#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
বারান্দার গ্রীলের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। যদিও এটা চৈত্রমাস নয় তবু তার মনের ভেতর চৈত্রের খড়া। তৃষ্ণায় ভেতরটা খা খা করছে। তবে এই তৃষ্ণা পানির নয়। কিসের তা জানতে চায় না চিত্রলেখা। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার খোলা চুলও উড়ছে। বাতাসের মৃদু ধাক্কায় ওড়নাটাও একদিক সেদিক করছে। মস্তিষ্কের ভেতরে তার হাজারটা চিন্তা ভাবনার ছড়াছড়ি। এসব চিন্তা ভাবনার শুরু আছে কিন্তু কোনো শেষ নেই। নেই কোনো মানে। তাও ভাবনা মস্তিষ্কের ভেতর শেকড় গজিয়েছে।
হাই তুলতে তুলতে চোখ ডলে বোনের পাশে এসে দাঁড়ায় চারু। চিত্রলেখার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলে,
-তুমি এখানে দাঁড়ায় আছো কেন আপা?
বলতে বলতেই আবার হাই তুলে। চিত্রলেখা চারুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
-তুই উঠে আসলি কেন?
-ঘুম ভেঙে গেল। তাকায় দেখি তুমি নাই। তাই দেখতে আসলাম তোমাকে।
-তোর চোখে অনেক ঘুম। যা ঘুমায় পর।
-তুমি ঘুমাবা না?
সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-ঘুম আসছে না।
-কেন আপা? কারো কথা ভাবতেছো?
❝কারো কথা ভাবতেছো?❞ জিজ্ঞেস করায় বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে চিত্রলেখার। প্রশ্নটা কোথায় গিয়ে যেনো বিঁধে। কারো কথা ভাবার অবকাশ কি ওর আছে? হু হু করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় চিত্রলেখার বুক চিঁড়ে। সেসব দীর্ঘশ্বাস আড়াল করতে গিলে ফেলে সে। বোনকে ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে চারু আরও বলে,
-একটা প্রশ্ন করি তোমারে আপা?
-কর।
-তোমার কি কখনো কাউকে ভালোবাসতে মন চায় না? কখনো কারো প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে না? শুনেছি প্রেম, ভালোবাসা নাকি স্বর্গীয় সুখ দেয়।
এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-না।
-কেন?
ব্যাখ্যা চায় চারু। জবাবে চিত্রলেখা বলে,
-প্রেম, ভালোবাসা অপাত্রে হলে জীবনটা বিষের মতো লাগে। ভালোবাসা যতখানি সুন্দর, অপাত্রে সেই ভালোবাসাই কাটার মতো বিষাদময়। ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন তা সুপাত্রে হয়। অপাত্রে ভালোবাসা হয়ে গেলে জীবন শেষ হয়ে যায়।
-অপাত্র! ভালোবাসার মানুষ কি কখনো অপাত্র হয়?
-হু, অপাত্র হয়। যাকে ভালোবাসবো সে যে সুপাত্রই হবে তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? দিতে পারবে কেউ গ্যারান্টি? মানুষ চিনা কি খুব সহজ?
বড় বোনের কথা ভাবায় চারুকে। জীবন নিয়ে চিত্রলেখার চিন্তাভাবনা শুধু বাস্তবিক নয়, কঠিন বাস্তবিক। আবেগে সে কখনোই গা ভাসায়নি। মূলত তার জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে সেই সুযোগ, অনুমতি কখনোই দেয়নি। তা চারুর অজানা নয়। আপাতত এইসব কঠিন বাস্তবিক চিন্তা ভাবনা হাতে ঠেলে চারু বোনের হাত টেনে ধরে বলে,
-চলো আপা ঘুমাবা।
-আমার ঘুম আসছে না, তুই ঘুমায় পর।
-আসো তোমার চুল টেনে দেই আরাম লাগবে, ঘুমও আসবে।
চিত্রলেখার মন চাইছে না ঘরে গিয়ে বিছানায় মাথা রেখে চোখ বন্ধ করতে। চোখের পাতা মিলালেই সেখানে কারো অবয়ব ভেসে উঠছে। কারো চলে যাওয়ার দৃশ্য। চোখ বন্ধ করে ওসব দেখার চাইতে মুক্ত আকাশ দেখতে ভালো লাগছে। কিন্তু চারুর জোরাজোরিতে ফিরে যেতে হয় বিছানায়।
বন্ধের দু’দিন বাসায় কাটিয়ে আজ আবার অফিসে এসেছে চিত্রলেখা। যদিও রওনক তাকে বলেছিল চাইলে আরও ২/১ দিন বাসায় থেকে বিশ্রাম করতে পারে। কিন্তু চিত্রলেখা নিজেই বাসায় থাকেনি। এমনও আহামরি কোনো শরীর খারাপ হয়নি যার জন্য বাসায় বসে ছুটি কাটাতে হবে। বরং এই দু’দিন বাসায় থেকেই অনেকটা হাপিয়ে উঠেছে বেচারী। ভাই-বোনদের অতিরিক্ত আদর-যত্নে আর আরামে বিরক্ত ধরে গেছে খানিকটা। তাই স্বাভাবিক হতে অফিস চলে এসেছে। অহেতুক ছুটি কাটানোর পক্ষে চিত্রলেখা কখনোই নেই। অফিস বিল্ডিংয়ে ডুকতেই রিসিপশনের মেয়েটা চিত্রলেখাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে আসে ওকে ডাক দিয়ে।
-চিত্রলেখা ম্যাম।
মেয়েটার ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা। অপারেটর ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রোমোশন হয়ে রওনকের অফিসে যাওয়ায় এই একটা সুবিধা হয়েছে। এখন অফিসের অনেকেই তাকে ম্যাম বলে ডাকে। আগে অনেকেই নাম ধরে ডাকতো, কেউ বা এই ঐ বলেই সম্বোধন করতো। কিন্তু যেদিন থেকে প্রোমোশন হয়ে রওনকের সঙ্গে কাজ শুরু করলো সেদিন থেকে অনেকেরই আচরণ বদলে গেছে। বেশির ভাগই ম্যাম বা ম্যাডাম বলেই সম্বোধন করছে। মেয়েটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
-ভালো আছি ম্যাম। আপনার নাকি শরীর খারাপ করেছে। এখন কেমন আছেন?
❝এই খবর অফিসে জানাজানি হয়ে গেছে!❞ মনে মনে ভাবে চিত্রলেখা। মুখে কেবল হেসে বলে,
-এখন ভালো আছি।
-আপনি স্যারের অফিসে যাচ্ছেন?
-অফিসেই তো যাবো। আর কোথায় যাবো?
-আপনাকে কষ্ট করে টপ ফ্লোরে যেতে হবে না।
-মানে? বুঝলাম না।
-সিইও স্যারের অফিস এখন সেকেন্ড ফ্লোরে।
-সেকেন্ড ফ্লোরে!
-হ্যাঁ, উপর থেকে নামিয়ে তিন তলায় অফিস সিফট করা হয়েছে।
-হঠাৎ ফ্লোর চেঞ্জ কেনো?
-সেটা তো আমি বলতে পারছি না ম্যাম। আমাকে বলা হয়েছিল সবাইকে জানিয়ে দিতে। আপনাকেও ফোন করতে বলা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম আপনি আজ আসবেন না। একটু পরেই ফোন করতাম আপনাকে। কিন্তু এর আগেই আপনি চলে এলেন।
আর কথা বাড়ায় না চিত্রলেখা। সময় নষ্ট না করে উপরে উঠে যায়। হঠাৎ রওনকের ফ্লোর পরিবর্তন করার কারণ কি হতে পারে তা ভাবায় তাকে। তবে কারণ যাই হয়ে থাকুক না কেনো চিত্রলেখার জন্য ভালোই হয়েছে। এখন আর কষ্ট করে এত্তগুলো সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে না তাকে। তবে চিত্রলেখার অবচেতন মন তাকে এটাও জানায় কোনোভাবে সে নিজেই ফ্লোর পরিবর্তনের কারণ নয় তো? এমন কি হতে পারে তার জন্যই রওনক উপর থেকে নিচে নেমে এসেছে? তার ফোবিয়ার কথা জানতে পেরে। এসব ভাবতে ভাবতেই তিন তলায় নতুন অফিসে এসে পৌঁছায় চিত্রলেখা।
চলবে…
#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)
রওনক কেবিনে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই একবার নক করে ট্রে হাতে ভেতরে প্রবেশ করে চিত্রলেখা। ওকে প্রবেশ করতে দেখে মোবাইলে কিছু দেখতে ব্যস্ত রওনক একবার চোখ তুলে তাকায়। তারপর আবার নিজ কাজে মনোযোগ দেয়। চিত্রলেখা ট্রে থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি, এক কাপ চা ও একটা বাটি নামিয়ে রেখে ট্রে নিয়ে ফিরে যেতে নিলেই বাঁধা দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,
-এটা কি?
দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা বলে,
-পায়েস।
-পায়েস কি উপলক্ষে?
আমতা আমতা করে চিত্রলেখা। ইতস্তত করে বলে,
-না মানে সেদিন আপনি এমন সময় বাসায় গিয়েছিলেন যে দুপুরের রান্না সেরে আমি আর সময় পাইনি যে আপনার জন্য মিষ্টি কিছু বানাবো। আমার মা সবসময় বলতো শুনেছি অতিথিকে কখনো মিষ্টিমুখ না করিয়ে বিদায় দিতে নেই। অথচ আপনাকে মিষ্টিমুখ না করিয়েই বিদায় জানাতে হয়েছিল। সেদিন পারিনি তাই আজ বানিয়ে নিয়ে এলাম। বাকিটুকু আর বাকি রাখলাম না।
-কিন্তু এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি তো খাওয়া দাওয়া করতে যাইনি সেদিন। তাছাড়া আমি কোনো ধরনের মিষ্টি খাবার খাই না। আমার জন্য অযথাই কেউ ব্যস্ত হোক সেটা আমার পছন্দ নয়।
এত শক্ত কথা আশা করেনি তাই রওনকের বলা কথা শুনে তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার মুখটা চুপসে পানি হয়ে যায়। এমনিতেই ইতস্তত লাগছিল বেচারীর এখন আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কি করবে দ্রুত চিন্তা করে হাত বাড়িয়ে পায়েসের বাটিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কদম বাড়ায়। রওনক হাত থেকে ফোনটা নামিয়ে রেখে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সবেই চিত্রলেখা কেবিনের দরজার নবে হাত রেখেছে তখনই সে পেছন থেকে ডেকে বলে,
-দাঁড়াও চিত্রলেখা।
ওমনি আবার দাঁড়িয়ে পরে চিত্রলেখা। কোনো অজ্ঞাত কারণে চোখ টলমল করছে ওর। দাঁড়িয়ে পড়লেও পেছন ফিরে রওনকের দিকে তাকায় না। মাথা নিচু করেই রাখে। লজ্জা লাগছে এভাবে অনুমতি ছাড়া কিছু বানিয়ে আনা একদম উচিত হয়নি। এটা অনধিকারচর্চা হয়ে গেল। কখনো চিত্রলেখা এই ধরনের আহাম্মকি কারবার করেনি। আজ কঠিন একটা ভুল হয়ে গেল ওর। হয়ত চারুর বলা কথায় অবচেতন মনই ওকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে, অন্যথায় চিত্রলেখা এমন নয়। রওনক চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। যদিও রওনক চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু ও বেচারী আজ ফ্লোর থেকে চোখ না তুলার পন করেছে মনে মনে। সামনের দিকে হাত পেতে রওনক বলে,
-বাটিটা দাও তো দেখি।
আচমকাই মুখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা। ওমনি চোখে টলমল করা পানি এক চোখ গলে বেরিয়ে গেল হুড়মুড়িয়ে। চিত্রলেখার গালে চোখ বেয়ে পরা পানি দেখে বুকের ভেতর অদৃশ্য কিছু নিজের অনুভূতির জানান দেয় রওনককে। ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে। বাম হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার ডান গাল বেয়ে পরা পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো?
মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক জিজ্ঞেস করে,
-তাহলে কাঁদছো কেনো?
-কাঁদছি না, চোখে হয়ত কিছু গিয়েছে তাই…
এবারে আগের চাইতে আরও বেশি ব্যস্ত হয় রওনক। এক কদম কাছাকাছি এগিয়ে যায় সে। চিত্রলেখার গাল হাতে স্পর্শ করে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চোখে ফু দিয়ে দেয়, কিছু গিয়েছে কিনা দেখার চেষ্টা করে। রওনকের দেয়া ফু চিত্রলেখার চোখ, গাল স্পর্শ করতেই বেচারীর বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় ওঠে। শরীর অবস লাগে। মনে হয় এই বুঝি এক্ষুনি মাথা চক্কর দিয়ে মাটিতে লুটিরে পরবে সে। বার দুই/তিনেক চিত্রলেখার চোখে ফু দিয়ে রওনক ওর গাল স্পর্শ করে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
-এখন ঠিক লাগছে কি?
আবারও মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক আরও জিজ্ঞেস করে,
-সিওর? তুমি আমার সঙ্গে বাথরুমে এসো চোখে পানি দিয়ে দেই।
রওনককে এতখানি ব্যস্ত হতে দেখে তৎক্ষনাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,
-এখন ঠিক আছি। পানি দেয়া লাগবে না।
-চোখটা লাল হয়ে আছে একটু পানি দিলে ভালো লাগবে।
-আমি বাইরে গিয়ে দিয়ে নিবো।
রওনক ছাড়তে চায় না তবুও আর জোর করে না। চিত্রলেখার হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে এক চামচ মুখে দিয়ে বলে,
-চমৎকার হয়েছে।
-কিন্তু মিষ্টি বেশি হয়েছে। আর আপনি মিষ্টি খান না।
-ইটস ওকে, একদিন এতটুকু মিষ্টি খেলে আমি ম রে যাবো না।
চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। রওনককে ওখানে রেখেই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। চিত্রলেখা বেরিয়ে যেতেই পায়েসের বাটি সমেত চেয়ার ফিরে আসে সে। বাটিটা নামিয়ে রেখে আবার মোবাইলটা হাতে নেয়। অফিসে আসতে না আসতেই তার ফোনে একটা ডকুমেন্ট এসেছে। সেই ফাইলটাই দেখছি রওনক তখন। ফাইলটা দেখে তার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। সেই বিগড়ে যাওয়া মেজাজের বিরক্তি নিজের অজানতে চিত্রলেখার উপরেই ঝেড়ে ফেলেছে। ভাগ্যিস তৎক্ষনাৎই সামলে নিতে পেরেছে।
রিপা সামনে এসে দাঁড়াতেই লিখন জিজ্ঞেস করে,
-এত দেরি করলা কেন? কখন থেকে ওয়েট করতেছি জানো না?
-জানি তো।
-তাহলে?
-মাথা বিগড়েছিল। গরম মাথায় তোমার সামনে আসতে মন চাইতেছিল না তাই মাথায় এত্তগুলা পানি দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে তারপর বের হলাম।
-বাহ! আর এদিকে রোদের মধ্যে দাঁড়ায় থেকে আমার যে চান্দি গরম হয়ে গেল এটার কি হবে?
-তোমার চান্দি ঠান্ডা করার ঔষধ আছে আমার কাছে?
-কি?
-আগে একটা রিকশা ডাকো তারপর বলতেছি কি।
লিখন দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে দু’জনে চেপে বসতেই রিপা নিজের ব্যগ থেকে একটা বক্স বের করে এগিয়ে দেয়। তা দেখে লিখন বলে,
-বিরিয়ানি রান্না করছো?
-না, আব্বু কাচ্চি নিয়ে আসছিল সুলতানের। জানোই তো আব্বু কিছু আনলে এত বেশি আনে যা বলার বাহিরে। আমরা খেয়েও অর্ধেক শেষ করতে পারিনি। সেখান থেকেই তোমার জন্য গরম করে নিয়ে আসছি। তোমার তো এসব বিরিয়ানি, কাচ্চি বেশি পছন্দ। আলুও এনেছি বেশি করে।
-চামচ আনো নাই?
ফিক করে হেসে ফেলে রিপা। হেসে নিয়ে ব্যাগ থেকে একটা চামচ বের করে দিতেই লিখন আর সময় অপচয় না করে খাওয়া শুরু করে। খেতে খেতে লিখন জিজ্ঞেস করে,
-হঠাৎ তোমার মাথা গরম কেন? তুমি তো সহজে রাগ হও না কখনো।
-রাগ হই না কিন্তু চোখের সামনে অন্যায় দেখলে রাগ লাগে আমার।
-কে আবার কি অন্যায় করলো?
ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিপা। সকাল সকাল বোনের সাথে ঝামেলা হয়েছে ওর। নতুন কোনো বিষয়ে নয়। সেই রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়েই। রিপাও ছাড়েনি উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সাবা ছোট বোনের ঠাস ঠাস করে বলা উচিত কথা হজম করতে না পেরে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছে। এনিয়েই দুই বোনের মধ্যে সকাল বেলায় বাদানুবাদ হয়েছে।
-কিছু না তুমি খাও। ঠান্ডা হয়ে গেলে মজা পাবা না।
লিখনও আর ঘাটে না। ও ভালো করেই জানে রিপার যেটা বলার সেটা সে নিজে থেকেই বলবে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। আরও কয়েক চামচ খাওয়ার পর রিপা জিজ্ঞেস করে,
-কাল থেকে তো তোমার আইএলটিএস এর ক্লাস শুরু, তাই না?
-হু।
-কোনটা ছাড়বা কিছু ভাবছো?
এই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই চামচটা নামিয়ে রাখে লিখন। রিপা জবাবের আশায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভ্রু নাচিয়ে তাগাদা দেয় জবাব দিতে। শীতল কন্ঠে লিখন বলে,
-ভাবছি।
-ভাবছি মানে কি? কাল থেকে তোমার ক্লাস শুরু আর তুমি এখনো ভাবছো? ফোনে না বললা দুই ভাইবোনকে যে পড়াও কি যেন নাম মেয়েটার! ওহ বৃষ্টি হ্যাঁ ওদের বাদ দিয়ে দিবা বললা না।
-ভাবছিলাম তো আন্টিকে বলবো ওদের আর পড়াতে পারব না। কিন্তু…
-আবার কিন্তু কি? টিউশনি একটা তোমাকে বাদ দিতেই হবে লিখন। নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে হবে।
-সেটা তো বুঝতেছি কিন্তু ওদের কীভাবে বাদ দেই বলো। আন্টি অনেক স্নেহ করে আমাকে। তাছাড়া বৃষ্টির সামনে পরীক্ষা।
-সিলেবাস নাকি শেষ করে ফেলছো। তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না।
-পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত সমস্যার শেষ নাই রিপা। পড়ালেখা কি আর এতই সহজ জিনিস। পড়লাম আর হয়ে গেল? পড়তে পড়তে জান জীবন বের হয়ে যায় তাও কতমানুষ কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট করতে পারে না। সেজন্য প্রস্তুতি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিতে হয়।
সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রিপা বলে,
-এক কাজ করো।
-কি কাজ?
-তোমার সার্কেলের কাউকে দিয়ে দাও পড়াক। পরে পরীক্ষার সময় লাগলে তুমিও দেখায় দিও। এমনিও মেয়েটার বোর্ড পরীক্ষা হয়ে গেলে তখন তো তুমি আর পড়াবা না। ভর্তি কোচিংয়েই যাবে। তুমি নাহয় কয়মাস আগে থেকেই বাদ দিলা। আপাতত পরিচিত ভালো কাউকে দিয়ে দাও পড়াক তোমার জায়গায়।
-এভাবে হয় না রিপা।
-কেন হয় না?
-তুমি বলতেছো তাই তোমার কাছে পানির মতো সহজ লাগতেছে। বিষয়টা এতখানিও সহজ না। ওর বাবা মা আমাকে ভরসা, বিশ্বাস করে। অনেক বছর ধরে পড়াই বলে নিজের ছেলের মতো আদর-স্নেহ করে আমাকে। একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। এমন হুট করে ছেড়ে দিলে উনারা মনে কষ্ট পাবে। বৃষ্টিও কষ্ট পাইতে পারে। সামনে ওর পরীক্ষা এখন মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমাকে ওর প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
-লিখন! তুমি এমন ভাবে বলতেছো যেন মেয়েটা তোমার…
-রিপা প্লিজ এমন কিছু বইলো না যেটা অশোভন শুনায়। বৃষ্টি আমার ছাত্রী। দুই চারদিন ধরে ওকে আমি পড়াই না। অনেক বছরের সম্পর্ক আমাদের। খুব ভালো, সুন্দর ও অনেস্ট একটা সম্পর্ক। কোনো আজাইরা খাতির না।
রিপা ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে,
-তাহলে অন্য দুইটার একটা ছাড়ো।
-ওগুলা ছাড়া যাবে না। দুইটারই এসএসসি পরীক্ষা।
-তাহলে অপশন এই একটাই। আর তুমি এটাই ছাড়তেছো ফাইনাল। কীভাবে কি করবা আমি এত কিছু জানি না। আজকেই না করে দিবা। বলবা তুমি কাল থেকে আর পড়াতে পারবা না। নিজের সমস্যার কথা ভেঙে বলবা। যেহেতু তোমাকে অনেক স্নেহ করেন, অনেকদিনের সম্পর্ক নিশ্চয়ই উনারা বুঝবেন তোমার বিষয়টা।
মুখটা কালো হয়ে যায় লিখনের। রিপা তাগাদা দিয়ে বলে,
-বলবা তো?
-আর তো অপশন নাই, বলতেই হবে।
-গুড, আজকেই বাদ দিয়ে আমাকে জানাবা। আমি কিন্তু আর কোনো বাহানা শুনবো না বলে রাখছি।
এবারে আর মুখে কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাকায় লিখন। মনে মনে সে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত। বৃষ্টির মাকে কীভাবে বলবে ছেড়ে দেয়ার কথা সেটাই মাথায় আসে না ওর। কিন্তু একটা না একটা উপায় তো করতেই হবে কিছু করার নেই। এখন সময় হয়েছে লিখনের সব কিছু ছাপিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার, নিজের জন্য কিছু করার। কিন্তু তবুও মন সায় দেয় না বৃষ্টিকে ছেড়ে দিতে। মেয়েটা হয়ত দিশেহারা হয়ে যাবে এমন কথা শুনলে। বৃষ্টির কথা ভেবেই বেশি মন কেমন করছে লিখনের। মন বলছে সে পারবে না ছাড়তে। তার দ্বারা হবে না।
চলবে…