মাতাল হাওয়া পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
606

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

নিজের ঘরের কাঁথার তলায় মুখ ঢেকে শুয়ে আছে চারু। নারগিস বেগম কয়েকবার করে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকেছেন কিন্তু আসেনি। তাই বোনকে ডাকতে দুই ভাই তার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। লিখন চারুর মাথার কাছে দাঁড়িয়েছে। চয়ন দাঁড়িয়েছে পায়ের কাছটায়। চারু আপাদমস্তক কাঁথায় মুড়ানো। লেপ, কম্বল গায়ে দেয়ার মতো শীত এখনো নামেনি। ফ্যানের ভলিউম কমিয়ে মোটা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমানো যায়। আর কয়দিন পরেই হয়ত শীত তার চাদরে ঢেকে নিবে পুরোপুরি। তখন আর মোটা কাঁথায় শীত মানবে না, নামাতে হবে লেপ, কম্বল। চয়ন পায়ের কাছে কাঁথায় ছোট্ট করে টান দিয়ে বলে,

-কিরে আয় ভাত খাবি।

চয়নকে সঙ্গ দিয়ে লিখনও বলে, আয় অল্প কয়টা ভাত খাবি। কত দেরি হয়ে গেল বল তো। অল্প একটু খেয়ে তারপর ঘুমা।

চারু ওঠে না, কথাও বলে না। এমনি দিন চিত্রলেখার উপস্থিতিতে রাত ১০ টার মধ্যেই সবার খাওয়া হয়ে যেতো। আজ তার অনুপস্থিতি যেন সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। চারু কাঁথার তলায় ফুপিয়ে কাঁদছে। কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। সবসময় কথার খৈ ফুটা চারু নিজের দূর্বলতা ভাইদের দেখাতে চায় না। কিন্তু আচমকাই মায়ের মতো বড় বোনের এভাবে চলে যাওয়া পোড়াচ্ছে তাকে। চিত্রলেখা চিরকাল তাদের সঙ্গে থাকবে না এটা জানা কথা কিন্তু ঘটনাটা যে এমন আচমকা ঘটবে সেটাও ভাবেনি কখনো। বোন বিদায় দেয়ার আগে মানসিক যে প্রস্তুতিটুকু চারুর দরকার ছিল সেটুকু সুযোগও সে পায়নি। অন্তত একটাদিন আগে জানতে পারলেও হয়ত নিজেকে সামলে নিতে পারতো, নিজেকে বুঝ দিতে পারতো। কিন্তু সে সুযোগ সে পায়নি।

অনেক ডাকাডাকির পরেও চারুর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। লিখন জানে কী করলে চারু কথা শুনবে। তাই চারুকে শুনিয়ে বলে,

-চয়ন এক কাজ কর আমার ঘর থেকে মোবাইলটা নিয়ে আয়। আপাকে ফোন দিয়ে বলি চারু রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে পরছে। যা ফোনটা নিয়ে আয় তো।

বলেই চয়নকে চোখ মারে। চয়ন বুঝতে পারে এটা ভাইয়ের নাটল। সেও সঙ্গ দিয়ে বলে,

-এখনই আনতেছি।

তৎক্ষনাৎই কাঁথা থেকে বেরিয়ে উঠে বসে চারু। লিখনের একটা হাত ধরে বলে,

-আপারে ফোন দিও না ভাইয়া প্লিজ।

চারুর ফুলে লাল হয়ে যাওয়া চোখ দেখে দুই ভাই এগিয়ে এসে পাশে বসে। লিখনকে জড়িয়ে ধরে এবারে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে চারু। দুই ভাইয়ের বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হয় না বোনের কান্নার কারণ কি। তবুও চারুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে চারু কাঁদতেছিস কেন?

-তোমরা কি একদিন হুট করে আমারেও আপার মতো দূরে পাঠায় দিবা?

-না পাঠাবো। তোরে আমরা বিয়ে দিবো না।

মুখ তুলে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় চারু। কান্না স্থগিত করে জিজ্ঞেস করে,

-সত্যি বিয়ে দিবা না?

-তুই বিয়ে করতে চাইলে দিবো নাইলে দিবো না।

আবার লিখনকে জড়িয়ে ধরে চারু বলে,

-তোমরা আমারে কোনোদিন বিয়ে দিও না ভাই। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।

চারুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লিখন বলে,

-আচ্ছা দিবো না। এখন আয় ভাত খাবি।

চারু আবার মুখ তুলে বলে, আপার কি আমাদের জন্য খারাপ লাগতেছে না ভাইয়া? আপা তো বলছিল কোনো বিয়ে করবে না। আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না। এই ঘরে আপাকে ছাড়া আমি একলা কেমন ঘুমাবো? আপারে জড়ায় না ধরলে তো আমার ঘুম হয় না ভাই।

স্থগিত হওয়া চারুর কান্না আবার গতি পায়। এবার আর লিখনের মুখে জবাব কুলায় না। কি বলবে সে? তার নিজেরই তো বুকের ভেতরটা কামড়াচ্ছে। এবারে চয়ন বলে,

-আপা যদি জানতে পারে তার পিছনে আমরা তার জন্য কানতেছি তাহলে কিন্তু আপাও কষ্ট পাবে। সে তো আমাদের জন্যই বিয়ে করবে না বলছি। এখন না হয় নিজের জন্য ভাবছে। আমাদের তো উচিত আপার জন্য খুশি হওয়া। দেখবি কালকে দিনের বেলায়ই আপা দেখা করতে আসবে।

-আপার কি এখন আর আমাদের জন্য সময় থাকবে?

চয়ন এগিয়ে এসে চারুর মাথায় ছোট্ট করে গাট্টা মেরে বলে, আপার জীবনে আমাদের ৩ জনের চাইতে বেশি কেউ না। দেখবি আপা শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের কাছে ছুটে আসবে। এখন আয় ভাত খাবি।

-খুদা নাই আমার।

চারু আপত্তি করলে দুই ভাই তাকে টেনে নিয়ে যায় ভাত খাওয়াতে। চিত্রলেখা থাকতে কখনো ওদের না খেয়ে রাতে ঘুমাতে দেয়নি। চারুকে কখনো কোনোকিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। আজ তার অবর্তমানে ওরা সেই দায়িত্ব পালনেরই চেষ্টা করছে। যদিও ওদের তিনজনেই চিত্রলেখা কখনো কোনোকিছুর কমতি হতে দেয়নি। নিজের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু করার চেষ্টা করছে। খাওয়া, পরায় কমতি থাকলেও ভালোবাসা কমতি কোনোদিন হতে দেয়নি চিত্রলেখা।

শাশুড়ির প্রেসার মেপে নিজের ঘরে ফিরতেই তানিয়া দেখে তার ঘরেই বসে আছে রাদিন। তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে এসে বউয়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিন্তু তাকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে তানিয়া পাশ কেটে চলে যায়। বিছানায় গিয়ে বসে, ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে তাতে মনোযোগ দেয়। আচমকা তানিয়ার আচরণে এমন পরিবর্তনের আভাস পেয়ে অবাক না হয়ে পারে না সে। তৎক্ষনাৎই অন্যকিছু ভাবে না সে। হয়ত অল্প কিছুদিনের কথা বলে গিয়ে বেশ লম্বা সময় পর আসায় বউয়ের অভিমান হয়েছে, এমনটাই ধরে নেয় রাদিন। স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টায় রাদিন পেছন ঘুরে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো? মীম, মিশকাত কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

নিজের কাজ করতে করতেই তানিয়া জবাব দেয়।

-এখনো মীম, মিশকাতের ঘুমানোর সময় হয়নি জানো না? নাকি নিজের ছেলেমেয়েদের রুটিন অজানা তোমার?

তানিয়াকে করা কেমন আছো প্রশ্নটা যে সে সরাসরি এড়িয়ে গেল তা বুঝতে রাদিনের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আচমকা তানিয়ার ভেতরকার এই পরিবর্তনের কারণ ধরতে পারছে না। তবে সন্দেহ মনের ভেতর ঠিকই উকি দিচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে হয়ত রওনক তানিয়াকে তার ও শবনমের বিষয়টা জানিয়েছে আবার মনে হচ্ছে হয়ত জানায়নি। রাদিন এক্ষুনি আর তানিয়াকে ঘাটায় না। পরে একান্তে সময় পাওয়া যাবে। তখন নাহয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে। মান-অভিমানও ভাঙানো যাবে।

-আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

বলে যেই রাদিন চেঞ্জিং রুমের দিকে আগায় তানিয়া বলে,

-তোমার সব জিনিসপত্র আমি তোমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। এই ঘরে আর তোমার কিচ্ছু নেই।

ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে রাদিন। কপাল সামান্য কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

-আমার ঘরে! এটা কার ঘর তাহলে?

-এটা আমার ঘর।

-তোমার আমার ঘর কি আলাদা?

ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে উঠে এসে রাদিনের মুখোমুখি দাঁড়ায় তানিয়া। তার চোখের দিকে তাকিয়ে যথেষ্ট শক্ত করেই বলে,

-তুমি আমি কখনই একজন ছিলাম না। শুধু একটা সম্পর্কের বোজা বয়ে বেরিয়েছি এতকাল। এখন আর এসব লোকদেখানোর প্রয়োজন নেই।

হাত উঁচু করে দরজা দেখিয়ে তানিয়া আরও বলে,

-তোমার ঘরে তোমার সবকিছু রাখা আছে। আর কিছু লাগলে জাহানারা খালাকে বললেই হবে। নাও এক্সকিউজ মি প্লিজ, আমি জরুরী কাজ করছি।

রাদিন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে তানিয়া বলে,

-লিভ রাদিন৷ আই নিড টু ওয়ার্ক।

বাধ্য হয়েই নিজের ঘর ছাড়তে হয় রাদিনকে। এই মুহূর্তে কথা বাড়াতে চায় না সে। তার পেছন পেছন দরজার পর্যন্ত এসে তানিয়া আরও বলে,

-একটু পরেই সবাই ডিনারে বসবে যদি খেয়ে এসে না থাকো তাহলে ইউ ক্যান জয়েন।

রাদিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার মুখের উপরেই দরজাটা আটকে দেয় তানিয়া।

রওনকের বুকে মাথা রেখেই কখন যেনো চিত্রলেখার চোখের পাতায় ঘুম নেমে এসেছে। ঠিক ঘুম নয় তন্দ্রা লেগেছে। রওনক আর সরায় না যদি ঘুম ভেঙে যায় ভেবে৷ প্যান্টের পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠতে তৎক্ষনাৎই বের করে। কল রিসিভ করে কানে তুলতেই অন্যপাশ থেকে তানিয়া বলে,

-ডিনার করবে না?

-তোমরা করে ফেলো ভাবী।

-সেকি কথা! তোমরা খাবে না? এই না বলে গেলে খুদা লেগেছে তোমার?

-চন্দ্রর চোখ লেগেছে। ও উঠলে পরে নাহয় আমরা খেয়ে নিবো। তোমরা অপেক্ষা না করে খেয়ে ফেলো।

-ও আচ্ছা। তাহলে আমাদের ডিনারের পরে নাহয় তোমাদের জন্য টেবিল সাজিয়ে দিবো৷

-এত কষ্ট করতে হবে না। ট্রে তে করে কাউকে দিয়ে উপরে পাঠিয়ে দাও। আমরা নাহয় ঘরেই খেয়ে নিবো আজ।

-ঠিক আছে।

রওনক ফোন রাখতেই টের পায়। চিত্রলেখা সজাগ হয়ে গেছে। নিজেকে রওনকের বুকে আবিষ্কার করে খানিকটা ইতস্তত বোধ করে। তৎক্ষনাৎই সরিয়ে গিয়ে বসে। ভেজা চুল হাত খোপায় বাঁধতে নিলে রওনক বাঁধা দিয়ে বলে,

-এক মিনিট, বেঁধো না।

বাথরুম গিয়ে একটা টাওয়াল নিয়ে ফিরে আসে সে। চিত্রলেখা টাওয়াল দেখে বলে,

-আমাকে দিন, আমি মুছে নিচ্ছি।

রওনক তার কথা শুনে না। বউকে কাছে টেনে নিয়ে যত্ন করে তার চুল মুছতে মুছতে বলে,

-এতটুকু আমায় করার সুযোগ দাও প্লিজ। আউ ওন্ট ডিজাপয়েন্ট ইউ।

রুমের দরজায় কেউ নক করতেই রওনক গিয়ে খুলে দেয়। জাহানারা নিজে এসেছেন ওদের খাবার নিয়ে। উনাকে দেখে রওনক বলল,

-তুমি কষ্ট করে আসতে গেলে কেন বলো তো? অন্যকাউকে পাঠিয়ে দিতে।

এগিয়ে এসে চিত্রলেখার চিবুক স্পর্শ করে চুমু খায় জাহানারা। বলেন,

-আমার রওনকের বউয়ের দায়িত্ব কি আমি অন্যকারো হাতে ছাড়তে পারি?

চিত্রলেখা কেবল মুচকি হাসার চেষ্টা করে। ওদের খাবার দিয়ে জাহানারা চলে গেলে রওনক বলে,

-উনি আমার বাবার দূরত্ব সম্পর্কের বোন হয়। আমার বুঝ হওয়ার পর থেকে উনাকে আমাদের বাড়িতে দেখছি। সম্পর্কে আমাদের ফুফু হলেও আমরা খালা বলেই অভ্যস্ত। মায়ের সঙ্গে সবসময় বোনের মতো করে থেকেছেন তাই আমরা ছোট থেকে খালা বলেই ডেকেছি। উনিও কখনো আপত্তি করেননি। আমাদের জন্য উনি আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য। আমি ভাইয়া অনেক সময় মাকে কাছে পেতাম না তখন এই জাহানারা খালাই নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে রাতের পর রাত আমাদের খেয়াল রেখেছেন। মায়ের অবর্তমানে মায়ের আদর, স্নেহ দিয়েছেন। আমাদের খেয়াল রেখেছেন।

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক আরও বলে,

-ভাবী কখনো উনাকে ছোট করে দেখননি। জানি তোমাকে আমার আলাদা করে বলে দিতে হবে না তবুও বলছি উনার দিকে খেয়াল রেখো। আমরা ছাড়া মানুষটার আর কেউ নেই।

চিত্রলেখা রওনককে আশ্বস্ত করে বলে,

-আপনি চিন্তা করবেন না আমি খালার খেয়াল রাখবো।

-আমি জানতাম তুমি রাখবে। এখন এসো ডিনারটা সেরে ফেলি।

একটু উসখুস করে চিত্রলেখা বলে, আমার না খুদা নেই।

ভ্রু কুঁচকে তাকায় রওনক জিজ্ঞেস করে, শাওয়ার নিতে গিয়ে কি পানি খেয়েছো?

চোখ বড় বড় করে তাকায় চিত্রলেখা, সেই সঙ্গে মাথা ঝাকায়। রওনক জিজ্ঞেস করে, তাহলে খুদা থাকবে না কেনো? আজ সারাদিনে ঠিকঠাক খেয়েছিলে কিছু?

এবারেও মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক হাত ধরেই টেনে নিয়ে যায়। বাইরের রুমে খাবার দিয়ে গেছেন জাহানার। চিত্রলেখাকে ইতস্তত করতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে, কিছু বলতে চাও?

মাথা দুলিয়ে চিত্রলেখা বলে, আগে চারুকে একটা ফোন করি? ওরা খেলো কিনা…

চিত্রলেখার গলা ধরে আসে। তা টের পেয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে, আসার পরে ফোন করোনি বাসায়?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। অবাক কন্ঠে রওনক বলে, ফোন দাওনি কেনো? ওরা নিশ্চয়ই ফোন কলের অপেক্ষায় আছে। এত বোকা তো তোমাকে ভাবিনি!

চিত্রলেখা জবাব দিতে পারে না। আসার পর রওনকের মায়ের রিয়্যাকশন দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে। মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল এই বাড়িতে যে সে গ্রহণযোগ্য নয় তা জানতে পেরেই মূলত মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই আর মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফোন করেনি। ঐ সময় তার কন্ঠ শুনলেই ওরা বুঝে ফেলতো এদিকে কিছু একটা ঘটেছে। তাই বলা যায় ইচ্ছা করেই ফোন করেনি সে। কিন্তু এখন খাওয়ার কথা উঠতেই বুক ভার হয়ে কান্না পাচ্ছে তার। যদিও আজ রাতের খাবার সে রান্না করে দিয়ে এসেছে কিন্তু কাল থেকে কে ওদের রান্না করে খাওয়াবে? ভাইবোনগুলো তো ওর হাতের রান্নার পাগল।

রওনক বলে, তুমি কথা বলে আসো তারপর একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবো আমরা।

চিত্রলেখা আর সময় বিলম্ব করে না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। চারুকেই ফোন লাগায়। একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়। বোনের কল পেয়ে কেঁদে ফেলে চারু। যদিও সে কাঁদতে চায়নি কিন্তু নিজেকে সামলেও রাখতে পারেনি। একটু করে সবার সঙ্গেই কথা হয় চিত্রলেখার। কথা শেষ করে ওখানেই থম ধরে বসে রয়। চারুর কান্না, খালার কান্না দুই ভাইয়ের ভারী হয়ে আসা কন্ঠ শুনে চিত্রলেখা নিজে কাঁদেনি। ও কেঁদে ফেললে ওরা আরও ভেঙে পড়তো। তাই নিজেকে আটকে রেখেছে। রওনক এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। একমিনিট সময় অপেক্ষা করে এগিয়ে আসে সে। চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় ডিনার করতে। এক্ষুনি কিছু বলে না রওনক চিত্রলেখাকে। নিজেই প্লেটে খাবার তুলে নেয়। ভাত মাখিয়ে প্রথম লোকমাটা বউয়ের মুখের সামনে ধরে বলে,

-হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি। আজ আর তোমাকে কষ্ট করে নিজের হাতে খেতে হবে না। তোমার মন খারাপের রাতগুলোতে নেয় আমি তোমার একটু বেশি যত্ন করবো৷ একটু বেশি খেয়াল রাখবো। তুমি কেবল আমায় সেই সুযোগ দিও।

চিত্রলেখা একপলক রওনকের চোখের দিকে তাকায়। তারপর বাধ্য মেয়ের মতো মুখ খুলে লোকমাটা নেয়। কি হলো তার কে জানে হুরহুর করে চোখ ঙেভে কান্না পেয়ে গেল। চিত্রলেখা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। চোখ ভাসিয়ে কেঁদে ফেলল। রওনক বাঁধা দিলো না। সেই সঙ্গে ভাত খাওয়ানোও বন্ধ করলো না। সে নিজের কাজ করতে থাকলো, চিত্রলেখাকেও কাঁদতে দিলো।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

খাওয়া দাওয়ার পর বেডরুমে ফিরে এসে রওনক চিত্রলেখাকে বলে, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।

চিত্রলেখা আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকে। কি দেখাবে তা দেখার জন্য। রওনক এগিয়ে গিয়ে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট রিমোট বের করে। রুমের একদিকের দেয়াল জুড়ে পর্দা। সেদিকে প্রেস করতেই অটোমেটিক পর্দা সরে যেতে লাগলো। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। পর্দা দু’পাশে সরে যেতেই বেরিয়ে আসলো সম্পূর্ণটা থাই করা। আর ওদিকে ঝুল খোলা বারান্দা। রওনক আবার রিমোট টিপে পর্দা আটকে দিয়ে বলল, এটা অটোমেটিক। তোমার সুবিধার জন্য জানিয়ে রাখলাম।

রিমোটটা জায়গা মতো রাখতে রাখতে রওনক আরও বলে, অনেক রাত হলো, আসো শুয়ে পড়ি। তুমি হয়ত টায়ার্ড।

বলতে বলতেই রওনক বিছানার বাম পাশটায় প্রায় শুয়ে পড়েছে। চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো ঘুমাই।

একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা মিনমিন করে বলল, আমরা এক বিছানায়ই ঘুমাবো?

চিত্রলেখার প্রশ্ন শুনে রওনক উঠে বসে। বলে,

-হাসবেন্ড ওয়াইফ তো এক বিছানাতেই ঘুমায় তাই না?

-কিন্তু আমাদের একসাথে ঘুমানোটা কি দরকার? না মানে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি বাইরের ঘরের সোফায় বা এখানে নিচেও ঘুমাতে পারবো। আমার কোনো সমস্যা নেই।

চিত্রলেখার কথা শুনে কেমন কেমন করে যেনো তাকায় রওনক। মুখে হাসি ভাব রেখে বলে,

-আমরা কি সিনেমা করছি? আমি বেডে ঘুমাবো, তুমি ফ্লোরে। কাম অন চন্দ্র। উই আর ম্যারিড কাপল। দিজ ইজ নট এ জোক এন্ড উই আর নট জোকিং হিয়ার। উই আর ম্যারিড ফর দ্যা লং লাইফটাইম।

তারপরেও গড়িমসি করে চিত্রলেখা। এবারে রওনক সামান্য শক্ত না হয়ে পাড়ে না। চোয়াল শক্ত করে বলে, তুমি কি চাইছো আমি উঠে গিয়ে তোমায় কোলে করে বেডে নিয়ে আসি। ইফ ইউ ওয়ান্ট আই ক্যান ডু দ্যাট হ্যাপিলি।

চিত্রলেখা তৎক্ষনাৎ তটস্থ হয়। খানিকটা ঘাবড়েও যায়। রওনক যে এমন কাজ করার আগে দুইবার ভাববে না সেটা তার বুঝা হয়ে গিয়েছে তাই আপত্তি করে বলে, না না এর প্রয়োজন নেই। আমি নিজেই শুয়ে পরছি।

ছোট ছোট কদম ফেলে বিছানায় গিয়ে বসে চিত্রলেখা, রওনকের দিকে পিঠ করে। পেছন দিকে রওনক বসে থেকেই জিজ্ঞেস করে, তুমি এই পাশে শুতে চাইলে আমি ওপাশে শুতে পারি, আই ডন্ট মাইন্ড।

-না না লাগবে না। যেকোনো একপাশ হলেই আমার চলবে। কোনোপাশেই সমস্যা নেই আমার।

-ভেরি গুড।

বলেই হাত বাড়ায় রওনক। তার পাশেই রুমের লাইটের সুইচ বোর্ড। লাইট অফ করে দিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালায় সে। একদমই মৃদু হলদেটে লাইটিং। অনেকটা নিয়ন আলোর মতো। শুয়ে পড়েছে রওনক পেছনে না ঘুরেও তা টের পায় চিত্রলেখা। বুকের ভেতর কেমন ধুকধুক করছে তার অকারণেই। একজন পুরুষের সঙ্গে একঘরে, একবিছানায় থাকতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতর অদৃশ্য তোলপাড় হয় তার। শুয়ে পড়ার আগে এক ঢোক পানি খায় সে। তারপর বুকে জড়িয়ে রাখা ওড়নাটা দলা পাকিয়ে বালিশের পাশে রাখে। চিত্রলেখার পরণে খুবই কমফোর্টেবল নাইটসুট। পাজামা ও শার্ট। এমনকি রওনকও একই ধরনের পোশাক পরেছে। টিভিতে, সিনেমায় দেখা যায় নারী চরিত্ররা নাইটি পড়ে কিন্তু রওনক তাকে তেমন কিছু দেয়নি। ভাগ্য ভালো দেয়নি নয়ত লজ্জায় মাটিতে ঢুকে পড়তে হতো তাকে। ওসব নাইটির চাইতে এই পোশাকটা যথেষ্ট মানসম্মতও। না পেট বের হয়েছে, না হাঁটু বের হয়েছে আর না বুক, পিঠ দেখা যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে এর সঙ্গে ওড়না নেই। স্কার্ফ হলেও ভালো হতো। তবে সমস্যা নেই চিত্রলেখা ড্রেসের ওড়না দিয়ে কাজ চালিয়ে নিয়েছে। আস্তেধীরে বিছানার কার্নিশ ঘেষে শুয়ে পড়ে চিত্রলেখা। কিং সাইজের বিছানাটা দু’জন মানুষের জন্য যথেষ্টের চাইতেও বেশি। চিত্রলেখার মনে হয় এই বিছানাটা হয়ত কিং সাইজের চাইতেও বড়। এতে অবশ্য ওর জন্যই ভালো হয়েছে। হাত পা সামান্য এদিক সেদিক হলেও সেটা রওনক পর্যন্ত পৌঁছাবে না। তাছাড়া চিত্রলেখার শোয়া খারাপ নয়। ঘুমের মধ্যে পাশের জনের উপর হাত পা তুলে দেয়ার অভ্যাস তার নেই। বরং দেখা যায় ঘুমের মধ্যে কমই হাত পা ছোড়ে সে। শান্ত হয়েই ঘুমায়। এদিক থেকে নিজের উপর বিশ্বাস আছে তার। কেবল বিশ্বাস নেই পেছন দিকে বিছানার অপর প্রান্তে শুয়ে থাকা মানুষটার উপর। কখন কি করে বলা মুশকিল। এখনো মানুষটাকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না সে।

চুপচাপ শান্ত হয়েই শুয়ে থাকে চিত্রলেখা একদম গুটিশুটি মেরে। বিছানার একদম কার্নিশ ঘেঁষেই শুয়েছে আরেকটু সামান্য এদিক হলে ধপাস করে নিচে পড়ে যাবে। তবুও ওভাবেই শুয়ে থাকে। পেছনে রওনকের সাড়াশব্দ নেই। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সামান্য স্বস্তি পায় চিত্রলেখা। কিন্তু তার স্বস্তি পাওয়া মিনিটও অতিক্রম করতে পারে না। আচমকাই পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার পেটের কাছে ধরে টেনে নেয় রওনক নিজের কাছে। আচমকা টান দেয়ায় চিত্রলেখা কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তার পিঠ গিয়ে ঠেকলো রওনকের বুকের সঙ্গে। অস্ফুটস্বরে চিত্রলেখা বলল, কী করছেন?

রওনক মুখটা চিত্রলেখার মাথার কাছাকাছি নিয়ে এলো। তার বাম হাতটা এখনো চিত্রলেখার পেটে জড়িয়ে রাখা শক্ত বাঁধনে। ডান হাত বাড়িয়ে রওনক চিত্রলেখার খোলা চুলগলো উপরের দিকে তুলে দিয়ে তার ঘাড় উন্মুক্ত করে। মুখ বাড়িয়ে কানের কাছে গিয়ে রওনক ফিসফিস করে বলে, বউকে কাছে টানছি।

চিত্রলেখার উন্মুক্ত ঘাড়ে আলতো করে চুমু খায় রওনক। খুব গভীর করে নয়, ছোট্ট করে। প্রথম স্পর্শে নিজের অভুক্ততা নয় ভালোবাসা প্রকাশ করতে চায় সে। আচমকা রওনকের এমন কাছে আসায় ঘাবড়ে গেছে চিত্রলেখা। হয়ত এখনই এমনটা আশা করেনি সে। চিত্রলেখার ইতস্তত বুঝতে পেরে তাকে স্বাভাবিক করতে রওনক বলে, তুমি কি ভেবেছিলে আমাদের ভেতর কিছুই হবে না? উই আর লিগ্যালি ম্যারিড। তুমি আমার বউ। উই ক্যান গেট ইনটিমেট। বিয়ে করেছি বউয়ের সঙ্গে কিছু হবে না, কিছু করব না এসব মুভিতে হয় বাস্তবে নয় বুঝলে। এন্ড ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন বলে রাখি আমি কিন্তু বিয়ের আগে বলিনি তোমায় স্পর্শ করব না, তোমার কাছে যাবো না, তোমাকে কাছে টানবো না। এমন কোনো এগ্রিমেন্ট আমাদের হয়নি। এন্ড লেট মি ক্লিয়ার মাইসেল্ফ, আই উইল ডেফিনিয়েটলি গেট ক্লোজ টু ইউ। অলসো উই উইল গেট ইনটিমেট।

চিত্রলেখা এমনিতেই দলা পাকিয়ে ছিল। রওনকের মুখে এসব কথা শুনে আরও নুইয়ে যেতে থাকে। এসব শুনতে হবে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। ইশ! ভীষণ লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে বেচারী। বউয়ের লজ্জা পাওয়া চোখে না দেখতে পেলেও বেশ টের পাচ্ছে রওনক। ভালোই লাগছে তার। এমনিতেই চিত্রলেখাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে রওনক। এবারে আরও খানিকটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করে বলে, ছয় বছর চন্দ্র। ছয় বছর পর কারো সঙ্গে বিছানা শেয়ার করছি, নিজের ঘর শেয়ার করছি, নিজেকে শেয়ার করছি। ছয় বছর, সিক্স লং ইয়ারস। তুমি বুঝবে না আমার অবস্থাটা।

কথাটা চিত্রলেখাকে কোথায় গিয়ে যেনো স্পর্শ করলো। একটা মানুষ চাইলেই নিজের শরীরিক চাহিদা মিটাতে পারতেন অথচ সয়ে গেছেন। কখনো কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায়নি। চিত্রলেখা ভাবে, সে কি আসলেই এত ভালো একজন মানুষের যোগ্য!

আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে ভাবে রওনক। প্রথম রাতেই চিত্রলেখাকে এর বেশি বিরক্ত করবে না ভাবে সে। রওনক চিত্রলেখার মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, তবে ডন্ট ওয়ারি আজ তোমায় একদম বিরক্ত করব না। আই নো তুমি টায়ার্ড। তাই আর একটুও বিরক্ত করছি না, ঘুমিয়ে পড়ো তবে দূরে গিয়ে নয়। আমার বুকে থাকো, এতে আমার ঘুমটা ভালো হবে। আমাকে একটু শান্তি করে ঘুমাতে দাও তো।

চিত্রলেখা কিছুই বলে না। সরে যাবারও চেষ্টা করে না। মানুষটা আপাদমস্তক মুগ্ধতায় মোড়ানো। চিত্রলেখার নিজেরও ভালো লাগছে এই মানুষটার আলিঙ্গনে থাকতে। যদিও অস্বস্তি লাগছে তবুও একদম মন্দ লাগছে না। বরং মনের ভেতরে ভালো লাগার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। নতুন সম্পর্ক, নতুন স্পর্শ, নতুন অনুভূতিদের সঙ্গে পরিচয়। সবটা ইতস্ততকর, অস্বস্তিকর হলেও কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করছে। ওভাবেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে চিত্রলেখার জানা নেই। গভীর ও গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছে সে।

চিত্রলেখার গভীর ঘুম আলগা হয় আচমকা কারো নিবিড় স্পর্শে। একমুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু তৎক্ষনাৎই মস্তিষ্ক তাকে জানিয়েছে চারু নয় রওনকের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমিয়েছে সে আজ। তার জীবন আর আগের মতো নেই, সব বদলে গেছে। এখন সে বিবাহিত, পাশের পুরুষটার তারউপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। চিত্রলেখার ঘুম আলগা হতেই সে টের পায় রওনকের হাত অবাধ্যের মতো তার দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। যদিও চিত্রলেখার গায়ের কাপড় গায়েই আছে কেবল রওনকের হাত চলে গেছে তার কাপড়ের ভেতর। কোথাও শক্ত স্পর্শ করছে কোথাও বা আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রওনকের ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চিত্রলেখার উন্মুক্ত বক্ষ ও গলায়। উঠে এসে রওনক তার কানের নিচে চুমু খাচ্ছে। সে চোখ মেলেনি। বিছানা খামচে ধরেছে। ইতোমধ্যে চিত্রলেখারও নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। রওনক এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কপালে চুমু খায়। তারপর কানের কাছে গিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-সরি, আজ তোমায় একদম ডিস্টার্ব করতে চাইনি বিশ্বাস করো। কিন্তু নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। আই এম ডাইং হিয়ার ট্রাস্ট মি। প্লিজ একবার একটু কাছে আসো এরপর একদম বিরক্ত করব না, আই প্রমিজ। সিক্স লং ইয়ারস চন্দ্র আমি কাউকে ছুঁয়ে দেখিনি। নারী স্বাদ জানা এই শরীরটা কারো সংস্পর্শে যায়নি। এখন আর পারছি না। তুমি আমার জীবনে এসে সব বদলে দিয়েছো, সব। আমাকে উল্টে-পাল্টে একদম ঘেটে দিয়েছো। ইটস অল ইউর ফল্ট।

চিত্রলেখা কিচ্ছু বলতে পারে না। শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে যেনো। তবে রওনকের প্রতিটা স্পর্শ তার অঙ্গে অঙ্গে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। শিরায় শিরায় যেন আগুন জ্বলছে। সেই সঙ্গে শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীলত করা অনুভূতিও বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে চিত্রলেখার। রওনক নিজে মাতাল হাওয়ায় মেতেছে সেই সঙ্গে তাকেও মাতিয়েছে৷ বিছানা ছেড়ে চিত্রলেখা রওনককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। রওনক এতটুকু সম্মতি পেয়ে বউয়ের কাঁপতে থাকা অধর জোড়া নিজের দখলে নেয়। গভীর ও নিবিড় স্পর্শে, গাঢ় চুমু খায় লম্বা সময় নিয়ে। খানিকক্ষণ আদর দিয়ে, কিছুক্ষণ হিংস্রভাবে ঐ ঠোঁটের সুধা পানে ব্যস্ত রওনক যেনো এই পৃথিবীর কোথাও নেই। তারা ভাসছে যেনো সৌরজগতের মহাশূন্যে। দীর্ঘ স্পর্শের পর আচমকাই রওনক চিত্রলেখার ঠোঁট ছেড়ে উঠে বসে। জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস ছাড়ে। চিত্রলেখা নড়ে না, চোখও মেলে না। অন্যদিকে কাত হয়ে কুঁচকে যায় আবারও। লজ্জায় সমস্ত শরীর মাখামাখি হয়ে আছে তার৷ রওনক উঠে গিয়ে খানিকটা পানি খায়। তার নিজের সাইডের বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার নিয়ে বারান্দায় চলে যায় সে। তখনই উঠে বসে চিত্রলেখা। তারও তীব্র পানির পিপাসা পেয়েছে। বুকের ভেতর এখনো বাদ্যযন্ত্র বাজছে। কেউ পাশে এসে বসলেই শব্দ শুনতে পাবে। তবে কোথাও গিয়ে মানুষটার জন্য মায়া হয় তার। এতগুলো বছর একটা মানুষ নিজেকে সবরকম চাহিদা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ভাবতেই রওনকের জন্য কষ্ট লাগে তার। ইচ্ছা হয় বলতে, আমি আছি। বিছানা থেকে নেমে পানি খায় চিত্রলেখা। আবার শুয়ে পড়তে নিয়েও শুয়ে পড়ে না। কি ভেবে যেনো চিত্রলেখা নিজেও বারান্দার দিকে আগায়। শব্দহীন হেটে বারান্দায় আসতেই দেখতে পায় রওনক জ্বলন্ত সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এর মধ্যেই তার উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতেই মুখ ঘুরিয়ে বউয়ের দিকে তাকায় রওনক। চিত্রলেখার কি হলো কে জানে! ঐ চাহনি দেখে একটা হার্টবিট মিস হলো তার। রওনকের দৃষ্টির গভীর চাহনি দেখে শরীর হালকা হয়ে এলে যেনো। তবু নিজেকে সামলে নেয় সে। রওনক বলে,

-দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাছে আসো।

মাথা ঝাঁকিয়ে চিত্রলেখা বলে, সিগারেটের গন্ধটা সহ্য হয় না আমার৷

-ফেলে দিতে বলছো?

-না না আমার জন্য ফেলতে হবে না।

-আর যদি একেবারেই ছেড়ে দেই?

-আমার জন্য?

-হু, তোমার জন্য।

-ছেড়ে দিবেন?

-দিতে পারি কিন্তু বিনিময়ে আমি কী পাবো?

চিত্রলেখা স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারে না। এই মানুষটাকে বিনিময় দেয়ার সাধ্য কি তার আছে? রওনক তার হাতের সিগারেটটার আগুন নিভিয়ে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এরপর একে একে লাইটার ও সিগারেটের প্যাকেটটাও ফেলে দেয়। সব ফেলে দিয়ে বলে,

-ফেলে দিলাম তোমার জন্য। বিনিময়ে একটা জিনিস চাই দিবে?

-কী?

রওনক এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার চোয়াল স্পর্শ করে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে বলে, এই ঠোঁট জোড়া আমায় দিয়ে দাও। পারমিশন দাও আমি যখন খুশি ছুঁয়ে দিতে পারবো। আই প্রমিজ সব ছেড়ে দিবো।

চিত্রলেখা জমে গেছে। জবাব দিতে পারে না। আমতা আমতা করে বলে, আমি যাই, ঘুম পাচ্ছে।

এক কদম পিছিয়ে গিয়ে রওনক বলে,

-সত্যি ঘুম পাচ্ছে নাকি পালাতে চাইছো?

চিত্রলেখা জবাব দিতে পারে না। আসলে সে পালানোর জন্যই ঘুমের বাহানা করেছে। রওনক বলে, সত্যি ঘুম না পেয়ে থাকলে একটু পাশে থাকো। আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।

আচমকাই রওনকের চেহারার রঙ পাল্টে যায়। তাকে সিরিয়াস দেখাচ্ছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আচমকাই রওনকের চেহারার রঙ পাল্টে যায়। তাকে সিরিয়াস দেখাচ্ছে। তার মুখের ভাব দেখে চিত্রলেখার চোখ-মুখও শক্ত হয় খানিকটা। রওনক একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কাছে এসো।

চিত্রলেখা আপত্তি করে না। তার দিকে রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাতটা হাত বাড়িয়ে ধরে। বউকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পেছন থেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে,

-আটবছর আগে তিলত্তমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আমার। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। পারিবারিক পছন্দেই বিয়ে হয়েছিল আমাদের। চাপে পড়ে বিয়ে করেছিলাম এমন নয়। সবসময় লেখাপড়া নিয়ে সিরিয়াস থাকার ফলাফল কখনো প্রেম করা হয়ে ওঠেনি আমার। তাই সেভাবে পার্সোনাল কোনো চয়েজ ছিল না বলতে পারো। এছাড়া বাবা-মায়ের উপর ভরসা ছিল আমার জন্য উনারা নিশ্চয়ই বেস্ট কাউকেই বেছে আনবেন। সত্যি কথা বলতে তিলত্তমাকে দেখে আমারও পছন্দ হয়েছিল। তাই আর আপত্তি করিনি। বলতে পারো ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। ওর আগে আমার জীবনে কোনো মেয়ে আসেনি। সি অয়াজ মাই ফাস্ট লাভ। মাই ফাস্ট লেডি।

রওনকের মুখে “সি অয়াজ মাই ফাস্ট লাভ” শুনে চিত্রলেখার বুকের ভেতর কোথায় গিয়ে যেনো কথাটা বিধলো। কিন্তু কেনো বিধলো তা বুঝতে পারলো না সে। রওনক বলতে থাকে নিজের মতো করে।

-সুখেই ছিলাম আমরা। ওকে ভালোবাসতে কোনো কমতি রাখিনি আমি। নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি। ওর যেনো কোনো কিছুর কমতি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেছি। ওর কি লাগবে না লাগবে খেয়াল রাখতাম। ও কি পছন্দ করে, কোনটা অপছন্দ করে সব, সবদিকে আমার নজর থাকতো। বলতে পারো ওই সময় তিলত্তমার ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম আমি বা এমনও বলতে পারো তিলত্তমাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। শুধু আমি একা নই, তিলত্তমাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। ওর জীবনেও আমার আগে কেউ আসেনি। ওর জীবনের প্রথম পুরুষ ছিলাম আমি।

“আপনি তো আমার জীবনেও প্রথম পুরুষ। কেউ তো কোনোদিন আমায় স্পর্শ করতে পারেনি। আমার মনের দরকার কড়াও নাড়তে পারেনি কিন্তু এই যে আপনি জড়িয়ে আছেন আমার আষ্টে-পৃষ্টে, আমার মনের ভেতর ঝড় তুলে দিচ্ছেন। আপনার গন্ধ মিশে আছে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। অথচ আপনার জীবনের প্রথম নারী আমি নই।” কথাটা মনে মনেই আওড়ায় চিত্রলেখা। রওনকের মুখে তার প্রথম ভালোবাসার কথা শুনে চিত্রলেখার মুখে খানিকটা অন্ধকার নামলো যেনো কিন্তু তা রওনকের অজানা থেকে গেল।

এতটুকু বলে একটু থামে সে। এই সুযোগে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে, তাহলে সেই মানুষটা এখন কোথায়? সেই ভালোবাসা এখন কোথায়?

মেকি হাসে রওনক, চিত্রলেখা সেই হাসি দেখতে পায় না কিন্তু শুনতে পায়। রওনক বলে,

-এত সুখ, ভালোবাসা হয়ত আমার কপালে ছিল না বা সয়নি তাই হারিয়ে গেছে। তিলত্তমা অনেক ভালো একটা মেয়ে, এত ভালো তুমি নিজে ওর সঙ্গে না মিশলে বুঝবে না আসলে। আমার থেকে শুনলে মনে হবে একটা সময় ভালোবাসতাম, আমার ওয়াইফ ছিল তাই হয়ত বাড়িয়ে বলছি কিন্তু একদম সত্যি বলছি বিশ্বাস করো অনেক ভালো একটা মেয়ে ছিল। মানুষ হিসেবে যত ভালো ছিল তার চাইতেও বেশি ভালো ছিল ওর মনটা। সহজেই যে কাউকে আপন করে নিতে পারতো।

চিত্রলেখার আগ্রহ বাড়ে রওনকের কথা শুনে। তার জানতে ইচ্ছা হয় কেন এই মানুষটা হারিয়ে গেল? কার দোষে হারিয়ে গেল? আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-বলুন না এত ভালো মানুষটা আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেল কেনো? আপনার এত ভালোভাসা তুচ্ছ করে মানুষটা চলে গেল কেনো?

-বলছি তো একটু ধৈর্য রাখো। সব বলবো তোমাকে। আমি চাইনা আমার ব্যাক্তিগত জীবনের গল্পটা তুমি অন্য কারো মুখ থেকে শুনো তাই আমি নিজেই সব বলবো তোমাকে। আজ, এখনই বলবো।

একমুহূর্ত থেমে রওনক বলতে থাকে নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের গল্পটা।

-আমি পড়ালেখা শেষ করে আসার পরপরই বাবার ব্যবসা জয়েন করি। যেহেতু আমার আল্টিমেট গোলই ছিল পারিবারিক বিজনেস জয়েন করা তাই দেশে ফিরে আমি সময় নষ্ট করিনি। তাছাড়া বাবা অবসর নেয়ার আগে তার থেকে আমার অনেককিছু শিখার ছিল। ভাইয়া নিজের পছন্দের ক্যারিয়ার আগেই চুজ করে নিয়েছিল। আমি নিজের ইচ্ছায় বিজনেস জয়েন না করলেও আমাকে বিজনেস জয়েন করা লাগতোই। আমি জয়েন করার কয়েক মাসের মাথায় বাসা থেকে জানানো হয় বাবা-মা আমার জন্য পাত্রী দেখছেন। আমার কোনো চয়েজ থাকলে জানাতে পারি নয়ত উনারা নিজেদের পছন্দ মতো দেখবেন। আমার যেহেতু কোনো চয়েজ ছিল না তাই আমি তাদের উপরেই সবটা ছেড়ে দিয়ে বিজনেসে মন দিলাম। উনারা আমার জন্য তিলত্তমাকে সিলেক্ট করলেন। পারিবারিক ভাবে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হলো। স্বপ্নের মতো করে বিয়ের প্রথম বছরটা কাটলো আমাদের। ভালোবাসা, ভালোলাগা, মগ্ধতার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু সেইসব ভালোবাসা, ভালোলাগা, মুগ্ধতায় ভাটা পড়লো একবছর পর। বাবার শরীর খারাপ হতে লাগলো। বিজনেসের সব দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিলেন। আমি দিনরাত এক করে বিজনেস সামলাচ্ছি। আমার ধ্যান-জ্ঞান সবটা জুড়ে কেবল বিজনেস বিজনেস আর বিজনেস। আমি জানতাম ওই সময়টাতে আমি তিলত্তমাকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলাম না সেজন্য আমার সরিও ফিল হতো। আমি বহুবার ওকে সরি বলেছি। কত রাত ও আমার অপেক্ষা করতে করতে না খেয়ে ডাইনিং টেবিলেই ঘুমিয়েছে। কখনো মধ্যরাতে, কখনো শেষরাতে, কখনো ভোরবেলায় বাড়ি ফিরলে দেখতে পেতাম আমার অপেক্ষা করতে করতে হয় ডাইনিং টেবিলে নয় ড্রইং রুমের সোফায় ঘুমাচ্ছে। আমি সরি বলতাম। প্রথম প্রথম তিলত্তমা কিছু বলতো না কিন্তু দিনের পর পর এমন হতে থাকলে পরে ও আপত্তি জানায়। আমার সরি না আমাকে চায় সে, আমার সময় চাই তার। আমার বুঝদার তিলত্তমা হঠাৎই অবুঝ হয়ে গেল। সে আর বুঝতে চায় না। তার শুধু আমাকে চাই। কিন্তু আমি পারছিলাম না ওকে সময় দিতে। ওর বুঝতে না চাওয়া আস্তে আস্তে সন্দেহের রূপ নিলো। আমি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিজনেসের কাজে বাসার বাইরে থাকতাম, ঢাকার বাইরে থাকতাম, দেশের বাইরে থাকতাম। ও ভাবতে শুরু করলো আমার জীবনে হয়ত অন্য কারো আগমন ঘটেছে। ভাবতে শুরু করলো আমি ওকে চিট করছি। অনেক বুঝিয়েছি ওকে। কিন্তু একদিন এসবের চুড়ান্ত হলো। আমার এক বিজনেস পার্টনার মিস মেলিসা আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসলেন। উনার থাকার ব্যবস্থা করা হলো লা মেরিডিয়ানে। লম্বা ফ্লাইটের পর ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন তিনি। তাই দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। আমার উনাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যাবার কথা ছিল কিন্তু জরুরী মিটিং পরে যাওয়ায় আমি যেতে পারিনি। সেদিন রাতেই আমাদের চিটাগং যাবার কথা। মিটিং শেষ করে আমি যখন ওখানে যাই আমার পিএ সোনিয়া সঙ্গে ছিল। তিলত্তমার এক ফ্রেন্ড আমাদের দেখে ফেলে ওকে জানায় আমি একটা মেয়েকে নিয়ে হোটেলে গিয়েছি। হন্তদন্ত তিলত্তমা ওখানে গিয়ে পৌঁছায়। ওর মতে ওর সন্দেহ সত্যি হলো। আমি ওকে চিট করছি। বিজনেসের নাম করে মেয়ে নিয়ে হোটেলে থাকছি। কিছুতেই আমি ওকে বিশ্বাস করাতে পারিনি সোনিয়ার সঙ্গে আমার কোনো এফেয়ার নেই। আমরা বিজনেস রিলেটেড কাজে ওখানে গিয়েছিলাম। আমার কোনো কথাই শুনলো না। উল্টো ক্লাইন্টের সামনেই তার আপ্যায়নে ওপেন করা শ্যাম্পেইনের বোতলের সবটুকু ও আমার গায়ে ঢেলে দিলো। আমি কিচ্ছু বলিনি। ভেবেছিলাম বুঝিয়ে বললেই ওর ভুল ভাঙ্গবে। কোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে আমি হারাতে চাইনি। কিন্তু বলে না ভাগ্যে না থাকলে সেখানে জোর খাটিয়েও কাজ হয় না। তিলত্তমা আমার নসিবে ছিল না। সেইরাতেই রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমি ওকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু লাভ হয়নি। সোনিয়াকেও ফায়ার করে দিয়েছিলাম। যেনো তিলত্তমা আমাকে অহেতুক সন্দেহ না করে। কিন্তু সন্দেহ এমন এক জিনিস এর বীজ একবার মনের জমিনে বোপন হয়ে গেলে সবকিছু ছারখার না করা পর্যন্ত পিছু ছাড়ে না। বাড়ি ছেড়ে যাবার সাতদিনের মাথায় ও আমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠায়। এরপরেও আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ওকে ফিরিয়ে আনার কিন্তু…

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে, অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ওকে ফেরাতে পারিনি আমি। ওর সন্দেহের কাছে আমার সব ভালোবাসা তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ আমার ভীষণ অভিমান হলো, ও কেনো আমার ভালোবাসা বুঝলো না? কেনো বুঝলো না আমার জীবনে ও ছাড়া কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আমার অভিমানের পাল্লা ভারী হলো, আমিও ওকে ফিরে আনার চেষ্টা বাদ দিলাম। যে নিজে থেকে ফিরতে চায় না আমি আমার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে তাকে আর ফেরাতে চাই না। অভিমান করে আমিও ওর পাঠানো ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিলাম। একটা সাইনের বিনিময়ে আমার জীবন থেকে আমার ভালোবাসার মানুষটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল।

কথা শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো রওনক। চিত্রলেখা বলল, তারপর আপনাদের আর দেখা হয়নি?

-না।

-কেনো?

-তিলত্তমা নিউইয়র্ক চলে গেছে। ওখানে যাবার ছয় মাস পরেই আবার বিয়ে করেছে। এখন ওর দুটো বাচ্চাও আছে।

একমুহূর্ত চুপ থেকে কিছু ভেবে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আপনার কি আফসোস হয়?

-আফসোস? হয় তবে তিলত্তমার জন্য নয়।

-তাহলে?

-আমার আফসোস হয় বাচ্চা দুটোর জন্য। ও ভুল বুঝে চলে না গেলে বাচ্চা দুটো আজ আমার হতো। আমাকে বাবা বলে ডাকতো। ও আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে না গেলে এতগুলো বছর আমার একাকী কাটাতে হতো না। আমার জীবনটা ভরে থাকতো। সব থাকতো আমার।

চিত্রলেখার মুখে আর কথা কুলায় না। মানুষটা সত্যি ভালোবাসতো, ভুল ভাবছে সে বাসতো না হয়ত এখনো বাসে। চাইলেই কি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া যায়? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া যায়? ভালোবাসার মানুষটা জীবনে থাকুক বা না থাকুক চাইলেও তাকে ভুলে যাওয়া যায় না, সেই ভালোবাসাও ভুলে যাওয়া যায় না। মানুষ পারে না ভুলে যেতে। তাই তো এতগুলো বছর পরেও রওনক তিলত্তমাকে ভুলে যায়নি, তার ফেলে যাওয়া সেই ভালোবাসা ভুলে যায়নি। রওনকের জীবনে ভালোবাসা নামক অধ্যায়ে তিলত্তমার নাম খোদাই করা হয়ে গেছে। সেখানে চিত্রলেখা কোনোদিনও জায়গা পাবে না।

রওনকের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে চিত্রলেখা বলে, আমার ঘুম পাচ্ছে।

তৎক্ষণাৎই তাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয় রওনক। হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে, আমাকে নামান প্লিজ।

-নামিয়ে দিবো জায়গা মতো গিয়ে।

চিত্রলেখা হাত-পা নাচিয়েও কাজ হয় না। রওনক বিছানায় এসে কোল থেকে নামিয়ে শুইয়ে দেয়। কিছু বুঝে উঠার আগেই কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

সরে গিয়ে রওনক চলে যেতে নিলে চিত্রলেখা পেছন থেকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছেন?

-শাওয়ার নিতে। নাহলে আজ আর ঘুমাতে পারবো না। ইটস টু হট ফর মি।

রওনক আর দাঁড়ায় না, শাওয়ার নিতে চলে যায়। পেছনে চিত্রলেখা বেচারী লজ্জায় পানি পানি হয়ে যায়। তার নিজেরও মনে হচ্ছে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। লজ্জায় বালিশে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে