মাতাল হাওয়া পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
542

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আফিফার ছেলে বাবলুটা ভারি লক্ষি। এই বয়সের বাচ্চা সারাদিন পে পু করে কান্নাকাটি করে। কিন্তু বাবলু কেবল খুদা লাগলেই কাঁদে। এছাড়া তার কান্নাকাটি নেই। আফিফার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটা বেশ সুন্দর। বেশি সুন্দর লাগে ফুলের টবগুলোর জন্য। একটা পাশ শখ করে ছোট্টখাট্টো বাগানের মতো করে ফেলেছে সে। ভালো ঠান্ডা পড়ে গেছে আজকাল। একটা ঠান্ডা বাতাস চিত্রলেখাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। আপাতত সঙ্গে কোনো গরম কাপড় না থাকায় ঠান্ডা তাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সঙ্গে একটা পাতলা মতন শোল ধরনের ছোট চাদর ছিল তবে এই মুহূর্তে সেটা বিছানায় রাখা। চিত্রলেখার একদম ইচ্ছা হচ্ছে না গিয়ে নিয়ে আসতে। ঠান্ডা বাতাসে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেই আরাম লাগছে। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার কোমড় সমান চুলগুলোও দোলাচ্ছে। পেছন থেকে এগিয়ে এসে আফিফা বলে,

-তোর চুল তো দেখছি আগের চাইতে আরও বড় হয়েছে।

কথার ফাঁকেই চায়ের মগ বাড়িয়ে দেয় আফিফা। প্রিয় বান্ধবীর হাত থেকে চায়ের মগটা নিয়ে ঘ্রান শুকেই চিত্রলেখা বলে, কতদিন ছিলি না বল তো?

-এই তো তিনমাস হবে।

চায়ের মগে একটা লম্বা টান দিয়ে তৃপ্তি সমেত চিত্রলেখা বলে, তুই পাষাণের মতো তিনমাস দূরে থাকলি কি করে বলতো? আমার যে তোকে ছাড়া চলে না জেনেও এতগুলো দিন…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আফিফা বলে, তোর আমাকে দরকার জানি বলেই তো ছুটে এলাম আমার প্রাণ ভ্রমরাকে রেখে। নাইলে কি আর আমি এই কনক্রিটের শহরে ফিরি? যেথায় আমার মন শখা নেই হেথায় আমার কি কাজ বলো সখি?

-হয়েছে আর কবিতা বলতে হবে না।

চিত্রলেখার অভিমান টের পেটে আফিফা তার চিবুকে হাত ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলে, আচ্ছা বাবা আর রাগ-অভিমান নয়। তোর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আর কোথাও যাচ্ছি না আমি। বাবলুর বাবাকেও বলে দিয়েছি। এই কথা শুনে বাবলুর বাবা বলেছে জলদি যেন তোর বিয়েটা দিয়ে দেই এবারে।

-তুইও সবার মতো বিয়ে নিয়ে শুরু করলি? তুই তো অন্তত সবার মতো কথা বলিস না।

-কেনো বলবো না বলতো? তুই কি আজীবন একা থাকবি?

-থাকতে হলে থাকবো। আমি ছাড়া ওদের কে আছে তুইই বল?

-জানি কেউ নেই। কিন্তু এভাবে তো সারাজীবন যাবে না। একদিন ওরাও নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ওদের জীবনেও কেউ না কেউ আসবে। চারুকে নিশ্চয়ই তুই সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখবি না। তারপর ওরা যখন নিজ নিজ ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন তোর পাশে কে থাকবে?

এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে চিত্রলেখা বলে, খালা আছে, তুই আছিস, আমার বাবলু সোনা আছে। আমার আর কি চাই বল?

-এখন গায়ে জোর আছে তো সেজন্য বলতে পারছিস আর কাউকে লাগবে না। বছর পাঁচেক গেলেই বুঝবি জীবনে একান্তই নিজের ব্যক্তিগত একজন থাকাটা কতখানি জরুরী। অবশ্য আমি তোকে এই বোকামি করতেই দিবো না। বিয়ে তো তোকে করতেই হবে। আর আমি করিয়েই ছাড়বো। তুই তো আমায় চিনিস। কিরে চিনিস না?

চিত্রলেখা ভালো করেই জানে সে প্রসঙ্গ পরিবর্তন না করলে আফিফা আজ তার মাথাটাই খেয়ে ফেলবে। তিনমাস পর তাদের দেখা হয়েছে। তিনমাসের যত কথা জমেছে আফিফা আজ একদিনেই সব শেষ করে ফেলতে চাইবে। আর সেসব কথার নব্বই ভাগ হবে বিয়ে নামক ঘ্যানঘ্যানানি। তাই আপাতত এসব কথার হাত থেকে বাঁচতে চিত্রলেখা বলে, আপাতত বিয়েটা থাক তুই আমার কথা শুন। একটা ভীষণ জরুরী কথা আছে।

চিত্রলেখার চোখ-মুখে সিরিয়াস ভাব দেখতে পেয়ে আগ্রহ ভরে আফিফা জানতে চায়, ঘটনা কি বলতো?

চায়ের মগটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখা বান্ধবীর একটা হাত ধরে। তা দেখে তাকে তাড়া দিয়ে আফিফা বলে, ওরে জলদি বল না কি কথা।

-তুই কি শান্ত ভাইকে বলবি আমার জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্থা করতে।

-কেন! আগের চাকরীটার কি হয়েছে? ছেড়ে দিয়েছিস? কিন্তু তুই তো চাকরী ছাড়ার মানুষ না। তাহলে কি ওরা তোকে বের করে দিয়েছে? বের করে দিলো কেন? কোনো ঝামেলা হয়েছে?

আফিফার প্রশ্নবাণ বন্ধ হওয়ার নামই নেয় না। তাই তার হাত ছেড়ে মুখ চেপে ধরে চিত্রলেখা বলে, ওরে থাম তুই। আমাকে বলতে দিলে তো বলবো। ওরা আমাকে বের করে দেয়নি। আর আমি নিজেও এখনো চাকরীটা ছাড়িনি তবে ছেড়ে দিবো।

-কিন্তু কেনো?

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে চিত্রলেখা। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তাগাদা দিয়ে আফিফা বলে, কিরে বল চাকরী ছাড়বি কেনো?

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে, তুই তো ছিলি না। তোর পেছনে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

-কী হয়েছে চিত্র? আমার সাথে হেয়ালি না করে খুলে বল তো ঘটনা কি। কী হয়েছে?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা বলে, আমার বস আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

আচমকা এমন কথা শুনে একটুর জন্য হাত থেকে চায়ের মগটা পড়ে যায়নি৷ বিস্ময়ে চোখ বড় ও মুখ হয়ে যায় আফিফার। হাত বাড়িয়ে বান্ধবীর হা হওয়া মুখ বন্ধ করে দিয়ে চিত্রলেখা বলে, এমন হা করে থাকিস না প্লিজ। আমার ভীষণ লজ্জা করছে।

-হা করব না? এত বড় একটা ঘটনা আর তুই বলছিস আমি হা করব না? এসব কখন হলো? কীভাবে হলো? তোরা দুইজন…

-১ মিনিট আমরা দুইজন বলতে কিছু নেই। আমার পক্ষ থেকে কিছু নেই আর হবার সম্ভাবনাও নেই তা তুই ভালো করেই জানিস। যদি সম্ভবই হতো তাহলে কি মামুন ভাইয়ের কথা একবারও ভেবে দেখতাম না আমি?

আফিফা মাথায় হাত দিয়ে বলে,

-এই যা! এত কথার মধ্যে তোর মজনুটার কথা তো জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। আছে কেমন লোকটা? আজকাল কি করছে?

-আর কি করবে? তার তো একটাই কাজ মায়ার পথ চেয়ে বসে থাকা। তবে আজকাল বিয়ের জন্য ভীষণ বিরক্ত করছে। পারলে প্রতি শুক্রবারই তার বাবা-মাকে পাঠায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। আমি রাজি হচ্ছি না বলে কিছু করতে পারছেন না। মামুন ভাই তো আছেনই, আজকাল বাসার সবাইও উনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জানি না আমার পেছনে সবাই মিলে কোনো বুদ্ধি এটেছে কিনা। নাহলে দল বেঁধে কেন বিয়ে বিয়ে করছে আল্লাহ জানেন।

-বিয়ে বিয়ে করছে কারণ তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। এই সময়ে তোর বিয়েটা হয়ে যাওয়া দরকার। চাচা-চাচী বেঁচে থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই তুই ঘরে বসে থাকতি না।

-সেসব বলে কি কোনো লাভ আছে? আমি নিজের কথা ভাবলে ওদের কথা কে ভাববে? আমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ওরা তো অথৈ সাগরে ভেসে যাবে। ওদের পায়ের তলার মাটি শক্ত না করে আমি নিজের কথা ভাবি কীভাবে তুইই বল?

-কিন্তু তোর কি মনে হয় না এসব করতে করতে, ওদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। পরে আর তুই নিজের জন্য কিছু করতে পারবি না। সেই সুযোগটা আর তোর হাতে থাকবে না। সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। ওদের জীবন গুছাতে গুছাতে তোর জীবন গুছানোর সুযোগটা যে হাত ছাড়া হয়ে যাবে সেই খবর আছে?

-আমি সবই জানি আফি, সবই বুঝি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি নিজের কথা ভাবলে পরবর্তীতে বাবা-মাকে মুখ দেখাবো কীভাবে বলতো? আমি ছাড়া তো ওদের আগে পড়ে কেউ নেই মাথায় হাত রাখার মতো।

-এত যুক্তি দিয়ে জীবন চলে না চিত্র।

-তোদের মতো শুধু আবেগ দিয়ে ভাবলেও জীবন চলে না, চলবে না। বাস্তবতাকে আমরা চাইলেও উপেক্ষা করতে পারি না। সে ক্ষমতা আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের নেই।

-ঠিক আছে আপাতত এত কথা থাক। তোর বস হঠাৎ তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো কেনো সেটা বল।

-জানি না।

-জানি না মানে?

-আমি আসলেই কিছু জানি না। আচমকা সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করলেন আমি উনাকে বিয়ে করব কিনা। আমি ধরেই নিয়েছিলাম কথাটা উনি মজার ছলে বলেছেন। কিন্তু না, আজ আবার বললেন উনি আমায় বিয়ে করতে চায়। আমাকে চিন্তা ভাবনা করতে সময়ও দিলেন। কিন্তু জবাবটা হ্যাঁ তেই চাই উনার।

-মানে!

-মানে আমার না বলার কোনো সুযোগ নেই।

-উনি কি তোকে ভালো টালোবাসেন নাকি?

-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এতদিন ধরে এই কোম্পানিতে আছি। কোনোদিন উনি আমাকে দেখেননি। আজ কয়েকমাস ধরে উনার অফিসে উনার আন্ডারে আছি। এতটুকু সময়ে ভালোবাসা হয়ে যাবে? তাও আবার আমার মতো ইমপ্লইয়ের সাথে যার না আছে রূপ না অর্থবিত্ত না বিশেষ কোনো বংশ পরিচয়। আমার মতো জুতার তলা ছিঁড়ে যাওয়া একটা মেয়েকে ভালোবাসেন উনি? এসব হয় গল্প উপন্যাসে আর রূপকথা। অবশ্য সিনেমাতেও হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে হয় না। বাস্তব জীবনে আমার সীমাবদ্ধ এতটুকুই আমি উনার একজন ইমপ্লইয়। এর বেশি কেউ না, বিশেষ কিচ্ছু না।

-তুই যদি বিশেষ না হয়ে থাকিস তাহলে কেন উনি তোকে বিয়ে করতে চাইবেন? তাও এত ডেস্পারেটলি? জানার চেষ্টা করেছিস?

-যেটা কোনোভাবেই সম্ভব না সেসব জেনে কি লাভ বল তো?

-শুন চিত্র ভালোবাসা মানুষের জীবনে বলে কয়ে আসে না। জাস্ট হয়ে যায়। দাওয়াত করে ভালোবাসাকে নিমন্ত্রণ দিয়ে আনতে হয় না। কখন আমরা কাকে ভালোবেসে ফেলবো তা আমরা নিজেরাও বলতে পারি না। হঠাৎ করেই ভালোবাসাটা আমাদের জীবনে চলে আসে। হতেই পারে উনার তোকে পছন্দ হয়েছে, ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই বিয়ে করতে চান।

-এসব মানুষ শুনলে ভাববে তুই আমি মিলে কোনো বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখছি৷

-তুই একটু সহজ করে ভেবে দেখছিস না কেনো বল তো?

-যার জীবনটা কোনোদিক দিয়ে সামান্য সহজ নয় সে কীভাবে সহজ করে ভাববে বল তো? আমার কি সহজ করে ভাবার উপায় আছে?

-নেই বলছিস?

-না নেই। এসব আমি ভাবতেও চাই না। সব বাদ দিলাম আমাদের সামাজিক অবস্থার দিকে তাকা তুই একবার। আদৌ কি এটা সম্ভব? উনি জামান গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। শতশত কোটি টাকার কারবার। উনার পাশে কি নাম পরিচয়হীন পথের ভিক্ষারি ধরনের আমাকে মানায়? সহজ ও এককথার উত্তর মানায় না। কোনো ভাবেই মানায় না। যার জীবনটা আপাদমস্তক টাকাপয়সা, অর্থবিত্ত আর ঐশ্বর্যে মোড়ানো তার সাথে কখনোই আমার মতো চালাচুলাহীন একটা মেয়ে সংসার বাঁধার, জীবন বাঁধার, ভালোবাসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

চিত্রলেখা থামার সঙ্গে সঙ্গেই আফিফা কিছু বলে না। এক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলে,

-আচ্ছা তোর বসকে না হয় বাদ দিলাম। মামুন ভাই। উনার কথাও কি ভেবে দেখা যায় না? মামুন ভাই তো তোর বসের মতো অর্থ সম্পদে মোড়ানো না। তোরা তো একই সমাজের অংশ। এদিক থেকে তোদের সমাজিক দিকটাও ভিন্ন নয়।

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে চিত্রলেখা। হেসে নিয়ে বলে,

-আমি জানি মামুন ভাই আমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে। কিন্তু কি জানিস ভালোবাসা জিনিসটাই হয়ত আমার জন্য না।

-মামুনে কি সমস্যা?

-মামুন ভাইয়ের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই, তার ভালোবাসায়ও কোনো দোষ নেই। দোষ সব আমার কপালের। এমন কপাল নিয়ে এসেছি যে কপালে ভালোবাসা নামক কিছু নেই। এতে অবশ্য আমর আফসোস নেই।

-হেয়ালি করিস না চিত্র। তুই একটু মামুনের কথা ভেবে দেখ। আমার মনে হয় না তুই মন্দ থাকবি।

-আমিও জানি মামুন ভাইকে বিয়ে করলে মন্দ থাকবো না। কিন্তু আমার ভালো মন্দ নিয়ে তো আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার ভাই বোনগুলোর ভালো থাকাই সবচাইতে জরুরী।

-সেটা তো বিয়ের পরেও করতে পারবি।

-কীভাবে? মামুন ভাই তো নিজের জন্যই কিছু করেন না। তোর কি ধারণা আমাকে বিয়ে করে উনি পরিবর্তন হয়ে যাবেন? চাকরী-বাকরী বা ব্যবসায় মন দিবেন? যে আমাকে পাবার আশায় নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনে না সে বিয়ের পর পরিবর্তন হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? মামুন ভাইকে বিয়ে করে আমাকে উনার বাবার সংসারে থাকতে হবে। সেখানে কি আমার ভাইবোনেরা জায়গা পাবে? তাছাড়া আরও বড় একটা সমস্যা হচ্ছে মামুন ভাইয়ের বাবা মা ছেলের বউদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করাটাকে সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন না। এত বাঁধা যেখানে সেখানে আমি নিজের কথা কীভাবে ভাবি তুই বল?

-তুই এত নেগেটিভ কেনো ভাবছিস?

-দুনিয়াটা নেগেটিভিটি দিয়ে ভরা আফি তাই ভাবছি।

-তবুও তুই অন্তত একবার…

আফিফাকে থামিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আর না আফি প্লিজ। এসব বিয়ে নামক যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতেই তোর কাছে ছুটে এসেছি। এখানেও যদি আমি শান্তি না পাই তাহলে কোথায় যাবো বল। আর কি কোনো জায়গা আছে আমার?

আফিফা আর কিছু বলতে পারে না। থেমে যায়। চিত্রলেখার এসব মায়া ভরা কথা তাকে সবসময় আটকে যায়। চিত্রলেখা নিজেই আরও বলে,

-এসব বাদ দিয়ে আমি যা বললাম তা কর প্লিজ। তুই আজই শান্ত ভাইকে বলবি উনি যেন আমার জন্য একটা মোটামুটি ভালো চাকরীর ব্যবস্থা করে দেন। যদি শহর বদল করতে হয় তাহলেও চলবে আমার।

-কেন? পালাতে চাইছিস? কার থেকে? তোর বসের হাত থেকে?

চুপ করে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারে না। এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলে,

-যদি পালাতে হয় তাহলে তাই সই। আমি পালিয়ে যাবো। তবুও এসব ঝামেলা আমার চাই না।

আফিফা আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। জোরাজুরিতে কাজ হবে না তা সে ভালো করেই জানে।

চিত্রলেখা আফিফার বাসা থেকে বের হয় ঠিক ৮ টার সময়। যদিও আফিফা ভীষণ করে বলছিল যেন অন্তত আজকের রাতটা থেকে যায়। কিন্তু চিত্রলেখা থাকেনি। পরেরদিন অফিস আছে তার। অন্য একটা চাকরীর জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত এই চাকরীটা সে ছাড়তে পারবে না। বেরিয়ে আসার সময় চিত্রলেখার হাত ধরে আফিফা বলেছিল, ওত চিন্তা করিস না। আমি এখনো আছি। তোরা নাহয় আমার বাসায় উঠলি। পরে আস্তেধীরে কোনো একটা ব্যবস্থা করা যাবে। বান্ধবীর থেকে এতটুকু ভরসা পেয়ে খুশি হলেও চিত্রলেখা কখনোই এমনটা করবে না। অন্যের উপর বোঝা হতে চায় না সে। এমনিতেও আফিফা আর খুব বেশিদিন ঢাকায় থাকবে না। আফিফার হাসবেন্ড শান্ত চাকরী সুবাদে চট্টগ্রাম থাকে। এতদিন কোয়াটার পায়নি বলে মা, স্ত্রী ও সন্তানকে ঢাকাতেই রেখেছে। কিন্তু এই মাসেই খবর পেয়েছে আগামী মাসেই কোয়াটার পেয়ে যাবে। খুব বেশি হলে আর মাস দুই কি তিন ঢাকায় থাকবে আফিফা তারপর চলে যাবে চট্টগ্রাম শান্তর কাছে। এমন একটা সময়ে বান্ধবীকে কোনো ধরনের চিন্তায় ফেলতে চায় না চিত্রলেখা।

কীভাবে কি করবে আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতেই তিনতলার সিড়ি বেয়ে নিচে নামে চিত্রলেখা। বিল্ডিংয়ের কেচি গেইট দিয়ে বেরিয়েই থম ধরে ধারায় সে। তাকে বের হতে দেখে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রওনক সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সময় বিলম্ব না করে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় সে চিত্রলেখার। শান্ত দৃষ্টি নিয়ে চোখ ভরে দেখে রওনক চিত্রলখাকে। চোখ-মুখ জুড়ে তার ব্যাকুলতার ছাপ। টাইটা নিচের দিকে টেনে রেখেছে। কোর্টটা হয়ত খুলে রেখেছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করে তুলে রাখা। আজ পর্যন্ত এভাবে কখনো দেখা হয়নি রওনককে। কোথায় গিয়ে যেন এই দর্শনটা বিধলো, একটা ধাক্কার মতো লাগলো। চিত্রলেখার ইচ্ছা করছে শরীরটা ছেড়ে দিতে। হঠাৎই যেন শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। কিন্তু পারলো না, শক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মতো। বেচারি এতটাই অবাক হয়েছে যে কি বলবে বুঝতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, আপনি কীভাবে জানলেন আমি এখানে আছি?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে, তুমি চাইলেও আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে না। যদি না আমি তোমাকে পালাতে দেই। ইউ হেভ টু ফেইস মি।

চিত্রলেখা চুপ করে থাকে। রওনক আরও বলে, বিয়ের প্রপোজাল দেয়াটা কি খুব বেশি অনৈতিক কাজ হয়ে গেছে? আমি কি কোনো অন্যায় করে ফেলেছি যে তুমি এভাবে পালাতে চাইছো?

তবুও চুপ করে থাকে চিত্রলেখা। এবারে রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার হাত ধরে বলে, কাম উইথ মি।

-কোথায় যাচ্ছি আমরা?

রওনক চিত্রলেখাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে সিট বেল্ট আটকে দিতে দিতে বলে, গেলেই দেখতে পারবে কোথায় যাচ্ছি। ডন্ট ওয়ারি আই উইল নট কিল ইউ। আই ডেয়ার নট টু।

চিত্রলেখা কিছু বলতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে। রওনক গাড়িতে উঠে আর একটি কথাও বলেনি। তারা কোথায় যাচ্ছে তা চিত্রলেখা জানে না।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

তুরাগ নদীর পাড়ে গাড়ির বোনাট ঘেষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তারা। গাড়িতে উঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি রওনক চিত্রলেখার সাথে। এমনকি তার মুখের দিকেও তাকায়নি। রওনক হয়ত কিছু বলবে সেই আশায় বারবার পাশ ফিরে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করেছে চিত্রলেখা কিন্তু অপেক্ষার ফলাফল শূন্য। রওনক কিছুই বলছে না। আর এদিকে সময় ফুরিয়ে রাত গভীর হয়ে আসছে। নদীর পাড় হওয়ায় কোনো মানুষজন নেই। জনশূন্যতার কারণে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে মধ্যরাত নেমে এসেছে। এমনিতেই শীতের সময়। নদীর পাড় হওয়ায় ঠান্ডা বেশি লাগছে। এতদিন শৈত্যপ্রবাহ ছিল না। মনে হচ্ছে এর মধ্যেই শুর হয়ে যাবে। আজ সকালে যখন চিত্রলেখা বাড়ি থেকে বের হয় তখনও এতটা ঠান্ডা অনুভব করেনি যতটা এখন লাগছে। পাতলা মতন একটা শাল নিয়ে বেরিয়েছিল। তা গায়ে জড়িয়ে রেখেও লাভ হচ্ছে না।

বোনাট ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রওনক। ড্রাইভিং সিটের দিকে অগ্রসর হলে পেছন থেকে চিত্রলেখা ইতস্তত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমরা কি বাসায় যাচ্ছি?

থেমে গিয়ে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে রওনক বলে, এখানেই দাঁড়াও আমি আসছি।

মনে মনে বাড়ি ফেরার তাগাদা অনুভব করে সে। কিন্তু মুখ ফুটে রওনককে কিছু বলার সাহস হচ্ছে ন। কেনো সাহস হচ্ছে না তাও বুঝতে পারছে না। মুখ খুলতে, একটা কথা বলতেই ভয় লাগছে বেচারীর। মনে হচ্ছে কিছু বললেই হয় কঠিন এক ধমক খাবে না ঠাস করে গালে নামবে চড়। কিন্তু ধমক খাওয়া বা চড় খাবার মতো কিছুই সে করেনি। তবুও কেনো এমন মনে হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না। অকারণে একটা লোককে এত কেনো ভয় লাগছে বুঝতে পারছে না চিত্রলেখা। এমনও নয় সে না জানিয়ে অফিস কামাই দিয়েছে। লাবিবকে জানিয়েই এসেছে। লিভ এপ্লিকেশনও জমা দিয়ে এসেছিল। এরপর ভয় পাবার কারণ থাকে না। এমনও নয় মিথ্যা বলে অফিস কামাই দিয়ে বসের হাতে ধরে পড়েছে। সামনের দিকে নদীর পানি দেখতে দেখতে এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ব্যস্ত চিত্রলেখার ধ্যান ভাঙ্গে রওনকের উপস্থিতিতে। তবে সে কিছু টের পাবার আগেই রওনক এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের কোটটা পরিয়ে দিতে নিলে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে, এর প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি।

চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে রওনক বলে, ঠান্ডায় কাঁপছো আর বলছো প্রয়োজন নেই? এমন শীতের সময় কেউ এসব পালতা কাপড় গায়ে জড়িয়ে বের হয়?

লজ্জা মাথা নুইয়ে ফেলে চিত্রলেখা। আমতা আমতা করে মিনমিনে সুরে বলে, সকালে এত ঠান্ডা ছিল না।

-আবহাওয়া কি ঠান্ডা হবার আগে তোমার পারমিশন নিয়ে শীত নামাবে? এই সময় যখন তখন ঠান্ডা বাড়তে পারে এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার সঙ্গে ঠান্ডা কাপড় রাখতে হবে।

চিত্রলেখা আর কথাই বলতে পারে না। বেচারী লজ্জায় লজ্জাবতি গাছের মতো জড়িয়ে আসছে। গাছ হলে সত্যি সত্যি নিজেকে জড়িয়ে ফেলত এতক্ষণে। মানুষ বলেই পারছে না।

আবারও বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর চিত্রলেখা বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করে, আমার বাসায় যেতে হবে।

গাড়ির বোনাটের সঙ্গে হেলান দিয়েই পাশ ফিরে তাকায় রওনক। বলে, We need to talk চন্দ্রলেখা।

চিত্রলেখা নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আচমকা রওনকের মুখে নিজের নামের ভুল শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি চিত্রলেখা।

-ওকে ফাইন চিত্রলেখা। তুমি জানো আমি তোমার জবাবের অপেক্ষা করছি। ইউ হ্যাভ টু এন্সার মি।

রওনকের চোখের দিকে তাকিয়েই চিত্রলেখা বলে, যার নামটাও ঠিকঠাক জানেন না তাকে বিয়ে করতে চাইছেন?

একবার ডানে নদীর দিকে তাকিয়ে আবার চিত্রলেখার দিকে তাকায় রওনক। নিজের জায়গা থেকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কপালের উপর এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেয়। রওনকের আঙ্গুল কপাল স্পর্শ করতেই যেনো সামান্য কেঁপে উঠলো চিত্রলেখা। কাছাকাছি দাঁড়িয়েই রওনক বলল, যাকে বিয়ে করছি তাকে কি নিজের পছন্দে একটা নাম দিতে পারি না?

চিত্রলেখা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে রওনকের ঐ গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। কি জবাব দিবে বুঝতে পারে না। রওনক নিজেই বলে, এত লুকোচুরি কেনো? কি প্রয়োজন? আমি কি মানুষ হিসেবে খুব বেশি খারাপ? বিয়ে করা যায় না আমায়?

-কথিত কথা আছে। চাদরের আকার দেখে পা ফেলা উচিত। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার দুঃসাহস করতে নেই। তাহলে আমি কীভাবে আমার চাদরের বাইরে পা ফেলি? বামন হয়ে চাঁদ স্পর্শ করার দুঃসাহস কীভাবে করি?

-চাঁদ যদি নিজে থেকে তোমার হাতের মুঠোয় আসতে চায় তাহলে তুমি কেনো চাঁদকে ছুঁয়ে দেখবে না?

-কারণ আমার সেই সাহস নেই। আপনার জন্য আমি কেবল চিত্রলেখা, আপনার অফিসের একজন সামান্য কর্মচারী। আমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না আপনি। তাই যা ইচ্ছা হচ্ছে বলছেন। বিয়ে নামক জোক করতে পারছেন।

-ওয়েট এ মিনিট! তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার সঙ্গে জোক করছিস? I am making fun?

চিত্রলেখা জবাব দিতে হিমশিম খায়। যত যাই হোক এখনো সে রওনকের অফিসে কর্মরত আছে। বেলাইনে কথা বললে চাকরী মুহূর্তেই খোয়া যাবে। যদিও সে নিজেই চাকরী ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিন্তু আগে অন্য একটা চাকরী জোগাড় করতে হবে। নাহলে তো সবাইকে নিয়ে না খেয়ে দিন যাপন করা লাগবে। চিত্রলেখা চুপ করে থাকায় রওনক নিজেই বলে,

-তোমার কি ধারণা তেমার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি?

-জানেন তো আমার নাম চিত্রলেখা। আমার লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন যা খুব হাই ক্লাস কিছু নয়। আমি তিন বছর ধরে আপনার কোম্পানিতে চাকরী করছি।

চিত্রলেখার কথা শুনে হেসে ফেলে রওনক। হেসে ফেলে বলে, সরি হাসি আটকে রাখতে পারলাম না। এই কথা বলার পর যেন রওনকের হাসি আরও বেড়ে যায়। চিত্রলেখার কি হলো কে জানে রওনকের হাসি ভরা ঐ মুখে তার দৃষ্টি আটকে গেলে। হাসলে দাঁড়ি গোফে ভরাট চেহারাটা খিলখিলিয়ে ওঠে। এর আগে কখনো তাকে এভাবে হাসতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না চিত্রলেখার। এত মধু দৃশ্য! হেসে নিয়ে রওনক বলে,

-এভাবে হেসে ফেলার জন্য দুঃখিত। এখন সিরিয়াস কথা বলি। চিত্রলেখার সম্পূর্ণ জীবনটা তার ভাইবোনদের জন্য। চিত্রলেখার বাবা-মা যখন মারা যায় তখন সে মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা-মার পরে চিত্রলেখাই ভাইবোনদের মাথার উপরে ছায়া, মায়া। খালার কাছে বড় হয়েছে। যদিও খালার সংসারেও খুব একটা ভালো নেই সে। কিন্তু চিত্রলেখা কম্প্রোমাইজ করতে জানে। লিখন সামনে গ্রাজুয়েশন শেষ করলে তাকে হায়ার এডুকেশনের জন্য বাইরে পাঠাবে। ছোট দুইজন চারু ও চয়ন তো বিশাল ব্রিলিয়ান্ট। দু’জন মেডিকেলে পড়তে চায়। কিন্তু চিত্রলেখার রাতে ঘুম হয় না এই চিন্তায় একজনকে মেডিকেল পড়ানোর সামর্থ্য তার নেই। সেখানে দু’জনের স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হবে? তারপর খালা, উনার কোনো সন্তান নেই। বোনের চার সন্তানকে নিজের কাছে রাখার জন্য সামান্য যেটুকু পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল তাও স্বামীকে লিখে দিয়েছেন অনেক আগেই। কিন্তু আজকাল খালার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। এরপর আছে মামুন সাহেব। যে চিত্রলেখাকে ভালোবাসে। নিজের মায়ায় বাঁধতে চায়। কিন্তু চিত্রলেখা; সে কি চায়? আরও কিছু বলবো? তুমি চাইলে বলতে পারি।

রওনকের মুখে নিজের পরিবারের অতীত ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয় চিত্রলেখা। অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চিত্রলেখা তোতলে বলে, আপনি এসব কীভাবে জানলেন?

-ভুলে যাচ্ছো আমি রওনক জামান। জামান গ্রুপের মালিক। এত বড় একটা ব্যবসা তো ছুমন্তর বলে চালাচ্ছি না। আমার জীবনে থাকা ইচ এন্ড এভরিওয়ানের ডিটেইলস আছে আমার কাছে। এটা ভিন্ন কথা সবার ডিটেইলস পার্সোনাল ফাইল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। চোখ বুলানো হয় না। কিন্তু তুমি স্পেশাল।

-আমি কেনো?

-তুমি কারণ তুমি, তুমি।

আবেগে ভাসতে চায় না চিত্রলেখা তাই বাস্তবতা পয়েন্ট আউট করে বলে, অলরেডি অফিসে নানারকম গুঞ্জন আছে। এমন কিছু ঘটলে কি হবে ভাবতে পারছেন?

-আমাকে কেনো ভাবতে হবে? ওরা আমার কোম্পানিতে চাকরী করে। বরং আমার ওয়াইফকে নিয়ে কিছু বলার আগে ওদের ভাবতে হবে। আর বলুক না মানুষের বলায় কি আসে যায়?

-আপনার আসে যায় না কিন্তু আমার যায়। হারানোর মতো আমার কিচ্ছু নেই নিজের আত্মসম্মান ছাড়া।

-ট্রাস্ট মি কেউ তোমার আত্মসম্মানে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারবে না। আই উইল প্রোটেক্ট ইউ।

-তবুও আপনি যেটা চাইছেন সেটা হয় না।

-তুমি হ্যাঁ বললেই হয়।

-আপনার জন্য আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া যতটা সহজ। বিয়ের করার চিন্তা করা যতটা সহজ। আমার জন্য এসব চিন্তা করাটাও ভীষণ কঠিন। আপনি বুঝবেন না। প্লিজ আমাকে এসবে টানবেন না দয়া করে। আমায় মাফ করুন।

রওনক আরও এক কদম চিত্রলেখার কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলে, আই এম সরি আর পেছাতে পারবো না।

চিত্রলেখা একদম বুঝতে পারে না রওনক কেনো এমন করছে। না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, আপনার অনেক বেটার অপশন আছে। আমি আপনার কোনো অপশনের মধ্যেই পরি না।

এবারে রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার বাহু ধরে বলে, ইউ আর মাই ওনলি অপশন। চিত্রলেখার গলা দিয়ে কথা বের হয় না। এমন জবাব আশা করেনি সে। রওনক বলে চলল নিজের মতো, একটু আগে তোমায় চন্দ্রলেখা বলে ডেকেছিলাম?

চিত্রলেখা মাথা ঝাকায়। তা দেখে রওনক বলে, ভুলে গিয়েছি বলে বা ভুল করে ডাকিনি। ইচ্ছা করেই ডেকেছি। তোমাকে আমার ঐ চাঁদের মতোই প্রয়োজন। এই অন্ধকার পৃথিবীর যেমন চাঁদকে প্রয়োজন নিজেকে আলোকিত করতে আমার তেমনি তোমাকে চাই। আই রিয়েলি নিড ইউ।

-আমাকে আপনার প্রয়োজন?

-ভীষণ।

রওনক তানিয়ার বিষয়টা বিস্তারিত খুলে বলে। মীম ও মিশকাতকে নিজের কাছে রাখার জন্য তাকে বিয়ে করতেই হবে। সব শুনে চিত্রলেখা বলে, আপনি তো অন্য যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন।

-তুমি যা পারবে অন্যরা সেটা পারবে না।

-কী পারবো আমি?

-যে বাবা-মা মারা যাবার পর নিজের ভাইবোনদের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছে আগলে রেখেছে সে আমার বাচ্চাদেরও নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করতে পারবে। আমার চেনা পরিচিত অন্যকেউ সেটা পারবে না।

চিত্রলেখার মস্তিষ্কের ভেতর মাছি ভন ভন করার মতো শব্দ হচ্ছে। বুঝতে পারছে না কি বলবে। রওনক নিজেই আরও বলে, আই নো উই ডোন্ট হ্যাভ এনি মিউচুয়াল ফিলিংস ফর ইচআদার অন্তত আমরা একে অপরের দায়িত্বগুলো তো ভাগাভাগি করতে পারি। তোমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে আমি তোমায় হেল্প করলাম বিনিময়ে তুমি আমার বাচ্চাগুলোকে মানুষ করতে আমায় সঙ্গ দিলে। আমি তোমার দায়িত্বের ভাগ নিবো আর তুমি আমার।

-বিনিময়ে আপনি আমায় টাকাও দিবেন?

-বউয়ের কি কোনো ফিক্সড সেলারি হয়? আমাদের বিয়ের পর যা আমার তা তোমারও। আমি কখনো জানতে চাইবো না কোথায় কীভাবে কত টাকা খরচ করেছো। লিখনের বিদেশ যাওয়া, চারু, চয়নের মেডিকেল পড়া। সবার সব স্বপ্ন পূরণ করতে আমি তোমার পাশে থাকবে। তুমি শুধু আমায় বিয়ে করে উদ্ধার করো।

চিত্রলেখা চুপ করে থাকে। রওনক আরও বলে, আমি আমার জীবনে কখনো কাউকে রিকুয়েষ্ট করিনি। আজ তোমাকে বলছি রিকুয়েষ্ট করছি প্লিজ হেল্প মি আউট।

-আমার একটু সময় লাগবে। আমাকে একটু ভাবতে দিন প্লিজ।

-ঠিক আছে ভাবো। তবে খুব বেশি সময় নিও না প্লিজ। আর পালানোর অযথা চেষ্টা করো না। আমি পারমিশন না দিলে তুমি পালাতে পারবে না। যদি পাতালেও চলে যাও তোমার পেছন পেছন গিয়ে উপস্থিত হবো। তোমাকে আমার লাগবেই। জানি আমাকে সেলফিশের মতো শুনচ্ছে বাট আই হ্যাভ নো আদার চয়েজ।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রওনক আরও বলে, চলো তোমার বাসায় নামিয়ে দেই।

চিত্রলেখা কথা বাড়ায় না। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে। তার মস্তিষ্কের ভেতর সব জগাখিচুরি হয়ে গেছে রওনকের কথা শুনে। এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারছে না সে।

রওনকের গাড়িটা যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। চিত্রলেখা বাড়তি কোনো কথা না বলে চুপচাপ নেমে যায়। রওনক পেছন থেকে ডাকে, চন্দ্রকথা।

রওনকের ডাকে থমকে না দাঁড়িয়ে পারে না চিত্রলেখা। পেছন ফিরে তাকালে রওনক নেমে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, মনে রেখো আই ব্যাডলি নিড ইউ। আর খুব বেশি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব ঠিক করে দিবো ট্রাস্ট মি।

আবারও চিত্রলেখার কপালের উপরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে বলে, নিজের খেয়াল রেখো।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন ও মামুন দু’জনেই লিখনদের বাড়ির গেইটের তাকিয়ে আছে। গলির মোড় দিয়েই এগিয়ে আসছিল দু’জনে। চিত্রলেখার জন্য মেইনরোড পর্যন্ত গিয়েছিল। যাওয়ার সময়ই মামুনের সঙ্গে দেখা হয় লিখনের। একসাথে দু’জন বেশি কিছুক্ষণ মেইনরোডের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছে। তারপর একসাথেই বাড়ির দিকে ফিরে আসছিল। মোড় পর্যন্ত আসতেই থমকে দাঁড়ায় দু’জনে বাড়ির গেইটের সামনে থাকা রওনকের বিএমডব্লিউ গাড়িটা দেখে। চিত্রলেখার গাড়ি থেকে নামা, তার পেছন পেছন রওনকের এগিয়ে আসা সবই দেখেছে তারা দূরে দাঁড়িয়ে। কেবল বুঝতে পারেনি কি কথা হচ্ছিল তাদের মাঝে। ওতখানি দূর থেকে কথা শুনা যায়নি। রওনকের চিত্রলেখাকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না হলেও তার কপালের চুল কানের পিছনে গুজে দেয়াটা স্বাভাবিক দৃশ্য নয়। পাশে মামুন থাকায় লিখনের নিজেরই ইতস্তত লেগেছে। বলার মতো কিছু খুঁজে পায়নি। তাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর লিখন বলেছে, অনেক রাত হয়ে গেছে মামুন ভাই। আপাও চলে আসছে, বাড়ি যাই।

-যাও।

-আপনিও বাড়ি যান। আপা তো চলেই আসছে আর চিন্তার কারণ নাই।

-হু।

লিখন আর কথা বাড়ায়নি। মামুন এমনিও কথা বলেনি। তাকে ওখানে রেখেই লিখন বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে।

চিত্রলেখা বাড়িতে ঢুকতেই দেখে ড্রইং রুমে চিন্তিত মুখ করে বসে আছেন নারগিস বেগম। উনার সঙ্গেই বসে আছে চারু ও চয়ন। চিত্রলেখাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, এতক্ষণ কই ছিলি তুই? কয়টা বাজে সেই খেয়াল আছে? ফোন বন্ধ করে রাখছিস কেন?

চিত্রলেখার খেয়ালই ছিল না দিনেরবেলায় ফোনটা বন্ধ করেছিল আর খোলা হয়নি। বাসায়ও কাউকে জানানো হয়নি সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আফিফার বাসায় ছিল সারাদিন। হঠাৎ আফিফার বিল্ডিংয়ের নিচে রওনককে দেখার পর সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল তার। আর খেয়ালই ছিল না বাসায় জানানোর কথা। বাসায় ফেরার জলদি ঠিকই ছিল কিন্তু বন্ধ ফোনটা অন করে যে একটু জানিয়ে দিবে সেই কথাটা খেয়ালে আসেনি। আসবে কীভাবে? লোকটা যেভাবে কথার খৈ ফুটিয়েছিল ওসব শুনার পর থেকে তো চিত্রলেখার মস্তিষ্কের ভেতর মাছি ভনভন করছে। বাসায় জানানোর কথা মনে আসবে কি করে!

চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে নারগিস বেগম তার হাত ধরে মৃদু ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেন, কিরে কথা বলছিস না কেন? কই ছিলি তুই?

চিত্রলেখা একবার খালার পাশে কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চারু ও চয়নের মুখের দিকে তাকার। পুনরায় খালার দিকে তাকিয়ে বলে, অফিসের জরুরী কাজে আটকে গিয়েছিলাম খালা। ফোনে চার্জ ছিল না। তাই তোমাদের কিছু জানাতে পারি নাই।

-তোর অফিসে তো আরও ফোন আছে। অন্য কারো ফোন থেকেও তো একটা ফোন করতে পারতি।

মিথ্যা ব্যাপারটাই এমন। একটা মিথ্যা ঢাকার জন্য আরও চৌদ্দটা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। তবুও এই মুহূর্তে আসল ঘটনা খালাকে বলতে পারে না তাই মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই চিত্রলেখা বলে,

-আমি অফিসে ছিলাম না। অফিসের বাইরে একটা মিটিং ছিল। মিটিংটাই এত লম্বা হয়ে গেছে যে দেরি হয়ে গেল বাসায় ফিরতে। বসের সঙ্গে ছিলাম। উনাকে তো আর বলতে পারি না উনার ফোন দিতে বাসায় ফোন করব। তাই তোমাদের জানাতে পারি নাই।

পাশ থেকে চারু কিছু বলার চেষ্টা করলে ওকে বাঁধা দিয়ে নারগিস বেগম বলেন, তুই চুপ থাক আপাতত। অনেক কথা হইছে। ফ্রেশ হয়ে আয় ভাত খাবি।

-আমার খুদা নাই খালা তোমরা খেয়ে নাও।

-খুদা নাই মানে?

-আমি তো মিটিং এ ছিলাম। ওখান থেকে খেয়ে আসছি তাই খুদা নাই। গোসল দিয়ে ঘুমাবো।

নিজের ঘরের দিক পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। লিখনকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, লিখন কই খালা?

-ওরে তো আমিই বাইরে পাঠাইলাম। বললাম মেইন রোড পর্যন্ত গিয়ে দেখতে তুই আসতেছিস কিনা। তোরে আগায় আনতে গেলো।

-আমি কি ছোট বাচ্চা খালা যে আমাকে আনতে লিখনরে পাঠাইছো?

-বাচ্চা না জানি। এতরাত তো কোনোদিন করিস নাই তাই ভয় লাগতেছিল।

চিত্রলেখা চয়নের দিকে তাকিয়ে বলে, যা লিখনরে ডেকে নিয়ে আয়। নাইলে একটা ফোন করে বলে দে আমি চলে আসছি।

-ফোন করা লাগবে না আমি চলে আসছি।

বলতে বলতেই পেছন থেকে এগিয়ে আসে লিখন। চিত্রলেখা আর দাঁড়ায় না ভেতরে চলে যায়। নারগিস বেগম রান্নাঘরে চলে যান ওদের রাতের খাবার দিতে। চিত্রলেখা সময় মতো বাড়ি না ফিরায় চিন্তায় কারো খাওয়া হয়নি এখনো।

চিত্রলেখা ও নারগিস বেগম প্রস্থান করলে ওরা তিন ভাইবোন রয়ে যায়। এগিয়ে এসে লিখন জিজ্ঞেস করে, আপার দেরি হইছে কেন কিছু বলছে?

চয়ন বলে, অফিসের মিটিং ছিল সেজন্য নাকি দেরি হইছে।

-আপা কিছু একটা লুকাইতেছে।

লিখনের কথা শুনে চারু বলে, আমারও তাই মনে হয়।

লিখন আরও বলে, আপাকে উনার বস নামায় দিয়ে গেছে দেখলাম।

চয়ন বলে, ঠিকই তো আছে। আপা তো বললই অফিসের মিটিং ছিল বাইরে। রাত হয়ে গেছে দেখেই উনার বস নামায় দিয়ে গেল। এটা তো ভালোই হইছে এতরাত করে আপারে একা আসতে হয় নাই।

মাথা ঝাঁকিয়ে লিখন বলে, সেটা ঠিক আছে তবুও এখানে কোনো একটা কিন্তু আছে।

-দূরো ভাইয়া তুমি যে কি বলো না। কোনো কিন্তু ফিন্তু নাই।

চয়ন আর দাঁড়ায় না ওখানে। নিজের ঘরে চলে যায়। ও চলে যাওয়ায় চারু আরেকটু বড় ভাইয়ের কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে, আপা মিথ্যা কথা বলতেছে ভাইয়া।

অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে চারুর দিকে তাকায় লিখন। চারু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আফিফা আপার সঙ্গে কথা হইছে আমার একটু আগে। আপা সারাদিন উনার বাসায় ছিল আজকে। ৮ টার দিকে বাসায় আসবে বলে বের হইছে কিন্তু বাসায় আসে নাই। খালা চিন্তা করবে দেখে বলি নাই এতক্ষণ তোমারেই বললাম।

-না বলে ভালো করছিস। হয়ত আপা কিছু আড়াল করতে চাইতেছে আমাদের থেকে। সে না বলা পর্যন্ত তুই বলিস না কিছু, আমিও বলবো না। আপার নিজস্ব প্রাইভেসি আছে। ভালো মন্দ সে আমাদের থেকে ভালো জানে। তাই আগবাড়ায় কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। আমরা এমন ভাবে থাকবো যেনো আমি কিছু দেখি নাই আর তুই কিছু জানিস না।

-আচ্ছা ভাইয়া।

রওনকের কেবিনে তার মুখোমুখি অন্যপাশে বসে আছে একজন মহিলা। রওনক অফিসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই লাবিব জানিয়েছে তার সঙ্গে দেখা করতে একজন মহিলা এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। এই মুহূর্তে সেই মহিলাই রওনকের সামনে বসা। এখনো কথা হয়নি তাদের। তবে মহিলাকে দেখে চিনতে অসুবিধা হয়নি রওনকের বিন্দুমাত্রও। প্রথমে মহিলা নিজেই পরিচয় দেয়ার ভঙ্গি করে বলেন, আপনি হয়ত আমায় চিনেন না। আমার নাম শবনম আমি আপনার…

শবনমকে বাকি কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক নিজেই বলে, আপনি আমার ভাইয়ের এক্স-গার্লফ্রেন্ড জানি।

মৃদু হেসে শবনম বলে, বয়সে ছোট হবে তাই তুমি করেই বলছি কেমন। তুমি হয়ত জানো তোমার ভাইয়া আর আমি আবার একত্রে আছি।

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রওনক বলে, আমি আপনার দেবর নই যে আমায় তুমি করে বলবেন। অপরিচয় কারো থেকে আপনি শুনতেই প্রেফার করব আমি। আর আমার ভাই বিবাহিত, দুই বাচ্চার বাপ। সেই পুরুষের সঙ্গে পরকীয়া করছেন এটা নিশ্চয়ই গর্ব করে বলার মতো কোনো বিষয় নয়।

রওনকের কথা শুনে শবনমের সমস্ত শরীর যেনো মরিচ পোড়া লাগার মতো জ্বলে উঠলো। তবু শবনম কোনো রিয়্যাক্ট করে না৷ সে একটা বিশেষ কাজে এসেছে। অযথা রেগে গিয়ে কাজ নষ্ট করতে চায় না সে।

রওনক জিজ্ঞেস করে, তা আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন?

-তুমি সরি আপনি তো জানেনই আপনার বড় ভাই আমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে সেটেল্ড হওয়ার ডিসিশন নিয়েছে।

-তো!

-তার কাছে শুনলাম আমার জন্য আপনার কোনো অফার আছে।

রওনক মনে মনে হাসে। শবনম সম্পর্কে যা ভেবেছিল, যা ইনফরমেশন পেয়েছিল সব একদম মিলে যাচ্ছে। মহিলা ইনিয়েবিনেয় কথা না বলে সরাসরি কাজের কথায় চলে গেছে। এবারে রওনক বলে, অফার আছে না ছিল।

-মানে!

-মানে টা সহজ। আমি আমার ভাইকে একটা চেক অফার করেছিলাম আপনার জন্য কিন্তু আমার ভাই সেটা নেয়নি। তার ধারণা টাকার বিনিময়ে আপনি তাকে ছাড়বেন না। বাট ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন অফারটা আর নেই। আপনি আমার ভাইয়ের সঙ্গে সিঙ্গাপুর সেটেল্ড করবে না আমেরিকা তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। ইউ পিপল আর নট এনিমোর মাই হেডেক।

শবনম কি বলবে ভেবে পায় না। ভেবেছিল বড় মাছ তার বড়শিতে আটকা পড়েছে। কিন্তু না সব পন্ড হয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে শবনম বলে, ইউ আর ইনসালটিং মি।

-নো, আই এমন নট। বাট বিফর আই স্টার্ট ইনসালটিং ইউ, ইউ মে লিভ প্লিজ।

শবনম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যাবার আগে বলে, এই অপমানের শোধ আমি অবশ্যই নিবো।

-আপনার যদি মনে হয় আপনি কিছু করতে পারবেন তাহলে অবশ্যই চেষ্টা করে দেখবেন। আই উইল লুক ফরওয়ার্ড টু সি হোয়াট ইউ কেন ডু।

শাপের মতো ফসফস করতে করতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় শবনম। এই মহিলার জন্য অফিসে আসার পর চা খাওয়ার সুযোগ পায়নি রওনক। এর সঙ্গে কথা বলে মুখের স্বাদও কেমন হয়ে গেছে। তাই মুখের স্বাদ ঠিক করতে ইন্টার কমে ফোন করে। চিত্রলেখা ফোন রিসিভ না করায় এবারে লাবিবকে ফোন করে। লাবিব রিসিভ করতেই রওনক বলে,

-চন্দ্র… সরি চিত্রলেখাকে বলো আমার জন্য চা নিয়ে আসতে।

-চিত্রলেখা তো অফিসে আসেনি।

-কেনো?

রওনকের কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। লাবিব বলে,

-সকালে আমাকে ফোন করে জানিয়েছে ওর শরীরটা নাকি ভালো না। তাই আসতে পারবে না। আমিও বলেছি আসার প্রয়োজন নেই। বাসায় থেকে বিশ্রাম করুক।

-ভালো করেছো।

-আমি চা…

লাবিবের কথা না শুনেই রিসিভার নামিয়ে রাখে রওনক। তার মুখের বিস্বাদ এখন মন-মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের দিনটাই মনে হয় খারাপ যাবে তার। একবার কি গিয়ে দেখে আসবে কেমন আছে তার চন্দ্রলেখা? পরমুহূর্তেই আবার ভাবে উচিত হবে না। চিত্রলেখা হয়ত গতকাল রাতের কথাই ভাবছে। এমনিও ভাবার জন্য সময় চেয়েছে। এই সময় সে গিয়ে উপস্থিত হলে বিষয়টা চিত্রলেখার জন্য ভালো হবে না। ওকে নিজের মতো ভাবতে সময় দেয়া উচিত তার। আপাতত সে তার চন্দ্রলেখার জবাবের অপেক্ষা করবে। কিছু পেতে হলে অপেক্ষা করতে করতে হয়। বিনা অপেক্ষায় পাওয়া কোনো কিছু পেলে পাওয়ার আসল আনন্দ অনুভব করা যায় না। চন্দ্রলেখার জন্য সে এতটুকু অপেক্ষা করতেই পারে। আবার ইন্টারকমে ফোন লাগায় রওনক। লাবিব রিসিভ করতেই বলে, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।

এবারে তাকে যথেষ্ট ফুরফুরে শুনচ্ছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে