মাতাল হাওয়া পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
527

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-আই প্রোপজড হার।

-কি!

বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে নিম্ন সরে জিজ্ঞেস করে লাবিব। রওনক আরও পরিষ্কার করে বলে,

-আমি চিত্রলেখাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।

এমন একটা কথা শুনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না লাবিব। এমন একটা কথা শুনতে হবে তা সে চিন্তাই করেনি। নিজের কানে শুনা কথা একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ড্যাবড্যাবে চোখ করে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। বেচারাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথার উপর বজ্রপাত হয়েছে তাই সে জমে গেছে। সেই সঙ্গে কথা বলতেও ভুলে গেছে যেনো।

কয়েক সেকেন্ড সময় নে লাবিব নিজেকে ধাতস্ত করতে। নিজেই উঠে গিয়ে পানি খায় এক গ্লাস। তারপর ফিরে এসে চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করে,

-আবার বলুন তো স্যার আপনি একটু আগে কি বললেন। আমি ঠিক শুনলাম নাকি আপনি ভুল বললেন?

রওনক আহাম্মকের মতো তাকিয়েই থেকেছে কেবল। সে জানে লাবিবের জন্য চিত্রলেখা বিশেষ কেউ। সে এটাও জানে জেনে বুঝে সে লাবিবের মন ভাঙ্গছে। চায়নি রওনক এমন একটা কাজ করতে কিন্তু ঘটনাটা জাস্ট ঘটে গেছে। কিছু কিছু ঘটনার প্রবাহ আমাদের হাতে থাকে না। কেবল ঘটে যায়। অনেক সময়ই আমরা হয়ত চাই না কোনো একটা কাজ করতে তাও করে ফেলি। রওনকও চায়নি চিত্রলেখা ও লাবিবের মাঝে আসতে। সে জানে লাবিব চিত্রলেখার জন্য একটা ভালো চয়েজ। ওরা একত্রে ভালোও থাকবে। এসব জেনে, বুঝেও ওদের মধ্যখানে চলে এসেছে সে। চায়নি তবুও চলে এসেছে। রওনকের কেবল মনে হয়েছে জীবনটা যেহেতু আবার নতুন করে শুরু করতেই হবে। সেই জীবনে তার চিত্রলেখার মতো কেউ নয় বরং চিত্রলেখাকেই চাই। নয়ত আবার জীবনটাকে ভেঙে তছনছ করার জন্য নতুন করে সাজাতে চায় না সে।

রওনক স্থির দৃষ্টি নিয়ে লাবিবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

-তুমি ঠিকই শুনেছো।

-আপনি আসলেই চিত্রলেখাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছেন?

-হ্যাঁ।

-আপনি সত্যি সত্যি ওকে বিয়ে করতে চান?

-হ্যাঁ।

-একদম সত্যি সত্যি?

-লাবিব গেট এ গ্রিপ। মিথ্যে মিথ্যে কি বিয়ে হয়? আই নো নিউজটা তোমার জন্য শকিং। তুমি কষ্ট পেয়েছো। এন্ড আই এম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট।

লাবিব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-নিউজটা আসলেই আমার জন্য শকিং তবে আমি কষ্ট কেনো পাবো বুঝলাম না।

-আমি চিত্রলেখাকে বিয়ের করতে চাই এটা শুনে তুমি কষ্ট পাবে না?

-কেনো পাবো? বিয়ের নিউজ কি কষ্ট পাওয়ার মতো কিছু? তাছাড়া আমি নিজেও চাই চিত্রলেখার জীবনে একজন ভালো মানুষ আসুক, ভালো মনের মানুষ আসুক৷ ওকে খুব ভালোবাসুক। এতে কষ্ট কেনো পাবো?

এবার লাবিবের কথা শুনে রওনকের মস্তিষ্কের ভেতরকার নিউরনেরা উল্টাপাল্টা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। এমন একটা কথা শুনে বেচারা এতখানিই শক খেয়েছে যে উল্টাপাল্টা বকছে। অবাক হওয়া কন্ঠে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তুমি চিত্রলেখাকে বিয়ে করতে না?

-আমি কেন ওকে বিয়ে করতে যাবো!

রওনকের কথা শুনে ভীমড়ি খায় লাবিব। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কেন বিয়ে করবা মানে? যাকে ভালোবাসো, পছন্দ করো তাকে বিয়ে করবা না?

-হ্যাঁ, অবশ্যই করব। যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করতে চাই আমি। কিন্তু চিত্রলেখাকে নয়।

-লাবিব, তুমি চিত্রলেখাকে ভালোবাসো না?

-না। আমি কেনো চিত্রলেখাকে ভালোবাসতে যাবো?

-তাহলে সেদিন যে বললে তুমি একজনকে পছন্দ করো, চাও সেটা চিত্রলেখা নয়?

-একদমই নয়। চিত্রলেখাকে আমি কখনোই সেই নজরে দেখিনি। ও কেবলই আমার একজন ভালো বন্ধু। ভালোবাসার মানুষ নয়।

ফস করে একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে ইজি হয়ে বসে রওনক বলে,

-ম্যান বাঁচালে তুমি আমাকে।

এতক্ষণে সবটা ঠিকঠাক বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আপনি কি ভাবছিলেন আমি চিত্রলেখাকে ভালোবাসি?

-এমনটাই বলতে পারো।

-সিরিয়াসলি!

মাথা ঝাকায় রওনক। লাবিব আরও জিজ্ঞেস করে,

-এমন কেনো মনে হলো আপনার?

-আমি প্রায়ই নোটিশ করেছি তুমি চিত্রলেখার প্রতি অনেক বেশি কনসার্ন। ওর খুব কেয়ার করো। ওকে খুব কাছ থেকে অবজারভ করো। আর ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো যা একজন কো-ওয়ার্কারের হয়ত জানার কথা নয়।

রওনকের মুখে এসব কথা শুনে আর না হেসে পারে না লাবিব। আটকে রাখতে না পেরে দাঁত বের করেই হেসে ফেলে সে। হেসে নিয়ে বলে,

-সরি স্যার না হেসে পারলাম না। এটা সত্যি আমি চিত্রলেখার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। এর কারণ আমরা ভালো বন্ধু। সবটা শেয়ার না করলেও চিত্রলেখা নিজের বিষয়ে টুকটাক অনেক কিছুই আমাকে জানিয়েছে। সেই সুবাদেই বলতে পারেন ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। তবে এর বেশি কিছু না। কখনোই আমি ওকে একজন ভালো বন্ধু ব্যতীত অন্যকোনো দৃষ্টিতে দেখিনি। ওকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবিনি।

লাবিবের মুখে এসব কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচে রওনক। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো সে তার কাছের একজন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তার পছন্দের মানুষটাকে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সবকিছু শুনার পর তার ভেতর থেকে একটা মস্তবড় পাথর নেমে গেল মনে হচ্ছে। এতক্ষণ হাসাহাসি করলেও এবারে খানিকটা সিরিয়াস ভাব নিয়েই লাবিব জানতে চায়,

-কিন্তু এসব কখন হলো?

-কোন সব?

-এই যে আপনি আর চিত্রলেখা। কখন আপনারা দু’জন একে-অপরের এত কাছে চলে এলেন? আমি তো কিছু টেরই পেলাম না। চিত্রলেখাও কখনো কিছু জানায়নি আমাকে।

-তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই না।

-তাহলে কেমন?

-আমাকে বাসা থেকে বিয়ে করার জন্য প্রেসারাইজ করা হচ্ছে।

-সেটা তো জানি।

-বিয়ে আমাকে করতেই হবে। না করার কোনো অপশন নেই।

-হঠাৎ! কি এমন হলো যে আপনি রাজি হয়ে গেলেন?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রওনক। তারপর বলে,

-তুমি তো ভাইয়া ভাবীর বিষয়টা জানো।

রাদিন যে তানিয়াকে চিট করছে তার লাবিবও জানে। ইনফ্যাক্ট রওনকের অর্ডারে লাবিবই রাদিনের সবরকম খোঁজ-খবর রাখতো, এখনো রাখছে। রওনক বলতে থাকে,

-ভাবী নিজেও সব জানে। সব জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাইয়াকে ডিভোর্স দিবে। আর আমাকে একটা শর্ত দিয়েছে।

-কিসের শর্ত?

-মিশকাত ও মীমকে যদি আমি নিজের কাছে রাখতে চাই তাহলে আমায় বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করলে আমি ওদের দায়িত্ব পাবো। নয়ত ভাবী ওদের সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে তাও দেশ ছেড়ে।

-দেশ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উনি?

-হ্যাঁ।

-আপনি বাঁধা দেননি কেনো?

-ভাবীকে আমি আর বেঁধে রাখতে চাই না। ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে সে নিজের জীবন ভাইয়ার জন্য, আমাদের পরিবারের জন্য বিজনেসের জন্য উৎসর্গ করে গেছে প্রতিমুহূর্ত। আমিও চাই ভাবী ভালো থাকুক। এবার অন্তত জীবনটা নিজের মতো করে কাটাক। নিজের জন্য বাঁচুক। মিশকাত, মীম আমার কাছে থাকলে ভাবী আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবে। ওরা সঙ্গে থাকলে সে কখনোই নিজের জন্য ভাববে না। নিজের যতটুকু জীবন বাকি আছে সেটুকুও বাচ্চাদের জন্য উজার করে দিবে, যা আমি চাই না।

-সবই বুঝলাম। কিন্তু এসবের মধ্যে চিত্রলেখা কোথা থেকে এলো?

-জানি না কোথা থেকে এলো জাস্ট চলে এসেছে।

-আর সেটা কীভাবে?

-বাসায় আমার জন্য সাবাকে ফাইনাল করা হয়েছে যদিও এতে ভাবীর হাত নেই। ভাবী চায় আমি বিয়ে করি কাকে করি সেটা ফ্যাক্ট নয়। তবে আমি জানি ভাবী নিজেও চায় না সাবা বা সাবার মতো কেউ আমার জীবনে আসুক। আর সারাজীবন বিয়ে না করলেও এই মেয়েকে আমি কেনোদিনও বিয়ে করব না। অবশ্য বিয়ে করতাম না। ভাবীর শর্তটার কাছে হার মানতে হচ্ছে আমায়। সেজন্যই মূলত বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখনই চিত্রলেখা সামনে পড়ে যায়। ওকে দেখে মনে হলো সি ইজ দ্যা ওনলি পার্ফেক্ট ওয়ান ফর মি। আমার নিজের বউয়ের চাইতে বাচ্চাদের জন্য মায়ের মতো একজন বেশি প্রয়োজন। এর জন্য চিত্রলেখার চাইতে পার্ফেক্ট কেউ হতেই পারে না। সাবা হাই সোসাইটি মেইনটেইন করার জন্য পার্ফেক্ট ওয়াইফ হলেও সি ইজ নট ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল। মিসেস রওনক হবার যোগ্যতা সাবার থাকলেও আমার বউ, বাচ্চাদের চাচী কম মা হওয়ার যোগ্যতা একমাত্র চিত্রলেখার আছে। তাই বলতে পারো আই রিয়েলি নিড হার।

-এসব আপনি চিত্রলেখাকে বলেছেন? জানিয়েছেন সব বিস্তারিত? সব শুনে কি ও রাজি হয়েছে আপনার প্রস্তাবে?

-এসব বলিনি। শুধু বলেছি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। ভাবতে সময় দিয়েছি। বলেছি চিন্তা ভাবনা করে আমাকে জানাতে তবে জবাবে না শুনবো না। রাজি হবার জন্য চিন্তা-ভাবনা করতে সময় দিয়েছি।

হতাশ দৃষ্টি নিয়ে লাবিব রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

-মাথায় ব ন্দু ক ঠেকিয়ে যদি কবুল বলতে বলেন তাহলে বেচারি কবুল না বলে কোথায় যাবে?

-ব ন্দু ক তো ঠেকাইনি এখনো।

চোখ বড় বড় করে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আপনি কি সত্যি সত্যি ব ন্দু ক ঠেকানোর কথাও ভাবছেন নাকি?

-প্রয়োজন হলে পিছ পা হবো না অবশ্য।

-না না এসব দিয়ে হবে না। এর চাইতে বরং সত্যি টা ওকে জানান। এতে হয়ত রাজি হলেও হতে পারে।

-রাজি হবে না আমি জানি। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে। জেনে শুনে কেউ আগুনে ঝাপ দেয় না। তাই সব জেনে চিত্রলেখা কখনোই বিয়ে করতে রাজি হবে না।

-আপনি চিত্রলেখাকে চিনেন না। ওর কর্মকান্ড কখনো কখনো পাগলকেও হার মানায়। আপনি ভাবছেন সব শুনে রাজি হবে না। অথচ এমনও হতে পারে সব শুনে তৎক্ষনাৎই রাজি হয়ে আপনাকে চমকে দিলো।

-তুমি বলছো ওকে সব বলে দিতে?

-হ্যাঁ বলছি।

চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয় রওনকের কপালে। কিন্তু আপাতত লাবিব আর এই লাইনে কথা না বাড়িয়ে অনুমতি চেয়ে বলে,

-আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলি?

-এতকিছু বলার পর অনুমতি চাইছো?

-এখন যা বলবো মনে হলো এই কথাটা বলার জন্য অনুমতি নেয়া প্রয়োজন।

-বলো, পারমিশান গ্রান্টেড।

-একান্তই নিজের প্রয়োজনে একজনকে বিয়ে করবেন এটা কি ঠিক হবে? বিয়ের মাধ্যমে একটা সম্পর্ক তৈরি হবে অথচ সেই সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা নেই। এটা কি উচিত?

লাবিবের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো উত্তর নেই রওনকের কাছে। সে নিজেও জানে এটা অন্যায় কিন্তু আপাতত সে নিরুপায়। চিত্রলেখাকে না হলে তাকে সাবাকে বিয়ে করতে হবে যা সে একদমই চায় না। সাবা ও চিত্রলেখা নামক দু’টো অপশনই আছে তার কাছে এই মুহূর্তে। অন্য-কোনো উপায় বের করার মতো সময় তার হাতে নেই। নাহলে চিত্রলেখাকে অপশন হিসেবে কখনোই বিবেচনা করতো না সে। লাবিব আরও বলে,

-চিত্রলেখা আমার খুব ভালো বন্ধু। আপনাকেও চিনি পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি আপনার সঙ্গে বিয়ে হলে চিত্রলেখা চমৎকার একজন লাইফ পার্টনার পাবে। তবে চিত্রলেখাকে যতটুকু চিনি, জানি তা থেকে এতটুকু বলতে পারি এই মুহূর্তে ওর একজন চমৎকার লাইফ পার্টনারের যতটুকু দরকার একই সঙ্গে ততটুকু একজন ভালোবাসার মানুষও খুব প্রয়োজন। যে প্রতিটা মুহূর্ত ওকে আগলে রাখবে ভালোবাসার চাদরে। এমন নয় ওর জীবনে ভালোবাসার অভাব। ওর পরিবার, ভাইবোনগুলো আমার মতো যে কয়জন কাছের মানুষ আছে আমরা সবাই ওকে ভালোবাসি কিন্তু তারপরেও ওর একজন একান্তই ব্যক্তিগত ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন, ভালো বন্ধু হিসেবে এটা আমি মনে করি। ও নিজে থেকে হয়ত কখনোই কাউকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করবে না। তাই কেউ যদি সামনে থেকে ওকে ভালোবাসে, নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে সেটা মনে হয় সবচাইতে ভালো হবে চিত্রলেখার জন্য।

রওনক কেবল শুনে যায় কিছু বলে না। লাবিব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বসকে এর বেশি ল্যাকচার দেয়াটা হয়ত শোভন দেখাবে না। যতই ওদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক, সুসম্পর্ক থাকুক তবুও ভুলে গেলে চলবে না আদৌতে ওরা সম্পর্কে বস ও এমপ্লয়ি। আর বস হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে ভুল হলেও সঠিক। একটা প্রবাদ আছে ❝বসেস আর অলওয়েজ রাইট।❞ বেরিয়ে যাবার আগে লাবিব কথার লেজ টেনে আরেকটু বলে,

-চিত্রলেখাকে সবটা বলবেন কি বলবেন না সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। টেনশন করবেন না, আমি কখনো ওকে এসব কিছুই বলবো না। তবে এতটুকু বলতে পারি যদি ওর বিয়ে আপনার সাথে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে চিত্রলেখা একজন চমৎকার লাইফ পার্টনার পাবে। আর একজন ভালো বন্ধু হিসেবে আমি চাই খুব বেশি কিছু না হলেও চিত্রলেখা অন্তত এতটুকু পাক। আপনার মতো একজন ভালো, চমৎকার পার্টনার ওর জীবনে আসুক। আপনি ওর জীবনে আসুন। ওকে আগলে রাখুন হয় আপনার ভালোবাসা দিয়ে নয় ছায়া দিয়ে তবু আগলে রাখুন। কখনো যদি মনে করেন আমার কোনো হেল্প আপনার প্রয়োজন আই এম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ বোথ।

লাবিব দরজা পর্যন্ত গিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্য গেইট খুলতেই পেছন থেকে রওনক বলে,

-আপাতত একটু খোঁজ নিয়ে দেখো কোথায় গেল। বাসায় গিয়ে থাকলে ইটস ওকে। ভাবতে ভাবতে তো পথে-ঘাটে ভবঘুরের মতো হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস আছে। গাড়ি একটা মে রে দিয়ে গেলেও টের পাবে না। টের পাবার আগেই ম রে ভূ ত হয়ে যাবে। কি একটা আপদ যে গলায় ঝুলাতে যাচ্ছি তা এক আল্লাহই ভালো জানেন।

লাবিব মুচকি মুচকি হাসে। বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে বলে,

-ডন্ট ওয়ারি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।

পেছনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রওনক। সে গতকাল থেকেই মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছিল লাবিবের জন্য। আজ সব কিছু শুনার পর সত্যিই স্বস্তি লাগছে। লাবিব তার কাছের মানুষ। ওকে কষ্ট দিতে চায় না সে কোনোভাবেই। ওর মনে যে চিত্রলেখাকে নিয়ে অন্য-কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই আপাতত এতটুকু শুনেই হালকা লাগছে রওনকের।

লাবিব নিজের চেয়ার বসে পড়েই আগে এক গ্লাস পানি খায়। চিন্তার ছাপ তার কপালে গাঢ় হয়। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় লাবিবের মন-মস্তিষ্ক। এমনটা হতে পারে তা সে কখনোই চিন্তা করেনি। রাদিনের অন্য একজনের সাথে সম্পর্কের কথা জানার পর লাবিব অনেক ভেবেছে তানিয়া এসব জানার পর কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে? এটাও ভেবেছে হয়ত ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আবার বাচ্চাদের কথা মাথায় আসলে মনে হয়েছে হয়ত বাঙালী অন্য আর সাধারণ দশটা নারীর মতো বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিবে চুপচাপ। যা লাবিব কখনোই চায়নি। তানিয়া ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুনে যথেষ্টই খুশি হয়েছে সে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশ ছেড়ে চলে যাবে এমনটা কখনোই আশা করেনি, ওর চিন্তা-ভাবনাতেও আসেনি এমন কিছু হতে পারে। তানিয়ার জায়গায় অবশ্য সে একদম সঠিক। এখানে একটা সম্পর্কের এমন করুন পরিণতির পর তার জন্য এখানে থাকাটা কঠিন হবে বলা যায়। তাছাড়া নতুন করে শুরু করার জন্য সব কিছু ছেড়ে তার দূরে চলে যাওয়াটাই শ্রেয়। কিন্তু লাবিব কি করবে! তানিয়া এভাবে চলে গেলে তার অব্যক্ত অনুভূতিদের কি হবে? সে কি কখনোই তানিয়াকে তার মনের কথা জানানোর সুযোগ পাবে না? তানিয়াকে যে সে এত পছন্দ করে, ভালোবেসে ফেলেছে এই কথাটা কি কখনো বলতে পারবে? বলার সুযোগ পাবে? এতদিন তো কেবল ভেবে এসেছে এই জীবন তার দূর থেকে ভালোবেসেই কাটবে। কিন্তু যখন থেকে রাদিনের পরকীয়ার বিষয়টা জানতে পারলো তখন থেকে লাবিবের নিজের অজান্তেই একটা আশার চারা বোপন হয়েছিল মনের ভেতর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চারা টা গাছে পরিনত হবার আগেই মা রা যাবে। এই জীবনে হয়ত লাবিব কখনোই তানিয়াকে নিজের মনের কথা, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না। বলার সুযোগ পাবে না। তাকে পাওয়া তো অনেক দূরের কথা। নিমাই ভট্টাচার্য তার মেমসাহেব উপন্যাসে যথার্থই বলেছিলেন, ❝জীবনে যে ভালবাসা পায়, সে আর কিছু পায় না; যে জীবনে আর সব কিছু পায়, সে ভালবাসা পায় না ।❞ লাবিব এই জীবনে সব না পেলেও অনেককিছুই পেয়েছে তাই ভালোবাসা বুঝি তার কপালে নেই। হতাশা ও হাহাকারে ওর বুকের ভেতরটা তাতিয়ে ওঠে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রিপা অনেকক্ষণ ধরে লিখনের জন্য অপেক্ষা করছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পেয়ে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিপা বলে,

-এতক্ষণ লাগলো কেন আজ তোমার?

-একটা কাজ ছিল ওটা করতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল।

-কি কাজ?

-ছিল একটা কাজ।

-ছিল একটা কাজ আবার কেমন কথা! কি কাজ সেটা বলতে পারছো না?

লিখন এক্ষুনি রিপাকে বলতে চাইছে না কিছু। চাকরীর কথা শুনলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলবে এই মেয়ে তা লিখন ভালো করেই জানে। তাই এক্ষুনি না বলে চাকরীর একটা ব্যবস্থা হলে পরে জানাতে চায় সে। লিখনকে চুপ করে থাকতে দেখে রিপা জোর দিয়ে বলে,

-ঘটনা কি খুলে বলো তো। এমন কি কাজ যা তুমি আমাকে বলতে পারছো না। কি আড়াল করছো সত্যি করে বলো তো।

লিখন ভালো করেই জানে পৃথিবীতে দুইজন নারীর কাছ থেকে সে নিজের মনের ভেতরকার অবস্থা আড়াল করতে পারবে না কখনোই। তাদের একজন চিত্রলেখা আরেকজন রিপা। তাই বাধ্য হয়েই লিখন রিপাকে চাকরীর বিষয়টা জানায়। সব শুনে রিপা বলে,

-এই সময়ে তুমি চাকরী করবা? এখন চাকরীতে ঢুকলে যে তোমার ফাইনাল খারাপ হবে এটা তুমি জানো না?

-জানি কিন্তু কিছু করার নাই। আমি স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা দেখে সব দায়-দায়িত্ব আপার ঘাড়ে চাপায় দিতে পারি না।

-আমি তোমাকে বলছিও না সব আপার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে। আমি জাস্ট বলছি যেখানে এতদিন কষ্ট করেছো আর নাহয় কয়েকটা মাস মাত্র। পরীক্ষাটা হয়ে যাওয়ার পর নাহয় ভালো দেখে একটা জব জয়েন করলা। এছাড়া বাইরে চলে গেলে তো পড়ালেখার পাশাপাশি ওখানেও পার্টটাইম জব করতে পারবা।

লিখন মুখ ফিরিয়ে রিপার মুখের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা রিপা ধরতে পারেনি। সেই কিছু একটা হচ্ছে অবাক হওয়া। রিপার কথা শুনে অবাক না হয়ে পারে না লিখন। পরিবারের এমন অবস্থায় বিদেশ যাবার কথা ভাবতেই পারে না ও। কীভাবে ভাববে? যেখানে দুইদিন পর একটা চাকরী জোগাড় না করতে পারলে ঘরের অবস্থা হবে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে লিখন কিনা বিদেশ যাবে! কি চিন্তা-ভাবনা করে রিপা এসব বলছে তা লিখন ভেবে পায় না। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ধরনের তর্ক করার মতো মন-মানসিকতা না থাকায় এই প্রসঙ্গে কথা বলে না ও। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রিপা নিজেই বলে,

-তুমি বরং একটা কাজ করো মন দিয়ে তোমার পড়ালেখাটাই সারো। এদিক থেকে আমি নাহয় তোমাকে কিছু হেল্প করলাম। কিছু না সবটাই করলাম। তোমার তো চাকরীর অভিজ্ঞতা নেই। এখন যদি তুমি চাকরী পেয়েও যাও দেখা যাবে কত টাকাই বা বেতন পাবা। সেই টাকা টা নাহয় আমি তোমাকে দিলাম। তুমি সেটা আপার হাতে দিয়ে দিও। এতে করে তোমার চাকরী করা লাগবে না আবার তুমি মন দিয়ে পড়ালেখাটাও করতে পারবে।

এবার আগের চাইতে আরও বেশি অবাক হয় লিখন। এমন সব কথা শুনে অবাক না হয়েও পারা যায় না। নিজেকে সামলে নিয়ে লিখন জানতে চায়,

-আর এভাবে কতদিন চলবে?

-যতদিন প্রয়োজন।

-টাকাগুলো আপার হাতে দেয়ার পর আপা যখন জানতে চাইবে এতগুলো টাকা কোথা থেকে আসলো তখন কি বলবো আমি?

-বলবা ফ্রেন্ডের থেকে ধার করেছো।

-প্রতিমাসে ধার করবো? শোধ দেয়া লাগবে না?

-আপাকে বলবা তোমার এই ফ্রেন্ডের পারিবারিক অবস্থা ভালো। বলছে পরে যখন চাকরী করবা তখন শোধ দিলে হবে। এখন শোধ দেয়া লাগবে না।

-আর তোমার মনে হয় আমার বোন এই বাহানা শুনে আমাকে সন্দেহ করবে না বা এই টাকা সে এক্সেপ্ট করবে?

-কেন করবে না? টাকাকে কি কেউ রিফিউজ করে নাকি?

-শুনো রিপা আমার বোন গোল্ড ডিগার না। যদি ওর ধ্যান ধারনায় কেবল টাকা টাই থাকতো তাহলে এতদিনে নিজের অফিসের একজন ভালো ইনকাম করা পয়সাওয়ালা কলিগকে বিয়ে করে আয়েশের জীবন কাটাতো। কিন্তু আমার বোন এমন না। ও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের মানুষ করতে চায়। আমাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চায় তবে নিজের যোগ্যতায় কারো দয়ায় না।

লিখনের কথা শুনে রিপা কিছুটা অপ্রস্তুত হয় সেই সঙ্গে খানিকটা ঘাবড়েও যায়। নিজের কথা দিয়ে ও এমন কিছু মিন করেনি। তাই তৎক্ষনাৎই কারেকশন করে বলে,

-তুমি ভুল ভাবছো লিখন। আমি মোটেও এটা মিন করিনি আপা গোল্ড ডিগার। আমি জাস্ট কথার কথা বললাম। দুনিয়াতে এমন কম মানুষই আছে যারা সামনে থেকে হেটে আসা টাকা রিফিউজ করে।

-আমার বোন সেই কয়জন মানুষেরই একজন রিপা। বরং বলতে পারো এমন যদি পৃথিবীতে একজন থাকে তাহলে সেটা আমার বোন। তুমি তো এখনো আমার বোনকে দেখোনি, ওর সঙ্গে তোমার আলাপ-পরিচয় হয়নি তাই তুমি জানো না ও কেমন। আমার বোনকে মাটি বললেও কম বলা হবে। মাটির চাইতেও নরম, সোনার চাইতেও খাটি যে মানুষটা সেটা হচ্ছে চিত্রলেখা; আমার বোন।

-আমার কথার ভুল মিনিং ধরছো তুমি লিখন। আমি জাস্ট তোমাকে হেল্প করতে চাই আর কিছু না। আমি চাইনা বর্তমানের চিন্তা করতে গিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ টা নষ্ট হয়ে যাক। সামনে তোমার অনেক সুন্দর একটা ভবিষ্য অপেক্ষা করছে।

-আপাতত আমার জীবন ডিকশনারিতে ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। যার বর্তমানের গ্যারান্টি নেই তার আবার কিসের ভবিষ্যৎ?

-সেজন্যই তো আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমার জন্য কিছু করতে চাই। যাতে করে বর্তমানের যাতাকলে পিষতে গিয়ে তুমি ভবিষ্যতের খেই না হারিয়ে ফেলো। সেজন্যই তোমার জীবন নৌকার পাল হতে চাই আমি লিখন।

-আমি সবসময়ই মনে করি আমার ভাগ্য ভীষণ ভালো বলেই তোমার মতো একটা মেয়ে আমার মতো পরিচয়হীন একটা ছেলের জীবনে এসেছে। এতদিনের সম্পর্কে কখনো তোমাকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত খাওয়াতে পারিনি। ঐ সর্বোচ্চ ২০০ টাকার পাস্তা, ৪০০ টাকার পিৎজ্জা ওসবকে ভালো খাওয়া বলেও না আজকাল আর। কিন্তু আমার মতো ছেলের জন্য ওটাই অনেক। আমি নিজেও চাই আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হোক সেজন্য আগে আমাকে বর্তমানের যুদ্ধটা জিততে দাও। এখনই যদি আমি তোমার সাহায্য নিয়ে ফেলি তাহলে ভবিষ্যৎ নামক যুদ্ধ জিতবো কী দিয়ে? আমাদের ভবিষ্যৎ টা যেনো সুন্দর হয় সেই খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি কেবল আমার পাশে থেকো তাহলেই হবে।

রিপা আর কিছু বলতে পারে না। লিখনের একটা হাত ধরে রাখে শক্ত করে। তাকে বুঝায় সে পাশে আছে সবসময়।

রওনকের কেবিনের দরজায় দু’বার নক করে ভেতরে প্রবেশ করেই লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আমায় ডেকেছিলেন?

-চিত্রলেখার কোনো খোঁজ পেলে? কোথায় গেছে কিছু জানো?

-ওর ফোনটা বন্ধ।

-বাসায় কাউকে ফোন করে দেখেছিলে?

-ওর ছোট বোনকে ফোন করেছিলাম। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে কথা বলে বুঝলাম চিত্রলেখা বাসায় যায়নি।

রওনকের কপালে চিন্তার রেখা গাঢ় হয়। তা দেখে লাবিব বলে,

-চিন্তা করবেন না। চিত্রলেখা বুদ্ধিমতী মেয়ে নিশ্চয়ই ঠিক আছে।

-হোপ সো।

বেরিয়ে যাবার আগে লাবিব আবার জিজ্ঞেস করে,

-চিত্রলেখাকে কি খুব বেশি প্রয়োজন? আই মিন কোনো জরুরী কাজ থাকলে আমায় বলতে পারেন।

-না ইটস ওকে। কিছু লাগলে তোমায় বলবো।

লাবিব আর অপেক্ষা করে না, বেরিয়ে যায়।

চিত্রলেখা আসার পর থেকে আফিফাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এর মধ্যে কান্নাকাটিও করেছে কয়েকদফা। চিত্রলেখাকে ওরকম হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে একদমই বাঁধা দেয়নি আফিফা। কিন্তু এতক্ষণ ধরে জড়িয়ে বসে থাকলে তো সমস্যা। অনেকক্ষণ হয়েছে বাবলুকে কিছু খাওয়ানো হয়নি। দুধের বাচ্চা বেশিক্ষণ না খেয়েও থাকতে পারে না। অবশ্য এখন সে ঘুমাচ্ছে তবে আফিফা জানে আর কিছুক্ষণ পরেই বাবলুর ঘুম ভাঙ্গবে। আর ঘুম থেকে উঠেই খাওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করবে। তাই বাবলুর ঘুম ভাঙ্গার আগেই চিত্রলেখাকে স্বাভাবিক করতে হবে। সেই চেষ্টায়ই বান্ধবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আফিফা বলে,

-বাকি কান্নাটা নাহয় বিকালে কাঁদিস। এখন বাবলু উঠে যদি দেখে তুই ওর মতো করে কাঁদছিস তাহলে তো আরেক কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর চাইতে নাহয় তুই আপাতত কান্নাকাটি পজ রাখ বাকিটা বিকালে কাঁদিস বাবলু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর।

আফিফাকে ছেড়ে দিয়ে চিত্রলেখাকে বলে,

-তুই আমার সঙ্গে মশকরা করছিস আফি?

চিত্রলেখার গালে সয়লাব হয়ে থাকা চোখের পানি পরম মমতায় দু’হাতে মুছে দিয়ে আফিফা বলে,

-একদম করছি। তোর সঙ্গে আমি মশকরা করব না তো কে করবে শুনি? এখন আমরা সই কয়দিন পর তোর বিয়ে হবে, একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হবে। সেই মেয়েকে আমি বাবলুর বউ করে আনবো। তারপর আমরা বেয়াইন হবো। হলো না আমাদের মশকরার সম্পর্ক?

-তুই আবার এসব শুরু করলি? কোনো বাবলু টাবলুর কাছে আমি মেয়ে বিয়ে দিবো না।

আফিফা দুষ্টুমি করে চিত্রলেখার চিবুকে টিপ দিয়ে বলে,

-ভুলে যাইস না তুই নিজেই নামটা দিয়েছিস। তোর এই নাম আমি একটা শর্তেই রাখছি। বাবলু তোর মেয়ের জামাই হবে।

এসব কথপোকথন চলতে থাকে। চিত্রলেখা কান্নাকাটি ভুলে গিয়ে দুই বান্ধবী জোড়ালো হাসিতে মেতে ওঠে। ওদের হাসির শব্দে বাবলুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেচারার আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘুটায় দুনিয়া ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দেয়। বাবলুকে বিছানা থেকে তুলে চিত্রলেখার কোলে দিয়ে আফিফা বলে,

-তুই তোর মেয়ের জামাই সামলা আমি ওর ফিডারটা বানিয়ে নিয়ে আসছি এক্ষুনি।

বাবলুকে চিত্রলেখার কোলে দিয়েই ভৌ-দৌড় লাগায় আফিফা। এদিকে চিত্রলেখা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাবলুর কান্না থাকাতে। অবশ্য তাকে বেশি কসরত করতে হয় না। বাবলু কান্নার ফাঁকে একবার চিত্রলেখাকে দেখেই থেমে যায়। মনে হয় যেনো কান্না করার কথা ভুলে গেছে বেচারা। চিত্রলেখাও নিজের মন কেমন ভুলে গিয়ে বাবলুকে নিয়ে মেতে ওঠে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন বাড়ি ফিরতেই তার দেখা হলো বৃষ্টির সঙ্গে।তার ঘরেই বসে আছে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো বৃষ্টি?

বৃষ্টি লিখনের কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

-আপনি চাকরী খুঁজছেন?

লিখন মুখ তুলে একবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। চেয়ার টেনে বসে পরে বৃষ্টির মুখোমুখি। লিখনের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বৃষ্টি আরও জিজ্ঞেস করে,

-চাকরীটা কি খুব বেশি প্রয়োজন?

-আমার হয়ে তুমি কি আঙ্কেলকে একটু বলবা? উনি তো তোমার কথা ফেলেন না কখনো।

-এই সময় চাকরী করলে যে আপনার লেখাপড়া গোল্লায় যাবে সে খবর জানেন তো?

-রেজাল্ট হয়ত আশানুরূপ হবে না তবে ফেইল করব না। তুমি তো জানোই আমি ফেলটুস ছাত্র না।

-সে খবর কি আমার থেকে ভালো কেউ জানে? তবে আমি একটা কথা বলি?

-অন্তত চাকরী করতে নিষেধ করো না অন্য সবার মতো। চাকরীটা আমার ভীষণ প্রয়োজন।

বৃষ্টি মুখ তুলে লিখনের মুখের দিকে তাকায়। এত মায়ামায়া লাগলো ওর কাছে। মন চাইছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলুক, আপনি একদম ভাববেন না। দেখব সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। আর এই কঠিন সময়ে আমি সর্বদা আপনার পাশে আছি। কিন্তু এসব কথা বৃষ্টির মনের ভেতরেই রয়ে যায়। সে জানে লিখন কোনোদিন তার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকায়নি। হয়ত কোনোদিন তাকাবেও না। বৃষ্টির নিজের মনের ভেতর অনুমতি ছাড়া জন্ম নেয়া এসব অনুভূতির দায় ভার তো লিখনের উপর বর্তায় না। দুম করে বলে দিয়ে লিখনকে সে বিব্রতও করতে চায় না, করবেও না। কিন্তু এই মায়াও সে ছাড়তে পারবে না। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বৃষ্টি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

-আমি বলছিলাম কি চাকরীর খোঁজ না করে আপনি বরং কোচিং সেন্টার খুলে ফেলুন।

-কোচিং সেন্টার?

-হ্যাঁ, বাড়িতেই নাহয় পড়াবেন। ব্যাচ করে। দেখবেন চাকরী করলে মাস শেষে যা বেতন আসবে ছাত্র পড়িয়ে আপনি আরও বেশ ভালো করছেন।

-কিন্তু আমার কাছে পড়বে কে?

-কে পড়বে না সেটা বলুন? এতদিন বাড়ি গিয়ে পড়িয়েছেন এখন আপনার বাড়ি এসে পড়বে। গিয়ে পড়ালে তো একই সময় ২/১ জনের বেশি পড়াতে পারবেন না। কিন্তু এসে পড়লে একই সময় ৫/৭ জন করেও পড়াতে পারবেন। আমি তো মনে মনে ভেবেও ফেলেছি। আপনি যদি শুধু ইংরেজিটাও পড়ান। একই ব্যাচে ১০ জন করে পড়লে ১ ঘন্টা করে সময় দিলেও মাস শেষে ১০ হাজার টাকা। দিনে ২/৩ টা ব্যাচে যদি ২০/২৫ জনও পড়ান তাহলেই আপনাকে আর চাকরী করতে হবে না। আপনি নিজেও পড়ার সময় পাবেন। আইএলটিএস বাদ দেয়া লাগবে না। আপনার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে না।

বৃষ্টির কথা শুনে লিখন ভারি অবাক হয়। অবাক হওয়ারই কথা। মেয়েটা আজ সকালেও তার সঙ্গে কথা বলেনি। মুখ ফিরিয়ে রেখেছে অভিমানে। অথচ তার বিপদের কথা শুনে দৌড়ে এসেছে তাও খালি হাতে নয়। একটা চমৎকার বুদ্ধি নিয়ে এসেছে। এই মেয়েটা যার জীবনে যাবে তার জীবনে বিপদ হবে সবচাইতে তুচ্ছ বিষয়। কারণ বৃষ্টি নামক চমৎকার মেয়েটা সব সহজ করে দিবে নিজের বুদ্ধি দিয়ে। মনে মনে এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতেই লিখনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তা দেখে বৃষ্টি অবাক হওয়া সুরে জিজ্ঞেস করে,

-হাসছেন কেনো? আমি কি হাসির কথা বললাম?

-না না হাসছি অন্য কারণে।

-আমি কি বললাম বুঝেছেন তো?

-সবই বুঝলাম কিন্তু এত ছাত্র আমি কোথায় পাবো?

-আপনি পড়ানো শুরু তো করুন। বাগানে ফুল থাকলে যেমন মৌমাছি আসবেই তেমন আপনি পড়াতে থাকলে ছাত্র আপনার কাছে আসবেই। আমার ক্লাসের কয়টা বান্ধবী আপনার কাছে পড়ার আগ্রহ জানিয়েছিল। আপনাকে তো আমি বলেও ছিলাম। আপনি না করে দিয়েছিলেন হাতে সময় নেই বলে। আমি ওদের সবাইকে জানাবো। হলে নাহয় ওদের দিয়েই শুরু করুন।

-আর তুমি? তুমি পড়বে না আমার কাছে।

-আমি তো কোচিং করছি আমার কলেজের মাসুদ স্যারের কাছে।

-তুমি না বলেছিলে মাসুদ স্যারের পড়া তুমি বুঝো না।

-যার পড়া বুঝি সে তো মাঝপথেই ছেড়ে দিলো তাই আপাতত মাসুদ স্যারই ভরসা।

-আই এমন সরি বৃষ্টি। ঐ সময়…

-এই প্রসঙ্গটা আপাতত থাক। আমি আজ বাড়ি যাই। ওদের সঙ্গে আলাপ করে আপনায় জানাবো। নাঈমকে দিয়ে খবর পাঠাবো।

-তুমি আসবে না?

-না।

-আমার কোচিং সেন্টারের প্রথম ছাত্র তুমি হলে কোচিং সেন্টার খুলবো আর নয়ত এসব পড়ানো টরানো বাদ। আমি চাকরী খুঁজে নিবো।

বৃষ্টি উঠে দাঁড়ায়। মুখটা কঠিন করে বলে,

-আমি মাঝপথে মাসুদ স্যারকে ছাড়তে পারব না। মাঝপথে ছেড়ে দেবার অভ্যাস আমার নেই।

-তবুও আমি অপেক্ষায় থাকবো। তুমি না এলে কাউকে পড়াবো না। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

বৃষ্টি বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও বলল,

-সকালে আপনি আমাদের বাড়ি কিছু খাননি। গতকাল বিরিয়ানি রান্না হয়েছিল। খালার কাছে দিয়েছি। বেশি করে আলু দিয়েছি, খেয়ে নিবেন। আসছি।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় বৃষ্টি। পেছনে লিখন বসে থাকে চেয়ারটায়। অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনার দোটানায় অস্থির সে।

বৃষ্টি ঘর থেকে বের হতেই তার দেয়া হয় চয়নের সঙ্গে। মিষ্টি করে হাসি দিয়ে চয়ন জিজ্ঞেস করে,

-অনেকদিন বাদে এলে। কেমন আছো?

-ভালো। তোমার কি খবর? লেখাপড়া কেমন যাচ্ছে?

-ঐ যাচ্ছে ভালোই। তুমি কি বসবে না?

-বসলাম অনেকক্ষণ। আজ বাড়ি ফিরব দেরি হয়ে যাচ্ছে।

-তাহলে তো গল্প করার সুযোগ পেলাম না। আরেকদিন এসো কেমন।

-আচ্ছা আসবো।

বৃষ্টি চয়নকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে চয়ন পেছন ফিরে বলে,

-বৃষ্টি আপু, তুমি অনেক লক্ষি একটা মেয়ে। এই কথাটা কি কেউ কোনোদিন তোমায় বলেছে?

-চিত্র আপা বলেন সবসময়। যখনই আমাদের দেখা হয় তখনই বলেন। আর আজ তুমি বললে।

-আপা কিন্তু সত্যি বলে। তুমি আসলেই লক্ষি। আমার ভাইয়ের কপাল ভালো।

-মানে!

-ওসব মানে আজ থাক আরেকদিন বলবো। আমার একটু তাড়া আছে।

চয়নের বলা রহস্য নিয়েই বাড়ি চলে যায় বৃষ্টি। মাথার ভেতর কথাটা রয়ে যায়। চিন্তা ভাবনার বিস্ফোরণ ঘটে মস্তিষ্কে। কথাটা দিয়ে চয়ন কি বুঝাতে চাইলো?

লিখন এখনো চেয়ারটাতেই বসে আছে। বৃষ্টি বেরিয়ে যাবার মিনিট খানিকের মাথায় চয়ন প্রবেশ করে। সে এখন কোচিং করতে যাবে। ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করে,

-বৃষ্টি আপুকে নিয়ে তোমার অপিনিয়ন কি?

-কিসের অপিনিয়ন?

-সে তোমাকে পছন্দ করে তুমি জানো না?

চয়নের কথা শুনে থমথমে মুখ করে ভাইয়ের দিকে তাকায় লিখন। তা দেখে চয়ন আরও বলে,

-অবাক হচ্ছো কেন? এতদিন ধরে পড়াও ধরতে পারেনি? তোমার প্রতি তার ভালো লাগা তো চোখ-মুখে ভেসে আছে। যেকেউ বলে দিতে পারবে। তুমি সত্যি সত্যি ধরতে পারোনি নাকি ইচ্ছা করেই বুঝেও না বুঝার ভান করেছো?

লিখন কোনো জবাব করে না। ভাইকে থম ধরে বসে থাকতে দেখে চয়ন কাঁধে ব্যাগ ঝুলাতে ঝুলাতে বলে,

-যাক গিয়ে আমার মনে হলো বলি তাই বললাম।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে চয়ন আরও বলে,

-তবে যাই বলো, জীবন সঙ্গী হিসেবে বৃষ্টি আপু কিন্তু চমৎকার একজন মানুষ। তোমার জীবনে সে এলে আমরা সবাই মন্দ থাকবো না। তুমি চাইলে ভেবে দেখতে পারো।

চয়ন আর অপেক্ষা করে না। বেরিয়ে পড়ে কোচিং করতে যাবে। সামনে ওর পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে