মাতাল হাওয়া পর্ব-৪০+৪১

0
565

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখাদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে রওনক। অন্যপাশে আছে নারগিস বেগম, লিখন, চয়ন ও চারু। চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে আছে রওনকের পাশেই। বসতে পারছে না বেচারী চিন্তায়। এক্ষুনি বিয়ের বিষয়টা সবাইকে বলতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি বলবে না আমি বলবো?

অন্যপাশে বাকিরা শব্দহীন। আপাতত উপস্থিত অন্যদের দৃষ্টি আটকে আছে ডাইনিং টেবিলের উপরে থাকা মিষ্টির প্যাকেটগুলোর দিকে। রওনক এর আগেও এই বাড়িতে এসেছে চিত্রলেখার বস হিসেবে। আজকেও এসেছে নিশ্চয়ই একই পরিচয়ে। কিন্তু হঠাৎ এত মিষ্টি নিয়ে আসার কারণটা গোলমেলে লাগছে সবার কাছে। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না মুখ ফুটে। অন্যরা চুপ করে থাকলেও চারু নিজের কৌতুহল, জানতে চাওয়ার আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারে না। তাই বেফাঁস বলে ফেলে, আপনি তো এত মিষ্টি নিয়ে আসছেন যেনো শশুরবাড়ি বেড়াতে আসছেন।

-এসব কেমন কথা চারু!

মৃদু স্বরে চারুকে ধমকাবার চেষ্টা করে লিখন। কিন্তু এই একই ধরনের চিন্তাভাবনা তার নিজের মস্তিষ্কের ভেতরেও চলছে। শুধু প্রশ্ন করতে পারছে না অনুচিত হবে ভেবে। রওনক মুখ তুলে একবার চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ওকে কিছু বলো না। ও ঠিকই বলেছে।

-ঠিক বুঝলাম না। (জিজ্ঞেস করে লিখন)

রওনক উঠে দাঁড়ায়। অফিস থেকে এখানে চলে এসেছে চিত্রলেখাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। দু’কদম এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে রওনক বলে, আমরা বিয়ে করেছি।

রওনকের কথায় যেনো ঘরের নীরবতা বাড়লো। আগেও কেউ কথা বলছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ঘরটা আরও নিশ্চুপ হয়ে গেল। রওনক নিজের কথার সঙ্গে যুক্ত করে, গতকাল বিয়ে করেছি আমরা। আজ ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছি।

বলেই চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকায় রওনক। আর এদিকে চিত্রলেখা সংকোচে, অজানা ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়েছে। তা বুঝতে পেরে রওনক আলতো করে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে। তাদের হাত ধরার দৃশ্য কারো দৃষ্টি এড়ায় না। যেনো রওনক ইচ্ছা করেই হাতটা ধরেছে। কারো এখনো বিশ্বাস করতে অসুবিধা হলে তাদের একে-অপরকে হাত ধরতে দেখলে তাদের অবিশ্বাস কাটবে। চিত্রলেখা নিশ্চয়ই তার বসের হাত ধরবে না এভাবে। কিন্তু স্বামীর হাত ঠিকই ধরবে। রওনকের কথা শুনে উপস্থিত কেউই এখনো ধাতস্থ হতে পারেনি। আমতা আমতা করে নারগিস বেগম বলেন, এসব কি বলছেন বাবা আপনি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কখন বিয়ে করলেন আর কীভাবেই বা করলেন? আমরা তো কেউ কিছু জানি না।

-আসলে দোষটা আমারই। আমিই তাড়া দেয়ার ফলে জলদি জলদি বিয়েটা করতে হলো তাই আপনাদের কাউকে জানানোর সময় পাইনি। শুধু আপনারা না, আমার বাসায়ও কেউ কিছু জানে না এখনো। এখান থেকে গিয়ে বাসায় জানাবো।

নারগিস বেগম হয়ত আরও কিছু বলতেন কিন্তু এর আগেই লিখন দাঁড়িয়ে পড়ে৷ চিত্রলেখাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপা একটু ঘরে আসো তো কথা আছে।

লিখন আর দাঁড়ায় না। চিত্রলেখার ঘরে চলে যায়। রওনকের মুখের দিকে তাকালে সে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে সব ঠিক হয়ে যাবে। ❝আসছি❞ বলেই চিত্রলেখা নিজের ঘরের দিকে আগায়। তার পেছন পেছন চারু, চয়নও উঠে যায়। ড্রইং রুমে রয়ে যায় রওনক ও নারগিস বেগম। কি বলবেন বা কি বলা উচিত ভেবে পান না তিনি। বরং উনাকে স্বাভাবিক করতে রওনক নিজেই বলে, আপনি চাইলে যেতে পারেন। আমার জন্য বসতে হবে না।

নারগিস বেগম চাইছিলেন উঠে যেতে। চিত্রলেখার সঙ্গে কথা আছে উনার। কিন্তু সবাই আচমকা উঠে যাওয়ায় উনি আর উঠতে পারলেন না। রওনক নিজ থেকে বলায় উনার জন্য সহজ হলো। সত্যি সত্যি উনি আর অপেক্ষা করলেন না। উঠে গেলেন চিত্রলেখার ঘরের দিকে।

-এসব কি আপা?

-শুনতেই তো পারলি।

-তুমি সত্যি সত্যি বিয়ে করছো?

-বিয়ে কি মিথ্যা মিথ্যা হয় লিখন?

-মিথ্যা হয় না জানি। কিন্তু এভাবে কেন? তুমি বিয়ে করতে চাইলে কি আমরা আপত্তি করতাম?

-তোরা আপত্তি করতি না আমি জানি। কিন্তু…

চিত্রলেখা বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। কি বাহানা করবে? আগে থেকে অনেক কিছুই ভেবে রেখেছিল বলার জন্য কিন্তু এখন আর সেসব কথা মাথায় আসছে না। সব গুলিয়ে গেছে।

-কিন্তু কি আপা?

-তুই আর ওকে জেরা করিস না লিখন।

বলতে বলতেই পেছন থেকে এগিয়ে আসেন নারগিস বেগম। চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে আরও বলেন, আমরা তো চাইলেই উনাদের মতো আয়োজন করতে পারবো না সেজন্যই হয়ত তোর বোন এভাবে বিয়েটা করেছে৷ তোর বোনকে কখনো দেখছিস চিন্তা ভাবনা ছাড়া কোনো কাজ করতে? তোরা আর ওর উপর রাগ করিস না।

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিখন বলে, আমি রাগ করি নাই খালা। আমার বোন বিয়ে করছে নিজের পছন্দে, নিশ্চয়ই নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করেছে। আমার জন্য এইটা খুশির ব্যাপার। দুঃখ লাগলো আপা আমাদের বঞ্চিত না করলেও পারতো। জানি উনাদের মতো আচার-অনুষ্ঠান করার সামর্থ্য আমাদের নাই অন্তত যেভাবে বিয়েটা হইছে সেভাবেই নাহয় আমরা সঙ্গে থাকতাম। তাও তো বলতে পারতাম আমার আপার বিয়ের সময় আমি তার পাশে ছিলাম। এতখানি আপার আমাদের বঞ্চিত করা উচিত হয় নাই খালা।

লিখন নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, তুমি নিজের পছন্দে, নিজের ইচ্ছায় বিয়েটা করছো তো?

চিত্রলেখা কেবল মাথা ঝাকায়। লিখন আরও বলে, কেন করছো, কি কারণে করছো, হঠাৎ কেন করলা কিছু জানতে চাইবো না। তুমি ভালো থাকলেই চলবে এর বেশি আমার কিছু চাই না আপা, সত্যি বলছি।

চিত্রলেখা লিখনের হাত ছেড়ে দিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

-আমি ভাবছি তোরা হয়ত রাগ করবি। তাই আগে বলার সাহস পাই নাই।

-তুমি কি পাগল হইছো আপা? তোমার বিয়ের কথা শুনলে আমরা রাগ করব তুমি ভাবলা কেমনে? এত বোকা কেন তুমি আপা?

চিত্রলেখা আর কথা বলতে পারে না। লিখন নিজেই জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আজকেই চলে যাবা?

লিখন কে ছেড়ে দিয়ে নিজের চোখ মুছে চিত্রলেখা। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আজকেই নিয়ে যাবেন। গতকালই নিয়ে যাইতেন আমিই বলছি আজকের কথা।

-তোমার বরের তো দেখছি অনেক তাড়া আপা।

উপস্থিত সকলের মুড ঠিক করতে মজা করে কথাটা পাশ থেকে বলে চয়ন। তাকে ধমকে দিয়ে লিখন বলে, তোর বড় বোনের বর তুই মজা নিচ্ছিস বেয়াদব।

চিত্রলেখা বাঁধা দিয়ে বলে, থাক ওকে বকিস না।

এবারে নারগিস বেগম সকলকে তাড়া দিয়ে বলেন, নতুন জামাই একা বসে আছে। তোরা সব এখানেই বসে থাকবি? যা গিয়ে বেচারাকে সঙ্গ দে। চারু তুই চা নাস্তা দে গিয়ে। আমি আসছি।

ওরা বেরিয়ে গেলেই নারগিস বেগম বলেন, তুই একটু থাক।

চিত্রলেখার খাটের নিচে থাকা একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক বের করেন নারগিস বেগম। এটায় কি আছে কেউ জানে না। ট্রাঙ্কের তালা খুলতেই চিত্রলেখা তাকিয়ে থাকে। নারগিস বেগম এতকাল যত্ন করে এই ট্রাঙ্কের ভেতর চিত্রলেখার মায়ের বেশ কিছু গহনা আড়াল করে রেখেছিলেন। নিজের স্বামীকে সে ভালো করেই চিনেন। ঐ লোকের নজরে গহনাগুলো পড়লে অনেক আগেই সব বেঁচে ফেলতেন। তাই এতগুলো বছর কাউকে গহনাগুলোর হদিস হতে দেননি। গহনাগুলো বিছানায় মেলে দিয়ে বলেন, তোর যেটা পছন্দ তুই নিয়ে যা। বাকিগুলো চারু, লিখন, চয়নের বউয়ের জন্য থাকুক।

মায়ের গহনাগুলোকে দু’হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চিত্রলেখা। গহনাগুলো থেকে মা মা ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখার পর পুনরায় নামিয়ে রাখে। গুছিয়ে রাখতে রাখতে মৃদু হেসে চিত্রলেখা বলে, এই সামান্য কয়টা জিনিস চার ভাগ করতে চাও?

-এগুলোর উপর তোদের ৪ জনেরই সমান অধিকার।

-আমার এখান থেকে কিচ্ছু লাগবে না খালা। এই গহনাগুলো তুমি চারুকে দিও ওর বিয়ের সময়। লিখন, চয়নের বিয়ের সময় ওদের বউদের কি দিতে হবে সেটা সময়ের টা সময় মতো আমি দেখে নিবো। এগুলো সব চারুর জন্য থাকুক খালা।

-তুই কিচ্ছু নিবি না?

-তোমার দোয়া ছাড়া আমার আর কিচ্ছু লাগবে না খালা।

-কিন্তু এভাবে খালি কান, গলা নিয়ে শশুরবাড়ি গেলে কি ভালো দেখাবে?

-এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। যারটা সে ঠিক ব্যবস্থা করে নিবেন।

নারগিস বেগম চিত্রলেখার একটা হাত ধরে বলেন, তোরে আমি পেটে ধরি নাই তারপরেও তুই আমার সন্তান। পেটে না ধরছি তো কি হইছে পালছি তো আমিই। জানি তো তোরে, চিনিও। অকারণে কিছু করার লোক তুই না। বিয়ের মতো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত যে তুই এমনি এমনি নেস নাই তাও জানি। কিন্তু কেন এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিছিস তা জানতে চাইবো না। তোর যদি কোনোদিন মনে হয় খালারে বলবি তখনই শুনবো। তোর উপর আমার অনেক বিশ্বাস রে মা। দিনদুনিয়া ভুল হইতে পারে কিন্তু আমার চিত্র কোনোদিন ভুল কাজ করবে না আমি জানি।

খালার কথায় চিত্রলেখার চোখ ভিজে আসতে চায়। কিন্তু আপাতত কান্নাকাটি করার সময় নয়। কান্নাকাটির জন্য পরে সময় পাওয়া যাবে। আপাতত নিজেকে সামলে নেয়।

চিত্রলেখা ড্রইং রুমে ফিরে আসতেই রওনক তার দিকে কয়েকটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে, আমাদের বের হতে হবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।

-এর মধ্যে কি?

-তোমার কাপড়চোপড় আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস।

চিত্রলেখা তৎক্ষনাৎই খুলতে নিলে রওনক বাঁধা দিয়ে কাছাকাছি এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফাস করে বলে, এখানেই খুলো না। ব্যাগের ভেতর তোমার জন্য আন্ডার গার্মেন্সও আছে।
রওনকের কথা শুনে চিত্রলেখা চোখ বড় বড় করে তাকায়। তা দেখে রওনক আরও বলে, আমি চাই না তুমি এখান থেকে কিছু নিয়ে যাও। তাই তোমার প্রয়োজন হবে এমন সবকিছুই নিয়ে এসেছি। যদিও এখানে একসেটই আছে বাকিটা পরে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

সকলের উপস্থিতিতে দু’জনের এভাবে কথা বলাটা কেমন দেখায় চিন্তা করে চিত্রলেখা সরে দাঁড়ায়। ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে, আমি তৈরি হয়ে আসছি।

চিত্রলেখার পেছন পেছন চারুও চলে আসে। ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে দেয়। তা দেখে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবি?

চারুর চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা। বোনের কাছাকাছি এগিয়ে এসে চারু বলে, মামুন ভাইয়ের কী হবে আপা?

এত সবকিছুর মধ্য দিয়ে চারু ভাবছে মামুনের কথা। চিত্রলেখার তো খেয়ালই ছিল না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটেছে যে মামুনের কথা ভাবার খেয়ালই ছিল না। চিত্রলেখা তাকিয়ে থাকে চারুর মুখের দিকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। চারুর বাহু ধরে চিত্রলেখা বলে, তুই এত ভাবিস না। সময়ের টা সময়ে দেখা যাবে। তাছাড়া আমি তো উনার সঙ্গে কমিটেড ছিলাম না।

-মানুষটা তোমাকে সত্যি অনেক ভালোবাসে আপা।

-সবসময় কেবল ভালোবাসা দিয়ে জীবন চলে না রে চারু। কেবল ভালোবাসা থাকলেই জীবন সুন্দর হয় না, সুখের হয় না।

-কিন্তু ভালোবাসা তো দরকার আপা। আর মামুন ভাই সত্যি তোমাকে ভালোবাসে। উনার ভালোবাসায় কোনো খাদ নাই।

-জানি খাদ নাই। কিন্তু আমি মামুন ভাইয়ের ভালোবাসার যোগ্য না। একদিন উনার জীবনেও এমন একজন আসবে যে উনাকে সবকিছুর চাইতে বেশি ভালোবাসে। নিখাঁদ ভালোবাসবে।

-যেমনটা তোমার বর তোমাকে ভালোবাসছে, সেইরকম তাই না আপা?

চিত্রলেখা জবাব দেয় না কেবল তাকিয়ে রয়। এই যে হুট করেই জোকের মাথায় বিয়েটা করে ফেলল কিন্তু এই মানুষটার সাথে কি কোনোদিন চিত্রলেখার ভালোবাসা আদান-প্রদানের মতো গভীর সম্পর্ক তৈরি হবে? এই বিনিময়ের সম্পর্কে কি কখনো ভালোবাসা আসবে? দু’জনের মাঝে গভীর কোনো সম্পর্ক তৈরি হবে? কাছাকাছি আসা হবে কি কখনো?

চিত্রলেখা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসতেই তাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় রওনক। মিক্সড কটন ফেবিক্সের মধ্যে প্রিন্ট করা একটা থ্রিপিস এনেছিল রওনক চিত্রলেখার জন্য। যা এই মুহূর্তে চিত্রলেখার পরনে। চাইলেই খুব বেশি ঝাঁক ঝমক কিছু আনতে পারতো কিন্তু রওনকের সিম্পল এই ড্রেসটাই পছন্দ হয়েছে। লং স্লিভ ও হাই নেক দেয়া সাধারণ ড্রেসটায় একরকম অসাধারণ লাগছে চিত্রলেখাকে দেখতে। অন্যদের কাছে হয়ত ওতটাও অসাধারণ লাগছে না কেবল রওনকের কাছেই অসাধারণ লাগছে। এত অসাধারণ লাগার কারণ কি? বরাবরের মতোই মুখে কোনো প্রসাধনী নেই কেবল ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক এতেই চমৎকার লাগছে দেখতে। রওনক চিত্রলেখার জন্য ছোট্ট একজোড়া রেগুলার পড়ার মতো কানের দুল, গলার একটা চেইন লকেট, দু’হাতের জন্য দু’টো করে চারটা চুড়ি, দু’টো আংটিও নিয়ে এসেছিল। সবগুলো জিনিসই ডায়মন্ডের। প্রথমে চিত্রলেখা দেখে ভেবেছিল হয়ত স্টোনের হবে। কিন্তু তার বুঝতে বেশি একটা সময় লাগেনি জিনিসগুলো ডায়মন্ডের। বুঝতে পারার পর পরতে ইতস্তত লাগলেও কিছু করার ছিল না।

রওনক চিত্রলেখাকে দেখে বলে, নাকের জিনিসটা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনবো তাই কিনিনি।

চিত্রলেখা কেবল ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি করে তাকিয়ে থাকে। মুখে রা করে না। পাশ থেকে নারগিস বেগম বলেন, আজকেই নিয়ে যাবেন। কয়টাদিন পরে নাহয়।

-কয়দিন পরে এসে নাহয় থেকে যাবে। আজ নিয়ে যাই। সামনে অনেক কাজ বাকি। বিয়েটা চুপ করে করলেও সবাইকে জানাতে হবে কিছু আয়োজনও করা বাকি।

এরপর কেউ আর বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে না। রওনক চিত্রলেখাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে লিখন এগিয়ে এসে বলে, আপনার প্রতি আমাদের কোনো অভিযোগ নেই তবে অনুরোধ আছে। আমার বোনটার খেয়াল রাখবেন প্লিজ। নিজের দুঃখ, কষ্টের কথা কখনো মুখ ফুটে বলে না। আপনি দেখবেন ওর যেনো কোনো কষ্ট না হয়।

রওনক হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে। লিখন হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরতেই রওনক বলে, তোমরা একদম কোনো চিন্তা করো না। আজ থেকে তোমার বোনের সুখ, দুঃখে দায়িত্ব আমি। ওর যেনো কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের কষ্ট না হয় সেটা দেখবো আমি। আমার জন্য ও সবকিছুর উর্ধ্বে থাকবে। আই উইল টেক কেয়ার অফ হার।

চারুকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখে চিত্রলেখা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার চোখে কোনো পানি নেই। মেঘলা আকাশের মতো বুকটা ভার হয়ে থাকলেও চোখের কোণে পানি নেই। কেমন যেনো সব গুমোট হয়ে আছে ভেতরে। চারুকে জড়িয়ে রেখেই চিত্রলেখা বলে, সবার খেয়াল রাখিস, তোর দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি।

চিত্রলেখার চোখে পানি না আসলেও চারু ইতোমধ্যেই কেঁদে ফেলেছে। বোনকে জড়িয়ে ধরতেই কান্নার বাঁধ ভেঙে গেছে ওর। পারছে না কেবল হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে। এগিয়ে এসে চারুকে ছাড়িয়ে নিয়ে নারগিস বেগম বলেন, যাওয়ার সময় এভাবে কাঁদতে হয় না মা। হাসি মুখে বিদায় দিতে হয়।
চারুকে বুঝিয়ে চিত্রলেখার কপালে একটা চুমু খান নারগিস বেগম। বিদায় জানিয়ে বলেন, সাবধানে যা মা। স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাক।
মনে মনে আরও বলেন, তোর কপালটা অনেক ভালো হোক, অনেক সুখের হোক। দুঃখের ছিটো ফোঁটাও না থাকুক তোর জীবনে।

বেরিয়ে যাবার জন্য বাড়ির নীল রঙের গেইটটা খুলতেই থতমত হয়ে তাকিয়ে রয় চিত্রলেখা। মামুন দাঁড়িয়ে দরজার ওপাশে। চিত্রলেখাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে, কই যাও মায়া?

পেছন থেকে এগিয়ে এসে রওনক চিত্রলেখার হাত ধরে বলে, তোমার কি আরেকটু সময় লাগবে?

-দু’মিনিট প্লিজ।

মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যায় রওনক। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়ায়। মামুন তাকিয়ে আছে চিত্রলেখার মুখের দিকে।

-আমার প্রতি কোনো অভিযোগ রাখবেন না মামুন ভাই। আমি আপনার ভাগ্যে ছিলাম না।

-কি বলতেছো আবোলতাবোল? যাও কই?

চিত্রলেখা বুঝতে পারছে না কীভাবে বলবে। তাই তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসে চারু বলে, আপা শশুরবাড়ি যায় মামুন ভাই। আপার বিয়ে হয়ে গেছে।
রওনককে ইশারা করে দেখিয়ে আরও বলে, ঐ যে আপার বর, আপাকে নিতে আসছে। আপা এখন চলে যাবে। চারু আরও বলে, যাও আপা তোমাদের দেরি হয়ে যাইতেছে। মামুন ভাইকে আমি বাকিটা বলবো নাহয়।

-আসি মামুন ভাই, ভালো থাকবেন।

এতটুকু বলেই বেরিয়ে যায় চিত্রলেখা। সে এগিয়ে আসতেই রওনক দরজা খুলে দেয়। সবসময় মতো সিটবেল্টটাও লাগিয়ে দেয়। চিত্রলেখার ভেতর যেন বিশেষ ভাবান্তর নেই। সে নিশ্চুপ বসে আছে। গাড়ি চালাতে শুরু করে রওনক।

আর এদিকে মামুন পাথরের মতো তাকিয়ে রয় চারুর দিকে। দিন পাঁচেক আগে একরাতে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিল মামুন। স্বপ্নে দেখেছি চিত্রলেখা একটা লাল রঙের টকটকে বেনারসি পরনে। তাকে দেখতে একদম বউ বউ লাগছে। চিত্রলেখাকে বউ সাজে দেখে মামুন জিজ্ঞেস করেছিল, বউ সাজছো কেন মায়া?

জবাবে চিত্রলেখা বলেছিল, আজকে আমার বিয়ে মামুন ভাই তাই বউ সেজেছি।

-কি যা তা বলতেছো। তোমার বিয়ে তো আমার সঙ্গে হবে।

-না মামুন, আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে না। আমার বিয়ে হবে অন্য একজনের সঙ্গে।

-অন্য একজনের সঙ্গে?

-হ্যাঁ, অন্য একজন আমার বর হবে।

তারপর মামুনের স্বপ্নটা ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর টের পায় শেষ রাতের স্বপ্ন ছিল। এরপর বাকি সময় আর ঘুম হয়নি তার। অজানা, অচেনা একটা চাপা ভয় রয়ে গিয়েছিল তার ভেতরে। সেই ভয় থেকেই দু’দিন আগে সে চিত্রলেখাকে বলেও গিয়েছিল পরের শুক্রবার বাবা-মাকে পাঠাবে বিয়ের কথা পাকা করতে। কিন্তু এর মধ্যেই তার জীবনের কঠিন অঘটনটা ঘটে গেল।

চারু বলতে নেয়, হয়েছে কি মামুন ভাই…
চারুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মামুন বলে, থাক চারু তোমার কিছু বলা লাগবে না। আমি আসি।
মামুন বেরিয়ে গেলে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রয় চারু। খুব বেশি কষ্ট লাগছে চারুর। কিন্তু কার জন্য কষ্ট লাগছে সেটা বুঝতে পারছে না। বোন চলে গেল বলে দুঃখ লাগছে নাকি মামুনের জন্য?

এখনো তারা চিত্রলেখাদের বাড়ির গলিতেই আছে। ভেতরের গলি তুলনামূলক ছোট হওয়ায় খুব একটা দ্রুত টানা যায় না। তাছাড়া রওনকেরও কোনো তাড়া নেই। পথ চলার সঙ্গী সাথেই আছে। বাসায় পৌঁছাতে সামান্য দেরি হলেও সমস্যা নেই। নিজের মোবাইল ফোনটা বাম হাত দিয়ে চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ধরো তো।

ফোনটা হাতে নিতেই রওনক পাসওয়ার্ড বলে ফোন খুলার ইন্সট্রাকশন দেয়। চিত্রলেখা এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকে রওনকের মুখের দিকে কি সুন্দর নিজের ব্যাক্তিগত ফোনের পাসওয়ার্ড বলে দিলো তাকে। রওনকের এমন কাজে অভিভূত হয় সে। ফোনের লক খুলতেই রওনক বলে, সেটিংসে যাও।

মোবাইলের সেটিংসটা কোথায় তা খুঁজে বের করতে সামান্য সময় লাগে চিত্রলেখার। ততক্ষণে উপযুক্ত জায়গা দেখে গাড়িটা দাঁড় করায় রওনক। গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলে, এবার আমাকে দাও।

রওনক তার ফোনের সিকিউরিটি সিস্টেমে চলে যায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট অপশনে গিয়ে চিত্রলেখার আঙ্গুলের ছাপও এড করে দেয়। এতে করে চিত্রলেখা চাইলেই যখন তখন রওনকের ফোন খুলতে পারবে। রওনকের কান্ড থেকে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে, এটা কি করলে? আপনার ফোনে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এড করলেন কেনো?

যদি কখনো আমার ফোনটা তোমার ইউজ করতে হয় আর আমি আশেপাশে না থাকি, তোমার যদি পাসওয়ার্ড মনে না থাকে সেজন্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট এড করে দিলাম। তুমি সহজেই ফোনের এক্সেস নিতে পারবে।

-কিন্তু এটা তো আপনার পার্সোনাল ফোন।

-হাসবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে পার্সোনাল বলে কিছু হয় নাকি? তোমাকে জীবনের এক্সেস দিয়ে দিলাম সেখানে মোবাইল তো সামান্য ব্যাপার।

চিত্রলেখা অদ্ভুত চাহনি করে তাকিয়ে রয়। মানুষটাকে আরও বেশি রহস্যে মোড়ানো মনে হচ্ছে তার কাছে। রওনক আরও বলে, এনি ওয়েজ এখন সবাইকে জানাবো।

-এক্ষুনি?

-হ্যাঁ, এক্ষুনি।

-কীভাবে? আমরা কোথায় যাচ্ছি?

-বাসায়।

রওনকের কথার আগা মাথা চিত্রলেখার বোধগম্য হয় না। কেমন গোলক ধাঁধার মতো লাগে। চিত্রলেখাকে কিছু ক্লিয়ার না করে রওনক জিজ্ঞেস করে, তোমার ফেসবুক আইডি আছে না?

-আছে তো।

-চালাও?

-চালানো হয় না। তবে চারু খুলে দিয়েছিল। ওই কখনো কখনো এটা সেটা করতো।

-ফোনে লগইন করা আছে?

-আছে।

নিজের ফোন থেকে রওনক তার আইডিতে ঢুকে ফোনটা চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তোমার আইডি নাম সার্চ করে এড পাঠাও আমার আইডি থেকে।

চিত্রলেখা বাড়তি প্রশ্ন করে না। রওনক যা বলে তাই করে। নিজের একাউন্টে এড পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, এরপর?

-তোমার আইডিতে গিয়ে এক্সেপ্ট করো।

-কিন্তু আমার ফোনে তো ইন্টারনেট নেই।

-এক মিনিট।

রওনক নিজের ফোনের হটস্পট চালু করে চিত্রলেখার ফোনে কানেক্ট করে দিয়ে নিজেই তার আইডিতে ঢুকে গিয়ে রিকুয়েষ্ট এক্সপেক্ট করে। তারপর নিজের ফোন থেকে চিত্রলেখাকে ট্যাগ করে ম্যারিটাল স্ট্যাটাস পোস্ট দিয়ে বলে, নোটিফিকেশন গিয়েছে, তোমার আইডি থেকে এক্সেপ্ট করে নাও।

চিত্রলেখা তাই তাই করে যা রওনক তাকে করতে বলে। বিয়ের স্ট্যাটাস দেয়া হয়ে গেলে নিজের ফোনটা চিত্রলেখার হাতে দিয়ে রওনক বলে, সবাইকে জানানো শেষ। আমার ফোনটা সাইলেন্ট করে তোমার কাছে রেখে দাও। পাঁচ মিনিট পরেই ফোন আসতে শুরু করবে। বউ নিয়ে বাড়ি ফিরছি এর মধ্যে কারো ডিস্টার্বেন্স চাই না।

বলেই রওনক গাড়ি চালাতে শুরু করে। চিত্রলেখা কয়েক মুহূর্ত তাকায় রওনকের মুখের দিকে তারপর চোখ সরিয়ে নেয় অন্য দিকে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

দিলারা জামান নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা। এই বইটা উনার ভীষণ প্রিয়। এই জীবনে কতবার যে পড়েছেন এর হিসেব নেই। এখনো প্রায়ই মন চাইলে বইটা নিয়ে বসে যান। একবসায় পড়ে ফেলেনে। আজও একই চিন্তা ভাবনা করেই বসেছিলেন বইটা নিয়ে সন্ধ্যার পরে। প্রায় শেষের দিকেই আছেন। ১০/১৫ পৃষ্টার মতো বাকি আছে। এটুকু শেষ করে একেবারেই উঠবেন। কিন্তু আচমকা উনার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায়। বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে একবার পাশে থাকা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকান তিনি এই রাতের সময় কে ফোন করেছে দেখতে। মোবাইলের স্ক্রিনে ছোট বোন ডালিয়ার নাম ভাসছে। হাত বাড়িয়ে রিংটোনের আওয়াজ বন্ধ করেন। ফোনটাকে ভাইব্রেশন মুডে দিয়ে দেন। কিন্তু উনার বোন ডালিয়া থামেন না। কল রিসিভ না হওয়ায় আবার কল দেন। দ্বিতীয়বার রিসিভ না হওয়ায় তৃতীয়বার কল লাগায়। এদিকে দিলারা জামান ফোনের ভাইব্রেশনের কারণে টের পাচ্ছেন উনার ফোনটা যে বেজেই চলেছে। ভাইব্রেশন মুডে থাকলেও ফোনটা কাছেই আছে বিধায় উনি টের পাচ্ছেন। এবারে অনেকটা বাধ্য হয়েই হাতের বই বিছানায় নামিয়ে রেখে কল রিসিভ করেন। ফোনটা কানে তুলে কিছু বলবেন তার আগেই লাইনের অন্যপাশ থেকে ডালিয়া বলেন,

-কি গো আপা লুকায় লুকায় ছেলের বিয়ে দিয়ে ফেললে আমাকে বললেও না। আর এখন ফোনটাও ধরছো না। ভীষণ কষ্ট পেলাম। তোমার থেকে তো এমনটা আশাই করিনি।

-কি যা তা বলছিস ডালিয়া? আমার আবার কোন ছেলের বিয়ে হলো?

-বারে তোমার ছেলে তুমি বিয়ে দিয়েছো আর এখন আমার কাছে জানতে চাইছো কোন ছেলেকে বিয়ে দিলে! আর ভনিতা করতে লাগবে না আপা। বুঝলাম আমি তোমার পর হয়ে গিয়েছি।

ছোট বোনের কথা শুনে বিরক্তি ধরে যায় দিলারা জামানের। অহেতু ফাজলামো উনার একদম পছন্দ নয়। তাই কন্ঠস্বর খানিকটা উঁচু রেখেই বলেন,

-ভনিতা আমি করছি না তুই করছিস? কি বলতে চাস সরাসরি বল নয়ত আমি রাখছি। তোর মতো অঢেল সময় আমার হাতে নেই অপচয় করবার, ব্যস্ত আছি।

-হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো তুমি ব্যস্ত থাকবেই। ছেলের বিয়ে দিয়েছো, ঘরে নতুন বউ এসেছে। এখন তো তোমার ব্যস্ত থাকারই সময়।

-আবার একই কথা বলছিস তুই? কার বিয়ের কথা বলছিস বল তো ডালিয়া। ভনিতা বাদ দিয়ে ক্লিয়ার করে বল।

-রওনকের কথা বলছি আপা। রাদিনের তো বউ, বাচ্চা আছে ওকে নিশ্চয়ই তুমি আবার বিয়ে দিবে না।

-রওনকের বিয়ে!

-হ্যাঁ, আর নয়ত কে! জানি এটা রওনকের দ্বিতীয় বিয়ে তাই বলে এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়েই দিয়ে দিলে। কাকপক্ষীতেও টের পেলো না।

-ডালিয়া! তোর কি মাথাটা গেছে? রওনককে কেনো বিয়ে দিতে যাবো?

-মানে! তুমিই তো রওনককে বিয়ে করাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলে।

-তা সত্য বিয়ে তো দিবোই, সারাজীবন তো আর একা থাকবে না। কিন্তু তুই কি বলছিস বিয়ে দিয়ে দিয়েছি লুকিয়ে এসব কি? কে বলল তোকে রওনককে বিয়ে দিয়েছি।

-রওনক।

-রওনক! (অবাক হওয়া দিলারা জামানের কন্ঠে স্পষ্ট)

-হ্যাঁ।

-ও নিজে বলেছে তোকে?

-না না নিজে বলেনি।

-ডালিয়া কি বলছিস তুই এসব? একবার বলছিস রওনক বলেছে আবার বলছিস রওনক নিজে বলেনি। মানে কি এসবের? তুই কি ফাজলামো করতে ফোন করেছিস?

-আরে না আপা। তোমার কনফিউশান দেখে আমিও গুলিয়ে ফেলেছি।

-তাহলে একটু ক্লিয়ার করে বল কি বলতে চাইছিস। আমি তো তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

বোনের সঙ্গে কথা বলতে থাকা অবস্থাতেই দিলারা জামানের আরেকটা কল আসে। রওনকের চাচী ফোন করেছে। কল কেটে দেবরের বউয়ের কল রিসিভ করতে নিয়েও করতে পারেন না বোনের কথা শুনে। ডালিয়া বলেন,

-সজিব আমাকে এই মাত্রই দেখালো রওনক ওর ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেছে বিয়ের বিষয়টা।

-রওনক!

-হ্যাঁ তো। এই মাত্রই দেখলাম। ওর বউ…

দিলারা জামান আর বোনের কথা শুনেন না। লাইনটা কেটে দিয়ে ফেসবুকে ঢুকেন। এদিকে তার ফোনে একে একে আত্মীয়স্বজনদের কল আসতে শুরু করেছে। ফেসবুকে ঢুকতেই তব্ধা খান তিনি। উনাকে কষ্ট করে ছেলের আইডির টাইমলাইনে যেতে হয়নি। নিজের ফেসবুক আইডিতে ঢুকতেই উনার নিউজফিডে প্রথম যে পোস্টটা এসেছে সেটা রওনকের ম্যারিটাল স্ট্যাটাসের আপডেট। কেউ একজনকে ট্যাগ করে বিয়ের আপডেট পোস্ট করেছে রওনক। পোস্টটা হয়েছে বিশ মিনিট আগে। শতশত রিয়্যাক্টের পাশাপাশি কমেন্টও পড়ছে একের পর এক। আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই দিলারা জামানকে কমেন্ট সেকশনে মেনশন দিয়ে জানতে চাইছেন এভাবে লুকোচুরি করে কেনো ছেলের বিয়ে দেয়া হলো? আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে রওনকের বন্ধু-বান্ধব, বিজনেস পার্টনাররা সবাই কমেন্ট করে অভিনন্দন জানাচ্ছে, কেউ কেউ জানতে চাইছে অনুষ্ঠান কবে হবে। সেদিকে সামান্য নজর বুলান দিলারা জামান। এখনো অনবরত ফোন কল আসছে উনার। এমনকি উনার ফেসবুক আইডির ম্যাসেজ বক্স, হোয়াটসঅ্যাপ দুটোতেই মেসেজ আসছে। কারো কল এটেন্ড না করে তিনি ছেলেকে ফোন লাগান। পরপর বেশ কয়বার ফোন দেন কিন্তু রওনক কল রিসিভ করে না। এবারে খানিকটা রাগ হয় উনার, বিরক্তিও ধরেন। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমের দিকে যান। এসবের মানে কি! ড্রইং রুমে এসেই জাহানারা জাহানারা করে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। একটু পরেই সবাই ডিনারে বসবে। জাহানারা কিচেনে ডিনারের আয়োজন দেখছিল। আচমকা ভাবীর গলার আওয়াজ পেয়ে আঁতকে ওঠেন। তৎক্ষনাৎই হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে আসেন এদিকে। দিলারা জামানের মুখোমুখি এসে জিজ্ঞেস করেন,

-কি হয়েছে ভাবী?

-কি হয়েছে আমি কীভাবে বলবো? আমাকে কি আজকাল কেউ কিছু জানায় নাকি?

জাহানারা বেআক্কলের মতো তাকিয়ে থাকেন। না বললে তো উনিও বুঝতে পারছেন না হঠাৎ কেন এই চিৎকার চেঁচামেচি। শাশুড়ির গলার আওয়াজ পেয়ে তানিয়াও তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সে ভেবেছিল হয়ত রওনক চিত্রলেখাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখে তার শাশুড়ি জাহানারার সঙ্গে কথা বলছে। এগিয়ে আসতে আসতে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো মা হঠাৎ খালার উপরে ক্ষেপলেন কেনো?

তানিয়া এগিয়ে আসতেই দিলারা জামান নিজের মোবাইল ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

-এই বিষয়ে কী তুমি কিছু জানো?

শাশুড়ির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে তাতে চোখ বুলায় তানিয়া। রওনকের কান্ড দেখে হাসি পায় তার। ছেলেটার বুদ্ধি আছে বলতে হয়। নিজের মুখে কাউকে কিছু বলল না তারপরেও সম্পূর্ণ পৃথিবীকে জানানো হয়ে গেল রওনক আর একা নেই, তার জীবনে চিত্রলেখা চলে এসেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে হাসতে পারছে না। এমনিই শাশুড়ি ক্ষেপে গোলাবারুদ হয়ে আছে। হাসলে উনি আরও ভরকে যাবেন। এই মুহূর্তে সে আর শাশুড়িকে ভরকে দিতে চায় না। তানিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে দিলারা জামান আবারও জিজ্ঞেস করেন,

-চুপ করে আছো কেন? তুমি কিছু জানতে না?

-কিছু জানতাম না বা জানি না বললে মিথ্যা বলা হবে মা। তবে আমার কাছ থেকে কিছু শুনার চাইতে আমি বলবো একটু অপেক্ষা করুন, রওনক আসুক। তারপর ওর বিষয়টা নাহয় ওর কাছেই শুনবেন।

-ও! তার মানে তুমি জানো।

-জি।

-এই পোস্টটা মিথ্যে নয় তাই তো?

-মা রওনক আপনার ছেলে। আমার থেকে আপনি ওকে ভালো চিনেন। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কিছু করার মানুষ রওনক নয় তা আপনিও ভালো করেই জানেন। যা দেখছেন সবই সত্যি।

দিলারা জামান হাইপার হয়ে গেছেন দেখে তানিয়া আরও বলে,

-মা প্লিজ আপনি হাইপার হবেন না।

-এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল আর তুমি বলছো আমি হাইপার হবো না?

-যা ঘটার তা ঘটে গেছে মা। আপনি হাইপার হলেই তো সব পাল্টে আগের মতো হয়ে যাবে না। বরং আপনার শরীর খারাপ করবে একটু বুঝতে চেষ্টা করুন।

দিলারা জামান এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু এখন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। চিৎকার চেঁচামেচি করায় উনার শরীর মৃদু কাঁপছে। সোফায় বসে পড়ে বলেন,

-আমার আর বুঝে কাজ নেই। তুমি রওনককে ফোন লাগাও। ওকে বলো এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে।

-ও চলে আসবে মা।

-ওকে ফোন লাগাও বলছি। এক্ষুনি আসতে বলো, এক্ষুনি।

চেঁচিয়ে বলেন দিলারা জামান।

-ঠিক আছে আপনি শান্ত হোন আমি ফোন করছি।

-এক্ষুনি আসতে বলো।

তানিয়া জাহানারাকে বলে,

-কাউকে বলো আমাকে আইসব্যাগ দিয়ে যেতে আর মায়ের প্রেসারের ঔষধটা নিয়ে আসো।

জাহানারা ঔষধ আনতে চলে গেলে তানিয়া রওনককে ফোন লাগায়। কিন্তু কলটা রিসিভ হয় না। হবার কথাও না তা তানিয়া জানে। তারপরেও শাশুড়িকে বুঝ দিতে একটা এসএমএস পাঠায়। আইসব্যাগ দিয়ে গেলে সেটা শাশুড়ির মাথায় ধরে তানিয়া। কিন্তু দিলারা জামান সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলেন,

-এসবের প্রয়োজন নেই।

-প্লিজ মা যার উপর রাগ হয়েছে সে আসলে নাহয় রাগ দেখাবেন। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তো আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে।

আর কিছু বলেন না দিলারা জামান। রাগে, ক্ষোভে ফসফস করতে লাগেন।

রিপা নিজের ঘরে বসে নোটস বানাচ্ছিল। বাইরে থেকে কথার উচ্চ শব্দ পেয়ে কি হয়েছে দেখার জন্য বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসতেই দেখে ড্রইং রুমের জিনিসপত্র উল্টেপাল্টে আছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন সানজিদা আহমেদ। কাজের লোক সব পরিষ্কার করছে। ভাঙা ফুলদানির কাচের টুকরো তুলছে। রিপা এগিয়ে গিয়ে মায়ের পাশে বসতে বসতে কাজের মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-সাবধানে তুল, খেয়াল না করলে তোর হাত কেটে যাবে।

-আইচ্ছা আপা।

মায়ের কাঁধে হাত রেখে রিপা আরও বলে,

-কী হয়েছে আম্মু? এসব কি আপু করলো?

কপাল থেকে হাত সরিয়ে ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে সানজিদা বলেন,

-আর কে করবে? এই বাসায় তো একজনই আছে এসব করার মতো।

-আবার কি হলো? ভাঙচুর কেন করলো?

-রওনক নাকি বিয়ে করেছে।

-হোয়াট! রওনক ভাই বিয়ে করে ফেলেছে?

-সত্যি মিথ্যা তো এখনো কিছু জানি না। সাবার মুখেই শুনলাম।

-আপু কীভাবে জানলো?

-রওনক নাকি ওর ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেছে। সেখান থেকে দেখে বলল আমায়।

-আপু কোথায় এখন?

-মাথা গরম করে বেরিয়ে গেল ভাঙচুর করে।

-আচ্ছা তুমি বসো আমি আমার ফোনটা নিয়ে আসি। আসলেই ব্যাপারটা সত্যি কিনা তা দেখতে হচ্ছে। রওনক ভাই সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেললেন!

রিপার এক্সাইটেড লাগছে। নিজের ফোন নেবার জন্য ঘরে আসলে দেখে তার মোবাইলের রিং বাজছে। দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে আসতেই দেখে স্ক্রিনে লিখনের নাম ভাসছে। তৎক্ষনাৎই কল রিসিভ করে সে। রিপাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লিখন বলে,

-আমি তোমার বাসার নিচে। পাঁচ মিনিটের জন্য নামতে পারবে প্লিজ।

-কী হয়েছে লিখন? তোমার কন্ঠ এমন শুনচ্ছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো?

-তুমি একটু নিচে আসো প্লিজ। তোমাকে একটু দেখেই চলে যাবো।

-তুমি দাঁড়াও আমি এক্ষুনি আসছি।

কলটা কেটে দিয়েই পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরে রিপা। ছোট মেয়েকেও বেরিয়ে যেতে দেখে সানজিদা আহমেদ জিজ্ঞেস করেন,

-এখন তুই কোথায় যাচ্ছিস?

-সুপারশপ যাচ্ছি মা।

-রাত করে তোকে কেন যেতে হবে ড্রাইভারকে বল কি লাগবে নিয়ে আসবে।

-উঁহু, আমারই যাওয়া লাগবে। এই যাবো আর আসবো। ততক্ষণ তুমি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো। আমি এসে তারপর দেখছি ঘটনা কি। রওনক ভাই কি সত্যি সত্যি বিয়ে করেছেন কিনা। এর মধ্যে তুমি একবার বাবাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো এই বিষয়ে কিছু জানে কিনা।

রিপা আর দাঁড়ায় না। এক নাগাড়ে কথা বলেই বেরিয়ে যায়। বিল্ডিংয়ের গেইট দিয়ে বেরতেই দেখতে পায় রাস্তার অন্যপাশের আইলেনের উপর দাঁড়িয়ে আছে লিখন। পেছন পেছন আসার ইশারা করে বামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যায় রিপা। রাস্তার মাথায় চলে এসে একটা ফাঁকা রিকশা পেয়ে উঠে বসে হুড টেনে নেয়। এখান থেকে রিপাদের বিল্ডিং দেখা যায় না৷ লিখন এগিয়ে এসে রিকশায় উঠে বসতেই রিপা বলে, মামা সামনে আগান।

লিখন রিকশায় উঠে চুপ করে বসে থাকে। তার হাতের মুঠোয় রিপার হাত। কিছু একটা হয়েছে তা লিখনের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রিপার অস্থির লাগছে। ব্যাকুল সুরে জিজ্ঞেস করে,

-কী হইছে তোমার?

-আমার কিছু হয় নাই।

-বললেই হলো কিছু হয় নাই। কিছু তো অবশ্যই হইছে। আসার আগে নিজের মুখ দেখছো তুমি আয়নায়? এই এতটুকু হয়ে গেছে। আমাকে বলো কী হইছে।

লিখন রিপার হাতটা আগের চাইতে আরেকটু বেশি শক্ত করে ধরে বলে,

-সত্যি আমার কিছু হয় নাই। তবে…

-তবে কি?

-আপা বিয়ে করছে।

-কি! কে বিয়ে করছে?

-আপা।

-হঠাৎ! আই মি এটা খুশির কথা আপার বিয়ে হয়েছে কিন্তু আসলে কিছু মিলাতে পারছি না আমি।

-আমিও পারিনি, এখনো পারছি না। কিছুদিন আগেও বলেছিলাম আমাদের কথা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবতে। মামুন ভাইকে বিয়ে করে নিতে। কিন্তু আপা না করে দিলো। সে বিয়ে করবে না। তারপর কি হলো? কীভাবে হলো? কেন হলো? কিছুই বুঝতে পারছি না।

-হুম।

তৎক্ষনাৎ বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না রিপা। দু’দন্ড চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করে,

-তুমি রাগ করেছো আপা এভাবে বিয়ে করেছে বলে?

-বুঝতে পারছি না। আমার রাগ লাগছে না আবার পুরোপুরি খুশিও হতে পারছি না এটা ভেবে আমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।

-কেনো?

-আমার আপাকে আমি সবচাইতে ভালো চিনি রিপা। সে কখনো নিজের জন্য কিছু করে না। যাই করে আমাদের জন্য। আমাদের চিন্তায় করে।

-কি বলতে চাইছো একটু ক্লিয়ার করে বলবা?

-আপা বিয়েটা আমাদের জন্য করছে।

-এমন কেনো মনে হচ্ছে তোমার?

লিখন চুপ করে থাকে জবাব দেয় না। কি জবাব দিবে? চিত্রলেখার কারো সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না তো ওদের কারো অজানা নয়। অথচ সেই মানুষটার এভাবে বিয়ে করে ফেলাটা তাও নিজের অফিসের বসকে, কেমন রহস্য রহস্য লাগে লিখনের কাছে। কিন্তু সিওর না হয়ে সে কিছু বলতে চায় না। লিখনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে রিপা আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। মিনিট পনেরোর মতো ওরা রিকশা করে ধানমন্ডির ভেতরের গলিগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। ততক্ষণে দু’জনের একজনও আর কোনো কথা বলে না। কেবল একে-অপরের হাত ধরে পাশাপাশি বসে রয়। নিরিবিলি রাস্তায় রিপা লিখনের কাঁধে আলতো করে মাথা ছোঁয়ায়। প্রিয়তমের বুক ভার হয়ে আছে টের পেয়ে টুক করে তার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। লম্বা বিরতির পর লিখন রিকশাওয়ালাকে বলে,

-যেখান থেকে রিকশায় উঠলাম ওখানে নিয়ে যাও মামা।

রিপা জিজ্ঞেস করে,

-চলে যাবা?

-কয়টা বাজে খেয়াল আছে?

আসলেই রিপার খেয়াল ছিল না দেরি হয়ে যাচ্ছে। লিখনের ওমন মনমরা চেহারা দেখে সব ভুলে গিয়েছিল সে। রিকশাটা পূর্বের জায়গায় এসে থামতেই লিখন নেমে যেতে নিলে রিপা বাঁধা দিয়ে বলে,

-তুমি এই রিকশাটা নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমার তো সামান্য একটু পথ আমি হেটে চলে যাই।

-আমি আরেকটা রিকশা নিয়ে নিবো, তুমি বাসায় যাও।

বলেই রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দেয় লিখন। রিপা আর কিছু বলে না। রিকশাটা গলির ভেতর ঢুকে গেলে অন্য একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে সে।

রওনকের গাড়িটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। গেইট খোলার জন্য হর্ন দেয় সে। সেই ফাঁকে রওনক বলে,

-চলে এসেছি আমাদের বাসায়।

-আমাদের বাসা!

-হ্যাঁ, আমাদের। আমি যেখানে থাকবো সেটাই তো তোমার বাসা তাই না?

চিত্রলেখা কিছু বলতে পারে না। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার। এমন এর আগে কখনো হয়নি। বাস্তবে তো দূরের কথা স্বপ্নেও না। রওনক আরও জিজ্ঞেস করে,

-তোমার কিছু লাগবে?

-না।

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। ততক্ষণে গেইট খুলে দেয় দারোয়ান। টান দিয়ে ভেতরে পার্কিংএ চলে যায় রওনক।

প্রেসারের ঔষধ খেয়েও দিলারা জামানের প্রেসার নরমাল হয়নি। এই পর্যন্ত কতবার যে তানিয়াকে জিজ্ঞেস করেছে রওনক এখনো আসছে না কেনো? এর ইয়ত্তা নেই। এক প্রশ্ন বারবার করলে হিসাব রাখা মুশকিল, তানিয়াও আর হিসাব রাখতে পারেনি। জাহানারা ভাবীর মাথায় আইসব্যাগ ধরে রেখেছেন। বারবার সরিয়ে দিচ্ছেন। যতবার সরিয়ে দিচ্ছেন ততবার জাহানারা মাথায় রাখছেন।

-এখনো আসছে না কেনো?

আবারও জিজ্ঞেস করেন দিলারা জামান। এবারে তানিয়া কিছু বলার আগেই কলিংবেল বাজে। তৎক্ষনাৎই ভেতর থেকে কাজের লোক বেরিয়ে আসে দরজা খুলতে। কে এসেছে এটা সহজেই অনুমেয়। পেইন্টিং এর কথা বলে রাদিন বাসার বাইরে আছে বেশ কিছুদিন হয়েছে। কবে আসবে কেউ জানে না। দরজা খুলে দিতেই ভেতর থেকে দিলারা জামান রওনককে দেখতে পায়। ছেলেকে দেখে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। রওনক বাসার ভেতর দু’কদম ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন দিকে ফিরে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-কই আসো?

চিত্রলেখা তখনও দরজার বাইরে একটু পাশ করে দাঁড়িয়ে। তাই ভেতর থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রথমে দেখে মনে হয়েছে রওনক একাই এসেছে। দুই পার্টের দরজার এক পাশ খোলায় চিত্রলেখাকে দেখা যায়নি। চিত্রলেখা রওনকের বাড়িয়ে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার। বলা যায় খানিকটা ভয় ভয়ও লাগছে কি হবে চিন্তা করে। রওনক আর অপেক্ষা করে না। নিজেই হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে মায়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। দিলারা জামান তাকিয়ে থাকেন ছেলের হাতের দিকে। যে হাত দিয়ে রওনক চিত্রলেখার হাত ধরে রেখেছে সেদিকে তার দৃষ্টি। তারপর মুখ তুলে ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

-এই মেয়ে কে রওনক?

-আমার বউ, চন্দ্র… চিত্রলেখা।

বলেই রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকায়। আতংকিত দৃষ্টি নিয়ে চিত্রলেখাও তাকিয়ে রয় রওনকের দিকে। তাদের দৃষ্টি আটকায় এক মুহূর্তের জন্য একে-অপরের দৃষ্টিতে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে