পছন্দ না পছন্দ জেনে নেবার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। প্রকাশ না করলেও চিত্রলেখা মনেপ্রাণে নিজেকে রওনকের বউ মেনে নিয়েছে তা সে মুখে স্বীকার করুক বা না করুক।

তানিয়া নিজের ঘরে অফিসে যাবে বলে তৈরি হয়ে কিছু ফাইল ঘাটছে। নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে রাদিন। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আজ অফিস যাবে তুমি?

রাদিনের শব্দ পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয় তানিয়া। আগে অবশ্য যেদিন রাদিন বাসায় ফিরতো তানিয়া অফিস স্কিপ করতো প্রিয়তমকে সময় দেয়ার জন্য। কিন্তু এখন আর আগের মতো কিছু নেই তার জীবনে। কাজ করতে করতে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-কিছু লাগবে তোমার? এই ঘরে তো তোমার কিছু নেই।

-আমার কি এই ঘরে আসার পারমিশন নেই?

-এই ঘরে তো তোমার কিছু নেই। প্রয়োজন না থাকলে এই ঘরে এসে তোমার কি কাজ বলো?

রাদিন বুঝতে পারে না হঠাৎ তানিয়ার কি হলো? এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। তানিয়া বিছানায় বসে থেকে ফাইল ঘাটতে থাকলেও রাদিনকে ঠিকই লক্ষ করেছে। তানিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে রাদিন জিজ্ঞেস করে,

-কী হয়েছে তোমার?

-কিছু কি হবার কথা?

-গতকাল আসার পর থেকে দেখছি তুমি কেমন আনইউজুয়াল বিহেভ করছো।

-সেটা কেমন?

-এজ ইফ আই এম নট ইউর হাজবেন্ড।

ফাইল হাত থেকে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় তানিয়া। রাদিনের চোখেচোখ রেখে বলে,

-তুমি কি আসলেই আমার হাজবেন্ড?

-কি বলতে চাও? আমি তোমার হাজবেন্ড নই? কাম অন তানিয়া হোয়াট হেপ্পেন টু ইউ? স্পিকআপ।

-আমি আর এই লোকদেখানো সম্পর্কটা বয়ে বেড়াতে চাই না রাদিন। ইটস হাই টাইম উই শুড গেট সেপারেট। যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই এমন একটা ভিত্তিহীন সম্পর্কে অহেতুক একে-অপরকে আটকে রাখার কোনো মানেই হয় না। অন্তত আমি চাই না আর এমন সম্পর্কে আটকে থাকতে।

-তাহলে কি চাও তুমি?

-আমার অলরেডি এডভোকেটের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে রাদিন। তুমিসহ একদিন গিয়ে ডিভোর্সের সবকিছু ফাইনাল করে ফেলবো।

-হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ডিভোর্স তানিয়া?

-ডিভোর্সের মানে নিশ্চয়ই তুমি জানো। আমাকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করতে হবে না।

রাদিনের আচমকা কি হলো সে তানিয়ার বাহু চেপে ধরে শক্ত করে। দাঁত চিবিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবে?

-অবশ্যই দিবো। তোমার সঙ্গে এক সংসারে থাকার মতো আর কোনো সম্পর্ক আমাদের মাঝে অবশিষ্ট নেই রাদিন।

-মানে!

তানিয়া এক মুহূর্ত সময় নেয়। এভাবে ভনিতা করতে ভালো লাগছে না তার। তাই এসব ভনিতা, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা বাদ দিয়ে সরাসরি বলে।

-শুনো রাদিন আমি তোমার সঙ্গে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কথা বলতে পারবো না। তাই অন দ্যা পয়েন্ট বলছি তুমি যতই আড়াল করতে চাও না কেন সত্য সারাজীবন আড়ালে থাকে না। সত্যকে চাইলেই আড়াল করে রাখা যায় না। একদিন না একদিন সত্য তার আত্ম প্রকাশ করবেই। আমি জানি তোমার পুরোনো প্রেমিকা আবার তোমার জীবনে ফিরে এসেছে। এমনকি তুমি তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাতার প্লান করছো। আমি কেবল তোমার পথটা সহজ করে দিচ্ছি আর কিছু না। তোমার লাভ লাইফে আমি বাঁধা হতে চাই না। যে আমাকে ভালোবাসে না সম্পর্কের দোঁহাই দিয়ে তাকে আটকে রাখার মতো দূর্বল আমি নই। তাছাড়া তোমার দয়া দেখানো সম্পর্কটাও আমি চাই না। তুমি ভেবেছিলে দয়া করবে আমাকে। এখানে তোমার স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে থাকবো আর তুমি অন্যদিকে কাজের নাম করে প্রেমিকাকে নিয়ে ভিনদেশে নতুন করে সংসার সংসার খেলবে। কিন্তু আই এম সরি রাদিন ডিয়ার, তোমার এই লোকদেখানো দয়াটা আমি নিতে পারছি না। এতটূকু দূর্বল আমি নই যে আমাকে তোমার পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। বরং তুমি লোকচক্ষুর, লোকে কি বলবে এই ভয়ে যে কাজটা করতে পারছো না আমি সেটাই করবো। তোমাকে এই সংসার নামক যাযাবরের জীবন থেকে মুক্তি দিবো। আমি চাই তুমি মুক্ত হয়ে জীবন যাপন করো।

তৎক্ষণাৎ রাদিনের মুখে কথা কুলায় না। সে তানিয়ার বাহু ছেড়ে দিয়ে পাশে বিছানায় বসে পড়ে ধপাস করে। তানিয়া নিজেই বলে,

-সত্য এমনই রাদিন। হয় মানুষকে ভেঙ্গে ফেলে নয় শক্ত করে দেয়। তুমি হয়ত ভাঙবে না, তোমার মতো মানুষেরা ভাঙে না। তুমি, তোমরা কেবল অন্যদের ভাঙতে জানো। কিন্তু আফসোস আমি ভেঙ্গে যাইনি। তোমার এই সত্যটা আমাকে শক্ত করে দিয়েছে ততখানি যতখানি তুমি ভাবতেও পারবে না।

-তোমাকে রওনক বলেছে এসব তাই না?

-তোমার নিজের ভাইকে তুমি ততটুকু চিনো না যতটুকু আমি চিনি, জানি। রওনক মুখপাতলা মানুষদের মতো নয় যে একটা কিছু জানলো, দেখলো আর ওমনি বলে দিলো। বরং শুরু থেকে সব জেনেও সে আমাকে কিছু জানায়নি। জানিয়েছে তবে যখন জানানোর প্রয়োজন হয়েছে তখন। কিন্তু ও জানানোর অনেক আগে থেকেই বিষয়টা আমি জানি। তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্তটা একান্তই আমার। এখানে রওনক কেনো অন্যকারো কোনো হাত নেই। অনেক আমি তোমার কথা ভেবেছি, সংসারের কথা ভেবেছি, এখন একটু নিজের কথা ভাবতে চাই যা তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে ভাবতে পারিনি, আসলে ইচ্ছা করেই ভাবিনি। কিন্তু এখন আমি নিজেকে প্রায়োরিটি দিতে চাই। নিজের জন্য বাঁচতে চাই।

-নিজেকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে বাচ্চা দুটোর কথা ভুলে যাচ্ছো তুমি। আমরা আলাদা হয়ে গেলে ওদের কি হবে একবার ভেবেছো? এত সেলফিশ হয়ে গেলে তুমি?
-একদম আমার দিকে আঙ্গুল তোলার চেষ্টা করবে না। তুমি নিজে ওদের কথা ভাবোনি। আমি মা বলে সব আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে তুমি বেঁচে যাবে ভাবছো? ওদের কথা ভাবা যতটা আমার দায়িত্ব ততটা তোমারও। কই তুমি তো ওদের কথা ভাবোনি। তাহলে আমি কেন ভাববো?

-আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আমার ছেলেমেয়েদের কথা ভাবতে হবে না। আমার বাচ্চাদের আমি সামলে নিবো।

এমন সিরিয়াস কথাবার্তার মধ্যেও রাদিনের কথা শুনে হেসে ফেলে তানিয়া। সে হাসতে চায়নি মূলত রাদিনের কথা শুনে বেফাঁস হাসি বেরিয়ে গেছে তার। হেসে নিয়ে তানিয়া বলে,

-তুমি সামলাবে বাচ্চাদের? রিয়েলি রাদিন! তোমার ছেলেমেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ে, কোন সেকশনে পড়ে সেটা জানো তুমি? ওদের ক্লাস টিচারকে চিনো? স্কুলের ফোন নম্বর আছে তোমার কাছে? স্কুল বাদে ওরা কে কোন ধরনের এক্টিভিটি ক্লাস করতে যায় সেসব জানো? তুমি কি জানো তোমার দুই ছেলেমেয়ের একজনেরও আর্ট করতে ভালো লাগে না। ওদের পেইন্ট করতে ভালো লাগে না। ওদের ধারণা তুমি পেইন্ট করো বলেই আমাদের সময় দাও না, আমাকে সময় দাও না, ওদেরকে সময় দাও না। ওদের কোনো প্যারেন্টস মিটিংয়ে তুমি যাও না। ওরা মনে করে তুমি পেইন্ট না করে ওদের চাচার মতো ব্যবসা করলে, আমার মতো অফিস করলে অন্তত দিনশেষে বাসায় ফিরে ওদের সময় দিতে, উইকেন্ডে ওদের নিয়ে ঘুরতে যেতে যেমনটা বাবা না হয়েও রওনক করে সবসময়। রওনক তার হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও অন্তত দু’ঘন্টা সময় হলেও তোমার ছেলেমেয়ের জন্য বরাদ্দ রাখে অথচ তুমি নিজেকে দেখো নিজের ছেলেমেয়ে সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়াই নেই। কীভাবে থাকবে? তুমি তো ব্যস্ত নিজের প্রেম, পরকীয়া নিয়ে। আমাকে বাদ দাও তোমার তো নিজের মা, নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকানোর সময়টাও নেই আর সেই তুমি আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো? ছেলেমেয়ে সামলাবে বলে চ্যালেঞ্জ করছো! হাস্যকর রাদিন, যেটা তুমি করতে পারবে না সেটা বলাও উচিত না। আমার ছেলেমেয়ের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের ডিভোর্সের পরে মীম, মিশকাতের দায়িত্ব আমিই পাবো। আমি অলরেডি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমার ছেলেমেয়ে কোথায় থাকবে, কার কেয়ারে থাকবে। রওনক চাচা হয়েও যতখানি ওদের বাবা হতে পারবে তুমি বাবা হয়েও তা পারবে না। তোমাকে ওদের কথা ভাবতে হবে না। আমার ছেলেমেয়েদের চিন্তা করতে আমি এখনো বেঁচে আছি রাদিন।

রাদিন উঠে দাঁড়ায়। তানিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,

-তুমি বলতে চাইছো আমার বর্তমানে আমার ছেলেমেয়ের দায়িত্ব রওনক পালন করবে?

-অবশ্যই পালন করবে। তুমি আমাদের জীবনে থেকেও তো বিশেষ লাভ হচ্ছে না। আমাদের ডিভোর্সের পর তোমার থেকে আমি তেমন কোনো আশা রাখছি না। তুমি বরং আমাদের কথা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবো। আমাদের ডিভোর্সটা যে তোমার জন্য খুব ভালো কিছু বয়ে আনবে না সেটা হয়ত এখনই আন্দাজ করতে পারছো। তাই এসব বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবো তুমি।

রাদিন আরও কিছু বলার জন্য মুখ খোলে কিন্তু তানিয়া আর তাকে কিছু বলার সুযোগ দেয় না। বাঁধা দিয়ে নিজেই বলে, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি রাদিন। এখন আর তোমাকে সময় দিতে পারছি না। তোমার কিছু লাগলে জাহানারা খালাকে বলো উনি ব্যবস্থা করে দিবেন। আজকাল আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরশুর এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখবো, তুমি সময় বের করে রেখো। আমাদের যেহেতু সরাসরি কথা হয়েই গেলো আমি আর ডিভোর্সিটা হোল্ডে রাখতে চাই না। তোমার থেকে যত জলদি সম্ভব মুক্তি চাই আমার। আমার জীবনের আর একটা মুহূর্তও আমি আর তোমার পেছনে অপচয় করতে রাজি নই। আমার জীবনটা এখন থেকে শুধুই আমার, আমার ছেলেমেয়ের। এখানে তোমার আর কোনো জায়গা নেই।

তানিয়া আর সুযোগ দেয় না রাদিনকে কিছু বলার। বিছানায় ছড়িয়ে থাকা ফাইলগুলো চাপিয়ে রেখে বেরিয়ে যায় সে। রাদিন ওখানেই থম ধরে দাঁড়িয়ে রয়।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

নাস্তা তৈরি হয়েছে কিনা দেখানার জন্য কিচেন আসতেই তানিয়া দেখে জাহানারার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে চিত্রলেখা। সকাল সকাল চিত্রলেখাকে কিচেনে দেখে টিটকারির সুরে তানিয়া বলে,

-সকাল সকাল নতুন বউয়ের বর রেখে কিচেনে কি করা হচ্ছে?

তানিয়ার কন্ঠ পেয়ে চিত্রলেখার সঙ্গে সঙ্গে জাহানারাও পেছন ফিরে তাকায়। জা এর কথা শুনে চিত্রলেখার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায় তৎক্ষণাৎই। জাহানারা কিছু বলেন না কেবল মুখ টিপে হাসেন। এগিয়ে এসে চিত্রলেখার চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরের দিকে তুলে তানিয়া আরও বলে,

-বাহ! চোখ-মুখে তো এখনো রাতের আবেশ মাখামাখি হয়ে আছে দেখছি। বর বুঝি খুব আদর দিয়েছে রাতভর।

ইতস্ততকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় চিত্রলেখা। এভাবে কেউ কখনো লজ্জা দেয়নি তাকে। আমতা আমতা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলার চেষ্টা করে,

-কি যে বলেন না ম্যাম!

-ওমা! ম্যাম বলছো কাকে? এখানে তোমার ম্যাম কে?

-আপনি!

-আমি তোমার ম্যাম হতে যাবো কেন ভাই? জা কে কেউ ম্যাম বলে ডাকে নাকি?

-না মানে আসলে এতদিনের অভ্যাস, অফিসে তো ম্যাম বলেই ডাকি।

-অফিসে ডেকেছো বলে কি বাসায় ডাকবে নাকি? মাথা কি খারাপ হয়েছে নাকি? ভাসুরের বউকে কেউ ম্যাম বলে? আর যেন না শুনি এসব ম্যাম ট্যাম ডাকতে।

-তাহলে কি ডাকবো আপনিই বলে দিন।

-অবশ্যই তোমার বর যা ডাকে তাই ডাকবে।

-সে কি ডাকে আমি তো জানিনা।

হেসে ফেলে তানিয়া, স্বচ্ছ ও মন খোলা হাসি। হাসি সামলে বলে,

-ভাইয়ের বউকে তো সবাই ভাবীই ডাকে। রওনকও তাই ডাকে, তুমিও নাহয় ডেকো।

মুখে কিছু বলে না চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাঁকায়। এগিয়ে এসে আগ্রহ ভরে তানিয়া আবার জিজ্ঞেস করে,

-তা কি করা হচ্ছে শুনি?

চিত্রলেখা কিছু বলার আগে পাশ থেকে জাহানারা বলেন,

-আমি এত করে না বললাম কিন্তু শুনলোই না আমার কথা। বলে কিনা রওনকের জন্য নিজে চা বানাবে।

-না করছো কেন খালা? নিজের বরের জন্য বানাতে চাইলে অবশ্যই বানাবে। শুনেছি তুমি নাকি পৃথিবীর সবচাইতে বেস্ট চা বানাও। এক কাপ আমাকেও দিও খেয়ে দেখবো কেমন খেতে তোমার হাতের ওয়ার্ল্ড বেস্ট চা।

চিত্রলেখার মুখে কথা কুলায় না। কি বলবে ভেবে মনে মনে হিমশিম খায় সে। তানিয়া নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আর কি করছিলে?

-উনি তো জগিং করতে গেছে তাই একটু লেবুর শরবত করছিলাম।

-বাহ! স্বামীর খেয়াল রাখা হচ্ছে। বেশ ভালো। তবে শুধু খেয়ালই রেখো না সঙ্গে লাগামটাও ধরে রেখো।

তানিয়ার কথার আগামাথা বুঝে না চিত্রলেখা। আপাতত এইসব বিষয়ে কথা বাড়ায় না দু’জনের একজনও। জাহানারার উপস্থিতিতে সমস্যা না থাকলেও অন্যান্য কাজের লোকেরা আশেপাশেই আছে তাই এইমুহূর্তে এসব কথা বলার উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ এটা নয় ভেবেই আর এই প্রসঙ্গে কেউ কিছু বলে না।

তানিয়া আরও বলে,

-তুমি তোমার বরের জন্য নাস্তা বানাও আমি যাই দেখি মীম, মিশকাত স্কুলের জন্য তৈরি হয়েছে কিনা।

আচমকাই মীম, মিশকাতের কথা শুনতে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে চিত্রলেখার নিজের ভাইবোনদের কথা মনে হয়ে। এতদিন তো সে নিজেই ভাইবোনগুলোর সকল বিষয়ের খেয়াল রেখেছে। আজ থেকে তো সে আর নেই ওদের সবকিছুর খেয়াল রাখতে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে তার। বিশেষ করে চারুর জন্য। চারুটা এমনিতে বড়দের মতো ভাব নেয়, ফটর ফটর কথা বলে, পাকামোও করে বেড়ায় কিন্তু নিজের যেকোনো কাজের সময় তার বড়বোনের সহায়তা চাই। বড়বোনকে ছাড়া কোনো কাজই করতে পারে না সে। চিত্রলেখা তাড়া না দিলে স্কুলের জন্য তৈরি হতে মন চায় না চারুর। কোনো কাজও করতে ইচ্ছা হয় না। অথচ আজ থেকে চারুকে নিজের সব কাজ একাই করতে হবে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে লিখন, চয়নের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তার আচমকা চলে আসায় চারুটা বুঝি হুট করেই বড় হয়ে যাবে। কিন্তু চিত্রলেখা কখনো চায়নি চারুটা তার মতো করে দায়িত্বের যাতাকলে পড়ে বড় হয়ে যাক। অথচ চিত্রলেখা না চাইলেও এমনটাই হবে।

তানিয়া কিচেন থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে চিত্রলেখা বাঁধা দিয়ে বলে,

-আমি আসি আপনার সাথে? ওদের সঙ্গে তো আমার এখনো দেখা হলো না।

-নাস্তার টেবিলে দেখা হবে। এখন যা করছিলে করো, রওনক চলে আসবে যেকোনো সময়। আগে বর পরে সব।

তানিয়া কিচেন থেকে বেরিয়ে ছেলেমেয়েদের ঘরে যাবার জন্য উপরে যেতে নিলেই রওনকের আগমন ঘটে। দেবরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে তানিয়া। দেবরের লেগপুল করতে বলে,

-তোমার তো কপাল খুলে গেলো রওনক।

-হঠাৎ এই কথা বলছো যে ভাবী?

-বউ সকাল সকাল চা বানাচ্ছে দেখে এলাম।

-চন্দ্র কোথায়?

-কিচেনে, তোমার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে।

-আই সি, তাহলে তো গিয়ে দেখে আসতে হচ্ছে কি বানানো হচ্ছে আমার জন্য।

-যাও গিয়ে দেখে আসো। পরম সৌভাগ্য তোমার।

চিত্রলেখা রওনকের জন্য লেবুর শরবত বানাতে ব্যস্ত। সন্তপর্ণে কিচেন প্রবেশ করে রওনক যেন বউ টের না পায়। তাকে দেখে জাহানারা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলে রওনক আগেই ইশারা করে যেনো কেউ কোনো কথা না বলে। ইশারা করে সবাইকে বেরিয়ে যেতে। চিত্রলেখাকে বুঝতে না দিয়ে বেরিয়ে যায় জাহানারা। তার সঙ্গে অন্য দু’জন কাজের লোকও বেরিয়ে যায় ইশারায়। আচমকা এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রওনক। একমুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে যায় চিত্রলেখা। কিন্তু তৎক্ষণাৎই আবার সামলে নেয় নিজেকে। রওনক মুখ বাড়িয়ে চিত্রলেখার কাঁধের উপর রেখে জিজ্ঞেস করে,

-কী করা হচ্ছে এত মনোযোগ দিয়ে?

ঘাবড়ে গিয়ে একমুহূর্তের জন্য চুপ করে রয় চিত্রলেখা। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ভয় পেয়েছো বুঝি?

-ভয় পাবো না? এভাবে জড়িয়ে ধরে কেউ? আমি তো ভাবলাম কে না কে।

চিত্রলেখাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চিবুক স্পর্শ করে মুখটা উপরে তুলে রওনক বলে,

-কার এতবড় সাহস আমার বউকে জড়িয়ে ধরে। তাও আমার বর্তমানে। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা শুনি? দুনিয়া থেকে গায়েব করে দিবো না।

চিত্রলেখা চুপ করে রয়। রওনক তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়ায় ঘর্মাক্ত রওনককে দেখে চিত্রলেখার মুখে আর কথা কুলায় না। রওনকের কপাল জুড়ে থাকা ঘাম যেনো তার সৌন্দর্য্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চিত্রলেখা নিজের অজানতেই তার ওড়নার আঁচল টেনে রওনকের কপাল জুড়ে থাকা ঘাম মুছে দেয়। রওনক চিত্রলেখাকে চমকে দিয়ে তার গালে একটা চুমু খায়। এতে চিত্রলেখার গাল লাল হলো, চোখে লজ্জার বাহার নেমে এলো। লজ্জায় লজ্জাবতি গাছের মতো নুইয়ে আসতে চাইলো যেনো বেচারি।

নাস্তার টেবিলে বাড়ির অন্য সবার সাথে দেখা হয়েছে চিত্রলেখার। মীম, মিশকাতের আগ্রহের শেষ নেই চিত্রলেখাকে নিয়ে। রওনককে ওরা ছোট পাপা বলে ডাকে তাই চিত্রলেখাকে কি বলে ডাকবে সেটা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই দু’জনের। রওনক বলেছে ওরা যা ইচ্ছা ডাকতে চায় ডাকতে পারে। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিমি বলে ডাকবে চিত্রলেখাকে। রাদিনের সঙ্গেও কুশল বিনিময় হয়েছে চিত্রলেখার কিন্তু একমাত্র দিলারা জামানই কোনো কথা বললেননি। নাস্তার টেবিলে চিত্রলেখার হাতে বানানো চা খেয়ে সবাই প্রসংশা করেছে। রওনক পরপর দুই কাপ চা খেয়েছে। এমনকি নাস্তার পর উপরে যাবার সময় জাহানারাকে বলে গেছে কাউকে দিয়ে আরেক কাপ চা উপরে পাঠিয়ে দিতে। তার বউয়ের হাতে বানানো চা বলে কথা এক কাপ খেয়ে পোষায় না।

নিজের ঘরে এসে তৈরি হয়ে নেয় রওনক। চেঞ্জিং রুম থেকে টাই হাতে বেরিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। টাইটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-টাই বাঁধতে পারো?

-কখনো বাঁধা হয়নি।

-ট্রাই করে দেখো, আমি বলে দিচ্ছি কীভাবে বাঁধতে হয়।

চিত্রলেখা আপত্তি করে না। রওনকের বলে দেয়া মোতাবেক টাই বেঁধে দেয়। প্রথম চেষ্টায় ঠিকঠাকই বাঁধতে পেরেছে সে। টাই বাঁধা ঠিক হওয়ায় রওনক বলে,

-এত সুন্দর করে টাই বেঁধে দিলে এর বিনিময়ে তো তোমাকে কিছু দেয়া উচিত।

-কি!

রওনক চিত্রলেখাকে কিছু বুঝার সুযোগ দেয় না। বুঝে উঠার আগেই আলতো ভঙ্গিতে ছোট্ট করে চিত্রলেখার ঠোঁটে চুমু খায় রওনক। ছেড়ে দিয়ে বলে,

-তোমার রিওয়ার্ড।

রওনকের কান্ডে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। তা দেখে হাসি পায় রওনকের। মৃদু হেসে বলে,

-আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি।

-কবে আসবেন?

চিত্রলেখাকে বিচলিত হতে দেখে আগের চাইতে আরও বেশি হাসি পায় রওনকের। এগিয়ে এসে বউয়ের গালে হাত রেখে বলে,

-চিন্তা করো না তোমাকে একা রেখে আপাতত আমি নিজেও বেশি সময় দূরে থাকতে পারবো না। সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসবো তোমার কাছে।

রওনকের এসব কথায় চিত্রলেখার বুকের ভেতর কি যেনো হয়। ডেউ ওঠে শিহরণের। মানুষটা এমন ভাবে বলে যেনো সে একান্তই তার ব্যাক্তিগত। রওনক নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-কোথাও যেতে চাও?

-আমি আবার কোথায় যাবো?

-ভাইবোনদের সাথে দেখে করে আসতে পারো চাইলে।

-সত্যি যাবো?

-যেতে চাইলে অবশ্যই যাবে। যখন যেখানে যেতে মন চাইবে যাবে। আমি ড্রাইভারকে বলে দিবো। আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসবে। তুমি যখন চাও বাইরে নিয়ে যাবে তোমাকে। তবে প্লিজ সন্ধ্যার আগে ফিরে এসো, আমি যেনো বাসায় ফিরেই তোমার মুখটা দেখতে পাই।

চিত্রলেখা মাথা ঝাঁকায়। রওনক আরও বলে,

-ওহ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তোমার জন্য একটা গিফট আছে।

-গিফট! আমার জন্য? কি?

-একমিনিট দেখাচ্ছি।

রওনক চেঞ্জিং রুমে গিয়ে একটা এনভেলপ নিয়ে ফিরে এসে সেটা চিত্রলেখার হাতে দিয়ে বলে,

-তোমার গিফট।

-এর ভেতর কী আছে?

-খুলে দেখো।

চিত্রলেখা এনভেলপটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা দলিল বেরিয়ে আসে। কৌতূহল নিয়ে দলিলটা চেক করে সে। চিত্রলেখার চোখ বড় হয়। দলিল পড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-এসব কী?

-পড়ে বুঝতে পারোনি কিছু?

-এটা কি করেছেন আপনি!

-কি করেছি?

-আমি না বুঝতে পারছি না কিছু।

রওনক এগিয়ে এসে চিত্রলেখার বাহু ধরে বলে,

-রিলাক্স চন্দ্র, এত ঘাড়বে যাচ্ছো কেনো?

-কিন্তু…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-ইটস জাস্ট এ লিটল গিফট ফর ইউ ফ্রম মি। আই ক্যান ডু মাচ মোর ফর ইউ।

-এসব তো আমি চাইনি।

-গিফট কি কেউ চেয়ে নেয়? আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি দিয়েছি ব্যস।

-তাও এটা…

রওনক দু’হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার গাল ছুঁয়ে বলে,

-তুমি রওনক জামানের ওয়াইফ, গেট ইউজ টু দিজ। আরও একটা জিনিস দেয়া বাকি তোমাকে।

-আবার কি!

রওনক তার মানিব্যাগ থেকে একটা ক্রেডিট কার্ড বের করে চিত্রলেখার হাতে দিয়ে বলে,

-এখন থেকে এটা তোমার। এনি টাইম ইউজ করবে, যা লাগবে কিনবে, যত খুশি টাকা তুলবে আমাকে কোনো হিসাব দিতে হবে না। আমি হিসাব চাইবোও না কখনো।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-এটা আমাকে কেনো দিচ্ছেন? এসব দিয়ে আমি কি করব?

-তোমার লাগবে তাই দিচ্ছি।

-না, আমি এটা দিয়ে কি করবো? আমার এসব কার্ড, টাকাপয়সা কিচ্ছু লাগবে না।

-লাগবে না বললেই তো হলো না। একশবার লাগবে। একটু পর ভাইবোনদের দেখতে যাবে, খালি হাতে যাবা নাকি? আমি সারাদিন থাকবো না, তোমার কিছু দরকার হলে এটা ইউজ করবে।

রওনক তার মানিব্যাগ থেকে কিছু ক্যাশ বের করে চিত্রলেখার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,

-এগুলোও হাতে রাখো কাজে লাগবে।

-এত টাকাপয়সা আমাকে কেনো দিচ্ছেন আপনি? আমার এসব চাই না বিশ্বাস করুন।

-এভাবে বলছো কেনো? আমি তো তোমার সেফটি, প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে দিচ্ছি। আমি না থাকলে তোমার যদি কিছু প্রয়োজন হয় তুমি আনিয়ে নিবে। টাকা ছাড়া কীভাবে আনাবে?

-আমার কিছু লাগবে না। এসব আমার চাই না। আপনি প্লিজ নিয়ে যান এগুলো।

চিত্রলেখা কার্ড, টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করলে রওনক ধমকে ওঠে তাকে।

-চুপ! শান্ত হয়ে আমার কথা শুনো। এমন করছো কেনো তুমি? আমার অবর্তমানে তোমার যদি কিছু প্রয়োজন হয় তখন কীভাবে ম্যানেজ করবে তুমি? তোমার যা লাগবে আমি সবই ব্যাবস্থা করে দিবো কিন্তু তারপরেও প্রত্যেকের একটা ব্যাক্তিগত নিড থাকে সেজন্যই দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো রাখো তোমার কাজে লাগবে ট্রাস্ট মি।

চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। তার কথা যে রওনকের সামনে ধোপে টিকবে না বুঝতে পেরে চুপ করে যায় সে। তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ইতস্তত সে। এভাবে রওনকের থেকে টাকা বা কার্ড নেয়াটা ঠিক লাগছে না তার। চিত্রলেখা টাকার জন্য রওনককে বিয়ে করেনি। অথচ কেউ দেখলে ভাববে টাকার জন্যই হয়ত সে রওনককে বিয়ে করেছে। এই চিন্তাটা মাথায় আসাতেই মস্তিষ্কের ভেতরটা আউলে যাচ্ছে চিত্রলেখার। রওনক হয়ত বুঝতে পারে। চিত্রলেখার বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে পায়ের উপর ভর দিয়ে নিচে বসে মুখ তুলে বউয়ের দিকে তাকায়। বলে,

-তোমার মাথার ভেতর যেসব উল্টাপাল্টা ভাবনা আসছে সব ঝেড়ে ফেলো। কে কি ভাবলো, কে কি ভাববে এসবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার জন্য শুধু তুমি ম্যাটার করো, তোমার ভালো থাকা ম্যাটার করে। সো সব ভুলে যাও।

রওনক উঠে দাঁড়িয়ে চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলে,

-আসছি, সাবধানে থেকো।

বেরিয়ে যেতে নিয়ে থেমে গিয়ে আচমকাই চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরে রওনক। এমন কান্ডে অবাক হয় চিত্রলেখা। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। রওনক চিত্রলেখার কানে বিড়বিড় করে কার্ডের পিন বলে দিয়ে আরও বলে, পিন ছাড়া কার্ড ইউজ করবে কীভাবে? আসছি, নিজের খেয়াল রেখো বউ।

ফি-আমানিল্লাহ, বলে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয় চিত্রলেখা। নিজের হাতে থাকা রওনকের দিয়ে যাওয়া কার্ড ও টাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই সঙ্গে রওনকের দিয়ে যাওয়া দলিলগুলোতে আরেকবার চোখ বুলায়। খালুর বাড়িটা চিত্রলেখার নামে কিনে নিয়েছে রওনক, এগুলো সেই বাড়ির দলিল। এখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে রায়বাজারের ঐ একতলা বাড়িরটার মালিকানা এখন থেকে চিত্রলেখার। রওনক কখন এসব করেছে ঘুনাক্ষরেও কিছু টের পায়নি সে। তাছাড়া চিত্রলেখা বাড়ি কেনার কথা কিছু বলেওনি তাকে। রওনক যে এমন কিছু করবে ভাবতেই পারেনি চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর সব কেমন তালগোল পাকিয়ে আসছে তার। কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে চিত্রলেখা, জীবন সহজ হচ্ছে না কঠিন কিছুই বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে রওনক নামক একটা গোলক ধাঁধায় আটকে আছে সে। চারিদিক কেবল অর্থবিত্ত, নামের প্রাচুর্যে ঘেরা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে