মাতাল হাওয়া পর্ব-৪২+৪৩

0
530

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন বাড়ি ফিরলেই দেখে তাদের ড্রইং রুমে বৃষ্টি বসে আছে। সঙ্গে নাঈমও আছে অবশ্য। লিখনকে দেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় বৃষ্টি। ওদের দু’জনকে এই সময়ে দেখে অবাক হয় লিখন। জিজ্ঞেস করে,

-তোমরা এই সময়ে? সব ঠিকঠাক তো?

বৃষ্টি কিছু বলে না। তাকিয়ে থাকে লিখনের মুখের দিকে। তাকে দেখে বিধ্বস্ত লাগছে খানিকটা। ক্লান্তও লাগছে। চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই। পাশ থেকে নাঈম বলে,

-আপুর পড়ায় কি যেন সমস্যা হয়েছে সেটা দেখতে আসছে আপনার কাছে।

-ও আচ্ছা, ঘরে আসো বৃষ্টি দেখায় দিচ্ছি।

বৃষ্টি কিছু বলে না। পেছন পেছন তার ঘরে এসে উপস্থিত হয়। লিখন বলে,

-তুমি বসো, কি সমস্যা বের করো আমি কাপড়টা পাল্টে হাত-মুখ ধুয়ে আসতেছি।

-আচ্ছা।

বলে মাথা ঝাকায় বৃষ্টি।

লিখন হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসেই বলে,

-কি সমস্যা দেখি।

এতক্ষণে বৃষ্টি বলে,

-আপনাকে ক্লান্ত লাগছে। আজ নাহয় থাক। আমি নাহয় আরেকদিন এসে সমস্যা ঠিক করে নিয়ে যাবো।

-উঁহু, রাত করে যেহেতু আসছো তার মানে জরুরী। কোথায় সমস্যা বলো আমি দেখায় দিচ্ছি।

বৃষ্টি খাতা খুলে সমস্যা দেখায় লিখনকে। কিন্তু তার দৃষ্টি লিখনের মুখেই। পড়ার সমস্যাটা বাহানা মাত্র। সে এসেছে লিখনকে দেখতে। চারুর কাছে খবর পেয়েছে চিত্রলেখার আচমকাই বিয়ে হয়ে গেছে। এই খবর পাবার পর থেকেই অজানা কারণে লিখনের জন্য অস্থির লাগছে তার। তাই লিখন কেমন আছে, ঠিক আছে কিনা দেখতেই পড়ার বাহানায় ছুটে এসেছে। নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি।

সমস্যা সমাধান করে দিয়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-আর কিছু?

মাথা ঝাকায় বৃষ্টি। লিখন আরও বলে,

-এটা তো সহজই, আগেও করাইছি তোমাকে।

-ভুলে গেছিলাম মাঝে অনেকদিন প্রাকটিস করি নাই তো।

-প্রাকটিস না করলে তো চলবে না। সব ভুলে যাবা। নিয়মিত প্রাকটিস করবা কেমন?

-আচ্ছা।

বৃষ্টি তবুও বসে থাকে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে লিখন। ১০ টা বাজে। তাই বলে,

-চলো বাসায় দিয়ে আসি।

এতক্ষণে হদিস হয় বৃষ্টির। লিখনের প্রতি এতটাই মনোনিবেশ করে ফেলেছিল যে সময়ের হদিস হারিয়ে ফেলেছিল। আচমকাই উঠে দাঁড়িয়ে বই খাতা গুছিয়ে নিতে নিতে বৃষ্টি বলে,

-দরকার নেই। নাঈম আছে, আমরা চলে যেতে পারব।

-অনেক দেরি হয়ে গেছে বৃষ্টি।

-সমস্যা নেই, এইটুকুই তো রাস্তা আমরা যেতে পারব।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। এমনিও তার সত্যি ক্লান্ত লাগছে। এসে বৃষ্টিকে না দেখলে এতক্ষণ হয়ত ঘুমিয়ে পড়তো সে। বৃষ্টি ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বলে,

-আসি, আপনি বিশ্রাম করুন।

মাথা ঝাকায় লিখন। শুয়ে পড়বে ভেবেও বৃষ্টির পেছন পেছন ড্রইং রুম পর্যন্ত এগিয়ে আসে ওদের বিদায় জানাতে। কিন্তু ড্রইং রুমে আসতেই দেখে নাঈম নেই। চারু জানায় অনেকক্ষণ আগেই বাসায় চলে গেছে সে। বৃষ্টি একাই বেরিয়ে যেতে নিলে বাঁধা দিয়ে লিখন বলে,

-চলো আমি দিয়ে আসি।

-না না দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।

লিখন কিছু বলার আগে নারগিস বেগম বলেন,

-কত রাত হইছে দেখছিস? এতরাত করে একা যাবে মেয়ের সাহস কত! যা তো বাবা তুই দিয়ে আয়।

-যাইতেছি খালা।

বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে লিখন আরও বলে,

-চলো।

এখানে আর কিছু বলে না বৃষ্টি। বাইরে বেরিয়ে বলে,

-আমি সত্যি একা যেতে পারব। আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না।

-আমার সঙ্গে যাইতে কোনো সমস্যা?

-না তো।

-তাহলে এত আপত্তি করতেছো কেন?

-আপনি ক্লান্ত।

বলেই মাথা নামিয়ে ফেলে বৃষ্টি। লিখন বলে,

-আসলেই আমি ক্লান্ত। তাই বলে এতটাও না যে এই সময় তোমাকে একা ছেড়ে দিবো।

বৃষ্টি বিড়বিড় করে বলে, আমি তো চাই আপনি সবসময় আমার পাশে থাকেন।

-কিছু বললা?

-না, কিছু না।

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বৃষ্টি বলে,

-আপার জন্য কি আপনার মন খারাপ?

স্মিত হাসে লিখন। বলে,

-সামান্য। তুমি কীভাবে বুঝলা?

-আপনার মুখ দেখলেই আমি বলতে পারি।

-কী বলতে পারো?

-কখন আপনার মন ভালো থাকে আর কখন খারাপ থাকে।

সামান্য শব্দ করে হাসে লিখন তবে মন খুলে নয়। বৃষ্টি আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথা বলে না। লিখনকে ঘাটাতে চায় না সে। নিজের মতো থাকলে ঠিক সামলে উঠবে, বৃষ্টি জানে।

বৃষ্টিদের বাসার সামনে এসে লিখন বলে,

-বাসায় যাও।

গেইট দিয়ে ভেতরে যাবার আগে বৃষ্টি বলে,

-আপনি মন খারাপ করবেন না। দেখবেন আপার সঙ্গে সব ভালো হবে। আপা অনেক ভালো একজন মানুষ। উনার সঙ্গে সব ভালো ভালোই হবে।

-তাই যেন হয় বৃষ্টি।

-তাই হবে দেখে নিয়েন।

-হুম, এখন বাসায় যাও তুমি। আর বেশি দেরি হলে খালাম্মা চিন্তা করবেন।

-আসি।

-হুম।

বৃষ্টি ভেতরে চলে গেলেও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে লিখন। ঢাকার শহরে রাত ১০ টা অনেক রাত নাহলেও এই সময়ে পথে ঘাটে বিশেষ করে এলাকার ভেতরের দিকে তেমন একটা মানুষ বাইরে থাকে না। যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের দূর্ঘটনা ঘটাটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বৃষ্টি উপরে গিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় দেখতে লিখন আছে না চলে গেছে। বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে তাকালেই দেখতে পায় লিখন এদিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো কথা বলে না বৃষ্টি কেবল হাত নাড়ায়। লিখন বৃষ্টিকে নিজের ঘরের বারান্দায় দেখেই যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরেই হাটা শুরু করে।

ছেলের চোখ-মুখের কনফিডেন্স দেখে দিলারা জামান পেছনের সোফায় বসে পড়েন। উপস্থিতি কারো মুখে কোনো কথা নেই। চিত্রলেখার ভীষণ নার্ভাস লাগছে। এত নার্ভাস এর আগে জীবনে কখনো লাগেনি। বোর্ড পরীক্ষার সময়ও না। বোর্ড পরীক্ষা দিতে বসে যদি দেখে প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্নও কমন পড়েনি তখন যেরকম নার্ভাস হওয়ার কথা এই মুহূর্তে তারচাইতেও কয়েকগুন বেশি নার্ভাস চিত্রলেখা। আর এমন মুহূর্তে রওনকের তার হাত ধরে রাখায় ইতস্ততের চাইতে বেশি ভালো লাগছে। খানিকটা ভরসা পাওয়া যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তানিয়া বলে,

-তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে যাও। ওকে নিয়ে ঘরে যাও রওনক।

তৎক্ষনাৎই দিলারা জামান বলেন,

-একমিনিট। আমার কথা তো এখনো শেষ হয়নি।

-এখন থাক মা। পরে নাহয়…

তানিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে ভাবী। বলো শুনছি।

-এই মেয়েটা কে?

-মাত্রই তো বললাম আমার ওয়াইফ, চিত্রলেখা।

-বউ বললেই বউ হয়ে যায় না রওনক।

-ডন্ট বি সিলি মা। বউ বললেই কেউ বউ হয়ে যায় না তা আমিও জানি। বিয়ে করলে বউ হয়। আর আমি ওকে বিয়ে করেই আমার বউ বানিয়েছি। ইট হেজ এ প্রোসিজার এন্ড আই অলরেডি ডান দ্যাট।

-বিয়েতে যে পরিবারের উপস্থিতি জরুরী এটা জানিস তো?

-জানি। ভাবী উপস্থিত ছিল আমার বিয়েতে।

দিলারা জামান মুখ তুলে একবার তানিয়ার মুখের দিকে তাকান। পুনরায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,

-বেশ। তা তোর বউ হওয়া ছাড়াও মেয়েটার নিশ্চয়ই অন্য পরিচয় আছে। বাবার নাম আছে, বংশ পরিচয় আছে।

-ওর পরিচয় ও নিজেই মা। একজন মানুষের পরিচয় সে নিজে। বাবার নাম, বংশ পরিচয় কারো আসল পরিচয় হতে পারে না।

তাচ্ছিল্যের সুরে দিলারা জামান বলেন,

-জামাম গ্রুপ কি মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে ইনভেস্ট করছে নাকি? তোর মুখে ফিল্মি ডায়লগ শুনতে পাচ্ছি।

রওনক বুঝতে পারছে মা তাকে ইচ্ছা করেই পোক করছে। এই ধরনের কথা বলতে যে তার মা ওস্তাদ তা রওনকের জানা। তাই ক্ষেপে না গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে,

-আইডিয়া মন্দ নয়। অবশ্যই এই বিষয়ে ভাববো। তবে আপাতত তোমার পারমিশন থাকলে আমরা ঘরে যাই?

-আমার কথা শেষ হয়নি রওনক।

রওনক চিত্রলেখাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে বসে পড়ে রিলাক্স ভঙ্গিতে। তারপর বলে,

-ভাবী তোমরাও বসো।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-বলো তোমার কথা, শুনছি।

-তুই নিশ্চয়ই ভুলে যাসনি আমি অলরেডি সাবার বাবাকে কথা দিয়ে রেখেছি।

-কিসের কথা?

-তোর আর সাবার বিয়ের কথা।

এমন কথা শুনে নিচের দিকে মুখ করে রাখা চিত্রলেখা এবারে মুখ তুলে রওনকের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ অবাক হয়েছে সে। রওনক চিত্রলেখার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

-আমি তো কখনো বলিনি সাবাকে বিয়ে করবো। আমার থেকে কনফার্ম না হয়ে কেনো কাউকে কথা দিয়েছো? এটা তো আমার হেডেক নয়। আমি ছোট বাচ্চা নই যে তুমি আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করবে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলবো। লাইফটা আমার তাই ডিসিশনটাও আমি নিবো কাকে বিয়ে করব আর কাকে করব না।

-আমি তো মা রওনক! তোর হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার রাইট আমার নেই?

-এসব ইমোশনাল কথা আমার সঙ্গে বলে লাভ নেই তা আগেই জানিয়েছিলাম তোমায়। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার জন্য কোনটা ইম্পর্ট্যান্ট আমার বিয়ে করা না সাবাকে বিয়ে করা। আই গেস তোমার মনে আছে। তখনই তোমার বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমি বিয়ে করলেও সাবাকে কখনো বিয়ে করবো না।

-সাবার মধ্যে কি সমস্যা? আমার পছন্দের কোনো ভ্যেলু নেই তোর কাছে?

উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে রওনক। অনেক চেষ্টা করেছে সে নিজের টেম্পার না হারাতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত খানিকটা টেম্পার হারায় সে। খানিক উচ্চ স্বরে বলে,

-করেছিলাম তো তোমাদের পছন্দে বিয়ে। তারপর কি হলো মনে নেই তোমাদের? ভুলে গেছো? মানুষ এক জীবনে হাজারটা বিয়ে করে না। এক বউ চলে গেলে আরেকটা বিয়ে, ওটা চলে গেলে আরেকটা দিজ ইজ নট লাইফ। এটলিস্ট আমি এমন না। বিয়েটা ছেলে খেলা নয় আমার জন্য।

-অতীতে যা হয়েছে ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিল রওনক।

-আর সেই এক্সিডেন্টটা আমি আবার করতে চাই না। নট এনি মোর। তোমাদের পছন্দকে প্রায়োরিটি দিয়ে বিয়ে করেছিলাম। তারপর যা হয়েছে সেজন্য আমি তোমাদের কাউকে দোষ দেই না। কারণ যা হয়েছে সেটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল, এখানে কারো হাত নেই। একবার যেহেতু তোমাদের কথা শুনেছি এবার নাহয় আমাকে আমার মতো করতে দাও। আমার লাইফ আমি কার সঙ্গে স্পেন্ড করব সেই ডিসিশানটা আমাকেই নিতে দাও। লেট মি লিভ প্লিজ।

স্তব্ধ নয়নে চিত্রলেখা কেবল রওনকের দিকে তাকিয়ে রয়। এমনিতেই বেচারীর মনচাইছে মাটি ফাঁক হয়ে তাতে সে ডুকে যাক। এখন যেনো আরও স্তব্ধ হয়ে গেল।

দিলারা জামান বলেন,

-তোর এই ডিসিশানটা যে কোম্পানির উপর প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারছিস?

-কোম্পানির চিন্তা তোমার না করলেও চলবে। আমি কোনো বাচ্চা নই যে হুজুগের বশে কাজ করে ফেলেছে। অনেক চিন্তা ভাবনার পরেই বিয়েটা করেছি। আর তুমি যদি মনে করো আমাকে কোম্পানি ছাড়তে হবে, বাড়ি ছাড়তে হবে তাহলে আগেই বলে রাখি এসব ইমোশনাল ডায়লগ দিয়ে কাজ হবে না তা তুমিও ভালো করে জানো। এই বাড়ি প্লাস জামান গ্রুপের ফিফটিফাইভ পার্সেন্ট শেয়ার হোল্ডার আমি, রওনক জামান। সো কেউ চাইলেই আমাকে আমার পজিশন থেকে সরাতে পারবে না। এমনকি তুমিও না।

দিলারা জামান আর কথা বলেন না। রাগে উনার চোয়াল শক্ত হয়। রওনক আরও বলে,

-তোমার আরও কিছু বলার থাকলে পরে কথা হবে। আপাতত আমি চন্দ্রলেখাকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। এসব ওর জন্য বেশি হয়ে গেছে। সি নিড’স টু রিলাক্স।

তানিয়ার দিকে তাকিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমরা ঘরে যাচ্ছি ভাবী।

-কিছু লাগলে আমায় বলো।

বসে থাকা চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে উঠায় রওনক। হাত ধরে টেনে উপরের দিকে অগ্রসর হয় তারা। চিত্রলেখা মাথা নিচু করে রেখেছে। রওনক একবার পেছন ফিরে চিত্রলেখার নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকায়। এই মুহূর্তে চিত্রলেখার মস্তিষ্কের ভেতর অনেক কিছু ঘুরছে। সবকিছু মিলে জগাখিচুরি হয়ে গেছে যেন। নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন। কীভাবে শান্ত করবে চিত্রলেখার জানা নেই। এই জগৎ টা যে তার নয় বেশ টের পাচ্ছে। রওনক জামানের মতো একজন মানুষের জন্য সে কোনোদিক দিয়েই উপযুক্ত নয় তা এই বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেয়ে গিয়েছে চিত্রলেখা। তারা দু’জন ভিন্ন দুই জগতের মানুষ। একে-অপরের পাশে তাদের কোনোভাবেই মানায় না। গোটা জীবন একসঙ্গে কাটানো তো দূরের কথা, একটাদিনও এই মানুষটার সঙ্গে থাকার যোগ্যতা তার নেই। চিত্রলেখা হয়ত মস্তবড় ভুল করে ফেলেছে। এমন একটা ভুল যা শুধরে নেবার কোনো রাস্তা নেই বা হয়ত আছে। কিন্তু রওনক কি অনুমতি দিবে এই ভুল শুধরে নেবার?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে রওনক বলে,

-তোমার কি হাটতে কষ্ট হচ্ছে? আমি কি তোমায় ক্যারি করব?

তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার বাড়ন্ত কদম থমকে যায়। মুখ তুলে রওনকের মুখের দিকে তাকায় সে। অবাক হয়ে চিত্রলেখার চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেছে। এক্ষুনি মনে হয় কোটোর থেকে বেরিয়ে আসবে। চিত্রলেখার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে হাসি পায় রওনকের কিন্তু এই মুহূর্তে সে হাসে না। নিজের মুখোভঙ্গি স্বাভাবিক ধরে রাখে। জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং রঙ?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। মুখে বলে,

-আমার হাটতে কষ্ট হচ্ছে না।

-আমার তোমাকে ক্যারি করতে একটুও কষ্ট হবে না।

বলেই আবার দু’জনে উপরের দিকে আগায়। দোতলায় উঠেই করিডর ধরে ডান দিকে এগিয়ে গেলেই রওকনের রুম। দোতলার এই পাশটায় রওনক থাকে। অন্যপাশে মিম ও মিশকাতের ঘর। দিলারা জামান, তানিয়া দু’জনেই নিচ তলায় থাকেন। নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রওনক। দরজাটা ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে চিত্রলেখাকে বলে,

-দিস ইজ ইউর বেডরুম। নো একচুয়েলি তোমার একার নয়, আমাদের। আওয়ার বেডরুম।

চিত্রলেখার মুখে কোনো কথা নেই। কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। রওনকের ভেতরে যে এমন সাইডও আছে তা চিত্রলেখার চিন্তা ভাবনায় কখনো ছিল না। অবশ্য থাকার কথাও নয়। সে কখনই রওনককে নিয়ে আলাদা করে ভাবেনি। ভাবার মতো কোনো সম্পর্ক তাদের ছিল না আগে কখনো। চিত্রলেখার হাত ধরে রেখেই তাকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে রওনক। ঢুকতেই চিত্রলেখা দেখে তারা একটা ব্যাক্তিগত লিভিং রুমে প্রবেশ করেছে। রুমের ডান পাশে দেয়াল জুড়ে সোফা বসানো আর বাম পাশে একটা টেবিল পেছনে দেয়াল কেবিনেট। ব্যাক্তিগত অসিফ সেটআপ দেখলেই বুঝা যায়। চিত্রলেখাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে রওনক বলে,

-আমার বন্ধুরা কখনো আসলে এখানে বসে আড্ডা দেয়া হয়। এছাড়া ওপাশে বসে আমি অফিসের কাজ করি। বাসা থেকে অফিস করলেও এখানেই কাজ করা হয়। আমার পারসোনাল অফিস বলতে পারো। চিত্রলেখা মনে মনে ভাবে সে ঠিকই ধরেছে। এগিয়ে গিয়ে রওনক আরেকটা দরজা খোলে। রওনকের বেডরুম৷ এতদিন তার একার ছিল, আজ থেকে তাদের দু’জনের। চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করতে করতে রওনক বলে,

-ওয়েলকাম টু মাই লাইফ, মাই ওয়ার্ল্ড। ওয়েলকাম।

চিত্রলেখা চুপ করেই রয়। কথা নেই তার মুখে। রওনক নিজেই চিত্রলেখার বাহুতে ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। নিচের দিকের মধ্যখানে। পা ঝুলিয়ে বসে আছে চিত্রলেখা। তাকে বসিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-তুমি একটু বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।

রওনক ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। সে চলে যেতেই চিত্রলেখা চারিদিকে চোখ বুলায়। একদম সিম্পল গেটআপ রুমের। দেয়ালের রঙ অফহোয়াইট। দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বিছানায়ও একই রঙের চাদর বিছানো। বিছানার ডান পাশটায় দু’জনের জন্য দু’টো সিঙ্গেল সোফা চেয়ার সঙ্গে ছোট টি-টেবিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুমটা দেখতে ব্যস্ত চিত্রলেখা। বিছানার ডানপাশে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রয়েছে তারপরেই দেয়াল জুড়ে পর্দা ফালানো। পর্দাগুলোও অফহোয়াইট রঙের। ওখানে সম্ভবত জানালা আছে তাই পর্দা লাগানো। কিন্তু এত বড় জানালা! ভাবে চিত্রলেখা। কারণ সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে পর্দা। বিছানার ঠিক অপজিট দেয়ালে একটা মস্তবড় টেলিভিশন ফিট করা। আসার সময় বাইরের ঘরের দেয়ালে ছবির ফ্রেম লাগানো দেখেছে চিত্রলেখা কিন্তু এই ঘরের দেয়ালে কোনো ছবির ফ্রেম নেই। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে তার অবাক লাগে। বেশি অবাক লাগে এটা দেখে যে এই ঘরে না আছে একটা আলমারি আর না ড্রেসিং টেবিল। কাপড়চোপড় রাখার জন্য কি তাহলে আলাদা ঘর আছে? ভাবে চিত্রলেখা। অবশ্য কাপড়চোপড় রাখার আলাদা ঘর থাকলে সে একটুও অবাক হবে না। এত বড়লোক মানুষের সবকিছু আলাদা হওয়ারই কথা। ওদের মতো তো এক ঘরে সব থাকার কথাও নয়। ওরা তো দুই রুমের একটা বাসায় ৪/৫ জন থাকতে পারে। কিন্তু বড়লোকদের তো ২ জন মানুষের জন্যও ডুপ্লেক্স কম হয়ে যায়। সেই তুলনায় এই বাড়ির সদস্য সংখ্যা একদম কম মনে হয়নি চিত্রলেখার। মুগ্ধ হয়ে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে ঘর দেখতে ব্যস্ত চিত্রলেখার বিষ্ময় কাটে দরজা খোলার শব্দে। রওনক বেরিয়ে এসেছে। গায়ের কাপড় বদলে গেছে তার। চিত্রলেখার জানতে আগ্রহ হয় ঐ দরজার ভেতর ওখানে কি আরেকটা ঘর, যেখানে রওনকের কাপড়চোপড় রাখা আছে। জানতে আগ্রহ হলেও সে কিছু জিজ্ঞেস করে না। তার দ্বারা সম্ভব হবেও না নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করার। রওনকে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখোমুখি বসে পড়ে। ফ্লোরে পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে মুখ তুলে চিত্রলেখার চোখে চোখ রাখে সে। হাত বাড়িয়ে নিজের দু’হাতের মুঠোয় চিত্রলেখার হাত আঁকড়ে ধরে। আতংকে সংকুচিত হয়ে আসে চিত্রলেখা। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। টের পায় ক্রমশ নিঃশ্বাস নিতে কিঞ্চিৎ কষ্ট হচ্ছে তার। শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছে। চেষ্টা চালায় কিন্তু নিজেকে সামলে নিতে হিমশিম খায় সে। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-আপসেট?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক আবারও জিজ্ঞেস করে,

-নিচের সিচুয়েশনটার জন্য আই এম সরি। আমি চাইনি এমন কিছু হোক তারপরেও… কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি থাকতে কেউ কখনো তোমাকে ছোট করতে পারবে না। অলওয়েজ, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি সবসময় তোমাকে প্রোটেক্ট করবো, কথা দিচ্ছি। আমি থাকতে আমার চন্দ্রলেখাকে কেউ কষ্ট দিতে পারবে না। কাউকে আমি এলাও করবো না, আই প্রমিজ।

অস্ফুটস্বরে চিত্রলেখা বলে,

-আমার নাম চিত্রলেখা, চন্দ্রলেখা নয়।

ডান দিকে তাকিয়ে ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকায় রওনক। আগের চাইতে আরও শক্ত করে হাত ধরে বলে,

-অন্য সবার জন্য তুমি চিত্রলেখা হলেও আমার জন্য তুমি চন্দ্রলেখা।

-চন্দ্রলেখা!

-হ্যাঁ, তুমি আমার চন্দ্রলেখা। চাঁদ ছাড়া যেমন রাত অসম্পূর্ণ তেমনি তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-তবে শুধু আমার জন্য। তোমায় চন্দ্রলেখা কেবল আমি ডাকবো, অন্যকারো এই নামে ডাকার পারমিশন নেই।

রওনকের কথায় অদৃশ্য কাঁপন ধরে চিত্রলেখার অঙ্গে। এই কাঁপন নগ্ন চোখে দেখতে পাওয়া যায় না, কেবল অনুভব করা যায় হৃদয় দিয়ে। অদৃশ্য কাঁপনে চিত্রলেখার ঠোঁট যুগল মৃদু কাপে। রওনক তার দৃষ্টি সরায় না। স্থির নয়নে তাকিয়ে রয়। যেনো জনম জন্মান্তরের না দেখতে পাবার পিপাসা মিটাতে ব্যস্ত সে। চিত্রলেখার কম্পিত ওষ্টদয় যেন রওনককে বলতে চায় তার দৃষ্টি সরিয়ে নিতে। ঐ দৃষ্টির মোহময় এই চাহনি আর সইছে না তার পরাণে। কিন্তু ঠোঁট তাকে সঙ্গ দেয় না। ফলাফল কিচ্ছু বলতে পারে না সে রওনককে।

নিজের দৃষ্টির চাহনি দিয়েই বুঝি চিত্রলেখাকে বশ করার প্রতিজ্ঞা করেছে সে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থাকার পর রওনক বলে,

-তুমি কি জানতে না আমার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল?

এতক্ষণে রওনকের কথায় ঘোর কাটে চিত্রলেখার। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে মাথা ঝাকায় সে। ফস করে আবারও নিঃশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে,

-অফিসে কম বেশি সবাই জানে আমি ডিভোর্সি। আগে একটা বিয়ে হয়েছিল আমার। সেটা ডিভোর্স হয়ে গেছে। শুনোনি?

-না।

-তিনবছরে কখনো শুনোনি?

-আমি আসলেে এই ধরনের গসিপে কখনো বসতাম না। অনেকেই সিনিয়রদের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে গসিপ করতো কিন্তু আমি কখনো ওখানে বসতাম না। কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না, রুচিতে আটকায়। তাই কখনো জানা হয়নি।

-অফিসের সবাই কম বেশি জানে বিষয়টা তাই ধরেই নিয়েছিলাম তুমিও জানো। আর জেনেই রাজি হয়েছো আমায় বিয়ে করতে।

চিত্রলেখা কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। রওনক নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-রাগ করেছো? কষ্ট পেয়েছো?

জোরে জোরে মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। বলে,

-আপনার আগের বিয়ে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, কোনো মাথা ব্যথা নেই।

-কোনো মাথা ব্যথা নেই!

অবাক হয় রওনক। চিত্রলেখা বলে,

-না।

-ওহ রিয়েলি?

তৎক্ষনাৎই উঠে দাঁড়ায় রওনক। চিত্রলেখাকে কিছু বুঝার সুযোগ না দিয়েই পেছন দিকে বিছানায় ঠেলে দেয়৷ সঙ্গে সে নিজে চিত্রলেখার উপরে চলে আসে। চিত্রলেখার শরীর জুড়ে রওনক জড়িয়ে আছে। মুখের ঠিক উপরেই মুখ তবে এদিকটায় খানিক দূরত্ব রয়েছে। এবারে রওনক বলে,

-কোনো সমস্যা নেই?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা।

-কোনো মাথা ব্যথা নেই?

এবারেও মাথা ঝাকায় তবে মৃদু ভাবে। ইতোমধ্যে চিত্রলেখার শরীর জমে ক্ষীর, পাথর হয়ে আসছে যেনো। শরীর জুড়ে কাঁপুনিও শুরু হয়ে গেছে। এই কাঁপুনি সম্ভবত রওনক টের পেয়েছে। তাই তো তার চোয়াল জুড়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি। চিত্রলেখার অঙ্গের কাঁপুনি আরও খানিকটা বাড়াতে হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করে রওনক, নিবিড়ভাবে। চিত্রলেখা উপলব্ধি করে এই স্পর্শ ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের গাঢ়, স্পর্শকাতর। তার অঙ্গের কাঁপন বাড়ে। মনে হয় শরীরের ভেতরে থাকা হাড়ও কাঁপছে। এই পর্যায়ে চিত্রলেখার দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়। এই বুঝি এক্ষুনি দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। নিচের দিকে আরেকটু ঝুঁকে রওনক। চিত্রলেখার একদম সন্নিকটে এসে কথা বলে। তার কথার সঙ্গে মুখ-নাক গলে বেরিয়ে আসা শ্বাস-প্রশ্বাস গিয়ে বারি খায় চিত্রলেখার নাক, ঠোঁট ও চিবুকে। রওনক বলে,

-বউ মানে বুঝো তো? এক ঘরে থেকেছি, এক বিছানায় ঘুমিয়েছি, এক সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। এরপরেও বলবে কোনো মাথা ব্যথা নেই?

চিত্রলেখার মুখে কথা নেই। স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে কেবল। নড়তে ভুলে গেছে সে, কথা বলতেও ভুলে গেছে। রওনকের স্পর্শ আরও প্রগাঢ় হয়, আরও নিবিড় হয়।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে