#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
পুরোনো গ্রীলের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর তার হাজারখানিক চিন্তা। এখান থেকে চলে যাওয়া মানে সংসার খরচ অনেক বাড়বে। পাঁচজন মানুষ মানে পাঁচটা পেট। এতগুলো মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব অথচ উপার্জনের মানুষ মাত্র একজন। লিখন সবে মাত্র আইএলটিএসের জন্য ভর্তি হয়েছে। ক্লাস শেষ করে, টিউশনি করে আরেকটা বাড়তি টিউশনি করার সময় ওর নেই। এমতাবস্থায় ওর উপর সংসারের দায়িত্ব কোনোভাবেই দিতে পারবে না চিত্রলেখা। কোনো না কোনো একটা উপায় তো বের করতেই হবে। সবেই চিন্তা-ভাবনা করেছিল লিখনের পরীক্ষাটা হয়ে গেলে ওর বিদেশ যাবার জন্য টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করবে। এর মধ্যে এখন সংসারের দায়িত্ব বেড়ে গেলো। ঠিক মতো সবার জন্য করতে পারবে কিনা এসব ভেবেই ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছে।
-কি ভাবছো আপা?
আচমকা কারো কন্ঠ পেয়ে খানিকটা ঘাবড়ে ওঠে চিত্রলেখা। পেছন ফিরে তিন ভাইবোনকে দেখে বলে,
-তোরা এই সময় এখানে কেন?
-তুমি এখানে কি করো? সকালে না অফিস আছে। না ঘুমায় অফিস করলে শরীর খারাপ করবে না?
লিখনের কথার জবাবে চিত্রলেখা বলে,
-সবে মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। একটু পরেই ঘুমাবো। তোরা রাত না জেগে গিয়ে ঘুমা। তোদেরও তো ক্লাস আছে।
আচমকাই ওরা তিনজন এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরে। বড় বোন কখনো মুখ ফুটে বলে না তবে ওরা ঠিকই বুঝে তার মনের অবস্থা। এই মুহূর্তে যে মন, মস্তিষ্কের দিক থেকে চিত্রলেখা খুব একটা ভালো নেই তা ওরা ভালো ভাবেই আন্দাজ করতে পারছে। লম্বা সময় নিয়ে ভাইবোনেরা মিলে আলিঙ্গন করার পর চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিলে সে নিজের ভরে আসা চোখের কোণ জুড়ে থাকা নোনাজলের অস্তিত্বদের আঙুলের টানে মুছে ফেলে। তারপর বলে,
-অনেক হয়েছে এখন গিয়ে শুয়ে পর।
চলে যাওয়ার বদলে দাঁড়িয়ে রয় ওরা। লিখন বলে,
-তুমি কোনো চিন্তা কইরো না আপা। ঠিকই একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মাত্র তো চারজন মানুষ আমরা। তুমি আর আমি মিলে ঠিক সামলায় নিবো।
লিখনের কথা শেষ হতে না হতেই চয়ন বলে,
-বারে তোমরা দু’জন মিলে কেন সামলাবা? আমরা দুইজন তোমাদের উপর বোঝা হবো ভাবছো? চারু নাহয় সবার ছোট ও ঘরে থাকলো ওর লেখাপড়া নষ্ট হবে কিন্তু আমিও তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলায় সংসারের দায়িত্ব নিবো। আমরা তিনজন ইনকাম করলে টাকার পাহাড় হয়ে যাবে আমাদের দেইখো।
চয়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে চারু বলে,
-ও আচ্ছা আমি ছোট, আমার পড়ালেখা নষ্ট হবে। এমন ভাবে বলতেছিস লাগে জানি নিজে অনেক লায়েক হয়ে গেছিস। তোর মাস্টার্স শেষ হয়ে গেছে।
বলেই মুখ ভেংচি কাটে। জবাবে চয়ন বলে,
-ওত বড় না হইলেও আপা আর ভাইয়াকে হেল্প করতে পারবো ওতখানি বড় ঠিকই হইছি।
-তুই পারলে আমিও পারব।
-তোকে কিচ্ছু করতে হবে না।
-তুই করলে আমিও করব।
-বললাম তো তোকে কিছু করতে হবে না।
-আমিও বললাম তো…
চয়ন আর চারু রীতিমতো ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে। ওদের ঝগড়া দেখে চিত্রলেখার হাসি পেয়ে যায়। কিছু বলে না সে। লিখন বাঁধা দিয়ে বলে,
-হচ্ছে কি এসব? তোরা থামবি? এমনিতেই আপা টেনশনে আছে তারমধ্যে তোরা দুইটায় শুরুটা করলি কি? বেক্কল কথাকার।
তৎক্ষনাৎই দু’জনের মুখ চুপসে গেলো। লিখনের ঝাড়ি থেকে দু’জনকে বাঁচাতে চিত্রলেখা বলে,
-থাক ব কি স না আর।
-ব কা তো শুরুই করতে পারলাম না আপা। তুমি আগেই আটকায় দিচ্ছো।
-থাক, হইছে তো।
-আচ্ছা যাও, তোমার জন্য আজ দুইটারে মাফ করে দিলাম।
এবারে চয়ন, চারু দু’জনে একদল হয়ে লিখনকে ভেংচি কাটে। চিত্রলেখা ওদেরকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,
-অনেক হইছে এখন ঘরে গিয়ে শুয়ে পর। রাত বাড়তেছে।
-আর তুমি?
লিখনের প্রশ্নের জবাবে চিত্রলেখা কিছু বলার আগে চারু বলে,
-তোমরা যাও, আমি আপাকে নিয়ে যাইতেছি।
আর কেউ কোনো কথা বাড়ায় না। লিখন ও চয়ন চলে গেলে রয়ে যায় চিত্রলেখা ও চারু। ছোট বোনকে চিত্রলেখা বলে,
-তুইও যা শুয়ে পর। আমি একটু পরেই আসতেছি।
এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে চারু বলে,
-আমি তোমার সাথে একটু থাকি আপা? একদম বিরক্ত করবো না প্রমিজ।
চিত্রলেখা কিছু বলে না। সে ভালো করেই জানে চারু তাকে কিছু বলতে চায় বলেই রয়ে গেল। নাহলে ঘুম কাতুরে মেয়েটা এই সময় অব্দি জেগে থাকতো না। তাই আর ভনিতা না করে চিত্রলেখা নিজেই জিজ্ঞেস করে,
-কি বলতে চাস বলে ফেল।
-তুমি কীভাবে বুঝলা আপা?
-আমি কীভাবে বুঝলাম সেটা আর কয়টা বছর পর তুই নিজেই বুঝতে পারবি আমায় বলে দিতে হবে না।
-আমি কি কোনোদিন তোমার মতো করে তোমাদের বুঝতো পারবো আপা?
-পারবি, অবশ্যই পারবি। আমার মতো করে না পারলেও নিজের মতো করে ঠিকই পারবি।
-কিন্তু আমি তোমার মতো করে সবাইকে বুঝতে চাই। আমি তোমার মতো হতে চাই আপা।
-আমরা কেউই কারো মতো হইনা রে। আমরা সবাই নিজের মতো হইতো। আমি চাই আমার চারু অন্যকারো মতো না হয়ে নিজের মতো হোক।
এতটুকু মুখে বলে চিত্রলেখা মনে মনে আরও আওড়ায়, ❝আমি কোনোদিনও চাই না তোর জীবনটা আমার মতো হোক, কখনো চাই না। এই প্রতিমুহূর্ত ম রে যাওয়াটা আমি তোর জন্য চাই না।❞
-একটা কথা বলি আপা?
-বলবি বলেই তো রয়ে গেলি। বল, কি বলবি।
-তুমি মামুন ভাইকে বিয়ে করে ফেলো।
সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে চারুর মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। বলে,
-মামুন ভাই কি রবিন হুড?
-সে তোমাকে অনেক চায় আপা।
-তুই নিজেও তো মামুন ভাইকে পছন্দ করিস।
-আমি তো তাকে পছন্দ করি কারণ সে তোমাকে ভালোবাসে সেজন্য আপা, অন্য কিছু না।
-তোর পছন্দ টা যেমন ভালোবাসা না, তেমন মামুন ভাই আমাকে চায় বলেই যে আমাকে তার পাইতে হবে এমন কোনো কথা নাই।
-কিন্তু মামুন ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে তোমার এত কষ্ট আর থাকবে না আপা।
-আমি কষ্টে আছি কে বলল তোকে?
-আমি জানি।
-কি জানিস তুই?
-তোমার অনেক কষ্ট। মামুন ভাই তোমাকে অনেক সুখে রাখবে আপা।
-সেটা নাহয় রাখলো। বিয়ে করলে আমি তার বউ হবো। আমাকে সুখে রাখা তার দায়িত্ব। কিন্তু তোদের কি হবে তখন?
-মামুন ভাই তো আমাদেরও অনেক পছন্দ করেন, আদর করেন। উনি নিশ্চয়ই আমাদের ফেলে দিবেন না।
-সেটা মামুন ভাই দিবে না তা আমিও জানি। কিন্তু মামুন ভাই নিজেই তো তার বাবার টাকায় খায়। বিয়ে করলে বউকেও তার বাবার টাকাতেই খাওয়াবে। সে কি চাইলেই তোদের দায়িত্ব নিতে পারবে?
-তার আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে না। শুধু তোমাকে সুখে রাখলেই হবে।
-তোর কেন মনে হলো তোদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে আমি আরাম-আয়েশের জীবন খুঁজবো?
-তুমি তো কখনই নিজের কথা ভাবো না তাছাড়া…
-তাছাড়া কি?
চারু চুপ করে থাকে। তা দেখে চিত্রলেখা তাগাদা দিয়ে বলে,
-তাছাড়া কি বল?
-এলাকার অনেকেই খালাকে বলে তোমাকে এখন বিয়ে না দিলে পরে তোমার আর বিয়ে হবে না। এমনিতেই তুমি চাকরী করো এটা নিয়েও নাকি অনেক সমস্যা হবে।
-আচ্ছা এতক্ষণে বুঝলাম আসল ঘটনা।
চারুর মাথায় হাত রেখে চিত্রলেখা আরও বলে,
-শুন, লোকের কাজ হচ্ছে কথা বলা। তারা বলুক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার জন্য তোরা সব কিছুর উর্ধ্বে। এরপর এসব কথা শুনবি না। শুনলেও এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে ফেলবি।
-কিন্তু আপা…
-তোদের একটা ব্যবস্থা না করে আমি কোথাও যাচ্ছি না চারু। তোরাই আমার সব, তোদের ফেলে আমি কোথাও যাবো না। এমনকি ম র বোও না।
-তাই বলে তুমি বিয়ে করবা না?
-বিয়ে যদি আমার নসিবে লেখা থাকে তাহলে সময় মতো এমনিই হবে। আর না হলে বুঝে নিবো আল্লাহ আমার জন্য কাউকে বানায়নি।
চারু আরও কিছু বলতে নিলে ওকে বাঁধা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-অনেক হইছে চারু এখন আর একটা কথাও না। ঘরে চল ঘুমাবি।
-কিন্তু আপা…
চিত্রলেখা চারুর মুখ চেপে ধরে ওকে টেনে নিয়ে ঘরে চলে যায়। আর কিচ্ছু বলার সুযোগ দেয় না। চিত্রলেখা নিজের দায়িত্ব কখনোই কারো কাঁধে চাপিয়ে দিতে চায় না। ভাইবোনগুলোর জীবন সে নিজের হাতে সাজিয়ে দিতে চায় সুখ, শান্তিতে। শুধু ওরা নিজ নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে গেলেই চিত্রলেখার মুক্তি। তারপর নাহয় খালাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। হয়ত পাহাড়ের কাছাকাছি। চিত্রলেখার ভীষণ পাহাড় পছন্দ কিন্তু কখনো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। ওরা যার যার জীবনে সেটেল্ড হয়ে গেলে নাহয় সে নিজের অবশিষ্ট জীবনটুকু কোনো এক পাহাড়ের কাছাকাছি সবুজে ঘেরা এলাকায় গিয়ে কাটিয়ে দিবে। এতটুকু ইচ্ছাই চিত্রলেখা নিজের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। এর বেশি তার চাই না।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
-তোমার মুখটা এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন মায়া?
মামুনের প্রশ্নের জবাবে দেয়ার মতো উত্তর খুঁজে পায় না চিত্রলেখা। মামুনের জন্য ওর মনে বিশেষ কোনো অনুভূতি আছে কিনা তা সে জানে না। তবে বেচারার জন্য অনেক মায়া হয় ওর। মানুষটার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। বরং মাঝেমধ্যে চিত্রলেখার নিজেকেই অভাগা মনে হয় এমন নিখাদ ভালোবাসা তার দুয়ারে ভিক্ষারির মতো পথ চেয়ে অপেক্ষমাণ কিন্তু হাত বাড়িয়ে সে তা গ্রহণ করতে পারছে না। চাইলেও আফসোস করতে পারে না চিত্রলেখা। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মামুন বলে,
-কই হারায় গেলা মায়া?
-কিছু না মামুন ভাই।
-কি হইছে আমাকে বলো।
-কিছু হয় নাই মামুন ভাই। আপনার কেন মনে হলো কিছু হয়েছে?
-তোমার চোখ দেখলে আমি বলতে পারি তুমি ভালো নাই।
চিত্রলেখার বুক উপচে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। বলে,
-আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। আপনি অহেতুকই চিন্তা করছেন।
মামুন আর কিছু বলে না। কেবল ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয় তার মায়ার মুখের দিকে। তাগাদা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-আজ আসি মামুন ভাই। অফিসের জন্য লেইট হয়ে যাচ্ছে।
মামুন আর আটকায় না। বিনয়ের সঙ্গে বলে,
-আমি তোমাকে অফিসে পৌছায় দেই?
-কোনো প্রয়োজন নাই মামুন ভাই। আমি যেতে পারবো।
মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে পাশ কেটে চলে যায় চিত্রলেখা। প্রতিদিনের মতো মামুন একলা নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়। আশায় বুক বাঁধে একদিন তার মায়া ঠিকই তার ভালোবাসার আহ্বানে সাড়া দিবে। সেই দিন আসা পর্যন্ত হাল ছাড়বে না সে। এই জীবনে সুখী হতে মামুনের আর কিচ্ছু চাই না। কেবল মায়াকে চাই। মায়াকে তার লাগবেই।
মামুন ব্যস্ত তার মায়ার যাবার পথে তাকিয়ে থাকতে। চিত্রলেখা গলির মাথায় গিয়ে ডানে মোড় দিতেই হারিয়ে গেলো। তবুও মামুনের দৃষ্টি সরে না। সে তাকিয়ে থাকে ঐ পথ ধরে। তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পেছন থেকে এগিয়ে এসে চারু বলে,
-আপাকে দেখছেন বুঝি মামুন ভাই?
চারুর কন্ঠ কানে আসতেই পেছন ঘুরে মামুন মিষ্টি করে হেসে বলে,
-কই যাও?
-কোচিংয়ে যাচ্ছি। আপনি কি করছিলেন?
-কিছু না।
-আপনার বাইকে করে আমাকে দিয়ে আসবেন?
-আমার পিছনে বসে গেলে লোকে যদি মন্দ বলে?
-বললে বলুক তাতে আমার কি? লোকের কথা এত শুনলে তো সমস্যা। সবার কথা তো শুনা যাবে না মামুন ভাই৷ তাছাড়া এলাকার সবাই জানে আপনি আপাকে পছন্দ করেন, বিয়ে করতে চান। সেই হিসাবে তো আমি আপনার বাইকে উঠতেই পারি। পারি না মামুন ভাই?
-তা অবশ্য পারো।
-তবে আপনি যদি না নিতে চান তাহলে সেটা ভিন্ন কথা।
-না না তেমন কিছু না। তোমার আপাকে বহুবার বলছি সে কখনো উঠে নাই। তার চিন্তা লোকে কি বলবে। তাই ভাবলাম তুমিও তোমার আপার মতোই ভাবো কিনা।
-আপার কথা বাদ দেন তো। আপার মাথায় একশ একটা চিন্তা।
-কিসের চিন্তা?
-আপার চিন্তার কি শেষ আছে?
-শুনি কি এত চিন্তা তোমার আপার।
-যেতে যেতে বলি মামুন ভাই? নাহলে আমার দেরি হয়ে যাবে যে।
-আচ্ছা চলো তোমাকে নামায় দিয়ে আসি। যাইতে যাইতে তোমার আপার কথা শুনবো নাহয়।
মামুন বাইকে উঠে বসে হেলমেট পরতেই চারু তার পেছনে উঠে বসে।
একটু আগেই চিত্রলেখার সামনে দিয়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করেছে রওনক। কথা হয়নি তাদের। এমনকি চোখাচোখিও হয়নি আজ। রওনক মনে হয় তাড়ায় ছিল। ঝড়ের গতিতে নিজের কেবিনে চলে গিয়েছে। চিত্রলেখা ঠিকঠাক টের পাবার আগেই ভেতরে চলে গেছে সে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার সময়ও পায়নি। অর্ধেক উঠে ছিল কেবল। পুরোপুরি না দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ে। ওকে অন্যমনস্ক দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে টেবিলের উপর খটখট করে বার দুই শব্দ করে লাবিব। এতে করে অন্যমনা ভাবটা কাটে চিত্রলেখার। চোখ-মুখ তুলে উপরের দিকে তাকায় সে। চিত্রলেখাকে চোখ বড় করে তাকাতে দেখে লাবিব জিজ্ঞেস করে,
-আর ইউ ফাইন?
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। লাবিব বিশ্বাস করে না। বরং জোর দিয়ে জানতে চায়,
-নো, সামথিং ইজ রঙ ফর সিওর। কি হয়েছে বলো তো?
-কিছু হয়নি।
-উঁহু, তোমার চোখ মুখ অন্য কথা বলছে।
-সত্যি তেমন কিছু না। রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মতো তাই হয়তো এমন লাগছে।
-সিওর?
-একদম।
-তাহলে বসে আছো যে?
-কিছু করতে হবে?
-স্যার এসেছে চা বানাবে না?
-ও হ্যাঁ চা। এক্ষুনি বানাচ্ছি।
-তুমি হয়তো আমায় বলতে চাইছো না তাই ফোর্স করছি না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে এটা কনফার্ম। নাহলে অন্তত সকালের চায়ের কথা আমার তোমায় বলে দিতে হতো না।
চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। লাবিব ধরে ফেলেছে। কিন্তু এমন একটা বিষয় ও চাইলেই কাউকে বলতে পারবে না। কি বলবে? বস ওকে জোকের বসে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। এটা কি আদৌ কাউকে বলার মতো বিষয়? আর যদি বলেও দেয়। লাবিব ভাববে ওরই মাথা নষ্ট হয়েছে সেজন্য উল্টাপাল্টা বকছে। তাই এই বিষয়ে কিছু না বলে সম্পূর্ণটাই চেপে গেলো। উঠে যাবার আগে শুধু বলল,
-চা বানিয়ে আনছি এক্ষুনি।
রওনককে অফিসে সকালের চা-টা প্রতিদিন চিত্রলেখাই দেয়। কিন্তু আজ লাবিব নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপটা সামনে নামিয়ে রাখতেই রওনক জিজ্ঞেস করে,
-চিত্রলেখা কোথায়?
-ওর ডেক্সেই আছে। ডেকে দিবো?
-তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি চা নিয়ে এলে সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম।
লাবিব আর কিছু বলে না। বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। লাবিব কেবিন থেকে বের হবার মিনিট খানিকের মাথায় রওনক তার কেবিনের দরজা অর্ধেক খুলে মাথা বের করে বলে,
-চিত্রলেখা একটু ভেতরে আসো।
সে চাইলে ইন্টারকমে কল করেই ডাকতে পারতো। এভাবে ডাকায় লাবিব ও চিত্রলেখা একে-অপরের দিকে তাকায়। এমনকি লাবিব ইশারায় জানতেও চায় ঘটনা কি? চিত্রলেখা জানি না এমন একটা ইঙ্গিত দিয়ে ভেতরে চলে যায়। রওনক তার টেবিলের কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। চিত্রলেখাকে দেখে সে চায়ের কাপে আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখে। পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে দিয়ে বলে,
-বসো।
-ইটস ওকে স্যার।
-নো, ইটস নট ওকে। সিট ডাউন, প্লিজ।
চিত্রলেখা বাড়তি কথা না বলে চুপচাপ বসে পড়ে। রওনক আরেকটা চেয়ার টেনে একদম মুখোমুখি বসে পড়ে। এতে করে চিত্রলেখার অস্বস্তি বাড়ে। ওড়নার নিচে আড়াল করে রাখা হাত মুঠ করে রেখেছে সে। রওনক এক মিনিট চুপচাপ চিত্রলেখাকে অবজারভ করার পর বলে,
-রাতে ঘুম হয়নি তাই না?
রওনকের এমন প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা। সে আরও বলে,
-চায়ে চিনি হয়নি আজ। নিশ্চয়ই চা বানানোতে মন ছিল না তোমার।
ব্যস্ত ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করলে রওনক বাঁধা দিয়ে বলো,
-প্লিজ বসো।
-আমি আরেক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
-আপাতত আর প্রয়োজন নেই। চিনি কম হলেও চা মন্দ হয়নি। সবসময়ের মতো চমৎকারই হয়েছে।
-তবুও…
-বললাম তো আপাতত প্রয়োজন নেই।
বাধ্য হয়েই শান্ত হয়ে বসার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। রওনক আরও মিনিটখানিক চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলে,
-আই এম সরি তোমাকে একটা অকওয়ার্ড সিচুয়েশনে ফেলে দেয়ার জন্য। আই এম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট।
চিত্রলেখা কি বলবে খুঁজে পায় না। এই মুহূর্তে আসলে তার কি বলা উচিত জানা নেই তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। রওনক আরও বলে,
-তোমাকে আর ঐ বিষয়টাতে ভাবতে হবে না। তুমি ধরে নিতে পারো আমি ঐ কথাটা তোমায় বলিনি। তখন কেনো স্টুপিডের মতো কিছু না ভেবেই তোমাকে ওভাবে কথাটা বললাম আমি নিজেও জানি না। আর সেজন্য আই এম রিয়েলি ভেরি সরি।
এবারে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক আরও বলে,
-সিট ডাউন চিত্রলেখা, লেট মি ফিনিশ।
কিন্তু চিত্রলেখা বসে না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলে,
-ইটস ওকে স্যার। এভরি পিপল মেক্স মিস্টেক। ইটস অলরাইট। ইউ ডন্ট হেভ টু এক্সপ্লেইন মি। আই এম টোটালি ফাইন।
রওনককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় চিত্রলেখা। ও মনে মনে যা ভেবেছিল হলো ঠিক তাই। বিয়ের কথাটা যে রওনক জোকের বসেই বলেছে তা চিত্রলেখা ঠিকই ধরতে পেরেছিল।
মামুনের বাইক থেকে নেমে কোচিংয়ে ডুকার আগে চারু বলে,
-একটা কথা বলি মামুন ভাই?
-বলো।
-আপনি আপাকে বিয়ে করে নিন। আপনাকে বিয়ে করলে আমার আপা অনেক ভালো থাকবে।
-তোমার কেন মনে হইলো আমাকে বিয়ে করলে তোমার আপা ভালো থাকবে?
-কারণ আপনি আপাকে অনেক ভালোবাসেন। ভালোবাসা ছাড়া ভালো থাকা যায় না মামুন ভাই।
মামুনের মনে হলো কথাটা বলার সময় চারু মনের ভেতর অদৃশ্য কষ্ট অনুভূব করেছে। তাই জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি কি কাউকে ভালোবাসো চারু?
-জানি না মামুন ভাই। যাই আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
চারু ভেতরে চলে গেলে মামুন দাঁড়িয়ে রয় ওখানেই কিছুক্ষণ। গভীর কোনো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় সে।
নিজের চেয়ারে ফিরে এসে দু গ্লাস পানি খেয়েছে চিত্রলেখা। জানা নেই কেনো কিন্তু এই মুহূর্তে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে ওর। এমন একটা ফাজলামো ওর সাথে না করলেও পারতো। লাবিব এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
-কি হয়েছে?
-কিছু না।
-কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে…
লাবিবকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চিত্রলেখা বলে,
-কিচ্ছু হয়নি। আই এম ফাইন।
লাবিব বুঝতে পারে চিত্রলেখা বিরক্ত হচ্ছে তাই আর ঘাটায় না। নিজের চেয়ারে ফিরে যায়। সবেই চিত্রলেখা আরেক গ্লাস পানি হাতে নিয়েছে আর তখনই তার ইন্টারকমটা বেজে ওঠে। পানির গ্লাসটা নামিয়ে রেখে রিসিভার তুলে কানে দিতেই অন্যপাশ থেকে রওনক বলে,
-আমার কথা শেষ হয়নি চিত্রলেখা। তুমি যদি না চাও আমি লাবিবের সামনে গিয়ে কিছু বলি তাহলে ১ মিনিটের মধ্যে ভেতরে আসো। ইউর কাউন্ট ডাউন স্টার্স্ট নাও।
ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা রওনকের কেবিনে গিয়ে ডুকতেই চমকে ওঠে। রওনক দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। এই কেবিনটা উপরের কেবিনের মতো নয় তাই বাহির থেকে দেখা যায় না। চিত্রলেখা ভেতরে প্রবেশ করতেই রওনক দরজাটা লক করে দিয়ে দাঁড়ায়। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে বলে,
-আমি শেষ না করা পর্যন্ত একটা কথাও বলবে না।
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক বলে,
-ওভাবে বলা আমার একদম উচিত হয়নি। বরং আমার বলা উচিত ছিল যদি তোমার আপত্তি না থাকে, যদি তুমি রাজি থাকো, যদি তোমার অনুমতি থাকে তাহলে কি আমি তোমায় বিয়ে করতে পারি?
চিত্রলেখার মাথার ভেতর ভনভন করতে লাগে। এই লোকটা এমন কেনো ভেবে পায় না ও। এর এক কথায় চিত্রলেখার দিন-দুনিয়া ঘুরতে শুরু করে দেয়। রওনক আরও বলে,
-আমাকে কি তোমার নিজের যোগ্য মনে হয় চিত্রলেখা? ইউল ইউ প্লিজ মেরি মি?
চিত্রলেখাকে ভূ ত দেখার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে রওনক আরও বলে,
-এক্ষুনি তোমায় কিছু বলতে হবে না। টেক টাইম এন্ড থিং কেয়ারফুলি। পরে নাহয় জানিয়ে দিও।
এতটুকু বলেই দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় সে। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চিত্রলেখা নবে হাত রাখতেই রওনক আরও বলে,
-কিন্তু জবাব টা কিন্তু ইয়েসই চাই আমার। যত সময় লাগে নাও তবে নো কিন্তু এক্সেপ্টেবল হবে না। আই ওয়ান্ট এ ইয়েস ফ্রম ইউ। হোয়াইল ইউ টেক এনি ডিসিশান জাস্ট রিমেমবার দ্যাট আই ওয়ান্ট টু মেরি ইউ।
চিত্রলেখার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। ওর পা দু’টো জমে গেছে মনে হচ্ছে। চোখ সরাতে পারে না ও রওনকের চোখ থেকে। আটকে গেছে কোথায় যেন। খানিকটা হারিয়েও গেছে ঐ চাহনিতে।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
বৃষ্টিদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে লিখন। ও এসেছে খুব বেশি একটা সময় হয়নি, মিনিট পাঁচের মতো হয়েছে। এমন একটা সময় না তো এখন সকালের নাস্তা করার সময় আর না দুপুরের খাওয়ার সময়। দরজা খুলে লিখনকে দেখতে পেয়েই সালেহা বেগম ওকে বসতে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে নাস্তা রেডি করতে। তড়িৎ গতিতে ভেতরের দিক চলে যান উনি তাই লিখন আর উনাকে কিছু বলার সুযোগ পায় ন। তাই অগত্যাই ওকে বসে থাকতে হয়েছে অপেক্ষায়, এতে অবশ্য সমস্যা নেই ওর। বৃষ্টি, নাঈম দুই ভাইবোনের একজনও বাসায় নেই তা বেশ আন্দাজ করতে পারছে। অন্তত নাঈম থাকলে বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। ঘর-বাড়ি এমন ঠান্ডা পড়ে থাকতো না। বৃষ্টি না থাকায় অবশ্য বেশ ভালোই হয়েছে লিখনের। চট জলদি কথা সেরে চলে যেতে পারবে। বিদায় নেয়ার দিন বৃষ্টি নিজের ঘরের খিল দেয়ার পর আর বেরিয়ে আসেনি। এমনকি এর মধ্যে নাঈম বেশ কয়দিন কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওর কাছে গেলেও বৃষ্টি একদিনও যায়নি। এমনকি একদিন একটা ফোনও দেয়নি। পড়া সংক্রান্ত কোনো হেল্পও চায়নি। লিখন পড়ানো বাদ দেয়ার একদিন পরেই তার এক বন্ধু এসেছিল ওদের পড়াতে বৃষ্টি তাকে মুখের উপরেই বলে দিয়েছিল সে পড়বে না। বন্ধুর কাছে এজন্য লজ্জায় পড়তে হয়েছিল লিখনকে খানিকটা। রিপাও দুটো কথা শুনিয়েছিল কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হয়নি লিখনের। ও কেবল বৃষ্টির ভালো চায়। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো তাই চায় না কোনো ভাবে ছিটকে পড়ুক।
মিনিট দশেক পরে ট্রেতে করে পাউরুটি, জ্যাম, ডিম পোজ, চা সহ ফিরে আসেন সালেহা বেগম। নাস্তার ট্রে টা লিখনের সামনে নামিয়ে রেখে বলেন,
-আগে একটু খাওয়া দাওয়া করো বাবা। তারপর নাহয় কথা বলবো।
-আমি কিছু খাবো না খালাম্মা। একটা জরুরী আলাপ করতে এসেছি। কথা সেরেই বেরিয়ে যাবো।
সালেহা বেগম লিখনকে বাঁধা দিয়ে বলেন,
-সব কথা শুনবো কিন্তু পরে আগে তুমি খাও। কতদিন আসো না আমাদের বাসায়। ভালো মন্দ রান্না করলে আমরা তোমারে কত মিস করি বলো তো। সেদিনের পরে তুমি তো একটা দিন আর আসলাও না।
-আসলে খালাম্মা পড়ালেখার চাপে সময় পাই না একদম। কিন্তু নাঈম গিয়েছিল পড়া বুঝতে ওকে আমি বুঝায় দিয়েছি।
-সেই খবর আমি জানি। এখন আগে খাও তো পরে কথা বইলো।
এক ফাঁকে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে সালেহা বেগম আরও বলেন,
-তুমি নাস্তা করতে করতে বৃষ্টিও আইসা পরবে।
-বৃষ্টি এই সময় বাসায় আসে?
-হ্যাঁ, কোচিং করে বাসায় আসে তারপর কলেজে যায়।
-ও আচ্ছা।
সালেহা বেগমের জোরাজুরির কাছে হার মেনেই বাধ্য হয়ে লিখন একপিস ব্রেড ও ডিম পোজ অর্ধেকটা খায়। সম্পূর্ণ খাওয়াও হয়নি ওর এর মধ্যেই বৃষ্টি চলে আসে। ড্রইং রুমে লিখনকে দেখতে পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় বৃষ্টি। তারপর নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে। এসব দেখে সালেহা বেগম পেছন ডেকে বলেন,
-এসব কি বৃষ্টি? লিখন যে বসে আছে। ওকে দেখতে পাস নাই তুই? এটা কোন ধরনের বেয়াদবি কোনো সালাম নাই, আদব নাই। এদিকে আয়।
-রেডি হবো মা কলেজে যাবো। আর উনি নিশ্চয়ই আমার কাছে আসে নাই। তোমার কাছে আসছে। তুমি মেহমানদারি করো। এখন তো আর উনি আমার শিক্ষক না যে দেখার সাথে সাথেই কদমবুসি করা লাগবে।
এতগুলো কথা বলে আর অপেক্ষা করে না বৃষ্টি নিজের ঘরে চলে যায়। পেছনে মেয়ের কান্ডের জন্য লজ্জায় পড়ে যান সালেহা বেগম। কি বলবেন বুঝে পান না। তা বুঝতে পেরে লিখন নিজেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,
-থাক খালাম্মা ওর না থাকলেও চলবে। আমি আসলেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসছি। কথাটা বলেই চলে যাবো।
-আচ্ছা বাবা বলো আমি শুনছি।
-আমি মূলত একটা অনুরোধ নিয়ে আসছি।
-কি অনুরোধ?
-আপনি কি আঙ্কেলকে একটু বলবেন উনার চেনা জানার মধ্যে আমার জন্য একটা চাকরী দেখে দিতে। উনার তো অনেক লিংক আছে, পরিচয় আছে। উনি চাইলে আমাকে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।
-সে নাহয় পারবে কিন্তু তুমি আসলেই চাকরী করবা?
-জি খালাম্মা, আমার এই মুহূর্তে একটা চাকরী ভীষণ দরকার।
-কিন্তু তোমার তো সামনে ফাইনাল পরীক্ষা আবার আইএলটিএসের ক্লাসও করতেছো তুমি। এতকিছু সামলে কি আসলেই চাকরী করতে পারবা?
-পারতে হবে খালাম্মা। আপনি একটু আঙ্কেলকে জোর দিয়ে বলুন আমার হয়ে, যেন একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেয়।
সালেহা বেগমকে খানিকটা চিন্তিত দেখায়। লিখনের সাথে উনাদের অনেক বছরের সম্পর্ক। অনেকদিন ধরে দেখছেন তিনি ছেলেটাকে। গতমাসেই নিজের পড়ার জন্য টিউশনি ছেড়ে দিলো অথচ আজ এসে বলছে তার চাকরী প্রয়োজন। কিছু না জেনেই সালেহা বেগম যথেষ্ট আন্দাজ করতে পারছেন একান্তই প্রয়োজন না হলে বা বড় ধরনের কোনো সমস্যা না হলে লিখন এভাবে চাকরীর জন্য আসতো না। লিখনকে আশ্বস্ত করতে সালেহা বেগম বলেন,
-তুমি চিন্তা কইরো না বাবা। আমি আজকেই বৃষ্টির বাবার সঙ্গে আলাপ করবো। জোর দিয়ে বলবো যেন জলদিই একটা ব্যবস্থা করেন। তুমি একদম নিশ্চিত থাকতে পারো। তবে আমি তোমারে একটা কথা বলতে চাই।
-বলেন খালাম্মা।
-তুমি চাইলে আবার ওদের পড়াতে পারো। যদি তোমার একান্তই দরকার হয়।
-টিউশন দিয়ে সংসার চালাতে পারবো না খালাম্মা। একটা খুব বেশি ভালো না হলেও মোটামোটি বেতনের চাকরী হলেও আপাতত আমার চলবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
আর সময় নষ্ট না করে দাঁড়িয়ে পড়ে লিখন। বলে,
-আজ আসি খালাম্মা। আমি পরে ফোন দিয়ে খবর নিবো নাহয়।
-বৃষ্টির সাথে কথা বলবা না যাওয়ার আগে?
বৃষ্টির ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে লিখন বলে,
-ও হয়ত আমার সাথে কথা বলতে চায় না। থাক, ওকে ডিস্টার্ব না করি। অন্য কোনোদিন নাহয় কথা বলবো। আজ আসছি।
বিদায় নিয়ে আর দাঁড়ায় না লিখন। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
রওনকের ঐ কথা বলার পর থেকে চিত্রলেখা আর এক মুহূর্তের জন্যও কাজে মন বসাতে পারেনি। বেচারী এতখানিই ডিস্টার্ব হয়ে গেছে যে কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছে না। এই মুহূর্তে এক কাপ চা খেতে পারলে হয়ত মন ও মস্তিষ্ক এক জায়গায় করতে পারতো। তাই চা বানাবে বলে উঠতে নিলেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ভাসতে থাকা নামটা দেখে একবার স্বস্তি নিঃশ্বাস ছাড়ে চিত্রলেখা। নিজের মন ও মস্তিষ্ককে ঠিক করার ঔষধ পেয়ে গেছে সে।
লাবিব রওনকের টেবিলে একটা ফাইল রেখে ফিরে আসতে নিলেই তাকে পেছন ডেকে রওনক বলে,
-চিত্রলেখাকে একটু পাঠিয়ে দাও তো।
ফিরে এসে লাবিব বলে,
-কি করতে হবে আমায় বলুন করে দিচ্ছি।
রওনক সাদা কাগজে ড্রাফ লিখছিল হাতে। কলম বন্ধ করে মুখ তুলে উপরের দিকে তাকায়। এক পলক লাবিবকে দেখে নিয়ে বলে,
-তুমি না চিত্রলেখাকে পাঠিয়ে দাও।
-চিত্রলেখা অফিসে নেই।
আবার লেখা বন্ধ করে মুখ তুলে লাবিবের দিকে তাকায় রওনক। চেয়ারে হেলান দিয়ে ইজি হয়ে বসে সে।
-অফিসে নেই তো কোথায় গেছে?
-সেটা তো বলতে পারছি না। ঘন্টাখানিক আগে আচমকাই আমাকে আধা বেলার লিভ এপ্লিকেশন ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
-কোথায় গেছে বা কি কারণে গেছে কিছু বলে যায়নি?
-না, আমি বলেছিলাম আপনাকে জানিয়ে বের হতে। বলল ওর বের হওয়াটা জরুরী আমি যেনো সামলে নেই। ও তো কখনো এভাবে ছুটি নেয় না তাই মনে হলো হয়ত জরুরী কোনো প্রয়োজন হবে সেজন্য আর বাঁধা দেইনি।
রওনকের চোখ-মুখে খানিকটা চিন্তিত ভাব ফুটে ওঠে। লাবিব বলে,
-কি করতে হবে আমায় বলুন করে দিচ্ছি এক্ষুনি।
রওনক তার হাতের কাছে থাকা ড্রাফট পেপারটার লাবিবকে দিয়ে বলে,
-এটা টাইপ করে নিয়ে এসো।
লাবিব বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করে,
-এনি থিং রং? আপনাকে কেমন যেনো লাগছে। কিছু কি হয়েছে?
রওনক উত্তর করে না কেবল তাকিয়ে রয়। তা দেখে লাবিব আরও বলে,
-আপনার বিষয়ে অনেক কিছুই আমি জানি। আমি আপনার পিএ তবুও আপনি নিজের বিষয়ে অনেক কথাই আমার সাথে শেয়ার করেছেন নিজের ইচ্ছায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কিছু একটা হয়েছে যা আমি এখনো জানি না। আমার অবর্তমানে কিছু না কিছু একটা তো হয়েছেই। চিত্রলেখাকেও সকাল থেকে দেখলাম কেমন উইয়ার্ড বিহেভব করছে। আপনার বিহেভিয়ারও অন্যান্য দিনের মতো নয়। হোয়াট হ্যাপেন? আমাকে কি বলা যায় না? আমি কি জানার এখতিয়ার রাখি না?
লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রওনক বলে,
-বসো।
তৎক্ষনাৎই চেয়ার টেনে বসে পরে লাবিব। ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে,
-জানি না চিত্রলেখা কোথায় গেছে তবে এটা জানি কেনো গেছো।
-কেনো?
-আমার থেকে পালাতে।
রওনকের কথার মানে ধরতে পারে না লাবিব। যার চাকরি করছে তার থেকে পালাবে কেনো? লাবিব যেন বুঝতে পারে তাই রওনক ক্লিয়ার করে বলে,
-আই প্রোপজড হার।
-কি!
বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে নিম্ন সরে জিজ্ঞেস করে লাবিব। রওনক আরও পরিষ্কার করে বলে,
-আমি চিত্রলেখাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।
এমন একটা কথা শুনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না লাবিব। এমন একটা কথা শুনতে হবে তা সে চিন্তাই করেনি। নিজের কানে শুনা কথা একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ড্যাবড্যাবে চোখ করে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে রয় লাবিব। বেচারাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথার উপর বজ্রপাত হয়েছে তাই সে জমে গেছে। সেয়ি সঙ্গে কথা বলতেও ভুলে গেছে যেনো।
চলবে…