#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
চিত্রলেখা রান্নাঘরে কাজ করছে। তার পেছনে এসে দাঁড়ায় লিখন। জিজ্ঞেস করে, আজ অফিসে গেলে না যে আপা?
হাতের কাজ করতে করতেই চিত্রলেখা জবাব দেয়, শরীরটা ভালো লাগছে না তাই সকালেই ফোন করে ছুটি নিয়েছি।
-ওহ! ডাক্তারের কাছে যাবা?
-ওতটাও খারাপ না যে ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে। সামান্য মাথা ধরা। বিশ্রাম করলেই সেরে যাবে। তোর আজকে ক্লাস নাই?
-আছে৷ তোমারে একটা জরুরী বিষয় জানানোর ছিল।
এবারের হাতের কাজ রেখে পেছন ঘুরে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। বলে, কি কথা?
-আমি সিদ্ধান্ত নিছি টিউশনি করাবো।
-টিউশনি তো করতেছিসই আবার সিদ্ধান্ত নিছিস মানে?
কথা আউলে ফেলে লিখন। এবারে শুধরে নিয়ে বলে, না মানে ব্যাচ পড়াবো। এতদিন তো বাড়ি গিয়ে পড়াইছি। এখন ভাবছি ব্যাচ করে পড়াবো বাড়িতেই। এতে করে একসাথে অনেকজন পড়াইতে পারবো। ইনকামটাও বাড়বে।
চিত্রলেখা এগিয়ে এসে ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে লিখনের একটা হাত আলতো করে ধরে বলে, ব্যাচ পড়াতে চাস ভালো কথা, অবশ্যই পড়া। তোদের নিজের বা পড়ালেখার ক্ষতি না হয় এমন সব কাজ করার অনুমতি আমি আগেই দিয়ে রাখছি। তাই ভালো হয় এমন কিছু করার আগে আমার অনুমতি নেয়ার দরকার নাই। যাই করবি শুধু খেয়াল রাখবি যেন তোর নিজের পড়ালেখার কোনো ক্ষতি না হয় তাহলেই চলবে। তোর ভবিষ্যতের জন্য যা ভালো হয় কর শুধু টাকা পয়সার চিন্তা করিস না। ওসব চিন্তা ভাবনার জন্য আল্লাহ এখনো আমাকে বাঁচায় রাখছে। টাকা পয়সার চিন্তা তোর না ওটা আমার কাজ, আমি করব। বাকি তোর যা ভালো মনে হয় কর আমি তোর সঙ্গে আছি। ব্যাচ পড়াবি পড়া, মাথায় রাখিস সামনে তোর ফাইনাল পরীক্ষা। আরেকজনকে পড়াইতে গিয়ে, অতিরিক্ত প্রেসারে যেন তোর নিজের পড়ার কোনো ক্ষতি না হয়। ওসব বাড়তি ইনকাম আমার চাই না।
বোনের কথা শুনে স্বস্তি পায় লিখন। সে ভেবেছিল সামনের তার পরীক্ষা তাই হয়ত চিত্রলেখা দ্বিমত করবে। বোনকে আস্বস্ত করে লিখন বলে, তুমি চিন্তা কইরো না আপা। আমার পড়ালেখার ক্ষতি যেন না হয় সেই খেয়াল রাখবো আমি।
মৃদু হাসে চিত্রলেখা তা দেখে শান্তি লাগে লিখনের। তবুও বুকের ভেতর তার খচখচানি রয়ে গেছে আগের রাতের ঘটনার। নিজের জায়গা থেকে বড় বোনকে প্রশ্ন করতে পারছে না। যদিও প্রশ্ন করাটা অবান্তর হবে না তবুও পারে না। সে ভালো করেই জানে ওদের তিনজনকে মানুষ করতে গিয়ে, লেখাপড়া করাতে গিয়ে চিত্রলেখার ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিচ্ছু নেই। আপাদমস্তক সে একটি সাদা পাতা। সেখানে গতকাল রাতের ঘটনাটা হয়ত নতুন কিছু। লিখনের সন্দেহ হয় না কেবল কৌতুহল হয় জানার। তার বোনের জীবনে কি কেউ এসেছে কিনা জানতে ইচ্ছা হয় এর বেশি কিছু না। তবে প্রশ্ন করার সাহস হয় না। না জিজ্ঞেস করতেই চিত্রলেখা সবসময় সব জানিয়েছে সেখানে একটা বিষয় চেপে গিয়েছে অকপটে নিশ্চয়ই এর পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।
লিখনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে, আর কিছু বলবি?
আমতা আমতা করে লিখন। তা দেখে চিত্রলেখা আবারও বলে, কি বলতে চাস বলে ফেল।
-তুমি ভালো আছো তো আপা?
ভাইয়ের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে চিত্রলেখার মৃদু হাসি খানিক প্রশস্ত হয়। জবাবে বলে, তোরা থাকতে আমি কখনো খারাপ থাকতে পারি?
-সব কিছু ঠিকঠাক চলছে তো? মানে তুমি ঠিক আছো তো?
-আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে ভাবিস না। তোরা ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো। এখন বেরিয়ে পর নয়ত দেরি হয়ে যাবে তোর।
নিজের কাজে আবারও মন দেয় সে। কিন্তু লিখন তবুও দাঁড়িয়ে রয়। এবারে চিত্রলেখা বলে, ঝেড়ে কাশ তো। কি বলতে চাস ক্লিয়ার করে বল।
-আপা তুমি কি আমাদের থেকে কিছু আড়াল করতে চাইতেছো?
হাতের কাজ বন্ধ করে চিত্রলেখা বলে, যেহেতু বুঝতেই পারছিস তাহলে জিজ্ঞেস করতেছিস কেন? হয়ত বলতে পারবো না বা বলার মতো না সেজন্য আড়াল করতেছিস।
এবারে লিখন এগিয়ে গিয়ে বোনকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি জানতে চাই না আপা। তবে একটা কথা বলতে চাই। সবসময় মনে রাখবা তোমার সব ভালো মন্দতে তোমার লিখন তোমার পাশে আছে সর্বদা। আর কেউ থাকুক আর না থাকুক আমি সবসময় আছি আপা।
চিত্রলেখা পেছন ঘুরে ভাইকে জড়িয়ে ধরে। লিখন হাত বুলিয়ে দেয় বোনের মাথায় পরম মমতায়। এমন করে অনেকদিন কেউ চিত্রলেখার মাথায় হাত বুলায় না। শান্তি লাগছে তার। অনুভব করতে পারছে এই মস্ত বড় পৃথিবীতে সে একা নয়।
চিত্রলেখা দুপুরের রান্না করছে। বন্ধের দিন না হওয়ায় নারগিস বেগম ছাড়া আর কেউ বাড়ি নেই। তবে আজ খালাও নেই। একটা কি কাজে যেন সকাল সকাল বেরিয়েছেন, এখনো ফিরেননি। জলদি জলদি বেরিয়ে গেছেন তাই চিত্রলেখা কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি। এই মুহূর্তে সে ছাড়া আর কেউ বাড়ি নেই। সকালে চারু যাবার আগেই বলে গিয়েছে আজ যেন শুটনি রান্না করে। ভাইবোনের আবদার মোতাবেকই রান্না করছে সে। আচমকা টের পায় বারান্দার গেইটে শব্দ হচ্ছে। কেউ হয়ত এসেছে। চুলার আচ কমিয়ে বেরিয়ে আসে চিত্রলেখা কে এসেছে দেখতে। বারান্দায় আসতেই দেখে মামুন দাঁড়িয়ে। নিজের ওড়নায় হাত মু্ছতে মুছতে চিত্রলেখা বলে,
-মামুন ভাই আপনি এই সময়ে?
-আজকে সকালে তোমারে অফিস যাইতে দেখি নাই। একটু আগে লিখনের সাথে পথে দেখা হইলো। ও বলল তুমি নাকি অফিস যাও নাই, তোমার শরীর খারাপ। তাই ভাবলাম খোঁজ নিয়ে যাই। তোমার কী শরীর বেশি খারাপ মায়া?
-না না তেমন কিছু না। সামান্য মাথা ধরা।
-ও আচ্ছা।
গ্রীলের গেইটের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। মামুন তার জীবনের সব মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখার মুখের দিকে। ওমন চাহনী দেখে যে কারো হৃদয় গলে পানি হয়ে যাবে কিন্তু একমাত্র চিত্রলেখা গলে পানি হয় না। তার ভালোবাসার আহ্বানে সাড়া দেয় না। দুনিয়াটাই এমন। আমরা যাকে ভালোবাসি, প্রতিমুহূর্ত চাই সে ছাড়া দুনিয়ার সবার মনে মায়া হলেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটার হৃদয়ে আমাদের জন্য কোনো অনুভূতি কাজ করে না। আবার অন্যভাবে ভাবলে ভলোবাসা বিষয়টাই এমন। জোর করে হয় না। কেউ আমাকে ভালোবাসে এর মানে এই না আমারও তাকে ভালোবাসতে হবে। আমরা কখন কাকে ভালোবেসে ফেলবো তা নিজেরাও বলতে পারি না। ভালোবাসা পরিকল্পনা করে হয় না, জোর করে হয় না, যুক্তিতর্ক দিয়ে হয় না। ভালোবাসা যখন হবার তখন আপনাআপনি হয়ে যায়। কোনো জোর ছাড়াই হয়ে যায়, অনুমতিও লাগে না।
সন্তপর্ণে নিজের দীর্ঘশ্বাস লুকানোর চেষ্টা করে হাসি হাসি মুখ করে মামুন বলে, আজ তাহলে আসি মায়া।
তৎক্ষনাৎই গ্রীলের গেইটটা খুলে দিয়ে চিত্রলেখা বলে, ভেতরে আসেন মামুন ভাই। এক কাপ চা খেয়ে যান।
মামুনের বিষন্নতায় ভরা মনটা যেন সঙ্গে সঙ্গেই ভালোলাগায় ভরে গেলো। স্বতঃস্ফূর্ত হেসে নিয়ে সে বলে, তুমি যখন বলতেছো অবশ্যই চা খাবো। কতদিন হয় তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না।
-ভেতরে আসেন।
চিত্রলেখার পেছন পেছন ড্রইং রুমে এসে বসে মামুন। সে বসতেই চিত্রলেখা বলে, আমি চা নিয়ে আসতেছি আপনি বসেন।
অপেক্ষা না করে দ্রুত রান্নাঘরে চলে যায় চিত্রলেখা। চা বানানোই ছিল। ঠান্ডা চায়ের পাতিল চুলায় বসিয়ে দেয় গরম হবার জন্য। এদিকে প্লেটে কিছু নাস্তা সাজায়। শুধু চা দেয়াটা খারাপ দেয়া। যদিও দুপুর ঘনিয়ে আসছে, খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে মামুন বলে, বাহ! চমৎকার চা বানাইছো।
মুচকি হাসে চিত্রলেখা। বলে, একটু কিছু মুখে দেন মামুন ভাই।
-না, অন্য কিছু খাবো না। থাকলে আরেক কাপ চা দেও।
-আচ্ছা আমি নিয়ে আসতেছি।
চিত্রলেখা আরেক কাপ চা মামুনকে বাড়িয়ে দিতেই চায়ে চুমুক দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, আমার বিষয়ে কি ভাবলা মায়া?
ইতস্তত করে তাকায় চিত্রলখা মামুনের দিকে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মামুন ভাই আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।
-আমি জানি। বলো শুনি তোমার কথা। আমি তো সবসময়ই তোমার কথা শুনতে চাই। তুমিই তো বলো না।
-আমার অবস্থা তো আপনি জানেনই। ভাইবোনদের একটা গতি না করে আমি নিজের কথা ভাবতে পারবো না। আপনি দয়া করে আমার অপেক্ষায় নিজের জীবনটা নষ্ট করবেন না। খালার কাছে শুনলাম খালাম্মা-খালু আপনাকে বিয়ে দিতে চায়। আমার অপেক্ষা বাদ দিয়ে ভালো একটা মেয়ে দেখে এবার নাহয় বিয়েটা করে ফেলুন।
চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে মামুন বলে, তোমাকে ভুলে যাইতে বলতেছো?
-আমি তো কখনোই আপনার জীবনে ছিলাম না। তাই ভুলে যাবার বা মনের করার প্রশ্নই আসে না। আমি কেবল বলছি এবার জেদটা বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবুন।
-আমি তো সবসময় নিজের কথাই ভাবি। আমার তো নিজের জন্যই তোমারে লাগবে। তোমারে ভালো না বাইসা আমি থাকতে পারবো না। আমার শুধু তোমারেই চাই।
-কিন্তু আমার কোনো চাওয়া পাওয়া নাই মামুন ভাই। আমার সব চাওয়া পাওয়া আমার ভাইবোনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
-আমাকে অল্প একটু জায়গা দেয়া যায় না?
চিত্রলেখা জবাব দিতে পারে না। তার কাছে জবাব নেই এমন না। কিন্তু এই মানুষটার আগাগোড়াই তার প্রতি স্বচ্ছতা দিয়ে ভরা। মানুষটার ভেতরে যা বাইরেও তা। তাই চাইলেও তার সাথে শক্ত হতে পারে না চিত্রলেখা। চোয়াল শক্ত করে কয়টা কঠিন কথা শুনিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারে না। চিত্রলেখার জীবনের পরম পাওয়া তাকে হয়ত পাবে না জেনেও মানুষটা নিঃস্বার্থভাবে তাকে ভালোবেসে আসছে শুরু থেকেই। এমন ভালোবাসা ভাগ্য করেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই ভালোবাসা গ্রহণ করার সাধ্য তার নেই। না মন সঙ্গ দেয় আর না মস্তিষ্ক।
মামুন আরও বলে, তবে তুমি একটা কথা ভুল বললা।
-কী!
-তুমি কখনোই আমার জীবনে ছিলা না এই কথাটা ভুল। আমার জীবনে শুরু থেকে শুধু মাত্র তুমিই আছো। তোমারে ছাড়া অন্য কারো কথা আমি ভাবতেও পারি না।
মামুনের দ্বিতীয় কাপ চা খাওয়া শেষ। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় সে। বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে বলে, এই সপ্তাহটা সময় নেও। তবে এর বেশি সময় দিতে পারবো না। এর বেশি সময় দিলে হয়ত আমারই ক্ষতি হয়ে যাবে। এই সপ্তাহ চিন্তা ভাবনা করো। পরের শুক্রবার আব্বা আম্মাকে পাঠাবো আমাদের বিয়ের দিন তারিখ পাকা করতে।
চিত্রলেখা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়। এখন মনে হচ্ছে মায়া দেখিয়ে ভেতরে আসতে বলাটাই কাল হয়েছে। বুঝাতে চাইলো কি আর লোকটা বলে গেলো কি! মাথা ঠুকতে মন চাইছে বেচারীর। সবাই এত কঠিন কেনো ওর সঙ্গে?
সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসে কেটেছে চিত্রলেখার। সকালের দিকে সত্যি সত্যি মাথা না ধরলেও এখন ঠিকই ধরেছে। এত চিন্তা ভাবনার ভার মস্তিষ্কে সইছে না। একদিকে রওনক অন্যদিকে মামুন। কার কথা ভাববে সে?
চিৎ হয়ে শুয়ে থেকে সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। মাথার কাছে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায় হাত বাড়িয়ে নিয়ে চোখের সামনে ধরতেই তড়িৎ গতিতে উঠে বসে সে। রওনক এই সময়ে কেনো ফোন করছে? সবে বিকাল চারটা বাজে। এখন তো তার অফিসে থাকার কথা। দ্রুত চিন্তা ভাবনা করে কল কেটে যাবার আগে রিসিভ করে কানে দিতেই লাইনের অন্যপাশ থেকে রওনক বলে, তোমার বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একটু আসবে কি?
চিত্রলেখার চোখ বড় হয়। সে যত দূরে থাকতে চায় মানুষটা ততই কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে। গতকাল রাতে দিয়ে গেছে তখন মানুষজন কম ছিল। এই দিনদুপুরে মানুষের নজর ফাঁকি দিবে কীভাবে? চিত্রলেখা চুপ করে থাকায় রওনক আবারও বলে, আমি অপেক্ষা করছি।
-আসছি। বলেই লাইন কাটে চিত্রলেখা। মাথার কাছে থাকা ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে নিয়ে চুলে হাত খোঁপা করতে করতেই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ঘরে পরা কাপড় পরেই বের হয়। তাড়াহুড়োয় খেয়াল নেই কিছুই। গেইট খুলে বেরিয়ে আসতেই দেখে ঠিক গেইটের সঙ্গেই গাড়ি দাঁড় করিয়েছে রওনক। ড্রাইভিং সিটের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা এলোমেলো লাগছে দেখতে তাকে। তা দেখে চিত্রলেখার মনের ভেতর সামান্য ঝড়ো বাতাস বয়। মনের ভেতর চিন্তা উদয় হয় অফিসে কি গুরুত্বর কিছু ঘটেছে? চিত্রলেখা এগিয়ে গিয়ে রওনকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
-অফিসে কি কিছু হয়েছে? আপনাকে এমন এলোমেলো লাগছে কেনো?
রওনক সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এতে তাদের ভেতরকার বাহ্যিক দূরত্ব খানিকটা কমে। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে বলে, তুমিই তো এলোমেলো করে রেখেছো আমায়।
চিত্রলেখা একবার ঢোক গিলে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আপনি এসে ভালো হয়েছে।
-আমাকে দরকার?
-একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
-বলো কি জানতে চাও।
-আমাকে বিয়ে করলে আপনার পরিবার মানবে?
-আমার মা অলরেডি আমার জন্য পাত্রী ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু তার ঠিক করে রাখা পাত্রীকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না তা তোমাকে আগেই জানিয়েছি। তাই কে মানবে আর কে মানবে না তা আমার দেখার বিষয় না। শুধু কেউ যেন আপত্তি করতে না পারে সেজন্য বিয়েটা আমরা আমাদের মতো করবো। তারপর সবাইকে জানাবো যেনো কেউ আর আপত্তি করতে না পারে। আগে বললে হয়ত বাসায় নানারকম নাটক হবে যদিও আমার ডিসিশন পাল্টাবে না। তবুও মা যেনো ইমোশনালি ব্লাকমেইল করতে না পারে তাই বিয়ে করার পর সরাসরি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।
চিত্রলেখা মনে মনে আরও কি কি যেনো চিন্তা ভাবনা করে। তা টের পেয়ে রওনক শক্ত কন্ঠে বলে, তোমাকে আরেকটু ইজি করে দেই বিষয়টা। যেহেতু আমাদের কোনো প্রেম ভালোবাসার বিয়ে নয়। সম্পূর্ণ টাই গিভ এন্ড টেক। তুমি আমায় হেল্প করবে আর আমি তোমায়। সো ইন ফিউচার মানে কয়েক বছর পর যদি তোমার মনে হয় তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চাও না। সম্পর্ক টা আর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও না তাহলে আমরা নাহয় মিউচুয়ালি আলাদা হয়ে যাবো। আমি তোমাকে আটকে রাখবো না। তবে তুমি থাকতে চাইলে অবশ্যই থাকবে এতেও আমার আপত্তি থাকবে না।
রওনকের কথাটা চিত্রলেখাকে কোথায় গিয়ে যেনো সামান্য আঘাত করলো। কেনো আঘাত করলো বুঝতে পারছে না। কেবল টের পেলো সে আঘাত পেয়েছে। ফ্যাকাসে দৃষ্টি নিয়ে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে, আর আপনার চাওয়া পাওয়া?
-আমার চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিকাশ আপাতত নাহয় থাক।
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রওনক আরও বলে, তুমি নাহয় ভাবো আমি আসি।
-কি জন্য এসেছিলেন বললেন না তো?
-তোমাকে দেখতে এসেছিলাম।
-কেনো?
-মন চাইছিলো।
একটু আগে চিত্রলেখা মনের ভেতর যে অদৃশ্য আঘাত অনুভব করছিল সেই আঘাত যেন আচমকাই মিলিয়ে গেলো। সেখানে একটা অদৃশ্য মিষ্টি অনুভূতি কাজ করছে। ক্ষণে ক্ষণে এমন অনুভূতির অদলবদলের কারণ বুঝে না চিত্রলেখা।
-আসছি তাহলে।
আসছি বলেও দাঁড়িয়ে রয় রওনক। চিত্রলেখা বলে, যদি আমি রাজি হই তাহলে বিয়েটা কবে হবে?
-তুমি যখন বলবে তখনই।
-এখন করলে কেমন হয়?
-ভেবে বলছো তো? পা বাড়ালে আর পিছাতে পারবে না কিন্তু।
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক প্যান্টের পকেটে থাকা মোবাইলটা বের করে ফোন লাগায় তানিয়াকে। কল রিসিভ হতেই রওনক চিত্রলেখার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে, তোমাকে একটা ঠিকানা পাচ্ছি। হাতের সব কাজ ফেলে লাবিবকে নিয়ে জলদি চলে আসো তো।
-এনিথিং সিরিয়াস রওনক?
-ইয়েস।
-কি হয়েছে বলো তো? তুমি ঠিক আছো তো?
-বিয়ে করতে যাচ্ছি। আই নিড ইউর হেল্প ভাবী।
প্রশস্ত হেসে তানিয়া বলে, ঠিকানা পাঠাও আমি এক্ষুনি আসছি।
লাইন কেটে দিয়ে রওনক এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয় চিত্রলেখার জন্য।
তানিয়া বা লাবিবের দু’জনের একজনও চিন্তা করেনি রওনক এভাবে বিয়ে করবে। কিন্তু ওরা না ভাবলেও সত্যি সত্যি বিয়েটা এভাবেই হয়ে গেছে। কোনো ধরনের আড়ম্বর ছাড়াই চিত্রলেখা মিস থেকে মিসেস হয়ে গেছে। কার কেমন লাগছে জানা নেই তবে লাবিব ও তানিয়া যথেষ্ট খুশি হয়েছে। চিত্রলেখা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে ভুল করেছে না ঠিক এখনো বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার এই মুহূর্তে। রওনকের কোনো প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যাচ্ছে না।
তানিয়া বলে, আমি কিন্তু চিন্তা করিনি তুমি এভাবে বিয়ে করবে।
-উপায় ছিল না ভাবী। সবাই জানাজানি হয়ে গেলে অনেক ধরনের বাঁধা আসতো তা তো তুমি ভালো করেই জানো। সবার আগে বাঁধা দিতো তোমার শাশুড়ি। সেজন্যই এভাবে বিয়েটা করতে বাধ্য হলাম।
তানিয়া আরও বলে, এরপর কি করবে কিছু ভেবেছো?
-আর কি বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবো।
-ঠিক আছে তাহলে আমি আর লাবিব নাহয় আপাতত অফিস ফিরে যাচ্ছি। তুমি কি আজ অফিস ফিরবে?
রওনক একবার চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে বলে, মনে হয় না আজ আর অফিস ফেরা হবে। আমার বাসায় তো পরে জানাবো আগে ওর বাসায় কথা বলতে হবে।
লাবিব বেরিয়ে যাবার আগে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, খুব বেশি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কিছু না বললেও এতটুকু বলতে পারি খাঁটি একজন মানুষকে পাশে পেয়েছো আজীবনের জন্য।
চিত্রলেখা মুখ তুলে একবার লাবিবের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বলতে পারে না। ওরা চলে গেলে রওনক বলে, চলো তোমার বাড়ি যাই। সবাইকে জানাতে হবে তো।
গাড়িতে ওঠার আগে চিত্রলেখা বলে, আগে আমাকে একটু নুরজাহান রোড নিয়ে যাবেন প্লিজ?
-ঠিক আছে।
রওনক জানে নুরজাহান রোড চিত্রলেখার বান্ধবী আফিফা থাকে। আগেরদিন ওখান থেকেই নিয়ে এসেছি তাকে। তাই বাড়তি প্রশ্ন করে না। চিত্রলেখার মানসিক অবস্থাটা আন্দাজ করতে পারছে।
গাড়িটা এসে আফিফার বাসার সামনে দাঁড়ালে রওনক বলে, কখন নিতে আসবো?
-আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি নিজেই চলে যেতে পারবো।
-তোমাকে আর একা পথ চলতে হবে না। এখন থেকে তোমার সব দায় দায়িত্ব আমার। কখন আসবো বলো। রাতে বাসায় নিয়ে যাবো তোমাকে।
-আজকের রাতটা সময় দিন আমায় প্লিজ।
রওনক বুঝতে পারে তাই আপত্তি করে না। বরং হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ঠিক আছে আজ থাকো নিজের পরিবারের সঙ্গে। তবে কাল কিন্তু সিওর নিয়ে যাবো। আর আপত্তি শুনবো না।
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। গাড়ি থেকে নেমে গেলে রওনকও নেমে আফিফার বাড়ির গেইট পর্যন্ত এসে বলে, বাসায় ফিরে যাবার সময় আমায় কল দিও, আমি এসে দিয়ে আসবো।
-আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি পারবো।
-আমি চাই না তুমি পারো। আমার কথার যেনো নড়চড় না হয়। যখন বাড়ি ফিরবে একটা কল দিয়েও যত ব্যস্তই থাকি না কেনো আমি চলে আসবো।
চিত্রলেখা আর কথা বাড়ায় না বিল্ডিংয়ের ভেতর চলে যায়। পেছনে রওনক খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে উঠে পড়ে। আজ যেহেতু চিত্রলেখা যাচ্ছে না তাই অফিস ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। অযথা সময় অপচয় করে কাজ নেই।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
-কি বলতেছিস তোর মাথা ঠিক আছে তো?
চিত্রলেখার মুখে বিয়ের কথা শুনে এটা ছিল আফিফার প্রাথমিক রিয়্যাকশন। ভীষণরকম অবাক হয়েছে সে। সেই সাথে শকও হয়েছে। শক হওয়ারই কথা। এভাবে হুটহাট বিয়ে করার মানুষ চিত্রলেখা নয় তা আফিফার চাইতে ভালো কেউ জানে না। তাছাড়া গতকাল যে মানুষটা বলে গেল বিয়ে টিয়ে তার জন্য নয়। আজ কিনা সেই মানুষটাই এসে বলছে সে বিয়ে করে ফেলেছে। এমন কথা শুনার পর আফিফা যে ফিট খেয়ে পড়ে যায়নি তাই যথেষ্ট। নয়ত চিত্রলেখার মুখে এমন কথা শুনে আফিফার এতক্ষণে ফিট হয়ে যাওয়ার কথা।
চিত্রলেখা বলে, ঠিকই শুনেছিস। আমি ভুল বলছি না। মাথাও ঠিকঠাকই আছে আমার। সত্যি বিয়ে করেছি। বিয়ে করে সরাসরি তোর কাছে চলে এলাম। এই মুহূর্তে বাড়ি গিয়ে খালা, লিখন বা অন্যকাউকে ফেইস করতে পারবো না তাই তোর কাছে ছুটে এলাম।
চিত্রলেখার কথার আগামাথা কোনো কিছুই আফিফার বোধগম্য হয় না। বারো বছরেরও বেশি তাদের বন্ধুত্বের। আফিফা ভালো মতো চিনে চিত্রলেখাকে। অন্য আর সবাইকে দিয়ে এই কাজ সম্ভব হলেও চিত্রলেখাকে দিয়ে চিন্তাও করা যায় না। আফিফাকে চুপ করে থাকতে দেখে চিত্রলেখা বলে, কিরে কিছু বল। চুপ করে আছিস কেনো?
-বলবি তো তুই। এমন একটা বানোয়াট কথা বলবি আর আমি বিশ্বাস করে ফেলবো ভেবেছিস?
দু’জনে বিছানার উপর মুখোমুখি বসে আছে। দূরত্ব সামান্য। চিত্রলেখা আফিফার হাত ধরে বলে, এই তোকে ছুঁয়ে বলতেছি। সত্যি বিয়ে করে ফেলছি। সবার আগে তোর কাছে আসলাম নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য। আমি চাই না খালা, লিখন, চারু, চয়ন ওরা কেউ আমাকে ভুল বুঝুক।
-আর আমি? আমি ভুল বুঝবো না তোকে?
-তোকে তো আমি চিনি। পৃথিবীর সবাই একজোট হয়ে আমাকে ভুল বুঝলেও তুই কোনোদিন আমায় ভুল বুঝবি না। তোর জন্য আমি সবকিছুর উর্ধ্বে।
কথাটা একদম সত্যি বলেছে চিত্রলেখা। সবাই তাকে ভুল বুঝলেও একমাত্র আফিফা একজন যে হয়ত কোনোদিন তাকে ভুল বুঝবে না। এমনকি চিত্রলেখা যদি কাউকে খু ন করে এসে আফিফাকে জানায় তবুও সে ভাববে নিশ্চয়ই কারণ আছে বলেই চিত্রলেখা এমন কাজ করেছে। তাই বিয়েটা করে থাকলেও যে এর পেছনেও বড় ধরনের কোনো কারণ লুকিয়ে আছে তা আন্দাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে না আফিফার। নিজের চোখ মুখের সিরিয়েস ভাব খানিকটা কমিয়ে আফিফা এবারে জিজ্ঞেস করে, বিয়েটা করলি কাকে? মামুন ভাই?
-তোর মাথা ঠিক আছে? মামুন ভাইকে বিয়ে করলে এভাবে করতাম?
-তাহলে?
অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। আফিফার বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, তোর বস?
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। এই কথা শুনার পর আফিফার মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যায়। কীভাবে কি হলো বুঝে উঠতে পারে না সে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। চিত্রলেখা নিজেই গতকাল লম্বা লেকচার দিয়ে গেল। সামাজিক অবস্থার লম্বা ব্যাখ্যা দিলো। দু’জনের মধ্যকার অসামঞ্জস্যতার কথা বলল। কিন্তু তারপরে কি এমন হলো? এতকিছুর পরেও এমন একটা ঘটনা কীভাবে ঘটে গেলে মিলাতে পারে না আফিফা। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে বলে, এই থাম তুই দাঁড়া। একটু পানি খেয়েনি। আপাতত মাথা কাজ করছে না আমার।
আফিফা সত্যি সত্যি উঠে গিয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি ও গ্লাস নিয়ে ফিরে এলো। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চিত্রলেখার দিকে তাক করে বলে, নে ধর পানিটা খা।
চিত্রলেখাও আপত্তি করে না। পানিটা এই মুহূর্তে এমনিও তার দরকার ছিল। গলা বুক আগে থেকেই শুকিয়ে ছিল তার। দুই বান্ধবীর পানি খাওয়ার পর্ব শেষ হলে এবারে আফিফা জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কি খুলে বল তো আমাকে। এমনি এমনি তো বিয়ে করে ফেলার মানুষ তুই না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। খুলে বল তো কি হয়েছে?
চিত্রলেখা ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, খালু বাড়িটা বিক্রি করে ফেলবেন।
-বাড়ি বিক্রি করে ফেললে তোরা কোথায় থাকবি?
-আমাদের তো উনি এমনিতেই একমাসের আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছেন বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার। তাহলে বাড়ি বিক্রির পর আমরা কোথায় থাকবো না থাকবো সেটা তো উনার মাথা ব্যথা না।
-সেটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু এই কথা তোকে জানানোর কারণ কি?
-বুঝতে পারছিস না? সহজ হিসাব আলটিমেটলি সবার দায়-দায়িত্ব আমার উপর। তাই বাড়ি বিক্রির বিষয়টা আমাকে জানালেন নিজের সুবিধার্থে। খালাকে বললে উনি হয়ত আকুতি মিনতি করতে বাড়ি বিক্রি না করতে। আমি তো আর খালুকে না করবো না। সেই এখতিয়ার আমার নেই। আর উনি ভালো করেই জানেন আমার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কোনো কথা আমি উনাকে বলবো না। তবে আমার মনে হয় খালু কথাটা খালাকে জানাতে এসেছিলেন। কিন্তু সামনে পেয়ে আমায়ই বলে ফেললেন। এতে উনার জন্যই ভালো হলো। খালাকেও ফেইস করা লাগলো না। আর দায়িত্ব যার উপর সরাসরি তাকেই জানানো হয়ে গেলো। খালাকে জানালে হয়ত সমস্যা তৈরি হতো কোনো। কিন্তু আমাকে জানানোর ফলে কোনোধরনের জটিলতা তৈরি হয়নি। খালুর বাড়ির তিনি বেঁচবে না রাখবে সেখানে নিশ্চয়ই আমার কোনো কথা থাকতে পারে না। উনার বাড়িতে থাকছি বলে উনি কেবল আমায় জানালেন এতটুকু।
-সে নাহয় বুঝলাম কিন্তু হঠাৎ বাড়ি বিক্রি করতে এমন মরিয়া হয়ে উঠলেন কেনো?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে চিত্রলেখা বলে, খালু আবার বিয়ে করেছে।
-খালা জানেন?
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। চিত্রলেখার বিয়ের কথা শুনে যতখানি অবাক হয়েছিল আফিফা এই মুহূর্তে তার চাইতে আরও বেশি অবাক হয়েছে। সেই সঙ্গে খালার জন্য কষ্টও অনুভব করছে। আফসোসের সুরে আফিফা বলে, খালা মানুষটাকে ভালোবেসে সারাটাজীবন দিয়ে গেলেন অথচ এই বয়সে এসে প্রতারণার স্বীকার হতে হলো। এমন কাজ করার আগে একবারও খালার কথা ভাবলেন না উনি? খালা কষ্ট পাবে এটা ভাবলেন না?
-খালু খালার কথা ভাবা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। উনি কখনো আমাদের আপন করে নিতে পারেনি। চাননি আমরা উনাদের জীবনে আসি, বাড়িতে আসি। উনার কথার অবাধ্য হয়ে খালা যখন আমাদের চার ভাইবোনকে বুকে টেনে নিলেন তখন থেকেই খালা খালুকে নিজের থেকে সরিয়ে দিতে শুরু করেছেন। খালার কথা ভাবতে বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
-তোদের সাথে উনার সমস্যাটা কোথায় বুঝি না আমি। কখনো তো তোদের একজনকেও উনার নামে কটু বলতেও শুনলাম। তাহলে সমস্যা কোথায়?
-পৃথিবীটা অনেক বিচিত্র রে আফি৷ এখানে তোর আমার চিন্তা ভাবনার চাইতে ভিন্ন চিন্তা ভাবনার অনেক মানুষ আছে। প্রত্যেকে একে-অপরের থেকে ভিন্ন। এমনকি তাদের চিন্তা ভাবনা, দেখার দৃষ্টি ভঙ্গিও ভিন্ন। এই পৃথিবীতেই এমন অনেক মানুষ আছে যাদের নিজের সন্তান নেই। তারা বাবা-মা হীন এতিম বাচ্চাদের বুকে টেনে নেয়। বাবা-মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করে। আবার সেই একই পৃথিবীতে খালুর মতোও অনেকে আছেন। যাদের নিজের সন্তান নেই বলে তারা অন্যের সন্তানের মুখের হাসি সহ্য করতে পারেন না। তারা চিনে শুধু নিজের রক্ত, বংশ। দত্তক নিলে তো আর নিজের রক্ত হলো না। খালু কখনো মানতেই পারেননি উনাদের বাচ্চা না হওয়ার জন্য খালা দায়িত্ব নয়। বরং সমস্যাটা উনার। এই কঠিন সত্যিটা খালু কখনো মানতে পারেননি এমনকি মানতে চানও না।
-কিন্তু বাড়িটা কেন বিক্রি করতে চাইছেন সেটাই তো বুঝলাম না।
-কিছুদিন আগেই খালু মিরপুরে প্রায় পঁচাশি লাখ টাকা দিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। ডাউনপেমেন্ট করে দিয়েছেন কিন্তু বাকি টাকা পরিশোধ করার মতো টাকা উনার কাছে নেই। ফ্ল্যাট কিনার সময় এলাকায় উনার যে ২ টা দোকান আছে তা বিক্রি করে দিয়েছেন। বাজারে উনার আরও দুইটা দোকান আছে। কিন্তু ঐ দুইটা থেকে খালু বড় অংকের ভাড়া পান। তাই বাজারের দোকান দুইটা বিক্রি করলে উনার সংসার চলবে না। সেজন্য উনার কাছে বেস্ট অপশন হচ্ছে বাড়িটা বিক্রি করে দেয়া। এতে করে দুটো কাজ হবে। এক ফ্ল্যাটের বাকি টাকা একবারে দিয়ে ফেলতে পারবেন। আর দুই খালাসহ আমরা খুব সহজেই উনার ঘাড় থেকে নেমে যাবো।
-তোরা তো কোনোদিনই উনার ঘাড়ে ছিলি না। তুই চাকরীতে জয়েন করার পর থেকে উনি সংসারে একটা পয়সা দেননি। তাহলে সেসব টাকা পয়সা কোথায়?
-বুঝতে পারলি না? নতুন বিয়ে করেছেন বউকে স্বর্ণ গহনা গড়িয়ে দিয়েছেন গাড়ি কিনেছে। সেসব খরচ করতে গিয়ে জমানো টাকা সব খুইয়েছেন। এখন বাড়ি বিক্রি করে খালাকে আর আমাদের ঘাড় থেকে নামাতে চাইছেন। উনি জাস্ট খালার সঙ্গে সব শেষ করে দিয়ে এখান থেকে একেবারের জন্য চলে যেতো চান।
-এসব কথা তোকে খালু নিজের মুখে বলল?
-আর কে বলবে তাহলে?
-ছিঃ ছিঃ মেয়ের বসয়ী তোর কাছে এসব কথা বলতে উনার একটুও লজ্জা করলো না!
-উনার যদি লজ্জা থাকতোই তাহলে কি একটা মানুষের সাথে জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে দেয়ার পর এই বয়সে এসে তাকে এভাবে ঠকাতে পারতেন? এভাবে প্রতারণা করতে পারতেন যদি উনার মধ্যে সামান্য লজ্জা থাকতো? মানুষ পারে এভাবে একটা মানুষকে ঠকাতে? খালা নিঃস্বার্থ ভাবে তার সারাটা জীবন দিয়ে গেলেন অথচ বিনিময়ে কি পেলেন? বেঈমানি আর প্রতারণা।
এক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর আফিফা বলে, সব বুঝলাম। কিন্তু এসবের সাথে তোর আচমকা বিয়ে করার কারণ কি?
-আমরা বিয়ে করতে যাবার সময় পথে আমি উনাকে এই বিষয়টা জানিয়েছি। সব শুনে উনি বলেছেন উনাকে বিয়ে করার পর আমার সব সমস্যা সমাধান করে দিবেন।
-আর ওমনি তুই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলি?
-বিয়ে করতে তো আগেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু মনে হলো বিয়ের আগে উনাকে বিষয়টা জানানো উচিত তাই জানিয়েছি।
চিত্রলেখালে ভুল বুঝে নয়। কেবল পরিস্থিতি বিবেচনা করে আফিফা বলে, এতকিছু না জানলে দূর থেকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে টাকার কাছে তুই নিজেকে…
কথা শেষ করতে পারে না আফিফা। চিত্রলেখা নিজেই বলে, টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছি তাই তো? আসলেই বিক্রি করে দিলাম। ভাইবোনদের ভবিষ্যৎ গড়বো। ওদের স্বপ্ন পূরণ করবো সেই সাধ্য আমার নেই। এমন কোনো মূল্যবান কিছু নেই যার বিনিময়ে কিছু করবো। আমার কেবল আমিই আছি তাই নিজেকেই বিক্রি করে দিলাম।
-এভাবে বলছিস কেনো?
-আমি যদি সারাজীবনও গাধারখাটুনি খাটি তবুও কিছুই করতে পারব না। সবার জন্য একটা ভালো থাকার জায়গা, তিনবেলা ভালো খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেয়ে যাবো। সেখানে লিখনের বিদেশ যাওয়া, চারু, চয়নের ডাক্তারি পড়া, খালার দায়িত্ব কীভাবে করবো এত কিছু? এমন তো না দুই, চার বা পাঁচ হাজার টাকার মামলা। তোর থেকে নিয়ে নিলাম। পরের মাসে বেতন পেয়ে ফেরত দিয়ে দিবো। এবারে আমার প্রয়োজনটা অনেক বড় রে।
-তাই বলে নিজেকে ঠকিয়ে?
-না তো। আমি তো ঠকিনি। রওনক জামান এমন একটা নাম যার জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে আমার মতো দশজন চিত্রলেখাকে পালা কোনো ব্যাপারই না। অথচ দেখ উনি তো আমায় কোনো কুপ্রস্তাব দেননি। কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়াননি। বরং বিয়ে করেছেন। নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। সমাজের আর সবার সামনে স্বীকৃতি দিবেন। এর চাইতে ভালো তো আমার সাথে হওয়ার কথাও না। এতখানিও তো আমার পাওয়ার কথা ছিল না। রওনক জামানের বিয়ে করা বউ আমি। এত ভালো কিছু তো আমি নিজের জন্য কখনো আশাও করিনি। এত নামকরা একজন মানুষের বউ হয়েছি এরপর আর কি চাই জীবনে বল তো?
-টাকা পয়সাটাই সব হয়ে গেলো? কখনো চিন্তাও করিনি যে তুই সবসময় টাকা পয়সাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিস সেই তোর মুখেই এমন কথা শুনতে হবে একদিন। তোর জন্য টাকা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।
-টাকা পয়সা এখনো আমার জন্য তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না আফি। কিন্তু আমার আশেপাশের, কাছের মানুষগুলোর স্বপ্ন পূরণ করতে, ওদের ভালো রাখতে আমার টাকা লাগবে। বেঁচে থাকতে হলে প্রত্যেককে টাকার কাছে হাঁটু গাড়তে হবে, মাথা নত করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আমার নিজের জন্য সত্যিই কিচ্ছু চাই না। কিন্তু লিখন, চারু, চয়ন ওদের স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে অনেক টাকা দরকার। খালা যেন সারাজীবন ভালো থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে গেলেও টাকার প্রয়োজন। তুই শান্ত ভাইয়াকেই দেখনা। তোদের ফেলে একলা সেই চট্টগ্রাম পড়ে আছেন। কেনো? ভালো ইনকাম করতেই তো। খালাম্মাকে, তোকে, বাবলুকে যেন একটা ভালো জীবন দিতে পারে সেজন্যই এত কষ্ট, দূরত্ব সহ্য করে পড়ে আছে। মাস শেষে ভালো মাইনে পাচ্ছেন বলেই তো কষ্টকে উনার কষ্ট মনে হচ্ছে না। আমার নিজের জন্য কিচ্ছু চাই না। গাড়ি, বাড়ির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ বা লোভ কিছুই নেই। কিন্তু ওদের জন্য কিছু করতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন যা আমার নেই। তাই নিজেকে বিক্রি করে দিয়ে হলেও আমি ওদের জন্য করবো।
আফিফা এই প্রসঙ্গে আর কথা বলে না। চিত্রলেখার কাছ ঘেষে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমি সবসময় তোর সাথে আছি।
বান্ধবীর কাছে এই ভরসাটাই আশা করেছিল চিত্রলেখা এমনকি সে নিরাশ হয়নি।
নারগিস বেগম নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে আসতেই দেখেন চারু একলাই বসে আছে। এগিয়ে এসে পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করেন, তোর আপা কই রে মা?
-আপা তো সেই বিকালে কই যেন গেল। এখন পর্যন্ত ফিরে নাই।
একবার ড্রইং রুমের দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকান নারগিস বেগম। আটটা বাজতে চলল। আচমকাই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো উনার। ব্যস্ত হয়ে ব্যাকুল সুরে বললেন, কই গেছে? কত রাত হয়ে যাইতেছে। এখনো ফিরে নাই আমাকে আরও আগে জানাবি না তুই। জলদি একটা ফোন কর। কই আছে খবর নে। লিখনরে ফোন দিয়ে জানা, ও গিয়ে নিয়ে আসুক। তুই আগে ফোন দিয়ে জান কই আছে।
খালা হাইপার হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে চারু বলে, তুমি ব্যস্ত হইও না। আপা বের হয়ে যাওয়ার পরেই ফোন দিয়ে খবর নিছি আমি। বৃষ্টি আপুদের বাসা গেছে। বৃষ্টি আপুই ফোন করে তাকা যাইতে বলছে কি নাকি দরকার। চইলা আসবে তুমি খামখো চিন্তা কইরা নিজের প্রেসার বাড়াইও না।
-তো এই কথাটা তুই আমাকে আগে বলবি না?
-বলার সুযোগ কই দিলা? তার আগেই তো শুরু হয়ে গেলা তুমি। আজকাল যে কি এত ভাবো কিছুই বুঝি না।
-বুঝবি, যখন তোর নিজের সংসার হবে, তুই নিজে মা হবি তখন বুঝবি সংসারের কত জ্বালা। সন্তানের কত জ্বালা। নারী হওয়ার কত জ্বালা।
-সেইটা যখনের টা তখন দেখা যাবে। এখন বলো কি খাইতে দিবো তোমারে? আসার পরেই তো দিলা ঘুম। সকালবেলায় কোনোরকম খাইয়াই দিলা দৌড়। দুপুরে কিছু খাইছো কিনা কে জানে? কয়টা ভাত দেই তোমারে?
-না, ভাত দিস না। এক কাপ চা দে।
-আচ্ছা বসো তুমি, আমি চা নিয়ে আসতেছি।
চারু উঠে রান্নাঘরে চলে আসে খালার জন্য চা বানাতে। এই মাত্র সে খালাকে একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে। এই ধরনের কঠিন মিথ্যা কথা সাধারণত চারু বলে না। কিন্তু আজকে মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। খালাকে অতিরিক্ত হাইপার হয়ে যেতে দেখে বাধ্য হয়েই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছে ওকে। তাছাড়া এই মুহূর্তে চারুর সবচাইতে বেশি চিন্তা হচ্ছে চিত্রলেখার জন্য। সেই বিকাল বেলায় কাউকে কিছু না জানিয়েই বেরিয়ে গেল। এমনকি মোবাইলটাও সঙ্গে নেয়নি। এমন বেতাইল্যা কাজ চিত্রলেখা কখনো করে না। আজ কি হলো? কোথায় গেল এমন করে কে জানে? তবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে চারুর। এই পর্যন্ত বেশ কয়বারই চিন্তা করেছে আফিফাকে ফোন করে খোঁজ নিবে ওখানে গিয়েছে কিনা। কিন্তু ফোন করার সাহস হয়নি। অকারণে কাউকে বিরক্ত করাটা চিত্রলেখা একদম পছন্দ করে না। যদি সে ওখানে না গিয়ে থাকে তাহলে বাড়ি ফিরে যখন জানবে তাকে খুঁজতে চারু আফিফাকে ফোন করেছে তখন চারুর কপালে শনির দশা আছে। কিন্তু আফিফা ছাড়া আর কারো কথা মাথাও আসছে না চারুর। চিত্রলেখার জীবনে হাতে গোনা কয়জন মানুষই আছে যাদের কাছে সে যেতে পারে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না। বানিয়ে মিথ্যা বলে খালাকে শান্ত করা গেছে আপাতত। কিন্তু জলদিই চিত্রলেখা বাড়ি না ফিরলে তখন আর চারুর মিথ্যা ধোপে টিকবে না। কোনো কারণে খালা বা লিখনের যেকোনো একজন চিত্রলেখাকে ফোন করলেই চারুর মিথ্যা ধরা পরে যাবে। যদিও চিত্রলেখার ফোনটা সে সাইলেন্ট করে লুকিয়ে রেখেছেন যেনো কেউ দেখে না ফেলে। চিত্রলেখা ফোন নিয়ে যায়নি একথা বাড়ির কেউ জানলেই খেল খতম হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত লিখনকে কিছু জানায়নি চারু। খালাকে কিছু একটা বলে বুঝাতে পারলেও লিখনকে বুঝ দিতে পারবে না। যা হয় হবে, না হয় খেলো বকা তবুও আফিফাকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নেয় চারু। ওখানে না থাকলেও নিশ্চয়ই আফিফা তাকে হেল্প করতে পারবে চিত্রলেখা কোথায় আছে জানতে।
চায়ের পাতিলটা চুলায় বসিয়ে দেয় চারু জাল হতে। ততক্ষণে সে আফিফাকে ফোন লাগায় বোনের খবর জানতে। ফোনটা বেজে উঠতেই আফিফা উঠে গিয়ে বেড সাইড টেবিলে থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়েই চমকে উঠে চিত্রলেখাকে জিজ্ঞেস করে, তুই যে আমার এখানে আসছিস এই কথা চারু জানে?
-না তো।
আফিফা এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মুখের সামনে নিজের মোবাইলটা বাড়িয়ে ধরে। তার ফোনের স্ক্রিনে চারুর নাম ভাসছে। ব্যস্ত সুরে আফিফা জিজ্ঞেস করে, কি বলবো ওরে?
-তোর বলতে হবে না, আমিই বলছি।
হাত বাড়ি দ্রুত ফোনটা নেয় চিত্রলেখা। বিয়ের ঘটনাটায় এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে বাড়িতে জানানোর কথা খেয়ালই ছিল না তার। এমনকি এখানে আসার পর যে মনে করে চারুকে অন্তত একটা ফোন করবে সেই খেয়ালটাও মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল তার। কল রিসিভ হতেই বড় বোনের কন্ঠ শুনতে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে চারু। হড়বড় করে বলতে শুরু করে, আপা তুমি আফিফা আপুর বাসায় গেছো আমাকে বলে যাবা না? সেই কখন বাইর হইছো। মোবাইলটাও সাথে নেও নাই। কত রাত হয়ে যাইতেছে। আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম তুমি জানো?
চিত্রলেখা অনুভব করতে পারে চারুর গলা ধরে আসছে কথা বলতে বলতে। সূক্ষ্ম অপরাধ বোধ ক্রিয়া করে তার ভেতর। বলে, আফি ফোন করে বলল ওর শরীরটা ভালো না। ওর কথা শুনে আমার মাথা ঠিক ছিল না রে। ওমনিই চলে আসছি। ফোনটাও ফালায় রেখে আসছি। এখানে আইসা ওরে দেখার পর আর মাথায়ই ছিল না তোকে যে একটা ফোন করে দিবো।
-কী হইছে আপুর? শরীর কী বেশি খারাপ?
-এখন অনেকটা ভালো আছে। শরীরটা দূর্বল হয়ে গেছে।
-ও আচ্ছা। তাহলে কি তুমি রাতে ঐখানেই থাকবা।
-না, থাকবো না। একটু পরেই চলে আসবো।
-আমি কী ভাইয়াকে বলবো তোমারে গিয়ে নিয়ে আসতে?
-তোর কী মাথা নষ্ট হয়ে গেল চারু। গতকাল খালা লিখনকে গলির মোড়ে পাঠাইছে আমাকে আগায় আনতে। আজকে তুই বলতেছিস লিখনকে পাঠাবি আমাকে নিয়ে যাইতে। তোদের হইছে টা কি? আমি কি ছোট বাচ্চা যে আমাকে আইসা নিয়ে যাইতে হবে?
-আরে রাগ হও কেন? রাত হয়ে গেছে সেজন্য বললাম।
-তোর এত ভাবা লাগবে না। লিখনেও পাঠাইতে হবে না। আধাঘন্টার মধ্যে বাসায় চলে আসবো আমি।
-আচ্ছা।
-আর কিছু বলবি?
-খালা তোমার জন্য অনেক টেনশন করতেছিল তাই বলছি তুমি বৃষ্টি আপুদের বাসায় গেছো।
-আর বৃষ্টি কি জানে?
-কিছু জানে না। আমি কি বৃষ্টি আপুকে ফোন করে বলবো বিষয়টা।
-দরকার নাই। কারে কি বলতে হবে তা আমি ফিরেই বলবো। তোর আর কাউকে কিছু বলতে হবে না। আসতেছি আমি।
চিত্রলেখা কল কাটতেই আফিফা তাকে ব্যঙ্গ করে বলে, আমার তো শরীর ভালো না, আজকের রাতটা নাহয় এখানেই থেকে যা।
বান্ধবীর কথা শুনে হেসে ফেলে চিত্রলেখা। তবুও ভালো এতক্ষণে বেচারীর মুখে হাসি তো ফুটেছে। চিত্রলেখা বলে, কি করতাম বল? এই মুহূর্তে সত্যিটা বলা সম্ভব না তাই বাহানা করতে হলো।
-সে নাহয় বুঝলাম কিন্তু আমাকে বল তোর আসলেই কি মাথা ঠিক আছে?
-কেন? আমার আবার মাথার কি হলো?
-আয় আমার সঙ্গে।
আফিফা চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে টেনে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। পেছন থেকে বলে, তোকে দেখে কেউ বলবে আজ তোর বিয়ে হয়েছে, তুই নতুন বউ?
আয়নায় চিত্রলেখা একবার আপাদমস্তক দেখে নেয় নিজেকে। আসলেই তাকে দেখে কেউ বলবে না সে নতুন বউ, সদ্যই তার বিয়ে হয়েছে। বাসায় পরা সুতির সাধারণ একটা জামা তার পরনে। চোখ, মুখে কোনো প্রসাধনীর বালাই নেই। বরং চোখের নিচ খানিকটা কালচে হয়ে গেছে নানারকম চিন্তা ভাবনায়। কোমড় সমান চুলগুলো হাত খোঁপা করা এমনকি চিরুনি দিয়ে আঁচড়েও নেয়নি। নিজেকে ব্যঙ্গ করে এবার চিত্রলেখা বলে, মানুষটা ঠকে গেলো রে। নয়ত আমার মতো দেখতে অসুন্দর মেয়েকে কেউ বিয়ে করে? আজীবনের জন্য জঘন্য রকম ঠকে গেলেন মানুষটা।
বলেই হেসে ফেলে চিত্রলেখা। রওনকের জন্য আফসোস হয় তার। পেছন থেকে আফিফা তার কাঁধে হাত রেখে বলে, তোর মানুষটা কেমন তা তো জানি না। তবে এতটুকু বলতে পারি একদমই ঠকেননি। বরং তুই হবি তার জীবনের সবচাইতে চমৎকার পাওয়া। আমার তো গতকালই তোর কথা শুনে মনে হয়েছিল লোকটা তোকে ভালোবাসে।
এবারে শব্দ করে হেসে ফেলে চিত্রলেখা। হেসে নিয়ে বলে, আর হাসাইস না। কোনো ভালোবাসা টাসা নাই। সবটাই হচ্ছে কেবল নিজের স্বার্থে ও প্রয়োজনের বাইরে আর কিচ্ছু না।
আফিফা আরও কিছু বলতে চায় কিন্তু চিত্রলেখা আর সুযোগ দেয় না। বরং তাড়া দিয়ে বলে, আজ আর দেরি করা যাবে না। কথায় কথায় কখন এত সময় চলে গেলো টেরই পেলাম না। আজকের মতো বিদায় দে আমায়।
-আজকের রাতটা থেকে গেলেও পারতি।
-সম্ভবত না রে। তুই তো জানিসই সব।
-কীভাবে বলবি কিছু ভেবেছিস?
-এখনো না। রাতটা কাটুক। কাল দিনের বেলায় দেখা যাবে।
-যদি মনে করিস আমি পাশে থাকলে তোর সুবিধা হবে তাহলে সকালে একটা ফোন দিয়ে দিস আমি চলে যাবো।
-ঠিক আছে।
চিত্রলেখা বেরিয়ে যাবার আগে আফিফাকে জড়িয়ে ধরে একবার। এই মানুষটার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে সে নিঃস্বার্থভাবে সবসময় পাশে থাকার জন্য, ভরসা করার জন্য সর্বোপরি তাকে এত ভালোবাসার জন্য।
বিল্ডিংয়ের গেইট দিয়ে বেরিয়েই আগের দিনের মতো থমকে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। তবে আগের দিনের চাইতে আজ একটু বেশিই অবাক হয়েছে সে রাস্তার অন্যপাশে রওনককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। প্রথমে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা এগিয়ে যায় রওনকের কাছাকাছি। এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালে রওনক বলে, তোমার দেরি দেখে আমি তো ভাবলাম হয়ত চলে গেছো।
-আমি তো আপনাকে ফোন করিনি তাহলে জানলে কীভাবে আমি এখন বের হবো?
-এখন বের হবে সেটা তো জানতাম না। তবে তুমি ফোন দিবে না জানতাম।
-কীভাবে জানলেন?
-তুমি নিজের জন্য কাউকে বিরক্ত করতে পছন্দ করো না তাই।
চিত্রলেখার কি যেন হলো। কথাটা সত্যি কিন্তু মানুষটা কীভাবে জানলো? কথাটা ভাবায় তাকে। রওনক আরও বলে, অবশ্য আজ চাইলেও ফোন করতে পারতে না।
-কেনো?
-তুমি তো ফোন আনোনি সাথে। আমার মোবাইল নম্বর নিশ্চয়ই তোমার মুখস্ত নেই যে বান্ধবীর ফোন থেকে কল করবে।
-আপনি খেয়াল করেছেন আমি ফোন আনিনি?
চিত্রলেখার অবাক হওয়া বাড়ে। রওনক বলে, আমি তোমার সবকিছুই খেয়াল করি। যাক গিয়ে সেসব কথা তোমাকে একটা জিনিস দেয়ার ছিল।
-কি?
রওনক গাড়ির ভেতর থেকে একটা আংটির বক্স বের করে। সেখান থেকে আংটিটা নিয়ে বাম হাত চিত্রলেখার দিকে মেলে দিয়ে বলে, হাতটা দাও তো দেখি।
নিজের হাত পেছন দিকে আড়াল করার চেষ্টা করে, আপত্তির সুরে চিত্রলেখা বলে, এত দামী জিনিস আমি নিতে পারবো না।
রওনক নিজেই হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, নিতে তো তোমাকে হবেই।
আংটিটা চিত্রলেখার আঙ্গুলে পরিয়ে দিতে দিতে সে আরও বলে, এখন তুমি আর কেবল চিত্রলেখা নও। বরং এখন থেকে মিসেস চিত্রলেখা রওনক জামান হিসেবে জানবে সবাই তোমাকে।
আংটিটা পরিয়ে দিয়ে মুখ তুলে চোখে চোখ রাখে রওনক। চিত্রলেখা আর কথা বলতে পারে না। অজানা জড়তায় জরিয়ে আসে ভেতর থেকে। রওনক এখনো তার হাতটা ধরে রেখেছে অচেনা অথবা খুব চেনা কোনো অধিকার বোধ থেকে। চাইলেও চিত্রলেখা এই হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে না। বরং অনুভব করে প্রতিমুহূর্ত সে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে। আগের চাইতে আরও বেশি বাঁধা পড়ে যাচ্ছে মানুষটার সঙ্গে অজানা কোনো শক্ত বন্ধনে। এর থেকে পালানোর উপায় জানা নেই চিত্রলেখার। কয়েদি হয়ে সারাজীবন তাকে আটকা থাকতে হবে রওনক নাম বন্ধী খানায়।
বেশ কিছুক্ষণ চিত্রলেখার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর রওনক নিজেই বলে, চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।
সটান দাঁড়িয়ে চিত্রলেখা বলে, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না৷ আমি একাই চলে যেতে পারবো। একটা রিকশা নিয়ে নাহয় চলে যাবো।
-তুমি গাড়িতে না যেতে চাইলে সমস্যা নেই। আমি রিকশা করে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো।
-সেটারও প্রয়োজন নেই। আমি একাই চলে যেতে পারবো না। আপনার কষ্ট করে দিয়ে আসা লাগবে না।
-কিন্তু আমি তো তোমাকে একা ছাড়বো না।
-কেনো?
-রাত হয়ে গেছে। একা যাবার হলে দিনের আলো থেকেই চলে যাওয়া উচিত ছিল তোমার।
-আজ প্রথম একা রাত করে বের হইনি আমি। এর আগে বহুবার রাত করে একাই বাড়ি ফিরেছি অফিস থেকে।
-প্রথমই তো। বিয়ের পর আজই তো প্রথম তাই না? এর আগে বহুবার রাত করে একলা বাড়ি ফিরেছো সেটা বিয়ের আগে। আমি তোমার জীবনে আসার আগে। আগে যেটা হয়েছে এখন তো সেটা হবে না। আমি হতে দিবো না।
-কেনো হবে না?
-আমি এসে গেছি তাই। আগে আমি ছিলাম না বলে তোমাকে একা পথ চলতে হয়েছে। কিন্তু এখন তো আর সেটা হবে না। এখন থেকে তোমার দিনের, রাতের সবসময়ের সঙ্গি আমি। আমি থাকতে তোমাকে একা পথ চলতে হবে না। আমি চলে দিবো না। তুমি চাও বা না চাও আমার সঙ্গেই পথ চলতে হবে তোমাকে। তুমি একা যেতে পারবে তা আমি জানি। কিন্তু আমি চাই না তোমাকে একা ছাড়তে। এখন থেকে তোমার সেফটি আমার জন্য সবকিছুর উর্ধ্বে।
চিত্রলেখা আর কথাই বলতে পারে না। রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার কপালের উপর উড়তে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলে, জানি বিয়েটা নিজের স্বার্থে করেছি তাই বলে তোমাকে শুধু ব্যবহার করবো না। আমার বউ হিসেবে তুমি তোমার যোগ্য সম্মান, মর্যাদা, ভালোবাসা সবটুকুই পাবে।
চিত্রলেখার নীরনতা, নিঃস্তব্ধতা বাড়ে। তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক আরও বলে, এখন বলো রিকশা ডাকবো না ম্যাডাম গাড়িতেই যাবে।
রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই চিত্রলেখা বলে, আপনি যেভাবে বলবেন।
তখনো হাতটা ছাড়েনি রওনক। চিত্রলেখার হাত ধরে রেখেই তাকে সামনের সিটে বসিয়ে দিয়ে সিটবেল্ট আটকে দেয়। সরে আসার আগে চিত্রলেখার মুখের একদম কাছাকাছি থমকে থাকে কিছুক্ষণের জন্য। বড়োজোর তিন আঙ্গুল পরিমাণ দূরত্ব দু’জনের ঠোঁটের মাঝে। এতখানি কাছাকাছি গিয়েও কিছু বলে না রওনক। কাছ থেকে কেবল চিত্রলেখাকে দেখে নয়ন ভরে। অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড় হয় চিত্রলেখার। একবার ঢোক গিলে নিয়ে মিনমিনে সুরে বলে, কি দেখছেন?
-তুমি বুঝবে না।
আর অপেক্ষা না করে সরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে রওনক গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। রওনকের গাড়িটা যখন চিত্রলেখার বাড়ির গেইটের কাছে এসে দাঁড়ায় নামার আগে চিত্রলেখা বলে, আপনি প্লিজ নামবেন না।
-কেনো?
-আমি চাই না আপনাকে কেউ দেখুক।
-আমাকে দেখলে কি হবে?
-এই মুহূর্তে এত ব্যাখ্যা করতে পারবো না। প্লিজ নামবেন না।
চিত্রলেখা রওনককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। কিন্তু যেই সে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতে যাবে ওমনি গাড়ি থেকে বেরিয়ে রওনক তাকে ডাকে,
-চন্দ্রলেখা শুনো।
বাধ্য হয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা। পেছন ফিরতেই দেখে রওনক কেমন করে যেন হাসছে। সিনেমায় থাকা ভিলেইনরা যেমন মিনমিনে ধরনের হাসি হাসি সেইরকম একটা হাসি তার মুখে লেগে রয়েছে এই মুহূর্তে৷ কিন্তু তাকে দেখতে একদমই ভিলেইনের মতো লাগছে না। বরং হলিউডের নায়কদের মতো সুন্দর লাগছে দেখতে। না না, হলিউডের নায়করাও হয়ত এত সুন্দর হয় না। চিত্রলেখার মাথার ভেতর আউল লেগে যায়। রওনক এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, কাল তৈরি থেকো নিতে আসবো।
-কালকেই? আর কয়টা…
চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে, কাল মানে কালই। আর একদিনও বেশি নয়।
চিত্রলেখা বুঝতে পারে আপত্তি করার সুযোগ নেই তার। তাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়। রওনক বলে,
-ভেতরে যাও, কাল দেখা হবে।
-আপনি সাবধানে যাবেন।
-আচ্ছা।
চিত্রলেখা বাড়ির ভেতর চলে গেলে রওনক গাড়িতে উঠার জন্য পেছন ফিরতে নিলেই তার দৃষ্টি যায় ডানের দিকে। খানিকটা দূরে একটা টঙ দোকানে সামান্য আড়াল হয়েই দাঁড়িয়ে আছে মামুন। চিত্রলেখা হয়ত এই কারণেই চাইছিল না রওনক আসুক বা গাড়ি থেকে নামুক। এটা আন্দাজ করতে পেরে ইচ্ছা করেই রওনক গাড়ি থেকে নেমেছে। সে চাইছিল মামুন দৃশ্যটা দেখুক। তার কাজ আপাতত হয়ে গেছে। আজকের রাতটা মামুন নামক লোকটা নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে কাটাবে। আসল বো ম কাল ফাটবে সে। আর অপেক্ষা না করে রওনক গাড়িতে উঠে বসে। তাকেও বাড়ি ফিরতে হবে।
চলবে….
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
বাসায় ফিরতেই তানিয়ার সঙ্গে দেয়া হয় রওনকের। দেবরকে দেখেই তানিয়া হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করে, এতক্ষণে ফিরলে তাহলে?
-আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি?
-শুধু তোমার জন্য নয়। বাড়িতে আজ তো নতুন সদস্য আসার কথা। মূলত তার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তাকে ওয়েলকাম করবো বলে।
-তাকে ওয়েলকাম করার জন্য আরও একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে তোমায়।
-কেনো?
-তোমার হাতে সময় আছে?
-সারারাতই তো পরে আছে। কেনো বলো তো?
-তাহলে কষ্ট করে দু’কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আমার ঘরে আসো। ততক্ষণে আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। তারপর কফি খেতে খেতে বিস্তারিত বলবো তোমায়।
-ঠিক আছে। তুমি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। একটু পরেই কফি নিয়ে আসছি।
রওনক আর দেরি করে না। তানিয়াকে ড্রইং রুমে রেখেই উপরে চলে যায়। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে এসে প্রথমে রওনক যে কাজটা করে সেটা হচ্ছে মোবাইল ফোন চার্জে লাগানো। আজকেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে ফোনটা চার্জে লাগানোর আগে একটা নতুন কাজ করেছে সে যা মাঝে অনেকদিন বলাবাহুল্য কয়েক বছর করা হয়নি। মূলত করার প্রয়োজন হয়নি। চিত্রলেখাকে একটা মেসেজ পাঠায় সে। তারপর ফোনটা চার্জে লাগিয়ে বাথরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। যদিও ফোন করতে চেয়েছিল কিন্তু কি একটা চিন্তা করে আর কল না দিয়ে মেসেজ পাঠায় কেবল।
রওনক ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই তানিয়া দু’কাপ কফি সমেত এসে উপস্থিত হয়। ভাবীকে দেখেই রওনক জিজ্ঞেস করে, ঘরে বসবে নাকি বারান্দায় যাবে?
-তোমার যেভাবে সুবিধা হয়।
-একটা মেইল চেক করবো, ঘরেই বসি। কাজটা করতে করতে নাহয় তোমার কথার জবাব দিবো।
রওনক তার বেডের একপাশে রাখা সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়ে। সামনে রাখা ছোট টি-টেবিলে ল্যাপটপটা রাখে। তানিয়া এগিয়ে এসে কফির কাপটা পাশেই নামিয়ে রেখে নিজে গিয়ে বসে বিছানার কার্নিশ ঘেষে। কফিতে দু’বার চুমুক দেয়ার পরে তামিয়া জিজ্ঞেস করে, বললে না নতুন সদস্যের আসা পিছিয়ে গেল কেনো?
-জানোই তো হুট করে বিয়েটা করলাম। এদিকে তাও তুমি জানো। কিন্তু ওদিকে কেউ জানে না। তাই চন্দ্র বলল আজকের রাতটা ওকে সময় দিতে। কাল গিয়ে নিয়ে আসবো।
-চন্দ্র কে?
রওনক ল্যাপটপের উপর থেকে মুখ তুলে তানিয়ার দিকে তাকায়। স্মিত হেসে পুনরায় ল্যাপটপে চোখ নামিয়ে বলে, চিত্রলেখা।
নাম বলতে বলতে যেন রওনকের মুখের হাসি প্রশস্ত হয়। তানিয়া জিজ্ঞেস করে, ওর নাম চন্দ্র?
-না তো।
-তাহলে তুমি যে চন্দ্র ডাকলে।
-ওটা আমার দেয়া নাম, শুধু আমিই ডাকবো।
তানিয়া কিছু বলে না। তার মনের ভেতর মিশ্র অনুভূতি ক্রিয়া করে। রওনককে দেখে তার খুশি লাগছে আবার একটা কেমন শূন্য লাগায় যেন ভেতরটা হাহাকারও করতে চায়। নিজেকে সামলে নিয়ে তানিয়া কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। বলে, একটা কথার জবাব দিবে সত্যি করে।
-আমাকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনেছো নাকি?
-সত্যি করে বলো তো তোমরা প্রেম করছিলে না?
-আমরা বলতে?
-তুমি আর চিত্রলেখা।
-একদমই না। আমাদের ভেতর এতদিন কোনো প্রেম ছিল না। আজকের পরে হলেও হতে পারে তবে আজ বিকেল পর্যন্ত কোনো প্রেম ছিল না এটা কনফার্ম থাকতে পারো।
-উঁহু, বিশ্বাস হচ্ছে না। বিয়ে হয়েছে ২৪ ঘন্টাও হয়নি। ২৪ ঘন্টা বাদ দাও এখনো তো দু’জনে একসাথে কয়েকটা ঘন্টাও থাকলে না অথচ তোমার চোখ-মুখ জুড়ে স্পষ্ট চিত্রলেখাকে দেখতে পারছি। আর তুমি বলছো তোমাদের মাঝে প্রেম ছিল না।
-সত্যিই কোনো প্রেম ছিল না ভাবী।
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না রওনক।
-বিশ্বাস করো ভাবী। আমাকে তো তুমি চিনোই।
-চিনি বলেই তো আমার চিনা জানা রওনকের সাথে তোমাকে মিলাতে পারছি না। আবার অমিলটা যে কোথায় সেটাও সঠিক ধরতে পারছি না। এত রহস্য রহস্য লাগছে কেনো বলো তো?
রওনক মুখে কিছু বলে না কেবল শব্দহীন স্মিত হাসে। তানিয়া নিজের আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারে না। আগ্রহ ভরে আরও জিজ্ঞেস করে,
-তোমার কি একটুও ইতস্তত লাগছে না?
-কেনো? ইতস্তত লাগবে কেনো? ইতস্তত লাগার মতো কি কিছু করেছি নাকি?
-এই যে হুট করে বিয়ে করে ফেললে। কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া, পরিকল্পনা ছাড়া।
-বিয়ে কি ইতস্তত হওয়ার মতো ব্যাপার নাকি? জীবনে বিয়ের চাইতে সুন্দর কিছু কি হতে পারে? তাছাড়া আমাকে তো তুমি চিনোই। পরিকল্পনা ছাড়া কি আমাকে কখনো কিছু করতে দেখেছো এতগুলো বছরে? আমি তো আরও ভাবলাম তুমি খুশি হবে, আমি বিয়ে করেছি বলে।
-সত্যিই খুশি হয়েছি। ভাষায় প্রকাশ করে বলতে পারবো না এতখানি খুশি হয়েছি মনে-প্রাণে। কিন্তু জানো তো নিজের জীবনে বিয়ে নামক চ্যাপ্টারে এমন বাজে ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছি যে ভয় হয়। আমি চাই না আরেকটা মেয়ে আমার মতো মুখ থুবড়ে পড়ুক। আরেকটা সম্পর্ক ভেস্তে যাক। ঠকে যাবার পর বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের রওনক।
-চিন্তা করো না ভাবী। ওর জন্য কতুটুকু করতে পারবো জানি না। তবে ওকে কখনো ঠকাবো না তোমাকে এই কথা দিলাম। নিজে হেরে গেলেও ওকে আমি ঠিকই জিতিয়ে দিবো।
তানিয়া মুগ্ধ হয়ে রওনকের কথা শুনে। সে অনুভব করে চিত্রলেখা নামক মেয়েটা নিজের কপাল সোনায় বাঁধিয়ে এসেছে। এর আগে ওর জীবন কেমন ছিল তানিয়ার জানা নেই। তবে এই যে আজ থেকে চিত্রলেখার জীবনে রওনক নামক একজন মানুষ আছে। এই মানুষটা সবরকম ঝড়, বৃষ্টি, তুফানের হাত থেকে ওকে আগলে রাখবে। নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসবে।
-আরেকটা প্রশ্নের জবাব দাও তো রওনক।
-আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে ভাবী। তোমার এসব প্রশ্ন উত্তর পর্ব কখন শেষ হবে বলো তো।
-এটাই লাস্ট।
-আচ্ছা বলো।
-এতখানি ভালোবেসে ফেললে কখন?
-জানি না।
-আরে বলোই না। এই ভালোবাসাটা কখন চলে এলো তোমার ভেতর।
-আমি সত্যি জানি না ভাবী। এখনো সিওর হয়ে বলতে পারছি না ভালোবাসি কিনা।
-বাসো বাসো শতভাগ বাসো। কিন্তু আমি খুঁজে পাচ্ছি না এসব হলো কখনো।
রওনক আর জবাব দেয় না। শব্দহীন স্মিত হাতে। তার চন্দ্রলেখার কথা চিন্তা করে মুখে লেগে থাকা সেই হাসি প্রশস্ত হয় আরও খানিকটা গভীর হয়। তানিয়া চলে যাবার আগ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়লে রওনক বলে, আরেকটা প্রশ্ন করতে চাও নিশ্চয়ই। করে ফেলো।
-মাকে কখন জানাবে?
-কাল।
-কীভাবে কী বলবে কিছু ভেবেছো? নাকি আমি বলবো?
-তোমাকে বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলবো।
-ঠিক আছে। বেস্ট অফ লাক।
তানিয়া চলে গেলে পরে রুমের দরজা লক করে, লাইট অফ করে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় রওনক। বন্ধ চোখের পাতায় তার এলোমেলো চিত্রলেখার চেহারা ভাসে। সে চাইলেই বিয়ের আগে চিত্রলেখাকে নিয়ে গিয়ে শপিং করে একটা ভালো পার্লার থেকে সাজিয়ে নিয়ে তারপর বিয়েটা করতে পারতো কিন্তু ইচ্ছা করেই করেনি। একটা সাধারণ কামিজে, মুখে কোনোরকম প্রসাধনী নেই, চুলগুলো হাত খোঁপা করা চিত্রলেখার চোখে-মুখে যতখানি মায়া মাখা ছিল মেকাপের তলে তা ঢাকা পরে যেত যা রওনক চায়নি। তার তো আরম্ভরহীন চিত্রলেখাকেই ভালোলাগে। হয়ত তানিয়ার ভাষায় সে ভালোবাসে ঐ সাধারণ দেখতে চিত্রলেখাকেই। যার ভেতর কোনোরকম বাড়াবাড়ি নেই কোনোকিছুর।
চিত্রলেখা তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে। রওনকের পাঠানো মেসেজটা এই পর্যন্ত কতবার পড়েছে তার হিসেব নেই। এই যে এক্ষুণি আবার পড়লো সে। খুব বেশি কিছু না। রওনক লিখে পাঠিয়েছে ❝আমি বাসায় পৌঁছে গিয়েছি।❞ এই যে তাকে জানানোর ব্যাপারটা। অদ্ভুত এক অধিকারবোধ, দায়িত্ববোধ অনুভব করে চিত্রলেখা। সেই সঙ্গে এও উপলব্ধি করে তার জীবনটা পাল্টে গেছে। আগের মতো আর কিচ্ছুই নেই। তার জীবনে আরও একজন মানুষের আগমন হয়েছে যাকে চাইলেও সে হেলায় ফেলতে পারবে না, অবহেলা করতে পারবে না। বরং তার জীবনের সবটা জুড়িয়েই থাকবে এই মানুষটা। চিত্রলেখা চোখ বন্ধ করতে পারে না। মনে হয় না আর সারারাতে ঘুম হবে তার। বারবার মস্তিষ্কের ভেতর আলোড়িত হয় একটা কথা আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই চিত্রলেখার রাত ভোর হয়।
চিত্রলেখাদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে রওনক। অন্যপাশে আছে নারগিস বেগম, লিখন, চয়ন ও চারু। চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে আছে রওনকের পাশেই। বসতে পারছে না বেচারী চিন্তায়। এক্ষুনি বিয়ের বিষয়টা সবাইকে বলতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি বলবে না আমি বলবো?
চলবে…